ঐতিহাসিক নাকবা দিবস : ইহুদিরা যেভাবে ফিলিস্তিন দখল করে

বিশ শতকের শেষার্ধে এই ষড়যন্ত্রের সূচনা। ফিলিস্তিন ভূখণ্ড তখন উসমানি খেলাফতের শাসনাধীন। যদিও খেলাফতের দাপট নিভু নিভু তারপরও তো খেলাফত! মুসলিম শক্তি। ফিলিস্তিনিদের জীবনমান বেশ উন্নত এবং সমৃদ্ধ। সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসী আরব মুসলমান আর কিছু খ্রিস্টান। ইহুদিদের সংখ্যা সাকুল্যে শতকরা চারভাগ।

ধূর্ততা শঠতা আর বেইমানির কারণে ইহুদিদের স্থায়ী নিবাস হতো না কোথাও। ছল-চাতুরির কারণে যেখানেই গেছে মার খেয়েছে। যাযাবরের জিন্দেগি ছিল তাদের। এ স্থানে কতদিন তো ও স্থানে কতদিন, এভাবেই ছিল তাদের জীবনযাত্রা। মার খেয়ে খেয়েই তারা স্বপ্ন দেখত একটি নিজস্ব ভূখণ্ডের। যেখানে নীরবে নির্বিঘ্নে ধূর্ততা আর শঠতার চর্চা করতে পারবে। পারবে অশান্তির আগুন কীভাবে জ্বালিয়ে রাখা যায় পুরো দুনিয়ায় সে ষড়যন্ত্রের ছক ঠাণ্ডা মাথায় বসে আঁকতে।

ইহুদিরা স্বপ্ন দেখল জেরুসালেম নিয়ে। মুসলমানদের ভালোবাসার আল-কুদস। ফিলিস্তিন। হ্যাঁ, ফিলিস্তিনেই হবে তাদের স্বপ্নের সেই অভয়ারণ্য। শুরু হলো স্বপ্ন পূরণের মিশন। ফিলিস্তিনে তারা রাষ্ট্র গড়বে, কিন্ত এখানে তাদের লোক কই? পুরো ফিলিস্তিনে সাকুল্যে কয়েক হাজার ইহুদির বসবাস।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তখন শেষ। ব্রিটেনের বিপরীত জোটে ছিল উসমানি খেলাফত। ব্রিটেনের জোটের কাছে তাদের পতন হয়েছে। ফিলিস্তিন থেকে গুটিয়ে ফেলতে হয়েছে হাজার বছর ধরে চলে আসা মুসলিম শাসনের হাত।

১৯১৯ সাল। উসমানি খেলাফতের কর্তৃত্ব বিলুপ্ত হয়ে গেছে ফিলিস্তিনের মাটি থেকে। পবিত্র আল-কুদসের অলিগলিতে এখন তুর্কি সৈনিকদের পরিবর্তে ব্রিটিশ সৈনিকদের দাম্ভিক পদচারণা। ফিলিস্তিন এখন ব্রিটিশ শাসনের অধীন। খ্রিস্টানদের হুকুমত।

১৯১৪ সালে যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বাঁধে, ব্রিটিশ সৈন্যরা ফিলিস্তিনে এসেছিল উসমানি খেলাফতের কর্তৃত্ব থেকে ফিলিস্তিনিদের রক্ষা করতে। হ্যাঁ রক্ষা করতে। আরব জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ফিলিস্তিনিরাই তাদের স্বাগত জানিয়েছিল। উসমানিদের শাসন তখন তাদের মনে হয়েছিল ভিনদেশিদের শাসন। কারণ, উসমানিরা তুর্কি আর তারা আরব। ভিনদেশিরা কেন আমাদের শাসন করবে? আমরা স্বাধীনতা চাই। আমরাই আমাদের দেশ শাসন করব।

