আল মামুন আব্দুল্লাহ আবুল আব্বাস

মামুন আব্দুল্লাহ আবুল আব্বাস বিন হারুন রশীদ ১৭০ হিজরীর রবিউল আউয়াল মাসের মাঝামাঝিতে জুমআর রাতে যেদিন হাদীর ইন্তেকাল হয় সেদিন জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আমীনের পর তাকে উত্তরাধিকার মনোনীত করেন। তার মাতার নাম মারাজিল,যিনি বাদী ছিলেন। তিনি সন্তান প্রসবের চল্লিশ দিনের মধ্যেই মারা যান।

মামুন বাল্যকালে ইলম অর্জন করেন। তিনি তার পিতা,হাশিম,উবাদা বিন আওয়াম,ইউসুফ বিন আতীয়া আবু মুআবিয়া আল যরীর,ইসমাঈল বিন উলীয়া,হাজ্জাজ আউর থেকে হাদীস শ্রবণ করেন। ইয়াযিদীর কাছে ভাষা-সাহিত্য চর্চা করেন। দূর-দূরান্ত থেকে ফিকাহবিদদের সমবেত করে ফিকাহ,আরবী ও ইতিহাসে পান্ডিত্য অর্জন করেন। পরিণত বয়সে তিনি দর্শন ও উলুমুল আওয়ায়েল (সূচনা সংক্রান্ত বিদ্যা) অর্জন করেন আর তা নিয়ে ব্যাপক গবেষণা ও চর্চা করার কারণে তিনি খলকে কুরআনে বিশ্বাসীতে পরিণত হোন। তার থেকে তার ছেলে ফজল,ইয়াহইয়া বিন আকতাম, জাফর বিন আবু উসমান আল তায়ালাসী,আমীর আব্দুল্লাহ বিন তাহের,আহমাদ বিন হারেস শায়আ,ওয়ায়েল খাযায়ীসহ অনেক লোক হাদীস বর্ণনা করেন।

তিনি বনূ আব্বাস বংশে অধ্যবসায়,দৃঢ়তা,সংকল্প,নম্রতা,জ্ঞান,বিচার,বুদ্ধিমত্তা,আকস্মিকতা,বীরত্ব ও নেতৃত্বের দিক থেকে সবার বড়। তার মধ্যে বহু নেক গুণাবলীর সমাবেশ ছিল। এর মধ্যে কারো কোন প্রকার সন্দেহ নেই যে,বনূ আব্বাস খান্দানে তিনি সবচেয়ে বড় আলেম। তিনি উচুঁ মাপের বাগ্নী আর ভাষাবিদ। তার বিখ্যাত উক্তি হলো – “মুআবিয়ার,উমরের আর আব্দুল মালিকের হাজ্জাজের প্রয়োজন ছিলো। আর আমার কারো প্রয়োজন নেই।”

বর্ণিত রয়েছেঃ বনূ আব্বাসের প্রথম খলীফা সাফফাহ,মধ্যবর্তী খলীফা মামুন আর শেষ খলীফা মুতাযদ।

কথিত আছে,কোন কোন রমযানে তিনি ৩৩ বার কুরআন শরীফ খতম করতেন। তার ব্যাপারে এ কথা প্রসিদ্ধ যে, তিনি ছিলেন শীআ। যারা এ মত প্রকাশ করেছে তাদের দলিল হলো,তিনি নিজের ভাই মুতামানকে উত্তরাধিকারের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে ইমাম আলী রেযাকে উত্তরাধিকার মনোনীত করেন।

আবু মুশার আল মাজাম বলেছেন,“মামুন ন্যায়বিচারক এবং প্রশাসকদের ইনসাফের প্রতি তাকীদ দিতেন। তিনি ফিকাহ শাস্ত্রে এতোই বিজ্ঞ ছিলেন যে,তাকে বড় আলেমদের মধ্যে গন্য করা হয়।”

হারূন রশীদ থেকে বর্ণিত তিনি বলেন,“মামুনের মনসুরের মতো দৃঢ়তর সংকল্প,মাহদীর মত বদান্যতা আর হাদীর মত মর্যাদাবোধ ছিল। আমি ইচ্ছে করলে তাকে আমার পর স্থান করে দিতে পারতাম। আমীন প্রবৃত্তি তাড়িত ব্যক্তি। সে অপচয়,বাঁদি ও নারীদের সাথে যুক্ত – এ কারণে মামুন তার  চেয়ে অগ্রগামী। যদিও তার মান বনূ হাশিম বংশোদ্ভূত, এছাড়া সব বিষয়ে মামুন অগ্রজ।

১৯৮ হিজরীতে আমীন নিহত হওয়ার পর মানুন আবূ জাফর উপাধি ধারণ করে খলীফা হোন।

সূলী বলেছেনঃ এ উপাধি মামুনের খুব প্রিয় ছিল, কারণ মানসুরের এ উপাধি ছিল। আর তিনি হলেন অত্যন্ত প্রতাপান্বিত বাদশাহ। এ উপাধি ধারনকারী বাদশাহগণ দীর্ঘ জীবন পেয়েছিলেন, যেমন মানসুর ও হারূন রশীদ।

২০১ হিজরীতে মামুন নিজ ভাই মুতামিনকে বঞ্চিত করে তদস্থলে আলী রেযা মূসা আল কাযিম বিন জাফর সাদিককে উত্তরাধিকার মনোনীত করেন। লোকেরা এ কাজ তার শীআ হওয়ার দলিল হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। এমনকি তারা এ কথাও বলে যে,মামুন নিজেই নিজেকে বঞ্চিত করে খিলাফতের দায়িত্ব আলী রেযার উপর অর্পণ করতে চেয়েছিলেন। তিনি তাকে রেযা উপাধিতে ভূষিত করেন। তার নাম ধারণের জন্য শাস্তি দেন। নিজের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেন। গোটা সাম্রাজ্যে তার নাম ঘোষণা করেন। তিনি কালো কাপড় পরতে নিষেধ করে সবুজ কাপড় পরার হুকুম জারি করেন। এ নির্দেশে বনূ আব্বাস অসন্তুষ্ট হয়ে ইবরাহীম বিন মাহদীর কাছে বাইআত করে মামুনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। বনূ আব্বাস সে সময় ইবরাহীম বিন মাহদীকে মুবারক উপাধিতে ভূষিত করে। মামুন তার সাথে মোকাবিলা করেন। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মামুন ইরাক সফরে গেলে ২০৩ হিজরীতে আলী রেযা পরলোক গমন করে। এরপর মামুন বাগদাদবাসীকে এ চিঠি লিখে পাঠান – আলী রেযার মৃত্যু হওয়ায় তোমরা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির সুযোগ পেয়েছো। জবাবে বাগদাদবাসী লিখলো – মামুনকে তারা অত্যন্ত জঘন্য মনে করে। এরপর তারা সহজে ইবরাহীমকে সহযোগিতা করতে লাগলো। ফলে ইবরাহীম প্রায় দুই বছর শেষে যিলহাজ্জ মাসে আত্নগোপন করেন। আট বছর তিনি আত্নগোপন করে ছিলেন।

