মানব জাতির সৃষ্টিলগ্ন থেকেই চলে আসছে হক্ব ও বাতিলের দ্বন্দ ও সংঘাত। যুগে যুগে এ দ্বন্দ ও সংঘাতকে মিটিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য পৃথিবীতে আগমন করেছেন অসংখ্য নবী-রাসূল, ওলামা-মাশায়েখ সংগ্রমী ও মহাপুরুষগণ। বাতিলের অবসান ঘটিয়ে হক্ব প্রতিষ্ঠা করতে সবাই করেছেন আমরণ সংগ্রাম।
বর্তমানেও বাতিলের সয়লাবে আচ্ছাদিত হয়ে আছে আমাদের দেশ ও সমাজ। আজ থেকে প্রায় চৌদ্দশত বছর পূর্বে বিশ্বমানবতার মুক্তির কান্ডারী, নবীয়ে কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পবিত্র যবান থেকে নিসৃত হয়েছে অমীয় বাণী, “আমার উম্মত এমন এক যমানার সম্মুখীন হবে যখন ঈমান নিয়ে টিকে থাকা জলন্ত অঙ্গার হাতে রাখার ন্যায় কষ্টকর হবে”। -সুনানে তিরমিযী: হা. নং-২২৬০, মুসনাদে আহমাদ: হা. নং-৯০৭৩।
সেই মহামানবের চিরন্তন বাণীর জলন্ত বাস্তবায়ন মনে হয় বর্তমান মুসলিম উম্মাহর ক্ষণে ক্ষণে অনুভব হচ্ছে। দেশী-বিদেশী, জাতি-বিজাতী চতুর্মূখী হায়েনাদের আগ্রাসনে ক্ষত-বিক্ষত আজ মুসলিম উম্মাহর সস্তির নিংশ্বাস ত্যাগ করার স্থানটুকুও নেই। নেই ঈমান-আকীদা নিয়ে বেঁচে থাকার মত সুন্দর ও নিরাপদ কোন পরিবেশ। চারিদিকে চলছে ধর্মের মনগড়া ব্যাখ্যা ও বাড়াবাড়ি। যার ফলে আজ দীনের নামে বদ-দীন এবং শিরক, বিদ‘আত ও কুসংস্কারে ছেয়ে গেছে সমাজ।
এমনি এক বহুল প্রচলিত বিদ‘আত ও কুসংস্কার হল, নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে হাযির-নাযির বলে বিশ্বাস করা। এর ভ্রান্তি সম্পর্কে এখানে সংক্ষিপ্ত কিছু আলোচনা করা হল:-
হাযির ও নাযির (حاضر و ناظر) শব্দ দু’টি আরবী শব্দ। হাযির অর্থ সর্বস্থানে সর্বাবস্থায় উপস্থিত বা বিদ্যমান। আর নাযির অর্থ সর্বদ্রষ্টা। যখন এ দু’টি শব্দকে একত্রে মিলিয়ে ব্যবহার করা হয়, তখন অর্থ হয় ঐ সত্ত্বা; যার অস্তিত্ব বিশেষ কোন স্থানে সীমাবদ্ধ নয় বরং তাঁর অস্তিত্ব একই সময়ে গোটা দুনিয়াকে বেষ্টন করে রাখে এবং দুনিয়ার প্রত্যেকটি জিনিষের শুরু থেকে শেষ অবস্থা পর্যন্ত তাঁর দৃষ্টির সামনে থাকে।
হাযির নাযির সম্পর্কে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের আকীদা:
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের সকলেই একমত যে, পূর্বোক্ত ব্যাখ্যা অনুসারে হাযির-নাযির কথাটি একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার ব্যাপারেই প্রযোজ্য হয়। হাযির-নাযির হওয়া একমাত্র আল্লাহ তা‘আলারই সিফাত। আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্য কেহ এসব গুনের অধিকারী হতে পারে না। এমনকি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বা কোন পীর-বুযুর্গ, ওলী-দরবেশও হাযির-নাযির হতে পারে না। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বা কোন পীর-বুযুর্গ, ওলী-দরবেশকে হাযির-নাযির বলে বিশ্বাস করা কুফুর ও শিরকের শামিল এবং ইসলামী আক্বীদার পরিপন্থী কাজ।
হাযির-নাযির সম্পর্কে বিদ‘আতীদের আকীদা:
