নবী-আদর্শের অনুসরণে মর্মান্তিক অবহেলা : বড় বড় সুন্নত পরিত্যক্ত, বহু সুন্নত নিষ্প্রাণ, এরপরও ঈমান ও মুহববতের দাবি! (১ম পর্ব) – মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক (দা.বা)

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর ঈমান আনার অর্থই হল, তাঁর নীতি ও সুন্নাহকে আমরা নিজেদের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করছি। আল্লাহ তাআলা এজন্যই রাসূল প্রেরণ করেছেন যে, আল্লাহর আদেশে তাঁর অনুসরণ করা হবে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-

وما ارسلنا من رسول الا ليطاع باذن الله

(তরজমা) আমি রাসূল এই উদ্দেশ্যেই প্রেরণ করেছি যে, আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে তার আনুগত্য করা হবে।-সূরা নিসা (৪) : ৬৪

আল্লাহ তাআলার নিকট বান্দা তখনই মুমিন সাব্যস্ত হয় যখন সে রাসূলকে নিজের সকল বিষয়ের সিদ্ধান্তদাতা (হাকাম) বলে স্বীকার করে এবং তাঁর সকল সিদ্ধান্ত মনেপ্রাণে মেনে নেয়। সকল দ্বিধা ও সংশয় ত্যাগ করে তাঁর ফয়সালার সামনে নিজেকে পুরোপুরি সমর্পিত করে।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

فلا وربك لا يؤمنون حتى يحكموك فيما شجر بينهم، ثم لا يجدوا فى انفسهم حرجا مما قضيت ويسلموا تسليما.

(তরজমা) কিন্তু না, আপনার প্রতিপালকের শপথ! তারা মুমিন হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের নিজেদের বিবাদ-বিসংবাদের বিচারভার আপনার উপর অর্পণ না করে; অতপর আপনার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে তাদের মনে কোনো দ্বিধা না থাকে এবং সর্বান্তকরণে তা মেনে নেয়।-সূরা নিসা (৪) : ৬৫

মুমিনকে আল্লাহ তাআলা একটি ব্যবস্থাই দিয়েছেন, যাকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা হচ্ছে আল্লাহর নিকট কোনো কিছু আশা করার পূর্বশর্ত। আর তা হল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রদত্ত ব্যবস্থা ও তাঁর পবিত্র জীবনাদর্শ।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

لقد كان لكم فى رسول الله اسوة حسنة لمن كان يرجو الله واليوم الآخر وذكر الله كثيرا.

(তরজমা) তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও আখিরাতকে ভয় করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে তাদের জন্য রাসূলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।-সূরা আহযাব (৩৩) : ২১

এই উত্তম আদর্শ দ্বারা ঐ জীবনাদর্শই উদ্দেশ্য, যা সূরায়ে জাসিয়ায় এভাবে বলা হয়েছে-

ثم جلعنك على شريعة من الامر فاتبعها ولا تتبع اهواء الذين لا يعلمون. انهم لن يغنوا عنك من الله شيئا وان الظلمين بعضهم اولياء لبعض والله ولى المتقين هذا بصائر للناس وهدى ورحمة لقوم يوقنون.

(তরজমা)  এরপর আমি আপনাকে প্রতিষ্ঠিত করেছি দ্বীনের বিশেষ বিধানের উপর। সুতরাং আপনি তা অনুসরণ করুন। অজ্ঞদের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করবেন না।

আল্লাহর মুকাবিলায় তারা আপনার কোনো উপকার করতে পারবে না। যালিমরা একে অপরের বন্ধু আর আল্লাহ তো মুত্তাকীদের বন্ধু।

এই কুরআন মানবজাতির জন্য সুস্পষ্ট দলিল এবং নিশ্চিত বিশ্বাসী জাতির জন্য পথনির্দেশ ও রহমত।-সূরা জাসিয়াহ (৪৫) : ১৮-২০

কালিমায়ে তাওহীদ ও কালিমায়ে শাহাদতে আমরা এই শরীয়ত ও এই আদর্শকে সত্যতা ও যথার্থতার স্বাক্ষ্য দেই এবং মনেপ্রাণে তা কবুল করার ঘোষণা দান করি। এজন্য আমাদের উপর ফরয, এই আদর্শের আলোকে  আমাদের পুরো জীবন, জীবনের প্রতিটি অঙ্গনকে যাচাই করা। অতপর যেখানেই ত্রুটি ও অসম্পূর্ণতা দেখা যায় সংশোধনের চেষ্টা করা।

