আলকুরআন : নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনন্য মুজেযা ও নবুওতের প্রমাণ – হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ শফী (রহঃ) [১ম পর্ব]

وَ اِنْ كُنْتُمْ فِیْ رَیْبٍ مِّمَّا نَزَّلْنَا عَلٰی عَبْدِنَا فَاْتُوْا بِسُوْرَةٍ مِّنْ مِّثْلِهٖ  وَ ادْعُوْا شُهَدَآءَكُمْ مِّنْ دُوْنِ اللهِ اِنْ كُنْتُمْ صٰدِقِیْنَ . فَاِنْ لَّمْ تَفْعَلُوْا وَ لَنْ تَفْعَلُوْا فَاتَّقُوا النَّارَ الَّتِیْ وَ قُوْدُهَا النَّاسُ وَ الْحِجَارَةُ اُعِدَّتْ لِلْكٰفِرِیْنَ.

তোমরা যদি এ কুরআন সম্পর্কে বিন্দুমাত্র সন্দেহে থাক, যা আমি আমার বান্দা (মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর প্রতি নাযিল করেছি, তবে তোমরা এর মত কোনো একটি সূরা বানিয়ে আন। আর সত্যবাদী হলে তোমরা আল্লাহ ছাড়া নিজেদের সাহায্যকারীদের ডেকে নাও।

তারপরও যদি তোমরা এ কাজ করতে না পার, আর এ তো নিশ্চিত যে, তোমরা তা কখনো পারবে না, তাহলে ভয় কর সেই আগুনকে, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর। যাকে কাফেরদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। -সূরা বাকারা (২) : ২৩-২৪

তাফসীরের সারমর্ম

আমি আমার মনোনীত বান্দার প্রতি যে কিতাব নাযিল করেছি এ বিষয়ে যদি তোমাদের কোনো সন্দেহ থাকে, তবে তোমরা এর মতো করে ছোট্ট একটি অংশ রচনা করে দেখাও। কারণ আরবী ভাষাজ্ঞান তোমাদেরও রয়েছে। এর গদ্য ও কাব্য চর্চায় তোমরা সুদক্ষ, সিদ্ধহস্ত। পয়গম্বর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো এসবের চর্চাও করেননি।

তা সত্ত্বেও যদি তোমরা কুরআনের একটি ছোট্ট অংশেরও উদাহরণ রচনা করে দিতে অক্ষম হও, তবে ইনসাফের বিবেচনায় অনিবার্যভাবে প্রমাণ হবে যে, এ কিতাব আল্লাহর পক্ষ থেকে মুজেযা। (আর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর নবী।) আর আল্লাহ ছাড়া তোমাদের (পছন্দনীয়) সাহায্যকারীদের এ কাজে ডেকে নাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক।

তারপরও যদি তোমরা এ কাজে অপারগ হও, আর নিশ্চিত যে কিয়ামত পর্যন্ত চেষ্টা করলেও সক্ষম হবে না। তবে দোযখের ব্যপারে সতর্ক থেকো, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর। কাফেরদের জন্য একে প্রস্তুত করা হয়েছে।

আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়

এগুলো সূরা বাকারার তেইশ ও চব্বিশতম আয়াত। ইতিপূর্বের দুই আয়াতে তাওহীদ ও একত্ববাদের প্রমাণনির্ভর আলোচনা ছিল। আলোচ্য আয়াতদুটিতে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রেসালাত ও সত্যবাদিতার প্রমাণ পেশ করা হয়েছে।

কুরআন যেই হেদায়েতের কথা বলে, তার বুনিয়াদী বিষয় দুটি : ১. তাওহীদ ২. রেসালাত। ইতিপূর্বের আয়াতদুটিতে আল্লাহ তাআলার কিছু বিশেষ কর্মের উল্লেখ করে তাওহীদের সত্যতা প্রমাণ করা হয়েছে। আর আলোচ্য দুই আয়াতে আল্লাহ তাআলার কালাম পেশ করে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রেসালাত ও সত্যবাদিতা সাব্যস্ত করা হয়েছে।

বিষয়দুটি একই পদ্ধতিতে প্রমাণ করা হয়েছে। পূর্বের দুই আয়াতে কিছু এমন কাজের উল্লেখ ছিল, যা আল্লাহ ছাড়া কেউ করতে পারে না। যেমন আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি, আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ এবং পানির মাধ্যমে ফল-ফলাদি উদ্গত করা। এ আলোচনার মূলকথা ছিল, যেহেতু এসব কাজ আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ করতে পারে না অতএব ইবাদতের উপযুক্তও তিনি ছাড়া কেউ হতে পারে না।

আর আলোচ্য আয়াতদুটিতে এমন এক বাণী পেশ করা হয়েছে, যা মহান আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো হওয়া সম্ভব নয়। কোনো একক ব্যক্তি বা জনগোষ্ঠী এর সমতুল্য রচনা করতে অক্ষম। যেমনিভাবে আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি, বৃষ্টি বর্ষণ এবং এ থেকে ফল-ফলাদি উদ্গত করতে মানবীয় শক্তির অপারগতা একথা প্রমাণ করে যে, এ কাজগুলো কেবলমাত্র আল্লাহ তাআলারই। তেমনি আল্লাহর কালামের নযির পেশ করতে গোটা সৃষ্টিজগতের অক্ষমতাও  সাব্যস্ত করে যে,  এটি একমাত্র আল্লাহর কালাম। কোনো মাখলুকের নয়।

আলোচ্য আয়াতে কুরআন গোটা বিশে^র মানুষকে সন্বোধন করে চ্যালেঞ্জ দিয়েছে যে, তোমরা যদি এ কালামকে আল্লাহর কালাম না মেনে মানবরচিত কালাম ভেবে থাক, তবে তোমরাও তো মানুষ। তোমাদেরও এরূপ বাণী রচনার দক্ষতা থাকবে, তোমরা এ পুরো কালাম না হোক, অন্তত এর ক্ষুদ্র কোনো ছত্রের মতো রচনা করে দেখাও।

আর হাঁ, তোমাদেরকে আরো সুযোগ  দেওয়া হচ্ছে, তোমরা একা সক্ষম না হলে পুরো পৃথিবী থেকে নিজেদের সহায়তাকারী ও মদদদাতাদের আমন্ত্রণ জানাতে পার। এরপর একটি বৈশি^ক সম্মেলনের আয়োজন করে এ কুরআনের ছোট্ট একটি সূরার সমকক্ষ সূরা রচনা করে ফেল।

