মদিনায় মসজিদে নববির নির্মাণ-কাজ শেষ হলো। নির্মাণ-কাজে নবীজি নিজে এবং মুসলিমগণ পরস্পরকেসাহায্য-সহযোগিতা ও উৎসাহ-উদ্দীপনা দিয়ে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন;—অথচ একদিন আগেও তাঁরা এভাবে আত্মীয় হয়ে ওঠার কথা ভাবতে পারতেন না। তাঁদের এই অনুপম ঐক্য, সংহতি ও ভ্রাতৃত্বকে অটুট ও স্থায়ী করার লক্ষ্যে নবীজি যে ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন, বিশ্ব-ইতিহাসে তা এক উজ্জ্বল ও স্বতন্ত্রতম অধ্যায়।নবীজি মুসলিমগণের মধ্যে অপূর্ব এক ভ্রাতৃত্ব-বন্ধন প্রতিষ্ঠিত করলেন;‘মুহাজির-আনসার ভ্রাতৃত্ব’ নামে যা অভিহিত।
হযরত আনাস বিন মালিক রাযিয়াল্লাহু আনহুর বাড়িতে মুহাজির ও আনসারগণের মধ্যে এ ভ্রাতৃত্বের সম্পর্কগড়ে দেওয়া হয়। এ সভায় সর্বশেষ নব্বই জন মুসলিম উপস্থিত ছিলেন;অর্ধেক সংখ্যক ছিলেন মুহাজির এবং অর্ধেক সংখ্যক আনাসার। ‘মুহাজির-আনসার ভ্রাতৃত্ব’-এর মূলনীতিগুলো ছিল:‘একে অন্যের দুঃখে দুঃখিত হবেন; মৃত্যুর পর নিজ আত্মীয়ের মতো একে অন্যের ওয়ারিস বা উত্তরাধিকারী হবেন।’ওয়ারাসাত বা উত্তরাধিকারের এ ব্যবস্থা বদর-যুদ্ধ পর্যন্ত চালু ছিলো। কিন্তু যখন কুরআনে আয়াত নাজিল হলো : তরজমা—“আল্লাহরবিধানে রক্ত-সম্পর্কীয়গণ পরস্পরের নিকট অগ্রগণ্য”, তখন এ উত্তরাধিকার-ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যায়।
‘মুহাজির-আনসার ভ্রাতৃত্ব’ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে মূর্খতার যুগের বংশীয় সম্পর্কের অনুচিত ও ভ্রান্তইমারতটি ভেঙে পড়ে।আত্মীয়তা বা অনাত্মীয়তার সম্পর্কের ভিত্তিমূল হিসেবে স্থাপিত হয় ইসলাম। মানুষে মানুষে বংশ, বর্ণ ও দেশের সম্পর্ক মুছে যায়। উঁচু, নিচু ও মানবত্বের মাপকাঠি নির্ধারিত হয় তাকওয়া।নবীজির প্রতিষ্ঠিত এই ভ্রাতৃত্ব-বন্ধন শুধুমাত্র দফা বা মূলনীতিসর্বসস্ব কোনো অকার্যকর ঘোষণা বা পদক্ষেপ ছিলো না; বরং তিনি এই ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে কার্যকরী প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন। মানব-ইতিহাসে রচিত হয় এক অভূতপূর্ব ভালোবাসার কাহিনি।নবীজির পরিকল্পিত ও প্রতিষ্ঠিত এ নবতর জীবনধারা শুধু সালাম-মোসাফাহায় সীমাবদ্ধ ছিলো না, এর বুনিয়াদ ছিলো রক্ত ও ধন-সম্পদের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সমবেদনা, সহযোগিতা ও সহমর্মিতারমিশ্রণে এ ছিলো এক অনন্য জীবন।
নবীজি আবদুর রহমান বিন আউফ এবং সাদ বিন রাবি রাযিয়াল্লাহু আনহুমার মধ্যে ভ্রাতৃত্ব-বন্ধন স্থাপন করিয়ে দিয়েছিলেন। এরপর সাদ আবদুর রহমানকেবললেন, ‘আনসারদের মধ্যে আমি সর্বাপেক্ষা ধনী ব্যক্তি। আপনি আমার সম্পদ দুই ভাগে ভাগ করে অর্ধেক গ্রহণ করুন। তাছাড়াআমার দুজন স্ত্রী রয়েছে; দুজনের মধ্যে যাঁকে আপনার পছন্দ হয়, আমাকে বলুন, আমি তাঁকে তালাক দেবো; ইদ্দত পালনের পর তাঁকে বিবাহ করবেন।’আবদুর রহমান বললেন, ‘আল্লাহ আপনার ধন-জন ও মালমাত্তায় বরকত দিন। আপনাদের বাজার কোথায়?’তাঁকে বনু কাইনুকার বাজার দেখিয়ে দেওয়া হলো।
আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহুর বর্ণনা—আনাসারগণনবীজির নিকট এ বলে আবেদন পেশ করলেন, ‘আমাদের এবং মুহাজির ভাইদের মধ্যে আমাদের খেজুর-বাগানগুলো ভাগ-বণ্টন করে দিন।’ তিনি বললেন, ‘না।’আনসারগণ বললেন, ‘তাহলে মুহাজিররা আমাদের কাজ করে দিক;তাঁদেরকে আমরা ফলের অংশ দেবো।’তাঁরা বললেন, ‘তাহলে ঠিক আছে।’এ থেকে সহজে অনুমান করা যায়, আনাসারগণ কিভাবে আন্তরিকতা ও আগ্রহের সঙ্গে আগ বেড়ে মুহাজির-ভাইদের জন্য সহমর্মিতা ও সহযোগিতার হাত সম্প্রসারিত করেছিলেন এবং কতটুকু মহববত, খুলুসিয়াত ও আত্মত্যাগের নজির দেখিয়েছিলেন। অধিকন্তু, মুহাজিরগণও তাঁদের আনসার-ভাইদের প্রতি কতটুকু শ্রদ্ধাশীল, সহমর্মী ও আত্মসচেতন ছিলেন, তাও এ ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয়ে যায়। আনসারগণের আত্মত্যাগের সুযোগ তাঁরা গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু সুযোগের অপব্যবহার কখনোই করেননি। তাঁদের ভেঙে-যাওয়া জীবনধারাকে ন্যূনতম প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে সচল করে তোলার জন্য যতটুকু গ্রহণ করার প্রয়োজন ছিলো, তাঁরা ঠিক ততটুকুই গ্রহণ করেছিলেন।এ প্রসঙ্গটি সম্পর্কে সত্য কথা এবং এর গৃঢ় রহস্য সম্পর্কে বলতে গেলে এ কথা অবশ্যই বলতে হয় যে, এ ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের ভিত্তি ছিল অভাবিত ও অপূর্ব।
তথ্যসূত্র :আর-রাহিকুল মাখতুম, সফিউর রহমান মোবারকপুরি।