বিদ‘আতীদের আকীদা হল, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাযির-নাযির বা সর্বত্র বিরাজমান। তাদের এই বিশ্বাসের পেছনে মীলাদে ‘কিয়াম’ করার স্বপক্ষে দলীল দাঁড় করানোর চিন্তা-চেতনা কাজ করছে। তা এভাবে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নামে দুরূদ পাঠ করা হলে, তিনি তা জানেন এবং দেখেন। কারণ তিনি সর্বত্র বিরাজমান। তাই তাঁর উপস্থিতিতে ‘কিয়াম’ করতে হবে। তাদের আকীদা মতে শুধু নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামই নন; বরং সকল বুযুর্গানে দীনও হাযির-নাযির সর্বত্র বিদ্যমান। তারাও পৃথিবীর সব কিছুকে হাতের তালুর মত দেখতে পান। তারা দূরের ও কাছের আওয়াজ শুনতে পান। মুহুর্তের মধ্যে গোটা বিশ্ব ভ্রমণ করতে পারেন এবং হাজার হাজার মাইল দূরের হাজতমন্দ ব্যক্তির হাজত পূরণ করতে পারেন।
খন্ডন: নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাযির-নাযির এ কথার দ্বারা যদি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সর্বত্র শারীরিকভাবে বিদ্যমান থাকা উদ্দেশ্য হয়, তাহলে তা অযৌত্তিক এবং সুস্পষ্ট ভ্রান্তি বৈ কিছুই নয়। কারণ এ কথা সর্বজনস্বীকৃত যে, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম রওযা মুবারকে আরাম করছেন এবং সমস্ত আশেকীনে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেখানে গিয়ে হাজিরা দেন, তাঁর রওযা মুবারক যিয়ারত করেন। আর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বত্র ‘হাযির-নাযির’ দ্বারা যদি তাঁর ‘রূহানী হাজিরী’ উদ্দেশ্য হয়ে থাকে অর্থাৎ এটা বোঝানো হয় যে, দুনিয়া থেকে চলে যাওয়ার পর নবী করীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পবিত্র রূহের জন্য সর্বস্থানে বিচরণ করার অনুমতি রয়েছে, তাহলে বলা হবে, সর্বস্থানে বিচরণের অনুমতি থাকার দ্বারা বাস্তবেই সর্বস্থানে উপস্থিত থাকা জরূরী নয়। বরং তিনি রওযা মুবারকে আরাম করছেন। অতএব এখন যদি কেউ অন্য কোন নির্দিষ্ট স্থানে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উপস্থিতির কথা দাবী করে, তাহলে সেটা হবে একটা স্বতন্ত্র দাবী। এর স্বপক্ষে দলীল চাই। অথচ এর স্বপক্ষে কোন দলীল নাই। সুতরাং দলীল বিহীন এমন আকীদা পোষণ করা না-জায়িয হবে। আর বিদ‘আতীরা তাদের দাবীর পক্ষে যে, দলীল পেশ করে থাকে তার দ্বারা কোনভাবেই হুজুর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে, ‘হাযির-নাযির’ তা সাব্যস্ত হয় না।
বিদ‘আতীদের দলীল ও তার খন্ডনঃ
১ নং দলীলঃ বিদ‘আতীরা তাদের দাবীর পক্ষে সবচেয়ে জোরালোভাবে যে দলীল পেশ করে থাকে তা হল, সূরা আহযাবের একটি আয়াত যাতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে কয়েকটি দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আয়াতের অর্থ হল: “হে নবী! আমি তো আপনাকে পাঠিয়েছি ‘শাহিদ’ (তথা সাক্ষ্যদাতা), সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে এবং আল্লাহর নির্দেশে মানুষকে আল্লাহর দিকে আহ্বানকারী ও আলো বিস্তারকারী প্রদীপরূপে”। -সূরা আহযাব: ৪৫-৪৬।
এখানে হুজুর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে ‘শাহিদ’ (شاهد) বলা হয়েছে, যার অর্থ ‘সাক্ষ্যদাতা’ও হতে পারে আবার ‘হাযির-নাযির’ ও হতে পারে। সাক্ষ্যদাতাকে ‘শাহিদ’ এজন্য বলা হয় যে, সে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে ঘটনা প্রত্যক্ষ করে সাক্ষ্য দিচ্ছে। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে ‘শাহিদ’ এ কারণে বলা হয়েছে যে, তিনি গায়েব (অদৃস্য বিষয়কে) দেখে সাক্ষ্য দেন। অন্যথায় অন্যান্য নবীগণ তো সাক্ষ্য প্রদান করে থাকেন। তাহলে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও অন্যান্য নবীগণের মাঝে পার্থক্য থাকল কোথায়?