ইসলামের মূল শিক্ষাটা তারা ভুলে গিয়েছিল। ভুলে গিয়েছিল মুসলিম ভ্রাতৃত্বের সৌন্দর্য। (নাকি কৌশলে তাদের ভুলিয়ে দেয়া হয়েছিল?) তুর্কি হলেও ওরা তো মুসলমান। মুসলমান মুসলমানের ভাই। ভাই আবার ভিনদেশি হয় কিভাবে? কিন্তু জাতীয়তাবাদের ভূত তাদের মাথায় এতই শক্ত হয়ে আসন গেড়েছিল যে, এসব ভাববার মতো বোধশক্তিটুকুও তাদের ছিল না।

যুদ্ধ তো শেষ। তুর্কি সৈন্যরা চলে গেছে ফিলিস্তিন ছেড়ে। ব্রিটিশদের কাজ শেষ। তাদের এবার চলে যাবার কথা। কিন্তু না, তারা যাবে না! এই অঞ্চলে শান্তি (!) প্রতিষ্ঠার জন্য তাদের আরো কিছু দিন থাকতে হবে।

আরব জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ফিলিস্তিনিরা তবুও খুশি। দেরি হোক তবু তারা তো একটি স্বাধীন ভূখণ্ড পাবে। যেখানে তুর্কিদের কোনো কর্তৃত্ব থাকবে না। নিজেরাই নিজেদের শাসন করবে।

১৯১৭ সালে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড বেলফোর একটি ঘোষণা দেন। ইতিহাস যেটাকে বেলফোর-ঘোষণা নামে স্মরণ রেখেছে। ঘোষণাটিতে তিনি ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র কায়েমের ওয়াদা করেন। এটা ছিল ফিলিস্তিনি মুসলমানদের সাথে একটা ধোঁকা। কারণ, জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ফিলিস্তিনিদের বাইরে যারা ছিলেন, তারা মনে প্রাণে চাইতেন উসমানি খেলাফতের অধীনেই থাকুক আল-কুদস আর ফিলিস্তিন। তাঁরা কোনোভাবেই ব্রিটিশদের পদচারণা এই মাটিতে সইতে পারছিলেন না। ব্রিটিশবিরোধী এসব ফিলিস্তিনির সমর্থন আদায়ের লক্ষেই ছিল তাঁর এ ঘোষণা।

নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্রের কথা শুনে এসব ফিলিস্তিনি পরবর্তীতে ব্রিটিশকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। কিন্তু এর পেছনে যে বেলফোরের অসৎ এবং ধূর্ত একটি উদ্দেশ্য ছিল, তারা টেরই পাননি। টের পেলেন যুদ্ধ যখন শেষ হলো, তখন। যুদ্ধ শেষ হবার পর দেখা গেল ফিলিস্তিনের মাটিতে দলে দলে ইহুদিরা এসে ঘর-বাড়ি নির্মাণ করছে। জাহাজ বোঝাই করে করে ইহুদিরা আসছে ইউরোপ থেকে। তাদের পৃষ্ঠপোষকতা আর পুনর্বাসনের কাজে সার্বিক সহযোগিতা করছে ফিলিস্তিনের ব্রিটিশ প্রশাসন।

ইহুদিদের কেউ কেউ স্থানীয় আরবদের কাছ থেকে জমি ক্রয় করে বাড়ি নির্মাণ করে, কেউ কেউ পতিত জমি দখলে নিয়ে সেখানে তিথু হয়। আবার কারো কারো জন্য স্বয়ং ব্রিটিশ প্রশাসন জমি অ্যাকোয়ার করে বসতি নির্মাণের বন্দোবস্ত করে দেয়। ব্রিটিশ উপনিবেশ শুরু হবার আগ পর্যন্ত ফিলিস্তিনে ইহুদিদের সংখ্যা ছিল যেখানে কয়েক হাজার, অল্প কদিন যেতে না যেতেই তা লাখ ছাড়িয়ে যায়।

১৯২৭ সাল পর্যন্ত ইহুদিদের ছোট-বড় ২২০টি বসতি গড়ে ওঠে ফিলিস্তিনে। ব্রিটিশ প্রশাসনই নির্মাণ করে দেয় এসব বসতি। ১৯৩১-এ এসে দেখা গেল ইহুদিদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে পৌনে ২ লাখ। মূল জনসংখ্যার ১৭ ভাগ। অল্প কয়েক বছরে ৪ ভাগ থেকে ১৭ ভাগ–কল্পনা করা যায়?

