নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম ও মৃত্যুর বিশুদ্ধ তারিখ
আমরা শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উম্মত। তাই আমাদেরকে তাঁর জন্ম ও মৃত্যুর সঠিক তারিখ জানা উচিত। নির্ভরযোগ্য ইতিহাসবেত্তাদের উদ্ধৃতির আলোকে আমরা নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম ও মৃত্যুর সঠিক তারিখ নির্ণয়ের চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।
নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম তারিখ
নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম তারিখ নিয়ে ঐতিহাসিকদের নিকট মতানৈক্য রয়েছে। তবে নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম রবিউল আউয়াল মাসের কোনো এক সোমবার হয়েছে, এ ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য সকল ইতিহাসবিদ উলামায়ে কেরাম একমত। (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া ২/২৮২)
জন্ম তারিখ সম্পর্কে বিভিন্ন ধরণের বর্ণনা পাওয়া যায়। নিম্নে বর্ণনাগুলো উল্লেখ করা হলোঃ
১.রবিউল আউয়াল এর দুই তারিখ।
২.রবিউল আউয়াল এর আট তারিখ।
৩.রবিউল আউয়াল এর দশ তারিখ।
৪.রবিউল আউয়াল এর বার তারিখ।
৫.রবিউল আউয়াল এর সতের তারিখ।
৬.রবিউল আউয়াল এর আট দিন বাকী থাকতে।
৭.রমযান মাসের বার তারিখ। (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া ২/২৮২)
এসব বর্ণনার মধ্য থেকে হাফেজ ইবনে কাছির রহ. ‘আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ এর মধ্যে ‘দুই’ ‘আট’ ও ‘বার’ তারিখের কথা গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করেছেন। তাই আমরা শুধু এই তিনটি তারিখ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। ইনশাআল্লাহ।
আর মুহাম্মাদ বিন সাআদ রহ. ‘তবাকাতুল কুবরা’ নামক গ্রন্থে দুই ও দশ তারিখের মতকে গ্রহণ করেছেন। বার তারিখের মতটি প্রসিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও এ মতটির আলোচনা তাঁর কিতাবে স্থান পায়নি। দুই ও দশ তারিখের পক্ষে পেশ কৃত তার দলীলসমূহ সনদসহ উল্লেখ করা হলোঃ
দুই তারিখের দলীলঃ
قال محمد بن سعد اخبرنا محمد بن عمربن واقد الاسلمى الواقدى قال: كان ابومعشر نجيح بن عبد الرحمن المدنى يقول: ولد رسول الله صلى الله عليه وسلم يوم الاثنين لليلتين خلتامن شهر ربيع الاول.
‘ইবনে সাআদ তার উস্তাদ ওয়াকেদী এর সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, আবূ মা‘শার আল-মাদানী বলতেন, রবিউল আউয়াল মাসের দুই তারিখ সোমবার নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম জন্ম গ্রহণ করেছেন।’ (তবাকাতে ইবনে সাআদ ১/৪৭)
এখানে লক্ষণীয় বিষয় হল, এ বর্ণনার রাবী ওয়াকেদী ও তার উস্তাদ আবূ মা‘শার উভয়েই ‘যয়ীফ’। রিজাল শাস্ত্রের প্রসিদ্ধ ইমাম হাফেজ ইবনে হাজার আসকলানী রহ. ওয়াকেদী সম্পর্কে বলেনঃ متروك مع سعة علمه ‘প্রশস্ত জ্ঞানের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তিনি পরিত্যাজ্য।’ তাকরীবুত তাহযীব পৃ.৪৯৮) আর আবূ মা‘শার সম্পর্কে বলেছেনঃ ضعيف ‘সে যয়ীফ’ (তাকরীব পৃ. ৫৫৯) অতএব দুই তারিখের বর্ণনাটির বর্ণনাকারীরা মাতরুক ও যয়ীফ হওয়ায় এমতটি গ্রহণ করা গেল না।
দশ তারিখের দলীলঃ
দশ তারিখের দলীলের সূত্রেও ওয়াকেদী রয়েছেন। তাই দশ তারিখের দলীলটিও মাতরুক বিবেচিত হবে। (তবাকাতুল কুবরা ১/৪৭)
আট তারিখের দলীলঃ
জেনে রাখা উচিত যে, হস্তি বাহিনী যে বছর মক্কায় হামলা করেছিল সেবছরই রবিউল আউয়াল মাসে নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম হয়। এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সকল ইতিহাসবিদ উলামায়ে কেরাম একমত।
ইবনে কাছীর রহ. বলেনঃ
قال ابن اسحاق: وكان مولده عليه السلام عام الفيل وهذا هو المشهور عند الجمهور. قال ابراهيم بن المنذر الحزامى: هو الذى لايشك فيه احدمن علمائنا انه عليه السلام ولد عام الفيل.