এখানেই শেষ নয়, পরবর্তী আয়াতে কুরআন তাদের আত্মসম্মানে এ বলে আঘাত হেনেছে যে, তোমরা কখনোই এরূপ সূরা রচনা করতে পারবে না। এরপর আযাবের ভয় দেখিয়েছে যে, তোমরা যখন এরূপ কালাম রচনা করতে নিজেদের অক্ষমতা উপলব্ধি করছ, যা স্পষ্ট প্রমাণ করে যে, এটি কোনো মানবরচিত কালাম নয়; বরং এমন এক সত্তার কালাম, যিনি সকল সৃষ্টির ঊর্ধ্বে। যিনি সুউচ্চ, সুমহান! যাঁর অপার কুদরত সবার উপর পরিব্যপ্ত।

এরপরও এ বিষয়ে ঈমান না আনা প্রকারান্তরে নিজেই জাহান্নামে নিজের বাসস্থান বানানোর নামান্তর। এ পরিণতি থেকে নিজেদের রক্ষা কর।

মোটকথা, এ দুটি আয়াতে কুরআনে কারীমকে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সর্বাপেক্ষা বড় মুজেযা অভিহিত করে তাঁর রেসালাত ও সত্যবাদিতার দলীল হিসেবে পেশ করা হয়েছে।

নবীজীর মুজেযা তো অসংখ্য। এর সবগুলিই অত্যন্ত বিস্ময়কর। কিন্তু এখানে এগুলোর মধ্য থেকে তাঁর ইলমী ও বিদ্যাগত মুজেযা তথা কুরআনকে এককভাবে উল্লেখ করে ইঙ্গিতে বলে দেওয়া হয়েছে যে, তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ মুজেযা হচ্ছে কুরআন।

আর এ মুজেযা অন্যান্য নবীগণের সাধারণ মুজেযা অপেক্ষা স্বতন্ত্র। কারণ সাধারণত আল্লাহ তাআলা নবী-রাসূল প্রেরণের পাশাপাশি নিজ মহান কুদরতে কিছু মুজেযাও প্রকাশ করে থাকেন।

তবে এসব মুজেযা সেই রাসূলগণের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। আর তাঁদের জীবন পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু কুরআনে কারীম এমন এক মুজেযা, যা কিয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী থাকবে।

 

অলৌকিক কুরআনের ব্যাখ্যা

এ সংক্ষিপ্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আপনাকে এ বিষয়টি জানতে হবে যে, পবিত্র কুরআনকে কিসের ভিত্তিতে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুজেযা অভিহিত করা হয়? এর অলৌকিক দিকগুলো কী কী? কেন সারা দুনিয়া এর নজির পেশ করতে অপারগ?

দ্বিতীয়ত সুদীর্ঘ দেড় হাজার বছরের ইতিহাসে কুরআনের শক্তিশালী চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও কেউ পুরো কুরআন বা তার কোনো ছত্রের সমতুল্য রচনা করতে পারেনি।

মুসলমানদের এ দাবিটি ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে কতটুকু নির্ভরযোগ্য? দুটো বিষয়ই দীর্ঘ আলোচনা ও ব্যাখ্যা সাপেক্ষ।

কুরআন মুজেযা হওয়ার কারণসমূহ

প্রথম কথা হচ্ছে, কুরআনকে মুজেযা কেন বলা হয়? সেই কারণগুলো কী যার দরুন গোটা পৃথিবী এর নজির পেশ করতে অপারগ?

এ বিষয়ে প্রাচীনকাল থেকেই আলেমগণ বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন। প্রত্যেক মুফাসসির স্ব স্ব পদ্ধতিতে বিষয়টির বিবরণ দিয়েছেন। এখানে সংক্ষেপে কিছু জরুরি বিষয় তুলে ধরছি।

সর্বপ্রথম ভাবার বিষয় হল, এ অনন্য, অনুপম, বিস্ময়কর ও সর্বজ্ঞানের আধার গ্রন্থটি কোন জনপদে, কোন পরিবেশে এবং কার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে?

সেখানকার সমাজে কি জ্ঞান-বিজ্ঞানের এমন কিছু উপকরণ ছিল, যা দ্বারা এরূপ অতুলনীয় মহাগ্রন্থ রচনা করা সম্ভব? যা একই সঙ্গে পূর্বাপর সকল ইলমের ধারক হবে? ব্যক্তি ও সামষ্টিক জীবনের সকল অঙ্গনে সর্বোত্তম নির্দেশনা দিতে সক্ষম? যেখানে মানুষের দেহ-আত্মা উভয় দিকের সুষ্ঠু বিকাশের পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা থাকবে? এবং পারিবারিক নিয়ম-শৃঙ্খলা থেকে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা অবধি সর্বক্ষেত্রে, সকল যুগে, সমভাবে প্রযোজ্য আদর্শ গঠনতন্ত্র ও নীতিমালা উল্লেখ থাকবে?

যে ভূখন্ডে এবং যে মহান ব্যক্তিত্বের প্রতি এ পবিত্র গ্রন্থ অবতীর্ণ হয়েছে তার ভৌগলিক প্রেক্ষাপট ও ঐতিহাসিক পটভূমি জানতে গেলে আপনার সম্মুখে দেড় হাজার বছর পূর্বের এক প্রাচীন জনপদের কথা আসবে।

চারিদিকে ঊষর মরুভূমি। তার মাঝে রুক্ষ, শুষ্ক ও উষ্ণপ্রধান একটি অঞ্চল। যার নাম ‘মক্কা’। এটি কৃষিপ্রধান বা শিল্পোন্নত কোনো দেশ নয়। এর আবহাওয়াও অতটা মনোরম নয়, যা বিদেশী পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে পারে। এখানে যাতায়াতের রাস্তাঘাটও দুর্গম, অনিরাপদ। এটি ছিল অবশিষ্ট দুনিয়া থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন অখ্যাত এক মরুদ্বীপ।

যেখানে শুষ্ক পাহাড়-পর্বত আর উত্তপ্ত বালুকাময় প্রান্তর ছাড়া কিছুই দেখা যেত না। দূর দূরান্ত পর্যন্ত কোথাও তেমন কোনো জনবসতি, ফসলক্ষেত বা গাছপালাও চোখে পড়ত না।

