মৃত্যুর স্মরণ – মাওলানা মুফতি তকী উছমানী (দা.বা)

[হযরত মাওলানা মুফতী তাকী উছমানী কিছুদিন আগে বাংলাদেশ সফর করেছেন। সে সফরে  ১৭ ফেব্রুয়ারি ’০৯ ঈ. সুন্নত চৌধুরী সাহেবের বাড়িতে মহিলাদের উদ্দেশে এই বয়ানটি করেছিলেন। তা রেকর্ড করা হয়েছিল। পরে তা কাগজে লেখা হয় ও অনুবাদ করা হয়। লিখেছেন মাওলানা সায়ীদ আহমদ, অনুবাদ করেছেন মাওলানা আবদুল্লাহ ফাহাদ]

 

সম্মানিত বোন ও প্রিয় কন্যা!

আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহ

 

আজকের আয়োজন বিশেষভাবে মহিলাদের জন্য করা হয়েছে। উদ্দেশ্য হল, মা, বোন ও মেয়েদের সাথে কিছু দ্বীনী আলোচনা করা। আল্লাহ তাআলা আমাকে ইখলাসের সঙ্গে তাঁর সন্তুষ্টি অনুযায়ী কথা বলার এবং আপনাদের সকলকে ইখলাসের সঙ্গে শ্রবণ করার আর আমাদের সকলকে এই কথাগুলোর উপর আমল করার তাওফীক দান করুন।

আমি আপনাদের সামনে একটি সূরা তেলাওয়াত করেছি, যা প্রায় সকল মুসলমানেরই মুখস্থ থাকে এবং নামাযের মধ্যেও অধিক পরিমাণে তেলাওয়াত করা হয়। সূরাটি ছোট হলেও একটি বড় সত্যের প্রতি ইঙ্গিত করে।

তা এই যে, এই দুনিয়ার সকল মানুষ, সে পুরুষ হোক কিংবা নারী দুনিয়াতে আসে শিশু অবস্থায় এরপর শৈশব অতিক্রম করে যৌবনে পদার্পণ করে। এরপর পূর্ণ বয়সে উপনীত হয় তারপর বার্ধক্যে পৌঁছে। এরপর একদিন দুনিয়া থেকে চলে যায়। কোনো মানুষ এই দুনিয়ায় স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য আসে না। যত বড় সম্পদশালী কিংবা প্রভাবশালী হোক  কেউ এই নিয়মের ব্যতিক্রম নয়। এমনকি আম্বিয়া আ., বুযূর্গানে দ্বীন, আওলিয়ায়ে কেরাম প্রত্যেকের সাথেই এমনটি ঘটে। তারা দুনিয়ায় আসেন। আসার সময় কারো জানা থাকে না যে, দুনিয়ায় তারা কত দিন থাকবেন। এরপর একদিন এই দুনিয়া থেকে চলে যান।

মৃত্যু এমন এক বাস্তবতা, যার ব্যাপারে কোনো মানুষেরই কোনো মতপার্থক্য নেই। মুসলিম-অমুসলিম, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সকলেই স্বীকার করে যে, এই দুনিয়ায় চিরদিন থাকার জন্য আসিনি, একদিন আমার মৃত্যু হবে। কোনো কাফের,  কোনো বেদ্বীন-মুনাফিকও তা অস্বীকার করতে পারে না। কিছু লোক তো আল্লাহ তাআলার অস্তিত্বকে পর্যন্ত অস্বীকার করে বসেছে, কিন্তু মৃত্যুকে কেউ অস্বীকার করতে পারে না। প্রত্যেক মানুষই জানে এবং বিশ্বাস করে যে, তার মৃত্যু হবে।

তদ্রূপ এটাও বাস্তব যে, মৃত্যুর কোনো সময় নির্দিষ্ট নেই। এ বিষয়েও কোনো মানুষের কোনো মতানৈক্য নেই। আমি জানি না, কখন আমার মৃত্যু ঘটবে। এখনি একজন মানুষ বসে আছে, সে সুস্থ, কথাবার্তা বলছে অথচ এক ঘন্টার ভিতরেই সে দুনিয়া থেকে চলে গেল। কোনো দুর্ঘটনা ঘটে গেল আর সে দুনিয়া থেকে চলে গেল। আল্লাহ তাআলা আমাদের হেফাযত করুন। কারো হার্ট এ্যাটাক হয়ে গেল আর সে দুনিয়া ছেড়ে চলে গেল। লোকেরা বলে থাকে এটা তো বড় আশ্চর্যের বিষয় যে, একজন মানুষ বসে আছে, কথাবার্তা বলছে অথচ মুহূর্তেই সে ঢলে পড়ল, হার্ট এ্যাটাক হয়ে সে দুনিয়া থেকে চলে গেল!