২০৪ হিজরীর সফর মাসে মামুন বাগদাদে ফিরে আসেন। তখন বনূ আব্বাসসহ অন্যান্য লোকেরা সবুজ কাপড় ছেড়ে কালো কাপড় পরতে আরম্ভ করে। প্রথমে মামুন এ বিষয়টিকে ভিন্ন চোখে দেখলেও পরবর্তীতে তা মানিয়ে নেন।

সূলী বলেছেনঃ মামুনের পরিবারের কিছু লোক তাকে বললো,“আপনি আলী বিন আবু তালিবের সন্তানদের সাথে সৎ আচরণ করতে চাইলে তাদের উপ খিলাফতের দায়িত্ব অর্পণ করলে কিভাবে আপনি এ কাজ পরিচালনা করবেন ? সুতরাং খিলাফত আপনার হাতে থাকা পর্যন্ত আপনি শক্তিধর। তাদের হাতে চলে গেলে আপনি আর কিছুই করতে পারবেন না।” মামুন জবাবে বললেন,“আমি তা এ জন্যই করছি যে,আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) খলীফা হওয়ার পর হাশেমী লোককে উত্তরাধিকার মনোনীত করেননি। এভাবে উমর (রাঃ) আর উসমান (রাঃ) কেন হাশেমীকে খিলাফতের কোন দায়িত্ব দেননি। খলীফা হওয়ার পর আলী (রাঃ) আব্দুল্লাহ বিন আব্বাসকে বসরায়,উবায়দুল্লাহকে ইয়ামানে, মাবাদকে মক্কায় আর কাসামকে বাহরাইনে প্রশাসক নিয়োগ করেন;বরং প্রত্যেক ব্যক্তিই কোন না কোনভাবে পদমর্যাদাসম্পন্ন অফিসার নিয়োগ করেছেন। এ প্রক্রিয়ায় অংশ হিসেবে আমি তার আওলাদদের তা প্রদান করতে চাই।”

২১০ হিজরীতে মামুন বোরান বিনতে হুসাইন বিন সহলকে বিয়ে করেন। এতে সহস্রাধিক সম্পদ মামুনকে দেয়া হয়। বোরানের বাবা ছিলেন মহানুভব দাতা। তিনি সকল নেতাদের উপঢৌকন দেন আর সতেরো দিন দাওয়াত খাওয়ান। তিনি অনেক স্লিপ লিখেন, প্রত্যেক স্লিপে কোন না কোন জায়গীরের (জমিদার কর্তৃক প্রাপ্ত জমি) কথা উল্লেখ ছিল। স্লিপগুলো বনূ আব্বাস এবং আমন্ত্রিক নেতাদের বন্টন করে দেয়া হয়। যে স্লিপ যার কাছে যায়, তাকেই সেই জায়গীর প্রদান করা হয়। যাওয়ার সময় সোনা ও মুক্তভর্তি অনেকগুলো থলে এনে মামুনকে দেওয়া হয়।

২১১ হিজরীতে মামুন ঘোষণা করে,যে মুয়াবিয়া (রাঃ) এর গুণবলী আলোচনা করবে, আমি তার নিরাপত্তা থেকে দূরে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর সর্বোত্তম ব্যক্তি হলেন আলী (রাঃ)।

২১২ হিজরীতে সে খলকে কুরআনের মাসআলা ইলান করে। আর সে আবু বকর (রাঃ) ও উমর (রা;) এর উপর হযরত আলী (রাঃ) এর মর্যাদার কথা ঘোষণা করে। এতে করে তার প্রতি লোকদের ঘৃণা জন্ম নেয়। অধিকাংশ শহরে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। কেউ তার এ আকীদা গ্রহণ না করায় ২১৮ হিজরীতে মামুন অপারগ হয়ে নিজের প্রচারিত মতবাদ থেকে নিজেই ফিরে আসে।

২১৫ হিজরীতে যুদ্ধ করতে রোম যাত্রা করেন। সেখানে কুরা আর মাজেদা নামক দূর্গদ্বয় যুদ্ধ করে জয় করেন। এরপর দামেশক ফিরে আসেন।

২১৬ হিজরীতে আবার রোমে গিয়ে কিছু দূর্গ জয় করে দামেশক প্রত্যাবর্তন করেন। দামেশক থেকে মিসরে যান। আব্বাসীয় কোন বাদশাহর এটাই প্রথম মিসর সফর।

২১৭ হিজরীতে মিসর থেকে এসে আবার রোম গমন করেন।

২১৮ হিজরীতে খলকে কুরআনের মাসয়ালা সম্পর্কে লোকদের পরীক্ষা করেন। বাগদাদ সাম্রাজ্যের নায়েব তাহের বিন হুসাইনের চাচাতো ভাই ইসহাক বিন ইবরাহীম খাযায়ী বাগদাদের আধ্যাত্মিক ওলামাদের কাছে এ মর্মে পত্র লিখেন যে – আমিরুল মুমিনীন অনেক মর্যাদাবান, আর ব্যক্তিবর্গ এমনকি আলেম থেকে জাহেল পর্যন্ত যাদের দ্বীনের কোন জ্ঞান নেই,যাদের অন্তরের ইলমের আলো নেই,যাদের কাছে কোন দলিল নেই – তাদের ব্যাপারেও অবগত আছেন। আল্লাহ তাআলার মারিফাতে যারা মূর্খ,অন্ধ আর গোমরাহ,যারা দ্বীনের গূঢ় রহস্য জানে না,আল্লাহ তাআলাকে সঠিকভাবে চেনে না,যারা হাকিকত-মারিফত বুঝে না,তার সৃষ্টি জগতের পার্থক্য করতে পারে না, তারা আল্লাহ তাআলা,তার মাখলুক আর যা কিছু কুরআন শরীফে অবতীর্ণ হয়েছে সবগুলোকে একই সমান মনে করে। এ কারণে লোকদের ধারণা – কুরআন শরীফ পুরাতন বা সেকেলে, আল্লাহ তাআলা তাকে সৃষ্টি করেননি। অথচ আল্লাহ তাআলা বলেছেন –