এ বিশাল ভূখন্ডে বড় কোনো শহরও ছিল না। স্থানে স্থানে কিছু ছোট ছোট গ্রাম। যেখানে উট বকরি লালন-পালন করে কিছু মানুষ জীবিকা নির্বাহ করত। এর ছোটখাটো গ্রাম তো দূরের কথা, নামে মাত্র যে কয়টি শহর ছিল তাতেও কোনো ধরনের লেখাপড়ার চর্চা হত না।

তবে কুদরতিভাবে এখানকার বাসিন্দাদেরকে মহান আল্লাহ জন্মসূত্রে ভাষা-সাহিত্যের একটি সমৃদ্ধ জ্ঞান দান করেছিলেন। যে বিদ্যায় তারা পৃথিবীতে অনন্য, অসাধারণ। ভাষার গদ্য ও পদ্য সাহিত্যে তাদের এমন আশ্চর্য প্রতিভা যে, তারা যখন মুখ খুলে খোদাপ্রদত্ত অপূর্ব বাকশিল্প প্রদর্শন করত তখন যেন আকাশের মেঘ গর্জন আর বৃষ্টি বর্ষণের অসাধারণ আবহ সৃষ্টি হত।

তাদের ছোট ছোট-ছেলে মেয়েরাও এমন বিশুদ্ধ ও অলংকারপূর্ণ কবিতা আবৃত্তি করত, যার সৃষ্টিশীলতা ও সাহিত্যসৌন্দর্যে যে কোনো সাহিত্যানুরাগী হতবাক হয়ে পড়বে। কিন্তু এসব ছিল তাদের খোদাপ্রদত্ত স্বভাবজাত প্রতিভা, যা শিখতে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজন হত না।

এককথায় না সেখানে শিক্ষা-দীক্ষার কোনো উপকরণ ছিল, না তার বাসিন্দাদের এসবের প্রতি কোনো আকর্ষণ ছিল। যারা শহরে বসবাস করত তারা পেশায় ছিল ব্যবসায়ী। পণ্যসামগ্রির আমদানি-রপ্তানিই ছিল তাদের প্রধান কাজ।

এ দেশের প্রাচীন শহর মক্কার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে সেই মহৎ ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ঘটে, যাঁর উপর আসমানী ওহী মহাগ্রন্থ কুরআন নাযিল হয়। প্রসঙ্গত সেই মহামানবের অবস্থাও শুনে নিন।

জন্মের পূর্বেই তার বাবা মারা যান। এতিম হয়ে তিনি পৃথিবীতে আগমন করেন। মাত্র সাত বছর বয়সে স্নেহময়ী মাতাও চলে যান দুনিয়া ছেড়ে। মায়ের স্নেহ-মমতার কোলে বড় হওয়ার সুযোগও তিনি পাননি।

জীবনের এ সূচনালগ্নে যখন পড়াশুনার প্রকৃত সময়, তখন যদি মক্কায় কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকত তবুও তাঁর জন্য সেখানে জ্ঞানার্জন করা সম্ভব হত না। আর পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, সেখানে তখন শিক্ষা-দীক্ষার প্রতি কারো উৎসাহই  ছিল না।

এজন্যই সমগ্র আরবজাতিকে ‘উম্মী’ বা ‘নিরক্ষর’ জাতি বলা হত। পবিত্র কুরআনেও তাদেরকে ‘উম্মী জাতি’ বলা হয়েছে। ফলে অনিবার্যভাবে সেই মহামানবও সর্বপ্রকার শিক্ষা-দীক্ষা থেকে বঞ্চিত রয়ে যান।

সেখানে এমন কোনো জ্ঞানীজনও ছিলেন না, যার সংস্পর্শে তিনি কুরআনের ইলম ও জ্ঞানের কোনো কিছু অর্জন করতে পারতেন। আসলে কুদরত এক অসাধারণ মুজেযা প্রদর্শনের জন্য অপেক্ষমান ছিল।

তাই নবীজীর জন্য এমন বিশেষ অবস্থা সৃষ্টি হল যে, ন্যূনতম অক্ষরজ্ঞান, যা সকল অঞ্চলের মানুষ কোনো না কোনোভাবে রপ্ত করেই নেয়, সেটাও তার পক্ষে হল না। তিনি সম্পূর্ণ নিরক্ষর থেকে গেলেন। নিজের নামটি পর্যন্ত লিখতে পারতেন না।

তৎকালীন আরবদের নিজস্ব গদ্য ও পদ্যসাহিত্য জ্ঞান, যাকে উদ্দেশ্য করে বিশেষ বিশেষ উৎসব সভার আয়োজন হত; কাব্য প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হত, প্রত্যেকেই তাতে অংশগ্রহণের চেষ্টা করত, কিন্তু হযরতকে মহান আল্লাহ এমন অনন্য স্বভাবরুচি দান করেছিলেন যে, এসবের প্রতি তাঁর বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। কখনো তিনি একলাইন ছড়া বা কবিতা রচনার চেষ্টা করেননি। জীবনে এ ধরনের সভাতেও অংশ নেননি।

তবে সম্পূর্ণ নিরক্ষর হওয়া সত্ত্বেও বাল্যকাল থেকেই তার পবিত্র জীবনে শান্তশিষ্ট স্বভাব, উন্নত চরিত্র, অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা ও দূরদর্শিতার লক্ষণ, সততা ও বিশ্বস্ততার উৎকৃষ্ট গুণাবলি সর্বসম্মুখে নিত্য উদ্ভাসিত ছিল। ফলে আরবের প্রতাপশালী ও অহংকারী শীর্ষ নেতৃবর্গও তাকে শ্রদ্ধা করত। আর সমগ্র মক্কায় তাঁকে ‘আলআমীন’ তথা বিশ্বস্ত উপাধিতে স্মরণ করা হত।

এ সম্পূর্ণ উম্মী মানুষটি জীবনের চল্লিশটি বছর স্বগোত্রীয়দের মাঝে যাপন করলেন। কোথাও গিয়ে জ্ঞানার্জন করা তো দূরের কথা, কোনো ভিনদেশের সফরই তিনি করেননি। কেবলমাত্র কিছুদিনের জন্য সিরিয়াতে দু’বার বাণিজ্যিক সফরে গিয়েছেন। তাও এত অল্প ক’দিনের জন্য, যাতে কোনোরূপ শিক্ষালাভ করা মোটেই সম্ভব নয়।

