কুদৃষ্টি – হযরত মাওলানা জুলফিকার আহমদ নকশবন্দী – ৪র্থ পর্ব

সালাফ তথা পূর্বসূরী বুযুর্গদের বাণীর আলোকে

পীরমাশায়েখ তাঁদের ভক্ত-মুরিদদেরকে কুদৃষ্টি থেকে বাঁচার উদ্দেশে বিভিন্ন উপায় বলে দিয়েছেন। মৌলিকভাবে সেগুলোকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়।

এক. কল্পনা পাল্টানো

যখনই নফস-প্রবৃত্তি পরনারীকে দেখার ইচ্ছা করবে তখনই সালেক তথা আত্মশুদ্ধি-প্রয়াসীব্যক্তির উচিত নিজের কল্পনা পরনারী থেকে সরিয়ে অন্যদিকে নিবদ্ধ করা। ইচ্ছা করে যদি অন্য কল্পনা ঢুকানো যায় তাহলে পরনারীর চিন্তা আপনাআপনি দূর হয়ে যাবে। কয়েকটি দৃষ্টান্ত নিম্নে উপস্থাপন করা হল-

ক. ইমাম গাযালী রহ. বলেন, ‘হে প্রিয়! জেনে রেখো, কোনো পরনারী তোমার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় শয়তান কামনা করে যে, তুমি তার প্রতি দৃষ্টি দিবে। একটু দেখে নিবে যে, নারীটি কেমন। এরূপ পরিস্থিতিতে শয়তানের সাথে বিতর্ক জুড়ে দাও যে, আমি কেন দেখব? নারীটি যদি কুশ্রী হয় তাহলে আমি তো স্বাদহীন গুনাহয় লিপ্ত হব। আর সুন্দরী হলে গুনাহতো হবে, পাশাপাশি এই আফসোসও অন্তরে জন্ম নিবে যে, আহ! তাকে যদি আমি পেতাম! কিন্তু সকল নারীকে তো পাওয়া যায় না। সুতরাং অন্তরকে আফসোসের মধ্যে ফেলে দেয়ার মাঝে কী ফায়দা! এভাবে বিতর্ক করলে অন্তরই এ সিদ্ধান্তে পৌঁছে দিবে যে, দেখব না। গুনাহ করব না। মনকে আফসোসেও ফেলব না। মনের স্বস্তি দূর করে দেয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়।’

খ. হযরতের আকদাস থানভী রহ. বলতেন, ‘কোনো সুন্দরীর নারীর প্রতি আকর্ষণ হলে সঙ্গে সঙ্গে কোনো কুশ্রীব্যক্তির কল্পনা করুন। এমন ব্যক্তির কল্পনা করুন যার রঙ কালো, চেহারায় দাগ, চোখ অন্ধ, চুল এলোমেলো, দাঁতালো চোয়াল, ঠোঁট মোটা, নাক থেকে পানি বেয়ে ঠোঁট অবধি পৌঁছেছে- যেখানে মাছি বসে আছে। এভাবে কল্পনা করলে রুচিতে একপ্রকার ঘেন্না সৃষ্টি করে, যা আপনার অন্তর থেকে সুন্দরীর প্রতি আকর্ষণকে নষ্ট করে দিবে। কখনও কখনও ভাবুন, কল্পিত সুন্দরীটি মারা গেলে তাকে কবরে রাখা হবে। তার দেহ গলে মাটির সাথে মিশে যাবে। পোকামাকড় দেহটাকে খেয়ে ফেলবে। দুর্গন্ধ বের হবে। সুতরাং একে দেখে নিজের মালিককে অসন্তুষ্ট করব কেন?’

গ. জনৈক বুযুর্গ বলেন, ‘কোনো সুন্দরীর প্রতি আসক্ত হলে সাথে সাথে তার বৃদ্ধবেলার কথা কল্পনা করুন। কোমর কুঁজো হয়ে যাবে। হাড্ডিসার দেহ হয়ে যাবে। দৃষ্টিশক্তি তার একেবারে দুর্বল হয়ে পড়বে। কানে শুনতে পাবে না। মুখে দাঁত থাকবে না, পেটে অাঁত থাকবে না। বসলে পেশাব নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। চোয়াল ভেতরে ঢুকে যাবে। সুতরাং একে দেখে আমার প্রভুকে অসন্তুষ্ট করব কেন?

