সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হল ঈমান। ঈমানের বিপরীত কুফর। ঈমান সত্য, কুফর মিথ্যা। ঈমান আলো, কুফর অন্ধকার। ঈমান জীবন, কুফর মৃত্যু। ঈমান পূর্ণ কল্যাণ আর কুফর পূর্ণ অকল্যাণ। ঈমান সরল পথ, আর কুফর ভ্রষ্টতার রাস্তা।
ঈমান মুসলমানের কাছে প্রাণের চেয়েও প্রিয়। ঈমানদার সকল কষ্ট সহ্য করতে পারে, মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে পারে, কিন্তু ঈমান ছাড়তে পারে না। ঈমানই তার কাছে সবকিছু থেকে বড়। ঈমান শুধু মুখে কালেমা পড়ার নাম নয়, ইসলামকে তার সকল অপরিহার্য অনুষঙ্গসহ মনেপ্রাণে কবুল করার নাম। আর একারণে মুমিনকে হতে হবে সুদৃঢ়, সত্যবাদী ও সত্যনিষ্ঠ। মুমিন কখনো শৈথিল্যবাদী হতে পারে না। কুফরির সাথে যেমন তার সন্ধি হতে পারে না তেমনি মুরতাদ ও অমুসলিমদের সাথেও বন্ধুত্ব হতে পারে না।
তো ইসলামের সে পূর্ণ পরিচয় কী? তার অপরিহার্য দাবি ও অনুষঙ্গগুলোই বা কী? এরই সংক্ষিপ্ত আলোচনা এ প্রবন্ধের উদ্দেশ্য।
দ্বীন ও ঈমান সম্পর্কে বেপরোয়া লোকদের যেহেতু এইসব বিষয়ের জ্ঞান নেই, কিংবা জ্ঞান থাকলেও পরোয়া নেই তাই তাদের মতে, ঈমান-কুফরের সন্ধিও অসম্ভব কিছু নয়। (লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহিল আলিয়্যিল আযীম)
তো কাকে বলে ঈমান, আর তার অপরিহার্য অনুষঙ্গ, নীচে এর উপরই আলোকপাত করা হল।
- ঈমান অহীর মাধ্যমে জানা সকল সত্যকে সত্য বলে বিশ্বাস করার নাম
অজ্ঞতা-অনুমান আর কল্পনা-কুসংস্কারের কোনো অবকাশ ঈমানে নেই। ঈমান ঐ সত্য সঠিক আকীদাকে স্বীকার করার ও সত্য বলে বিশ্বাস করার নাম, যা আসমানী ওহীর দ্বারা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত, যে অহী ‘আল কুরআনুল কারীম’ এবং ‘আস্সুন্নাতুন নাবাবিয়্যাহ’ রূপে এখনো সংরক্ষিত আছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত সংরক্ষিত থাকবে ইনশাআল্লাহ।
- ঈমান অবিচল বিশ্বাসের নাম
ঈমান তো অটল ও দৃঢ় বিশ্বাসের নাম। সংশয় ও দোদুল্যমানতার মিশ্রণও এখানে হতে পারে না। সংশয়ই যদি থাকল তাহলে তা ‘আকীদা কীভাবে হয়’? বিশ্বাস যদি দৃঢ়ই না হল তাহলে তা ঈমান কীভাবে হয়’?
কুরআন মজীদের ইরশাদ-
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ آَمَنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ ثُمَّ لَمْ يَرْتَابُوا وَجَاهَدُوا بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ أُولَئِكَ هُمُ الصَّادِقُونَ
তারাই মুমিন যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনে, পরে সন্দেহ পোষণ করে না এবং জীবন ও সম্পদ দ্বারা আল্লাহর পথে জিহাদ করে তারাই সত্যনিষ্ঠ।-আলহুজুরাত ৪৯ : ১৫
সংশয় ও দোদুল্যমানতা কাফির ও মুনাফিকের বৈশিষ্ট্য, মুমিনের নয়। ইরশাদ হয়েছে-
لَا يَسْتَأْذِنُكَ الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ أَنْ يُجَاهِدُوا بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ وَاللَّهُ عَلِيمٌ بِالْمُتَّقِينَ l إِنَّمَا يَسْتَأْذِنُكَ الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ وَارْتَابَتْ قُلُوبُهُمْ فَهُمْ فِي رَيْبِهِمْ يَتَرَدَّدُونَ
যারা আল্লাহে ও শেষ দিবসে ঈমান আনে তারা নিজ সম্পদ ও জীবন দ্বারা জিহাদে অব্যাহতি পাওয়ার প্রার্থনা তোমার নিকট করে না। আল্লাহ মুত্তাকীদের সম্বন্ধে সবিশেষ অবহিত। তোমার নিকট অব্যাহতি প্রার্থনা শুধু ওরাই করে যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসে ঈমান আনে না এবং যাদের চিত্ত সংশয়যুক্ত। ওরা তো আপন সংশয়ে দ্বিধাগ্রস্ত।-আত তাওবা ৯ : ৪৪-৪৫
৩. কোনো বিষয়কে শুধু আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতি আস্থার ভিত্তিতে মেনে নেয়ার নাম ঈমান
ঈমানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রোকন হল, কোন বিষয়কে শুধু আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি আস্থার ভিত্তিতে সন্দেহাতীতভাবে মেনে নেয়া ও বিশ্বাস করা। সচক্ষে প্রত্যক্ষ করার পর ঈমান আনার আর কী থাকে? চোখে দেখা বিষয়কে কে অস্বীকার করে?
ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও দৃশ্যমান বস্ত্তসমূহ বা সাধারণ বিবেক বুদ্ধি দ্বারা বোঝা যায় এমন বিষয়সমূহ ঈমানের বিষয়বস্ত্ত হতে পারে না। এসব তো মানুষ এমনিতেই মেনে নেয়। এতে ঈমান আনা না আনার প্রশ্নই অবান্তর।
দেখা বিষয়ে বিশ্বাস স্থাপনের নাম ঈমান নয়। মুমিনকে তো এজন্য মুমিন বলা হয় যে, সে না দেখা বিষয় শুধু আল্লাহ বা তাঁর রসূলের সংবাদের উপর ভিত্তি করে মেনে নিয়েছে ও বিশ্বাস করেছে।
দাহরিয়ারা বলে, ‘স্বচক্ষে দেখা ছাড়া আমরা কিছু মানি না।’ আর যুক্তিপুজারীরা বলে, ‘যা বিবেক বুদ্ধি দিয়ে উপলব্ধি করা যায় না তা আমরা মানি না।’ পক্ষান্তরে মুমিন বলে, ‘সত্য সংবাদদাতার সংবাদ মেনে নেওয়া সুস্থ বিবেকেরই ফয়সালা।’
তাই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বাণী পৌছার পর তা গ্রহণ করতে বিলম্ব করার কোনই অবকাশ নেই। আল্লাহ তাআলা কুরআন মজীদের শুরুতেই মুমিনের গায়েবে বিশ্বাস করার এই গুন-বৈশিষ্ট্যের প্রশংসা করে বলেছেন,
الم l ذَلِكَ الْكِتَابُ لَا رَيْبَ فِيهِ هُدًى لِلْمُتَّقِينَl الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِالْغَيْبِ وَيُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنْفِقُونَ l وَالَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ وَبِالْآَخِرَةِ هُمْ يُوقِنُونَ l أُولَئِكَ عَلَى هُدًى مِنْ رَبِّهِمْ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ
আলিফ লাম মীম, এটি সেই কিতাব এতে কোন সন্দেহ নেই। এটা হিদায়াত এমন ভীতি অবলম্বনকারীদের জন্য-
যারা অদৃশ্য জিনিসসমূহে ঈমান রাখে এবং সালাত কায়েম করে এবং আমি তাদেরকে যা কিছু দিয়েছি তা থেকে (আল্লাহর সন্তোষজনক কাজে) ব্যয় করে।
এবং যারা ঈমান রাখে আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তাতেও এবং আপনার পূর্বে যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তাতেও এবং তারা আখিরাতে পরিপূর্ণ বিশ্বাস রাখে। এরাই এমন লোক, যারা তাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে সঠিক পথের উপর আছে এবং এরাই এমন লোক, যারা সফলতা লাভকারী।-সূরা বাকারা (২) : ১-৫
যে ব্যক্তি মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও কুরআন-সুন্নাহয় বর্ণিত অদৃশ্যের বিষয় মেনে নিতে এ জন্য সন্দিহান থাকে যে, সে সকল বিষয়ের ধরণ ও বিস্তারিত বিবরণ তার বুঝে আসছে না। অথবা শরীয়তের কোন হুকুম কবুল করতে এজন্য দ্বিধাগ্রস্ত যে তার এই হুকুমের হেকমত বুঝে আসছে না। অথবা কুরআন-হাদীসে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত কোন বিষয়ে সে এজন্য সন্দেহ পোষণ করে যে, সে বিষয়ে কোন বিজ্ঞানীর সাক্ষ্য নেই। এ সকল লোক আসলে ঈমানের হাকীকতই বোঝে না।
তাদেরকে কে বোঝাবে যে, যে বিষয়টি আপনি স্বচক্ষে দেখেছেন অথবা আকলের মাধ্যমে অনুধাবন করেছেন অথবা আপনার কোন বিশ্বস্ত ব্যক্তি আপনাকে খবর দিয়েছে ফলে আপনি তা বিশ্বাস করেছেন; তাহলে এটা ‘ঈমান কীভাবে হয়?!
আপনার এ মেনে নেয়া তো আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের কথার উপর নির্ভর করে হয়নি। (দেখা, বোঝা বা অন্য কারো উপর নির্ভর করে হয়েছে।) ঈমান তো তখন ঈমান বলে গণ্য হবে যখন আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি আপনার আস্থা ও নির্ভরতা থাকবে। যার প্রতি আস্থা ও নির্ভরতাই নেই তার উপর ঈমানের দাবি কীভাবে হয়?
আল্লাহর দেওয়া ইলমে ওহীর মাধ্যমে প্রাপ্ত গায়েবের প্রতি ঈমানের নেয়ামত থেকে যারা মাহরূম তারা ঈয়াকীনী ইলম ছেড়ে নিছক ধারণা, অনুমান এবং খেয়াল খুশির পিছনে ছুটে বেড়ায় এবং আল্লাহ রাববুল আলামীন যিনি ‘আসদাকুল ক্ব-ইলীন’, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যিনি ‘আস সাদিকুল মাসদূক’ এবং ‘আস সাদিকুল আমীন’ তাঁদের সংবাদের উপর নির্ভর না করে না বুঝে না দেখে এমন অনেকের কথা মেনে নেয় যাদের কাছে না আছে গায়েবের ইলম না তাদের বিশ্বস্ততা সন্দেহাতীত। নেয়ামতের কদর না করলে এটাই হয় পরিণাম।
৪. ঈমান সত্যের সাক্ষ্যদান এবং আরকানে ইসলাম পালনের নাম
অন্তরের বিশ্বাসের সাথে মুখেও সত্যের সাক্ষ্য দেওয়া ঈমানের অন্যতম রোকন। হাদীস শরীফে আছে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রবীআ গোত্রের প্রতিনিধিদলকে এক আল্লাহর উপর ঈমান আনার আদেশ করে জিজ্ঞাসা করেছিলেন-
أتدرون ما الإيمان بالله وحده؟ قالوا : الله ورسوله أعلم، قال : شهادة أن لا إله إلا الله، وأن محمدا رسول الله، وإقام الصلاة وإيتاء الزكاة وصيام رمضان، وأن تعطوا من المغنم الخمس.
