হযরত ইবরাহীম (আঃ) – ১০

পরীক্ষা সমূহের মূল্যায়ন :

ইবরাহীমের পরীক্ষা সমূহ তাঁর যোগ্যতা যাচাইয়ের জন্য ছিল না বা তাঁর কোন অপরাধের সাজা হিসাবে ছিল না। বরং এর উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে লালন করে পূর্ণত্বের মহান স্তরে পৌছে দেওয়া এবং তাঁকে আগামী দিনে বিশ্বনেতার মর্যাদায় সমাসীন করা। সঙ্গে সঙ্গে সবাইকে এটা দেখিয়ে দেওয়া যে, আল্লাহর নিকটে প্রিয় ও সম্মানিত বান্দাগণকে দুনিয়াতে বিভিন্ন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হ’তে হয়। আল্লাহর সুন্দর গুণাবলীর মধ্যে  رَبُّهُ (‘তার পালনকর্তা’)  গুণটিকে খাছ করে বলার মধ্যে স্বীয় বন্ধুর প্রতি স্নেহ ও তাকে বিশেষ অনুগ্রহে লালন করার প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে। এক্ষণে তাঁর পরীক্ষার সংখ্যা কত ছিল সে বিষয়ে কুরআন নির্দিষ্টভাবে কিছু উল্লেখ করেনি। কেবল বলেছে, بِكَلِمَاتٍ ‘অনেকগুলি বাণী দ্বারা’ (বাক্বারাহ ২/১২৪)। অর্থাৎ শরী‘আতের বহুবিধ আদেশ ও নিষেধ সমূহ দ্বারা। ‘কালেমাত’ শব্দটি বিবি মারিয়ামের জন্যেও ব্যবহৃত হয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, وَصَدَّقَتْ بِكَلِمَاتِ رَبِّهَا ‘মারিয়াম তার পালনকর্তার বাণী সমূহকে সত্যে পরিণত করেছিল’ (তাহরীম ৬৬/১২)

ইবরাহীমের জীবনে পরীক্ষার সংখ্যা কত ছিল এরূপ এক প্রশ্নের জবাবে ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, ইসলামের ৩০টি অংশ রয়েছে। যার ১০টি সূরা তওবায় (১১২ আয়াতে), ১০টি সূরা মুমিনূনে (১-৯ আয়াতে) ও সূরা মা‘আরিজে (২২-৩৪ আয়াতে) এবং বাকী ১০টি সূরা আহযাবে (৩৫ আয়াতে) বর্ণিত হয়েছে। যার সব ক’টি ইবরাহীম (আঃ) পূর্ণ করেন। অতঃপর  আল্লাহ তাকে সনদ দিয়ে বলেন, وَإِبْرَاهِيْمَ الَّذِىْ وَفَّى ‘এবং ইবরাহীমের ছহীফায়, যিনি (আনুগত্যের অঙ্গীকার) পূর্ণ করেছিলেন’ (নাজম ৫৩/৩৭)।[24] তবে ইবনু জারীর ও ইবনু কাছীর উভয়ে বলেন, ইবরাহীমের জীবনে যত সংখ্যক পরীক্ষাই আসুক না কেন আল্লাহ বর্ণিত ‘কালেমাত’ বহু বচনের শব্দটি সবকিছুকে শামিল করে’ (ইবনু কাছীর)

বস্ত্ততঃ পরীক্ষা সমূহের সংখ্যা বর্ণনা করা কিংবা ইবরাহীমের সুক্ষ্মদর্শিতা ও জ্ঞানের গভীরতা যাচাই করা এখানে মুখ্য বিষয় নয়, বরং আল্লাহর প্রতি তাঁর আনুগত্যশীলতা ও নিখাদ আত্মসমর্পণ এবং কার্যক্ষেত্রে তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তা যাচাই করাই ছিল মুখ্য বিষয়।

শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ :

(১) ইবরাহীমী জীবন থেকে প্রধান শিক্ষণীয় বিষয় হ’ল সর্বাবস্থায় আল্লাহর নিকটে আত্মসমর্পণ। যাকে বলা হয় ‘ইসলাম’। যেমন আল্লাহ বলেন,

إِذْ قَالَ لَهُ رَبُّهُ أَسْلِمْ قَالَ أَسْلَمْتُ لِرَبِّ الْعَالَمِيْنَ، وَوَصَّى بِهَا إِبْرَاهِيْمُ بَنِيْهِ وَيَعْقُوْبُ- (البقرة ১৩১-১৩২)-