‘ইমামুল মাগাযী ইবনে ইসহাক বলেছেন, নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম হস্তি বাহিনীর বছর হয়েছিল। এটিই জমহুরের নিকট প্রসিদ্ধ অভিমত। আর ইবরাহীম বিন মুনযির রহ. বলেন, নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম হস্তি বাহিনীর বছর হওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের উলামাদের নিকট কোনো সন্দেহ নেই।’ (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ২/২৮৩)
অতএব, এতটুকু নিশ্চিতভাবে সাব্যস্ত হলো যে, হস্তি বাহিনীর মক্কায় আক্রমণের বছর নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম হয়েছিল। এখন প্রশ্ন থেকে যায় যে, হস্তি বাহিনীর হামলার কয়দিন পর নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম হয়ে ছিল? হাফেজে হাদীস ইমাম সুহায়লী, ইমাম ইবনে কাছীর, ইমাম মাসঊদী রহ. এর নিকট বিশুদ্ধতম মত হল, হস্তি বাহিনী মক্কায় হামলার পঞ্চাশ দিন পর নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম জন্ম গ্রহণ করেছেন। আবূ বকর মুহাম্মাদ বিন মূসা আল খাওয়ারেযেমী রহ. বলেন, হস্তি বাহিনী মক্কায় হামলা করে মুহাররম মাসের তের দিন বাকী থাকতে। তখন থেকে পঞ্চাশ দিন পর নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম জন্ম গ্রহণ করলে জন্ম দিবস আটই রবিউল আউয়াল হয়। অতএব, সাব্যস্ত হলো যে, উল্লেখিত বড় বড় ইমামদের মতে নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম হয়েছিল আটই রবিউল আউয়াল। আরো বিস্তারিত জানতে দেখুনঃ (সুবুলুল হুদা ওয়ার রশাদ ফী সীরাতি খাইরিল ইবাদ ১/৩৩৫)
আল্লামা আহমাদ বিন মুহাম্মাদ আল কসতালানী আট তারিখের মতকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে বলেনঃ
وقيل لثمان خلت منه, قال الشيخ قطب الدين: هو اختيار اكثر اهل الحديث, ونقل عن ابن عباس و جبير بن مطعم وهو اختيار من له معرفة بهذا الشان, واختاره الحميدى و شيخه ابن حزم , وحكى القضاعى فى عيون المعارف اجماع اهل الزيج(اى الميقات) عليه, ورواه الزهرى عن محمد بن جبير بن مطعم وكان عارفا بالنسب وايام العرب اخذ ذالك عن ابيه.
‘কারো কারো মতে নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম রবিউল আউয়াল মাসের আট তারিখ জন্ম গ্রহণ করেন। শায়েখ কুতুবউদ্দিন (আবূ বকর মুহাম্মদ বিন আহমাদ) বলেছেন, এ মতটিই অধিকাংশ মুহাদ্দিসগণ গ্রহণ করেছেন এবং এ মতটিই হযরত ইবনে আব্বাস এবং জুবাইর বিন মুতইম রা. থেকে বর্ণিত আছে। তাছাড়া ইতিহাস সম্পর্কে যার নূন্যতম ধারণা আছে সেও এমতটিই গ্রহণ করবে। হুমাইদি ও তার উস্তাদ ইবনে হাযম রহ.ও এ মতটি গ্রহণ করেছেন এবং কুযায়ী (আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মদ বিন সালাম) ‘উয়ূনুল মাআরেফ’ নামক গ্রন্থে আট তারিখে নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম গ্রহণ সম্পর্কে মীকাতবাসীদের ঐক্যমতের কথা উল্লেখ করেছেন। এমতটিকেই হাফেজ যুহরী রহ. মুহাম্মাদ বিন জুবাইর বিন মুতইম থেকে বর্ণনা করেছেন। আর মুহাম্মাদ বিন জুবাইর নসবনামা ও আরবের ইতিহাস সম্পর্কে পণ্ডিত ছিলেন। মুহাম্মাদ তার পিতা জুবাইর বিন মুতইম থেকে এ বিষয়ে পাণ্ডিত্য গ্রহণ করেছেন।’ (আল মাওয়াহেবুল লাদুনিয়্যাহ ১/৮৫)
আল্লামা যারকাশী রহ.ও ‘শরহে যারকাশী আলাল মাওয়াহেব’ এর মধ্যে আট তারিখের মতকে প্রাধান্য দিয়েছেন। (শরহে যারকাশী আলাল মাওয়াহেব ১/২৪৬)
সুপ্রসিদ্ধ ইতিহাসবেত্তা হাফেজ ইবনে কাছীর রহ. ‘আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ এর মধ্যে আট তারিখের মতকে যেভাবে উল্লেখ করেছেন তার দ্বারা স্পষ্টভাবে বুঝে আসে যে, তিনিও আট তারিখের প্রবক্তা। তিনি বলেনঃ
وقيل لثمان خلون منه, حكاه الحميدى عن ابن حزم ورواه مالك وعقيل ويونس بن يزيد عن الزهرى عن محمد بن جبيربن مطعم, ونقل ابن عبد البر عن اصحاب التاريخ انهم صححوه, وقطع به الحافظ الكبير محمد بن موسى الخوارزمى, ورجحه الحافظ ابو الخطاب بن دحية فى كتابه التنوير فى مولد البشير النذير.