ঘ. জনৈক বুযুর্গ বলতেন, কোনো সুন্দরীকে দেখতে মন চাইলে সঙ্গে সঙ্গে কল্পনা করুন, আমার শায়েখ আমাকে দেখছেন। তাহলে মন আন্দোলিত হবে। দৃষ্টি সরে যাবে। তারপর ভাবুন, আমার শায়েখ আমার একাজটি দেখে কত না অসন্তুষ্ট হবেন! অথচ আল্লাহতাআলা বাস্তবেই দেখছেন। সুতরাং তিনি কী পরিমাণ অসন্তুষ্ট হবেন। এভাবে ভাবতে পারলে কুদৃষ্টি থেকে তাওবা নসিব হবে।

দুই. নিজেকে সাজা দিন

কুদৃষ্টি থেকে বাঁচার দ্বিতীয় পদ্ধতি হল, নিজেই নিজের জন্য সাজা নির্ধারণ করা যে, কুদৃষ্টি হয়ে গেলে আমি নিজেকে এই শাস্তি দিব। যেহেতু কুদৃষ্টির মজার চাইতে সাজার কষ্টটা বেশি হবে তাই ধীরে ধীরে কুদৃষ্টির অভ্যাস থেকে ফিরে আসা সহজ হয়ে যাবে।

ক. হযরত আকদাস থানবী রহ. বলতেন, ‘কুদৃষ্টির গুনাহর জন্য বিশ রাকাত নফল পড়ার সাজা ঠিক করে নাও। এতে নফস এক দু’দিনেই চিৎকার দিয়ে ওঠবে এবং কুদৃষ্টি থেকে ফিরে আসবে। শয়তানও বলবে, লোকটি তো দেখি একটি কুদৃষ্টির পরিবর্তে বিশটি সিজদা করছে। এমন যেন না হয় এর গুনাহগুলো নেকি দ্বারা পাল্টে দেয়া হবে। তখন তো আমার সারাজীবনের চেষ্টা বরবাদ হয়ে যাবে। সুতরাং একে কুদৃষ্টির কুমন্ত্রণা দেয়া যাবে না।’

খ. জনৈক বুযুর্গ বলতেন, ‘যে লোকটি ভোজনপ্রিয় তার উচিত তিনদিনের রোযার সাজা নির্ধারণ করা। যখন ক্ষুৎপিপাসায় থাকবে তখন রিপুর সব তাড়না নিস্তেজ হয়ে পড়বে।’

গ. জনৈক বুযুর্গ বলতেন, ‘কুদৃষ্টিতে অভ্যস্ত ব্যক্তি যদি গরিব হয় তাহলে সে নিজের ওপর কিছু সদকা নির্ধারণ করে নেয়ার শাস্তি আরোপ করবে। যখন নিজের প্রয়োজনকে কুরবানি দিয়ে সদকা করার প্রয়োজন পড়বে তখন সব ঘোর এমনিতে কেটে যাবে।’

ঘ. জনৈক বুযুর্গ বলতেন, ‘মনে কুদৃষ্টির তাড়না তৈরি হলে নির্জনে কাপড় পেঁচিয়ে তৈরি করা চাবুক দিয়ে নিজের পেটে কয়েকটি আঘাত করুন। তারপর ভাবুন, যখন কেয়ামতের দিন ফেরেশতারা চাবুক মারবে তখন কী অবস্থা হবে? এ পদ্ধতিতে কয়েকদিনের মধ্যেই কুদৃষ্টির অভ্যাস খতম হয়ে যাবে।’

অধমের অতিরিক্ত কিছু পরীক্ষিত ব্যবস্থাপত্র

নিচে কয়েকটি ব্যবস্থাপত্র উল্লেখ করা হল। এগুলোর দ্বারা অধম ও সংশ্লিষ্টরা অনেক উপকৃত হয়েছে। পাঠকরাও এগুলো অন্তরে গেঁথে নিতে পারলে উপকৃত হবেন- ইনশাআল্লাহ।