إِنَّا جَعَلْنَاهُ قُرْآنًا عَرَبِيًّا

“আমি কুরআন শরীফকে আরবী বানিয়েছি ….” (সূরাহ আয-যুখরুফ, ৪৩ : ৩)

বুঝা গেলো, যাকে বানানো হয় সে মাখলুক। অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে –

نَقُصُّ عَلَيْكَ مِنْ أَنبَاءِ مَا قَدْ سَبَقَ

“আমি পূর্বে যা ঘটেছে, তার সংবাদ আপনার কাছে বর্ণনা করি …” (সূরাহ ত্বহা, ২০ : ৯৯)

আবার, ইরশাদ হচ্ছে –

وَجَعَلَ الظُّلُمَاتِ وَالنُّورَ

“আর অন্ধকার ও আলো সৃষ্টি করেছেন।” (সূরাহ আল-আনআম, ৬ : ১)

এ দ্বারা স্পষ্ট হয় যে,আল্লাহ তাআলা অনেক বিষয়ে বিশদ বিবরণ দিয়েছেন। ইরশাদ হচ্ছে –

أُحْكِمَتْ آيَاتُهُ ثُمَّ فُصِّلَتْ

“… যার আয়াতসমূহ খুবই সুস্পষ্ট (ও সুবিন্যস্ত) করে রাখা হয়েছে, এরপর (এর বর্ণনাসমূহও এখানে) বিশদভাবে বলে দেওয়া হয়েছে …” (সূরাহ হুদ, ১১ : ১)

এ থেকে প্রতিভাত হয় যে,আল্লাহ তাআলা কুরআনকে আহকাম আর বিস্তারিত করে বানিয়েছেন। তিনিই খালিক বা সৃষ্টিকর্তা। এরপরও তারা নিজেদের সুন্নতের দাবীদার হিসেবে জাহির করে এবং নিজেদের আহলুল হক ওয়াল জামাআত নাম রাখে। যারা তাদের আকীদা বিশ্বাস করে না, তারা তাদেরকে আহলে বাতেল ওয়াল কুফর বলে। এ বিষয়ে তারা সীমালঙ্ঘন করে এবং জাহেলদের ধোঁকার মধ্যে ফেলে, এমনকি পরহেযগার লোকেরাও তাদের প্রতি ঝুঁকে পড়ছে আর সত্য থেকে মিথ্যার দিকে চলে যাচ্ছে। তারা নিজের গোমরাহীর কারণে নিজের মতো করে আল্লাহর ইবাদত করছে। আমিরুল মুমিনীনের দৃষ্টিতে বজ্জাত আর জঘন্য ওরা,যারা তাওহীদ থেকে সরে যায়। যারা তাওহীদের মধ্যে কমি করবে সে জাহেল। আর যে তাওহীদের মিথ্যা প্রচার করবে সে শয়তান। শয়তান তার বন্ধুর মুখ দিয়ে কথা বলে, আর শত্রু অর্থাৎ আল্লাহর খাস বান্দাদের ভয় করে। ওদের (শয়তানের বন্ধুদের) সত্য কথারও কোন মূল্য নেই। তাদের সাক্ষ্য পরিত্যাজ্য,কারণ যে তাওহীদের বিষয়ে অন্ধ, তার চেয়ে বড় অন্ধ এবং পথভ্রষ্ট আর কে হতে পারে!

আমিরুল মুমিনীনের কসম,সবচেয়ে মিথ্যাবাদী লোক সেই ব্যক্তি, যে আল্লাহ এবং তার ওহীকে মিথ্যা জ্ঞান করে,বাতিলের সঙ্গ দেয় দেয় আর আল্লাহ তাআলাকে সঠিকভাবে চেনে না। অতএব সকল কাযীকে সমবেত করে আমার পত্রখানা তাদের সামনে পড়া হবে। তারা কিছু বললে তাদেরও পরীক্ষা নেওয়া হবে। সৃষ্টিজগৎ আর কুরআনের জন্ম সম্পর্কিত তাদের বিশ্বাস সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে। তাদের বলা হবে,যে ব্যক্তি দীনের উপর অটল নয়, তার প্রতি কখনই ভরসা করা হবে না। কোন কাজে তাকে সাহায্য করা হবে না। আর যদি সে এ মাসয়ালাকে স্বীকৃতি দেয়, তবুও তার জন্য কুরআনের জ্ঞানসমৃদ্ধ ব্যক্তিদের উপস্থিতি আর তাদের সাক্ষ্য প্রয়োজন হবে। যারা এ মাসয়ালাকে স্বীকৃতি দিবে না, তাদের কোন সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়। এ বিষয়ে তাদের মতামত লিপিবদ্ধ করার জন্য সংশ্লিষ্ট কাযীদ্র নির্দেশ প্রদান করেছি।

মামুন প্ত্রটি যে সাতজনের কাছে পাঠিয়ে তাদের ডেকে পাঠান, তারা হলেন – ওকেদীর লেখক মুহাম্মাদ বিন সাদ, ইয়াহইয়া বিন মঈন,আবু খায়সামা (যাহীর বিন হরব – অনুবাদক),আবু মুসলিম মুসতামালা, ইয়াযিদ বিন হারুন,ইসমাঈল বিন দাউদ,ইসমাঈল বিন আবু মাসউদ আর আহমাদ বিন ইবরাহীম দুরকী। তারা এলে খলকে কুরআন সম্পর্কে তাদের পরীক্ষা করা হয়। তাদের ভূমিকা অপরিবর্তনীয় থাকায় তাদের জণ্য বাগদাদের পথ রুদ্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে দুঃখ-দুর্দশা থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্য তারা তা কবুল করেন।

এরপর মামুন ইসহাক বিন ইবরাহীমকে পত্র মারফত জানালেন যে,তুমি মুফতী আর আলেমদের একত্রিত করে জানিয়ে দাও,উপরিউক্ত সাতজন খলকে কুরআনের আকীদা মেনে নিয়েছেন। ইসহাক সেটাই করলেন। কিছু লোক কথাটি বিশ্বাস করলো, আবার অধিকাংশরা তা প্রত্যাখ্যান করলো।

পুনরায় মামুন ইসহাককে পত্র লিখে নির্দেশ দিলেন – যারা এ আকীদা প্রত্যাখ্যান করেছে, তাদের একত্রিত করে ভালোভাবে জেনে নাও। ইসহাক তাদের ডাকলেন। ইয়াহইয়া বিন মুঈন বলেন,তলোয়ারের জোরে আমরা এ আকীদা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছি।