‘কেউ কেউ বলেছেন নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম জন্ম গ্রহণ করেছেন রবিউল আউলায় এর আট তারিখ। এ মতটি হুমাইদী রহ. ইবনে হাযাম রহ. থেকে বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম মালেক রহ., উকাইল (ইবনে খালেদ) ও ইউনুস বিন ইয়াযীদ ইমাম যুহরী এর সূত্রে, আর ইমাম যুহরী মুহাম্মদ বিন জুবাইর বিন মুতইম এর সূত্রে আট তারিখের কথা বর্ণনা করেছেন। সুপ্রসিদ্ধ স্প্যানিশ আলেম ইবনে আব্দুল বার বলেছেন, ইতিহাসবেত্তাগণ আট তারিখের অভিমতকেই বিশুদ্ধ বলেছেন। তাছাড়া হাফেজে হাদীস মুহাম্মদ বিন মূসা আল খাওয়ারেযেমী নিশ্চিতভাবে আট তারিখকে সঠিক বলেছেন। আরেক হাফেজে হাদীস আবুল খাত্তাব উমর ইবনে হাসান ইবনে দিহইয়া স্বীয় গ্রন্থ ‘আত তানবীর ফী মাওলিদিল বাশীর ওয়ান নাযীর’ এর মধ্যে আট তারিখের অভিমতকেই প্রধান্য দিয়েছেন। (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া ২/২৮২)
বার তারিখের দলীলঃ
হাফেজ ইবনে কাছীর রহ. বার তারিখের দলীল সম্পর্কে বলেনঃ
وقيل لثنتي عشرة خلت منه, نص عليه ابن اسحاق ورواه ابن ابى شيبة فى مصنفه عن عفان بن مسلم عن سعيد بن مينا عن جابر وابن عباس رضى الله عنهما انهما قالا: ولد رسول الله صلى الله عليه وسلم عام الفيل يوم الاثنين الثانى عشر من شهر ربيع الاول وفيه بعث وفيه عرج به الى السماء وفيه هاجر وفيه مات, وهذا هوالمشهور عند الجمهور و الله اعلم.
