একাদশ হিজরিতে নবীজি ও তাঁর মহাপ্রয়াণ

মক্কা হতে ফিরে এসে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একাদশ হিজরির ২৬শে সফর সোমবার দিন রোমানদের বিরুদ্ধে জিহাদের উদ্দেশ্যে একটি অভিযান প্রস্তুত করেন। যে অভিযানে হযরত সিদ্দিকে আকবর, হযরত ফারুকে আযম ও হযরত আবু উবাইদার ন্যায় প্রবীণ সাহাবিগণ শামিল ছিলেন। এ অভিযানের নেতৃত্ব অর্পিত হয় অপেক্ষাকৃত তরুণ সাহাবি হযরত উসামার উপর। এটাই ছিলো সর্বশেষ অভিযান, যা প্রেরণের সকল ব্যবস্থা নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে সম্পন্ন করেন। এ কাফেলা রওনা হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে নবীজি জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়েন।

একাদশতম হিজরির ২৮শে সফর দিবাগত রাতে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাকি গরকাদ নামক গোরস্তানে গমন করে কবরবাসীদের উদ্দেশ্যে মাগফিরাতের দুআ করেন, ‘হে কবরবাসীগণ, তোমাদের বর্তমান অবস্থা এবং কবরের অবস্থান শুভ হোক।’

সেখান থেকে ফিরে আসার পর তিনি মাথাব্যথা অনুভব করেন এবং সাথে সাথে জ্বরও এসে পড়ে। এ জ্বর ক্রমাগত ১৩ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয় এবং এ জ্বরেই নবীজি ইন্তেকাল করেন। এ সময় নবীজি তাঁর অভ্যাস মাফিক প্রত্যহ তাঁর পূত-পবিত্র স্ত্রীগণের হুজরায় যান।যখন তাঁর অসুস্থতা দীর্ঘ ওকঠিন আকার ধারণ করলো, তখন, অসুস্থতার দিনগুলোতে হযরত আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহার ঘরে অবস্থান করার জন্য অন্যান্য স্ত্রীগণের নিকট অনুমতি চাইলে সকলেই অনুমতি দিয়ে দিলেন।

অসুস্থতা ধীরে ধীরে এত প্রবল আকার ধারণ করলো যে, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আর মসজিদে যেতে পারছিলেন না। তখন তিনি এরশাদ করলেন,‘আবু বকরকে বলো, সে যেন নামাযেরইমামতি করে।’ হযরত সিদ্দিকে আকবর নবীজির জীবদ্দশায় প্রায় ১৭ ওয়াক্ত নামাযের ইমামতি করেন।

এ সময় একদিন হযরত সিদ্দিকে আকবর ও হযরত আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা আনসারদের একটি মজলিসের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখতে পেলেন যে, তাঁরা কাঁদছেন। কাঁদার কারণ জানতে চাইলে তাঁরা বললেন, ‘নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মজলিসের কথা স্মরন করে আমরা কাঁদছি।’ হযরত আব্বাস নবীজিকে খবর দিলে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আলি ও হযরত ফযল রাযিয়াল্লাহু আনহুমার কাঁধে ভর দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন। নবীয়ে করিম মিম্বরে আরোহণ করতে চাইলেন, কিন্তু দুর্বলতার কারণে নিচের সিঁড়িতে বসে পড়লেন, অতঃপর গুরুত্বপূর্ণ একটি ভাষণ দিলেন—