তোমরা কি জান ‘এক আল্লাহর উপর ঈমান’ কাকে বলে? তারা বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, (এক আল্লাহর উপর ঈমান আনার অর্থ) এই সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোন সত্য মাবুদ নেই। মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল। আর সালাত কায়েম করা, যাকাত আদায় করা, রমযানের রোযা রাখা ও গণীমতের এক পঞ্চমাংশ প্রেরণ করা।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৫৩, কিতাবুল ঈমান, আদাউল খুমুসি মিনাল ঈমান
হকের সাক্ষ্য দেওয়া মুমিনের পরিচয়। মুমিন কখনো সত্য গোপন করে না অর্থাৎ, সত্যকে জেনেও তা স্বীকার করা থেকে বিরত থাকে না। কখনো মিথ্যা ও অবাস্তব সাক্ষ্যও দেয় না। অসত্য ও অবাস্তবের সাক্ষ্য দেওয়া তো কাফির মুশরিকদের বৈশিষ্ট্য। মুমিন তো এমন সাক্ষ্য প্রত্যাখ্যান করে।
شَهِدَ اللَّهُ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ وَالْمَلَائِكَةُ وَأُولُو الْعِلْمِ قَائِمًا بِالْقِسْطِ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ l إِنَّ الدِّينَ عِنْدَ اللَّهِ الْإِسْلَامُ وَمَا اخْتَلَفَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ إِلَّا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْعِلْمُ بَغْيًا بَيْنَهُمْ وَمَنْ يَكْفُرْ بِآَيَاتِ اللَّهِ فَإِنَّ اللَّهَ سَرِيعُ الْحِسَابِ l فَإِنْ حَاجُّوكَ فَقُلْ أَسْلَمْتُ وَجْهِيَ لِلَّهِ وَمَنِ اتَّبَعَنِ وَقُلْ لِلَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ وَالْأُمِّيِّينَ أَأَسْلَمْتُمْ فَإِنْ أَسْلَمُوا فَقَدِ اهْتَدَوْا وَإِنْ تَوَلَّوْا فَإِنَّمَا عَلَيْكَ الْبَلَاغُ وَاللَّهُ بَصِيرٌ بِالْعِبَادِ l إِنَّ الَّذِينَ يَكْفُرُونَ بِآَيَاتِ اللَّهِ وَيَقْتُلُونَ النَّبِيِّينَ بِغَيْرِ حَقٍّ وَيَقْتُلُونَ الَّذِينَ يَأْمُرُونَ بِالْقِسْطِ مِنَ النَّاسِ فَبَشِّرْهُمْ بِعَذَابٍ أَلِيمٍ l أُولَئِكَ الَّذِينَ حَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ فِي الدُّنْيَا وَالْآَخِرَةِ وَمَا لَهُمْ مِنْ نَاصِرِينَ
আল্লাহ সাক্ষ্য দেন যে, নিশ্চয়ই তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, ফেরেশতাগণ এবং জ্ঞানীগণও; আল্লাহ ন্যায়নীতিতে প্রতিষ্ঠিত, তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।
*নিঃসন্দেহে ইসলামই আল্লাহর নিকট একমাত্র দ্বীন। যাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছিল তারা তো পরস্পর বিদ্বেষবশত তাদের নিকট জ্ঞান আসার পরই মতানৈক্য ঘটিয়েছিল। আর কেউ আল্লাহর নিদর্শনকে অস্বীকার করলে আল্লাহ তো হিসাব গ্রহণে অত্যন্ত তৎপর।
* যদি তারা তোমার সাথে বিতর্কে লিপ্ত হয়, তবে তুমি বল ‘আমি আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ করেছি এবং আমার অনুসারীগণও’। আর যাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছে তাদেরকে ও নিরক্ষরদেরকে বল, ‘তোমরাও কি আত্মসমর্পণ করেছ’? যদি তারা আত্মসমর্পণ করে তবে নিশ্চয়ই তারা পথ পেয়েছে, আর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে তোমার কর্তব্য তো শুধু প্রচার করা, আল্লাহ বান্দাদের সম্পর্কে সম্যক দ্রষ্টা।
* যারা আল্লাহর আয়াত অস্বীকার করে, অন্যায়রূপে নবীদেরকে হত্যা করে এবং মানুষের মধ্যে যারা ন্যায়পরায়ণতার নির্দেশ দেয় তাদেরকে হত্যা করে, তুমি তাদেরকে মর্মন্তুদ শাস্তির সংবাদ দাও।
* এসব লোকদের কার্যাবলী দুনিয়া ও আখেরাতে নিষ্ফল হবে এবং তাদের কোনো সাহায্যকারী নেই।-আলে ইমরান ৩ : ১৮-২২
وَمَنْ يَرْغَبُ عَنْ مِلَّةِ إِبْرَاهِيمَ إِلَّا مَنْ سَفِهَ نَفْسَهُ وَلَقَدِ اصْطَفَيْنَاهُ فِي الدُّنْيَا وَإِنَّهُ فِي الْآَخِرَةِ لَمِنَ الصَّالِحِينَ l إِذْ قَالَ لَهُ رَبُّهُ أَسْلِمْ قَالَ أَسْلَمْتُ لِرَبِّ الْعَالَمِينَ l وَوَصَّى بِهَا إِبْرَاهِيمُ بَنِيهِ وَيَعْقُوبُ يَا بَنِيَّ إِنَّ اللَّهَ اصْطَفَى لَكُمُ الدِّينَ فَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنْتُمْ مُسْلِمُونَ
বল, ‘‘সাক্ষ্যতে সর্বশ্রেষ্ঠ বিষয় কী? বল, আল্লাহ আমার ও তোমাদের মধ্যে সাক্ষী এবং এই কুরআন আমার নিকট প্রেরিত হয়েছে যেন তোমাদেরকে এবং যার নিকট এটা পৌঁছবে তাদেরকে এর দ্বারা সতর্ক করি। তোমরা কি এই সাক্ষ্য দাও যে, আল্লাহর সাথে অন্য ইলাহও আছে? বল, ‘আমি সে সাক্ষ্য দেই না’। বল, তিনি তো এক ইলাহ এবং তোমরা যে শরীক কর তা হতে আমি অবশ্যই নির্লিপ্ত। আমি যাদেরকে কিতাব দিয়েছি তারা তাকে সেইরূপে চিনে যেইরূপ চিনে তাদের সন্তানগণকে। যারা নিজেরাই নিজেদের ক্ষতি করেছে, তারা বিশ্বাস করবে না। যে ব্যক্তি আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যা রটনা করে অথবা তার আয়াতসমূহ প্রত্যাখ্যান করে তার চেয়ে বড় জালিম আর কে হতে পারে? নিশ্চিত জেনে রাখ, জালিমরা সফলতা লাভ করতে পারে না।-আল আনআম ৬ : ১৯-২১
৫. ঈমান অর্থ সমর্পণ
ঈমান আনার অনিবার্য অর্থ, বান্দা নিজেকে আল্লাহর কাছে সমর্পণ করবে। তাঁর প্রতিটি আদেশ শিরোধার্য করবে। আল্লাহর প্রতি ঈমান আর আল্লার বিধানে আপত্তি একত্র হতে পারে না। রাসূলের প্রতি ঈমান আর তাঁর আদর্শের উপর আপত্তি, কুরআনের প্রতি ঈমান আর তার কোনো আয়াত বা বিধানের উপর আপত্তি কখনো একত্রিত হয় না।
মুমিনের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সমর্পণ আর ইবলীস ও তার অনুসারীদের বৈশিষ্ট্য বিপরীত যুক্তি। এখন তো শুধু আপত্তি বা বিপরীত যুক্তিই নয়, রাসূল, কুরআন ও ইসলামের প্রতি প্রকাশ্য বিদ্রোহকারীকেও মুসলমান মনে করা হয়। কারো প্রতি ঈমান, অতপর তার বিরুদ্ধতা এ দুটো একত্র হওয়া অসম্ভব হলেও ‘অসহায়’ ইসলামের ব্যাপারে বর্তমানের ‘বুদ্ধিজীবী’দের কাছে তা পুরাপুরিই সম্ভব। বুদ্ধিমান মানুষমাত্রই জানেন, ইসলাম বিহীন তথা সমর্পণ বিহীন ঈমানের কথা কল্পনাও করা যায় না। আর না তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে। এ তো ঈমানের সাথে সরাসরি বিদ্রূপ ছাড়া আর কিছুই নয়।
قُلْ إِنَّنِي هَدَانِي رَبِّي إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ دِينًا قِيَمًا مِلَّةَ إِبْرَاهِيمَ حَنِيفًا وَمَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِينَ l قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ l لَا شَرِيكَ لَهُ وَبِذَلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا أَوَّلُ الْمُسْلِمِينَ
যে নিজেকে নির্বোধ করেছে সে ব্যতীত ইবরাহীমের ধর্মাদর্শ হতে আর কে বিমুখ হবে। পৃথিবীতে তাকে আমি মনোনীত করেছি; আর আখেরাতেও সে অবশ্যই সৎকর্মপরায়ণগণের অন্যতম। * তার প্রতিপালক যখন তাকে বলেছিলেন, আত্মসমর্পণ কর, সে বলেছিল, জগতসমূহের প্রতিপালকের নিকট আত্মসমর্পণ করলাম। *এবং ইবরাহীম ও ইয়াকুব এই সম্বন্ধে তাদের পুত্রগণকে নির্দেশ দিয়ে বলেছিল, হে পুত্রগণ! আল্লাহই তোমাদের জন্য এই দ্বীন মনোনীত করেছেন, সুতরাং আত্মসমর্পণকারী না হয়ে তোমরা কখনো মৃত্যুবরণ করো না।-আল বাকারা ২ : ১৩০-১৩২
قُلْ إِنَّنِي هَدَانِي رَبِّي إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ دِينًا قِيَمًا مِلَّةَ إِبْرَاهِيمَ حَنِيفًا وَمَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِينَ قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ لَا شَرِيكَ لَهُ وَبِذَلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا أَوَّلُ الْمُسْلِمِينَ
* বল, আমার প্রতিপালক তো আমাকে সৎপথে পরিচালিত করেছেন। সেটাই সুপ্রতিষ্ঠিত দ্বীন, ইবরাহীমের ধর্মাদর্শ, সে ছিল একনিষ্ঠ এবং সে মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না।
* বল, আমার সালাত, আমার ইবাদত, আমার জীবন ও আমার মরণ জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহরই উদ্দেশ্যে। তাঁর কোন শরীক নেই। আমাকে এরই হুকুম দেওয়া হয়েছে এবং আমি তাঁর সম্মুখে সর্বপ্রথম মাথানতকারী।-আল আনআম ৬ : ১৬১-১৬৩
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ حَقَّ تُقَاتِهِ وَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنْتُمْ مُسْلِمُونَ
* হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে যথার্থভাবে ভয় কর এবং তোমরা আত্মসমর্পণকারী না হয়ে কোনো অবস্থায় মৃত্যুবরণ করো না।-আলে ইমরান ৩ : ১০২
৬. ঈমান শরীয়ত ও উসওয়ায়ে হাসানাকে গ্রহণ করার নাম
ইসলামকে শুধু সত্য ও সুন্দর জানা বা বলার নাম ঈমান নয়। কারণ, হক ও সত্যকে শুধু জানা বা মুখে বলা ঈমান সাব্যস্ত হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। ঈমান তো তখনই হবে যখন এই সত্যকে মনেপ্রাণে কবুল করবে এবং এর সম্পর্কে অন্তরে কোনো দ্বিধা থাকবে না। ইসলাম তো ‘আকীদা’ ও ‘শরীয়ত’-এ দুইয়ের সমষ্টির নাম। এ দুটোর বিশ্বাস এবং মেনে নেওয়ার দ্বারাই ঈমান সাব্যস্ত হতে পারে। ‘শরীয়ত’ অর্থ, দ্বীনের বিধিবিধান ও ইসলামী জীবনের নবী-আদর্শ, কুরআন যাকে মুমিনের জন্য উসওয়ায়ে হাসানা সাব্যস্ত করেছে।
فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا
কিন্তু না, তোমার প্রতিপালকের শপথ! তারা মুমিন হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের বিবাদ-বিসম্বাদের বিচারভার তোমার উপর অর্পণ না করে; অতঃপর তোমার সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে তাদের মনে কোনো দ্বিধা না থাকে এবং
সর্বান্তকরণে মেনে নেয়।-আন নিসা ৪ : ৬৫
أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ يَزْعُمُونَ أَنَّهُمْ آَمَنُوا بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ يُرِيدُونَ أَنْ يَتَحَاكَمُوا إِلَى الطَّاغُوتِ وَقَدْ أُمِرُوا أَنْ يَكْفُرُوا بِهِ وَيُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَنْ يُضِلَّهُمْ ضَلَالًا بَعِيدًا l وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ تَعَالَوْا إِلَى مَا أَنْزَلَ اللَّهُ وَإِلَى الرَّسُولِ رَأَيْتَ الْمُنَافِقِينَ يَصُدُّونَ عَنْكَ صُدُودًا
