ব্যক্তি ও সমাজ গঠনে সীরাতের ভূমিকা – মুহাম্মাদ সিফাতুল্লাহ [২য় পর্ব]

সমাজবদ্ধতা

মানুষ একা একা জীবনযাপন করতে পারে না। তাকে অন্যের সাথে থাকতে হয়, অন্যের সহযোগিতা ও সাহচর্যের প্রয়োজন হয়। পরস্পর সহযোগিতা ও আদান-প্রদানের মাধ্যমেই সমাজ এগিয়ে যায়। তাই সমাজবদ্ধতা মানুষের সাধারণ প্রয়োজন।

মানব-স্বভাব ও মানব-জীবনের এই স্বাভাবিকতার সাথে ইসলামের নীতি ও শিক্ষা খুবই সামঞ্জস্যপূর্ণ। ইবাদত-বন্দেগী থেকে শুরু করে জীবনের নানা ক্ষেত্রে ইসলামের সমাজবদ্ধতার নীতি স্পষ্ট। এর সহজ উদাহরণ হচ্ছে সালাত, যা ঈমানের পর ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিধান। কুরআন-সুন্নাহয় পুরুষকে জামাতের সাথে সালাত আদায়ের তাকিদ করা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে-

وَ اَقِیْمُوا الصَّلٰوةَ وَ اٰتُوا الزَّكٰوةَ وَ ارْكَعُوْا مَعَ الرّٰكِعِیْنَ

 তোমরা নামায পড় ও যাকাত দাও এবং যারা রুকু করে তাদের সাথে রুকু কর। -সূরা বাকারা (২) : ৪৩

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একা নামাযের চেয়ে জামাতের নামাযের সাতাশ গুণ বেশি ফযীলত বর্ণনা করেছেন। ইরশাদ হয়েছে-

صَلاَةُ الجَمَاعَةِ تَفْضُلُ صَلاَةَ الفَذِّ بِسَبْعٍ وَعِشْرِينَ دَرَجَةً.

জামাতের নামায একা নামাযের চেয়ে সাতাশগুণ বেশি মর্তবা রাখে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৪৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৬৫০

আরো ইরশাদ হয়েছে-

صَلَاةُ الرَّجُلَيْنِ يَؤُمُّ أَحَدُهُمَا صَاحِبَهُ، أَزْكَى عِنْدَ اللَّهِ مِنْ صَلَاةِ أَرْبَعِينَ تَتْرَى، وَصَلَاةُ أَرْبَعَةٍ يَؤُمُّ أَحَدُهُمْ أَزْكَى عِنْدَ اللَّهِ مِنْ صَلَاةِ ثَمَانِينَ تَتْرَى، وَصَلَاةُ ثَمَانِيَةٍ يَؤُمُّهُمْ أَحَدُهُمْ أَزْكَى عِنْدَ اللَّهِ تَعَالَى مِنْ صَلَاةِ مِائَةٍ تَتْرَى.

আল্লাহর কাছে দুই ব্যক্তির নামায, যাদের একজন ইমাম হয়- চল্লিশ ব্যক্তির আলাদা আলাদা নামাযের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। আর চার ব্যক্তির নামায, যাদের একজন ইমাম হয়- আশি ব্যক্তির আলাদা নামাযের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। আর আট ব্যক্তির নামায, যাদের একজন ইমাম হয়- একশ ব্যক্তির আলাদা আলাদা নামাযের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। -আলমুজামুল কাবীর, তবারানী ১৯/৭৪, হাদীস ৭৩;মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ৬৬২৬; সুনানে কুবরা, বায়হাকী, হাদীস ৪৯৬৫

শুধু ফযীলতই বর্ণনা করেননি, বিনা ওজরে জামাত ত্যাগকারীর জন্য শক্ত হুঁশিয়ারিও উচ্চারণ করেছেন-

وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِه لَقَدْ هَمَمْتُ أَنْ آمُرَ بِحَطَبٍ، فَيُحْطَبَ، ثُمَّ آمُر بِالصَّلاَةِ، فَيُؤَذَّنَ لَهَا، ثُمَّ آمُر رَجُلًا فَيَؤُمَّ النَّاسَ، ثُمَّ أُخَالِف إِلى رِجَالٍ، فَأُحَرِّقَ عَلَيْهِمْ بُيُوتَهُمْ.