আজ সময়ের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন এই যে, আমরা প্রত্যেকে এবং সমাজের প্রতিটি শ্রেণী নিজের জীবন ও কর্মকে সেই ‘উসওয়ায়ে হাসানা’র মাপকাঠিতে যাচাই করব ও নিজেকে সংশোধন করব। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র সীরাতের চর্চা সেভাবেই করব যেভাবে সাহাবায়ে কেরাম করতেন।

সীরাতে নববিয়্যাহ সম্পর্কে আমাদের অবস্থা সাহাবায়ে কেরামের অবস্থা থেকে ভিন্ন থেকে ভিন্নতর হতে চলেছে। বিশেষত নিম্নের বিষয়গুলোতে –

১. সঠিক জ্ঞান

সাহাবায়ে কেরাম সরাসরি আল্লাহর রাসূলের বাণী শুনতেন, তাঁর জীবনযাপন দেখতেন এবং নিজেদের মাঝে আলোচনার মাধ্যমে সীরাতের সঠিক জ্ঞান অর্জন করতেন। আমরা তাঁর সরাসরি সাহচর্য থেকে বঞ্চিত হলেও আল্লাহ তাআলা আমাদের জন্যও সীরাতের সঠিক জ্ঞান লাভের পথ খোলা রেখেছেন। কুরআন মজীদ হচ্ছে নবী-জীবনকে জানার সবচেয়ে বড় উৎস। হাদীস ও সীরাতের নির্ভরযোগ্য কিতাব আমাদের সামনে আছে। সুন্নতের অনুসারী আল্লাহওয়ালা মাশায়েখ বিদ্যমান আছেন। আমরা যদি গভীর মনোযোগ ও চিন্তা-ভাবনার সাথে কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করি (কোনো সংক্ষিপ্ত ও নির্ভরযোগ্য তাফসীরের কিতাবের সহযোগিতা নিয়ে), আহলে ইলমদের সাথে পরামর্শ করে হাদীস ও সীরাতের নির্ভরযোগ্য কিতাবপত্র অধ্যয়ন করি এবং সুন্নতের অনুসারী মাশায়েখের সাহচর্যে বসি তাহলে ইনশাআল্লাহ আমরাও সীরাতের সঠিক জ্ঞান অর্জন করতে পারব।

কিন্তু আমরা যে বড় উদাসীনতার শিকার। প্রথমত সীরাত অধ্যয়ন এবং সীরাতের পাঠ-পঠনের বিষয়ে আমরা গুরুত্ব কম দেই, দ্বিতীয়ত সীরাত ও মীলাদ সংক্রান্ত অনেক মওযূ’ ও বানোয়াট বর্ণনা খুব সহজেই বলতে থাকি। অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নামে কোনো কিছু প্রস্ত্তত করে তা হাদীস বলে প্রচার করা যেমন হারাম ও কুফরের মতো গুনাহ তেমনি তাঁর সম্পর্কে দলিল-প্রমাণহীন কোনো কিছু বলা এবং ভিত্তিহীন বর্ণনার আলোকে তাঁর সম্পর্কে কোনো কিছু বলাও হাদীস জাল করার অন্তর্ভুক্ত ও অনেক বড় কবীরা গুনাহ। একই সাথে এটা তাঁর প্রতি অনেক বড় ধৃষ্টতা ও বেআদবী।

মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকা থেকে প্রকাশিত ছোট্ট পুস্তিকা ‘প্রচলিত জাল হাদীস’ও যদি মনোযোগ দিয়ে পাঠ করা হয় তাহলে ইনশাআল্লাহ এ বিষয়ে কিছুটা সতর্ক হওয়ার রুচি সৃষ্টি হবে।

২. ঈমান ও নির্ভরতা

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র সীরাত ও তাঁর উসওয়ায়ে হাসানার প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস ও নির্ভরতা ছিল সাহাবায়ে কেরামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। তাঁরা তো এই কল্পনাও করতে পারতেন না যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর ঈমান আনার পর তাঁর সুন্নাহ ও আদর্শের কোনো একটি ক্ষুদ্র বিষয়েও সামান্য সংশয়-সন্দেহ হতে পারে! তদ্রূপ এ বিষয়টিও তাদের সমাজে সম্ভব ছিল না যে, বিশ্বাস হবে রিসালতের প্রতি আর শিক্ষা ও সংস্কৃতি এবং সভ্যতা ও জীবনযাপন পদ্ধতি হবে অন্য জাতির!

