সুলতানি আমলে বাংলা সাহিত্য

বাংলায় মুসলিম শাসনের শুরুতে মুসলিমরা ছিল বহিরাগত। মুসলিম সুলতানদের মুখের ভাষা ছিল তুর্কি, রাজভাষা ছিল ফার্সি। কিন্তু মুসলিম শাসকরা দ্রুতই এখানকার মানুষের জীবনের সাথে নিজেদের জড়িয়ে ফেলেন। ইতিপূর্বে বহিরাগত আর্যরা অনার্যদের সাথে যে বৈষম্যের দেয়াল তুলে রেখেছিল মুসলিমরা সে দেয়াল ভেঙ্গে ফেলেন। তারা ইসলামের সাম্যবাদ ঘোষণা করেন। ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে সকল পক্ষপাতমূলক আচরণ তারা পরিহার করেন। এই অঞ্চলে তারা স্থায়ী হয়ে যান। এখানকার জনসাধারণের যাপিত জীবনকে আপন করে নেন। জনসাধারণও মুসলিম শাসনকে নিজেদের জন্য আশীর্বাদ হিসেবেই গ্রহণ করে।

মুসলিমরা বাংলা কেড়ে নিয়েছিল সেন রাজাদের হাত থেকে। লক্ষণ সেনের পরাজয়ের মাধ্যমে হিন্দুদের হাত থেকে মুসলমানদের হাতে রাজদন্ড স্থানান্তরিত হয়। এটি ছিল একটি বড় ঘটনা। স্থানীয়দের মনে অবশ্যই এর প্রভাব পড়েছিল। কিন্তু তাদের প্রতিক্রিয়া কী ছিল? এ সম্পর্কে দীনেশচন্দ্র সেন লিখেছেন, ‘এতবড় ঘটনাতে প্রজাদের হৃদয়ে গুরুতর আঘাত লাগিবার কথা অথচ তাহারা তাহাদের চিরাগত অভ্যাসানুযায়ী এই মর্মন্তুদ ঘটনার অভিব্যক্তি-স্বরূপ কোনো গীতিকা রচনা করে নাই। ইহার কারণ কি? আমার মনে হয়, সেই রাজত্বের লোপে জনসাধারণের মনে তেমন আঘাত লাগে নাই’। (১)

ব্রাহ্মণ-অনুশাসনের যুগে প্রজাদের বড় অংশই ছিল অবহেলিত। উচু-নিচু বর্ণের ভেদাভেদ মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের মাঝে তুলে দিয়েছিল বাধার প্রাচীর। নাপিত, ধোপা, ডোম, চন্ডাল ইত্যাদি পেশার লোকজন ছিল চরম ঘৃণিত। তাদের দেখলে অন্যদের যাত্রাভঙ্গ করতে হত। ‘ছি ছি’ ‘ধুর ধুর’ এই ছিল তাদের প্রতি সম্বোধনের ভাষা। সে সময় ছিল সংস্কৃত ভাষার জয়জয়কার। বাংলা ছিল অবহেলিত। প্রচার করা হয়েছিল, যদি কেউ রামায়ণ ও পুরাণের কথা বাংলায় প্রচার করে তাহলে সে রৌরব নরকে পতিত হবে। রামায়নের অনুবাদক কৃত্তিবাস এবং মহাভারতের অনুবাদক কাশীদাসের নিন্দা করে ভট্টাচার্যরা প্রবাদ রচনা করেছিলেন, ‘কৃত্তিবেসে, কাশীদেসে আর বামুন ঘেষে, এই তিন সর্ব্বনেশে’। (২)

ত্রয়োদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু প্রথম বাংলা কাব্য চন্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন’ রচিত হয় এর প্রায় দুইশো বছর পরে। এর কারণ হলো ইলিয়াস শাহী বংশের প্রতিষ্ঠাকালে যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগেই ছিল। ফলে এই সময় সাহিত্যচর্চার অনুকুল ছিল না। এই সময়ের কোনো সাহিত্য এখনো পাওয়া যায়নি। ফলে ১২০১-১৩৫২ পর্যন্ত সময়কালকে বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের অন্ধকার বলা হয়।