এক. কুদৃষ্টির পরিবেশ থেকে বাঁচুন

এটাই সবচেয়ে বড় সতর্কতা যে, যেসব পরিবেশে কুদৃষ্টি হয় সেগুলো থেকে দূরে থাকুন। বিয়ে-শাদির অবাধ অনুষ্ঠানগুলোতে মোটেও যাবেন না। কোথাও যাওয়ার দুটি পথ থাকলে ওই পথ বেছে নিন যেখানে কুদৃষ্টির আশঙ্কা কম থাকে। কারো দরজার কড়া নেড়ে সরাসরি না দাঁড়িয়ে একপাশে দাঁড়ান। এমন যেন না হয় যে, কোনো বালিকা দরজা খুলে দিল আর পর্দার লঙ্ঘন হয়ে গেল। বিমান ইত্যাদির টিকেট কাটার সময় ওই কাউণ্টারে যান যেখানে পুরুষ আছে, যেন মহিলার সাথে কথা বলতে না হয়। গাড়িতে চলার সময় আশপাশের গাড়িগুলোর প্রতি তাকাবেন না। হতে পারে কোনো নারীর ওপর কুদৃষ্টি পড়ে যাবে। নিজের বাসায় ঢোকার সময় গলা খাঁকারি দিয়ে বা আওয়াজ করে ঢুকুন। যাতে পরনারী থাকলে সে পর্দা করতে পারে। ট্রেন বা বিমানসফরে নিজের প্রিয় কোনো বই সঙ্গে রাখুন এবং তা পড়ে সময় কাটাবেন। ক্লান্তি আসলে শুয়ে পড়ুন। ঘুম না আসলে মুরাকাবার নিয়তে বসে থাকুন। চোখ খুললে ভ্রমণকারীনারীর প্রতি দৃষ্টি পড়ার আশঙ্কা আছে। রাস্তায় চলার সময় এমনভাবে দৃষ্টিকে অবনত করে রাখুন, যাতে পায়ের আওয়াজে অনুমান করতে পারেন নারী না পুরুষ। সবসময় মনে রাখুন, নারীরা আমাদের সাথে পর্দা করবে না, আমাদেরকেই তাদের সঙ্গে পর্দা করতে হবে। তাওয়াফকালীন দৃষ্টি পায়ের দিকে রাখুন। দৃষ্টি মোটেও ওঠাবেন না। বিনোদনকেন্দ্রে প্রথমত যাবেন না, একান্তই যদি যেতে হয় তাহলে এমন দিন বেছে নিন যেদিন লোকজন থাকে না বললেই চলে। যদি কোনো অফিস বা বিমানবন্দরের লাউঞ্জে বসে অপেক্ষা করার প্রয়োজন পড়ে, সেখানে যদি টিভি চলে কিংবা নারীর ছবিসম্বলিত সাইনবোর্ড থাকে, তাহলে ইচ্ছা করেই এসবের দিকে পিঠ দিয়ে বসুন। সড়কের পাশের সিনেমার পোস্টার বা বিজ্ঞাপনের দিকে তাকাবেন না। মোটরসাইকেল কিংবা গাড়ি চালানোর সময় রিকশা ইত্যাদি সামনে পড়লে সেখানে বসে থাকা নারীর প্রতি দৃষ্টি যেতে দিবেন না। যেসব সড়কে কিংবা গলিতে মেয়েদের স্কুল-কলেজ আছে সেগুলো এড়িয়ে চলা ভালো। বিধর্মীরাষ্ট্রে সফর করার প্রয়োজন পড়লে উত্তম হল, কারো চেহারা না দেখা। কারণ, প্রথমত যদি গ্রীস্মকাল হয় তখন তারা অর্ধনগ্ন থাকে। আর শীতকালে পোশাক দ্বারা দেহ ঢাকলেও নারী-পুরুষের মাঝে পার্থক্য করা কঠিন হয়। সবাইকে এক টাইপের মনে হয়। নারীরাও শাট-কোর্ট-টাই পরে। পুরুষের মত চুল কাটে। এই মসিবতের সামাধান এটাই যে, দৃষ্টি অবনত রাখুন এবং নিজের ঈমান বাঁচান। আল্লাহতাআলার কাছে বিনীতপ্রার্থনা করুন। কবির ভাষায়-

غم حيات كے ساۓ محيط نہ كرنا

كسى غريب كو دل كا غريب نہ كرنا

ميں امتحان كے قابل نہيں مرے مولى

مجهے گناه كا موقع نصيب نہ كرنا

‘বিষণ্ণজীবনের ছায়ায় আমাকে বেষ্টিত করবেন না।

গরিবকে অন্তরের গরিব করবেন না।

মাওলা আমার! আমি পরীক্ষার যোগ্য নই,

আমাকে গুনাহ করার সুযোগ দিবেন না।’