‘হে লোকসকল, আমি জানতে পেরেছি যে,তোমরা তোমাদের নবীর মৃত্যুর ব্যাপারে আশঙ্কা করছো। আমার পূর্বে কি কোনো নবী চিরদিন ছিলেন, যে, আমিও থাকবো? হ্যাঁ, আমি আমার পরওয়ারদিগারের সাথে মিলিত হওয়ার জন্য যাচ্ছি এবং তোমরাও আমার সাথে মিলিত হবে। তোমাদের সাথে আমার মিলনের স্থান হাউজে কাউসার। অতএব, তোমাদের মধ্যে যে হাউজে কাউসার থেকে পরিতৃপ্ত হয়ে পানি পান করার বাসনা রাখে, সে যেন হাত ও মুখকে অপ্রয়োজনীয় কাজ ও কথা থেকে বিরত রাখে। আমি তোমাদেরকে মুহাজিরদের সাথে উত্তম ব্যবহারের ওসিয়ত করছি।

যখন লোকেরা আল্লাহর আনুগত্য করে, তখন তাদের শাসক ও বাদশা তাদের সাথে ন্যায়ানুগ আচরণ করে। আর যখন তারা তাদের পালনকর্তার অবাধ্যতা করে, তখন তাদের শাসকরাও তাদের সাথে নিষ্ঠুর আচরণ শুরু করে দেয়।’

এরপর তিনি ঘরে ফিরে এলেন; মৃত্যুর তিন কিংবা পাঁচদিন পূর্বে আরও একবার বাইরে এলেন, তখন তাঁর মাথায় পট্টি বাঁধা ছিলো, সিদ্দিকে আকবর নামায পাড়াচ্ছিলেন। নবীজির আগমনের বিষয়টি টের পেয়ে তিনি পেছনে সরে আসতে লাগলে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে হাতের ইশারায় বারণ করলেন এবং নিজে তাঁর বামপাশে বসে গেলেন। নামাযের পর একটি সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিলেন; তিনি এরশাদ করলেন, ‘আমার প্রতি আবু বকরের অনুগ্রহ সবার চেয়ে বেশি। মহান আল্লাহ ব্যতীত আমি যদি অন্য কাউকে খলিল বা অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতাম, তবে আবু বকরকেই করতাম। কিন্তু আল্লাহ তাআলা ব্যতীত আর কেউ যেহেতু খলিল হতে পারে না, তাই আবু বকর আমার দ্বীনি ভাই ও বন্ধু।’ তিনি আরও বললেন,‘আবু বকরের দরজা ছাড়া মসজিদে নববির দিকে আর যতগুলো দরজা রয়েছে, বন্ধ করে দেওয়া হোক।’ এই হাদিসে মূলত নবীজির পরে হযরত আবু বকর খলিফা হবেন, এই বিষয়ের ইঙ্গিত রয়েছে।

এরপর রবিউল আউয়ালের দ্বিতীয় তারিখ সোমবার লোকেরা যখন হযরত আবু বকরের পেছনে ফজরের নামায আদায় করছিলেন, তখন হঠাৎ নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহার কক্ষের পর্দা উঠিয়ে লোকদের দিকে তাকালেন এবং মুচকি হাসলেন। লক্ষ করে হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু পেছনে সরে আসতে চাইলেন এবং আনন্দের আতিশয্যে সাহাবাদের মন নামাযের মধ্যে এলোমেলো হয়ে যেতে লাগলো। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদেরকে হাতের ইশারায় নামায পূর্ণ করার নির্দেশ দিয়ে ভেতরে চলে গেলেন এবং পর্দা নামিয়ে দিলেন। এরপর আর কখনও তিনি বাইরে আসেননি, হঠাৎ কোনো নামাযে তুলে ধরেননি আয়েশার কক্ষের পর্দা, মুচকি হেসে সাহাবাদের মনে এনে দেননি আনন্দের এলোমেলো অতিঝড়; বরং এ দিন তিনি চলে গেলেন—চলে গেলেন মাটির পৃথিবী ছেড়ে তাঁর খলিল, তাঁর রফিকে আলা, তাঁর মহামান্য রব আল্লাহ তাআলার সান্নিধ্যে। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিলো ৬৩ বছর।

 তথ্যসূত্র :সিরাতে খাতামুল আম্বিয়া, মুফতি শফি।