ইসহাকের ডাকে ইমাম আহমদ বিন হাম্বল,বশর বিন ওলীদ কিন্দী,আবু হাসান যিয়াদী,আলী বিন আবু মুকাতিল,ফজল বিন গানিম,উবায়দুল্লাহ বিন উমর কাওয়ারেরী,আলী বিন জাআদা,সুজাদা যিয়াল বিন হাশিম,কায়তাবা বিন সাঈদ,ইসহাক বিন ঈসরাঈল, ইবনে হরশ,ইবনে উলীয়া আল আকবর,মুহাম্মাদ বিন নূহ আল আজলী, ইয়াহইয়া বিন আব্দুর রহমান উমরী,বাবু নসর তামার,আবু মুআম্মার কতীয়ী,মুহাম্মাদ বিন হাতিম বিন মাইমুন,সাদ প্রমুখ সমবেত  হলে ইসহাক মামুনের পত্রটি পড়ে শোনান। শোনার পর তারা মাথা নিচে করে ফেলেন, কোন উত্তর দিলেন না, বরং ভাসা ভাসা কিছু কথা বললেন। অবশেষে ইসহাক বশর বিন ওলীদকে বললেন,“আপনার অভিমত কি ?” তিনি বললেন,“আমি আমিরুল মুমিনীনকে বলবো।” ইসহাক বললেন, “আমিরুল মুমিনীন একে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তার ফরমানকে মান্য করা জরুরি।” তিনি বললেন, “আমার মতামত হলো,কুরআন শরীফ আল্লাহ তাআলার কালাম।” ইসহাক বললেন,“আমি আপনাকে এটা প্রশ্ন করিনি;বরং আমি জিজ্ঞেস করছি – আপনি কুরআন শরীফকে মাখলুক বলেন কিনা ?” তিনি বললেন, “আমি যা বলেছি এর চেয়ে বেশী কিছু বলা শোভন মনে করি না। আমি আমিরুল মুমিনীনের নিকট শপথ করেছি যে,এ মাসয়ালা সম্বন্ধে অগ্রিম কিছু বলবো না।”

এরপর ইসহাক আলী বিন আবূ মুকাতিলের মতামত জানোতে চাইলেন। তিনি বললেন,“কুরআন শরীফ আল্লাহর বাণী। যদি আমিরুল মুমিনীন কিছু বলেন, তবে আমরা শুনবো আর তার আনুগত্য করবো।” ফের আবু হাসান যিয়াদীকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনিও একই উত্তর দিলেন। তারপর হযরত ইমাম আহমাদ বিন হাম্বলকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন,“কুরআন আল্লাহর কালাম।” ইসহাক বললেন, “কুরআন মাখলুক কিনা ?” তিনি বললেন,“এটা আল্লাহর কালাম -এর চেয়ে বেশী কিছু বলতে পারবো না।” এরপর অবশিষ্টদের যাচাই করা হয়। অবশেষে ইবনে বাকা আল আকবার বললেন,“কুরআন শরীফ বানানো (তৈরি বা সৃষ্টি করা) হয়েছে। কুরআন মুহদিস। কারন এ ব্যাপারে কুরআনিক দলিল রয়েছে।” ইসহাক বললেন, “যাকে বানানো হয়, সে-ই তো মাখলুক।” ইবনে বাকা আল-আকবার বললেন,“জ্বি।” ইসহাক বললেন,“তাহলে কি কুরআন শরীফও মাখলুক ?” ইবনে বাকা আল আকবার বললেন,“আমি কুরআনকে মাখলুক বলবো না।”

ইসহাক আলোচনার বিস্তারিত বিবরণ লিখে খলীফা মামুনের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। জবাবে মামুন দীর্ঘ চিঠি লিখে ইসহাকে কাছে পাঠালেন। তিনি লিখেছিলেন – তোমার পত্র পড়েছি। যারা নিজদের আহলে কিবলা আর শাসকগোষ্ঠী বলে দাবী করছেন, তারা মূলত আহলে কিবলা আর শাসকগোষ্ঠী নয়। যারা খলকে কুরআনে বিশ্বাসী নয়, তাদেরকে ফতোয়া দেওয়া,হাদীস বর্ণনা করা আর কুরআন শিক্ষা দেয়া থেকে বিরত রাখবে। বশর মিথ্যা বলেছে,আমিরুল মুমিনীনের সাথে তার কোন কসমের মোয়ামেলা নেই। আমিরুল মুমিনীনের বিশ্বাস,নিষ্ঠা ও বানী হলো – কুরআন মাখলুক। যা তাকে বলা হয়েছে। যদি সে তাওবা করে, তবে তা ঘোষণা করবে। নাহলে তাকে হত্যা করে তার মাথা আমার কাছে পাঠিয়ে দিবে।

ইবরাহীম বিন মাহদীকে আবার বলো,যদি সে তা গ্রহণ করে তবে ভালো, নাহলে তার গর্দানও উড়িয়ে দাও। আলী বিন আবূ মুকাতিলকে বলো,সে কি আমিরুল মুমিনীনকে বলেনি – আপনিই হালাল হারাম করবেন। যিয়ালকে বলো,শহরে লুটতরাজের অপরাধই তোমার জন্য যথেষ্ট। আহমাদ বিন ইয়াযিদ আর আবুল আওয়ামের কুরআন সম্পর্কিত জবাব সন্তোষজনক নয়। তারা বয়সে বৃদ্ধ হলেও বুদ্ধির দিক থেকে শিশু আর মূর্খ। তাদের আবার জিজ্ঞেস করো। যদি তারা নিজ অবস্থানে অটল থাকে, তাহলে ঘোষণা দিয়ে তলোয়ার দ্বারা তাদের মোকাবিলা করবে। আহমদ ইবন হাম্বলকে বলো,আমিরুল মুমিনীন আপনার জবাবের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছেন আর আপনার মূর্খতাকে দলিল হিসেবে গ্রহণ করেছেন। ফজল বিন গানিমকে জানিয়ে দিবে,মিসরে সে যা করেছে,আমিরুল মুমিনীনের তা অজানা নয়। অর্থাৎ মিসরে অল্প সময়ের জন্য কাযী থাকা অবস্থায় তিনি অনেক সম্পদ অর্জন করেছেন। যিয়াদীকে বলবে,তুমি মিথ্যা বলেছো। আবু নসরকে বলো,তার ব্যবসার ব্যাপারে আমিরুল মুমিনীনের আগে থেকেই সন্দেহ ছিল। ইবনে নূহ আর ইবনে হাতিমকে জানিয়ে দিবে,সুদ খেতে খেতে তাওহীদের জ্ঞান তাদের লোপ প্যেছে। সুদ খাওয়ার কারণে আমিরুল মুমিনীন তোমাদের সঙ্গে লড়াই করবেন। ইবনে শুজাকে বলো,আমীরের সম্পদ আলী বিন হিশামের জণ্য বৈধ,যা তুমি গ্রাস করেছো। সাদকে বলবে,যে রাজত্বের লোভ করে, আল্লাহ তাআলা তাকে এতটুকুও দিবেন না। সাজাদাহকে জানিয়ে দাও,তুমি এ বিষয়টি অস্বীকার করবে যে,তোমার পাশে যে আলেমরা থাকেন, তাদের কাছ থেকে কুরআন মাখলুক -এ কথাটি শোননি? আলী বিন ইয়াহইয়ার আমানতদারী ঠিক করতে গিয়ে সে তাওহীদের কথা ভুলে গেছে। কাওয়ায়েরীর জানা আছে যে,আমি তার রাজস্ব আদায়ের ব্যাপারে অবগত। তুমি আবার তাদেরকে জিজ্ঞেস করো। মানলে তা ঘোষনা করে দাও, নাহলে তাদের বেঁধে আমিরুল মুমিনীনের সৈনিকদের কাছে পাঠিয়ে দাও। তারা তাদের জিজ্ঞেসবাদ করবে। তারপরও না মানলে তলোয়ার দিয়ে তাদের গর্দান উড়িয়ে দেওয়া হবে।