কল্পনা করা যাক বা না যাক ইহুদিদের সংখ্যা বাড়তেই থাকল ফিলিস্তিনে। বাড়তে থাকল এর চেয়েও আরো অকল্পনীয় আর দ্রুত হারে। ইহুদিদের স্বপ্ন পূরণের জন্যই এত আয়োজন। তাদের একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের স্বপ্ন। যেখানে নির্বিঘ্নে তারা ধূর্তামির জাল বুনতে পারবে পৃথিবীকে অশান্তির দাবানলে পোড়ানোর জন্য। ব্রিটিশরা তাদের সেই স্বপ্ন পূরণে সর্বাত্মক সহযোগিতা করছে। তাদের সাথে আছে আমেরিকা। বেলফোর ঘোষণা ছিল এই স্বপ্ন বাস্তবায়নেরই একটি পদক্ষেপ।

কিন্তু আমেরেকিা আর ব্রিটেন কেন ইহুদিদের এমন সহযোগিতা করবে? বিশ্ব জনমতের বিরুদ্ধে গিয়ে ইতিহাসখ্যাত সন্ত্রাসী জাতি ইহুদিদের জন্য স্বতন্ত্র একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় তারা কেন এত গরজ দেখাবে?

এই কেন’র জবাবে অনেক কিছু বলা যেতে পারে।

অধিকাংশ ইহুদির বাস ছিল ইউরোপে। এরা কখন কী করে বসে কোনো ঠিক নেই। এদের বিশ্বাস করা খুব কঠিন। যত দূরে রাখা যায় এদেরকে, ততই মঙ্গল। ফিলিস্তিনে তাদের জন্য একটি রাষ্ট্র বানিয়ে দিলে তারা নিজেদের রাষ্ট্রে চলে যাবে। ইউরোপিয়ানরা আতঙ্ক আর অনিষ্টের আশংকা থেকে রেহাই পাবে। তা ছাড়া ইহুদিরা খুবই দূরদর্শী জাতি। ব্রিটিশ এবং মার্কিন প্রশাসনের প্রতিটা সেক্টরে তাদের লোক নিয়োজিত। এরা ভেতর থেকে প্রশাসনকে সবসময় চাপের মুখে রাখে। এদের চাপের কারণেই ব্রিটিশ-মার্কিন প্রশাসন ইহুদিদের জন্য স্বতন্ত্র একটি রাষ্ট্রের পক্ষে তোড়জোড় দেখাতে বাধ্য হয়।

ইহুদিদের আছে বিপুল অর্থবিত্ত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর তাদের শীর্ষ নেতারা ব্রিটেনকে প্রস্তাব দিল, ফিলিস্তিন তো তোমাদের দখলেই আছে, সেখানে আমাদের একটি রাষ্ট্র বানিয়ে দাও, যুদ্ধে তোমাদের যা লোকসান হয়েছে, আমরা সব পুষিয়ে দেব।

বোমা তৈরির দুর্লভ একটি উপকরণ কৃত্রিম ফসফরাস। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেনের প্রয়োজনে ইহুদি বিজ্ঞানী ড. হেইস বাইজম্যান এই জিনিসটা তৈরি করে দিয়েছিলেন। তার তৈরি এ উপকরণ যুদ্ধের সময় অনেক কাজে লাগে ব্রিটিশদের। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী তাঁর এ কাজে খুশি হয়ে জিজ্ঞেস করেন, এর জন্য তিনি কী পুরস্কার চান?