তুমি কি তাদেরকে দেখনি, যারা দাবি করে যে, তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে এবং তোমার পূর্বে যা অবতীর্ণ হয়েছে তাতে তারা বিশ্বাস করে, অথচ তারা তাগুতের কাছে বিচার প্রার্থী হতে চায়, যদিও তা প্রত্যাখ্যান করার জন্য তাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং শয়তান তাদেরকে ভীষণভাবে পথভ্রষ্ট করতে চায়? * তাদেরকে যখন বলা হয় আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তার দিকে এবং রাসূলের দিকে এসো, তখন মুনাফিকদেরকে তুমি তোমার নিকট হতে মুখ একেবারে ফিরিয়ে নিতে দেখবে।-আন নিসা ৪ : ৬০-৬১
ثُمَّ جَعَلْنَاكَ عَلَى شَرِيعَةٍ مِنَ الْأَمْرِ فَاتَّبِعْهَا وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَ الَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ l إِنَّهُمْ لَنْ يُغْنُوا عَنْكَ مِنَ اللَّهِ شَيْئًا وَإِنَّ الظَّالِمِينَ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ وَاللَّهُ وَلِيُّ الْمُتَّقِينَ l هَذَا بَصَائِرُ لِلنَّاسِ وَهُدًى وَرَحْمَةٌ لِقَوْمٍ يُوقِنُونَ
এরপর আমি তোমাকে প্রতিষ্ঠিত করেছি দ্বীনের বিশেষ শরীয়তের উপর; সুতরাং তুমি তার অনুসরণ কর, অজ্ঞদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করো না। * আল্লাহর মুকাবেলায় তারা তোমার কোনোই উপকার করতে পারবে না; যালিমরা একে অন্যের বন্ধু; আর আল্লাহ তো মুত্তাকীদের বন্ধু। * এই কুরআন মানবজাতির জন্য সুস্পষ্ট দলীল এবং নিশ্চিত বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য পথনির্দেশ ও রহমত।-আল জাছিয়া ৪৫ : ১৮-২০
৭. ঈমান শুধু গ্রহণ নয়, বর্জনও, সত্যকে গ্রহণ আর বাতিলকে বর্জন
কোনো আকীদাকে মেনে নেওয়ার পাশাপাশি তার বিপরীত বিষয়কেও সঠিক মনে করা স্ববিরোধিতা, মানবের সুস্থ বুদ্ধি তা গ্রহণ করতে পারে না। ইসলামেও তা অকল্পনীয়। ঈমান তখনই সাব্যস্ত হবে যখন বিপরীত সব কিছু বাতিল ও মিথ্যা মনে করবে এবং তা থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করবে। সকল প্রকারের শিরক ও কুফর থেকে সম্পর্কচ্ছেদ করা সরাসরি ঈমানেরই অংশ। যেমন ঈমানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ তাওহীদ। তাওহীদ কি শুধু আল্লাহ তাআলাকে মাবুদ মানা? না তা নয়। তাওহীদ অর্থ একমাত্র আল্লাহ তাআলাকে সত্য মাবুদ বলে বিশ্বাস করা এবং আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে বা কোনো কিছুকে মাবুদ বলে স্বীকার না করা। তাওহীদ অর্থ, আল্লাহ তাআলারই ইবাদত করা, আল্লাহ ছাড়া আর কারো ইবাদত না করা। তাওহীদ অর্থ, উপায়-উপকরণের ঊর্ধ্বের বিষয়ে শুধু আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাওয়া, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে সাহায্য না চাওয়া। তাওহীদের অর্থ, একমাত্র আল্লাহকেই কল্যাণ-অকল্যাণের হায়াত মওতের মালিক মনে করা, অন্য কাউকে এসব বিষয়ে ক্ষমতাশালী মনে না করা। তাওহীদ অর্থ, শুধু আল্লাহকে আহকামুল হাকিমীন মনে করা, আল্লাহর হুকুমের বিরুদ্ধে কারো হুকুম স্বীকার না করা, তাওহীদ অর্থ, শুধু শরীয়তে মুহাম্মাদিয়ার আনুগত্যকেই অপরিহার্য মনে করা, অন্য কোনো শরীয়তের আনুগত্য বৈধ মনে না করা। তাওহীদ অর্থ, শুধু ইসলামকেই হক্ব ও সত্য মনে করা, অন্য কোনো দ্বীনকে হক্ব ও সত্য মনে না করা।
মোটকথা, সব জরুরিয়াতে দ্বীন (দ্বীনের সর্বজনবিদিত বিষয়) এবং অকাট্য আকীদা ও আহকাম এই প্রকারেরই অন্তর্ভুক্ত। এসব বিষয়ে ঈমান তখনই সাব্যস্ত হবে যখন তার বিপরীত বিষয়কে বাতিল ও মিথ্যা বলে বিশ্বাস করা হবে। আর তা থেকে ‘তাবার্রি’ (সম্পর্কহীনতা) অবলম্বন করা হবে। এ সব তো ‘মুজতাহাদ ফী’ (যাতে শরীয়তের দলীলের ভিত্তিতে একাধিক মত হতে পারে) বা ‘তানাওউয়ে সুন্নত’ (যাতে একাধিক সুন্নাহসম্মত পদ্ধতি রয়েছে)-এর ক্ষেত্র নয় যে, বিপরীত দিকটিকেও গ্রহণযোগ্য বা নীরবতার যোগ্য মনে করা যায়।
আজকাল দ্বীন ও ঈমানের বিষয়ে যেসব বিপদ ও ফিৎনার ব্যাপক বিস্তার ঘটছে তন্মধ্যে সবচেয়ে বড় ফিৎনা এটাই যে, জরুরিয়াতে দ্বীন, মৌলিক আকীদা ও ঐকমত্যপূর্ণ বিষয়াদিকেও একাধিক মতের সম্ভাবনাযুক্ত বিষয়াদির মতো মত প্রকাশের ক্ষেত্র বানিয়ে নেওয়া হয়েছে। অথচ এগুলো হচ্ছে হুবহু মেনে নেওয়ার বিষয়। এগুলো তো ‘ধারণা’ ও ‘মতামত’ প্রকাশের ক্ষেত্রই নয়। এসব ক্ষেত্রে একমাত্র সেটিই সত্য, যা কুরআন মজীদ, সুন্নতে মুতাওয়ারাছা (গোটা মুসলিম উম্মাহর মাঝে সর্বযুগে প্রতিষ্ঠিত সুন্নাহ) ও ইজমার দ্বারা প্রমাণিত।
এখানে বিপরীত দিকগুলোর কোনো অবকাশই নেই। সেগুলো নিঃসন্দেহে বাতিল ও ভ্রান্ত। এই হক ও সত্যকে গ্রহণ করা এবং সকল বিরোধী মত, চিন্তা ও দর্শন, যা নিঃসন্দেহে বাতিল ও ভ্রান্ত, তা থেকে তাবার্রি (সম্পর্কহীনতা) অবলম্বনের নাম ঈমান।
ইবরাহীম আ. তাঁর কওমকে বলেছিলেন :
يَا قَوْمِ إِنِّي بَرِيءٌ مِمَّا تُشْرِكُونَ l إِنِّي وَجَّهْتُ وَجْهِيَ لِلَّذِي فَطَرَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ حَنِيفًا وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ
‘হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা যাকে আল্লাহর শরীক কর তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। * আমি একনিষ্ঠভাবে তাঁর দিকে মুখ ফিরাচ্ছি, যিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই।- আল আনআম ৬ : ৭৮-৭৯
হূদ আ. তার কওমের উত্তরে বলেছিলেন-
إِنِّي أُشْهِدُ اللَّهَ وَاشْهَدُوا أَنِّي بَرِيءٌ مِمَّا تُشْرِكُونَ l مِنْ دُونِهِ فَكِيدُونِي جَمِيعًا ثُمَّ لَا تُنْظِرُونِ l إِنِّي تَوَكَّلْتُ عَلَى اللَّهِ رَبِّي وَرَبِّكُمْ مَا مِنْ دَابَّةٍ إِلَّا هُوَ آَخِذٌ بِنَاصِيَتِهَا إِنَّ رَبِّي عَلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ
আমি তো আল্লাহকে সাক্ষী করছি এবং তোমরাও সাক্ষী হও যে, নিশ্চয়ই আমি তা হতে মুক্ত, যাকে তোমরা আল্লাহর শরীক কর, * আল্লাহ ব্যতীত তোমরা সকলে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র কর, অতঃপর আমাকে অবকাশ দিয়ো না। * আমি নির্ভর করি আমার ও তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহর উপর; এমন কোনো জীবজন্তু নেই, যে তাঁর পূর্ণ আয়ত্তাধীন নয়, নিশ্চয়ই আমার প্রতিপালক আছেন সরল পথে।-হূদ ১১ : ৫৪-৫৬
সূরায়ে মুমতাহিনায় বলা হয়েছে-
قَدْ كَانَتْ لَكُمْ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ فِي إِبْرَاهِيمَ وَالَّذِينَ مَعَهُ إِذْ قَالُوا لِقَوْمِهِمْ إِنَّا بُرَآَءُ مِنْكُمْ وَمِمَّا تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ كَفَرْنَا بِكُمْ وَبَدَا بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةُ وَالْبَغْضَاءُ أَبَدًا حَتَّى تُؤْمِنُوا بِاللَّهِ وَحْدَهُ إِلَّا قَوْلَ إِبْرَاهِيمَ لِأَبِيهِ لَأَسْتَغْفِرَنَّ لَكَ وَمَا أَمْلِكُ لَكَ مِنَ اللَّهِ مِنْ شَيْءٍ رَبَّنَا عَلَيْكَ تَوَكَّلْنَا وَإِلَيْكَ أَنَبْنَا وَإِلَيْكَ الْمَصِيرُ l رَبَّنَا لَا تَجْعَلْنَا فِتْنَةً لِلَّذِينَ كَفَرُوا وَاغْفِرْ لَنَا رَبَّنَا إِنَّكَ أَنْتَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ l لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِيهِمْ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللَّهَ وَالْيَوْمَ الْآَخِرَ وَمَنْ يَتَوَلَّ فَإِنَّ اللَّهَ هُوَ الْغَنِيُّ الْحَمِيدُ
* তোমার জন্য ইবরাহীম ও তার অনুসারীদের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ। যখন তারা তাদের সম্প্রদায়কে বলেছিল, ‘তোমাদের সঙ্গে এবং তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যার ইবাদত কর তার সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা তোমাদেরকে মানি না। তোমাদের ও আমাদের মধ্যে সৃষ্টি হল শত্রুতা ও বিদ্বেষ চিরকালের জন্য; যদি না তোমরা এক আল্লাহতে ঈমান আন’, তবে ব্যতিক্রম তার পিতার প্রতি ইবরাহীমের উক্তি; আমি নিশ্চয়ই তোমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করব; এবং তোমার ব্যাপারে আল্লাহর নিকট আমি কোনো অধিকার রাখি না।
হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আপনারই উপর নির্ভর করেছি, আপনারই দিকে আমরা রুজু হয়েছি এবং আপনারই কাছে আমাদেরকে ফিরে যেতে হবে।
হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি আমাদেরকে কাফেরদের পরীক্ষার পাত্র বানাবেন না এবং হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে ক্ষমা করুন। নিশ্চয়ই কেবল আপনিই এমন, যার ক্ষমতা পরিপূর্ণ, হেকমতও পরিপূর্ণ।
(হে মুসলিমগণ!) নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য তাদের (কর্মপন্থার) মধ্যে আছে উত্তম আদর্শ, প্রত্যেক এমন ব্যক্তির জন্য, যে, আল্লাহ ও আখেরাত দিবসের আশা রাখে। আর কেউ মুখ ফিরিয়ে নিলে (সে যেন মনে রাখে), আল্লাহ সকলের থেকে মুখাপেক্ষীতাহীন, আপনিই প্রশংসার্হ।-সূরা মুমতাহিনা ৬০ : ৪-৬
কাফির, মুশরিক ও মুনাফিকদের জন্য মাগফিরাতের দুআ করা হারাম। এরপরও ইবরাহীম আ. আযরের জন্য কেন দুআ করেছেন-তার জবাব স্বয়ং আল্লাহ তাআলা সূরা তাওবায় দিয়েছেন-
مَا كَانَ لِلنَّبِيِّ وَالَّذِينَ آَمَنُوا أَنْ يَسْتَغْفِرُوا لِلْمُشْرِكِينَ وَلَوْ كَانُوا أُولِي قُرْبَى مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُمْ أَصْحَابُ الْجَحِيمِ l وَمَا كَانَ اسْتِغْفَارُ إِبْرَاهِيمَ لِأَبِيهِ إِلَّا عَنْ مَوْعِدَةٍ وَعَدَهَا إِيَّاهُ فَلَمَّا تَبَيَّنَ لَهُ أَنَّهُ عَدُوٌّ لِلَّهِ تَبَرَّأَ مِنْهُ إِنَّ إِبْرَاهِيمَ لَأَوَّاهٌ حَلِيمٌ
* আত্মীয়-স্বজন হলেও মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা নবী ও মুমিনদের জন্য সংগত নয় যখন এটা সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে, নিশ্চিতই ওরা জাহান্নামী। * ইবরাহীম তার পিতার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছিল, তাকে এর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বলে; অতঃপর যখন এটা তার নিকট স্পষ্ট হল যে, সে আল্লাহর শত্রু তখন ইবরাহীম তার সম্পর্ক ছিন্ন করল। ইবরাহীম তো কোমলহৃদয় ও সহনশীল।-আত তাওবা ৯ : ১১৩-১১৪