ঐ সত্তার কসম যাঁর হাতে আমার প্রাণ, আমি উদ্যত হয়েছিলাম যে, কাউকে লাকড়ি জমা করতে বলি, এরপর নামাযের জন্য আযান দিতে বলি। আযান দেয়া হলে একজনকে জামাতের ইমাম বানিয়ে আমি ঐ সব লোকের কাছে যাই, (যারা  জামাত ছেড়ে ঘরে বসে রয়েছে) আর তাদের ঘরবাড়ি আগুনে জ্বালিয়ে দেই! -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৪৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৬৫১

প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাযে জামাতের পাশাপাশি রয়েছে শুক্রবারে জুমার নামাজের বিধান। জুমার নামাযের জন্য জামাআত শর্ত। বিনা ওজরে জুমা ত্যাগকারীর ব্যাপারেও শক্ত হুঁশিয়ারি বর্ণিত হয়েছে। আবুল জা‘দ আদদামরী রা. থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

مَنْ تَرَكَ ثَلَاثَ جُمَعٍ تَهَاوُنًا بِهَا، طَبَعَ اللَّهُ عَلَى قَلْبِهِ.

যে জুমার প্রতি অবহেলাবশত তিন জুমা ত্যাগ করে আল্লাহ তার অন্তরে মোহর করে দেন। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১০৫২; জামে তিরমিযী, হাদীস ৫০০; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১১২৬

এরপর বছরে দুটি ঈদ রয়েছে, যা সম্মিলিতভাবে খোলা ময়দানে আদায় করতে হয়। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার শুধু মাঠ ছেড়ে মসজিদে ঈদের সালাত আদায় করেছেন। হযরত আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেন-

أَنَّهُ أَصَابَهُمْ مَطَرٌ فِي يَوْمِ عِيدٍ، فَصَلَّى بِهِمُ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ صَلَاةَ الْعِيدِ فِي الْمَسْجِدِ.

 (একবার) ঈদের দিন বৃষ্টি হয়েছিল। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদের নিয়ে মসজিদে ঈদের নামায পড়েন। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১১৬০; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৩১৩

তো সারকথা এই যে, শুধু নামাযেই সমাজবদ্ধতার বিষয়টি কত গুরুত্বের সাথে পাওয়া যাচ্ছে!

একা একা সফর করতে হাদীস শরীফে নিষেধ আছে। আর যখন একত্রে সফর করবে তখনও একজনকে আমীর নির্বাচন করার আদেশ দিয়েছেন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-

إِذَا خَرَجَ ثَلَاثَةٌ فِي سَفَرٍ فَلْيُؤَمِّرُوا أَحَدَهُمْ

যখন তিনজন কোনো সফরে বের হয় তখন তারা যেন একজনকে আমীর বানায়। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৬০৮

ইসলাম শুধু সমাজবদ্ধতার নয়: বরং ন্যায়ভিত্তিক আদর্শ-সমাজবদ্ধতার শিক্ষা দান করেছে, যা অনুরসণ করার দ্বারা সমাজ-জীবন শান্তিপূর্ণ ও কল্যাণপূর্ণ হতে পারে। তার মৌলিক কিছু দিক এখানে উল্লেখ করছি :

ঐক্য

ইসলামী সমাজ-বিধির এক গুরুত্বপূর্ণ ধারা হচ্ছে ঐক্য। ধর্মীয় বিধান ও সামাজিক ব্যবস্থা উভয় ক্ষেত্রে চিন্তাগত ও কর্মগত একতা রক্ষার ও বিচ্ছিন্নতা পরিহারের আদেশ খুব তাকিদের সাথে দেওয়া হয়েছে।

কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-

وَ اعْتَصِمُوْا بِحَبْلِ اللهِ جَمِیْعًا وَّ لَا تَفَرَّقُوْا  وَ اذْكُرُوْا نِعْمَتَ اللهِ عَلَیْكُمْ اِذْ كُنْتُمْ اَعْدَآءً فَاَلَّفَ بَیْنَ قُلُوْبِكُمْ فَاَصْبَحْتُمْ بِنِعْمَتِهٖۤ اِخْوَانًا .

তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ কর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর; তোমরা ছিলে পরস্পর শত্রু; তিনি তোমাদের হৃদয়ে প্রীতির সঞ্চার করেছেন। ফলে তাঁর অনুগ্রহে তোমরা পরস্পর ভাই হয়েছে। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ১০৩

‘হাবলুল্লাহ’ অর্থ- আল্লাহর রজ্জু। অর্থাৎ আলকুরআন এবং আল্লাহর সাথে কৃত বান্দার সকল অঙ্গিকার, যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গিকারটি এই যে, আমরা শুধু রবেরই ইবাদত করব, অন্য কারো নয়। এ কারণে ইসলামে ঐক্যের ভিত্তি হচ্ছে তাওহীদ- এক আল্লাহর ইবাদত, এক আল্লাহর ভয়।

তাওহীদের সমাজকে ইসলাম আদেশ করে সীরাতে মুস্তাকীম ও সাবীলুল মুমিনীনের উপর একতাবদ্ধ থাকতে, নিজেদের ঐক্য ও সংহতি এবং সৌহার্দ ও সম্প্রীতি রক্ষা করতে। ইজমা ও সাবীলুল মুমিনীনের বিরোধিতা পরিহার করতে এবং এমন সব কর্মকা- থেকে বিরত থাকতে, যা উম্মাহর একতা নষ্ট করে এবং সম্প্রীতি বিনষ্ট করে। (উম্মাহর ঐক্য : পথ ও পন্থা, পৃ. ১০, ১৫)