অথবা এ কারণে ‘শাহিদ’ বলা হয়েছে যে, তিনি কিয়ামতের দিন সকল নবীর পক্ষে চাক্ষুস সাক্ষ্য প্রদান করবেন। আর এ সাক্ষ্য দেওয়া দেখা ছাড়া সম্ভব নয়। আর এটাই হুজুর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাযির-নাযির হওয়ার প্রমাণ।
অনুরূপভাবে হুজুর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মুবাশশির (সুসংবাদদাতা), নাযীর (সতর্ককারী) এবং দায়ী ইলাল্লাহ (মানুষকে আল্লাহর দিকে আহ্ববানকারী) হওয়াও তাঁর হাযির-নাযির হওয়ার প্রমাণ বহন করে। কেননা এসব কাজ তো অন্যান্য নবীগণ করেছেন। বাকি তাঁরা করেছেন শুনে-শুনে আর হুজুর এসকল কাজ করেছেন দেখে-দেখে।
অনুরূপ এ আয়াতে হুজুর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে ‘সিরাজ’ ও ‘মুনীন’ (তথা আলো বিস্তারকারী প্রদীপ) বলা হয়েছে। যার অর্থ সূর্য। এটা প্রথিবীর সর্বস্থানে বিদ্যমান, প্রত্যেক ঘরে ঘরে বিদ্যমান। তদ্রুপ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামও সর্বস্থানে বিদ্যমান। সুতরাং এই আয়াতের প্রত্যেকটি বাক্য থেকে হুজুর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ‘হাযির-নাযির’ হওয়া প্রামাণিত হয়।
জবাব: বিদ‘আতী ভায়েরা এ সত্যটুকুও অনুধাবন করতে পারেননি যে, সূর্য সর্বস্থানে বিদ্যমান নয়; বরং যেখানে দিন সূর্য শুধু সেখানেই বিদ্যমান থাকে। আর যেখানে রাত সেখানে সূর্য অবিদ্যমান। সুতরাং এই উপমার মাধ্যমে বিদ‘আতীদের দাবী প্রমাণিত হয় না; বরং এর বিপরীতে তার বক্তব্য দ্বারাই নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সর্বত্র হাযির-নাযির না হওয়া প্রমাণিত হয়। আর নবীগণ গায়েব সম্পর্কে সংবাদ প্রদান করেন, এর দ্বারা কিয়ামত পর্যন্ত তাঁদের সবকিছু জানা ও দেখা প্রমাণিত হয় না। বরং আল্লাহ তা‘আলার ওহী ও ইলমের মাধ্যমে যতটুকু জানেন তাঁরা শুধু ততটুকুই অবগত হয়ে থাকেন এর বেশি নয়।
অনুরূপভাবে বিদ‘আতীরা ‘শাহিদ’ শব্দের যে অর্থ ও ব্যাখ্যা করেছেন তা সম্পূর্ণ বানোয়াট ও প্রবৃত্তি নির্ভর বৈ কিছুই না। কারণ ‘শাহিদ’ শব্দটি ইসমে ফায়েলের সীগা। যার অর্থ নিশ্চিত ও সঠিক সংবাদ প্রচার করা। এর জন্য সাক্ষ্যদাতাকে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে ঘটনা প্রত্যক্ষ করে সাক্ষ্য দেওয়া জরূরী নয়। কারণ অন্যের মাধ্যমে কোন কিছু নিশ্চিতভাবে জেনেও তার সংবাদ দেওয়াকে শাহিদ বলা হয়।
২ নং দলীলঃ বিদ‘আতীরা হুজুর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাযির-নাযির পক্ষে যেসব হাদীসে হুজুর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভবিষ্যত বাণী ইরশাদ করেছে। যেমন একটি হাদীস, “আমি তোমাদের ঘরে বৃষ্টির ন্যায় ফেতনা পড়তে দেখছি”। এছাড়া জান্নাত-জাহান্নাম, হাউযে কাউসার, বরযখ ইত্যাদির খবর প্রদান সম্বলিত হাদীস সমূহ তাঁর হাযির-নাযির হওয়ার পক্ষে পেশ করে থাকে। যার দ্বারা বুঝা যায় যে, হুজুর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ‘হাযির-নাযির’ এর ক্ষমতা দিয়েছেন।