আজ পর্যন্ত দুনিয়াতে এমন কোনো প্রযুক্তি আবিষ্কার হয়নি যা এ কথা বলে দিতে সক্ষম যে, এই মানুষটি কত সময় জীবিত থাকবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আজ কত উন্নতি সাধন করেছে। মানুষ চাঁদে পৌঁছে গেছে, কিন্তু এমন কোনো প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হয়নি যা মানুষকে বলতে পারে যে, সে কতদিন দুনিয়ায় থাকবে এবং কখন দুনিয়া থেকে বিদায় নিবে।

মোটকথা, এ বিষয়ে সবাই একমত যে, মৃত্যু অবশ্যই আসবে। তদ্রূপ এ বিষয়েও সকলে একমত যে, কখন মৃত্যু হবে তা কারো জানা নেই। তাই এখন চিন্তা করা দরকার যে, মানুষকে যখন যেতেই হবে তবে কেন সে এই দুনিয়ায় আসে? বাস্তবতা বলে যে, দুনিয়ায় মানুষের আসা একটা সফর। মানুষ কোথাও সফরে গেলে যেমন কিছু দিনের জন্য যায়, স্থায়ীভাবে থাকার জন্য যায় না। কোনো কাজে-উদ্দেশ্যে সেখানে অবস্থানের পর পুনরায় নিজের বাড়িতে ফিরে আসে তেমনি দুনিয়ার এই জীবনও একটা সফর, যা শুরু হয় জন্মলাভের মাধ্যমে আর কখন শেষ হবে তা জানা নেই।

দুনিয়ার জীবন যদি সফরই হয় তাহলে ভাবতে হবে যে, এই সফরের উদ্দেশ্য কী? মানুষ কেন এই দুনিয়ায় আসে? কেন দুনিয়ার জীবনের এতই ব্যস্ততা দৌড়-ঝাঁপ? কেনইবা মানুষ দুনিয়ায় এসে কিছুদিন থেকে আবার চলে যায়?

কুরআন মজীদ একটি ছোট সূরার মধ্যেই এই উদ্দেশ্যের কথা বলে দিচ্ছে, ‘হে গাফেল মানুষ! তুমি দুনিয়ায় এসেছ এখন উপলব্ধি কর, কেন তুমি এসেছ? ইরশাদ হয়েছে, তরজমা : আমি জ্বিন ও মানব জাতিকে শুধুমাত্র এ জন্যই সৃষ্টি করেছি যেন তারা আমার বন্দেগী করে, আমার ইবাদত করে। এজন্যই তাদেরকে দুনিয়ায় পাঠিয়েছি।

আসল উদ্দেশ্য তো এটাই ছিল যে, মানুষ আল্লাহ তাআলার ইবাদত করবে। আল্লাহ তাআলা ইবাদতকে সহজ করে দিয়েছেন। অর্থাৎ ইবাদতের মূল দাবি তো এই যে, মানুষ সারা দিন সারা রাত আল্লাহ তাআলার সামনে দন্ডায়মান থাকবে, সিজদায় পড়ে থাকবে, আল্লাহ তাআলার যিকর করবে, তাঁর কাছে দুআ করবে। শুধু এই কাজই করবে, অন্য কোনো কাজ করবে না। কিন্তু আল্লাহ তাআলা নিজ অনুগ্রহে মানুষের দুর্বলতার কারণে এই অনুমতি দিয়েছেন যে, তোমরা দুনিয়ায় পানাহার কর, বিশ্রাম কর, জীবিকা উপার্জন কর তবে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত আমার কাছে এসে আমার ইবাদত করবে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের ব্যাপারে যত্নবান থাকবে। রমযানের এক মাস রোযা রাখবে। উপার্জিত সম্পদ থেকে শতকরা আড়াই ভাগ বার্ষিক যাকাত হিসেবে আদায় করবে, জীবনে একবার হজ্ব করবে। এতটুকুই তোমাদের জন্য আবশ্যকীয় করে দিলাম। আর বাকি সারা জীবন পানাহার, উপার্জন সবকিছুই তোমাদের জন্য বৈধ করে দিলাম। যেন তোমাদের প্রয়োজন মিটে।

তবে একটি কথা মনে রাখবে, জীবিকা উপার্জনের ফিকির যেন এমন না হয় যে, তোমরা তাতেই আচ্ছন্ন জীবনের আসল উদ্দেশ্যই ভুলে গেলে। তোমরা যদি জীবনের আসল উদ্দেশ্যকে স্মরণ রেখে সে অনুযায়ী ব্যবসা কর তাহলে সে ব্যবসাও ছওয়াবের হবে! হাদীস শরীফে আছে, সত্যবাদী, আমানতদার ব্যবসায়ীও কিয়ামতের দিন আম্বিয়া, সিদ্দীকীন ও শহীদগণের সঙ্গে থাকবে।

এত অধিক ফযীলতের কথা বলা হয়েছে কাদের জন্য?

ওই সব লোক যাদেরকে ব্যবসা, লেনদেন, ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ থেকে বিরত রাখে না। তাদের এই ব্যবসা তাদের জন্য হালাল। শুধু হালালই নয়; বরং ছওয়াবের কাজ। আল্লাহ তাআলা এতই সহজ করে দিয়েছেন। সৃষ্টি করেছেন ইবাদতের জন্য। কিন্তু ইবাদতের জন্য দিনরাতে বিশেষ কিছু কাজ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, যাতে খুব বেশি হলে এক ঘন্টা, সোয়া ঘন্টা সময় লাগে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাযে সাধারণত এরচেয়ে বেশি সময় ব্যয় হয় না। অবিশষ্ট সকল সময় তোমরা নিজেদের প্রয়োজন পূরণ করতে পার। তবে শর্ত এই যে, আল্লাহকে যেন ভুলে যেও না, আল্লাহ তাআলার আহকাম, কোন কাজ হালাল আর কোনটি হারাম তা ভুলে যেও না। তাহলে সকল কিছুই তোমাদের জন্য বৈধ হবে।

 

রজব ১৪৩০ .  জুলাই ২০০৯

মাসিক আলকাউসার