ড. বাইজম্যান উত্তরে বলেছিলেন, আমাদের স্বাধীন একটি ভূখণ্ড নির্মাণে আপনারা সহযোগিতা করবেন। আর সেটা হবে ফিলিস্তিনের মাটিতে। ব্যাস, আর কিছু লাগবে না।

এসব নানাবিধ কারণে ব্রিটিশ-মার্কিন শক্তি ফিলিস্তিনে ইহুদিদের স্বাধীন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে তোড়জোড় কাজ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর ব্রিটিশরা ফিলিস্তিনের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের কাছে রেখেছিল মূলত এ স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্যই। দীর্ঘ তিরিশ বছর তারা এখানে আধিপত্য কায়েম করে রাখে। আর ইহুদিদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বন্দোবস্ত করে।

একদিকে তারা বিশ্বের নানা স্থানে বসবাসরত ইহুদিদের জন্য অবারিত করে দেয় ফিলিস্তিনের দোয়ার, আরেকদিকে আগত ইহুদিরা তাদের মদদে গড়ে তোলে বিভিন্ন সন্ত্রাসী সংগঠন। এই সংগঠনগুলোর কাজ হলো স্থানীয় আরব মুসলমানদের তাদের নিজস্ব ভিটামাটি থেকে উচ্ছেদ করে সেখানে ইহুদি বসতি নির্মাণ করা।

স্বভাবতই স্থানীয় আরব মুসলমানরা নিজেদের ভিটেমাটি ছাড়তে চাইত না। ইহুদি সংগঠনগুলো তখন বেছে নিত ভয়ংকর পন্থা। যারাই ভিটেমাটি ছাড়তে অস্বীকৃতি জানাত, তারাই শিকার হত নির্মম হত্যাযজ্ঞের। ইহুদিদের এই দমন-পীড়ন নিয়ে বিশ্ব মিডিয়ায় যখন উঠে এল আর সমালোচনার ঝড় শুরু হলো, তখন তারা কৌশল পরিবর্তন করে।

ইহুদিরা বড় ভয়ানক সম্প্রদায়। নিজেদের জাতীয় স্বার্থ হাসিলের জন্য এরা নিজেদের নিরপরাধ লোককে হত্যা করতেও পিছপা হয় না। ফিলিস্তিনি আরব মুসলমানদের ওপর গণহত্যা চালানোর কারণে ইহুদিরা যখন বিশ্ব বিবেকের কাছে সমালোচিত হচ্ছিল, তখন জনমত নিজেদের পক্ষে আনার জন্য তারা বেছে নেয় এক ভয়ংকর পন্থা। ইহুদিদের সবচেয়ে শক্তিশালী আর ভয়ংকর গোপন সন্ত্রাসী সংগঠনের নাম হাগানাহ। ১৯৪০ সালে ২৭৬ জন ইহুদিকে বহন করে নিয়ে আসা একটি জাহাজ হাইফা নৌবন্দরে নোঙর ফেলে। তারা এসেছে ফিলিস্তিনে বসবাসের জন্য। হাগানাহ স্বজাতির নীরিহ এসব মানুষের ওপর গুপ্ত আক্রমণ চালায়। যাত্রীসহ পুরো জাহাজটাকেই উড়িয়ে দেয়।

তারপর তারা প্রচার করে, ফিলিস্তিনি মুসলমানরা নিরীহ ইহুদিদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। বিশ্ব জনমতকে নিজেদের পক্ষে আনার এ ছিল এক ঘৃণ্য অপকৌশল। তার দুই বছর পর আবার একই কাহিনির পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছিল এই হাগানাহ। সেই হত্যাকা- ছিল আরোও বিভৎস। তখন জাহাজে যাত্রী ছিল ৭৬৯ জন। বিশ্ব মিডিয়ায় এই হত্যাকাণ্ডের দায়ও স্থানীয় ফিলিস্তিনি মুসলমানদের ওপর চাপায় তারা।

এভাবে দমন-পীড়ন হত্যা আর ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ইহুদিরা তাদের স্বাধীন একটি রাষ্ট্র কায়েমের কণ্টকাকীর্ণ পথ পরিস্কার করতে থাকে। বহিরাগত ইহুদির আগমনে ভারি হতে থাকে ফিলিস্তিনের পূণ্যভূমি। ১৯৪৭ সালে এসে দেখা গেল ইহুদিদের সংখ্যা ৬ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। ইহুদিরা এবার চূড়ান্ত ফায়সালার দিকে এগোয়। ফিলিস্তিনে তাদের একটি রাষ্ট্র চাই। ইহুদি রাষ্ট্র। ইসরায়েল। ৬ লাখ ইহুদির নিরাপত্তার জন্য এই রাষ্ট্র না হলেই নয়!