ঠিক চল্লিশ বছর পর অপ্রত্যাশিতভাবে তার পবিত্র যবানে এক অলৌকিক বাণী আসতে আরম্ভ করল, যার নাম ‘কুরআন’। যা ভাষাগত বিশুদ্ধতা, অপূর্ব বাকশৈলী ও সাহিত্যগুণে এবং মর্মগত নানাবিধ জ্ঞান-বিজ্ঞানময়তায় অলৌকিক ও বিস্ময়কর। এটুকু ঘটনাই তো যে কোনো উদার ও নিরপেক্ষ মানুষের পক্ষে কুরআনকে অলৌকিক বিশ্বাস করার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু ঘটনা এখানেই শেষ নয়। কুরআন সমগ্র পৃথিবীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আহ্বান জানাল। তাকে আল্লাহর কালাম মেনে নিতে সন্দেহ থাকলে তার সমকক্ষ রচনা করার চ্যালেঞ্জ দিল।

লক্ষ্য করুন, একদিকে কুরআনের এ আহ্বান অন্যদিকে তাবৎ পৃথিবীর বিরোধী শক্তিগুলোর অবস্থা। যারা ইসলাম ও ইসলামের নবীকে পরাজিত করতে নিজেদের জান-মাল, ইজ্জত-সম্মান, সন্তান-সন্ততি সর্বস্ব নিয়োজিত করতে প্রস্তুত। অথচ কুরআনের কোনো ক্ষুদ্র সূরার সমকক্ষ সূরা রচনার সামান্য সাহসটুকু কেউ করেনি। একজন সম্পূর্ণ নিরক্ষর মানুষের মুখ থেকে এর উদ্ভব ও বহিঃপ্রকাশ ঘটা কোনো অলৌকিকতার বিশ্লেষণে না গিয়েও কুরআনের মুজেযা প্রমাণিত হবার পক্ষে কম নয়। বিষয়টি যে কেউ উপলব্ধি করতে সক্ষম।

কুরআন মুজেযা হওয়ার দ্বিতীয় কারণ

আপনারা জানেন, পবিত্র কুরআনের শিক্ষা ও আদর্শ পৃথিবীর সকলের জন্য অবতীর্ণ হয়েছে। কিন্তু এর প্রথম ও সরাসরি সম্বোধনের পাত্র ছিলেন আরবগণ। যাদের আর কোনো বিদ্যা না থাকতে পারে, কিন্তু সাহিত্য ও বাকচাতুর্য তাদের মজ্জাগত ও জন্মগত বৈশিষ্ট্য ছিল। এ বিষয়ে তারা পৃথিবীর অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী থেকে স্বতন্ত্র ছিলেন।

কুরআন এ দক্ষ লোকদেরকে সম্বোধন করে চ্যালেঞ্জ করছে যে, আমার আল্লাহর কালাম হওয়ার বিষয়ে তোমাদের সন্দেহ থাকলে তোমরা আমার কোনো একটি সূরার নমুনা তৈরি করে দেখাও।

কুরআনের এ চ্যালেঞ্জ যদি তার অর্থগত সৌন্দর্য, অভ্যন্তরীণ চমৎকারিত্ব তথা প্রজ্ঞাপূর্ণ নীতিমালা, জ্ঞানের মর্মকথা আর ইলমের অন্তর্নিহিত রহস্যের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকত তাহলে এ নিরক্ষর জাতির পক্ষে এর নজির পেশ করতে অপারগ হওয়া যুক্তিযুক্ত বলে বিবেচিত হত। কিন্তু কুরআন তো শুধু ভেতরগত সৌন্দর্যের বিষয়েই চ্যালেঞ্জ করেনি। বরং ভাষাসাহিত্য ও বাগ্মিতার ক্ষেত্রেও যথারীতি পুরো দুনিয়াকে আহ্বান জানিয়েছে। এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে পৃথিবীর অপরাপর জাতিগোষ্ঠী অপেক্ষা আরবরাই অধিক উপযুক্ত ছিল।

যদি এ কালাম আসলেই মানবীয় সাধ্যের অতীত কোনো সত্তার কালাম না হত তাহলে আরবী ভাষাবিদ ও কাব্যকুশলীদের জন্য তো একজন উম্মী লোকের কথার সমতুল্য বা তারচে উত্তম বাণী রচনা করা বিন্দু মাত্রও কঠিন ছিল না। আর দু-একজন মিলে কুলিয়ে না উঠতে পারলে কুরআন তো তাদেরকে জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের সহায়তা গ্রহণের সুযোগ দিয়ে রেখেছিল। কিন্তু কুরআনের এ উদাত্ত আহ্বান আর নানা রকম ভর্ৎসনা-তিরস্কার সত্ত্বেও আরবের সম্মানবোধ সম্পন্ন জাতি সম্পূর্ণ নিরুত্তর রইল। কয়েক লাইন নিয়েও তারা মোকাবেলায় আসেনি।

আরব সরদারগণ ইসলাম, কুরআন ও ইসলামের নবীকে পরাজিত ও সমূলে ধ্বংস করতে যেরূপ নিজেদের শক্তি-সামর্থ্য ব্যয় করে উঠে পড়ে লেগেছিল তা শিক্ষিত সমাজের কারো অজানা নয়।

প্রথমদিকে তারা নবীজী ও তার অল্প সংখ্যক সঙ্গীদেরকে অনেক অত্যাচার-নির্যাতন করে চলেছিল, যাতে তারা ইসলাম ত্যাগে বাধ্য হন। কিন্তু যখন দেখতে পেল, এ ‘নেশা’ তো দূর হবার নয়!’ তখন তোষামোদের আশ্রয় নিল।

আরবনেতা উতবা ইবনে রবীআ স্বজাতির প্রতিনিধি হয়ে রাসূলের দরবারে হাযির হল। যেন সমগ্র আরবের ক্ষমতা-কর্তৃত্ব, অর্থবিত্ত, আর সুন্দরী রমণীর মনভোলানো প্রলোভনে তাকে ইসলামপ্রচার থেকে ফিরিয়ে রাখতে পারে। উত্তরে রাসূল শুধু কুরআনের ক’খানি আয়াত তিলাওয়াত করে শুনিয়ে দিলেন।

এ কৌশলটিও যখন ব্যর্থ হল, তখন তারা সংঘর্ষ আর আক্রমণের পথকে বেছে নিল। মদীনায় হিজরতের পূর্বে ও পরে কোরাইশরা প্রিয়নবী ও মুসলমানদের মোকাবেলায় বহুবার জীবনের বাজি লাগান। জানমাল, ইজ্জত-আবরু, সন্তান সর্বস্ব বিসর্জন দিতে প্রস্তুত হয়ে গেল।