আজ আমাদের বড় দুর্ভাগ্য এই যে, আমাদের জীবন সংশয় ও স্ববিরোধিতায় পূর্ণ। আমাদের ঈমান মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর অথচ আমাদের জীবনাদর্শ হচ্ছে পশ্চিমা সভ্যতা। সুন্নতে নববীর পরিবর্তে পশ্চিমা সংস্কৃতি আমাদের কাছে অনুকরণীয়। বেশভূষায় আমরা আল্লাহর রাসূলের অনুসারী নই, পশ্চিমাদের অনুসারী।

মসজিদের কিবলা ও মুসল্লিদের চেহারা যদিও বাইতুল্লাহ অভিমুখী, যা হেদায়েত, বরকত ও শান্তি-নিরাপত্তার কেন্দ্র, কিন্তু জীবনের ‘কিবলা’ হোয়াইট হাউস, যা ভ্রষ্টতা ও বিপথগামিতা এবং জুলুম ও ফাসাদের সর্বনিকৃষ্ট কেন্দ্র।

সংবিধানের সূচনা বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম দ্বারা, অথচ ভিতরের অনেক বিধান বিতাড়িত শয়তানের! …

এ ধরনের অসংখ্য সংঘাত ও স্ববিরোধিতা এবং সংশয় ও কপটতায় জর্জরিত আমাদের মুসলিমসমাজ। এ থেকে মুক্তির একমাত্র পথ সুদৃঢ় ঈমান। আমরা যদি রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সত্যবাদিতা, তাঁর সুন্নাহর যথার্থতা এবং শুধু ও শুধু তাঁরই জীবনযাপন পদ্ধতি ‘উসওয়াহে হাসানাহ’ হিসেবে এবং মানবতার শুদ্ধি ও সফলতার একমাত্র উপায় হিসেবে অন্তরের অন্তস্তল থেকে গ্রহণ করতে পারি এবং পরিপূর্ণ বিশ্বাস ও নির্ভরতার সাথে এর উপর অটল অবিচল থাকতে পারি, আর মন-মুখ ও চাল-চলনে একথা প্রমাণ করতে পারি যে-

رضيت بالله ربا، وبالإسلام دينا، وبمحد صلى الله عليه وسلم نبيا.

(আমি আল্লাহকে রব হিসেবে পেয়ে, ইসলামকে দ্বীন হিসেবে পেয়ে এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নবী হিসেবে পেয়ে সন্তুষ্ট) তাহলেই আমরা মুক্তি পাব।

৩. শ্রদ্ধা ও ভালবাসা

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি এবং তাঁর সুন্নাহ ও আদর্শের প্রতি সাহাবায়ে কেরামের শ্রদ্ধা ও ভালবাসা একটি সর্বজনবিদিত বিষয়। তাঁদের গোটা জীবনই ছিল এর বাস্তব প্রমাণ। পক্ষান্তরে এ বিষয়ে আমাদের দূরত্ব অত্যন্ত মর্মান্তিক। আমাদের সাধারণ অবস্থা এই যে, মুখে ভালবাসার দাবি অথচ জীবনের সকল কাজ এর বিপরীত। আর অসংখ্য মানুষের মধ্যে আরো যা আছে তা হল মুহাববতের নামে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রধান দুই শিক্ষা তাওহীদ ও সুন্নাহ বিরোধিতা এবং বিদআতে লিপ্ত হওয়া।

৪. নিজ জীবনে প্রয়োগ

সীরাত চর্চার ক্ষেত্রে সাহাবায়ে কেরাম ও আমাদের মাঝে সবচেয়ে বড় পার্থক্য এই যে, তাঁরা সুন্নতে নববিয়্যাহ ও উসওয়ায়ে হাসানার প্রতিটি অংশকেই নিজেদের জীবনে বাস্তবায়ন করেছেন। অথচ আমরা শাখাগত বিষয়গুলো তো পরের কথা, মৌলিক বিষয়গুলো থেকেও উদাসীন।

