যারা ঈমানের নেয়ামত ও ইসলামের আলো থেকে বঞ্চিত তাদের কাছে বর্ণ, বংশ, ভাষা, ভূখন্ড, সংস্কৃতি, মতবাদ, রাজনৈতিক দল ও দর্শন ইত্যাদি বিভিন্ন মানদন্ডের ভিত্তিতে জাতীয়তা নির্ধারিত হয়, আর এই জাতীয়তাই তাদের কাছে মুয়ালাত ও বারাআত (বন্ধুত্ব ও সম্পর্কচ্ছেদ) এবং পারস্পরিক সাহায্য ও সহযোগিতার মানদন্ড হয়ে থাকে। ইসলামের দৃষ্টিতে এটা সরাসরি জাহেলিয়্যাত। ইসলামের দৃষ্টিতে বর্ণ, বংশ, ভাষা ও ভূখন্ড নির্বিশেষে সকল মুমিন এক জাতি। আর অন্যান্য অমুসলিম বিভিন্ন জাতি হলেও ইসলামের বিপরীতে তারা অভিন্ন জাতি। ‘‘আলকুফরু মিল্লাতুন ওয়াহিদা’’ (সকল কুফর অভিন্ন মিল্লাত) যেমন শরীয়তের দলীল দ্বারা প্রমাণিত তেমনি তা বাস্তবতাও বটে।
ইসলামের শিক্ষায় ‘মুয়ালাত’ ও ‘বারাআত’ (তথা বন্ধুত্ব পোষণ ও বর্জন)-এর মানদন্ড ঈমান। আর পরস্পর সহযোগিতার মানদন্ড ভালো কাজ ও খোদাভীরুতা।
আমি যদি মুমিন হই তাহলে আল্লাহর সব মুমিন বান্দার সাথে আমার বন্ধুত্ব ও ভালবাসা। তা সে যে বর্ণের, যে ভাষার, যে বংশের বা যে দেশেরই হোক না কেন। তার রাজনৈতিক পরিচয়ও যা-ই হোক না কেন। তার সাথে আমার ঈমানী বন্ধুত্ব সর্বাবস্থায় অটুট থাকবে। (উল্লেখ্য, কোনো মুসলমানের রাজনৈতিক দলের সদস্য হওয়ার এবং ঐ দলীয় পরিচিতি বহন করার শরয়ী বিধান কী এবং এতে কী আলোচনা আছে তা এ নিবন্ধের বিষয়বস্ত্ত নয়) মুমিনের সাথে আমার এই বন্ধুত্ব ঈমানের কারণে এবং আল্লাহর জন্য, সাম্প্রদায়িক চেতনা থেকে নয়। একারণে আল্লাহর নাফরমানীর ক্ষেত্রে না তার সঙ্গ দিব, না তার সাহায্য করব। সে যদি কোনো অমুসলিমের উপরও জুলুম করে আমি তার সহযোগিতা করব না; বরং সাধ্যমত তাকে জুলুম থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করব।
আর যে অমুসলিম (দ্বীন ও আখিরাত অস্বীকারকারী কিংবা ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দ্বীনের অনুসারী যে কোনো কাফির, মুশরিক, মুনাফিক) তার সাথে আমার আল্লাহর জন্যই বিদ্বেষ, কারণ সে আমার, তার ও গোটা জগতের রব আল্লাহর বিদ্রোহী। আর যেহেতু এই শত্রুতা শুধু আল্লাহর জন্য, কোনো সাম্প্রদায়িক চেতনা থেকে নয়, একারণে আমি তার সাথে কখনো না–ইনসাফী করব না; বরং যদি দেখি, সে মজলুম হচ্ছে আর তাকে জুলুম থেকে মুক্ত করার সামর্থ্য আমার আছে তাহলে জুলুম থেকে মুক্ত করতেও আমি পিছপা হব না।
দু’জন লোকের মাঝে হয়তো ভাষা, ভূখন্ড, বর্ণ, গোত্র, আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক পরিচয় সব বিষয়ে অভিন্নতা আছে, কিন্তু এদের একজন মুসলিম অন্যজন অমুসলিম, তো এই সকল অভিন্নতার কারণে মুসলিমের উপর অমুসলিমের যে হক্বগুলো সাব্যস্ত হয় তা তো ঐ মুসলিম অবশ্যই আদায় করবেন কিন্তু এদের মাঝে বন্ধুত্বের সম্পর্ক হতে পারে না; বরং মুসলিম তাকে আল্লাহর জন্য দুশমনই মনে করবে যে পর্যন্ত না সে ঈমান আনে ও ইসলাম কবুল করে।