দুই. স্ত্রীকে সন্তুষ্ট রাখুন

নিজের স্ত্রীর সাথে মধুর সম্পর্ক বজায় রাখুন। তার সব বিষয়েয় প্রতি লক্ষ্য রাখুন। ঘরের স্ত্রী স্বামীর সঙ্গে ভালোবাসামোহিত ঘনিষ্ঠতা ধরে রাখতে পারলে মুচকিহেসে স্বামীকে অভ্যর্থনা জানালে স্বামীর চিন্তা পরনারীর প্রতি যায় না। একটু ভেবে দেখুন যদি স্বামী-স্ত্রীর প্রতিদিনের সম্পর্কটা বিরক্তিমাখা ঝগড়াপূর্ণ হয়, মন খারাপ করে স্বামী নাস্তা ছাড়া অফিসে চলে যায়, আর সেখানে পর্দাহীনা কোনো সহকর্মী হাসির আভা ছড়িয়ে তাকে জিজ্ঞেস করে, স্যার! কেমন আছেন আপনি! তখন এই নারীর এই হাসিটা দাম্পত্যজীবনের জন্য বিষের ভূমিকা পালন করে। এভাবেই সংসারে ভাঙ্গন ধরে। ঘরে যখন সুন্দরী স্ত্রী ঝগড়াটে হয় তখন বাইরের কুশ্রী নারীও ‘জান্নাতের হূর’ মনে হয়। এজন্য স্বামী-স্ত্রী উভয়ের চেষ্টা থাকা উচিত, সংসারে যেন প্রেম-ভালোবাসার পরিবেশ থাকে। তখন বাইরের প্রতিকূলতা থেকে নিরাপদ থাকা সহজ হবে। সাধারণত কুদৃষ্টির শিকার হন তারাই যাদের স্ত্রী নেই কিংবা স্ত্রী থাকলেও জৈবিকচাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে স্ত্রী পরিপূর্ণ তৃপ্তি দিতে পারে না। পবিত্র কুরআনে স্ত্রীর ‘উদ্দেশ্য’ বলা হয়েছে-

لِتَسْكُنُوْآ اِلَيْهَا

‘যাতে তাদের কাছে স্বস্তি লাভ কর।’

যেস্ত্রীর কাছে স্বামী অস্বস্তিতে থাকে, সে স্ত্রী আল্লাহর কাছে কী জবাব দিবে? এখনকার যুবকেরা যে উদ্দীপনা নিয়ে টেলিভিশন দেখে অনুরূপ আগ্রহ নিয়ে যদি নিজের স্ত্রীকে দেখত তাহলে তাকে জান্নাতের হূর মনে হত। প্রসিদ্ধ আছে, ভালোবাসার আতিশয্যের কারণে জুলায়খা প্রতিটি জিনিসের নাম রেখেছিলেন ‘ইউসুফ’। তার কাছে ইউসুফ ছাড়া দুনিয়ার অন্যকিছু চোখে ভাসত না। স্বামী-স্ত্রীর মাঝে এরূপ অকৃত্রিম ভালোবাসা থাকলে স্বামীর দৃষ্টি পরনারীর প্রতি যাবে না।

তিন. নিজেকে নির্লোভ করে নিন

সালেক নিজের অন্তরে এ কল্পনা বারবার বদ্ধমূল করে নিবে যে, আমি আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করতে চাই না। পরনারীর প্রতি উত্থিত প্রতিটি দৃষ্টি আমাকে আমার প্রকৃত প্রেমাস্পদ থেকে দূরে সরিয়ে দিবে। পক্ষান্তরে পরনারীর প্রতি দৃষ্টি বিরত রাখার প্রতিটি দৃষ্টি আমাকে আমার প্রেমাস্পদের সাথে ঘনিষ্ঠ করে তুলবে। সুতরাং আমি আল্লাহর ঘনিষ্ঠতার পথকে নিজের জন্য বেছে নিলাম। তাঁর ভালোবাসায় আমি পরনারীকে দেখা থেকে তাওবা করে নিলাম। এবার যেকোনো পর্দাহীননারী আমার সামনে আসলে তার প্রতি আমার কোনো লোভ নেই। সে কালো কিংবা সুন্দরী, মোটা কিংবা চিকন, হূর কিংবা ডাইনি- যাই হোক না কেন; আমার জন্য নয়। সে অন্যের জন্য। তার দ্বারা যেহেতু আমার উদ্দেশ্য পূরণ হবার নয়, সুতরাং তার প্রতি তাকিয়ে লাভ কী?