৫. সুন্নতকে জীবিত করা ও বিদআতকে ঘৃণা করা

সাহাবায়ে কেরাম তালীম-তারবিয়ত, দাওয়াত-তাবলীগ, ওয়ায-নসীহত এবং সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ, এমনকি প্রয়োজনে জিহাদ ও কিতালের মাধ্যমেও নবী-আদর্শের প্রতিষ্ঠা ও প্রচারের নিরলস প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন। তাঁরা সব ধরনের চিন্তাগত, বিশ্বাসগত, কর্ম ও প্রথাগত বিদআত এবং সকল প্রকার জাহেলী রীতিনীতিকে পুরোপুরি ঘৃণা করতেন এবং তা নির্মূলের জন্য  সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন।

অথচ এসব ক্ষেত্রে আমাদের সাধারণ অবস্থা তো আমাদের সামনেই আছে। এই বিষয়ে যৎসামান্য মেহনত যা হচ্ছে তা পরিমাণ ও গুণগতমান দু’দিক থেকেই আরো অগ্রসর করা অপরিহার্য।

৬. নিজ সন্তান, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের জন্য তা-ই পছন্দ করা

সাহাবায়ে কেরামের উপরোক্ত গুণাবলির নিশ্চিত ফলাফল এই ছিল যে, তারা নিজেদের সন্তান-সন্ততি, প্রিয়জন ও আত্মীয়-স্বজনের জন্যও আল্লাহর রাসূলের সীরাত ও সুন্নাহকেই পছন্দ করতেন,  এরই আলোকে তাঁরা নিজ সন্তানের তরবিয়ত করতেন এবং

সন্তানদেরকে এরই উপর প্রতিষ্ঠিত করতেন। আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবকেও এরই দিকে আহবান করতেন এবং তাদেরকে এই পবিত্র জীবনাদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত দেখতে চাইতেন।

তাদের মাঝে এই হীনম্মন্যতা (বরং এই কপটতা ও নেফাকি) কল্পনাও করা যেত না যে, উসওয়ায়ে হাসানার উপর প্রতিষ্ঠিত করলে সন্তানদের হক খর্ব হয়!! কিংবা এই উসওয়ায়ে হাসানাহ থেকে বঞ্চিত রেখে সন্তানদের শিক্ষাদীক্ষাও হতে পারে!! নাউযুবিল্লাহ।

৭. শুধু একটিমাত্র মাপকাঠি

মোটকথা, সাহাবায়ে কেরামের কাছে হক-বাতিল, কল্যাণ-অকল্যাণ, আলো-অন্ধকার, সুপথ-বিপথ ও সফলতা-ব্যর্থতার একটিমাত্র মাপকাঠিই ছিল। আর তা হল মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ, তাঁর প্রতি অবতীর্ণ সর্বশেষ গ্রন্থ কুরআনুল কারীম, তাঁকে প্রদত্ত সর্বশেষ জীবনপদ্ধতি-শরীয়তে মুহাম্মাদিয়া, তাঁর পবিত্র সীরাত ও সুন্নাহ তথা উসওয়ায়ে হাসানাহ।

৮. সুন্নাহর ভিন্নতা কিংবা ইজতিহাদের ভিন্নতায় অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা

সীরাত ও সুন্নাহর বিষয়ে সাহাবায়ে কেরামের একটি গুরুত্বপূর্ণ গুণ এটাও ছিল যে, তাঁরা সুন্নাহর ভিন্নতা ও ইজতিহাদের ভিন্নতার ক্ষেত্রে পরস্পর আলোচনা-পর্যালোচনা তো করতেন। কিন্তু পরস্পর ঝগড়া-বিবাদ, তর্কবিতর্কে লিপ্ত হতেন না; বরং প্রত্যেকে অন্যের আমলকে, অন্যের মতকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন।

শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহ. (মৃত্যু : ৭২৮ হি.) তাঁর বিভিন্ন গ্রন্থে সাহাবায়ে কেরামের সীরাতের এই বিষয়টি সবিস্তারে উল্লেখ করেছেন। আর সুন্নাহর বিভিন্নতা বা বৈধ মতপার্থক্য শিরোনামে তিনি নিজে এবং তাঁর শাগরিদ ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রাহ. (মৃত্যু : ৭৫১হি.) অনেক বিষয় উল্লেখ করেছেন। যেমন-আযানে তারজী’ তথা শাহাদাতের বাক্যদুটির পুনরাবৃত্তি হবে কি হবে না, ইকামতের বাক্যগুলো দুই দুই বার করে পড়া হবে কি একবার করে, সিররী কিরাআতের (নিম্বস্বরে কুরআন তিলাওয়াতের) নামাযগুলোতে ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পড়া হবে কি হবে না, আমীন উচ্চস্বরে বলা হবে নাকি নিম্নস্বরে, রুকু ইত্যাদির তাকবীরে হাত তোলা হবে কি হবে না ইত্যাদি। এছাড়াও এজাতীয় অনেক মাসআলা তাঁরা একত্র করেছেন, যাতে সাহাবা-যুগ থেকেই মতভিন্নতা চলে এসেছে এবং উভয় দিকেই সাহাবায়ে কেরামের আমলও রয়েছে। উভয় পক্ষেরই দলিল-প্রমাণ রয়েছে। তবে কোন পদ্ধতিটি উত্তম বা অগ্রগণ্য শুধু এটুকু নিরূপণের ক্ষেত্রে ইমামগণের মাঝে মতপার্থক্য হয়েছে।

শায়খ ইবনে তাইমিয়া রাহ. লেখেন, যখন এই সবগুলো পদ্ধতিই বৈধ এবং প্রত্যেক পদ্ধতিতেই ইবাদত হয়ে যায় তখন উত্তম ও অগ্রগণ্য নিরূপণে যে মতপার্থক্য তা তো মারাত্মক কিছু নয়; বরং কখনো তো এমনও হয় যে, দলিল-প্রমাণের আলোকে উভয় পদ্ধতিই সমান। আর একটি পদ্ধতি উত্তম হলেও এর বিপরীত পদ্ধতিতে আমলকারীর প্রতি জুলুম করা জায়েয নয়। তার সম্পর্কে কটু কথা বলা ও তার দোষ অন্বেষণ করা জায়েয নয়।

তিনি আরো বলেন, এ বিষয়ে মুসলিম উম্মাহর ইজমা রয়েছে। এমনকি মুজতাহিদ  থেকে যদি কোনো ভুলও হয়ে যায় তবুও উম্মাহর সর্ববাদীসম্মত সিদ্ধান্ত এই যে, তার নিন্দা করা জায়েয নয়।-রিসালাতুল উলফাহ বাইনাল মুসলিমীন পৃ. ৪৬

আরো দেখুন : আলফাতাওয়াল কুবরা ১/১৪০; ইকতিযাউস সীরাতিল মুসতাকীম ১/১২৪; মাজমুউল ফাতাওয়া ২৪/২৪২-২৫২, ১৯/১১৬-১২৮, ৩/২৮২-২৮৮, ৩১০-৩১৪, ৪১৫-৪২২, ২৪/১৭০-১৭৬; যাদুল মাআদ, ইবনুল কায়্যিম

সুন্নাহর বিভিন্নতা কিংবা ইজতিহাদের মতপার্থক্যের ক্ষেত্রে একে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা, পারস্পরিক বিবাদ-বিসংবাদ থেকে বিরত থাকা, একে অন্যকে রাসূলবিরোধী, সুন্নাহবিরোধী বা হাদীসবিরোধী প্রভৃতি উপাধিতে আখ্যায়িত না করা রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এরই শিক্ষা ও সন্নাহর অনুসরণের শামিল। রিসালাতুল উলফা, আদাবুল ইখতিলাফ ফী মাসাইলিল ইলমি ওয়াদ দ্বীন ও ড. আবদুল্লাহ যইফুল্লাহ রুহায়লীর ‘দাওয়াতুন ইলাস সুন্নাহ ফী তাতবীকিস সুন্নাহ মানহাজান ওয়া উসলুবান’ ইত্যাদি কিতাব থেকে এই বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শিক্ষা ও নির্দেশনা সম্পর্কিত হাদীস ও আছার অধ্যয়ন করা যেতে পারে।