তোমার জন্য ইবরাহীম ও তার অনুসারীদের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ। যখন তারা তাদের সম্প্রদায়কে বলেছিল, ‘তোমাদের সঙ্গে এবং তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যার ইবাদত কর তার সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা তোমাদেরকে মানি না। তোমাদের ও আমাদের মধ্যে সৃষ্টি হল শত্রুতা ও বিদ্বেষ চিরকালের জন্য; যদি না তোমরা এক আললাহতে ঈমান আন’। [সূরা মুমতাহিনা ৬০: ৪]
আল্লাহ তাআলার হুকুম:
‘হে মুমিনগণ! তোমাদের স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততিগণের মধ্যে কেউ কেউ তোমাদের শত্রু; অতএব তাদের সম্পর্কে তোমরা সতর্ক থেক। [আত্তাগাবুন (৬৪): ১৪]
এ প্রসঙ্গে কুরআনে হাকীমের শিক্ষা অতি স্পষ্ট। কুরআনে আমাদের মনোযোগের সাথে পাঠ করা উচিত যে, ইবরাহীম আ. তার মুশরিক পিতা আযরের সাথে কী আচরণ করেছিলেন, নূহ আ.-এর কাফির পুত্রের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা কী বলেছেন। লূত আ.-এর স্ত্রী সম্পর্কে কী বলেছেন আর এর বিপরীতে ফিরাউনের মুমিন স্ত্রী সম্পর্কে কী বলেছেন। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর চাচা আবু তালিবকে কী বলেছেন, যিনি তাঁর সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছিলেন, কিন্তু কুফর ও শিরক থেকে তওবা করে ইসলাম কবুল করেননি। কুরআন কারীম, সীরাতে নববী ও হায়াতুস সাহাবা বিষয়ক গ্রন্থাদিতে এ ধরনের ঘটনা আমাদের বার বার পাঠ করা উচিৎ, যাতে বিষয়টি আমাদের সামনে ভালোভাবে স্পষ্ট হয়ে যায়।
মোটকথা, ‘মুয়ালাত’ (বন্ধুত্ব) ও ‘মুয়াদাত’ (শত্রুতা)-এর মানদন্ড’ দ্বীন ইসলামের অতি গুরুত্বপূর্ণ নীতি। ইসলামে ‘মুয়ালাতের’ মানদন্ড হচ্ছে ঈমান ও ইসলাম আর ‘মুয়াদাত’-এর ভিত্তি শিরক ও কুফর। যে কেউ মুসলিম উম্মাহর অন্তর্ভুক্ত সে শুধু ঈমান ও ইসলামের কারণেই, অন্য কোনো বৈশিষ্ট্য ছাড়াই মুয়ালাতের হক্বদার এবং সকল বাস্তব মানবিক অধিকার (যার বিধান ইসলাম দিয়েছে, বর্তমান সময়ের অসার, অবাস্তব বা প্রতারণামূলক মৌখিক অধিকার নয়) তার প্রাপ্য। আর যে শিরক বা অন্য কোনো ধরনের কুফর অবলম্বন করেছে (প্রত্যেক কুফর শিরকেরই কোনো না কোনো প্রকার) তার সাথে ‘মুয়ালাত’ হারাম; বরং তা কুফরের চিহ্ন।
অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই যে, ‘মুয়ালাত’ ও ‘বারাআতে’র এই নীতিতে অন্যদের কথা তো বলাই বাহুল্য, স্বয়ং পিতামাতাও ব্যতিক্রম নন।
আল্লাহ তাআলার ইরশাদ –