একটু ভাবুন, তারা এতসব করতে পেরেছে। অথচ কুরআনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে সামান্য কয়েকটি লাইন রচনা করার কেউ সাহস করেনি। আরবদের এমন নীরবতা আর অপারগতা কি এ কথার জ¦লন্ত প্রমাণ নয় যে, এটি মানবরচিত নয়; বরং মহান আল্লাহর কালাম। যার কোনো কর্ম ও বাণীর তুলনা শুধু মানুষ কেন, সকল সৃষ্টিরও সাধ্যের অতীত। আর আরবরা যে কুরআনের মোকাবেলায় শুধু নীরবই ছিল, তাই নয়, বরং নিজেদের একান্ত বৈঠকগুলোতে সকলে এর অতুলনীয় হওয়ার স্বীকারও করেছে। এদের অনেকে ইসলাম গ্রহণ করেছে। আর কেউ কেউ বংশীয় পূর্বপুরুষদের রীতিনীতি পালনের বাধ্যবাধকতা অথবা আবদে মানাফ বংশের প্রতি প্রতিহিংসা বশত স্বীকারোক্তি সত্ত্বেও ইসলাম থেকে বঞ্চিত থেকেছে। আরবের কোরাইশদের ইতিহাস এ জাতীয় ঘটনায় ভরপুর।

আরবরা যে এ কালামকে অতুলনীয় অসাধারণ মেনে নিয়েছিল এবং এর নজির পেশ করাকে নিজেদের অপমানিত হবার ভয়ে পরিত্যাগ করেছিল- এ বিষয়ে কিঞ্চিত ধারণা দেওয়ার উদ্দেশ্যে এখানে কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরছি :

প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও পবিত্র কুরআনের বিষয়টি যখন মক্কানগরের বাইরে মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল, এরই মধ্যে হজে¦র মৌসুমও এসে উপস্থিত হল, তখন মক্কার কোরাইশরা বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ল। তারা ভাবল, এখন সারা আরব থেকে মানুষ হজ¦ করতে আসবে। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ অপূর্ব বিস্ময়কর বাণী শুনলে তো তারা আকৃষ্ট হয়ে পড়বে। ইসলামও গ্রহণ করে ফেলার ভয় আছে।

বিষয়টির একটি সুরাহা ও সুষ্ঠু সমাধানের লক্ষ্যে কোরাইশরা এক জরুরি পরামর্শ বৈঠক আহ্বান করল। বৈঠকে শীর্ষ আরব গোত্রপ্রধানগণ উপস্থিত ছিলেন। তাদের মধ্যে ওয়ালীদ বিন মুগীরা ছিল বয়সে সবচে প্রবীণ। যাকে সর্বাপেক্ষা বিচক্ষণ ও পাকাবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি গণ্য করা হত।

ওয়ালীদ বিন মুগীরা সবার উপস্থিতিতে এ প্রস্তাব পেশ করল যে, এখন বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লোকজন এখানে আসবে। তারা  তোমাদের মুহাম্মাদের বিষয়টি সম্পর্কে জানে। অতএব তোমরা এ ব্যাপারে কোনো সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে একমত হও। উপস্থিত লোকেরা তখন বলল, তাহলে আপনিই কোনো সিদ্ধান্ত দিন। আমরা সেটাই পালন করব। ওলীদ বলল, তোমরাই বল, লোকদেরকে কী কথা বলা উচিত?

তখন কেউ কেউ এরূপ মত দিল যে, আমরা তাকে গণক অভিহিত করি। ওয়ালীদ বলল, সে তো গণক নয়। আমি জীবনে বহু গণক দেখেছি। সে মোটেও তাদের দলের নয়।

কেউ বলল, আমরা এ কথা বলতে পারি যে, মুহাম্মাদ একজন পাগল। (নাউযুবিল্লাহ) আর তার কথাগুলো পাগলের প্রলাপ। ওয়ালীদ বিন মুগীরা বলল, তোমরা কখনোই এরূপ কথা বলো না। কারণ, আমি অনেক পাগল দেখেছি। ওদের এলোমেলো ও আবোল তাবোল কথা শুনেছি। কিন্তু মুহাম্মাদের মধ্যে সেসবের লেশমাত্রও নেই।

এরপর কিছুলোক বলল, আচ্ছা, আমরা তাহলে লোকদেরকে এরূপ বলি যে, সে একজন কবি মানুষ। ওয়ালীদ এতেও বাধা দিয়ে বলল, সে কবিও নয়। কবিতা ও কাব্য সাহিত্যের সকল শাখায় আমার ব্যাপক অভিজ্ঞতা রয়েছে। তার কালাম কখনোই কবিতা নয়।

এ পর্যায়ে এসে কেউ কেউ বলল, তাহলে আমরা তাকে যাদুকর বলি। ওয়ালীদ বলল, সে যাদুকরও নয়। আমি যাদুকরদের এবং তাদের যাদুবিদ্যা দেখেছি। এখানে তাদের ঝাড়-ফুঁক বা তন্ত্র-মন্ত্রের কিছুই নেই।

এবার কওমের লোকেরা তাকে জিজ্ঞাসা করল, তাহলে আপনিই বলুন, আমরা কী করব? মুহাম্মাদের ব্যাপারে মানুষকে কী বলব? ওয়ালীদ বলল, আল্লাহর কসম! (মুহাম্মাদের) এ কালামে এক অপূর্ব মাধুর্য এবং বিস্ময়কর দীপ্তি রয়েছে। তোমরা তার কালাম সম্পর্কে এই মন্তব্যগুলোর যেটিই প্রচার করবে, তার অসারতা জনসম্মুখে সহজেই ধরা পড়ে যাবে। এজন্য আমার মতে সবচেয়ে নিরাপদ হচ্ছে, তাকে তোমরা বল যাদুকর। যে তার যাদুবলে পিতা-পুত্র আর স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিচ্ছেদ সৃষ্টি করে।