উমর ইবনুল খাত্তাব রা. থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা জামাআর সাথে থাক এবং বিচ্ছিন্নতা পরিহার কর। কারণ শয়তান থাকে সঙ্গীহীনের সাথে। আর দু’জন থেকে সে থাকে দূরে।…। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২১৬৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১১৪

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহ ও সীরাতকে সামনে রেখে চিন্তা করলে প্রতীয়মান হয় যে, ‘আল জামাআ’-এর অর্থে নিমেণাক্ত বিষয়গুলো শামিল :

১. আমীরুল মুমিনীন বা সুলতানের কর্তৃত্ব স্বীকারকারীদের থেকে বিচ্ছিন্ন না হওয়া এবং শরীয়তসম্মত বিষয়ে তার আনুগত্য বর্জন না করা। (দ্রষ্টব্য : ফাতহুল বারী ১৩/৩৭, হাদীস ৭০৮৪-এর আলোচনায়)

২. শরীয়তের আহকাম ও বিধানের ক্ষেত্রে উম্মাহর ‘আমলে মুতাওয়ারাছ’ তথা সাহাবা-তাবেয়ীন যুগ থেকে চলে আসা কর্মধারা এবং উম্মাহর সকল আলিম বা অধিকাংশ আলিমের ইজমা ও ঐক্যের বিরোধিতা না করা। (দ্রষ্টব্য : উসূলের কিতাবসমূহের ইজমা অধ্যায়)

৩. হাদীস-সুন্নাহ এবং ফিকহের ইলম রাখেন, এমন উলামা-মাশাইখের সাথে নিজেকে যুক্ত রাখা। ইমাম তিরমিযী রাহ. আহলে ইলম থেকে আলজামাআর যে ব্যাখ্যা বর্ণনা করেছেন তা এই-

أهل الفقه والعلم و الحديث

অর্থা জামাআ হচ্ছে ফিকহ ও হাদীসের ধারক আলিম সম্প্রদায়। (কিতাবুল ফিতান, বাবু লুযুমিল জামাআ, হাদীস ২১৬৭-এর আলোচনায়)

৪. মুসলিমসমাজের ঐক্য, সংহতি এবং ঈমানী ভ্রাতৃত্বের উপাদানসমূহের সংরক্ষণ এবং অনৈক্য, বিবাদ ও হানাহানির উপকরণসমূহ থেকে সমাজকে মুক্ত করার প্রয়াস, যে সম্পর্কে ইতিপূর্বে বলা হয়েছে।

এখানে যে চারটি বিষয় উল্লেখ করা হল সাধারণত আলজামাআর ব্যাখ্যায় এগুলোকে আলাদা আলাদা মত হিসেবে বর্ণনা করা হয়। কিন্তু বাস্তবে এদের মাঝে কোনো সংঘর্ষ নেই। প্রত্যেকটি হচ্ছে আলজামাআর বিভিন্ন দিক।

একেকজন একেকটি দিক আলোচনা করেছেন। (উম্মাহর ঐক্য : পথ ও পন্থা, পৃ. ৩৮)

তদ্রূপ বিচ্ছিন্নতার প্রায়োগিক রূপগুলোও পরিষ্কারভাবে জানা কর্তব্য। আর তা এই-

১. দ্বীন ইসলামে দাখিল না হওয়া, ইসলামের বিরোধিতা করা বা ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যাওয়া- এগুলো সর্বাবস্থায় দ্বীনের ক্ষেত্রে বিভেদ-বিচ্ছিন্নতা।

২. তাওহীদের এবং দ্বীনের অন্যান্য মৌলিক বিষয়, যেগুলোকে পরিভাষায় ‘জরূরিয়াতে দ্বীন’ বলে- তার কোনো একটির অস্বীকার বা অপব্যাখ্যা হচ্ছে ইরতিদাদ (মুরতাদ হওয়া), যা দ্বীনের ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নতার জঘন্যমত প্রকার। এ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় দ্বীন ইসলামকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করা।

৩. ইসলাম গ্রহণের পর কুরআন-সুন্নাহ ও ইসলামী আকীদাসমূহ বোঝার ক্ষেত্রে খেয়ালখুশির অনুসরণ করে সাহাবীগণের পথ থেকে বিচ্যুত হওয়া। এটাও বিচ্ছিন্নতা। হাদীস শরীফে কঠিন ভাষায় এর নিন্দা করা হয়েছে এবং তা থেকে বাঁচার জন্য দুটি জিনিসকে দৃঢ়ভাবে ধারণের আদেশ করা হয়েছে : আসসুন্নাহ এবং আলজামাআ। এ কারণে যে জামাত সিরাতে মুসতাকীমের উপর অটল থাকে তাদের নাম ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ।’