‘ইবনে ইসহাক রহ. বার তারিখের মতটি স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন। আর ইবনে আবী শাইবা তার ‘মুসান্নাফ’ গ্রন্থে আফফান ইবনে মুসলিম এর সূত্রে সাঈদ ইবনে মীনা থেকে বর্ণনা করেন যে, জাবের (রাযি.)ও ইবনে আব্বাস (রাযি.) বলেছেন, নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম হস্তি বাহিনীর মক্কায় আক্রমণের বছর রবিউল আউয়াল মাসের বার তারিখ সোমবার জন্ম গ্রহণ করেন। আর রবিউল আউয়াল মাসে তাকে নবুওয়াত দেয়া হয় এবং এ মাসে তাঁর মে‘রাজ হয় এবং এ মাসেই তিনি হিজরত করেন আর এ মাসেই তিনি ইন্তিকাল করেন। (হাফেজ ইবনে কাছীর বলেন,) জমহুরের নিকট এ মতটিই প্রসিদ্ধ। (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া ২/২৮৩)
এখানে দুইটি বিষয় লক্ষণীয়ঃ
১. বার তারিখের দলীল হিসেবে একটি হাদীস পেশ করা হল। এই হাদীসের রাবী আফফান বিন মুসলিম ও সাঈদ বিন মীনা উভয়ে নির্ভরযোগ্য। তবে আফফান বিন মুসলিম সাঈদ বিন মীনা থেকে সরাসরি হাদীস শুনতে পাননি। কারণ সাঈদ বিন মীনার ইন্তেকাল হয় ১১০ হিজরীর দিকে। আর আফফান বিন মুসলিমের জন্মই হয় ১৩৪ হিজরীর দিকে। (সূত্রঃ সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ৯/২৫) এর দ্বারা বুঝা গেল যে, আফফান বিন মুসলিম এবং সাঈদ বিন মীনা উভয়ের মাঝে একজন রাবী আছে যার নাম এই সনদে উল্লেখ করা হয় নি। তাই এই হাদীসটি মুনকাতে হয়ে গেল। আর মুনকাতে হাদীস দলীল হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়।
২. হাফেজ ইবনে কাছীর রহ. এই মতটি বর্ণনা করার পর বলেছেন, ‘এই মতটি জমহুরের নিকট প্রসিদ্ধ’ লক্ষণীয় বিষয় হলো, এই মতটিকে তিনি প্রসিদ্ধ বলেছেন বটে কিন্তু বিশুদ্ধ বলেননি; বরং আট তারিখের মতকেই তিনি প্রকারান্তরে বিশুদ্ধ বলেছেন। জেনে রাখা উচিত যে, সব প্রসিদ্ধ বিষয়ই বিশুদ্ধ হয় না; বরং সমাজে অনেক এমন প্রসিদ্ধ বিষয় রয়েছে যা বিশুদ্ধ নয়। আমাদের মনে হয় এখানেও তেমনটিই ঘটেছে।
যাই হোক উপরিউক্ত আলোচনা দ্বারা একথা সাব্যস্ত হল যে, বড় বড় মুহাদ্দিস ইমাম ও ইতিহাসবিদগণের মতে নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম রবিউল আউয়াল মাসের আট তারিখ সোমবার জন্ম গ্রহণ করেছেন। ঐতিহাসিক বিবেচনায় এটাই বিশুদ্ধ অভিমত। বার তারিখের দলীল সম্পর্কীয় হাদীস ‘মুনকাতে’। তাই বার তারিখের অভিমত প্রসিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও বিশুদ্ধ নয়।
জ্যোতির্বিজ্ঞান ও নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম তারিখঃ
নিকট অতীতের ভারত উপ-মহাদেশের কয়েকজন বরণীয় আলমের মতামত হল, নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ৯ই রবিউল আউয়াল সোমবার জন্ম গ্রহণ করেছেন। আল্লামা শিবলী নু‘মানী ও শায়খ সুলাইমান নদভী কর্তৃক যৌথভাবে উর্দূ ভাষায় রচিত ‘সীরাতুন নবী’ নামক গ্রন্থে এবং শায়খ সফীউর রহমান কর্তৃক আরবী ভাষায় রচিত ‘আররাহীকুল মাখতূম’ নামক গ্রন্থে এই মতামত উল্লেখ করা হয়েছে। এই মতের পথে দলীল বর্ণনা করতে গিয়ে ‘সীরাতুন নবীর’ গ্রন্থকার বলেছেন, বিগত শতাব্দীর মিশরের প্রখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী আলেম মাহমূদ পাশা ফালাকী রহ. তার রচিত ‘নাতায়েজুল ইফহাম ফী তাকবীমিল আরব কাবলাল ইসলাম ওয়া ফী তাহকীকে মাউলিদিন নাবিয়্যি আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম’ নামক গ্রন্থে গাণিতিক প্রমাণাদির মাধ্যমে সাব্যস্ত করেছেন যে, নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম মূলত রবিউল আউয়াল এর নয় তারিখ হয়েছে। তিনি দলীল সম্পর্কে যে কয়েক পৃষ্ঠা ব্যাপী আলোচনা করেছেন তার সারাংশ এরূপঃ