উপস্থিত সকলে একবাক্যে তার এ সিদ্ধান্তে সন্তুষ্টি প্রকাশ করল। আর সকলকে তার কথাটি বলতে শুরু করল। কিন্তু আল্লাহর জ¦ালানো এ আলোকপ্রদীপ কারো ফুঁ-তে কী করে নির্বাপিত হবে? আরবের বিভিন্ন অঞ্চলের লোকজন মক্কায় আসল। কুরআন শুনল। আর দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করে নিল। দিকে দিকে ইসলাম ছড়িয়ে পড়ল। -দালাইলুন নবুওয়াহ, বায়হাকী ২/১৯৯২০১; দালাইলুন নবুওয়াহ, আবু নাআঈম ১/৩০১-৩০৩; আলখায়েসুল কুবরা, সুয়ূতী ১/১৮৮-১৮৯

এমনিভাবে একজন কোরাইশ নেতা নযর বিন হারেস একবার নিজ গোত্রকে উদ্দেশ্য করে বলেছিল, হে কোরাইশের জনগণ! আজ তোমরা এমন এক বিপজ্জনক পরিস্থিতির শিকার, যার মুখোমুখি ইতিপূর্বে কখনো হওনি। মুহাম্মাদ তোমাদেরই বংশের একজন যুবক ছিল। তোমরা সকলে তার স্বভাব ও চরিত্রগুণে মুগ্ধ ছিলে। তাকে আপন গোত্রে সর্বাপেক্ষা সৎ ও বিশ্বস্ত ব্যক্তি গণ্য করতে এবং মুখে মুখেও একথা বলতে। আজ যখন তার চুলে বার্ধক্যের আলামত দেখা দিতে শুরু করেছে, আর তিনি এক অসাধারণ কালাম আল্লাহর পক্ষ থেকে পেশ করছেন তখন তোমরা তাকে যাদুকর বলতে আরম্ভ করেছ।

আল্লাহর কসম! তিনি যাদুকর নন। আমি বহু যাদুকর দেখেছি। তাদের চালচলন, কথাবার্তা, রীতি-রেওয়াজ সবই জেনেছি এবং বুঝেছি। তিনি মোটেই এদের মতো নন।

কখনো তোমরা তাকে গণক বলছ। খোদর কসম! তিনি গণকও নন। আমি অনেক গণক দেখেছি। তাদের কথা শুনেছি। তাঁর কালামের সঙ্গে সেসবের কোনো মিল নেই।

কখনো তাকে তোমরা কবি বলছ। আল্লাহর শপথ! তিনি কবিও নন। আমি নিজে কবিতা ও কাব্যকুশলতার যাবতীয় বিদ্যা অর্জন করেছি। এর নাড়ি-নক্ষত্র আমার জানা। খ্যাতনামা কবিদের পদ্যচরণ আমার মুখস্থ। (মুহাম্মাদের বাণী এসবের সম্পূর্ণ বিপরীত।)

আবার কখনো তোমরা তাকে পাগল বল। আল্লাহর কসম! তিনি পাগলও নন। আমি অনেক পাগল দেখেছি। ওদের এলোমেলো আবোল-তাবোল প্রলাপ শুনেছি। (এখানে এসবের কিছুই নেই।) হে আমার গোত্রের লোকেরা! তোমরা ব্যাপারটি উদারমনে নিরপেক্ষভাবে ভেবে দেখ। কারণ আল্লাহর কসম, তোমরা এক গুরুতর সমস্যার সম্মুখীন হয়েছ। -দালাইল, বায়হাকী ২/২০১-২০২; সীরাতে ইবনে হিশাম ১/৩২৭-৩২৮; আলখাসায়েস, সুয়ূতী ১/১৯

সাহাবী হযরত আবু যর গিফারী রা. বলেন, আমার ভাই উনায়েস একবার পবিত্র মক্কা নগরীতে যায়। সেখান থেকে ফিরে এসে আমাকে সে বলে যে, মক্কায় একজন লোক আছেন। যিনি নিজেকে আল্লাহর প্রেরিত রাসূল বলে দাবি করেন।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তার ব্যাপারে সেখানকার অধিবাসীদের মতামত কী? ভাই বলল, কেউ তাকে কবি বলে। কেউ গণক বলে। আর কেউ বলে যাদুকর।

আমার ভাই উনায়েস নিজেই একজন ভালো কবি। (ভাগ্য গণনা ইত্যাদি বিষয়েও তার বেশ জানাশোনা ছিল।) সে আমাকে বলল, আমি যতদূর চিন্তা করেছি, লোকজনের সবগুলো মতই অবাস্তব, ত্রুটিপূর্ণ। তার কথাগুলো না কবিতা, না গণকের ভবিষ্যদ্বাণী, না পাগলের প্রলাপ; বরং আমার দৃষ্টিতে একে সত্যবাণী বলে মনে হয়েছে।

আবু যর রা. বলেন, ভাইয়ের কথাগুলো শুনে আমি মক্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা করি এবং মসজিদুল হারামে এসে আশ্রয় নেই। এখানে আমার ত্রিশদিন এভাবে অতিবাহিত হয় যে, একমাত্র যমযম কূপের পানি ছাড়া অন্য কোনো খাবার আমার ভাগ্যে জোটেনি। এ পুরো সময়ে না আমার খিদে পেয়েছে, না কোনো দুর্বলতা অনুভব করেছি।

নিজ গোত্রে ফিরে আসার পর তিনি লোকজনকে ইসলামের দাওয়াত দেন। এ দাওয়াতের ফলে তখনই তার গোত্রের অর্ধেক মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেন। আর বাকি অর্ধেক আল্লাহর নবীর মদীনায় আগমনের পর ইসলাম গ্রহণ করেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৪৭৩-২৪৭৪; খাসায়েস, সুয়ূতী ১/১৯৩

ইসলাম ও প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রধান শত্রু আবু জাহেল, আখনাস বিন শুরাইক প্রমুখও মানুষের চোখ ফাঁকি দিয়ে কুরআন তিলাওয়াত শুনত। কুরআনের বিস্ময়ভরা অপূর্ব ও অতুলনীয় সব ভাব-প্রবাহে প্রভাবান্বিত ও উদ্বেলিত হত।