ইসলাম ছাড়া অন্যসব ধর্ম ও মতবাদ থেকে এবং ইসলামের দুশমনদের থেকে তাবার্রি (বিমুখতা ও সম্পর্কহীনতা) ঈমানের রোকন হওয়ার কারণ, একমাত্র ইসলামই হক ও সত্য :
إِنَّ الدِّينَ عِنْدَ اللَّهِ الْإِسْلَامُ
অর্থাৎ আল্লাহর কাছে দ্বীন একমাত্র ইসলামই।- আলে ইমরান ৩ : ১৯
وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآَخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ
* কেউ ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দ্বীন গ্রহণ করতে চাইলে তা কখনো কবুল করা হবে না, এবং সে হবে আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত।-আলে ইমরান ৩ : ৮৫
মোটকথা, লা-দ্বীনী (ধর্মহীনতা) যেমন কুফর তেমনি ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দ্বীন অন্বেষণ করাও কুফর। হক ও সত্য আকীদাসমূহ গ্রহণ করা আর কুফরী কর্ম ও বিশ্বাস থেকে সম্পর্কহীনতা অবলম্বন করা-এ দুয়ের সমষ্টির দ্বারা ঈমান অস্তিত্ব লাভ করে। ঈমান ও ঈমান বিনষ্টকারী বিষয় একত্র হবে কীভাবে? এ তো অজু ভঙ্গের কারণ বিদ্যমান থাকার পরও অজু আছে বলে দাবি করার মতো। এটা যেমন সম্ভব নয়, ওটাও সম্ভব নয়।
৮. আস্থা-ভালবাসা ও ভক্তি-শ্রদ্ধা ছাড়া ঈমান হয় না; বিদ্রূপ ও অবজ্ঞা অস্বীকারের চেয়েও ভয়াবহ কুফর
কোনো ব্যক্তি বা বিষয়ের প্রতি ঈমান তখনই হতে পারে যখন তার উপর থাকে পূর্ণ আস্থা, অন্তরে তাঁর প্রতি থাকে ভক্তি ও শ্রদ্ধা। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল, তাঁর নাযিলকৃত আসমানী কিতাব, তাঁর বিধান ও শরীয়ত এবং তাঁর দীনের সকল নিদর্শনের সাথে মুমিনের সম্পর্ক ঐ আস্থা-বিশ্বাস এবং ভক্তি-শ্রদ্ধারই সম্পর্ক।
যার প্রতি বা যে বিষয়ে ঈমান আনা হয়েছে তার প্রতি বা ঐ বিষয়ে আস্থা-বিশ্বাস এবং ভক্তি-ভালবাসাই হচ্ছে ঈমানের প্রাণ। চিন্তা-ভাবনা এবং আমল ও আলোচনার দ্বারা একে শক্তিশালী করা এবং গভীর থেকে গভীরতর করা প্রত্যেক মুমিনের ঈমানী দায়িত্ব।
বিদ্বেষ ও ঈমান একত্র হওয়া অসম্ভব। যার প্রতি ঈমান থাকবে তার প্রতি ভালবাসাও থাকবে। পক্ষান্তরে যার প্রতি বিদ্বেষ ও শত্রুতা থাকবে তার প্রতি ঈমান থাকতে পারে না। অন্তরের বিদ্বেষ সত্ত্বেও যদি মুখে ঈমান প্রকাশ করে তবে তা হবে মুনাফিকী।
মুসলমানের ভালবাসা হবে আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও তাঁর নেক বান্দাদের প্রতি। আর কাফির, মুশরিক ও মুনাফিকের ভালবাসা হবে তাদের নিজ নিজ উপাস্য ও নেতাদের প্রতি।
وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَتَّخِذُ مِنْ دُونِ اللَّهِ أَنْدَادًا يُحِبُّونَهُمْ كَحُبِّ اللَّهِ وَالَّذِينَ آَمَنُوا أَشَدُّ حُبًّا لِلَّهِ
তথাপি মানুষের মধ্যে কেউ কেউ আল্লাহ ছাড়া অপরকে আল্লাহর সমকক্ষরূপে গ্রহণ করে এবং আল্লাহকে ভালবাসার ন্যায় তাদেরকে ভালবাসে; কিন্তু যারা ঈমান এনেছে আল্লাহর প্রতি ভালবাসায় তারা সুদৃঢ়।-আলবাকারা ২ : ১৬৫
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا مَنْ يَرْتَدَّ مِنْكُمْ عَنْ دِينِهِ فَسَوْفَ يَأْتِي اللَّهُ بِقَوْمٍ يُحِبُّهُمْ وَيُحِبُّونَهُ أَذِلَّةٍ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ أَعِزَّةٍ عَلَى الْكَافِرِينَ يُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَلَا يَخَافُونَ لَوْمَةَ لَائِمٍ ذَلِكَ فَضْلُ اللَّهِ يُؤْتِيهِ مَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ l إِنَّمَا وَلِيُّكُمُ اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَالَّذِينَ آَمَنُوا الَّذِينَ يُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَهُمْ رَاكِعُونَ lوَمَنْ يَتَوَلَّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَالَّذِينَ آَمَنُوا فَإِنَّ حِزْبَ اللَّهِ هُمُ الْغَالِبُونَ
হে মুমিনগণ! তোমাদের মধ্যে কেউ দ্বীন হতে ফিরে গেলে নিশ্চয়ই আল্লাহ এমন এক সম্প্রদায় আনবেন, যাদেরকে তিনি ভালবাসেন এবং যারা তাঁকে ভালবাসেন; তারা মুমিনদের প্রতি কোমল ও কাফিরদের প্রতি কঠোর হবে; তারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে এবং কোনো নিন্দুকের নিন্দার ভয় করবে না; এটা আল্লাহর অনুগ্রহ, যাকে ইচ্ছা তিনি দান করেন এবং আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ। * তোমাদের বন্ধু তো আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও মুমিনগণ, যারা বিনত হয়ে সালাত কায়েম করে ও যাকাত দেয়। * কেউ আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং মুমিনদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করলে আল্লাহর দলই তো বিজয়ী হবে।-আল মাইদা ৫ : ৫৪-৫৫
النَّبِيُّ أَوْلَى بِالْمُؤْمِنِينَ مِنْ أَنْفُسِهِمْ وَأَزْوَاجُهُ أُمَّهَاتُهُمْ
নবী মুমিনদের নিকট তাদের নিজেদের অপেক্ষা ঘনিষ্ঠতর এবং তাঁর পতীণগণ তাদের মাতা।-আল আহযাব ৩৩ : ৬
إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ شَاهِدًا وَمُبَشِّرًا وَنَذِيرًا لِتُؤْمِنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَتُعَزِّرُوهُ وَتُوَقِّرُوهُ وَتُسَبِّحُوهُ بُكْرَةً وَأَصِيلًا
(হে রাসূল!) আমি তোমাকে পাঠিয়েছি সাক্ষ্যদাতা, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে। যাতে (হে মানুষ) তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আন এবং রাসূলকে শক্তি যোগাও, তাঁকে সম্মান কর; আর সকাল সন্ধ্যায় আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর।-আল ফাতহ ৪৮ : ৮-৯
হাদীসে বলা হয়েছে-
لا يؤمن أحدكم حتى أكون أحب إليه من ولده ووالده والناس أجمعين.
তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হবে না যতক্ষণ আমি তার কাছে তার সন্তান ও পিতা (মাতা)র চেয়ে এবং সকল মানুষের চেয়ে অধিক প্রিয় না হব।- সহীহ মুসলিম, হাদীস : ৪৪; সহীহ বুখারী, হাদীস : ১৫
অন্য হাদীসে আছে-
لا يؤمن أحدكم حتى أكون أحب إليه من نفسه.
তোমরা কেউ ঐ পর্যন্ত মুমিন হবে না, যে পর্যন্ত আমি তার কাছে তার প্রাণের চেয়েও বেশি প্রিয় না হই।-মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ১৮০৪৭; সহীহ বুখারী, হাদীস : ৬৬৩২
সূরা তাওবায় দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলা হয়েছে-
قُلْ إِنْ كَانَ آَبَاؤُكُمْ وَأَبْنَاؤُكُمْ وَإِخْوَانُكُمْ وَأَزْوَاجُكُمْ وَعَشِيرَتُكُمْ وَأَمْوَالٌ اقْتَرَفْتُمُوهَا وَتِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَمَسَاكِنُ تَرْضَوْنَهَا أَحَبَّ إِلَيْكُمْ مِنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ وَجِهَادٍ فِي سَبِيلِهِ فَتَرَبَّصُوا حَتَّى يَأْتِيَ اللَّهُ بِأَمْرِهِ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ
বল, তোমাদের নিকট যদি আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং আল্লাহর পথে জিহাদ অপেক্ষা অধিক প্রিয় হয় তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভ্রাতা, তোমাদের পত্নী, তোমাদের স্বগোত্রীয়, তোমাদের অর্জিত সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, যার মন্দা পড়ার আশংকা কর এবং তোমাদের বাসস্থান, যা তোমরা ভালবাস, তবে অপেক্ষা কর আল্লাহর বিধান আসা পর্যন্ত। আল্লাহ সত্যত্যাগী সম্প্রদায়কে সৎপথ প্রদর্শন করেন না।-আত তাওবা ৯ : ২৪
আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও তাঁর বিধানসমূহের প্রতি শ্রদ্ধা ও আনুগত্য যে পর্যন্ত ঐ সকল ব্যক্তি, বস্ত্ত ও মতবাদের আসক্তির উপর প্রাধান্য না পায়, যা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ভালবাসা ও আল্লাহর বিধানসমূহের প্রতি সশ্রদ্ধ আনুগত্যের পথে প্রতিবন্ধক হয়, সে পর্যন্ত ব্যক্তিকে ‘মুমিন’ বলা হবে না, ‘ফাসিক’ (কাফির) বলা হবে। আর যে এই কুফরের উপর অবিচল থাকবে সে কখনো হেদায়েত পাবে না।
মোটকথা, আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও তাঁর দ্বীনের (ইসলামের) প্রতি অনুরাগ-ভালবাসাই হচ্ছে মুমিনের বৈশিষ্ট্য- আর এঁদের প্রতি বিরাগ-বিদ্বেষ কাফির, মুশরিক ও মুনাফিকের বৈশিষ্ট্য।
مَنْ كَانَ عَدُوًّا لِلَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَرُسُلِهِ وَجِبْرِيلَ وَمِيكَالَ فَإِنَّ اللَّهَ عَدُوٌّ لِلْكَافِرِينَ
যে কেউ আল্লাহর, তাঁর ফিরিশতাগণের, তাঁর রাসূলগণের এবং জিবরীল ও মীকাঈলের শত্রু সে জেনে রাখুক, আল্লাহ নিশ্চয়ই কাফিরদের শত্রু।-আল বাকারা ২ : ৯৮
অবজ্ঞা ও বিদ্রূপ বিরাগবিদ্বেষের চেয়েও হীন ও ভয়াবহ
ভদ্রতা ও মানবতার ছিটেফোঁটাও যার মধ্যে আছে তার কোনো ব্যক্তি, ধর্ম বা মতবাদের প্রতি বিদ্বেষ থাকলেও কখনো সে হীনতা ও অশ্লীলতায় নেমে আসতে পারে না। তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, অবজ্ঞা-বিদ্রূপ এবং কটূক্তি ও গালিগালাজের মতো নীচ কর্মে অবতীর্ণ হতে পারে না। কারণ এটা বিদ্বেষ ও শত্রুতা প্রকাশের চরম হীন উপায়। শরাফতের লেশমাত্র আছে এমন কেউ তা অবলম্বন করতে পারে না। যেহেতু ইসলামই একমাত্র সত্য ধর্ম তাই দুষ্কৃতিকারী ও ভ্রান্ত মতে বিশ্বাসীই এর শত্রু। এদের অতিমাত্রায় উগ্র ও কট্টর শ্রেণীটি তাচ্ছিল্য, বিদ্রূপ ও অশ্লীল বাক্যের দ্বারা এই শত্রুতার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে থাকে। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, সকল যুগের উগ্র কাফির-মুশরিকের প্রবণতা এটাই ছিল। এদের যে শ্রেণীটি এ অসভ্যতাকে মুনাফিকীর আবরনে আবৃত রাখার চেষ্টা করেছে তারাও এতে সফল হতে পারেনি।
এদের সাথে মুসলিম জনগণের আচরণ কী হবে এবং রাষ্ট্রপক্ষের আচরণ কী হবে তা আলাদা আলোচনা। এখানে যে কথাটি বলতে চাই, তা এতই স্পষ্ট যে, বলারও প্রয়োজন ছিল না, কিন্তু আমরা এমন এক পরিবেশে বাস করি, মনে হয়, এই সুস্পষ্ট কথাটিও অনেকেরই জানা নেই বা উপলব্ধিতে নেই।