জাতিসংঘ তো আগ থেকে প্রস্তুত হয়েই ছিল। ১৯৪৭ সালের ২৮ এপ্রিল সাধারণ অধিবেশন বসে জাতিসংঘে। অধিবেশনে ফিলিস্তিন নিয়ে আলোচনা হয়। ফিলিস্তিনের চলমান সংকট নিয়ে তদন্তের জন্য গঠন করা হয় ১১ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি।

কমিটির সদস্য ছিল অস্ট্রেলিয়া চেকস্লোভাকিয়া, কানাডা, যুগোস্লাভিয়া, গুয়েতেমালো, ভারত, নেদারল্যান্ড, ইরান, পেরু, উরুগুয়ে এবং সুইডেন। নির্ধারিত সময়ে কমিটি রিপোর্ট পেশ করে। রিপোর্টে কমিটির সদস্যরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। ভারত, ইরান আর যুগোস্লোভিয়া ফিলিস্তিনে সবার সমন্বয়ে একটি ফেডারেল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে সুপারিশ করে। আর বাকি সদস্যরা মতামত ব্যক্ত করে সেখানে ইহুদিদের অভয়ারণ্য নির্মাণের জন্য ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে।

সাধারণ পরিষদ উভয় পক্ষের প্রস্তাব মূল্যায়নের জন্য এডহক কমিটির কাছে তা প্রেরণ করে। উরুগুয়ে আর গুয়েতামালো দেশ দুটো সেখানেও ইহুদিদের পক্ষে জোর ওকালতি করে। পাকিস্তানসহ আরো কয়েকটি রাষ্ট্র তাদের বিরোধিতা করে। কিন্তু তাদের এ বিরোধিতা ষড়যন্ত্রকারীদের ধুপে টিকে না।

নানা তর্ক-বিতর্কের পর অবশেষে ভোট গ্রহণ করা হয়। ফিলিস্তিন বিভক্তির পক্ষেই রায় আসে। ইহুদিরা জিতে যায়। জিতে যায় তাদের শত বছরের ষড়যন্ত্র আর কূটকৌশল। (নাকি জিতিয়ে নেয়?)

বিভক্তির পক্ষে রায় আসার মূল কারণ আমেরিকা আর রাশিয়া। দুই পরাশক্তিই ইহুদিদের সমর্থন করে। হায়, ইহুদিদের ক্ষমতা আর প্রতিপত্তির হাত কত প্রসারিত!

এডহক কমিটিতে ফিলিস্তিন বিভক্তির রায় পাশ হয়ে ফিরে আসে সাধারণ পরিষদে। সাধারণ পরিষদের দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন পেলে তবেই রায়টি কার্যকর করা যাবে।

১৯৪৭ সালের ২৬ নভেম্বর সাধারণ পরিষদের অধিবেশন। রায়টি এই অধিবেশনেই উপস্থাপন করা হবে। কিন্তু ২৬ তারিখ পর্যন্ত পরিস্থিতি ইহুদিদের অনুকূলে ছিল না। তারা আঁচ করতে পারে এই তারিখে ফিলিস্তিন বিষয়ক রায়টি পুনর্বিবেচনার জন্য উত্থাপিত হলে অধিকাংশ রাষ্ট্রই তাদের বিপক্ষে মতামত ব্যক্ত করবে। নানা টালবাহানা করে তাই এই দিন রায়টি উত্থাপন করাটা তারা বানচাল করে দেয়। তারপর পশ্চিমা শক্তিগুলো ছোট ছোট সদস্য রাষ্ট্রের ওপর চাপ প্রয়োগ শুরু করে। চলে নানা হুমকি-ধমকি। যাতে তারা ফিলিস্তিন বিভক্তির পক্ষে ভোট দেয়।