জবাবঃ এ ব্যাপারে শেখ সা‘দী রহ: সুন্দর বলেছেন, “কেউ হযরত আ: কে জিজ্ঞাসা করেছেন ব্যাপর কি? শত সহস্র মাইল দূরে মিসর থেকে হযরত ইউসূফ আ: এর জামার ঘ্রাণ পান। অথচ কেনানের নিকটে এক কুপে হযরত ইউসূফের ভাইয়েরা যখন তাকে নিক্ষেপ করলো আপনি তা দেখতে পেলেন না? উত্তরে তিনি বললেন, আমাদের অবস্থা হল আকাশে চমকানো বিদ্যুতের ন্যায়। যা উদ্দীপ্ত হয়েই নিভে যায় (অর্থাৎ যখন আল্লাহ তা‘আলার মেহেরবানীর ফয়জান হয়, তখন আমরা দূর-দূরান্ত পর্যন্ত দেখতে পাই। তবে এ অবস্থা বেশিক্ষণ স্থায়ী থাকে না, অল্প সময় পরই শেষ হয়ে যায়।) কখন আমরা বহু উঁচু আসনে বসি, আবার কখন আমার নিজের পায়ের পিঠ পর্যন্তও দেখতে পাই না”। -গুলিস্তা: খ. ২, পৃ. ৭৩। সারকথা ঐ কথাগুলী তিনি নিজের পক্ষ থেকে বলেননি বরং আল্লাহ তা‘আলা তাকে জানিয়েছেন ওহীর মাধ্যমে এবং ঐ কথাগুলী উম্মতকে জানানোর জন্য আদেশ করেছেন। এর দ্বারা স্পষ্ট বুঝে আসে যে, নবীগণ হাযির-নাযির নন; বরং তাদেরকে যতটুক জানানো হয়, তাঁরা শুধু ততটুকুই জেনে থাকেন।
এছাড়াও বিদ‘আতীরা আরো অনেক আয়াত ও হাদীসের দ্বারা হুজুর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাযির-নাযির হওয়ার পক্ষে দলীল পেশ করে থাকে, যেখানে তারা কুরআন ও হাদীসের ভুল ব্যাখ্যা ও প্রবৃত্তির শরনাপন্ন হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এর কোনটির দ্বারাই তাঁর ‘হাযির-নাযির’ হওয়া প্রমাণিত হয় না।
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের দলীলঃ
১ নং দলীলঃ আল্লাহ তা‘আলা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে হযরত মূসা ‘আলাইহিস সালাম-এর ঘটনা সম্পর্কে অবগত করতে গিয়ে ইরশাদ করেন, “আর আপনি (তূর পর্বতের) পশ্চিম পার্শে উপস্থিত ছিলেন না, যখন আমি মূসা ‘আলাইহিস সালাম-এর কাছে হুকুম প্রেরণ করি। আপনি তা প্রত্যক্ষও করেননি। -সূরা কাসাস: ৪৪
একটু চিন্তা করুন! স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনের আয়াত নাযির করে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হযরত মূসা ‘আলাইহিস সালাম এর নবুওয়াত প্রাপ্তির ঘটনা শুনিয়ে বলছেন, আপনি তূর পর্বতের পশ্চিম পার্শ্বে হাযিরও ছিলেন না নাযিরও ছিলেন না অর্থাৎ ঘটনাস্থলে স্বশরীরে উপস্থিত ছিলেন না এবং ঘটনা প্রত্যক্ষও করেননি। তাই কুরআনের আয়াত নাযিল করে আমি আপনাকে সেই ঘটনা শুনাচ্ছি। কিন্তু আমার বিদ‘আতী ভায়েরা আজ দূর থেকেই বলতে চাচ্ছেন যে, তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন এবং তা প্রত্যক্ষ করেছেন। কুরআন-হাদীস সম্পর্কে কি পরিমাণ অজ্ঞ হলে মানুষ এমন কথা বলতে পারে?