বাজার-গলি দিয়ে চলার সময় নফস যখন পরনারীর প্রতি তাকানোর জন্য ইতিউতি করবে তখনই এই কল্পনার পুনরাবৃত্তি করবে যে, এর প্রতি আমার কোনো লোভ নেই। আপনার অভিজ্ঞতা হয়ত আছে যে, বাসে কিংবা স্টেশনে যদি আপনার পাশের চেয়ারে কোনো পুরুষ বসে তাহলে আপনার অনুভূতিকে আন্দোলিত করে না। কিন্তু যদি কোনো নারী বসে তাহলে বিচিত্র ভাবনা আপনাকে আন্দোলিত করে। এর কারণ হল, নফসের মধ্যে লোভ থাকে। ওই নারীটি যদি বৃদ্ধা হয় তাহলে তার সম্পর্কেও আপনার মাঝে কোনো ভাবনা আসবে না। এটা এ কথারই প্রমাণ যে, নফস বা প্রবৃত্তির মাঝে নষ্টামিও আছে। সুতরাং এই লোভ ও নষ্টামি থেকে নফসকে ইচ্ছাকৃতভাবে বের করার চেষ্টা করতে হবে। রাতের শেষপ্রহরে তাহাজ্জুদ-নামাযের পর মহান আল্লাহর কাছে দুআ করুন, হে মালিক! আমাকে পরনারী থেকে নির্লোভ করে দিন। হে ওই সত্তা! যার আঙ্গুলের মাঝে মানুষের অন্তর, আমার অন্তর থেকে পরনারীর আকর্ষণ দূর করে দিন। যাতে আমার কাছে পরনারী ও দেয়ালের মাঝে কোনো পার্থক্য না থাকে। এভাবে করতে পারলে কয়েকদিনের মধ্যে ফল পাবে। পরীক্ষা করে দেখুন।

চার. হূরদের সৌন্দর্যের কল্পনা করুন

নফস প্রবৃত্তি যদি পরনারী দেখতে চায় তাহলে সালেক তথা সংশোধনপ্রত্যাশীব্যক্তি মনে মনে হূরের সৌন্দর্য নিয়ে কল্পনা করবে। যেমন-

حُوْرٌ مَّقْصُوْراَتٌ فِىْ الْخِيَامِ

‘তাবুতে উপবিষ্ট হূরসমূহ’

قاصِرَتُ الطَّرْفِ

‘আনত নয়না’

لَمْ يَطْمِثْهُنَّ اِنْسٌ قَبْلَهُمْ وَلَا جَآنٌّ

‘যাদেরকে পূর্বে কোনো মানুষ কিংবা জিন স্পর্শ করে নি।’

كَاَنَّهُنَّ الْيَاقُوْتُ وَالْمَرْجَانُ

‘ইয়াকুত (পদ্মরাগ) ও মারজান (প্রবাল) মোতির মত।’

اَزْوَاجٌ مُّطَهَّرَةٌ

‘হায়েয-নেফাস থেকে পবিত্র স্ত্রীরা।

হূরদের এসব গুণের বিপরীতে পরনারী সম্পর্কে ভাবুন, কখনও হায়েযের রক্ত, কখনও সন্তান জন্ম দেয়ার রক্ত ঝরে। প্রতিদিন কয়েকবার পেশাব-পায়খানার ময়লা পেট থেকে বের হয়। নাক থেকে ময়লা ঝাড়ে। মুখ থেকে কফ-থুথু বের হয়। বগল থেকে ঘামের গন্ধ বের হয়। মাথায় উকুন পড়ে থাকে। কয়েকদিন গোসল না করলে শরীর থেকে উৎকট গন্ধ ছড়ায়। মেসওয়াক না করলে মুখ থেকে দুর্গন্ধ বের হয়। অসুস্থ হলে কয়েকদিনের মধ্যেই নেতিয়ে পড়ে। বৃদ্ধ হলে চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে যাবে। মুখে দাঁত থাকবে না। পেটে আঁত থাকবে না। কোমর বাঁকিয়ে চলাফেরা করবে। কথা স্পষ্ট বলতে পারবে না। গুপ্তাঙ্গের লোম পরিষ্কার না করলে জঙ্গলসদৃশ হয়ে যাবে। সবসময় পেটে পেশাব-পায়খানার ময়লা নিয়ে চলে। এমন নারীর প্রতি তাকিয়ে কি আমার প্রভুকে অসন্তুষ্ট করব? জান্নাতের হূর নেয়ামত থেকে বঞ্চিত হব? সেই হূর থেকে যারা সবসময় কুমারী থাকবে। মোতির মত বিভা ছড়াবে। শরীরের প্রতিটি অঙ্গ সুগন্ধি দ্বারা মোহিত করবে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হবে। পানিতে থুথু ফেললে পানি সুমিষ্ট হয়ে যাবে। আঙ্গুল বের করলে সূর্যের আলোর মত ঝলমলিয়ে ওঠবে। মৃতের মাঝেও প্রাণ চলে আসবে। যাকে কেউ স্পর্শ করে নি। যার অন্তস্থল থেকে উতলে ওঠা ভালোবাসা মানুষ স্বচক্ষে দেখতে পাবে। অসুস্থ হবে না। লাবণ্যহারা হবে না। এরূপ গুণবতী বিশ্বস্ত রূপপ্রাচুর্যে পরিপূর্ণ স্ত্রীকে পরনারীর প্রতি একটুখানি তাকানোর কারণে হারাব- এটা কোন ধরনের বুদ্ধিমানের কাজ? সুতরাং দুনিয়াতে আমার জন্য আছে হালাল স্ত্রী। আখেরাতে আছে মুগ্ধতাছড়ানো হূর। মার্কেটে ঘুরঘুরকারী মহিলাদের প্রতি আমার কোনো আকর্ষণ নেই। এদের থেকে আমার দৃষ্টিকে সংরক্ষণ করব। মালিককে সন্তুষ্ট করব। হূরের অধিকারী হব।