১. সহীহ বুখারীতে আছে যে, দশম হিজরীতে যখন নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সর্বকনিষ্ঠ ছেলে ইবরাহীম (রাযি.) ইন্তেকাল করেন তখন সূর্য গ্রহণ হয়েছিল। আর তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বয়স ৬৩ বছর চলছিল।
২. গাণিতিক হিসেবে সাব্যস্ত হয় যে, দশম হিজরীর সেই সূর্য গ্রহণ খ্রিষ্টীয় ৬৩২ সালের জানুয়ারি মাসে সকাল আটটা ত্রিশ মিনিটে হয়েছিল।
৩. চান্দ্র মাস হিসেবে এ সময় থেকে ৬৩ বছর পিছনে ফিরে গেলে দেখা যায় যে, নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম ৫৭১ সালে হয়ে ছিল। আর এ সময় রবিউল আউয়াল মাসের প্রথম তারিখ মোতাবেক ১২ই এপ্রিল হয়।
৪. জন্ম তারিখ সম্পর্কে যদিও মতভেদ রয়েছে, কিন্তু এ ক্ষেত্রে সবাই একমত যে, নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম রবিউল আউয়াল মাসের কোনো এক সোমবার হয়েছে। আর নির্ভরযোগ্য মতগুলো ৮-১২ এর মধ্যে সীমাবদ্ধ।
৫. রবিউল আউয়াল এর ৮-১২ তারিখের মধ্যে সোমবার হয় নয় তারিখ। এসব কারণে নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম খ্রিষ্টীয় ৫৭১ সালের ২০শে এপ্রিল হয়েছিল। (সীরাতুন নবী ১/১১৭)
নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ইন্তেকালের তারিখ
ইন্তেকালের তারিখ সম্পর্কেও মতভেদ রয়েছে। কারো মতে রবিউল আউয়াল এর বার তারিখ সোমবার, কারো মতে রবিউল আউয়াল মাসের দুই তারিখ সোমবার আর কারো মতে রবিউল আউয়াল মাসের এক তারিখ সোমবার নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইন্তেকাল করেছেন। প্রত্যেকেই নিজের দাবির পথে প্রমাণ পেশ করেছেন, কিন্তু বার ও দুই তারিখের পথে যে-সব দলীল পেশ করা হয়েছে তা আমাদের তাহকীক অনুযায়ী বিশুদ্ধ নয় কিংবা যুক্তিযুক্ত নয়। তাই আমরা বার তারিখ এবং দুই তারিখের মতটি গ্রহণ করিনি। আমাদের তাহকীক অনুযায়ী নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম রবিউল আউয়াল মাসের এক তারিখ সোমবার ইন্তেকাল করেছেন। এক তারিখ সম্পর্কীয় দলীল নিম্নে পেশ করা হলোঃ
নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ইন্তেকালের ব্যাপারে যেসব বিষয়ে ইমামগণ একমত তা নিম্নরূপঃ
১. নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম মৃত্যু বরণ করেন ১১ হিজরীতে।
২. রবিউল আউয়াল মাসে।
৩. সোমবার।
৪. এক তারিখ থেকে বার তারিখের মধ্যে মৃত্যুর তারিখ সম্পর্কে হাদীসের মৌলিক গ্রন্থসমূহে স্পষ্ট কোনো বর্ণনা পাওয়া যায় না। সীরাতাজ্ঞ ও ইতিহাসবিদগণ এ সম্পর্কে তিনটি মত উল্লেখ করে থাকেনঃ এক, দুই ও বারই রবিউল আউয়াল। এই তিনটি মতকে সবরকম যাচাই বাছাইয়ের পর ১ম রবিউল আউয়াল এর মতটিই যুক্তিযুক্ত মনে হয়। কেননা সহীহ বুখারীর হাদীসের মাধ্যমে একথা সাব্যস্ত যে, اليوم اكملت لكم دينكم… শীর্ষক আয়াতটি দশম হিজরীর যিলহজ্জ মাসের নয় তারিখ শুক্রবার আরাফার ময়দানে নাযিল হয়েছিল। (বুখারী, কিতাবুত তাফসীর) এই হিসাব ঠিক রেখে চান্দ্রমাসের সাধারণ নিয়ম অনুসরণ করলে রবিউল আউয়াল এর এক তারিখ সোমবার সাব্যস্ত হয়।