এ ফরমান শুনে ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল,সাজাদাহ,মুহাম্মাদ বিন নূহ আর কাওয়ারেরীর ছাড়া সকলেই খলকে কুরআনের আকীদা গ্রহণ করে নেয়। ইসহাক এ চার জনকে বন্দী করে। পরদিন সে জেলখানায় গিয়ে এ আকীদা সম্পর্কে তাদের আবার জিজ্ঞেস করে। সাজাদাহ আর কাওয়ারেরী চাপের মুখে নতি স্বীকার করেন এবং এ আকীদা মেনে নেন। এরপর ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল আর মুহাম্মাদ বিন নূহকে রোমে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এদিকে মামুন জানোতে পান যে,সকলেই জেদাজেদীর কারণে এ মতাদর্শ গ্রহণ করেছে। এ কথা শুনে তিনি ক্রোধান্বিত হয়ে এ আদেশ লিখে পাঠালেন – সবাইকে বন্দী করে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও। ইসহাক সকলকেই পাঠিয়ে দিলো,কিন্তু তারা গিয়ে না পৌঁছুতেই মামুন পরলোক গমন করে। আল্লাহ তাআলা তাদের উপর রহম করলেন।

মামুন রোগে অসুস্থ হয়ে পড়ে। রোগের পীড়া তীব্রতর হলে সে পুত্র আব্বাসকে ডেকে পাঠায়। তার ধারণা ছিল, আব্বাস আসার আগেই সে ইন্তেকাল করবে। কিন্তু মামুনের মুমূর্ষু অবস্থায় আব্বাস এসে পৌঁছে। তবে এর আগেই বিভিন্ন শহরে, নগরের জনপদে পত্র পাঠিয়ে দেওয়া হয়। যার উপরাংশে লিখা ছিল – এ পত্র মামুন আর তার ভাই আবু ইসহাকের পক্ষ থেক,যিনি মামুনের পর খলীফা হবেন। কথিত আছে,এ পত্রটি আমিরুল মুমিনীনের পক্ষ থেকে লিখা হয়েছিলো। আবার কেউ কেউ বলেন,মামুন জ্ঞান হারিয়ে ফেলার পর এ পত্রটি লিখা হয়।

২১৮ হিজরীর রযব মাসের ১৮ তারিখ বৃহস্পতিবারে রোমের বাযনাদুন অঞ্চলে ইন্তেকাল করে। তাকে তারতুসে দাফন করা হয়।

মাসউদী বলেছেন,বাযনাদুন ঝর্ণার পাদদেশে মামুন তাঁবু স্থাপন করেন। এলাকাটি শীতল,পরিচ্ছন্ন,সবুজ ও মনোরম হওয়ায় তিনি তা পছন্দ করেছিলেন। হঠাৎ পাশের ঝর্ণায় চাঁদীর মত চকচকে একটি মাছ দেখা গেলো। মামুন এতে আশ্চর্য হয়ে মাছটি ধরার নির্দেশ দিলো। কিন্তু ঝর্ণার পানি খুবই ঠান্ডা হওয়ার কারণে কেউ পা দিতে সাহস করলো না। মামুন মাছটি ধরার জন্য একটি তলোয়ার পুরস্কার ঘোষণা করলে ফারাশ নামক একজন ঝর্ণায় নেমে মাছটি ধরে কিনারায় নিয়ে এলে লাফ দিয়ে তা পানিতে পড়ে যায়। ফারাশ আবার ঝর্নায় নেমে মাছটি ধরে আনে। মামুন একে কাবাব বানানোর নির্দেশ দিলো। কাবাব তৈরি না হতেই মামুনকে দারুণ ঠান্ডায় পেয়ে বসে। সে কাঁপতে থাকে। ফলে লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে যায়। এরপরও কম্পন থামে না। সে অসম্ভব রকম কাঁপতেই থাকে। এতে করে তার দাঁতে দাঁতে সংঘর্ষ হতে থাকে। চারদিকে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। মাছটি কাবাব হয়ে আসে। কিন্তু মামুন তা একটুও চাখতে পারলো না। মৃত্যু এসে তাকে পরপারে নিয়ে গেলো। এর মধ্যে সে অল্পক্ষণের জন্য কিছুটা সুস্থতা বোধ করলে বাযনাদুনের অর্থ জানোতে চাইলেন। একজন বললো,পা ফেলাকে বাযনাদুন বলা হয়। এরপর সে এর পার্শ্ববর্তী বনাঞ্চলের নাম জিজ্ঞেস করলো। বলা হলো,এর নাম রোকা। মামুনের জন্মের সময় যে ভবিষ্যবানী করা হয়েছিলো, তাতে লিখা ছিল সে রোকায় মারা যাবে। সে রোকার কথা শুনে নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে। সেই সময় সে এ দুয়া করে -“হে জগতের প্রতিপালক, হে সেই পবিত্র সত্তা – যার রাজত্ব কোন দিন ধ্বংস হবে না, এ বান্দার প্রতি রহম করুন,যার রাজত্ব ধ্বংস হয়ে যাবে।”

সালাবী বলেছেনঃ মামুন ও তার পিতা হারুন রশিদের কবর (রাজধানী থেকে) যত দূরে, আমার দৃষ্টিতে খলীদাদের মধ্যে কোন পিতা-পুত্রের কবর এত দূরে নয়। বনূ আব্বাসের পাঁচ জনের কবর অনেক দূরে,তারা হলেন – আব্দুল্লাহ তায়েফে,উবায়দুল্লাহ মদীনায়,ফজল সিরিয়ায়,কাসাম সমরকন্দে আর মাবাদ আফ্রিকায়।