পাঁচ. আল্লাহর দর্শন লাভ থেকে বঞ্চিত হওয়ার কথা ভাবুন

হাদীসশরীফের ভাষ্য মতে জান্নাতিরা জান্নাতে আল্লাহর দর্শন লাভে ধন্য হবে। কেউ একবার দর্শন লাভ করবে। কেউ প্রতি বছর একবার, কেউ প্রতি মাসে একবার, কেউ প্রতি শুক্রবারে একবার, কেউ প্রতিদিন একবার দর্শন লাভ করার অকল্পনীয় সুযোগ পাবেন। যেলোকটি দুনিয়াতে অন্ধ হয়ে জন্ম নিয়েছিলেন, যাপিতজীবনে সৎ ও আল্লাহভীরু ছিলেন এবং সবর ও শোকরের সাথে জীবন কাটিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁর সুমহান সৌভাগ্য হবে প্রতিটি মুহূর্তে তিনি আল্লাহকে দেখে বিমোহিত হবেন। আল্লাহ বলবেন, এতো আমার ওই বান্দা, যে দুনিয়াতে কাউকে ভালোবাসার দৃষ্টিতে দেখে নি। এখন সে যখন ইচ্ছা করবে, আমার নূরানী চেহারা দেখতে পারবে।

কোনো কোনো আলেম লিখেছেন, পরনারীর প্রতি দৃষ্টি দেয়া থেকে নিজের দৃষ্টিকে যে দুনিয়াতে সংরক্ষণ করবে, মহান আল্লাহ তাকে প্রতিটি বিরত রাখা দৃষ্টির বিনিময়ে একবার করে নিজের দর্শন দিয়ে ধন্য করবেন। সালেকের উচিত বিষয়টি নিয়ে মোরাকাবা করা এবং মনকে বুঝানো যে, কয়েক মুহূর্তের কুদৃষ্টির কারণে আল্লাহর সুমহান দর্শন থেকে বঞ্চিত হব কেন?

ছয়. নিজের মা-মেয়ের কল্পনা করুন

নফস যদি পরনারীকে দেখার জন্য লালসা করে তাহলে সঙ্গে-সঙ্গে নিজের মা-মেয়ের কল্পনা করুন। এ সম্পর্ক দু’টি এতই পবিত্র যে, প্রবৃত্তির তাড়না এমনভাবে মিটে যায় যেমনভাবে আগুনে পানি দিলে আগুন নিভে যায়। তবে এই আমল শালীনতাবোধসম্পন্ন শরীয়ত দ্বারা সমৃদ্ধ লোকদের জন্য অধিক উপকারী।

সাত. চোখে শলাকা পড়ার কথা ভাবুন

ওলামায়েকেরাম লিখেছেন, কুদৃষ্টিকারী যখন জাহান্নামে যাবে তখন ফেরেশাতারা তার চোখে গলিত শীশা ঢেলে দিবে। কোনো কোনো কিতাবে লেখা হয়েছে, লোহার শলাকা গরম করে তার চোখে ঢুকিয়ে দেয়া হবে। সালেকের নফস কুদৃষ্টির প্রতি যখন তাড়িত করবে তখন কল্পনা করুন, ক্ষণিকের মজার কারণে উত্তপ্ত শলাকা আমার চোখে বিদ্ধ করা হলে তখন আমার কী অবস্থা হবে! কয়েকদিন নিয়মিত এ কল্পনা করলে নফসের নষ্টামি দূর হয়ে যাবে।