রায় উত্থাপিত হয় ২৯ নভেম্বর। ততদিনে পরিস্থিতি ইহুদিদের পক্ষে চলে আসে। ভোট অনুষ্ঠিত হয়। পূর্বের সিদ্ধান্তের ওপরই রায় আসে। ফিলিস্তিনকে বিভক্ত করা হবে। পবিত্র ভূমির বুকে প্রতিষ্ঠা করা হবে ইহুদিদের অভয়ারণ্য। ইসরায়েল।

ফিলিস্তিনকে ভাগ করে দেয়া হয় বহিরাগত ইহুদি আর যুগ যুগ ধরে বসবাস করে আসা স্থানীয় আরব মুসলমানদের মধ্যে। সংখ্যালঘু ইহুদিরা পেল ফিলিস্তিনের ৫৭ ভাগ ভূমি আর স্থানীয় অধিবাসী যারা ছিল মোট জনসংখ্যার তিন-চতুর্থাংশ–তাদের ভাগে পড়ল মাত্র ৪৩ ভাগ ভূমি। হায়, পৃথিবীর ইতিহাস এরচেয়ে বড় বেইনসাফি আর কি কখনো প্রত্যক্ষ করেছিল?

ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হবে আরবের বুকে, সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। কিন্তু ফিলিস্তিন? ফিলিস্তিন রাষ্ট্র কিভাবে হবে, কী হবে এর অবকাঠামো, তা অমীমাংসিতই থেকে যায়।

জাতিসংঘ থেকে ইহুদিরা তাদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব পাশ করানোর পর ফিলিস্তিনিদের ওপর শুরু করে নতুন রূপে নির্যাতন। তাদের জঙ্গি গ্রুপগুলো হয়ে ওঠে আরোও বেপরোয়া। ঘর-বাড়ি লুণ্ঠন, উচ্ছেদ আর একটু প্রতিবাদ করলেই গুলি করে হত্যা–ফিলিস্তিনিদের ওপর যেন কেয়ামতের বিভীষিকা নেমে আসে!মাত্র ১০০ দিনে ১৭ হাজার ফিলিস্তিনি মুসলমান ইহুদিদের নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে শাহাদত বরণ করেন।

ভয়ানক এই পরিস্থিতির কারণে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে আবারও আলোচনা ওঠে ফিলিস্তিন নিয়ে। ১৯৪৮ সালের ২০ এপ্রিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে মার্কিন প্রতিনিধি ফিলিস্তিন বিভক্তির ব্যাপারটা স্থগিত রেখে পুরো ফিলিস্তিনকে সরাসরি জাতিসংঘ কর্তৃক নিয়ন্ত্রণ করার প্রস্তাব পেশ করেন। এ প্রস্তাবকে সামনে রেখে আলোচনার নামে শুরু হয় নতুন প্রহসন। এদিকে একই বছর ১৪ মে ফিলিস্তিন থেকে ব্রিটিশরা চলে আসার কথা। ১৪ মের আগে আগেই একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছা জরুরি।

ইহুদি নেতা ওয়াইজম্যান এক নতুন চাল চাললেন তখন। তিনি গোপনে সাক্ষাত করলেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট মিস্টার ট্রুমেনের সঙ্গে। ব্যাস। কেল্লা ফতে করে এলেন তিনি।

১৪ মে স্থানীয় সময় রাত ১২টা। ফিলিস্তিনে ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণের মেয়াদ শেষ। ওয়াশিংটনে তখন ভোর ৬টা। মিনিটের কাঁটা পেরোতে না পেরোতেই ইহুদি নেতা বেন-গুরিয়ান তেল আবিব থেকে ফিলিস্তিনের বুকে একটি স্বাধীন ইহুদি রাষ্ট্রের ঘোষণা দিলেন। রাষ্ট্রের নাম ইসরাইল।

এর ঠিক ১০ মিনিটের মাথায় ওয়াশিংটন থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুমেন ইসরাইলকে স্বীকৃতি প্রদান করেন। তারপর ব্রিটেন থেকেও শোনা গেল স্বীকৃতির আওয়াজ। সোভিয়েত ইউনিয়নও সুর মেলাল এরপর। ৩ সুপার পাওয়ারের স্বীকৃতি প্রায় এক সঙ্গেই পেয়ে গেল ইহুদিরা। আর কী লাগে?