 

বিভিন্ন ঘটনাবলী

লাফযূয়া বলেছেন যে, হামেদ বিন আব্বাস বিন উযীর আমার কাছে বর্ণনা করেছেনঃ একদিন আমি মামুনের কাছে বসেছিলাম। মামুন হাঁচি দিলেন, আমি আলহামদুলিল্লাহ’র জবাব দিলাম না। মামুন এর কারণ জানোতে চাইলেন। আমি বললাম,“হে আমিরুল মুমিনীন, আমি আভিজাত্য বজায় রাখার জন্য বলিনি।” তিনি বললেন,“আমি সে রকম বাসশাহ নই, যারা দুয়াকে পরোয়া করে না।”

আবু মুহাম্মাদ ইয়াযিদী থেকে ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেনঃ আমি মামুনকে শৈশবকালে শিক্ষাদান করেছি। একদিন যথারীতি আমি এলাম, কিন্তু মামুন অন্দর থেকে বের হলো না। আমি পরপর দু’জন খাদেমকে ডাকতে পাঠালাম। এরপরও সে এলো না। আমি বললাম,“সে নিজের সময়গুলো নষ্ট করছে।” এ কথা শুনে খাদেমরা বললো,“আপনি যাওয়ার পর শাহজাদা খাদেমদের যথেচ্ছা ব্যবহার করে এবং তাদের প্রহার করে। আজ তাকে হাল্কা শাসন করবেন।” এমন সময় মামুন এলো,আমি তাকে সাতটি বেত্রাঘাত করলাম। মামুন কাঁদতে লাগলো। এমন সময় জাফর বিন ইয়াহইয়া বরমক্কী এসে পড়লেন। শাহজাদা রুমাল দিয়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে কার্পেটের উপর দিয়ে বসলো আর জাফরকে ডেকে নিলেন। আমি উঠে বাইরে গেলাম। মামুন জাফরের কাছে নালিশ করে কিনা এ ব্যাপারে আমার ভয় হলো। জাফর চলে গেলে আমি তার কাছে এসে বললাম,“আমার ভয় ছিল যদি আমার ব্যাপারে নালিশ করো!” এটা শুনে মামুন বলল,“হে বাবা মুহাম্মাদ, আমি হারুন রশীদকেও বলি না,সেখানে জাফরকে বলব ? কারণ শিক্ষা গ্রহণে আমার উপকার। আমি আদবের মোহতাজ।”

আসমায়ী বলেছেন, “মামুনের মোহরে খোদাই করে লিখা ছিল – আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল্লাহ।”

মুহাম্মাদ বিন উবাদা বলেছেন, “খলীদাফের মধ্যে উসমান (রাঃ) আর মামুন ছাড়া কেউ হাফেজ ছিলেন না।”

ইবনে আয়নাহ বলেছেনঃ একদিন মামুন ওলামাদের সাথে সাধারণ পরিষদে বসেছিলেন। এক মহিলা এসে বললো,“হে আমিরুল মুমিনীন, আমার ভাই ইন্তেকাল করেছে। মুত্যুর সময় ছয়শত দিনার রেখে গেছে,আমাকে এক দিনার দিয়ে বলা হয়েছে, এটাই তোমার অংশ।” মামুন কিছুক্ষণ ফারায়েযের অংক কষে বললেন,“তুমি একটি দিনারই পাবে।” ওলামা হযরত বললেন,“আমিরুল মুমিনীন, এটা কি করে হয় ?” মামুন বললেন, “মৃত ব্যক্তি দুইজন কন্যা সন্তান রেখে গেছে।” মহিলা বললো, “হ্যা।” মামুন বললেন, “এ দুই সন্তান পেয়েছে দুই-তৃতীয়াংশ, অর্থাৎ চারশো দিনার। তার মা রয়েছে,তিনি পেয়েছন অষ্টাংশ, অর্থাৎ একশো দিনার। স্ত্রীর ভাগে অষ্টমাংশ, অর্থাৎ ৭৫ দিনার। তার বারোজন ভাই ছিল না ?” মহিলা বললো,“হ্যাঁ।” মামুন বললেন,“তারা পেয়েছে দুই দিনার করে। অবশিষ্ট থাকে এক দিনার, যা তোমার ভাগে এসেছে।”

মুহাম্মাদ বিন হাফয আল-আনমাতী বর্ণনা করেছেনঃ ঈদের দিন আমি মামুনের সাথে খাবার খেতে বসলাম। দস্তরখানে ছিল তিন শতাধিক প্রকার খাবার। মামুন এক একটি খাবারের প্রতি ইশারা করে বললেন,“এ খাবার অমুক রোগের ঔষধ। যার বমি করার অভ্যাস রয়েছে সে এ খাবার খাবে না – ইত্যাদি এ ধরনের আরো অনেক কথা। ইয়াহইয়া বিন আকতাম এ দৃশ্য দেখে বললো,“আমিরুল মিমিনীন, চিকিৎসাশাস্ত্রের দিক থেকে দেখা হলে আপনি জালেনুস, জ্যোর্তিবিদ্যায় আপনি হলেন হরমুস, উলুমুল ফিকহে আলী বিন আবু তালিব, দানশীলতায় হতেম তাঈ, সত্যবাদিতায় আবু যর, দায়ার্দ্রতায় কাব বিন উমামা, আর প্রতিশ্রুতি রক্ষায় আপনি হলেন সহুল বিন আদিয়া।” এ কথা শুনে মামুন দারুণ খুশি হয়ে বললেন,“এজন্য জ্ঞানের কারণে মানুষকে মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে।”