আবু জাহেলকে যখন জিজ্ঞেস করা হল, মুহাম্মাদের এ বাণী সম্পর্কে তোমার মত কী? তখন সে উত্তর দিতে গিয়ে বলেছিল, বনু আবদে মানাফ এবং আমাদের গোত্রের মাঝে চিরকাল ধরে প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলে আসছে। তারা কোনো কাজে অগ্রসর হতে চাইলে আমরাও তাতে অগ্রসরতার স্বাক্ষর রাখি। আজ যখন আমরা উভয় গোত্র সমমর্যাদার অধিকারী তখন তারা এ কথা বলছে যে, আমাদের মাঝে একজন নবীর আবির্ভাব হয়েছে। যার প্রতি আসমানী ওহী অবতীর্ণ হয়। এমতাবস্থায় আমরা এ বিষয়ে কী করে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করব? আল্লাহর কসম! আমি তো কখনোই তার প্রতি ঈমান আনব না এবং কোনো দিনই বিষয়টি স্বীকার করে নেব না। -দালায়েল, বায়হাকী ২/২০৬-২০৭; সীরাতে ইবনে হিশাম ১/৩৪২-৩৪৩; খাসায়েস, সুয়ূতী ১/১৯২-১৯৩

মোটকথা, কুরআনের এ শাশ্বত দাবি ও চ্যালেঞ্জের মোকাবেলায় সমগ্র আরব যে শুধু নীরবে পরাজয় মেনে নিয়েছিল তাই নয়। বরং এর অনন্যতা, অদ্বিতীয়তা এবং নিজেদের অপারগতা খোলাখুলি স্বীকারও করে নিয়েছিল। যদি এ কুরআন কোনো মানুষের বাণী হয়, তাহলে কী কারণে আরব-আজম নির্বিশেষে গোটা পৃথিবীর মানুষ এর সমতুল্য রচনায় অক্ষম হয়ে পড়ল?

এর কারণ হল, সে যুগের লোকেরা নিজেদের জাহেলি কর্মকা- সত্ত্বেও উদারমনা ও উন্নত চরিত্রের অধিকারী ছিল। ভণ্ডামি তাদের স্বভাবে ছিল না। তারা যখন কুরআন শুনে উপলব্ধি করল যে, এ কালামের সমতুল্য রচনা করা আমাদের পক্ষে আদৌ সম্ভব নয়। তখন নিছক প্রতারণা আর গোঁড়ামি করে কোনো রচনা পেশ করাকে নিজেদের জন্য অবমাননাকর মনে করল।

কারণ, তাদের এও জানা ছিল যে, আমরা যদি কোনো কিছু পেশ করেও দেই, তবে গোটা আরবের ভাষাবিদ-সাহিত্যিকগণ এ তুলনামূলক পরীক্ষায় আমাদেরকে পরাজিতই সাব্যস্ত করবে। ফলে অযথাই অপমানের মুখে পড়তে হবে। এজন্যই গোটা জাতি নীরব ভূমিকা পালন করল। আর যারা কিছুটা নীতিবান ও নিরপেক্ষ ছিল তারা বিষয়টি খোলাখুলি স্বীকারও করে নিল। যার কিছু বিবরণ ইতিপূর্বে আলোচিত হয়েছে।

 

এ প্রসঙ্গেরই কয়েকটি ঘটনা

আরব সর্দার আসআদ বিন যুরারাহ প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চাচা হযরত আব্বাস রা.-এর নিকট স্বীকার করে বলেছিল, আমরা (আকাবার বাইআতের দিন) মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের (আনুগত্যের জন্য) নিজেদের আত্মীয়তা ছিন্ন করছি। পারস্পরিক সম্পর্ক বিনষ্ট করছি। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, তিনি নিঃসন্দেহে আল্লাহর প্রেরিত রাসূল। তার মধ্যে প্রতারণা বা মিথ্যার লেশমাত্র নেই। যে বাণী তিনি নিয়ে এসেছেন তা মানবরচিত হতে পারে না। -দালায়েল, আবু নুআঈম ১/৩৯৯; মা‘রিফাতুস সাহাবা, আবু নুআঈম ১/২৬২, ৪/১৯৫, ৪/৩২৩; খাসায়েস, সুয়ূতী ১/১৯৩

বনু সুলাইম গোত্রের জনৈক ব্যক্তি। নাম কায়েস বিন নুসাইবা। লোকটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে এসে উপস্থিত হল। তার পবিত্র যবানে কুরআন তিলাওয়াত শুনল। এরপর রাসূলকে কয়েকটি প্রশ্ন করল। রাসূল উত্তর প্রদান করলেন। লোকটি তখনই ইসলাম গ্রহণ করল। তারপর নিজ গোত্রে ফিরে গিয়ে লোকদের বলল, আমি রোম-পারস্যের অগণিত সুসাহিত্যিক ও কথা-শিল্পীর বক্তব্য শুনেছি। অসংখ্য ভাগ্যগণকের কথা শোনার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। যাদুকরদের কথাবার্তাও প্রায়ই শুনি। কিন্তু মুহাম্মাদের অসাধারণ বাণী আমি আজ পর্যন্ত কোথাও শুনিনি। তোমরা সকলে আমার কথা শোন, সবাই তার আনুগত্য করে নাও। এ দাওয়াতে অনুপ্রাণিত হয়ে তার গোষ্ঠীর এক হাজার মানুষ মক্কাবিজয়ের সময় রাসূলের খেদমতে উপস্থিত হয়ে ইসলাম গ্রহণের সৌভাগ্য লাভ করেন। -আলখাসায়েসুল কুবরা, ১/১৯৩-১৯৪

এসব স্বীকারোক্তিমূলক বিবৃতি যে কেবল নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষসমর্থনকারী আর নিরপেক্ষ ব্যক্তিবর্গের ছিল তা-ই নয়, যারা সর্বাবস্থায় যেকোনো উপায়ে প্রিয়নবীর বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগেছিল, কুরআনের ব্যাপারে তাদেরও একই রকম মতামত ছিল। কিন্তু নিজেদের আক্রোশ আর প্রতিহিংসাপরায়ণতার কারণে জনসমক্ষে তারা তা প্রকাশ করত না।

সুয়ূতী রাহ. বায়হাকীর সূত্রে ‘খাসায়েসে কুবরা’ গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন, একবার আবু জাহেল, আবু সুফিয়ান এবং আখনাস বিন শুরাইক প্রত্যেকে রাতের বেলা নিজ নিজ ঘর ছেড়ে বের হল। সবার উদ্দেশ্য ছিল, লুকিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কুরআন তিলাওয়াত শোনা। প্রত্যেকে আলাদা আলাদা বের হল। তাদের কেউ অপরজনের বিষয়ে জানত না। সকলে পৃথক পৃথক কোণে আত্মগোপন করে একাগ্রচিত্তে কুরআন শোনায় এমনই বিভোর হল যে, সারারাত পেরিয়ে গেল।