তাদের পথ থেকে যারাই বিচ্যুত হয়েছে তারাই এই বিভেদ-বিচ্ছিন্নতার শিকার হয়েছে। অতপর কোনো দল ও ফের্কার জন্ম দিলে তা তো আরো জঘন্য। (উম্মাহর ঐক্য : পথ ও পন্থা, পৃ. ৪০-৪১)

৩. আল জামাআর ব্যাখ্যায় উল্লেখিত প্রথমোক্ত তিনটি বিষয়ের কোনো একটি ভঙ্গ করা কিংবা কোনো একটি থেকে বিচ্যুত হওয়া পরিষ্কার বিচ্ছিন্নতা। (উম্মাহর ঐক্য : পথ ও পন্থা, পৃ. ৪৬)

উপরোক্ত বিষয়গুলোর বিস্তারিত ব্যাখ্যা এবং সুন্নাহ ও সীরাত থেকে এর দলীল ও প্রায়োগিক দৃষ্টান্ত জানার জন্য পড়ুন- উম্মাহর ঐক্য : পথ ও পন্থা, হযরত মাওলানা আব্দুল মালেক ছাহেব হাফিযাহুল্লাহু তাআলা ওয়া রা‘আহু।

বৈচিত্র ও বিচ্ছিন্নতা

ইসলামী সমাজ-বিধির এক অনুপম বৈশিষ্ট্য, যা তার ন্যায়নিষ্ঠা ও ভারসাম্য-প্রিয়তারই এক দিক, এই যে, এখানে ‘বৈচিত্র ও বিচ্ছিন্নতা’ খুব স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত হয়েছে। আর এ কারণে বৈচিত্রকে বিচ্ছিন্নতা কিংবা বিচ্ছিন্নতাকে ‘বৈচিত্র’ ভাবার অবকাশ নেই। এ কারণে একদিকে যেমন দলীল-প্রমাণ ভিত্তিক চিন্তা-ভাবনার প্রতি প্রবলভাবে উৎসাহিত করা হয়েছে অন্যদিকে বক্র ও ভিত্তিহীন চিন্তা-ভাবনার বিস্তার প্রতিরোধের বিধানও ইসলামে রয়েছে।

তবে একই সাথে বিচ্ছিন্নতা অবলম্বনকারীদের ব্যাপারেও ইসলামী সমাজ-বিধি খুব তাকীদের সাথে ইনসাফ অবলম্বনের আদেশ করেছে। এ ক্ষেত্রেও যুলুম-অবিচারের কোনো সুযোগ নেই।

ইসলামী সমাজ-বিধিতে ইসলাম গ্রহণ না করা বিচ্ছিন্নতা, কিন্তু ইসলাম কবুলের ব্যাপারে বাধ্য করা পরিষ্কারভাবে নিষিদ্ধ। অমুসলিমদের সাথে সহাবস্থানের ন্যায়সঙ্গত ও ভারসাম্যপূর্ণ নীতি ও বিধান ইসলামী সমাজ-বিধির  এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।

দুই. মাশওয়ারা ও পরামর্শ

মাশওয়ারা ইসলামী সমাজ ও সমষ্টিগত জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পরামর্শের দ্বারা পরস্পর ঐক্য সৃষ্টি হয়, উত্তম ব্যবস্থা ও সমাধান বের হয়ে আসে, চিন্তা-ভাবনা, বিচার-বিশ্লেষণ, আলোচনা-পর্যালোচনার ধারা শক্তিশালী হয় এবং ব্যক্তিগত ভুল-ভ্রান্তি থেকে আত্মরক্ষা সহজ হয়।

ইসলামে ধর্মীয় বিধি-বিধান এবং ব্যবস্থাপনাগত বিষয়াদি উভয় ক্ষেত্রেই রয়েছে মাশওয়ারার বিধান । স্বয়ং আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেও আল্লাহ তাআলা পরামর্শ করার নির্দেশ দিয়েছেন। অথচ তিনি ছিলেন নবী ও রাসূল। ইরশাদ হয়েছে  :

وَ شَاوِرْهُمْ فِی الْاَمْرِ

 (প্রয়োজনীয় বিষয়ে) আপনি তাদের সাথে পরামর্শ করুন। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ১৫৯

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র সীরাত এই কুরআনী বিধানের বাস্তব দৃষ্টান্ত। খন্দকের যুদ্ধে এবং ইফকের ঘটনায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবাদের সঙ্গে পরামর্শ করেছেন। যুদ্ধ ও সন্ধি সবক্ষেত্রেই পরামর্শ করেছেন।