বাংলায় মুসলিম শাসন থিতু হতেই বাংলাকে আমন্ত্রণ জানানো হয় রাজদরবারে। সুলতান গিয়াসউদ্দিন আযম শাহ (১৩৮৯-১৪১০ খ্রিস্টাব্দ) শিক্ষানুরাগী হিসেবে ইতিহাসে বিশেষ স্থান লাভ করেছেন। তার পৃষ্ঠপোষকতায় শাহ মুহাম্মদ সগীর রচনা করেন বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘ইউসুফ জোলেখা’ (৩)। এই ধর্মীয় ও রম্য উপাখ্যান বাংলা সাহিত্যে নব দিগন্তের সূচনা করে। সুলতানের এই পৃষ্ঠপোষকতা অন্য কবিদের জন্য ছিল আশার বাণী, কারণ সে সময় রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া সাহিত্য-সাধনার কাজটি ছিল বেশ কঠিন।

সুলতান শামসুদ্দিন ইউসুফ শাহ মালাধর বসুকে ভগবতের বাংলা অনুবাদ করার দায়িত্ব দেন। পরে কবিকে তিনি গুণরাজ খান উপাধিতে ভূষিত করেন।

সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের সময়কালকে ধরা হয় বাংলা সাহিত্যের স্বর্ণযুগ হিসেবে। এই আমলের ৪৫ বছর সময়ে বাংলা সাহিত্যের অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়। ফলে এই সময়কালকে বাংলা সাহিত্যের রেনেসাঁর যুগ বলা হয়। এই সময়ে কবি-সাহিত্যিকরা ব্যাপকহারে সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন। সুলতান ও তার দরবারের সভাসদরা সাহিত্যচর্চায় পৃষ্ঠপোষকতা করছিলেন। সেকালের কবি-সাহিত্যিকদের লিখিত গ্রন্থে এর প্রমাণ মেলে। ‘শ্রীকৃষ্ণ বিজয়’ গ্রন্থের লেখক যশোরাজ খান ছিলেন আলাউদ্দিন হোসেন শাহের দরবারের কর্মচারী। যশোরাজ খান তার গ্রন্থে সুলতানকে ‘শাহ হুসেন জগত-ভূষণ’ বলে সম্বোধন করেন। কবিন্দ্র পরমেশ্বর ‘কলিকালে হরি হৈল কৃষ্ণ অবতার’ বলে সুলতানের বন্দনা করেছেন।

তার আমলেই বিজয়গুপ্ত ও বিপ্রদাস রচনা করেন ‘মনসামঙ্গল’ ও ‘মনসাবিজয়’ গ্রন্থদুটি। বিজয়গুপ্ত তার লেখায় সুলতানের প্রশংসা করেছিলেন। আলাউদ্দিন হুসেন শাহের ছেলে নসরত শাহও বাংলা সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। আবদুল করিম লিখেছেন, হোসেন শাহী বংশে চারজন রাজা রাজত্ব করেন, এই চারজনই কবিদের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।

আলাউদ্দিন হোসেন শাহের সেনাপতি ও চট্টগ্রামের শাসনকর্তা পরাগল খান মহাভারতের বাংলা অনুবাদ করার দায়িত্ব দেন কবি পরমেশ্বরকে। পরমেশ্বের মহাভারতের বিশাল অংশ অনুবাদ করেন। পরে পরাগল খানের পুত্র ছুটি খানের আদেশে বাকি অংশ অনুবাদ করেন সভাকবি শ্রীকর নন্দী।