আমি তো মানুষকে তার পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছি। মা সন্তানকে কষ্টের পর কষ্ট সহ্য করে গর্ভে ধারণ করে এবং তার দুধ ছাড়ান হয় দুই বৎসরে। সুতরাং আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। প্রত্যাবর্তন তো আমারই নিকট। তোমার পিতা-মাতা যদি তোমাকে পীড়াপীড়ি করে আমার সমকক্ষ দাঁড় করাতে যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তুমি তাদের কথা মেনো না, তবে পৃথিবীতে তাদের সাথে বসবাস করবে সদভাবে এবং যে বিশুদ্ধচিত্তে আমার অভিমুখী হয়েছে তার পথ অবলম্বন কর, অতঃপর তোমাদের প্রত্যাবর্তন আমারই কাছে এবং তোমরা যা করতে সে বিষয়ে আমি তোমাদেরকে অবহিত করব।- [লুকমান (৩১) ১৪-১৫]
আরো ইরশাদ –
আত্মীয়-স্বজন হলেও মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা নবী এবং মু’মিনদের জন্য সংগত নয় যখন এটা সুস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, নিশ্চিতই এরা জাহান্নামী। ইবরাহীম তার পিতার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছিল, তাকে এর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বলে; অতঃপর যখন তাঁর কাছে এটা সুস্পষ্ট হল যে, সে আল্লাহর শত্রু তখন ইবরাহীম তার সম্পর্ক ছিন্ন করল। ইবরাহীম তো কোমলহৃদয় ও সহনশীল। [আত তাওবা (৯): ১১৩-১১৪]
সূরা মুজাদালায় ‘মুয়ালাত’ ও ‘বারাআতে’র উপরোক্ত নীতি অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে –
“তুমি কি তাদের প্রতি লক্ষ কর নাই যারা, আল্লাহ যে সম্প্রদায়ের প্রতি রুষ্ট, তাদের সাথে বন্ধুত্ব করে? তারা তোমাদের দলভুক্ত নয়, তাদের দলভুক্তও নয় এবং তারা জেনে শুনে মিথ্যা শপথ করে।
আল্লাহ তাদের জন্য প্রস্ত্তত রেখেছেন কঠিন শাস্তি। তারা যা করে তা কত মন্দ! তারা তাদের শপথগুলোকে ঢাল স্বরূপ ব্যবহার করে, আর তারা আল্লাহর পথ হতে নিবৃত্ত করে; অতএব তাদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি। আল্লাহর শাস্তির মুকাবিলায় তাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তাদের কোনো কাজে আসবে না; তারাই জাহান্নামের অধিবাসী, সেখানে তারা স্থায়ী হবে। যে দিন আল্লাহ পুনরুত্থিত করবেন তাদের সকলকে, তখন তারা আল্লাহর নিকট সেইরূপ শপথ করবে যেইরূপ শপথ তোমাদের কাছে করে এবং তারা মনে করে যে, এতে তারা ভালো কিছুর উপর রয়েছে। সাবধান! তারাই তো প্রকৃত মিথ্যাবাদী।
শয়তান তাদের উপর প্রভাব বিস্তার করেছে; ফলে তাদেরকে ভুলিয়ে দিয়েছে আল্লাহর স্মরণ। তারা শয়তানেরই দল। সাবধান! শয়তানের দল অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত। যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে, তারা হবে চরম লাঞ্ছিতদের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ সিদ্ধান্ত করেছেন, আমি অবশ্যই বিজয়ী হব এবং আমার রাসূলগণও। নিশ্চয় আল্লাহ শক্তিমান, পরাক্রমশালী। তুমি পাবে না আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাসী এমন কোনো সম্প্রদায়, যারা ভালবাসে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধাচারীগণকে– হোক না এই বিরুদ্ধাচারীরা তাদের পিতা, পুত্র, ভাই অথবা তাদের জ্ঞাতি–গোত্র তাদের অন্তরে আল্লাহ সুদৃঢ় করেছেন ঈমান এবং তাদেরকে শক্তিশালী করেছেন তাঁর পক্ষ থেকে রূহ দ্বারা। তিনি তাদেরকে দাখিল করবেন জান্নাতে, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত; সেখানে তারা স্থায়ী হবে; আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট, তারাই আল্লাহর দল। জেনে রাখ, আল্লাহর দলই সফলকাম হবে।” [আল মুজাদালা (৫৮): ১৪-২২]
আরো ইরশাদ –
হে মু’মিনগণ! তোমাদের আপনজন ছাড়া অন্য কাউকেই অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তারা তোমাদের ক্ষতি করতে ত্রুটি করবে না; যা তোমাদেরকে বিপন্ন করে তাই তারা কামনা করে। তাদের মুখে বিদ্বেষ প্রকাশ পায় এবং তাদের হৃদয় যা গোপন রাখে তা আরও গুরুতর। তোমাদের জন্য নিদর্শনসমূহ বিশদভাবে বিবৃত করেছি, যদি তোমরা অনুধাবন কর। দেখ, তোমরাই তাদেরকে ভালবাস কিন্তু তারা তোমাদেরকে ভালবাসে না অথচ তোমরা সব কিতাবে ঈমান রাখা আর তারা যখন তোমাদের সংস্পর্শে আসে তখন বলে, ‘আমরা বিশ্বাস করি; কিন্তু তারা যখন একান্তে মিলিত হয় তখন তোমাদের প্রতি আক্রোশে তারা নিজেদের অঙ্গুলির অগ্রভাগ দাঁতে কেটে থাকে। বল, ‘তোমাদের আক্রোশেই তোমরা মর।’ অন্তরে যা রয়েছে সে সম্বন্ধে আল্লাহ সম্যক অবগত। তোমাদের মঙ্গল হলে তা তাদেরকে কষ্ট দেয় আর তোমাদের অমঙ্গল হলে তারা তাতে আনন্দিত হয়। তোমরা যদি ধৈর্যশীল হও এবং মুত্তাকী হও তবে তাদের ষড়যন্ত্র তোমাদের কিছুই ক্ষতি করতে পারবে না। তারা যা করে নিশ্চয়ই আল্লাহ তা পরিবেষ্টন করে আছেন। [আলে ইমরান ৩: ১১৮-১২০]
এখানে কিছু অবুঝ মুসলমানের ভুল ধারণারও সংশোধন করা হয়েছে, যারা সামাজিক সৌজন্যের নামে ধর্মীয় ক্ষেত্রে চরম শিথীলতার শিকার হয় এবং বলে, ‘তারা অমুসলিম হলেও তো আমাদের ভাই/বন্ধু!’ নাউযুবিল্লাহি মিন যালিক। নিঃসন্দেহে এটা চরম নির্বুদ্ধিতা। কেউ যদি বুঝে শুনে একথা বলে তাহলে এটাই তার ‘মুনাফিক’ হওয়ার স্পষ্ট নিদর্শন। আমাদের তরফ থেকে তো এই নির্বুদ্ধিতা যে, এদের প্রতি প্রীতি ও ভালবাসা পোষণ করতে থাকব অথচ তারা তাদের ভ্রান্ত ধর্ম বা মতবাদে এতই কট্টর যে, আমাদের প্রতি ভালোবাসা তো দূরের কথা, আমাদেরকে তারা হীনতম শত্রু মনে করে এবং আমাদেরকে যন্ত্রণা দেওয়ার ক্ষেত্রে, দেশে দেশে আমাদের ভাইবোনদের ব্যাপক হত্যা-নির্যাতনের ক্ষেত্রে কোনো অপচেষ্টা বাদ রাখে না।
এ বিষয়ে এই আয়াতগুলো মনোযোগের সাথে পাঠ করুন : ২: ২৫৭; ৩: ২৮; ৪: ১৩৯; ৫: ৫১, ৫৭, ৮১; ৮: ৭২-৭৩; ৯: ২৩-২৪, ৬৭, ৭১; ৪৫: ১৯।
ঈমান সবার আগে