তা এই যে, ইসলাম, ইসলামের নবী (কিংবা ইসলামের কোনো নিদর্শন সম্পর্কে কটূক্তিকারী, আল্লাহর ও তাঁর রাসূল কিংবা তার কোনো বিধানের অবজ্ঞা ও বিদ্রূপকারী যদি মুসলিমপরিবারের সন্তান হয়, মুখে কালিমা পাঠকারীও হয় তবুও সে কাফির ও মুসলমানের দুশমন। শরীয়তের পরিভাষায় এই প্রকারের কাফিরের নাম ‘মুনাফিক’, ‘মুলহিদ’ ও যিনদীক। এই স্পষ্ট বিধান এখন এজন্যই বলতে হচ্ছে যে, আমাদের সমাজে এমন লোকদের কুফরী কর্মকান্ড থেকেও বারাআত (সম্পর্কহীনতা) প্রকাশ নিজের ঈমান রক্ষার জন্য অপরিহার্য মনে করা হয় না; বরং এদের সাথেও মুসলমানদের মতো আচরণ করা হয়, এদের প্রশংসা করা হয়, এদেরকে ‘জাতীয় বীরে’ পরিণত করার চেষ্টা করা হয়।
কুরআন মজীদ পাঠ করুন এবং স্বয়ং আল্লাহ তাআলার নিকট থেকেই শুনুন, ইসলাম ইসলামের নিদর্শনের সাথে মুসলমানের সম্পর্ক কেমন হয় আর কাফির-মুনাফিকের আচরণ কেমন হয়। এরপর ফয়সালা করুন, আপনি কাদের সাথে থাকবেন। কুরআন কারীমে আরো দেখুন, যারা ইসলামের সাথে, ইসলামের নবীর সাথে ও ইসলামের নিদর্শনসমূহের সাথে বিদ্রূপ করে, আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও মুসলমানদের কষ্ট দেয় তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলার ফয়সালা কী।
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا الَّذِينَ اتَّخَذُوا دِينَكُمْ هُزُوًا وَلَعِبًا مِنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ مِنْ قَبْلِكُمْ وَالْكُفَّارَ أَوْلِيَاءَ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَl وَإِذَا نَادَيْتُمْ إِلَى الصَّلَاةِ اتَّخَذُوهَا هُزُوًا وَلَعِبًا ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ قَوْمٌ لَا يَعْقِلُونَ
হে মুমিনগণ! তোমাদের পূর্বে যাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছে তাদের মধ্যে যারা তোমাদের দ্বীনকে হাসি-তামাশা ও ক্রীড়ার বস্ত্তরূপে গ্রহণ করে তাদেরকে ও কাফিরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না এবং যদি তোমরা মুমিন হও তবে আল্লাহকে ভয় কর। * তোমরা যখন সালাতের জন্য আহবান কর তখন তারা ওটাকে হাসি-তামাশা ও ক্রীড়ার বস্ত্ত্রূপে গ্রহণ করে। এটা এই জন্য যে, তারা এমন এক সম্প্রদায় যাদের বোধশক্তি নেই।-আল মাইদা ৫ : ৫৭-৫৮
বোঝা গেল, নামাযের অবজ্ঞাকারী ও নামায থেকে বাধাদানকারী ঐ যুগেও ছিল, কিন্তু মুসলমানদের জন্য আল্লাহ তাআলার বিধান, তোমরা কখনো তাদের কথায় কর্ণপাত করো না; বরং আল্লাহকেই সিজদা করতে থাক এবং তাঁর নৈকট্য অর্জন করতে থাক।
كَلَّا لَا تُطِعْهُ وَاسْجُدْ وَاقْتَرِبْ
সাবধান! তুমি ওর অনুসরণ করো না, এবং সিজদা কর ও আমার নিকটবর্তী হও।-আল আলাক ৯৬ : ১৯
আশ্চর্যের বিষয় এই যে, গাইরুল্লাহর সিজদায় এদের কোনো গাত্রদাহ নেই আর এতেও কোনো ক্ষোভ ও যন্ত্রণা নেই যে, এদের অন্তর (যা আল্লাহ তাআলারই মাখলুক) সর্বদা তাদের মিথ্যা উপাস্যদের, যেমন প্রবৃত্তি, কুফরী মতবাদসমূহ ও নিজেদের নেতা ও সর্দারদের) প্রতি সিজদাবনত। বিচার বুদ্ধির সঠিক ব্যবহার করলে এদের মনেও গায়রুল্লাহর সিজদায় ঘৃণা ও ক্ষোভ জাগত এবং তারা তা বর্জন করত। অতপর হৃদয় ও ললাট উভয়ের দ্বারাই নিজের মতো সৃষ্টির পরিবর্তে আপন স্রষ্টার সামনে সিজদাবনত হত। বান্দার জন্য তার প্রকৃত মাবুদের সামনে সিজদাবনত হওয়াই তো পরম সৌভাগ্য।
দুনিয়াতে যে সিজদা থেকে বিমুখ থাকে কিংবা তার অবজ্ঞা ও বিদ্রূপ করে, আখিরাতে শত চেষ্টা করেও সে সিজদার সুযোগ পাবে না।
يَوْمَ يُكْشَفُ عَنْ سَاقٍ وَيُدْعَوْنَ إِلَى السُّجُودِ فَلَا يَسْتَطِيعُونَ l خَاشِعَةً أَبْصَارُهُمْ تَرْهَقُهُمْ ذِلَّةٌ وَقَدْ كَانُوا يُدْعَوْنَ إِلَى السُّجُودِ وَهُمْ سَالِمُونَ
স্মরণ কর, সেই দিনের কথা যেদিন ‘সাক’ উন্মোচিত করা হবে, সেই দিন তাদেরকে আহবান করা হবে সিজদা করার জন্য, কিন্তু তারা সক্ষম হবে না। * তাদের দৃষ্টি অবনত, হীনতা তাদেরকে আচ্ছন্ন করবে। অথচ যখন তারা নিরাপদ ছিল তখন তো তাদেরকে অহবান করা হয়েছিল সিজদা করতে।-আল কলম ৬৮ : ৪২-৪৩
মুনাফিকরা একদিকে কুরআন, ইসলাম ও ইসলামের নবীর প্রতি অবজ্ঞা ও বিদ্রূপ করে অন্যদিকে মুসলমানদের থেকে তা গোপন করারও চেষ্টা করে। কিন্তু আল্লাহ তাআলা তা প্রকাশ করেই দেন।
يَحْذَرُ الْمُنَافِقُونَ أَنْ تُنَزَّلَ عَلَيْهِمْ سُورَةٌ تُنَبِّئُهُمْ بِمَا فِي قُلُوبِهِمْ قُلِ اسْتَهْزِئُوا إِنَّ اللَّهَ مُخْرِجٌ مَا تَحْذَرُونَ l وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ لَيَقُولُنَّ إِنَّمَا كُنَّا نَخُوضُ وَنَلْعَبُ قُلْ أَبِاللَّهِ وَآَيَاتِهِ وَرَسُولِهِ كُنْتُمْ تَسْتَهْزِئُونَ l لَا تَعْتَذِرُوا قَدْ كَفَرْتُمْ بَعْدَ إِيمَانِكُمْ إِنْ نَعْفُ عَنْ طَائِفَةٍ مِنْكُمْ نُعَذِّبْ طَائِفَةً بِأَنَّهُمْ كَانُوا مُجْرِمِينَ
মুনাফিকরা ভয় করে, তাদের সম্পর্কে এমন এক সূরা না অবতীর্ণ হয়, যা তাদের অন্তরের কথা ব্যক্ত করে দিবে। বল, বিদ্রূপ করতে থাক; তোমরা যা ভয় কর আল্লাহ তা প্রকাশ করে দেবেন। * এবং তুমি তাদেরকে প্রশ্ন করলে তারা নিশ্চয়ই বলবে, ‘আমরা তো আলাপ-আলোচনা ও ক্রীড়া-কৌতুক করছিলাম।’ বল, তোমরা কি আল্লাহ, তাঁর আয়াত ও তাঁর রাসূলকে বিদ্রূপ করছ। * তোমরা অযুহাত দেখিও না। তোমরা ঈমানের পর কুফরী করেছ। তোমাদের মধ্যে কোনো দলকে ক্ষমা করলেও অন্যদলকে শাস্তি দেব, কারণ তারা অপরাধী।-আত তাওবা ৯ : ৬৪-৬৬
অর্থাৎ অবজ্ঞা ও বিদ্রূপ করে এই অজুহাত দাড় করানো যে, আমরা এমনি একটু ঠাট্টা করছিলাম কিংবা আমরা তো শুধু একসাথে বসে ছিলাম, মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়।
এই আয়াত থেকে আরো জানা গেল, মুনাফিক যদিও ঈমানহীন, কিন্তু ভাষায় বা ভাবে যেহেতু ঈমানের দাবিদার তাই তার কুফরী কথাবার্তা বা কুফরী আচরণ ‘কুফর বা’দাল ঈমান’ (ঈমানের পরে কুফর) তথা ইরতিদাদ হিসেবে গণ্য। তার বিধান হবে মুরতাদের বিধান।
আর এই যে বলা হয়েছে, মুনাফিকদের কাউকে কাউকে আল্লাহ তাআলা মাফ করেন, এর অর্থ, দুনিয়ার শাস্তি স্থগিত করা যে, দেখা যাক কুফর ও ঈসলামবিদ্বেষে কতদূর সে যেতে পারে। আখিরাতের শাস্তি থেকে এদের কারোরই মুক্তির কোনো উপায় নেই।
وَعَدَ اللَّهُ الْمُنَافِقِينَ وَالْمُنَافِقَاتِ وَالْكُفَّارَ نَارَ جَهَنَّمَ خَالِدِينَ فِيهَا هِيَ حَسْبُهُمْ وَلَعَنَهُمُ اللَّهُ وَلَهُمْ عَذَابٌ مُقِيمٌ
মুনাফিক নর, মুনাফিক নারী ও কাফেরদেরকে আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন জাহান্নামের অগ্নির, যেখানে তারা স্থায়ী হবে, এটাই তাদের জন্য যথেষ্ট এবং আল্লাহ তাদেরকে লা’নত করেছেন আর তাদের জন্য রয়েছে স্থায়ী শাস্তি।-আত তাওবা ৯ : ৬৮
إِنَّ الْمُنَافِقِينَ فِي الدَّرْكِ الْأَسْفَلِ مِنَ النَّارِ وَلَنْ تَجِدَ لَهُمْ نَصِيرًا
বরং মুনাফিকগণ তো জাহান্নামের নিমণতম স্তরে থাকবে এবং তাদের জন্য তুমি কখনো কোনো সহায় পাবে না।-আন নিসা ৪ : ১৪৫
অবজ্ঞা ও বিদ্রূপ কেন, এর চেয়েও অনেক কম কষ্টদায়ক বিষয়ও কঠিন আযাবের কারণ। আর সেটাও বৈশিষ্ট্য মুনাফিকদেরই।
وَمِنْهُمُ الَّذِينَ يُؤْذُونَ النَّبِيَّ وَيَقُولُونَ هُوَ أُذُنٌ قُلْ أُذُنُ خَيْرٍ لَكُمْ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَيُؤْمِنُ لِلْمُؤْمِنِينَ وَرَحْمَةٌ لِلَّذِينَ آَمَنُوا مِنْكُمْ وَالَّذِينَ يُؤْذُونَ رَسُولَ اللَّهِ لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ l يَحْلِفُونَ بِاللَّهِ لَكُمْ لِيُرْضُوكُمْ وَاللَّهُ وَرَسُولُهُ أَحَقُّ أَنْ يُرْضُوهُ إِنْ كَانُوا مُؤْمِنِينَ l أَلَمْ يَعْلَمُوا أَنَّهُ مَنْ يُحَادِدِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَأَنَّ لَهُ نَارَ جَهَنَّمَ خَالِدًا فِيهَا ذَلِكَ الْخِزْيُ الْعَظِيمُ
এবং তাদের মধ্যে এমনও লোক আছে, যারা নবীকে কষ্ট দেয় এবং বলে, ‘সে তো কান-পাতলা। বল, তার কান তোমাদের জন্য যা মঙ্গল তা-ই শোনে। তিনি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনেন এবং মুমিনদেরকে বিশ্বাস করেন; তোমাদের মধ্যে যারা মুমিন তিনি তাদের জন্য রহমত এবং যারা আল্লাহর রাসূলকে কষ্ট দেয় তাদের জন্য আছে মর্মন্তুদ শাস্তি। * তারা তোমাদেরকে সন্তুষ্ট করার জন্য তোমাদের নিকট আল্লাহর শপথ করে। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল এরই অধিক হকদার যে, ওরা তাদেরকেই সন্তুষ্ট করে যদি ওরা মুমিন হয়। * ওরা কি জানে না যে, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরোধিতা করে তার জন্য তো আছে জাহান্নামের অগ্নি, যে স্থানে সে স্থায়ী হবে। সেটাই চরম লাঞ্ছনা।-আত তাওবা ৯ : ৬১-৬৩
মুনাফিকদের কাছে আল্লাহর দ্বীন, আল্লাহর ইবাদত ও আল্লাহর আহকাম অতি অপছন্দনীয়
الْأَعْرَابُ أَشَدُّ كُفْرًا وَنِفَاقًا وَأَجْدَرُ أَلَّا يَعْلَمُوا حُدُودَ مَا أَنْزَلَ اللَّهُ عَلَى رَسُولِهِ وَاللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ l وَمِنَ الْأَعْرَابِ مَنْ يَتَّخِذُ مَا يُنْفِقُ مَغْرَمًا وَيَتَرَبَّصُ بِكُمُ الدَّوَائِرَ عَلَيْهِمْ دَائِرَةُ السَّوْءِ وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ l وَمِنَ الْأَعْرَابِ مَنْ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ وَيَتَّخِذُ مَا يُنْفِقُ قُرُبَاتٍ عِنْدَ اللَّهِ وَصَلَوَاتِ الرَّسُولِ أَلَا إِنَّهَا قُرْبَةٌ لَهُمْ سَيُدْخِلُهُمُ اللَّهُ فِي رَحْمَتِهِ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ
কুফরী ও কপটতায় মরুবাসীগণ কঠোরতর; এবং আল্লাহ তাঁর রাসূলের প্রতি যা অবতীর্ণ করেছেন, তার সীমারেখা সম্পর্কে অজ্ঞ থাকার যোগ্যতা এদের অধিক। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। *মরুবাসীদের কেউ কেউ, যা তারা আল্লাহর পথে ব্যয় করে তা অর্থদন্ড বলে গণ্য করে এবং তোমাদের ভাগ্যবিপর্যয়ের প্রতীক্ষা করে। মন্দ ভাগ্যচক্র ওদের হোক। আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। মরুবাসীদের কেউ কেউ আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে এবং যা ব্যয় করে তাকে আল্লাহর সান্নিধ্য ও রাসূলের দুআ লাভের উপায় মনে করে। বাস্তবিকই ওটা তাদের জন্য আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের উপায়; আল্লাহ তাদেরকে নিজ রহমতে দাখিল করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।-আত তাওবা ৯ : ৯৭-৯৯
