হক্কানী উলামায়ে কেরামের নিদর্শন – মুফতী মনসূরুল হক (দা.বা)

১. হক্কানী উলামায়ে কিরাম আপন ইলম দ্বারা দুনিয়া উপার্জন করেন না। আলেম হলে কমপক্ষে দুনিয়ার প্রতি ঘৃণা, উহার অপবিত্রতা ও হীনতার অনুভূতি থাকতে হবে। আর আখেরাতের আযমত, উহার স্থায়িত্ব ও উহার নিয়ামতের পবিত্রতার অনুভূতি থাকতে হবে। এ কথা উপলব্ধি করে যে, দুনিয়া এবং আখেরাত দুটি বিপরীতমুখী বস্তু, দুই সতীনের সমতুল্য। একজনকে রাজী করলে অপরজন নিশ্চয় অসন্তুষ্ট হবে। হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, হুযূর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি এমন ইলম যা দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায় তা শুধু দুনিয়া পাওয়ার জন্য অর্জন করে সে কিয়ামতের দিন জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না।” (আবু দাউদ হাঃ নং-৩৬৬৪, মুস্‌তাদরাকে হাকেম-১/৮০)

উল্লেখ্য, এর দ্বারা মসজিদে ইমামতী বা মাদ্‌রাসায় শিক্ষকতা করে বিনিময় নিষেধ করা হয়নি বরং ইলম শিখেও ইল্‌মী খেদমত সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করে নিরেট দুনিয়া উপার্জনে মশগুল হওয়া, যেমন বিদেশে গিয়ে টাকা উপার্জনে মশগুল হওয়া, অনুরূপ ইলমের দ্বারা আমীর উমারা বা ভ্রান্ত ব্যক্তি বা দলের দালালীর বিনিময় গ্রহণ বুঝানো হয়েছে। (সংকলক)

২. তাঁদের কথা ও কাজে গরমিল না হওয়া অর্থাৎ, এমন না হওয়া যে অপরকে নছীহত করে অথচ নিজে আমল করে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “কী গজবের কথা যে, অন্যকে উপদেশ দিচ্ছো আর নিজের খবর নিচ্ছো না! অথচ তোমরা আল্লাহর কিতাবও পাঠ করে থাকো। (সূরায়ে বাক্বারা, আয়াত-৪৪)

৩. তাঁরা এমন ইলমে মশগুল হবে যা পরকালে কাজে আসবে ও নেক কাজে আগ্রহী হবে। এমন ইলম হতে বেঁচে থাকবে যা দ্বারা পরকালে কোন ফায়দা হবে না। বা হলেও খুব কম। যে বিদ্যা দ্বারা দুনিয়া উপার্জন করা হয়, আমরা মূর্খতা বশতঃ উহাকেও ইলম মনে করি, অথচ উহা ইলম নয়।

৪. তাঁরা উন্নতমানের খানাপিনা ও পোষাক-পরিচ্ছদের চাকচিক্যের দিকে মনোযোগী হবে না, বরং এসব ব্যাপারে মধ্যমপন্থা ও বুযুর্গানের তরীকা গ্রহণ করবে। এসব ব্যাপারে যত বেশী সাধারণ বস্তুর দিকে তার লক্ষ্য হবে তত বেশী আল্লাহর নৈকট্য লাভ হবে ও আখেরাতে তার মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি. বলে, ‘তোমরা আল্লাহ তা‘আলার ব্যাপারে যথাযথ ভাবে লজ্জাবোধ কর। বর্ণনাকারী বলেন, আমরা তো আল্লাহর ব্যাপারে লজ্জাবোধ করে থাকি। প্রতিউত্তরে তিনি বলেন, বিষয়টা এমন নয়, বরং আল্লাহ তা‘আলার ব্যাপারে যথাযথ লজ্জিত হওয়ার অর্থ হল, মাথাকে এবং মাথা যা কিছু সংরক্ষণ করে তাকে হিফাযত করা, উদর ও উদরের চাতুরি থেকে বেঁচে থাকা, এবং মৃত্যু ও মৃত্যুর পরের জীবনকে স্মরণ করা, আর যে ব্যক্তি পরকালের সফলতা চায় সে দুনিয়ার চাকচিক্য বর্জন করে, যে ব্যক্তি এরূপ করল সেই মূলত আল্লাহর ব্যাপারে যথাযথ লজ্জাবোধ করল।” (তিরমিযী শরীফ- পৃষ্ঠাঃ ৫৫৪, হাদীস নং-২৪৫৮, মুসনাদে আহমাদ-১/৩৮৮ হাদীস নং-৩৬৭১)