আট. নিয়মের কথা ভাবুন

যেসব লোকের কুদৃষ্টির অভ্যাস পুরনো এবং প্রাথমিক চিকিৎসায় কাজ হয় না, তাদের উচিত হল, নিজেকে বুঝানো যে, আল্লাহর একটা নিয়ম আছে। কেউ যখন কোনো গুনাহর কাজ শুরু করে তখন আল্লাহ তার সঙ্গে ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার আচরণ করেন। এতেও যদি বান্দা পিছু না হটে তাহলে তার সঙ্গে তিনি কিছু দিন যাবত দোষ-ত্রুটি ঢেকে রাখার আচরণ করতে থাকেন। এরপরেও ফিরে না আসলে আল্লাহ তাকে সাজা দেয়ার ইচ্ছা করেন। আর যে দুর্ভাগার ব্যাপারে তিনি শাস্তির ইচ্ছে করেন তাকে তিনি নাচিয়ে ছাড়েন। তখন তাকে ঘরে বসিয়ে রেখে লাঞ্ছিত করে ছাড়েন। এমন কি অন্যের জন্য ওই শাস্তিকে দৃষ্টান্ত বানিয়ে দেন। সুতরাং এভাবে ভাবুন, আমি অনেক দিন থেকে কুদৃষ্টির গুনাহয় লিপ্ত। এখন পর্যন্ত আল্লাহতাআলা দোষ গোপন করে রাখার আচরণ করছেন। যদি শাস্তি দেয়ার ইচ্ছা করে ফেলেন তাহলে আমার দীন-দুনিয়া উভয়টাই যাবে। আমার কিছু থাকবে না। আল্লাহতাআলা বলেন-

وَمَنْ يُّهِنِ اللهُ فَمَا لَهُ مِنْ مُكْرِمٍ

‘আল্লাহ যাকে লাঞ্ছিত করেন, তার সম্মানদাতা কেউ নেই।’ -সূরা হজ্ব : ১৮

আয়াতটি নিয়ে ভাবলে কুদৃষ্টি থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়া যায়।

নয়. নিজের নফসের সাথে বিতর্ক করুন

যখন নফস কুদৃষ্টি দেয়ার চেষ্টা করবে তখন তার সাথে বিতর্ক করুন যে, হে নফস! তোমার নাম এত উঁচু অথচ তোমার কর্মকান্ড কত নিচু। তুমি সৃষ্টিকুলের চোখে আল্লাহর বন্ধু, কিন্তু কাজ কর তাঁর দুশমনের মত। বাহ্যিকদৃষ্টিতে ঈমানদার অথচ ভেতরে-ভেতরে পাক্কা গুনাহগার। লেবাসে-সূরতে ‘লা-ইলাহা’, লোকচক্ষুর আড়ালে ‘প্রতিমা-প্রতিমা।’ মানুষের সামনে আল্লাহর বান্দা, অন্দরমহলে শয়তানের গোলাম। তোমার যবান আল্লাহর তলবগার, তোমার চোখে পরনারীর পেয়ার। তুমি সকলের কাছে সাধাসিধে সূফী-বেচারা কিন্তু স্রষ্টার দৃষ্টিতে ক্ষমাযোগ্য বেচারা। তোমার উপরটা সুন্নাতসমৃদ্ধ, অথচ ভেতরটা যৌনতাতাড়িত। মাখলুকের কাছে তোমার স্বভাবচরিত্র গোপন, কিন্তু স্রষ্টার কাছে তো সবই দৃশ্যমান। দৃশ্যত তুমি জান্নাত প্রত্যাশী, বাস্তবে তুমি জাহান্নাম খরিদকারী। তোমার জন্য এই লোকসানের ব্যবসা থেকে ফিরে আসাটাই শ্রেয়। ছাড়ো এ ক্ষতির ব্যবসা। আল্লাহ তোমার জন্য তাওবার দরজা খোলা রেখেছেন। হতে পারে এটাই তোমার জন্য সুযোগ লুফে নেয়ার আখেরি দিন। পরে আক্ষেপ অনুশোচনার মাঝে কোনো ফায়দা নেই।

اب پچهتاۓ كيا ہوت

جب   چڑيا ں چك گئيں كهيت

‘এখন আফসোস করে কী হবে!