ভোর হতেই সবাই ফিরে চলল। ঘটনাচক্রে মাঝপথে পরস্পরে সাক্ষাৎ হয়ে গেল। প্রত্যেকে অপরের বিষয়ে জানতে পেরে একে অন্যকে তিরস্কার করে বলল, তোমাদের এ কাজটি খুবই অন্যায় হয়েছে। একজন একথাও বলল, ভবিষ্যতে কেউ যেন এ কাজ না করে। কারণ তোমাদের বোকা জনগণ টের পেলে তারা ইসলামের প্রতি ঝুঁকে পড়বে। এসব বলাবলি করে সকলে নিজ নিজ ঘরে চলে গেল।

পরবর্তী রাতে পুনরায় প্রত্যেকের মনে কুরআন তিলাওয়াত শোনার সাধ জাগল। এবারও সকলে লুকিয়ে গিয়ে আগের মতো কুরআন শুনল। এমনকি রাত পার করে দিল। সকালে ফেরার পথে আবার পরস্পর মুখোমুখি হল। একে অন্যকে বকাঝকা করে এহেন কর্ম পরিত্যাগে সকলে সম্মত হল। কিন্তু তৃতীয় রাতেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল। কুরআনের অনুপম সৌন্দর্য আর অপূর্ব মাধুরী আবার তাদেরকে বাধ্য করল। তারা পুনরায় সেখানে গেল।

রাতভর কুরআন তিলাওয়াত শুনল। ফিরতি পথে ফের তাদের পরস্পর সাক্ষাত ঘটল। এবার সবাই বলল, এসো আমরা সকলে মিলে প্রতিজ্ঞা করি যে, আর কখনো আমরা এ কাজ করব না। অবশেষে সকলে এ প্রতিজ্ঞা করে যার যার বাড়ি ফিরে গেল।

সকালবেলা আখনাস বিন শুরাইক নিজের লাঠিখানা নিয়ে প্রথমে আবু সুফিয়ানের কাছে গিয়ে বলল, বলো, এ কালামের ব্যাপারে তোমার কী মত? সে অস্ফুটস্বরে আমতা-আমতা করে কুরআনের সত্যতা ও অকাট্যতার পক্ষে মত দিল। আখনাস তখন বলে উঠল, আল্লাহর কসম! আমারও একই মত।

এরপর সে আবু জাহেলকে গিয়ে এ প্রশ্ন করল যে, মুহাম্মাদের বাণীর বিষয়ে তোমার মূল্যায়ন কী? তখন আবু জাহেল বলল, সত্যি করে বলতে গেলে আমাদের বংশ আর বনু আবদে মানাফ বংশের মাঝে যুগ যুগ ধরে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলে আসছে।  জাতীয় নেতৃত্ব ও আধিপত্যের প্রশ্নে তারা কোনো অঙ্গনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করলে আমরাও তাতে অগ্রসরতার স্বাক্ষর রাখি। তারা বদান্যতা ও দয়া-দাক্ষিণ্য করে সমাজে প্রভাব ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে আমরা একধাপ এগিয়ে এ কাজ করে দেখিয়েছি। তারা পরোপকার ও জনকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডে মানুষের পাশে দাঁড়ালে আমরা এ অঙ্গনেও তাদের চেয়ে পিছিয়ে থাকিনি। ফলশ্রুতিতে আজ গোটা আরব জানে যে, আমরা উভয় গোষ্ঠী সমমর্যাদার অধিকারী। এরূপ পরিস্থিতিতে তাদের বংশ থেকে এ আওয়াজ উঠল যে, আমাদের মধ্যে একজন নবীর আগমন ঘটেছে, যার প্রতি আসমানী ওহী অবতীর্ণ হয়।  এখন স্পষ্টতই আমাদের জন্য এ বিষয়ে পাল্টা পদক্ষেপ গ্রহণ করা অসম্ভব। এজন্য আমাদের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, কখনোই তার প্রতি ঈমান আনব না এবং বিষয়টি কোনোভাবেই মেনে নেব না। -দালায়েল, বায়হাকী ২/২০৬-২০৭; সীরাতে ইবনে হিশাম, ১/৩৪২-৩৪৩; খাসায়েস, সুয়ূতী ১/১৯২-১৯৩

এ হল কুরআনের সেই প্রকাশমান মুজেযা, যা শত্রুদেরকেও স্বীকার করতে হয়েছে। এসকল  ঘটনা আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূতী রাহ. ‘আল খাসায়েসুল কুবরা’ গ্রন্থে সংকলন করেছেন।

তৃতীয় কারণ

কুরআনের অলৌকিকতার তৃতীয় কারণ হচ্ছে, এতে অদৃশ্যজগত এবং ভবিষ্যতে ঘটিতব্য নানা ঘটনার আগাম বিবরণ রয়েছে। কুরআন যা যা বলেছে, ঘটনাগুলো হুবহু তেমন ঘটেছে।

যেমন : কুরআন ঘোষণা দিয়েছিল, রোম-পারস্যের যুদ্ধে -যা নবীজীর যুগে সংঘটিত হয়েছিল- পারস্যবাসী বিজয় লাভ করবে। আর রোমবাসী পরাজিত হবে।

তবে সঙ্গে এ আগাম সংবাদও জানিয়ে দিয়েছিল যে, পরবর্তী দশ বছরের মধ্যে রোমবাসী পারস্যবাসীর ওপর বিজয়লাভ করবে। মক্কার গোত্রপ্রধানরা কুরআনের এ ভবিষ্যদ্বাণী নিয়ে হযরত সিদ্দীকে আকবর রা. সঙ্গে হারজিতের চুক্তি করেছিল।

তারপর ভবিষ্যদ্বাণী মোতাবেক যখন রোমকেরা বিজয় অর্জন করল, তখন তাদেরকে চুক্তিতে পরাজয় মেনে নিয়ে শর্তানুযায়ী পরাজিত পক্ষের উপর ধার্যকৃত জরিমানা দিতে হল। তবে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ সম্পদ গ্রহণ করলেন না। কারণ, এ চুক্তিটি ছিল এক ধরনের জুয়া।

গায়েবের বিষয়ে এ জাতীয় আরো বহু ঘটনা ও ভবিষ্যদ্বাণী কুরআনে কারীমে উল্লেখ রয়েছে। যার সত্যতা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট।

 

সফর ১৪৪০ – নভেম্বর ২০১৮

মাসিক আলকাউসার