মাশওয়ারার দ্বারা সংশ্লিষ্টদের মাঝে যে প্রেরণা ও উদ্যম তৈরি হয় তার উদাহরণ দিতে গিয়ে ইবনে কাসীর রাহ. বলেন, বদর যুদ্ধের প্রস্ত্ততিকালে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরামর্শের জন্য সাহাবায়ে কেরামের সঙ্গে বসলেন এবং সবার কাছে পরামর্শ চাইলেন, তখন হযরত সা‘দ ইবনে মু‘আজ রা. দাঁড়িয়ে এক উদ্দীপনাময়ী ভাষণ দিলেন যে, আমি আনছারদের পক্ষ থেকে পূর্ণ প্রত্যয়ের সঙ্গে বলছি, আপনি যেখানে ইচ্ছা যাত্রা করুন। যার সঙ্গে ইচ্ছা সম্পর্ক স্থাপন করুন। কিংবা সম্পর্ক ছিন্ন করুন, আল্লাহর কসম, আপনি যদি (সুদূর) বারকুল গিমাদেও যেতে চান, আমরা আপনার সঙ্গে যাব। আল্লাহর কসম আপনি যদি আমাদেরকে নিয়ে এই সাগরে ঝাঁপ দিতে চান আমরাও ঝাঁপ দিব।

হযরত মিকদাদ রা. বললেন, আমরা হযরত মূসা আ.-এর সম্প্রদায়ের মত বলব না যে, আপনি ও আপনার রব গিয়ে তাদের সঙ্গে লড়াই করুন। আমরা এখানেই বসে থাকব। বরং আমরা আপনার ডান দিকে, বাম দিকে, আপনার সামনে, পিছনে- সব জায়গায় থেকে লড়াই করব। -তাফসীরে ইবনে কাসীর ২ : ১২৮; যাদুল মা‘আদ ৩ : ১৭৩

কুরআন মাজীদে পরামর্শের ভিত্তিতে কাজ করাকে মুমিনদের বৈশিষ্ট্য বলা হয়েছে-

وَ اَمْرُهُمْ شُوْرٰی بَیْنَهُمْ

তাদের কর্ম পরস্পর পরামর্শের ভিত্তিতে হয়। -সূরা শুরা (৪২) : ৩৮

তিন. পরস্পর সহযোগিতা

ইসলামী সমাজ-বিধির এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ ‘তাআউন’-পরস্পর সহযোগিতা। এক্ষেত্রে রয়েছে সুনির্দিষ্ট নীতি ও বিধান, যার দ্বারা ইসলামের সমাজ-বিধি অন্য সকল জাহেলী সমাজ-ব্যবস্থা থেকে আলাদা।

ইসলামে পরস্পর সহযোগিতার ভিত্তি হচ্ছে ‘বির’ ও ‘তাকওয়া’ অর্থাৎ ‘সদাচার’ ও ‘পরহেযগারি’। ইরশাদ হয়েছে-

وَ تَعَاوَنُوْا عَلَی الْبِرِّ وَ التَّقْوٰی  وَ لَا تَعَاوَنُوْا عَلَی الْاِثْمِ وَ الْعُدْوَانِ.

সৎকর্ম ও তাকওয়ায় তোমরা পরস্পর সাহায্য করবে এবং পাপ ও সীমালংঘনে একে অন্যের সাহায্য করবে না। -সূরা মায়েদা (৫) : ২

শুধু বংশ, গোত্র, দল, বন্ধুত্ব ইত্যাদি কারণে কারো অন্যায়কর্মে সহযোগিতা ইসলামে ‘আসাবিয়্যা’ বা সাম্প্রদায়িকতা নামে অভিহিত এবং সম্পূর্ণ বর্জনীয়।

এক সাহাবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন-

مَا الْعَصَبِيَّةُ؟

আসাবিয়্যা (সাম্প্রদায়িকতা) কী?

নবীজী উত্তরে বললেন-

أَنْ تُعِينَ قَوْمَكَ عَلَى الظُّلْمِ

তুমি তোমার কওমকে যুলমের ক্ষেত্রে  সাহায্য করা। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস  ৫১১৯; সুনানে কুবরা, বাইহাকী, হাদীস ২১০৭৬

আরেক হাদীসে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

لَيْسَ مِنَّا مَنْ دَعَا إِلَى عَصَبِيَّةٍ، وَلَيْسَ مِنَّا مَنْ قَاتَلَ عَلَى عَصَبِيَّةٍ، وَلَيْسَ مِنَّا مَنْ مَاتَ عَلَى عَصَبِيَّةٍ.

 সে আমাদের নয় যে আসাবিয়্যার দিকে ডাকে। সে আমাদের নয় যে আসাবিয়্যার কারণে লড়াই করে। সে আমাদের নয় যে আসাবিয়্যার উপর মৃত্যুবরণ করে। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫১২১

চার. মানবীয় সাম্য

কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-

یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ اِنَّا خَلَقْنٰكُمْ مِّنْ ذَكَرٍ وَّ اُنْثٰی وَ جَعَلْنٰكُمْ شُعُوْبًا وَّ قَبَآىِٕلَ لِتَعَارَفُوْا اِنَّ اَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللهِ اَتْقٰىكُمْ   اِنَّ اللهَ عَلِیْمٌ خَبِیْرٌ.