চড়ুইরা তো ক্ষেত বিরাণ করে দিয়েছে।’

কয়েকবার নিজের নফসের সাথে এভাবে বিতর্ক করলে কুদৃষ্টির ব্যাপারে তার দাপানি যথেষ্ট কমে আসবে।

দশ. আল্লাহর সান্নিধ্যের মুরাকাবা করুন

কুদৃষ্টিতে অভ্যস্ত হয়ে গেলে সালেক তথা আত্মশুদ্ধিপ্রত্যাশী আল্লাহর সান্নিধ্যের অনুভূতি অন্তরে তৈরি করার উদ্দেশে প্রত্যেক নামাযের পর কিছু সময়ের জন্য নিম্নোক্ত আয়াতের বিষয়বস্ত্ত নিয়ে চিন্তা করবেন।

هُوَ مَعَكُمْ اَيْنَمَا كُنْتُمْ

‘তোমরা যেখানেই তিনি তোমাদের সঙ্গে আছেন।’

এরপর নিজের নফসকে বুঝাবেন যে, দেখো, তুমি আল্লাহর দৃষ্টি থেকে কোনোভাবেই ভাগতে পারবে না। তুমি যখন পরনারীর প্রতি তাকাও তখনও তোমার প্রভু তোমাকে দেখেন। এটা তো তার মহান ধৈর্যের পরিচয় যে, তিনি তোমাকে পাকড়াও করেন না। কিন্তু তুমি যদি এভাবে চলতে থাক তবে তিনি কতকাল ধৈর্য ধরবেন। এই দৃষ্টি তোমার জন্য রূহানী মৃত্যুর কারণ হতে পারে। যদি তুমি পরনারীকে কুদৃষ্টিতে দেখ তাহলে তোমার আপন-নারীদের প্রতি অন্যপুরুষরা কুদৃষ্টিতে দেখবে।

جيسے كرنى ويسى بهرنى نہ ما نے تو كركے ديكھ

جنت بهى ہے دوزخ بهى ہے نہ ما نے تو مركے ديكھ

‘যেমন কর্ম তেমন ফল, না মানলে করে দেখ

জান্নাত আছে জাহান্নামও আছে, না মানলে মরে দেখ।’

উক্ত মুরাকাবা করলে আল্লাহতাআলার রহমত তোমার সঙ্গী হবে এবং কুদৃষ্টি থেকে তাওবা করার খোশনসিব হবে। ইনশাআল্লাহ।

একটি ভুল বুঝাবুঝি

কিছু তরুণ যুবক এই প্রত্যাশা করে যে, তার মনে যেন পরনারীর প্রতি দৃষ্টি দেয়ার চিন্তাই সৃষ্টি না হয়। এই মর্যাদা লাভ না হলে তারা খুব চিন্তিত হয়। ভাবে, যিকির ও মুরাকাবায় কাজ হয় নি। মনে রাখবে, এটা শয়তানিকুমন্ত্রণা। নফস বা মনে যদি কুদৃষ্টির বাসনাই উদিত না হয় তাহলে তা থেকে বেঁচে থাকাটা কোন্ ধরনের বাহাদুরি। যদি কোনো ‘অন্ধ’ পরনারীকে না দেখার দাবী করে তাহলে এটা কোনো গৌরব বা অহঙ্কারের বিষয় নয়। মজা তো হল উদ্দাম যৌনচাহিদা থাকা সত্ত্বেও গুনাহ থেকে বেঁচে যাওয়া। অন্তরে লজ্জা সৃষ্টি করা। পরনারীর প্রতি দৃষ্টি দেয়া থেকে বেঁচে থাকা অনেক বড় জিহাদ। উল্লেখিত আমলগুলো সারাজীবন করতে হয়। নিজের দোষ-ত্রুটির জন্য কান্নাকাটি করতে হয়। এ অবস্থায় মারা গেলে শান্তিময় ঘুম আসবে। হয়ত তখন মুনকার-নাকীর ফেরেশতা বলাবলি করবে-

سرہا نے مير كے آہستے بو لو

ابهى تك روتے روتے سو گيا ہے

‘আমির সাহেবের মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আস্তে কথা বল

এই পর্যন্ত কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়েছে মাত্র।’


অনুবাদ ও সম্পাদনা
মাওলানা উমায়ের কোব্বাদী নকশবন্দী

কুদৃষ্টি – হযরত মাওলানা জুলফিকার আহমদ নকশবন্দী – পর্ব ১
কুদৃষ্টি – হযরত মাওলানা জুলফিকার আহমদ নকশবন্দী – পর্ব ২
কুদৃষ্টি – হযরত মাওলানা জুলফিকার আহমদ নকশবন্দী – পর্ব ৩