৫. তাঁরা বাদশাহ ও সরকারী কর্মকর্তাদের নিকট হতে দূরে থাকবে। দীনী প্রয়োজন ছাড়া তাদের নিকট মোটেই যাবে না, স্বয়ং তারা আসলে খুব কমই সাক্ষাত দিবে। কেননা তাদের সহিত মেলামেশায় অনেক ক্ষেত্রে তাদের মিথ্যা প্রশংসা করতে হয়, তাদের অন্যায় আচরণের প্রতি বাধা দেয়া জরুরী হওয়া সত্ত্বেও বাধা দেয়া মুশকিল হয়। আবার তাদের মালের প্রতিও লোভ জন্মে যা একেবারেই নাজায়েয। মুলকথা আমীরদের সংশ্রব হল অনেক অন্যায়ের চাবিকাঠি। হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, “যে ব্যক্তি মাঠে ময়দানে থাকে সে রুক্ষ মেজাযী হয়। যে শিকারের পিছনে লাগে সে যাবতীয় কাজ হতে গাফেল হয়ে যায়। আর যে রাজ দরবারে আনাগোনা শুরু করে সে ফেতনায় পড়ে যায়।” (আবু দাউদ শরীফ-৪৩৫ হাদীস নং ২৮৫৯, তিরমিযী শরীফ হাদীস নং ২২৫৬, নাসাঈ শরীফ হাদীস নং ৪৩০৯, মুসনাদে আহমাদ- ২/২৭৪ হাদীস নং ৮৮২২)

৬. তাঁরা ফাতাওয়া দেয়া বা মাসআলা বয়ান করার সময় খুব সতর্ক থাকে, বরং যথাসম্ভব কোন সমস্যার সমাধানপ্রার্থী আসলে তার চেয়ে আরও উপযুক্ত আলেমের নিকট তাকে সোপর্দ করে দেয়।

৭. তাঁরা বাতেনী ইলম অর্থাৎ, কলবের ইসলাহ-আত্মশুদ্ধি প্রতি বেশী যত্নবান হয়। এতে জাহেরী ইলম উন্নতি লাভ করে। (আর আমল তখনই নসীব হয় যখন বান্দা আত্মশুদ্ধি ব্যাপারে যত্নবান হয়। (সংকলক)

৮. আল্লাহ তা‘আলার উপর তাঁদের ঈমান ও ইয়াক্বীন অধিক পরিমান হবে। (গায়রুল্লাহ তথা আসবাবের উপর তাঁদের ভরসা থাকে না।) (সংকলক)

৯. তাঁদের প্রতিটি কাজকর্মে আল্লাহর ভয় প্রকাশ পেতে থাকে। আল্লাহর আযমত ও বড়ত্বের প্রভাব সেই ব্যক্তির পোষাক, অভ্যাস, কথা-বার্তা, চুপ থাকা ইত্যাদিতে প্রকাশ পাবে। তাদের সূরত দেখলে আল্লাহর স্মরণ তাজা হবে। নম্রতা, ভদ্রতা, বিনয়, সহনশীলতা তাঁদের অভ্যাসে পরিণত হবে। বেহুদা কথা ও ঠাট্টা-মস্কারী হতে বেঁচে থাকবে। কেননা, এগুলো অহংকারের চি‎হ্ন ও আল্লাহর প্রতি নির্ভয়ের নিদর্শন।

১০. তাঁদের অধিক মনযোগ হল ঐসব মাসআলার প্রতি যা জায়েয-নাজায়েয বিষয়ক আমলের সহিত সম্পর্কযুক্ত। যেমন, অমুক জিনিস দ্বারা নামায নষ্ট হয়ে যায়। তারা মানতেক-ফালসাফা ইত্যাদি তর্কশাস্ত্রের পিছনে তেমন পড়ে না, যা দ্বারা লোকে তাঁদেরকে দার্শনিক বা যুক্তিবাদী মনে করে।

১১. তাঁরা কাউকে অন্ধভাবে অনুকরণ অনুসরণ করে না, বরং নিজেদের ইলম দ্বারা সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে লক্ষ্য করে শুধুমাত্র হুযূরে পাক (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের) তাবেদারী করে, আর এটা হয় সাহাবীদের রাযি. অনুকরণের মাধ্যমে, কেননা তাঁরা প্রিয় নবীজীর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম হালত সম্পর্কে সর্বাধিক জ্ঞানী ছিলেন।

১২. তাঁরা কঠোরভাবে বিদ‘আত হতে আত্মরক্ষা করে। একমাত্র প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবাদের আমল ও আদর্শ তালাশ করে তার উপর আমল করে। কারো নিকট লোকদের অতিমাত্রায় আনাগোনা দেখেই তাকে মকবূল বলে মনে করে না। (বিঃ দ্র: বিস্তারিত জানার জন্য ফাযায়েলে সাদাকাত দ্বিতীয় খন্ড- ৩২০ পৃষ্ঠা থেকে ৩৩২ পৃষ্ঠা দেখুন)