নামাযও তাদের কাছে অপছন্দনীয়। এরপরও মুনাফিকী গোপন রাখার জন্য কখনো কখনো লোকদেখানো নামায পড়ে।
مُذَبْذَبِينَ بَيْنَ ذَلِكَ لَا إِلَى هَؤُلَاءِ وَلَا إِلَى هَؤُلَاءِ وَمَنْ يُضْلِلِ اللَّهُ فَلَنْ تَجِدَ لَهُ سَبِيلًا
দোটানায় দোদুল্যমান, না এদের দিকে, না ওদের দিকে এবং আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন তুমি তার জন্য কখনো কোনো পথ পাবে না।-আন নিসা ৪ : ১৪৩
আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাব এবং তার প্রদত্ত শরীয়ত অপছন্দ করা কুফরী। যে এই কুফরীতে লিপ্ত ব্যক্তিদের কিছুমাত্র সমর্থন করবে সে মুরতাদ।
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا إِنْ تَنْصُرُوا اللَّهَ يَنْصُرْكُمْ وَيُثَبِّتْ أَقْدَامَكُمْ l وَالَّذِينَ كَفَرُوا فَتَعْسًا لَهُمْ وَأَضَلَّ أَعْمَالَهُمْ
হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহকে সাহায্য কর আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করবেন এবং তোমাদের অবস্থান দৃঢ় করবেন। * যারা কুফরী করে তাদের জন্য রয়েছে দুর্ভোগ এবং তিনি তাদের কর্ম ব্যর্থ করে দিবেন।-মুহাম্মাদ ৪৭ : ৭-৮
আরো ইরশাদ হয়েছে-
إِنَّ الَّذِينَ ارْتَدُّوا عَلَى أَدْبَارِهِمْ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمُ الْهُدَى الشَّيْطَانُ سَوَّلَ لَهُمْ وَأَمْلَى لَهُمْ l ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ قَالُوا لِلَّذِينَ كَرِهُوا مَا نَزَّلَ اللَّهُ سَنُطِيعُكُمْ فِي بَعْضِ الْأَمْرِ وَاللَّهُ يَعْلَمُ إِسْرَارَهُمْ l فَكَيْفَ إِذَا تَوَفَّتْهُمُ الْمَلَائِكَةُ يَضْرِبُونَ وُجُوهَهُمْ وَأَدْبَارَهُمْ l ذَلِكَ بِأَنَّهُمُ اتَّبَعُوا مَا أَسْخَطَ اللَّهَ وَكَرِهُوا رِضْوَانَهُ فَأَحْبَطَ أَعْمَالَهُمْ
যারা নিজেদের নিকট সৎপথ ব্যক্ত হওয়ার পর তা পরিত্যাগ করে শয়তান তাদের কাজকে শোভন করে দেখায় এবং তাদেরকে মিথ্যা আশা দেখায়। * এটা এইজন্য যে, আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেন, তা যারা অপছন্দ করে তাদেরকে ওরা বলে, ‘আমরা কোনো কোনো বিষয়ে তোমাদের আনুগত্য করব’’ আল্লাহ ওদের গোপন অভিসন্ধি অবগত আছেন। * ফিরিশতারা যখন ওদের মুখমন্ডলে ও পৃষ্ঠদেশে আঘাত করতে করতে প্রাণ হরণ করবে, তখন ওদের দশা কেমন হবে! *এটা এইজন্য যে, ওরা তার অনুসরণ করে,যা আল্লাহর অসন্তোষ জন্মায় এবং তাঁর সন্তুষ্টি অপ্রিয় গণ্য করে। তাই তিনি এদের কর্ম নিষ্ফল করে দেন।-সূরা মুহাম্মাদ ৪৭ : ২৫-২৮
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে এটুকু বেয়াদবীও আল্লাহ তাআলা বরদাশত করেন না যে, কথা বলার সময় তাঁর স্বরের চেয়ে স্বর উঁচু করবে। ইরশাদ হয়েছে যে, শুধু এই অশিষ্ট আচরণের কারণে সকল আমল ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لَا تُقَدِّمُوا بَيْنَ يَدَيِ اللَّهِ وَرَسُولِهِ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ عَلِيمٌ l يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لَا تَرْفَعُوا أَصْوَاتَكُمْ فَوْقَ صَوْتِ النَّبِيِّ وَلَا تَجْهَرُوا لَهُ بِالْقَوْلِ كَجَهْرِ بَعْضِكُمْ لِبَعْضٍ أَنْ تَحْبَطَ أَعْمَالُكُمْ وَأَنْتُمْ لَا تَشْعُرُونَ l إِنَّ الَّذِينَ يَغُضُّونَ أَصْوَاتَهُمْ عِنْدَ رَسُولِ اللَّهِ أُولَئِكَ الَّذِينَ امْتَحَنَ اللَّهُ قُلُوبَهُمْ لِلتَّقْوَى لَهُمْ مَغْفِرَةٌ وَأَجْرٌ عَظِيمٌ
হে মুমিনগণ! আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সমক্ষে তোমরা কোনো বিষয়ে অগ্রণী হয়ো না এবং আল্লাহকে ভয় কর; আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। * হে মুমিনগণ! তোমরা নবীর কণ্ঠস্বরের উপর নিজেদের কণ্ঠস্বর উঁচু করো না। এবং নিজেদের মধ্যে যেভাবে উচ্চস্বরে কথা বল তাঁর সাথে সেই রূপ উচ্চস্বরে কথা বলো না, কারণ এতে তোমাদের কর্ম নিষ্ফল হয়ে যাবে তোমাদের অজ্ঞাতসারে। * যারা আল্লাহর রাসূলের সম্মুখে নিজেদের কণ্ঠস্বর নীচু করে, আল্লাহ তাদের অন্তরকে তাকওয়ার জন্য পরীক্ষা করে নিয়েছেন। তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও মহা পুরস্কার।-আল হুজুরাত ৪৯ : ১-৩
মোটকথা, ইসলাম, ইসলামের নবী ও ইসলামের নিদর্শন ও ইসলামের বিধানসমূহের প্রতি ভালোবাসা ও ভক্তি-শ্রদ্ধা ঈমানের অপরিহার্য অংশ, যা ছাড়া ঈমান কল্পনাও করা যায় না। আর এইসব বিষয়কে অবজ্ঞা, বিদ্রূপ করা, বিদ্বেষ পোষণ করা, এমনকি অপ্রীতিকর মনে করাও কুফরী ও মুনাফিকী। এই মানসিকতা পোষণকারীদের ঈমান-ইসলামের সাথে বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই।
৯. ঈমান একটি একক, এতে বিভাজনের অবকাশ নেই
এটি ঈমান-সংক্রান্ত এক গুরুত্বপূর্ণ নীতি, যা পুরোপুরি স্পষ্ট ও স্বীকৃত হওয়ার পরও অনেককে উদাসীনতা প্রদর্শন করতে দেখা যায়। ঈমান সাব্যস্ত হওয়ার জন্য ইসলামের সকল অকাট্য বিধান ও বিশ্বাসকে সত্য মনে করা এবং কবুল করা অপরিহার্য। এর কোনো একটিকে অস্বীকার করা বা কোনো একটির উপর আপত্তি তোলাও ঈমান বরবাদ হওয়ার জন্য যথেষ্ট। যেমন অজু হওয়ার জন্য অজুর সবগুলো ফরয পালন করা জরুরি, কিন্তু তা ভেঙ্গে যাওয়ার জন্য অজুভঙ্গের সবগুলো কারণ উপস্থিত হওয়া জরুরি নয়। যে কোনো একটি কারণ দ্বারাই অজু ভেঙ্গে যায়। তদ্রূপ ঈমান তখনই অস্তিত্ব লাভ করে যখন ইসলামের সকল অকাট্য বিধান ও বিশ্বাস মন থেকে কবুল করা হয়। পক্ষান্তরে এসবের কোনো একটিকেও অস্বীকার করার দ্বারা ঈমান নষ্ট হয়ে যায়।
আর অবজ্ঞা ও বিদ্রূপ তো এতই ভয়াবহ যে, তা শরয়ী দলীলে প্রমাণিত ছোট কোনো বিষয়ে প্রকাশিত হলেও সাথে সাথে ঐ ব্যক্তির ঈমান শেষ হয়ে যাবে এবং তার উপর কুফরের বিধান আরোপিত হবে।
আকাইদ ও আহকামের বিদ্রূপ কিংবা অস্বীকার তো এজন্যই কুফর যে, তা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য বর্জন এবং তাঁদের প্রতি ঔদ্ধত্য প্রকাশ। সুতরাং গোটা ইসলামকে অস্বীকার বা বিদ্রূপ করা আর ইসলামের কোনো একটি বিষয়কে অস্বীকার বা বিদ্রূপ করা একই কথা! উভয় ক্ষেত্রে একথা
বাস্তব যে, ঐ ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে এবং ঔদ্ধত্য ও বিরুদ্ধতা প্রকাশ করেছে। ইবলীস তো কাফির মরদূদ হয়েছিল একটি হুকুমের উপর আপত্তি করেই। বিষয়টি এমনিতেও স্পষ্ট। এরপরও আল্লাহ তাআলা কুরআন হাকীমে একাধিক জায়গায় তা সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন।
أَفَتُؤْمِنُونَ بِبَعْضِ الْكِتَابِ وَتَكْفُرُونَ بِبَعْضٍ فَمَا جَزَاءُ مَنْ يَفْعَلُ ذَلِكَ مِنْكُمْ إِلَّا خِزْيٌ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ يُرَدُّونَ إِلَى أَشَدِّ الْعَذَابِ وَمَا اللَّهُ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعْمَلُونَ
তবে কি তোমরা কিতাবের কিছু অংশে বিশ্বাস কর আর কিছু অংশ প্রত্যাখ্যান কর? সুতরাং তোমাদের যারা এরকম করে, তাদের একমাত্র পরিণাম পার্থিব জীবনে হীনতা এবং কেয়ামতের দিন তারা কাঠিন শাস্তির দিকে নিক্ষিপ্ত হবে, তাদের কর্মকান্ড সম্পর্কে আল্লাহ বেখবর নন।-আল বাকারা ২ : ৮৫
আরো ইরশাদ হয়েছে-
إِنَّ الَّذِينَ يَكْفُرُونَ بِاللَّهِ وَرُسُلِهِ وَيُرِيدُونَ أَنْ يُفَرِّقُوا بَيْنَ اللَّهِ وَرُسُلِهِ وَيَقُولُونَ نُؤْمِنُ بِبَعْضٍ وَنَكْفُرُ بِبَعْضٍ وَيُرِيدُونَ أَنْ يَتَّخِذُوا بَيْنَ ذَلِكَ سَبِيلًا l أُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ حَقًّا وَأَعْتَدْنَا لِلْكَافِرِينَ عَذَابًا مُهِينًا l وَالَّذِينَ آَمَنُوا بِاللَّهِ وَرُسُلِهِ وَلَمْ يُفَرِّقُوا بَيْنَ أَحَدٍ مِنْهُمْ أُولَئِكَ سَوْفَ يُؤْتِيهِمْ أُجُورَهُمْ وَكَانَ اللَّهُ غَفُورًا رَحِيمًا
যারা আল্লাহ ও তার রাসূলগণকে অস্বীকার করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলগণের মধ্যে পার্থক্য করতে চায় ও বলে, আমরা কতক (রাসূল)-এর প্রতি তো ঈমান রাখি এবং কতককে অস্বীকার করি। আর (এভাবে) তারা (কুফর ও ঈমানের মাঝখানে) মাঝামাঝি একটি পথ অবলম্বন করতে চায়।
এরূপ লোকই সত্যিকারের কাফির। আর আমি কাফিরদের জন্য লাঞ্ছনাকর শাস্তি প্রস্ত্তত করে রেখেছি।
যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনবে এবং তাদের কারও মধ্যে কোনও পার্থক্য করবে না, আল্লাহ তাদেরকে তাদের কর্মফল দান করবেন।
আল্লাহ অতিশয় ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।-সূরা নিসা ৪ : ১৫০-১৫২
যারা শরীয়তের শুধু ‘শান্তির বিধান গ্রহণ করেন আর জিহাদের বিধানকে সন্ত্রাস বা উগ্রবাদিতা বলেন; উপদেশের কথাগুলো গ্রহণ করেন আর হদ-তাযীর ও কিসাসের বিধান বর্জনীয় মনে করেন; ইবাদতের বিষয়গুলো গ্রহণ করেন, আর লেনদেন ও হালাল-হারামের বিধান মানতে অসম্মত থাকেন; ব্যক্তিগত জীবনের বিধিবিধান গ্রহণ করেন, কিন্তু সমাজ ও রাষ্ট্র-পরিচালনার বিধি-বিধান (প্রশাসন, নির্বাহী ও বিচার-বিভাগের সাথে সংশ্লিষ্ট) সম্পর্কে বিরূপ থাকেন; অথবা ইবাদত ও লেনদেনের বিধান মানেন, কিন্তু বেশ-ভূষা, আনন্দ-বিষাদ, পর্ব-উৎসব ও জীবন যাপনের আদব কায়েদার ইসলামী নির্দেশ ও নির্দেশনার প্রতি বিরূপ থাকেন বা মানাকে জরুরি মনে করেন না এরা সবাই ইসলামের কিছু অংশের অস্বীকার বা কিছু অংশের উপর বিরুদ্ধপ্রশ্নের কারণে নিজের ঈমান হারিয়ে বসেছেন। তাদের ঈমান মূলত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর নয়; নিজ পসন্দ-অপসন্দের উপর কিংবা নেতা ও গুরুর পছন্দ-অপছন্দের উপর। নতুবা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিধান তো এইটাও এবং ঐটাও। এরপরও এই দ্বিমুখিতা কেন? আল্লাহর আদেশ তো এই-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا ادْخُلُوا فِي السِّلْمِ كَافَّةً وَلَا تَتَّبِعُوا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُبِينٌ
হে মুমিনগণ! তোমরা সর্বাত্মকভাবে ইসলামে প্রবেশ কর এবং শয়তানের পদাংক অনুসরণ করো না। নিশ্চয় সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।-আল বাকারা ২ : ২০৮
ভালোভাবে বুঝে নিন, শরীয়তের বিধি বিধানকে হক ও অবশ্যপালনীয় বলে স্বীকার করার পর পালনে ত্রুটি হলে তা গোনাহ, কুফর নয়। কারণ এই ব্যক্তি নিজেকে অপরাধী মনে করে। পক্ষান্তরে বিধানের উপর বিরুদ্ধপ্রশ্ন বা প্রতিবাদের অর্থ সরাসরি আনুগত্য-ত্যাগ, যা সাধারণ অপরাধ নয়, বিদ্রোহ। এটা মানুষকে দুনিয়ার বিধানে ‘মোবাহুদ দম’ (হত্যাযোগ্য) আর আখিরাতের বিধানে চিরজাহান্নামী সাব্যস্ত করে।
১০. ঈমানী আকাইদ ও আহকাম স্পষ্টভাবে ঘোষিত ও গোটা উম্মাহর দ্বারা প্রজন্ম পরম্পরায় প্রবাহিত, এতে বিকৃতি ও অপব্যাখ্যা অস্বীকারেরই এক প্রকার
ঈমানী আকাইদ ও আহকাম অস্বীকার করা, অবজ্ঞা ও বিদ্রূপ করা এবং বিরুদ্ধ প্রশ্নের লক্ষ্যবস্ত্ত বানানো যেমন কুফর তেমনি এগুলোর কোনো একটিরও এমন কোনো ‘ব্যাখ্যা’ করাও সরাসরি কুফর, যার দ্বারা তার প্রতিষ্ঠিত অর্থই বদলে যায়। কোনো কিছুর অপব্যাখ্যা ও অর্থের বিকৃতি হচ্ছে ঐ বিষয়টি অস্বীকারের ভয়াবহতম প্রকার। ঈমানের বিষয়গুলোর উপর প্রতিষ্ঠিত অর্থেই ঈমান আনতে হবে। নিজের পক্ষ হতে সেগুলোর কোনো অর্থ নির্ধারণ করে, কিংবা কোনো বেদ্বীনের নবউদ্ভাবিত অর্থ গ্রহণ করে ঈমানের দাবি করা সম্পূর্ণ অর্থহীন ও সুস্পষ্ট মুনাফেকী।
‘ব্যাখ্যা’ তো ঐখানে হয় যেখানে ভাষার বাকরীতি ও মর্মোদ্ধারের নীতিমালা অনুযায়ী একাধিক অর্থের সম্ভাবনা থাকে, কিন্তু যেখানে কোনো বিধান বা বিশ্বাসের অর্থ ও মর্ম আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগ থেকে অসংখ্য মুমিনের সুসংহত সূত্রে প্রজন্ম পরম্পরায় প্রবাহিত হয়ে আসে এবং যাতে প্রতি যুগে মুসলিম উম্মাহর ইজমা ও ঐকমত্য বিদ্যমান থাকে সেখানে ভিন্ন ব্যাখ্যার অবকাশ থাকে কীভাবে? সেখানে তো ঐ অর্থই নিশ্চিত ও নির্ধারিত। ওখানে ভিন্ন ‘ব্যাখ্যার’ অর্থ ঐ অকাট্য ও প্রতিষ্ঠিত বিষয়কে অস্বীকার করা।
যেমন কেউ বলল, ‘নামায সত্য, কিন্তু তা পাঁচ ওয়াক্ত নয়, দুই ওয়াক্ত।’ কিংবা বলল, ‘নামায সত্য, কিন্তু আসল নামায তা নয়, যা মুসল্লিগণ মসজিদে আদায় করেন, আসল নামায তো মনের নামায, যে তা আদায় করতে পারে তার দেহের নামাযের প্রয়োজন নেই।’ (নাউযুবিল্লাহ)
কিংবা বলল, ‘শরীয়ত সত্য, কিন্তু তা আম বা সাধারণ মানুষের জন্য, খাস বা বিশেষ ব্যক্তিদের জন্য আছে আলাদা শরীয়ত।’ (নাউযুবিল্লাহ)
কিংবা বলল, ‘শরীয়ত তো প্রাচীন যুগের ব্যাপার, আজকের উন্নতির যুগে এর সংস্কার প্রয়োজন।’ (নাউযুবিল্লাহ)
কিংবা বলল, ‘‘শরীয়ত মানা একটি ঐচ্ছিক ব্যাপার। মানলে ভালো, না মানলেও দোষ নেই।’ (নাউযুবিল্লাহ)
কিংবা কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের মতো বলল, ‘মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল ও খাতামুন্নাবিয়্যীন। তবে গোলাম আহমদ কাদিয়ানীও নবী, তিনি জিল্লী বা বুরুজী নবী। এর দ্বারা খতমে নবুওতের আকীদায় কোনো ধাক্কা লাগে না।’ (নাউযুবিল্লাহ)
তো এইসব কুফরী ‘ব্যাখ্যা’ এবং এজাতীয় আরো অসংখ্য ‘ব্যাখ্যা’, যার আবরণে বেদ্বীন-মুলহিদ চক্র ‘জরুরিয়াতে দ্বীন’ (দ্বীনের সর্বজনবিদিত বিষয়) ও ‘কাওয়াতিউল ইসলাম’ (ইসলামের অকাট্য বিষয়াদি)-এর অস্বীকার করে এবং সেই কুফরীকে ঢেকে রাখার অপচেষ্টা করে, এর দ্বারা তো তাদের কুফরী আরো ভয়াবহ হয়ে যায়। ‘অস্বীকারে’র সাথে ‘অপব্যাখ্যা’ যুক্ত করে নিজেদেরকে সাধারণ কাফিরের চেয়েও মারাত্মক প্রকারের কাফির- মুলহিদ, যিন্দীক ও মুনাফিকের সাড়িতে অন্তর্ভুক্ত করে।
আল্লাহ তাআলার এই হুঁশিয়ারি এদের সকলের মনে রাখা উচিৎ-
إِنَّ الَّذِينَ يُلْحِدُونَ فِي آَيَاتِنَا لَا يَخْفَوْنَ عَلَيْنَا أَفَمَنْ يُلْقَى فِي النَّارِ خَيْرٌ أَمْ مَنْ يَأْتِي آَمِنًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ اعْمَلُوا مَا شِئْتُمْ إِنَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ
যারা আমার আয়াতসমূহকে বিকৃত করে তারা আমার অগোচরে নয়, শ্রেষ্ঠ কে-যে ব্যক্তি জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে সে, না যে কিয়ামতের দিন নিরাপদে থাকবে সে? তোমাদের যা ইচ্ছা কর; তোমরা যা কর তিনি তার সম্যক দ্রষ্টা।-হা-মীম আসসাজদা ৪১ : ৪০
দ্বীনকে অপব্যাখ্যার হাত থেকে রক্ষার জন্য আল্লাহ তাআলা ‘সাবীলুল মুমিনীন’কে মানদন্ড বানিয়েছেন। এবং ‘সাবীলুল মুমিনীন’ (মুমিনের সর্বসম্মত পথ) থেকে বিচ্যুতিকে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধতার মতো জাহান্নামে যাওয়ার কারণ সাব্যস্ত করেছেন। এ কারণে কোনো ইসলামী আকীদা বা হুকুমের (বিশ্বাস বা বিধানের) এমন সকল ‘ব্যাখ্যা’র গন্তব্য জাহান্নাম, যা উম্মাহর সর্বসম্মত ‘ব্যাখ্যার’ বিরোধী।
وَمَنْ يُشَاقِقِ الرَّسُولَ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهُدَى وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيلِ الْمُؤْمِنِينَ نُوَلِّهِ مَا تَوَلَّى وَنُصْلِهِ جَهَنَّمَ وَسَاءَتْ مَصِيرًا
* কারো নিকট সৎপথ প্রকাশ হওয়ার পর সে যদি রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং মুমিনদের পথ ব্যতীত অন্য পথ অনুসরণ করে, তবে যে দিকেই সে ফিরে যায়, সে দিকেই তাকে ফিরিয়ে দেব এবং জাহান্নামে তাকে দগ্ধ করব, আর তা কত মন্দ আবাস!-আন নিসা ৪ : ১১৫
আল্লাহ তাআলা কুরআন মজীদে একথাও জানিয়ে দিয়েছেন যে, মুনাফিকদের কাছে আল্লাহ তাআলার এই মানদন্ড পছন্দনীয় নয়। তারা ঈমানের দাবি করে, কিন্তু মুমিনদের মতো ইমান আনে না, নিজেদের মনমতো ঈমান আনে। এরা মুমিনদের মনে করে বুদ্ধিহীন। আজও আমরা একই প্রবণতা লক্ষ করছি-
وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ آَمِنُوا كَمَا آَمَنَ النَّاسُ قَالُوا أَنُؤْمِنُ كَمَا آَمَنَ السُّفَهَاءُ أَلَا إِنَّهُمْ هُمُ السُّفَهَاءُ وَلَكِنْ لَا يَعْلَمُونَ l وَإِذَا لَقُوا الَّذِينَ آَمَنُوا قَالُوا آَمَنَّا وَإِذَا خَلَوْا إِلَى شَيَاطِينِهِمْ قَالُوا إِنَّا مَعَكُمْ إِنَّمَا نَحْنُ مُسْتَهْزِئُونَ l اللَّهُ يَسْتَهْزِئُ بِهِمْ وَيَمُدُّهُمْ فِي طُغْيَانِهِمْ يَعْمَهُونَ l أُولَئِكَ الَّذِينَ اشْتَرَوُا الضَّلَالَةَ بِالْهُدَى فَمَا رَبِحَتْ تِجَارَتُهُمْ وَمَا كَانُوا مُهْتَدِينَ
যখন তাদেরকে বলা হয়, যে সকল লোক ঈমান এনেছে তোমরাও তাদের মত ঈমান আনয়ন কর, তারা বলে, নির্বোধগণ যেরূপ ঈমান এনেছে আমরাও কি সেরূপ ঈমান আনব? জেনে রাখ, এরাই নির্বোধ, কিন্তু তারা জানে না। * যখন তারা মুমিনগণের সংস্পর্শে আসে তখন বলে, আমরা ঈমান এনেছি। আর যখন নিভৃতে তাদের শয়তানদের সাথে মিলিত হয় তখন বলে, আমরা তো তোমাদের সাথেই আছি। আমরা শুধু তাদের সাথে ঠাট্টা-তামাশা করে থাকি। * আল্লাহ তাদের সাথে তামাশা করেন এবং তাদেরকে তাদের অবাধ্যতায় বিভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়ানোর অবকাশ দেন। * এরাই হিদায়াতের বিনিময়ে ভ্রান্তি ক্রয় করে। সুতরাং তাদের ব্যবসা লাভজনক হয়নি, তারা সৎপথেও পরিচালিত নয়।-আল বাকারা ২ : ১৩-১৬
সুতরাং হেদায়াত এদের কাছে পাওয়া যাবে না। পাওয়া যাবে তাদেরই কাছে যাদের এরা ‘বুদ্ধিহীন’ বলে।
১১. দিল ও যবানের একাত্মতা ঈমান। এখানে নেফাকের কোন স্থান নেই।
إِذَا جَاءَكَ الْمُنَافِقُونَ قَالُوا نَشْهَدُ إِنَّكَ لَرَسُولُ اللَّهِ وَاللَّهُ يَعْلَمُ إِنَّكَ لَرَسُولُهُ وَاللَّهُ يَشْهَدُ إِنَّ الْمُنَافِقِينَ لَكَاذِبُونَ l اتَّخَذُوا أَيْمَانَهُمْ جُنَّةً فَصَدُّوا عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ إِنَّهُمْ سَاءَ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
যখন মুনাফিকরা তোমার কাছে আসে তারা বলে, ‘আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসূল’। আল্লাহ জানেন যে, তুমি নিশ্চয়ই তাঁর রাসূল এবং আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, মুনাফিকরা অবশ্যই মিথ্যাবাদী।
* ওরা ওদের শপথগুলিকে ঢালরূপে ব্যবহার করে এবং ওরা আল্লাহর পথ হতে মানুষকে নিবৃত্ত করে। ওরা যা করছে তা কত মন্দ!-আল মুনাফিকূন ৬৩ : ১-২
সামনে ইরশাদ হয়েছে-
هُمُ الَّذِينَ يَقُولُونَ لَا تُنْفِقُوا عَلَى مَنْ عِنْدَ رَسُولِ اللَّهِ حَتَّى يَنْفَضُّوا وَلِلَّهِ خَزَائِنُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَلَكِنَّ الْمُنَافِقِينَ لَا يَفْقَهُونَ l يَقُولُونَ لَئِنْ رَجَعْنَا إِلَى الْمَدِينَةِ لَيُخْرِجَنَّ الْأَعَزُّ مِنْهَا الْأَذَلَّ وَلِلَّهِ الْعِزَّةُ وَلِرَسُولِهِ وَلِلْمُؤْمِنِينَ وَلَكِنَّ الْمُنَافِقِينَ لَا يَعْلَمُونَ
ওরাই বলে, ‘তোমরা আল্লাহর রাসূলের সহচরদের জন্য ব্যয় করো না, যাতে ওরা সরে পড়ে’। আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর ধন-ভান্ডার তো আল্লাহরই, কিন্তু মুনাফিকরা তা বুঝে না। * ওরা বলে, আমরা মদীনায় প্রত্যাবর্তন করলে যারা মর্যাদাবান তারা হীনদেরকে সেখান থেকে বহিস্কার করবে। কিন্তু মর্যাদা তো আল্লাহরই, আর তাঁর রাসূল ও মুমিনদের। তবে মুনাফিকগণ তা জানে না।-আল মুনাফিকূন ৬৩ : ৭-৮
১২. ঈমান একটি স্থায়ী অঙ্গিকার, ‘ইরতিদাদ’ সাধারণ কুফরের চেয়েও ভয়াবহ কুফর
ঈমান আল্লাহ ও বান্দাদের মধ্যকার এক স্থায়ী অঙ্গিকারের নাম; যার কোনো মেয়াদ নেই। যখনই ঈমানের সম্পদ পাওয়া গেল তখন থেকেই এর পুষ্টি ও বর্ধন, শক্তি ও সংস্কারে মগ্ন থাকা জরুরি। সবসময় সতর্ক থাকা চাই, এমন কোনো কথা বা কাজ যেন প্রকাশিত না হয়, যা ঈমান নষ্ট করে। আর আল্লাহর দরবারে তাঁর শেখানো দুআ করতে থাকা চাই-
رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ رَحْمَةً إِنَّكَ أَنْتَ الْوَهَّابُ
হে আমাদের প্রতিপালক! সরল পথ প্রদর্শনের পর তুমি আমাদের অন্তরকে সত্যলংঘনপ্রবণ করো না এবং তোমার নিকট হতে আমাদেরকে করুণা দাও, নিশ্চয়ই তুমি মহাদাতা।-আলে ইমরান ৩ : ৮
আল্লাহর কাছে ঐ বান্দার ঈমানই গ্রহণযোগ্য, যে ঈমানের উপর অবিচল থাকে। পক্ষান্তরে যে ঈমান থেকে সরে যায় সে তো দুই বিদ্রোহে লিপ্ত-কুফরের বিদ্রোহ ও ইরতিদাদের বিদ্রোহ।