হে মানুষ! আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে। পরে তোমাদের বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরের সাথে পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে অধিক মুত্তাকী। নিশ্চয়ই আল্লাহ সকল কিছু জানেন; সমস্ত খবর রাখেন। -সূরা হুজুরাত (৪৯) : ১৩

হযরত আবু যর গিফারী রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

يَا أَيُّهَا النَّاسُ، أَلَا إِنَّ رَبَّكُمْ وَاحِدٌ، وَإِنَّ أَبَاكُمْ وَاحِدٌ، أَلَا لَا فَضْلَ لِعَرَبِيٍّ عَلَى عَجَمِيٍّ، وَلَا لِعَجَمِيٍّ عَلَى عَرَبِيٍّ، وَلَا أَحْمَرَ عَلَى أَسْوَدَ، وَلَا أَسْوَدَ عَلَى أَحْمَرَ، إِلَّا بِالتَّقْوَى.

 হে মানুষ! শোনো, তোমাদের রব একজন তোমাদের আব (বাবাও) একজন। শোনো কোনো আরবীর শ্রেষ্ঠত্ব নেই কোনো আজমীর উপর। আর না কোনো আজমীর শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে কোনো আরবীর উপর। না কোনো লাল বর্ণের কৃষ্ণ বর্ণের উপর আর না কৃষ্ণ বর্ণের লাল বর্ণের উপর। শ্রেষ্ঠত্ব শুধু তাকওয়ার কারণে। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৩৪৮৯; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ৪৭৭৪;

তো মানবীয় সাম্যের মূল কথাটি হচ্ছে সকল মানুষ আল্লাহর সৃষ্টি এবং সকলেই আদম-সন্তান। সুতরাং মানুষ হিসেবে কেউ কারো চেয়ে শ্রেষ্ঠ নয়। শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি তাকওয়া।

পাঁচ. শিক্ষা-দীক্ষার সর্বজনীনতা

সীরাতের নীতি ও শিক্ষার এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হচ্ছে, শিক্ষা-দীক্ষার সর্বজনীনতা। ইসলামে জ্ঞান-অর্জনের সুযোগ সবার জন্য উন্মুক্ত। তা বিশেষ কোনো গোত্র-গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের বিশেষ অধিকার নয়।

যে কোনো বংশের, যে কোনো গোত্রের, যে কোনো অঞ্চলের যে কোনো মুসলিম জ্ঞান-অর্জনে ব্রতী হতে পারেন এবং মেধা, যোগ্যতা, চেষ্টা ও সাধনার দ্বারা ইমামের মাকামে উন্নীত হতে পারেন।

ইসলামের শুভাগমনের সমসাময়িক বিশ্বে দাস-প্রথার প্রচলন ছিল। মানবসমাজে দাসশ্রেণি ছিল চরম নিগৃহীত এবং সমাজের মানবেতর জীবন যাপনকারী মানব শ্রেণি। এই ক্ষেত্রে ইসলামের সাম্য অতি অল্প সময়ে কী বিপস্নবী পরিবর্তন এনেছিল তার চিত্র পাওয়া যাবে তৎকালীন ইসলামী দুনিয়ার জ্ঞান-ইতিহাসের পাতা ওল্টালে। আরবীতে ‘মাওলা’ অর্থ আযাদকৃত দাস। জ্ঞানার্জনের উন্মুক্ত সুযোগের কারণে এই শ্রেণী একসময় সমগ্র মুসলিমজাহানের জ্ঞান কেন্দ্রগুলোর অধিপতিতে পরিণত হয়েছিল।

দ্বিতীয় হিজরী শতকের ইসলামী দুনিয়ার উপরই যদি একবার নজর বোলান এবং লক্ষ করেন কোন্ জনপদে কে ইলমের ইমাম তাহলে এই বাস্তবতা স্পষ্ট হয়ে যাবে।

মক্কা মুকাররমা থেকে শুরু করুন।

মক্কা মুকাররমায় এখন ইলমের ইমাম কে?

: আতা ইবনে আবী রাবাহ।

: তিনি ‘আরব’ না ‘মাওলা’?

: মাওলা।

: একজন মাওলা  কীভাবে আরবদের ইমাম হয়ে গেলেন?

: ইলম ও তাকওয়ার কারণে।

: ইয়ামানবাসীদের ইমাম কে?

: তাউস ইবনে কায়সান।

: তিনি আরব না মাওলা?

: ‘মাওলা’।

: তিনি কীভাবে ইমামের আসনে সমাসীন হলেন?

: যেভাবে আতা সমাসীন হয়েছেন।

: মিশরের ইমাম কে?