‘স্মরণ কর যখন তাকে তার পালনকর্তা বললেন, তুমি আত্মসমর্পণ কর। তখন সে বলল, আমি আত্মসমর্পণ করলাম বিশ্ব চরাচরের প্রতিপালকের নিকট’। ‘এবং একই বিষয়ে সন্তানদেরকে অছিয়ত করে যান ইবরাহীম ও ইয়াকূব’ (বাক্বারাহ ২/১৩১-৩২)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, مَا كَانَ إِبْرَاهِيْمُ يَهُوْدِيًّا وَلاَ نَصْرَانِيًّا وَلَكِنْ كَانَ حَنِيْفًا مُّسْلِمًا- (آل عمران ৬৭)-  ‘ইবরাহীম ইহুদী বা নাছারা ছিলেন না। বরং তিনি ছিলেন একনিষ্ঠরূপে ‘মুসলিম’ বা আত্মসমর্পিত’ (আলে ইমরান ৩/৬৭)।

অতএব ইহুদী, নাছারা ইত্যাদি দলীয় রং দিয়ে তাঁকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করা বাতুলতা মাত্র। বরং তিনি ছিলেন নিখাদ আল্লাহ প্রেমিক। আর সেকারণ সকল আল্লাহভীরু মানুষের তিনি নেতা ছিলেন।

(২) আল্লাহর কাছে বড় হ’তে গেলে তাকে আল্লাহর পক্ষ থেকেই বড় বড় পরীক্ষায় ফেলা হয়। আর তাতে উত্তীর্ণ হওয়ার মধ্যেই থাকে ইহকালীন ও পরকালীন সফলতা।

(৩) পরীক্ষা এলে সাহসিকতার সাথে মুকাবিলা করতে হয়। শয়তানী প্ররোচনায় পিছিয়ে গেলেই ব্যর্থ হ’তে হয়। যেমন পুত্র যবহের পূর্বে শয়তানী ধোঁকার বিরুদ্ধে ইবরাহীম (আঃ) কংকর নিক্ষেপ করেছিলেন ও পরে সফলকাম হয়েছিলেন।

উপসংহার :

ইবরাহীম (আঃ)-এর প্রায় দু’শো বছরের পুরা জীবনটাই ছিল পরীক্ষার জীবন। সুখে-দুখে, আনন্দে-বিষাদে সর্বাবস্থায় তিনি ছিলেন আল্লাহর উপরে একান্ত নির্ভরশীল। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রশক্তির বিরোধিতা তাঁকে তাঁর বিশ্বাস থেকে এক চুল টলাতে পারেনি। অবশেষে জন্মভূমি ত্যাগ করে হিজরত করে আসতেও তিনি  পিছপা হননি। আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনায় বৃদ্ধ বয়সের নয়নের মণি একমাত্র শিশু পুত্রকে তার মা সহ মক্কার বিজনভূমিতে নির্বাসনে দিয়ে আসতেও তাঁর হৃদয় টলেনি। অবশেষে ঐ সন্তানকে যবেহ করার মত কঠিনতম উদ্যোগ নিতেও তাঁর হাত কেঁপে ওঠেনি। এভাবে জীবনভর অগণিত পরীক্ষার চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে পূর্ণ-পরিণত ইবরাহীম পেলেন ‘বিশ্বনেতা’ হবার মত বিরল দুনিয়াবী পুরস্কারের মহান এলাহী ঘোষণা। হ’লেন ভবিষ্যৎ নবীগণের পিতা ‘আবুল আম্বিয়া’ এবং মিল্লাতে ইসলামিয়াহর নেতা হবার মত দুর্লভ সম্মান। আজও যদি পৃথিবীর দিকে দিকে ইবরাহীমী ঈমানের জ্যোতি বিকীরিত হয়, আবার মুসলিম উম্মাহর মধ্যে সে ঈমান ফিরে আসে, তবে বর্তমান অশান্ত পৃথিবীর নমরূদী হুতাশন আবারও পুষ্পকাননে পরিণত হবে ইনশাআল্লাহ। ইকবাল তাই গেয়েছেন,

اگر هو پہر ابراھیم کا ايماں پيدا

آگ کرسکتي هے پهر انداز گلستاں پيدا

‘বিশ্বে যদি সৃষ্টি হয় ফের ইবরাহিমী ঈমান
হুতাশনে তবে সৃষ্টি হবে ফের পুষ্পের কানন’


[24]. হাকেম ২/৫৫২ সনদ ছহীহ; তাফসীর ইবনে কাছীর, বাক্বারাহ ১১৪-এর টীকা দ্রষ্টব্য।