এসব মাসাইলে যে মতপার্থক্য তা কখনো নিন্দনীয় নয়, কিন্তু এই মতপার্থক্যকে বিবাদ-বিসংবাদের বুনিয়াদ বানানো চরম নিন্দনীয়। আর দুই পক্ষের যে কেউ অন্যের প্রতি কটুক্তি করলে তা হবে সুন্নাহ ও ইজমার বিরোধিতা। চাই এটা তারা আমল বিলহাদীসের নামেই করুক বা ধর্মীয় গায়রতের নামে করুক। আর সুন্নাহর বিভিন্নতার ক্ষেত্রে অপর সুন্নাহর উপর আমলকারীকে মন্দ বলা সরাসরি সুন্নাহর উপর আক্রমণের নামান্তর। আমাদেরকে সুন্নাহ অনুসরণের আদেশ করা হয়েছে। কিন্তু একটি সুন্নাহকে গ্রহণ করে অন্য সুন্নাহকে রহিত করা কিংবা তার অনুসারীদের নিন্দা করার অনুমতি কখনো দেওয়া হয়নি।

বর্তমানে এই বিপদটিই বড় হতে চলেছে। আমল বিল হাদীসের নামে সুন্নাহর বিরোধিতা, ইত্তেবায়ে সুন্নতের নামে উম্মতের ঐক্যে ফাটল সৃষ্টি করা আর তাকলীদের বিষয়ে সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হওয়ার দরুণ কাউকে সামগ্রিকভাবে বিতর্কিত করা ও তার সকল ভালো দিকগুলো অস্বীকার করা হয়। অথচ সঠিক পথে অবিচল থাকা যেমন সুন্নাহ তেমনি সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত ব্যক্তির প্রতি আপত্তি করার ক্ষেত্রে সঠিক পন্থা অবলম্বন করাও সুন্নাহ।

৯. ঐক্য ও প্রাধান্যের ক্ষেত্রে ধর্মীয় দূরদর্শিতার ব্যবহার

দ্বীন ও দুনিয়ার বিষয়ে মানুষ এমন হাজারো অবস্থার সম্মুখীন হয় যখন একসঙ্গে অনেকগুলো হক ও দায়িত্ব তার কাঁধে এসে পড়ে। বাহ্যত মনে হয় এসব হক ও দায়িত্ব একসাথেই আঞ্জাম দেওয়া উচিত। অথচ তার পক্ষে কার্যত তা সম্ভব নয়। এমন পরিস্থিতিতে সম্ভাব্য পদ্ধতি অন্বেষণ কিংবা অগ্রাধিকারের নীতি অবলম্বন করা ছাড়া উপায় থাকে না। এ রকম পরিস্থিতিতে এটাই সুন্নাহ। আর তা এমন সুন্নাহ যে, তার সঠিক প্রয়োগের জন্য অনেক বেশি ধর্মীয় প্রজ্ঞার প্রয়োজন। কারো মধ্যে দ্বীনের ‘ফিকহে আম’ (সাধারণ বোধ) তৈরি না হলে এ সুন্নাহর উপর আমল করা তার পক্ষে সম্ভব হবে না। ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় সে বাড়াবাড়ি ছাড়াছাড়ির শিকার হবে।

এসব বিষয়ে সাহাবায়ে কেরাম অত্যন্ত সচেতন ও সতর্ক ছিলেন। আল্লাহ তাআলা তাঁদের স্বভাবেই ফিকহ দান করেছিলেন। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহচর্যের বরকতে তাঁদের মধ্যে দ্বীনের জ্ঞান ও প্রজ্ঞা জাগ্রত হয়েছিল। অবশ্য এ ক্ষেত্রে তাদের মাঝে স্তর ভিন্নতাও ছিল। এজন্য অন্যান্য দ্বীনী বিষয়ের মতো এ বিষয়েও তারা প্রয়োজনের সময় পরস্পর মতবিনিময় করে নিতেন। ছোটজন বড়জন থেকে জেনে নিতেন।

