নবীজির (সাঃ) এর নবুওতপ্রাপ্তি

মুহাম্মদের (সাঃ) চল্লিশতম বছর যখন পূর্ণ হলো—এটাই হচ্ছে মানুষের পূর্ণত্ব প্রাপ্তির বয়স; এবং বলা হয়েছে যে, এ বয়স হচ্ছে পয়গম্বরগণের নবুয়তপ্রাপ্তির উপযুক্ত বয়স—তখন নবুওতের কিছু স্পষ্ট লক্ষণ প্রকাশ হতে লাগলো। সে লক্ষণগুলো প্রাথমিক পর্যায়ে স্বপ্নের মাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছিলো : তিনি যখনই কোনো স্বপ্ন দেখতেন, তা প্রতীয়মান হতো সুবহে সাদেকের নিশ্চিতির মতো; এ অবস্থার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হলো ছয়টি মাস।

এরপর তিনি যখন হেরা-গুহায় নিরবচ্ছিন্ন ধ্যানে নিমগ্ন থাকতেন এবং এভাবে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস এবং বছরের পর বছর অতিবাহিত হতে হতে তৃতীয় বর্ষ অতিবাহিত হতে থাকলো, তখন আল্লাহ তাআলা পৃথিবীর মানুষের উপর স্বীয় রহমত বর্ষণের ইচ্ছা করলেন; আল্লাহ রব্বুল আলামিন জিবরাঈল আলাইহিস সালামের মাধ্যমে কুরআনুল কারিমের কয়েকটি আয়াতে কারিমা নাজিল করে মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে নবুওতের মহান মর্যাদা-প্রদানে ভূষিত করেন।

নবুওত—এটা নৈসর্গিক নূর বা আসমানি দীপ্তির মতো এমন এক আলোকরশ্মি ছিল, যা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে অবিশ্বাস ও ভ্রষ্টতার অন্ধকার বিদূরিত হতে থাকে, জীবনের গতিধারা পরিবর্তিত হতে থাকে এবং ইতিহাসের পট পরিবর্তিত হয়ে নতুন নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি হতে থাকে। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেছেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নিকট ওহি অবতীর্ণ হয়েছিলো ঘুমের অবস্থায় স্বপ্নযোগে; তিনি যখন যে স্বপ্নই দেখতেন, তা প্রভাতরশ্মির মতো প্রকাশিত হতো। তারপর ক্রমান্বয়ে তিনি নির্জনতাপ্রিয় হতে থাকলেন। নিরবচ্ছিন্ন নির্জনতায় ধ্যানমগ্ন থাকার সুবিধার্থে তিনি হেরা-গুহায় অবস্থান করতেন। কোনো কোনো সময় ঘরে ফিরতেন না। রাতের পর রাত তিনি ইবাদত-বন্দেগি এবং গভীর ধ্যানে নিমগ্ন থাকতেন। এজন্য খাদ্য এবং পানীয় সঙ্গে নিয়ে যেতেন। সেসব ফুরিয়ে গেলে পুনরায় তিনি ঘরে ফিরতেন। পূর্বের মতো খাদ্য এবং পানীয় সঙ্গে নিয়ে পুনরায় তিনি হেরা গুহায় গিয়ে ধ্যানমগ্ন হতেন। ওহি নাজিলের মাধ্যমে তাঁর নিকট সত্য প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত এভাবেই তিনি হেরা-গুহার নির্জনতায় অবস্থান করতে থাকেন।

এমনভাবে একদিন, তিনি যখন ধ্যানমগ্ন অবস্থায় ছিলেন, তখন আল্লাহর দূত জিবরাঈল (আলাইহিস সালাম) তাঁর নিকট আগমন করে বললেন, ‘তুমি পড়ো।’ তিনি বললেন, ‘পড়ার অভ্যাস আমার নেই।’ তারপর তিনি তাঁকে অত্যন্ত শক্তভাবে ধরে আলিঙ্গন করলেন এবং ছেড়ে দিয়ে বললেন, ‘তুমি পড়ো।’ তিনি আবারও বললেন, ‘আমার পড়ার অভ্যাস নেই।’ তারপর তৃতীয় দফায় আমাকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করার পর ছেড়ে দিয়ে বললেন,

‏ ‏ اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ خَلَقَ الْإِنسَانَ مِنْ عَلَقٍ اقْرَأْ وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ

অর্থ : সেই প্রভুর নামে পড়ো, যিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষকে রক্তপিণ্ড থেকে। পড়ো সেই প্রভুর নামে, যিনি তোমাদের জন্য অধিকতর দয়ালু।

তারপর ওহির আয়াতগুলো অন্তরে ধারণ করে নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিছুটা অস্থির ও স্পন্দিত চিত্তে খাদিজা বিনতে খোওয়াইলিদের নিকট প্রত্যাবর্তন করলেন এবং বললেন, ‘আমাকে বস্ত্রাবৃত করো, আমাকে বস্ত্রাবৃত করো।’ খাদিজা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) তাঁকে শায়িত অবস্থায় বস্ত্রাবৃত করলেন। এভাবে কিছুক্ষণ থাকার পর তাঁর অস্থিরতা ও চিত্ত স্পন্দন প্রশমিত হলে তিনি তাঁর সহধর্মিনীকে হেরা-গুহার ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করলেন। তাঁর অস্থিরতা ও চিত্ত-চাঞ্চল্যের ভাব লক্ষ্য করে খাদিজা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) তাঁকে আশ্বস্ত করে বললেন, ‘কোনো ভয় করবেন না, আপনি ধৈর্য ধরুন। আল্লাহ কখনো আপনাকে অপমান করবেন না। আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে আপনি সুসম্পর্ক রক্ষা করে চলেন। অভাবগ্রস্তদের অভাব মোচনের চেষ্টা করেন। অসহায়দের আশ্রয় প্রদান করেন। মেহমানদের আদর-যত্ন করেন, অতিথিদের আতিথেয়তা প্রদান করেন এবং ঋণগ্রস্তদের ঋণের দায় মোচনে সাহায্য করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ আপনাকে অপদস্থ করবেন না।’