: ইয়াযীদ ইবনে আবী হাবীব।

: তিনি আরব না মাওলা।

: মাওলা।

: সিরিয়ার ইমাম?

: মাকহূল।

: তিনি আরব না মাওলা?

: মাওলা।

: জাযীরার ইমাম?

: মায়মুন ইবনে মেহরান।

: তিনি আরব না মাওলা?

: মাওলা।

: খোরাসানবাসীর ইমাম কে?

: যাহহাক ইবনে মুযাহিম।

: তিনি আরব না মাওলা?

: মাওলা।

: বসরার ইমাম কে?

: হাসান বসরী।

: তিনি আরব না মাওলা?

: মাওলা।

: কুফার ইমাম কে?

: ইবরাহীম নাখায়ী।

: তিনি আরব না মাওলা?

: তিনি আরব।

সুবহানাল্লাহ! এতক্ষণ পর একজন আরবের নাম এল। ঐ সময়ে আরবেরা রাজ্যশাসনে এগিয়ে ছিলেন ফলে মাওয়ালিরা এগিয়ে গিয়েছিলেন জ্ঞান- সাধনায়।

শায়খুল ইসলাম মুফতী মুহাম্মাদ তাকী উসমানী লেখেন-

كم من عبد في تاريخ الإسلام بلغ مع كونه عبدا ذروة المجد و السيادة، وكم من عبد أصبح مرجعا للأحرار في العلم والمعرفة، وكم من عبد عاش في الإسلام عيشا مغبوطا للأحرار، إن تاريخنا مفعم بهذه النماذج.

ইসলামের ইতিহাসে কত দাস উন্নীত হয়েছেন মর্যাদা ও নেতৃত্বের উচ্চ শিখরে! কত দাস পরিণত হয়েছেন আযাদ লোকেদেরও পরম সম্মানিত উস্তাযে। কত দাস যাপন করেছেন এমন কীর্তিময় জীবন, যা ছিল আযাদ লোকদের জন্যও ইর্ষণীয়। আমাদের ইতিহাস এমন সব দৃষ্টান্তে ভরপুর। -তাকমিলা ফাতহুল মুলহিম ১/১৭৬

তিনি আরও বলেছেন-

ومن الغير المسلمين قال الكاتب الفرنسي موسيو آبو : إن الاسترقاق ليس بعيب في البلاد الإسلامية، حتى إن جميع سلاطين القسطنطينية الذين كانوا أمراء المؤمنين كلهم ولدوا من بطون الجواري، … وكان أمراء مصر ربما يشترون العبيد فيعلمونهم ويربونهم ثم يزوجونهم بناتهم.

এক অমুসলিম ফরাসী লেখক বলেন, ইসলামী দেশগুলোতে ‘দাস’ হওয়া দোষের বিষয় নয়। এমনকি কনস্টান্টিনোপলের সকল সুলতান, যারা ছিলেন মুসলমানদের আমীর, দাসীর গর্ভে জন্ম লাভ করেছেন।… মিসরের আমীরেরা ‘দাস’ কিনে আনতেন এবং তাদের শিক্ষা-দীক্ষায় উন্নত করে তুলতেন এরপর নিজের কন্যাদের তাদের সাথে বিয়ে দিতেন। -তাকমিলা ফাতহুল মুলহিম ১/১৭৭

এই যে চিন্তা ও কর্মের বিল্পব এটা ছিল সীরাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অবদান। এক হাদীসে তিনি ইরশাদ করেছেন-

ثَلاَثَةٌ لَهُمْ أَجْرَانِ: رَجُلٌ مِنْ أَهْلِ الكِتَابِ، آمَنَ بِنَبِيِّهِ وَآمَنَ بِمُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، وَالعَبْدُ المَمْلُوكُ إِذَا أَدَّى حَقَّ اللَّهِ وَحَقَّ مَوَالِيهِ، وَرَجُلٌ كَانَتْ عِنْدَهُ أَمَةٌ فَأَدَّبَهَا فَأَحْسَنَ تَأْدِيبَهَا، وَعَلَّمَهَا فَأَحْسَنَ تَعْلِيمَهَا، ثُمَّ أَعْتَقَهَا فَتَزَوَّجَهَا فَلَهُ أَجْرَانِ.

তিন প্রকারের মানুষের জন্য রয়েছে দুই দুই আজর : এক. যে কিতাবী নিজের নবীর উপর ঈমান এনেছে এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপরও ঈমান এনেছে। দুই. যে দাস আল্লাহর হকও আদায় করেছে, নিজের মালিকদের হকও আদায় করেছে। আর তিন. যার কাছে একজন দাসী আছে সে তাকে উত্তম জ্ঞান ও আদব শিক্ষা দিয়েছে এরপর তাকে আযাদ করে বিয়ে করেছে তার জন্যও দুই বিনিময়। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৯৭ ; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৫৪

তাঁর শিক্ষায় অনুপ্রাণিত হয়ে সাহাবা-তাবেয়ীন তাঁদের অধীনস্তদের কীভাবে শিক্ষা-দীক্ষায় অগ্রসর করেছেন তার একটি নমুনা দেখুন-

বিখ্যাত তাবেয়ী ইমাম ইকরিমা রাহ. -যিনি ছিলেন ইবনে আব্বাস রা.-এর মাওলা বলেছেন-

طَلَبْتُ العِلْمَ أَرْبَعِيْنَ سَنَةً، وَكُنْت أُفْتِي بِالبَابِ، وَابْنُ عَبَّاسٍ فِي الدَّارِ.