পঞ্চদশ ও ষোড়শ দশকে অনেক মুসলমান কবি প্রেমকাব্য রচনা করেছেন। এদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিলেন, ‘হানিফা ও কায়রা পরী’ গ্রন্থের লেখক কবি সাবিরিদ খান, ‘সয়ফুল মুলক’ কাব্যের রচয়িতা দোনাগাজি এবং ‘লাইলি মজনু’র লেখক দৌলত উজির বাহরাম খান। সে সময় মুসলমান কবিরা আরবী ও ফারসি সাহিত্যের রম্য উপাখ্যান থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করছিলেন। এভাবে তারা বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে তোলেন। মুসলিম লেখকরা তাদের লেখায় নায়ক-নায়িকার নৈতিকতা, মানবীয় গুণাবলী, ও চারিত্রিক বিশুদ্ধতার দিকে জোর দেন। মূলত মুসলমান লেখকদের মাধ্যমেই বাংলা সাহিত্যে ইতিহাস বিষয়ক রচনার সংযোজন হয়। তারা ইতিহাসের সাথে কল্পনা মিশিয়ে ইসলামের প্রথম যুগের বীরদের বীরত্বগাথা রচনা করেন। এসব রচনার উদ্দেশ্য ছিল ইসলামের গৌরবগাথা প্রচার করা এবং মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় আবেগের উন্মেষ ঘটানো। সুলতান ইউসুফ শাহের (১৪৭৪-৮১) সভাকবি শেখ জৈনুদ্দিন রচনা করেন ‘রাসুল বিজয়’। এ গ্রন্থের উপাদান তিনি নিয়েছিলেন একটি ফার্সি গ্রন্থ থেকে। এ ধরনের আরেকটি রচনা হলো শেখ ফয়জুল্লাহ লিখিত ‘গাজি বিজয়’। তিনি এই গ্রন্থ রচনা করেছিলেন সুলতান বারবক শাহের সেনাপতি বিখ্যাত দরবেশ শেখ ইসমাইল গাজির জীবনী অবলম্বনে। অবশ্য এটি নিরেট ইতিহাস ছিল না। বরং ইতিহাসের সাথে কল্পনার মাধুরী মিশিয়ে তিনি এই গ্রন্থ রচনা করেন।

মুসলিম কবিগণ বাংলা ভাষায় মরমী সাহিত্য সৃষ্টি করার ক্ষেত্রেও কৃতিত্বের দাবিদার। পারস্যের জালালুদ্দিন রুমি ও অন্যান্য সুফি কবিদের গজলিয়াত-এর অনুসরণে তারা পদাবলী নামে পরিচিত মরমী ভাবধারার কবিতা রচনা করেন। এই পদাবলী মূলত ফারসি সাহিত্যের মসনবী। সুলতান হোসেন শাহের অধীনে চাঁদ কাজী নামে নবদ্বীপের একজন কাজী ছিলেন বাংলা সাহিত্যের এই ভাবমূলক গীতি-কবিতা রচনার প্রথম খ্যাতনামা কবি।
মুসলিম কবিদের আরেকটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন ছিল সত্যপীরের কাহিনী। এটি মূলত মুসলিম মানসের ভক্তি ও হিন্দুদের পৌরাণিক কাহিনীর প্রভাবে তৈরী হয়। মুসলিম পীর-দরবেশদের প্রতি ভক্তির ফলে হিন্দুরাও সত্যপীরের কাহিনী রচনা করতে থাকে। শেখ ফয়জুল্লাহ ছিলেন সত্যপীর বিষয়ক কাব্য রচনার ক্ষেত্রে প্রথম বাঙ্গালি কবি। এ জাতীয় কাব্য ১৫৪৫-১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে লেখা হয়েছিল। পরে হিন্দু-মুসলমান দুই ঘরানাতেই এই সাহিত্য জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত এ জাতীয় কাব্য-সাহিত্য বাঙ্গালি সমাজে বেশ জনপ্রিয় ছিল।

মুসলিম কবিরা বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করার জন্য আরবী ও ফারসি ভাষা থেকে বহু শব্দ আমদানি করেন, এবং বাংলা ভাষার জীবনী-শক্তি সঞ্চার করেন। সুলতান নুসরত শাহের পুত্র যুবরাজ ফিরোজ শাহের পৃষ্ঠপোষকতায় আফজল আলি নামক একজন মুসলমান কবি বেশকিছু কবিতা রচনা করেন। তার কবিতাগুলো মুসলমানদের ভাষা-বিষয়ক ঐতিহ্যের দৃষ্টান্ত বহন করে। তিনি তার নসিহতনামায় লিখেছেন–
উপহাস্য করে বুলি মুনাফিকগণ,
আয়ত হাদিস লেখিয়াছি তেকারণ।
খোয়াব বলিয়া শাহা রুস্তমে কহিল,
অলগণ পদে প্রণোমিয়ে পুনি পুনি,
ভাবে ডুবি যেবা পড়ে ছাড়ে কুফরানি।
খোয়াব যে, নসিহতনামা তার নাম।