আরব রাষ্ট্রগুলো বিশ্বমোড়লদের এ হঠকারিতা মেনে নিতে পারেনি। ফিলিস্তিনি মুসলমানদের মেনে নেয়ার তো প্রশ্নই আসে না। শুরু হয় আরব-ইসরাইল যুদ্ধ।

যুদ্ধ যে অনিবার্য ইহুদিরা আগে থেকেই জানত। তারা আঁটঘাঁট বেঁধেই ছিল। কিন্তু আরব রাষ্ট্রগুলোর ভেতর ছিল প্রচুর অনৈক্য আর বিশৃঙ্খলা। অন্যদিকে ইহুদিদের ষড়যন্ত্র। ইহুদিরা আগ থেকেই এসব রাষ্ট্রে ষড়যন্ত্রের জাল বিছিয়ে রেখেছিল। যাতে তারা রাষ্ট্র ঘোষণা দেয়ার পর আরবরা যুদ্ধ করতে এসে এই জালে আটকা পড়ে হাঁসফাঁস করে।

ফলাফল যা হবার তাই হলো। আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব আর ইসরাইলি ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করা সম্ভব হলো না আরবদের পক্ষে। ইসরায়েল এই ফাঁকে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করে নিল। অসহায় ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্যাতন-নিষ্পেষণ তো আর আছেই।

ফিলিস্তিনিরাও থেমে নেই। নিজেদের যা আছে, যতটুকু আছে তা দিয়েই প্রতিরোধ করতে লাগল ইহুদিদের।

এলো ১৯৬৭ সাল। আবারও বাঁধল আরব-ইসরাইল যুদ্ধ। আরবরা দীর্ঘ প্রস্তুতি নিয়েই নেমেছিল। কিন্তু ইসরায়েলিদের গোপন ষড়যন্ত্র রুখবে কে? এরা আগ থেকেই আরব রাষ্ট্রগুলোতে অনৈক্য আর বিভেদ ছড়িয়ে রেখেছিল। তার ওপর আছে তাদের শক্তিশালী গোয়েন্দা ইউনিট। আরবদের পূর্বপরিকল্পনা গোয়েন্দা মারফত মুহূর্তেই পৌঁছে যেত তেলআবিব। ছয়দিনের যুদ্ধে আরবরা আবারও পরাজিত হলো। হারাতে হলো আরো নতুন কিছু ভূখণ্ড।

মিশরের অধীনে থাকা সিনাই উপত্যকা, সিরিয়ার অধীনে থাকা গোলান মালভূমি এবং জর্ডানের অধীনে থাকা পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুসালেম ইসরায়েলিরা দখল করে নেয়। আর এর মধ্য দিয়েই মুসলমানদের ভালোবাসার শহর পবিত্র আল-কুদসে ইহুদিদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। ফিলিস্তিনি মুসলমানরা হয় চূড়ান্ত বঞ্চনার শিকার। সেই বঞ্চনা আর না পাওয়ার হাহাকারে আজও ভারি হয়ে আছে ফিলিস্তিনের আকাশ। এর ভেতরে পৃথিবীর রূপ-বৈচিত্রে কত পরিবর্তন এসেছে, জর্দান নদীতে কলকল রব তুলে গড়িয়েছে কত জল, কিন্তু হতভাগ্য আল-কুদস আর ফিলিস্তিনের মানুষের ভাগ্যে কোনো পরিবর্তন আসেনি। জুলুম নির্যাতন আর পরাধীনতার গ্লানিতে আজও তারা ক্লান্ত-কাহিল।

তাই বলে যে তাঁরা থেমে আছে, এমন নয়। তাঁদের সংগ্রাম আর প্রতিরোধ চলমান। বঞ্চনার আগুনে পুড়তে পুড়তে তাঁদের কেউ কেউ হঠাৎ জ্বলে ওঠে। আর পৃথিবী অবাক হয়ে দেখে প্রতিবাদের অভিনব ভাষা এবং স্বরূপের আগুন-মূর্তি।


হামমাদ রাগিব
সূত্রঃ fateh24