এখানে আল্লাহ তা‘আলা নিজেই স্পষ্ট করে বলে দিলেন যে, হযরত মূসা ‘আলাইহিস সালাম এর নবুওয়াত প্রাপ্তির সময় আপনি তূর পর্বতের পশ্চিম পার্শ্বে হাযিরও ছিলেন না নাযিরও ছিলেন না। রাসূল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যদি হাযির নাযির হতেন, তাহলে একথার কোন অর্থ থাকত না।
২ নং দলীলঃ অপর আরেক স্থানে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন, “আপনার আশপাশের পল্লীবাসী ও মদীনাবাসীর মাঝে এমন কিছু মুনাফিক রয়েছে যারা মুনাফিকতায় সিদ্ধ। আপনি তাদেরকে জানেন না। আমি তাদেরকে জানি”। -সূরা তাওবা: ১০১
৩ নং দলীলঃ আল্লাহ তা‘আলা হুজুর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হযরত ইউসুফ ‘আলাইহিস সালাম ও তাঁর ভাইদের ঘটনা বিস্তারিত জানানোর পর ইরশাদ করেন, “(হে নবী) এসব অদৃশ্য সংবাদসমূহের একটি কাহিনী, যাহা আমি ওহীর আপনাকে জানাচ্ছি, আর আপনি সেই সময় তাদের নিকট উপস্থিত ছিলেন না যখন তারা ষড়যন্ত্র করে নিজেদের সিদ্ধান্ত স্থির করে ফেলেছিল (যে তারা ইউসুফকে কুয়ায় ফেলে দিবে)”। -সূরা ইউসুফ: ১০২
এখানে আল্লাহ তা‘আলা হুজুর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে উদ্দেশ্য করে বলেন, হে নবী হযরত ইউসুফ আ: এর দশ ভাই মিলে যখন হযরত ইউসুফ আ: কে কুপে নিক্ষেপ করার ষড়যন্ত্র করে ছিল তখন আপনি সেখানে হাযির ছিলেন না এবং এ ঘটনার নাযিরও ছিলেন না, তাই ওহী নাযিল করে আপনাকে আমি তাঁর কাহিনী অবগত করছি।
৪ নং দলীলঃ হযরত মারয়াম রা: এবং হযরত যাকারিয়া ‘আলাইহিস সালাম-এর ঘটনা অবগত করার পর ইরশাদ করেন, “(হে নবী) এসব অদৃশ্যের সংবাদ, যা ওহীর মাধ্যমে আপনাকে দিচ্ছি। তখন আপনি তাদের কাছে ছিলেন না, যখন কে মারয়ামের তত্ত্বাবধান করবে- (এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য) তারা নিজ-নিজ কলম নিক্ষেপ করছিলেন এবং তখনও আপনি তাদের কাছে (হাযির) ছিলেন না, যখন তারা (এ বিষয়ে) একে অন্যের সাথে বাদানুবাদ করছিল (তখন আপনি ঘটনার নাযিরও ছিলেন না)”। -সূরা আলে-ইমরান: ৪৪
৫ নং দলীলঃ অনুরূপভাবে হুজুর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই তাঁর হাযির-নাযির হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন, হযরত আব্দুল্লাহ রা: হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন যে, আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীনের পক্ষ হতে পৃথিবীতে বিচরণকারী কিছু ফেরেশতা নিয়োগ করা হয়েছে, যারা (পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত হতে) আমার উম্মতের প্রেরিত সালাম আমার নিকট পৌঁছে দেয়। -নাসায়ী শরীফ: হা. নং- ১২৮২, মুস্তাদরাকে হাকেম: হা. নং- ৩৫৭৬
হুজুর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাযির-নাযিরই হন, তাহলে ফেরেশতাদের মাধ্যমে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট সালাম পৌঁছানোর প্রয়োজনটা কী? এ ধরণের অসংখ্য ঘটনা হাদীসের কিতাবের পাতায় পাতায় বিদ্যমান যার দ্বারা স্পষ্ট বুঝা যায় যে তিনি হাযির-নাযির নন।
সুতরাং এসকল কুরআনের আয়াত ও হাদীস দ্বারা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট প্রমাণিত হয়ে যায় যে, হুজুর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ‘হাযির-নাযির’ নন বরং আল্লাহ তা‘আলা ওহীর মাধ্যমে যতটুকু অবগত করেন, তিনি ততটুকুই জানেন, এর বেশি কিছুই তিনি জানেন না। তাকে হাযির-নাযির বিশ্বাস করা শিরকী আকীদা, যার দ্বারা ঈমান নষ্ট হয়ে যায়। এরূপ ব্যক্তি তাওবা করে নতুনভাবে ঈমান না আনলে সে কক্ষনো বেহেস্তে যেতে পারবেনা।