)قال : و) أَنَّ ابْنَ عَبَّاسٍ، قَالَ: انْطَلِقْ، فَأَفْتِ النَّاسَ، وَأَنَا لَكَ عَوْنٌ.

আমি চল্লিশ বছর ইলম অন্বেষণ করেছি। আমি দরজায় বসে ফতোয়া দিতাম আর ইবনে আবক্ষাস রা. ঘরে থাকতেন। ইবনে আবক্ষাস রা. আমাকে বলেছেন, যাও, মানুষকে দ্বীনের বিষয়ে ফতোয়া দাও আর আমি তোমার সহযোগিতাকারী। -সিয়ারু আলামিন নুবালা : ৫/৫০৫

ছয়. কর্মের দ্বারাই মর্যাদা

শুধু ইলমের ক্ষেত্রে নয় জীবনের সকল ক্ষেত্রে ইসলাম এই নীতি প্রতিষ্ঠা করেছে যে, মানুষের মর্যাদা তার নিজ কর্ম ও যোগ্যতার দ্বারা, নিছক বংশ ও কৌলিন্যের দ্বারা নয়।

হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

مَنْ بَطَّأَ بِهِ عَمَلُهُ، لَمْ يُسْرِعْ بِهِ نَسَبُهُ

যার কর্ম তাকে পিছনে নিয়ে যায়, কৌলিন্য তাকে এগিয়ে নিতে পারে না। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬৯৯; মুসনাদে আহমাদ ২/২৫২, হাদীস ৭৪২৭

আপন কর্ম ও যোগ্যতার দ্বারা সমাজে যার যে অবস্থান তাকে ঐ অবস্থানেই রাখতে হবে। নতুবা তা হবে যুলুম।

আয়েশা রা. বর্ণনা করেছেন-

أَمَرَنَا رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنْ نُنَزِّلَ النَّاسَ مَنَازِلَهُمْ.

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আদেশ করেছেন, আমরা যেন প্রত্যেক মানুষকে স্বস্থানে রাখি। (মুকাদ্দিমাতু মুসলিম)

সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রাহ. তাঁর জগদ্বিখ্যাত ماذا خسر العالم بانحطاط المسلمين  গ্রন্থে বলেন-

‘‘হাবসী দাস বেলাল, যার কোন মূল্য ছিল না; এমনকি বেচাকেনার বাজারেও। গুণ ও যোগ্যতায় এবং সততা ও ধার্মিকতায় তিনি এমন উচ্চস্তরে উপনীত হলেন যে, আমীরুল মুমিনীন ওমর ইবনুল খাত্তাব পর্যন্ত তাকে বলতেন, সায়্যিদুনা বিলাল!

আবু হুজায়ফা রা.-এর আযাদকৃত গোলাম সালিম, আরব জাহিলিয়াতে যার আলাদা কোন পরিচয় ছিল না; ইসলাম তাঁকে এমনই অত্যুচ্চ মর্যাদায় অভিষিক্ত করল যে, খলীফা ওমর রা. তাঁকে খেলাফতের গুরু দায়িত্ব বহনেরও উপযুক্ত মনে করেছেন, তিনি বলেছেন, আবু হুজায়ফার আযাদকৃত গোলাম সালিম যদি বেঁচে থাকতো, তাকে আমার স্থলাভিষিক্ত করে যেতাম।

যায়েদ ইবনে হারেছা, যিনি লুণ্ঠিত কাফেলা থেকে দাস-বাজারে  গিয়ে বিক্রি হয়েছেন, মুতার যুদ্ধে ছিলেন মুসলিম বাহিনীর সেনাপতি, যেখানে ছিলেন জাফর বিন আবু তালিব ও খালিদ ইবনে ওয়ালিদের মত অভিজাত কোরাইশ বীর; আর তাঁর পুত্র উসামা ছিলেন সেই বাহিনীর প্রধান, যাতে ছিলেন হযরত আবু বকর ও ওমরের মত সাহাবী।’’ -মা যা খাসিরাল আলামু বিনহিতাতিল মুসলিমীন, অনুবাদ : মাওলানা আবু তাহের মেছবাহ, পৃ. ২০১-২০২

জুমাদাল উলা ১৪৩৮ – ফেব্রুয়ারি ২০১৭

মাসিক আলকাউসার