নিম্নে বিস্তারিত একটি নকশার মাধ্যমে একথা আরো স্পষ্ট করে দেওয়া হলোঃ
নং | মাসের অবস্থা | রবিউল আউয়াল এর ১ম সোমবারের তারিখ | রবিউল আউয়াল এর ২য় সোমবারের তারিখ | রবিউল আউয়াল এর ৩য় সোমবারের তারিখ |
১ | যিলহজ্জ, মুহাররম, সফর সব ৩০শা | ৬ | ১৩ | ২০ |
২ | যিলহজ্জ, মুহাররম, সফর সব ২৯শা | ২ | ৯ | ১৬ |
৩ | যিলহজ্জ, মুহাররম ২৯শা, সফর ৩০শা | ১ | ৮ | ১৫ |
৪ | যিলহজ্জ ৩০শা, মুহাররম ও সফর ২৯শা | ১ | ৮ | ১৫ |
৫ | যিলহজ্জ ২৯শা, মুহাররম ৩০শা, সফর ২৯শা | ১ | ৮ | ১৫ |
৬ | যিলহজ্জ ৩০শা, মুহাররম ২৯শা, সফর ৩০শা | ৭ | ১৪ | ২১ |
৭ | যিলহজ্জ ৩০শা, মুহাররম ৩০শা, সফর ২৯শা | ৭ | ১৪ | ২১ |
৮ | যিলহজ্জ ২৯শা, মুহাররম ও সফর ৩০শা | ৭ | ১৪ | ২১ |
এই তারিখগুলোর মধ্য থেকে ৬, ৭, ৮, ৯, ১৩, ১৪, ১৫, ১৬, ২০, ও ২১ তারিখ আলোচনার বাহিরে। কেননা এসব তারিখের কোনো প্রবক্তা নেই। (বি.দ্র. নকশায় দেখা যাচ্ছে যে, বার তারিখ কোনো ভাবেই সোমবার হচ্ছে না। তাই বার তারিখ সোমবার না হওয়া আরো স্পষ্টভাবে সাব্যস্ত হল।) এখন রইল শুধু এক আর দুই তারিখ। আমরা নকশায় দেখতে পাচ্ছি যে, এক অবস্থায় দুই তারিখ সোমবার হতে পারে। অর্থাৎ উল্লেখিত তিনটি মাসকে একাধারে উনত্রিশা ধরলে। আর জেনে রাখা উচিত যে, চান্দ্রমাস একাধারে তিনবার উনত্রিশা হওয়া চান্দ্রমাসের সাধারণ নিয়ম এর পরিপন্থী। তাই দুই তারিখের মতটি যুক্তিযুক্ত নয়। পক্ষান্তরে উল্লেখিত তিনটি মাসের যেকোনো দুইটিকে উনত্রিশা ধরলে যিলহজ্জ মাসের নয় তারিখ শুক্রবার হওয়া হিসেবে রবিউল আউয়াল মাসের এক তারিখ সোমবার হয়। আর স্বাভাবিকভাবেও চান্দ্রমাস পর পর দুই বার উনত্রিশা হয় কিংবা একটি উনত্রিশা এবং পরেরটি ত্রিশা হয়ে থাকে। অতএব যুক্তির সাথে সাথে হাফেজ মূসা ইবনে উকবা, লাইস বিন সাআদ, মুহাম্মদ বিন মূসা আলখাওয়ারেযমী প্রমুখ ইমামগণের উক্তি এক তারিখের মতকে সমর্থন করায় আমরা এক তারিখের মতটি গ্রহণ করছি। (সীরাতুন নবী ২/৪৭৭)
তাছাড়া তাফসীরে তবারী ও তাফসীরে ইবনে কাছীরে ইমাম ইবনে জুরাইজ তবারী থেকে বর্ণিত রয়েছে যে, ‘আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দেওয়া হল’ শীর্ষক আয়াতটি নাযিল হওয়ার দিন থেকে নিয়ে ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত মোট একাশি দিন নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম জীবিত ছিলেন।’ (তাফসীরে তবারী ৬/৯৬)
ইমাম ইবনে জুরাইজ এর এই উক্তি অনুযায়ীও উল্লেখিত আয়াত নাযিল হওয়ার দিন থেকে নিয়ে একাশিতম দিন রবিউল আউয়াল এর এক তারিখ সোমবার হয়, যদি জিলহজ্জ, মুহাররাম ও সফর এই তিন মাসের যেকোনো দুইটিকে উনত্রিশা ধরা হয়। অতএব, রবিউল আউয়াল মাসের এক তারিখ সোমবার নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ইন্তেকাল হয়েছে। এটিই বিশুদ্ধ ও যুক্তিযুক্ত মত। আল্লাহ তা‘আলাই ভাল জানেন। বিস্তারিত জানতে দেখুনঃ (‘সীরাতুন নবী’ ২/৪৭৭)