খাদিজা (রাঃ) ও আবু তালেবের ইন্তেকাল

বার্ধক্য, দুশ্চিন্তা, অনিয়ম ইত্যাদি নানাবিধ কারণে রাসূলুল্লাহর চাচা আবু তালিব খুব ভেঙে পড়েছিলেন। তার উপর বয়কট-জীবনের দুঃসহ কষ্ট ও নানাজনিত পীড়ায় তিনি ন্যুব্জ হয়ে যাচ্ছিলেন। অসুস্থতা ক্রমেই বাড়ছিলো। সবাই বুঝতে পারছিলো, আবু তালিবের দিন ঘনিয়ে আসছে। সেই দিন একদিন এলো। প্রিয় একা-ভাতিজাকে আরও একা করে আবু তালিব চলে গেলেন। পাড়ি জমালেন পরপারে।

যখন আবু তালিবের মৃত্যুসময় ঘনালো, তখন নবীজি তাকে বললেন, ‘চাচা, আপনি অন্তত কালিমা পড়ুন, যেন আমি আপনার ব্যাপারে সুপারিশ করতে পারি।’ পাশেই ছিলো আবু জাহল। সে আবু তালিবকে প্ররোচনা দিলো ও ভর্ৎসনা করলো;—বললো, ‘আবু তালিব, শেষ পর্যন্ত তুমি তোমার ধর্ম বিসর্জন দেবে?’ এবং সে আবু জাহলকে নানা অহেতুক কথা বলে ব্যস্ত করে রাখলো। আবু তালিবের মৃত্যুর সময় ইসলামের কালিমা পড়েননি। তাঁর মুখে ‘আবদুল মুত্তালিবের ধর্মের উপর’—এই কথাটি ছিলো।

তবে নবীজির অকৃত্রিম এই অভিভাবকের প্রতি ইসলাম ও তাওহিদের শূন্যতার দরুন লঘু আচরণ করা হবে। রাসূল বলেন, ‘তিনি জাহান্নামের অগভীর স্থানে আছেন। আমি তাঁর সাথে সম্পৃক্ত না হলে জাহান্নামের অতল গভীরই তাঁর স্থান হতো।’

‘যে সময় লোকেরা আমাকে অস্বীকার করলো, সেই সময়ে খাদিজা আমার প্রতি নিটোল বিশ্বাস স্থাপন করলেন; যে সময় লোকেরা আমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করলো, সে সময় তিনি আমাকে দান করলেন; আর লোকেরা যখন আমাকে বঞ্চিত করলো, তখন তিনি আমাকে তাঁর সম্পদে অংশীদার করলেন। আল্লাহ আমাকে তাঁর গর্ভে সন্তানাদি প্রদান করলেন, অন্য কোন স্ত্রীর গর্ভে সন্তান দেন নাই।’—প্রিয়তম স্ত্রী খাদিজার ব্যাপারে এই হলো রাসূলের  ভাষ্য।

নবীজির বয়স তখন পঞ্চাশ, খাদিজার পঁয়ষট্টি।—এই খাদিজা হলেন সেই খাদিজা, যিনি দীর্ঘ পঁচিশ বছর যাবৎ আল্লাহর নবীকে সাহচর্য দিয়ে, সেবা-যত্ন দিয়ে, বিপদাপদে সাহস ও শক্তি দিয়ে, অভাব অনটনে অর্থ-সম্পদ দিয়ে, ধ্যান ও জ্ঞানের প্রয়োজনে প্রেরণা ও পরামর্শ দিয়ে ইসলাম নামক আদর্শ-বীজের অঙ্কুরোদগমে এবং ইসলামের প্রথম সকালে ইসলামকে পরিস্ফুট করে তোলার ক্ষেত্রে রাসূলের অবিচ্ছ্যেদ্য এক অঙ্গ হয়ে ছিলেন। খাদিজারও ফেরার সময় এলো। আবু তালিব চলে গেলেন বেশি কাল হলো না। সেই পথে যাওয়ার তাড়া পেয়ে বসলো খাদিজাকেও। তিনিও তাঁর প্রিয় একা-বন্ধুটিকে ছেড়ে অপার রহস্যের গাঢ় ভুবনে আবাস নিলেন।

আবু তালিব ও খাদিজা অন্তরীণ হতে সময় নিলেন, কিন্তু কাফেররা তাদের কুশ্রী-কুটিল রূপের সর্বশেষ সীমা দেখাতে বিন্দুমাত্র সময় পার করলো না। জিঘাংসার সর্বমুখী গ্রাস নিয়ে তারা ঝাঁপিয়ে পড়লো রাসূল, ইসলাম ও মুসলিমদের উপর। বিমর্ষপ্রাণ নবীজির এই বিভীষিকা-কালে খুব মনে পড়লো বিপদের বন্ধু ও অভিভাবক চাচা আবু তালিব ও স্ত্রী খাদিজাকে; কিন্তু তাঁরা তো তখন দূর-আকাশের তারা। নবীজি এই কষ্টের কালকে বললেন ‘আম্মুল হুজুন’—শোকের বছর।