আজ আমাদের সমাজ যেসব কঠিন বিপর্যয়ের সম্মুখীন তার মধ্যে একটি মারাত্মক বিষয় হল সমন্বয় ও অগ্রাধিকারের বিষয়ে সঠিক পথ থেকে বিচ্যুতি, ‘তাকদীমুল আহাম ফালআহাম’ নীতি সম্পর্কে অজ্ঞতা ও তার সঠিক প্রয়োগের বিষয়ে ব্যর্থতা ও উদাসীনতা। এটি সমাজের বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফরযের চেয়ে নফলের প্রতি অধিক গুরুত্বারোপ, কবীরা গুনাহয় লিপ্ত থেকে সগীরা গুনাহর বিষয়ে শোরগোল, জীবনের বহিরঙ্গ পরিপাটি অথচ অন্দরের পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে উদাসীন, মুস্তাহাব বিষয়ে যত্নবান অথচ মানুষের অধিকার হরণ, ইবাদত-বন্দেগীতে স্পৃহা অথচ হালাল জীবিকার বিষয়ে অনীহা, সুনানে আদিয়া তথা অভ্যাসগত সুন্নতের প্রতি তাকিদ অথচ অসংখ্য সুনানে হুদা ও প্রকৃত সুন্নাহর ব্যাপারে অকল্পনীয় উদাসীনতা, নিজের ও নিজের সন্তানের সংশোধন সম্পর্কে উদাসীন অথচ জাতি ও রাষ্ট্র নিয়ে চিন্তা এবং এ জাতীয় আরো অসংখ্য উপসর্গ। আর এসবের ফলাফল এই যে, আমরা ফিকহুল আওলাওয়িয়াত তথা আলআহাম ফালআহাম-নীতির সঠিক জ্ঞান ও তার সমন্বয় প্রদানের ক্ষেত্রে উদাসীনতার পরিচয় দিয়ে থাকি। অথচ সাহাবায়ে কেরামের অবস্থা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন।

১০. পূর্ণ নির্ভরতা ও তাৎক্ষণিক আমল

আমাদের অনেকের মাঝেই এই দুর্বলতা আছে যে, শরীয়তের বিধান জানার পরও-আল্লাহ মাফ করুন-কিছুটা দ্বিধা-সংশয় থেকে যায়। কোনো বিধান যদি যুক্তিবিরোধী মনে হয় বা নিজের অভ্যাস ও স্বভাববিরোধী হয় তবে তা স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করতে মন প্রস্ত্তত হয় না। এ রকম আরেকটি ব্যাধি এই যে, তাৎক্ষণিকভাবে পালনীয় বিষয় জানার পরও আমলে বিলম্ব করা হয়, অন্তর তাৎক্ষণিকভাবে আমলে প্রস্ত্তত হয় না।

সাহাবায়ে কেরাম রা.-এর অবস্থা ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। নবী-শিক্ষার প্রতি তাঁদের ছিল পূর্ণ আস্থা, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ঘোষণা ও তাঁর মানশা জানার পর এ বিষয়ে তাঁদের বিন্দুমাত্র সংশয়ও হত না। চাই তার যৌক্তিক উপযোগিতা জানা হোক বা না হোক, কিংবা সে বিধান তাদের স্বভাবের পূর্ণ বিরোধীই হোক। তাৎক্ষণিকভাবে আমল করতে গিয়ে অনেক ক্ষতির মুখোমুখি হলেও সর্বাবস্থায় তারা অম্লান বদনে সে আহকামের উপর আমল করতেন।

জিহাদের সফরে যখন খাদ্যের সংকট তখন গৃহপালিত গাধা হালাল মনে করে জবাই করে রান্না করতে শুরু করলেন। হাড়ি তখনও চুলায়, কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট থেকে হারাম হওয়ার সংবাদ পৌঁছামাত্রই হাড়ি উল্টে ফেলে দেওয়া হল।

অনেকের দীর্ঘ বছরের মদ্যপানের অভ্যাস ছিল। কিন্তু যখন মদ্যপান হারাম হওয়ার কথা শোনানো হল সাথে সাথে সকলেই নিজ নিজ মদের সোরাহি ভাঙ্গতে আরম্ভ করে দিলেন এবং মশকের মুখ খুলে মদ ঢালতে লাগলেন। এমনকি গোটা সড়ক মদে রঙিন হয়ে গিয়েছিল। এ ধরনের অসংখ্য ঘটনা সাহাবা-জীবনের সৌন্দর্য।

এখানে পূর্ণ ঘটনা ও দৃষ্টান্ত উল্লেখ না করেই অতি সংক্ষেপে শুধু দশটি বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হল। উদ্দেশ্য নিজেকে ও পাঠকবৃন্দকে স্মরণ করানো।

আল্লাহ তাআলা তাওফীক দিলে এই বিষয়ে দলিল-প্রমাণ ও ঘটনা-বর্ণনার আলোকে আলাদা নিবন্ধ লিখার ইচ্ছা আছে ইনশাআল্লাহ।

 

রবিউস সানী-১৪৩৩ . মার্চ-২০১২

মাসিক আলকাউসার