কবি আলাওলের সময় বাংলা ভাষার ইসলামি ঐতিহ্য উন্নতির শিখরে আরোহণ করে। মুসলিম কবিদের লেখনি হিন্দু কবিদেরকেও প্রভাবিত করেছিল। ফলে গোঁড়া হিন্দু কবিরাও তাদের কাব্যে আরবী-ফারসি শব্দ ব্যবহার না করে পারছিলেন না। বিজয়গুপ্ত তার মনসামঙ্গলে লিখেছেন–
তকাই নামে মুল্লা কিতাব ভাল জানে
কাজির মেজবান হৈলে আগে তারে আনে
কাছ খুলিয়া মুল্লা ফরমায় অনেক।
কাজি বলে আরে বেটা ভূতের গোলাম।
পীর থাকিতে কেন ভূতেরে সালাম।
কাজী বলে আহম্মক জোয়াব দাও কেনে।

(তকী নামে একজন মোল্লা বা শিক্ষিত লোক ধর্মীয় গ্রন্থাদি ভালো জানেন। কাজী কোনো ভোজের আয়োজন করলে তিনি সকলের আগে মোল্লাকে নিমন্ত্রণ করেন। মোল্লা তার পোষাকের প্রান্ত আলগা করে ধর্ম সম্পর্কে অনেক কথা বলেন। কাজী কাউকে বলেছিলেন, ব্যাটা ভূতের গোলাম কোথাকার। মোল্লা থাকতে তুমি কেন ভূতের ভয় পাও। কাজী লোকটিকে আহম্মক বলে অভিহিত করেন এবং তাকে তর্ক করতে নিষেধ করেন।)

এই প্রভাব দেখা যায় বংশীবদনের কাব্যেও। তিনি লিখেছেন–
পায়জামা, নিমা টুপি পরি কটিবন্ধ,
হাসান সাইদের সাজে সাত ফরজন্দ।
আওখন্দ হাসান কাজী হৈলা আগুয়ান,
তালিপ মুর্শিদী তার ধরিছে জোগান।

হিন্দু কবিরা তাদের কাব্যে দেব-দেবীর বন্দনা দিয়ে শুরু করতেন। মুসলিম কবিগণ যথাক্রমে আল্লাহ ও নবিজির প্রতি হামদ ও নাত দিয়ে তাদের রচনা শুরু করতেন। এরপর তারা তাদের পৃষ্ঠপোষকদের বন্দনা করতেন। নানা উপাধিতে তাদের ভূষিত করতেন। তাদের কৃতজ্ঞতা আদায় করতেন। কৃতজ্ঞতার কারণও স্পষ্ট। আর্থিক সহায়তা না পেলে সাহিত্যচর্চা করা ছিল কঠিন। সেকালে লেখার উপায়-উপকরণও ছিল সীমিত। ফলে সুলতান ও সভাসদদের সাহায্য তাদের সাহিত্যচর্চার পথ সুগম করতো। জীবিকার চিন্তাও দূর হতো।

সুলতানরা এই বাস্তবতা জানতেন। ফলে রাজসভা থেকেই বাংলা সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা শুরু হয়। এভাবেই সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগের সমাপ্তি ঘটে, পরবর্তীতে যাকে আরো সমৃদ্ধ করে তোলেন অন্যরা।

সূত্র
১। প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে মুসলমানের অবদান, পৃ-৩৯ – দীনেশচন্দ্র সেন। দিব্যপ্রকাশ, ঢাকা।
২। প্রাগুক্ত, পৃ-৪০
৩। ডক্টর এনামুল হক ও ডক্টর এম এ রহিম এই মত দিয়েছেন। তবে আবদুল করিমের মতে সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহের শাসনামলে ইউসুফ জোলেখা রচিত হয়। বিস্তারিত জানতে দেখুন, বাংলার ইতিহাস সুলতানি আমল, পৃ-৪৫৮- আবদুল করিম। জাতিয় সাহিত্য প্রকাশ।


ইমরান রাইহান
সূত্রঃ fateh24