অবিচল মুমিনদের জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে খোশখবরি-
إِنَّ الَّذِينَ قَالُوا رَبُّنَا اللَّهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوا فَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ l أُولَئِكَ أَصْحَابُ الْجَنَّةِ خَالِدِينَ فِيهَا جَزَاءً بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
* যারা বলে, ‘আমাদের প্রতিপালক তো আল্লাহ’ অতঃপর অবিচল থাকে, তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিত হবে না। * তারাই জান্নাতের অধিবাসী, সেখানে তারা স্থায়ী হবে, তারা যা করত তার পুরস্কার স্বরূপ।-আল আহকাফ ৪৬ : ১৩-১৪
অন্য আয়াতে আছে-
إِنَّ الَّذِينَ قَالُوا رَبُّنَا اللَّهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوا تَتَنَزَّلُ عَلَيْهِمُ الْمَلَائِكَةُ أَلَّا تَخَافُوا وَلَا تَحْزَنُوا وَأَبْشِرُوا بِالْجَنَّةِ الَّتِي كُنْتُمْ تُوعَدُونَ l نَحْنُ أَوْلِيَاؤُكُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِي الْآَخِرَةِ وَلَكُمْ فِيهَا مَا تَشْتَهِي أَنْفُسُكُمْ وَلَكُمْ فِيهَا مَا تَدَّعُونَ l نُزُلًا مِنْ غَفُورٍ رَحِيمٍ
যারা বলে, ‘আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ’, অতঃপর অবিচলিত থাকে, তাদের নিকট অবতীর্ণ হয়, ফিরিশতা এবং বলে, তোমরা ভীত হয়ো না, চিন্তিতও হয়ো না এবং তোমাদেরকে যে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল তার জন্য আনন্দিত হও। * ‘আমরাই তোমাদের বন্ধু দুনিয়ার জীবনে ও আখিরাতে। সেখানে তোমাদের জন্য রয়েছে যা কিছু তোমাদের মন চায় এবং সেখানে তোমাদের জন্য রয়েছে যা তোমরা ফরমায়েশ কর। * এটা ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু আল্লাহর পক্ষ হতে আপ্যায়ন।-হামীম আসসাজদা ৪১ : ৩০-৩২
পক্ষান্তরে যারা ঈমানের উপর কায়েম থাকে না; বরং পশ্চাদপসরণ করে কিংবা বারবার এদিক-ওদিক আসা-যাওয়া করে এদের কাছে দ্বীন এক ক্রীড়ার বস্ত্ত! ইরতিদাদ (সত্য ধর্ম থেকে পিছু হটা) মূলত মুনাফিকদের কাজ। এর দ্বারা তারা দুর্বল ঈমানদারদের সংশয়গ্রস্ত করতে চায়। কুরআন মাজীদে তাদের এই অপকৌশলের বিবরণ আছে। (দেখুন : আলে ইমরান ৩ : ৭২-৭৩)
যে কোনো ইরতিদাদ সাধারণ কুফর থেকে ভয়াবহ। সাধারণ কুফর তো সত্য দ্বীন থেকে বিমুখ থাকা বা গ্রহণ না করা, কিন্তু ইরতিদাদ নিছক বিমুখতাই নয়, এ হচ্ছে বিরুদ্ধতা। সত্য দ্বীন গ্রহণ করার পর তা বর্জনের অর্থ ঐ দ্বীনকে অভিযুক্ত করা, যা নির্জলা অপবাদ। বরং ইরতিদাদ তো সত্য দ্বীনের প্রতি বিরুদ্ধতার পাশাপাশি ‘ইফসাদ ফিল আরদ’ (ভূপৃষ্ঠে দুস্কৃতি) ও বটে। বিশেষত মুরতাদ (সত্য দ্বীন ত্যাগকারী) যখন কটাক্ষ-কটূক্তি এবং অবজ্ঞা বিদ্রূপে লিপ্ত হয়। এ তো সরাসরি ‘মুহারিব’ (যুদ্ধঘোষণাকারী) ও ‘মুফসিদ ফিল আর্দ’ (ভূপৃষ্ঠে দুস্কৃতিকারী)
মুরতাদ সম্পর্কে কুরআন কারীমের আসমানী হুঁশিয়ারি পাঠ করুন :
إِنَّ الَّذِينَ آَمَنُوا ثُمَّ كَفَرُوا ثُمَّ آَمَنُوا ثُمَّ كَفَرُوا ثُمَّ ازْدَادُوا كُفْرًا لَمْ يَكُنِ اللَّهُ لِيَغْفِرَ لَهُمْ وَلَا لِيَهْدِيَهُمْ سَبِيلًا l بَشِّرِ الْمُنَافِقِينَ بِأَنَّ لَهُمْ عَذَابًا أَلِيمًا l الَّذِينَ يَتَّخِذُونَ الْكَافِرِينَ أَوْلِيَاءَ مِنْ دُونِ الْمُؤْمِنِينَ أَيَبْتَغُونَ عِنْدَهُمُ الْعِزَّةَ فَإِنَّ الْعِزَّةَ لِلَّهِ جَمِيعًا
যারা ঈমান আনে ও পরে কুফরী করে এবং আবার ঈমান আনে, আবার কুফরী করে, অতঃপর তাদের কুফরী প্রবৃত্তি বৃদ্ধি পায়, আল্লাহ তাদেরকে কিছুতেই ক্ষমা করবেন না এবং তাদেরকে কোনো পথে পরিচালিত করবেন না। * মুনাফিকদেরকে শুভসংবাদ দাও যে, তাদের জন্য মর্মন্তুদ শাস্তি রয়েছে! *মুমিনগণের পরিবর্তে যারা কাফিরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে তারা কি ওদের নিকট ইযযত চায়? সমস্ত ইযযত তো আল্লাহরই।-আন নিসা ৪ : ১৩৭-১৩৯
كَيْفَ يَهْدِي اللَّهُ قَوْمًا كَفَرُوا بَعْدَ إِيمَانِهِمْ وَشَهِدُوا أَنَّ الرَّسُولَ حَقٌّ وَجَاءَهُمُ الْبَيِّنَاتُ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ l أُولَئِكَ جَزَاؤُهُمْ أَنَّ عَلَيْهِمْ لَعْنَةَ اللَّهِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ l خَالِدِينَ فِيهَا لَا يُخَفَّفُ عَنْهُمُ الْعَذَابُ وَلَا هُمْ يُنْظَرُونَ l إِلَّا الَّذِينَ تَابُوا مِنْ بَعْدِ ذَلِكَ وَأَصْلَحُوا فَإِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ
আল্লাহ কিরূপে সৎপথে পরিচালিত করবেন সেই সম্প্রদায়কে, যারা ঈমান আনার পর ও রাসূলকে সত্য বলে সাক্ষ্য দেওয়ার পর এবং তাদের নিকট সুস্পষ্ট নিদর্শন আসার পর কুফরী করে? আল্লাহ যালিম সম্প্রদায়কে সৎপথে পরিচালিত করেন না, *এরাই তারা যাদের কর্মফল এই যে, তাদের উপর আল্লাহর, ফিরিশতাগণের এবং মানুষসকলের লানত, * তারা তাতে স্থায়ী হবে। তাদের শাস্তি লঘু করা হবে না এবং তাদেরকে অবকাশও দেওয়া হবে না; * তবে এর পর যারা তওবা করে ও নিজেদেরকে সংশোধন করে নেয় তারা ব্যতিরেকে। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।-সূরা আলে ইমরান ৩ : ৮৬-৮৯
কিন্তু যারা সারা জীবন কুফরের উপর থাকে আর মৃত্যু উপস্থিত হলে তওবা করে তাদের তওবা কবুল হয় না।
إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا بَعْدَ إِيمَانِهِمْ ثُمَّ ازْدَادُوا كُفْرًا لَنْ تُقْبَلَ تَوْبَتُهُمْ وَأُولَئِكَ هُمُ الضَّالُّونَ
ঈমান আনার পর যারা কুফরী করে এবং যাদের সত্য প্রত্যাখ্যান-প্রবৃত্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে তাদের তওবা কখনো কবুল হবে না। এরাই পথভ্রষ্ট।-আলে ইমরান ৩ : ৯০
আরো ইরশাদ হয়েছে-
وَلَيْسَتِ التَّوْبَةُ لِلَّذِينَ يَعْمَلُونَ السَّيِّئَاتِ حَتَّى إِذَا حَضَرَ أَحَدَهُمُ الْمَوْتُ قَالَ إِنِّي تُبْتُ الْآَنَ وَلَا الَّذِينَ يَمُوتُونَ وَهُمْ كُفَّارٌ أُولَئِكَ أَعْتَدْنَا لَهُمْ عَذَابًا أَلِيمًا
তওবা কবুলের বিষয়টি তাদের জন্য নয়, যারা অসৎকর্ম করতে থাকে। পরিশেষে তাদের কারও যখন মৃত্যুক্ষণ এসে পড়ে, তখন বলে, এখন আমি তওবা করলাম এবং তাদের জন্যও নয়, যারা কুফর অবস্থায়ই মারা যায়। এরূপ লোকদের জন্য তো আমি যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি প্রস্ত্তত করে রেখেছি।-সূরা নিসা (৪) : ১৮
আর এই প্রশ্ন যে, দুনিয়াতে মুরতাদের শাস্তি কী, এর জবাব তো সুস্পষ্টই। মুরতাদ যেহেতু আল্লাহ ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে যুদ্ধ ঘোষণাকারী ও ভূপৃষ্ঠে অনাচার বিস্তারকারী এজন্য তার শাস্তি মৃতুদন্ড, যা কার্যকর করা সরকারের উপর ফরয।
إِنَّمَا جَزَاءُ الَّذِينَ يُحَارِبُونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَيَسْعَوْنَ فِي الْأَرْضِ فَسَادًا أَنْ يُقَتَّلُوا أَوْ يُصَلَّبُوا أَوْ تُقَطَّعَ أَيْدِيهِمْ وَأَرْجُلُهُمْ مِنْ خِلَافٍ أَوْ يُنْفَوْا مِنَ الْأَرْضِ ذَلِكَ لَهُمْ خِزْيٌ فِي الدُّنْيَا وَلَهُمْ فِي الْآَخِرَةِ عَذَابٌ عَظِيمٌ l إِلَّا الَّذِينَ تَابُوا مِنْ قَبْلِ أَنْ تَقْدِرُوا عَلَيْهِمْ فَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ
যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কার্য করে বেড়ায় এটাই তাদের শাস্তি যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা শুলে চড়ানো হবে অথবা বিপরীত দিক হতে তাদের হাত ও পা কেটে ফেলা হবে অথবা তাদের দেশ হতে নির্বাসিত করা হবে। দুনিয়াতে এটাই তাদের লাঞ্ছনা ও পরকালে তাদের জন্য মহাশাস্তি রয়েছে। * তবে, তোমাদের আয়ত্তাধীনে আসার পূর্বে যারা তাওবা করবে তাদের জন্য নয়। সুতরাং জেনে রাখ যে, আল্লাহ অবশ্যই ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।-আল মাইদা ৫ : ৩৩-৩৪
আর আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
من بدل دينه فاقتلوه
অর্থাৎ, যে তার ধর্ম (ইসলাম) পরিবর্তন করে তাকে হত্যা কর।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৬৯২২
অন্য হাদীসে আছে, একবার মুয়ায রা. আবু মূসা আশআরী রা.-এর সাথে সাক্ষাত করতে এলেন, (তাঁরা উভয়ে ঐ সময় ইয়ামানে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ হতে দায়িত্বশীল হিসেবে প্রেরিত হয়েছিলেন) মুয়ায রা. দেখলেন, এক লোককে তার কাছে বেঁধে রাখা হয়েছে। জিজ্ঞাসা করলেন, কী ব্যাপার? আবু মূসা আশআরী রা. বললেন, এ লোক ইহুদী ছিল, ইসলাম গ্রহণ করেছিল, আবার ইহুদী হয়ে গেছে। আপনি বসুন। মুয়ায রা. বললেন, একে হত্যা করার আগ পর্যন্ত আমি বসব না। এটিই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ফয়সালা। তিনি একথা তিনবার বললেন। সেমতে ঐ মুরতাদকে হত্যা করা হল।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৬৯২৩; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১৭৩৩
বিশেষত যে নাস্তিক বা মুরতাদ আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে কটূক্তি করে কিংবা ইসলামের নিদর্শনের অবমাননা করে সে তো সরাসরি ‘মুফসিদ ফিল আরদ’’ (ভূপৃষ্ঠে দুষ্কৃতিকারী)। এ ব্যক্তি রাসূল অবমাননাকারী হিসেবেও ‘‘ওয়াজিবুল কতল’’ (অপরিহার্যভাবে হত্যাযোগ্য) এবং দুষ্কৃতিকারী হিসেবেও।
একারণে প্রত্যেক মুসলিম জনপদের দায়িত্বশীলদের উপর ফরয, উপরোক্ত দন্ড কার্যকর করে নিজেদের ঈমানের পরিচয় দেয়া। যেখানে এ আইন নেই তাদের কর্তব্য, অবিলম্বে এই আইন প্রণয়ন করে তা কার্যকর করা, যদি তারা আখিরাতের কল্যাণ চান।
তারা যদি এই সৎসাহস করেন তবে তা তাদের ‘মসনদে’র জন্যও উত্তম। নতুবা মনে রাখতে হবে, যাদের নারাজির ভয়ে তারা এইসব দন্ড কার্যকর করা থেকে বিমুখতা প্রদর্শন করছেন তারা না তাদের মসনদ রক্ষা করতে পারবেন, না আখিরাতের কঠিন পাকড়াও থেকে মুক্ত করতে পারবে, আর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শাফায়াত থেকে বঞ্চিত হওয়া তো অনিবার্য-ই।
জুমাদাল উলা ১৪৩৪ . মার্চ ২০১৩
মাসিক আলকাউসার