ইয়াহইয়া বিন আকতাম বলেছেনঃ আমি মামুনের চেয়ে পূর্ণাঙ্গ ব্যক্তি আর দেখিনি। একদিন রাতে আমি তার সাথে ছিলাম। তিনি আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে বললেন,“ইয়াহইয়া, দেখো তো আমার পায়ের কাছে কি ?” আমি তেমন কিছু দেখতে পেলাম না। তিনি নিশ্চিন্ত হতে পারলেন না। বিছানার দায়িত্বে নিয়োজিত প্রহরীদের ডাকলেন। এক প্রহরী মোমবাতি নিয়ে হাযির হলো, তিনি তাকেও দেখতে বললেন। ফলে দেখা গেলো, বিছানার নিচে একটি লম্বা সাপ বসে রয়েছে। তারা সাপটি মেরে ফেললো। আমি বললাম,“আমিরুল মুমিনীনকে এ ঘটনার প্রেক্ষিতে আলেমুল গায়েব বললেও কোন ক্ষতি নেই।” তিনি বললেন,“আল্লাহ ক্ষমা করুন। তুমি এ কি বলছো ? আমি এইমাত্র স্বপ্নে দেখলাম যে, এক ব্যক্তি আমার কাছে এসে এ কবিতাটি আবৃত্তি করলো – ‘হে ঘুমন্ত ব্যাক্তি, জেগে উঠুন আর নগ্ন তলোয়ার দিয়ে নিজেকে রক্ষা করুন।’ এটা শুনে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলো আর বিশ্বাস হল অবশ্যই কিছু একটা হতে চলেছে। অবশেষে বিছানার নিচে সাপ পাওয়া গেলো।”

উমারাহ বিন আকল বলেছেনঃ একদিন কবি আবু হাফসা আমাকে বললেন,“তুমি কি কখন ভেবে দেখেছো যে,আমার দৃষ্টিতে মামুন কবিতার ভাবার্থ মোটেও অনুধাবন করতে সক্ষম নন ?” আমি বললাম,“তার চেয়ে বেশী কথোপকথন অনুধাবনকারী আর কে আছে ? আল্লাহর কসম, আপনি তাকে অনেক কবিতা শুনিয়েছেন। আর তিনি প্রথম চরণ শুনেই গোটা কবিতার সারাংশ ও ভাবার্থ বুঝে ফেলেন।” তিনি বললেন,“আমার শ্রেষ্ঠ রচনা চমৎকার একটি কবিতা তাকে শুনলাম। কিন্তু তার মধ্যে কোন প্রকার অনুভূতি জাগলো বলে মনে হলো না। কবিতার অর্থটি  এমন – ‘ইমাদুল হুদা মামুন দ্বীন নিয়ে মশগুল। আর জনতা দুনিয়ার মোহে আচ্ছন্ন।’ ” আমি বললাম,“কবিতার প্রভাব- শক্তি মাটি হয়ে গেছে। মামুন যদি শুধু দ্বীন নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়েন, তাহলে রাষ্ট্রীয় কার্যাদি কিভাবে সম্পাদন হবে ? আপনি তার শানে সে কবিতাটিই আবৃত্তি করেছেন,যা আপনার চাচা ওলীদের সামনে আবৃত্তি করেছিলেন।”

নযর বিন শামীল বলেছেনঃ আমি তালিযুক্ত চাদর পড়ে মামুনের কাছে গেলাম। তিনি বললেন,“নযর, আমিরুল মুমিনীনের সামনে এভাবেই কি আসা উচিত ?” আমি বললাম,“হে আমিরুল মুমিনীন, এমনটা পরেছি গরমের কারণে।” তিনি বললেন,“না, না; কথা এটা নয়। মনে হয় তুমি গরীব ঘয়ে গেছো। এ হাদীসটি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করে দেখো,যা হিশাম বিন বশীর আমার কাছে বর্ণনা করেছেন; তিনি মুজাহিদ থেকে,মুজাহিদ আল-শাবী থেকে,তিনি ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন – ‘এমন নারী, যার মধ্যে দ্বীন ও লাবণ্য রয়েছে, এমন নারীকে বিয়ে করলে অভাব ও দরিদ্রতার দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়।’ ” আমি বললাম,“আমিরুল মুমিনীন, হিশামের বর্ণনা অনুযায়ী আপনার অভিমত সত্য। তবে হাসানের বরাত দিয়ে আউফুল আরাবী আমার কাছে বর্ণিত করেছেন যে,রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- ‘দ্বীনী ও লাবণ্যময়ী নারীকে বিয়ে করলে আয়েশের দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়।’ ” মামুন কোলবালিশে হেলান দিয়েছিলেন, আমার কথা শুনে সোজা হয়ে উঠে বসলেন। তিনি বললেন,“তবে কি প্রথম হাদীসে শব্দ ভুল রয়েছে ?” বললাম,“জ্বি,হিশাম ভুল বলেছেন। তিনি বুঝতে পারেননি।” এরপর মামুন রেওয়ায়েতের মধ্যে পার্থক্যগুলো বর্ণনা করলেন।

মামুন আমাকে বললেন,“তুমি কি আরবী কবিদের সনদ বর্ণনা করতে পারবে ?” আমি আরবী কবির একটি কবিতা আবৃত্তি করলাম। এটা শুনে মামুন বললেন,“আল্লাহ তাআলা এমন ধরণের কবিদের বিধ্বস্ত করুন,যারা ইলমুল আদব (আরবি সাহিত্য) ভালোভাবে জানে না।” এরপর তিনি আত্মপক্ষ সমর্থনে ইবনে আবী উরওয়াতাল মাদানী কবির কাব্য বলে শোনালেন। আমিও তাকে অনেক কবিতা শোনালাম। তিনি আমাকে পঞ্চাশ হাজার দিরহাম দেওয়ার নির্দেশ লিখে আমাকেসহ কাগজটি ফজল বিন সহলের কাছে পৌঁছে দিতে বললেন। আমি গেলাম। ফজল বললেন,“আমিরুল মুমিনীদের খুব ভুল ধরছেন ?” আমি বললাম,“হিশাম ভুলের উপর ছিলেন। আর তিনি তার অনুসরণ করছিলেন।” এ কথা শুনে ফজল নিজের পক্ষ থেকে আরো ত্রিশ হাজার দিরহাম দিলেন।

মুহাম্মাদ বিন যিয়াদ আরাবী থেকে খতীব বর্ণনা করেছেনঃ একদিন আমি মামুনকে ইয়াহইয়া বিন আকতামের সাথে বাগানে পায়চারী করতে দেখলাম। সামনে গিয়ে খলীফাসূচক অভিবাদন জানালাম। আমি শুনলাম তিনি ইয়াহইয়াকে বললেন,“আবু মুহাম্মাদ ইলমে আদব সম্পর্কে অভিজ্ঞ।” এরপর তিনি আমাকে একটি কবিতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। আমি এর যথাযথ ব্যাখ্যা করায় তিনি আমাকে আম্বর দান করলেন, সে সময় যা তার হাতে ছিল। তিনি পাঁচ দিরহামে বিক্রি করি।

আবু উবাদা বলেছেন,“মামুন পৃথিবীর বাদশাহ,তার মতো আর একজনকেও দেখিনি।”

আবু দাউদ বলেছেনঃ মামুনের কাছে এক খারেজী লোক এলে তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন,“তোমার কাছে আমার খিলাফতের কোন দলিল আছে কি ?” সে বললো – আছে, তা হলো কুরআন শরীফের এ আয়াত –

وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللَّـهُ فَأُولَـٰئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ

“আল্লাহ’র নাযিল করা আইন অনুযায়ী যারা বিচার-ফয়সালা করে না, তারাই (হচ্ছে) কাফের।” (সূরাহ আল-মাইদাহ, ৫ :৪৪)

মামুন বললেন,“কিভাবে বুঝলে এটা কুরআনের আয়াত ?” সে বললো,“উম্মতের ইজমা দ্বারা।” তিনি বললেন,“যখন তোমরা নাযিলকৃত আয়াতের ক্ষেত্রে উম্মতের ইজমা দ্বারা একমত হচ্ছো,তখন বিশ্লেষণসাপেক্ষেও ঐকমত্যে পৌঁছা উচিত।” সে বললো,“আপনি সত্য বলেছেন।”

মুহাম্মাদ বিন মানসুর থেকে ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেনঃ মামুনের উক্তি হল – “ভদ্র লোকদের আলামত হচ্ছে সে ঊর্ধ্বতন লোকদের অত্যাচার সহ্য করবে, কিন্তু দুর্বলদের উপর জুলুম করবে না।”

সাঈদ বিন মুসলিম বলেছেনঃ মামুন বলতেন,“আমি ক্ষমা করতে এতটাই ভালোবাসি যে,যদি অপরাধীরা তা জানোতে পারে তাহলে তাদের অন্তর থেকে ভয় উঠে যাবে আর তারা ভীষন আনন্দিত হবে।”

ইবরাহীম বিন সাঈদ জাওহারী থেকে বর্ণনা করেছেনঃ এক অপরাধীকে মামুনের সামনে আনা হলে তিনি কসম খেয়ে বললেন,“আমি তোমাকে হত্যা করবো।” সে বললো,“হে আমিরুল মুমিনীন, একটু ধৈর্য ধরুন আর সহনশীলতার সাথে কাজ করুন। কারণ নমনীয়তা প্রদর্শন অর্ধেক ক্ষমা করার সমান।” মামুন বললেন,“আমি যে কসম করেছি।” সে বললো,“আল্লাহ তাআলার সামনে হত্যাকারী হিসেবে উপস্থিত হওয়ার চেয়ে কসম তরককারী হয়ে হাযির হওয়া অনেক ভালো।” এ কথা শুনে তিনি তাকে ছেড়ে দেন।

আবুল সলত আব্দুস সালাম বিন সালিহ থেকে খতীব বর্ণনা করেছেনঃ একদিন আমি মামুনের কক্ষে শুয়ে গেলাম। এদিকে মশালবাহীদের তন্দ্রার কারণে মশাল গলে পড়ে যায়। মামুন নিজেই উঠে আসেন আর মশালগুলো ঠিক করে দেন। এমন সময় আমার চোখ খুললো। আমি শুনতে পেলাম মামুন বলছেন, “নিয়ম অনুযায়ী আমি গোসলখানায় ছিলাম। গোসলখানার খাদেমরা আমাকে গালি দিলো। আমি যে তাদের গালি শুনতে পেলাম তা তারা জানোতো না। আমি তাদের ক্ষমা করে দিলাম।”

আব্দুল্লাহ বিন আল বাওয়াব থেকে সূলী বর্ণনা করেছেনঃ মামুন খুবই ধৈর্যশীল ব্যক্তি ছিলেন। এমনকি তার ধৈর্যশীলতা দেখে আমাদেরই রাগ হতো। একদিন আমরা জাহাজে করে দজলা নদী ভ্রমণ করছিলাম। জাহাজের ডেকে পর্দা টানানো ছিল। একদিকে আমরা অন্যদিকে মাঝি মাল্লার দল বসেছিলো। একজন মাঝি বললো,“তোমরা জানো আমার অন্তরে মামুনের প্রতি এতটুকু শ্ৰদ্ধাবোধ নেই। তিনি আমার চোখের কাঁটা। কারণ তিনি নিজ ভাইয়ের হত্যাকারী।” আল্লাহর কসম,এ কথা শুনে মামুন হেসে উঠলেন। এরপর তিনি আমাদের বললেন,“আপনারা একটি গ্রহণযোগ্য উপায় বের করুন যা দ্বারা মর্যাদাবান ব্যক্তিদের দৃষ্টিতে আমি সম্মানিত হতে পারি।”

খতীব ইয়াহইয়া বিন আকতাম থেকে বর্ণনা করেছেনঃ আমি মামুনের চেয়ে দয়াবান আর কাউকে দেখিনি। একদিন আমি তার ঘরে শয়ন করলাম। তখনও আমি ঘুমিয়ে যাইনি। মামুন হাচিঁ দিয়ে উঠে বসলেন। হাঁচির শব্দে কারো যেন ঘুমের ক্ষতি না হয় সেজন্য জামার কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে নিয়ে বলতে লাগলেন, “ইনসাফের প্রথম পর্যায় হচ্ছে নিকটবতী বন্ধুদের প্রতি ইনসাফ প্রদর্শন, এরপর ক্রমান্বয়ে নগণ্যদের প্রতিও।”

ইয়াহইয়া বিন খালিদ বরমক্কী থেকে ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেনঃ একদিন মামুন আমাকে বললেন,“ইয়াহইয়া, লোকদের প্রয়োজনে সাহায্য করাকে সৌভাগ্য মনে করবে। কারণ আকাশ ধ্বংস হবে, যুগ যুগান্তর কেউ বেঁচে থাকবে না, আর কারো দয়াও অবিনশ্বর নয়।”

আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ যহরী কর্তৃক বর্ণিতঃ মামুন বলেছেন,“আমার মতে কষ্টার্জিত বিজয় স্বভাবজাত বিজয়ের চেয়ে প্রিয়। কারণ স্বভাবজাত বিজয় স্নান হয়ে পড়ে, আর কষ্টার্জিত বিজয় অটুট থাকে।”

শাবী থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, মামুন বলেছেন,“যে তোমার ভালো সংকল্পে গর্বিত নয়,সে তোমার নেক কাজেরও সমর্থক নয়।”

আবুল আলীয়া বলেছেনঃ আমি মামুনকে বলতে শুনেছি,“সুলতানের খোশামোদ করা ঘূণ্য কাজ।”

আলী বিন আব্দুর রহীম আল মুরুষী বলেছেনঃ মামুন বলতেন,“ঐ ব্যক্তি নিজের নফ্‌সের উপর অত্যাচার করে – যে এমন কাউকে কাছে পেতে চায়, যে তার থেকে নিজেকে দূরে রাখে। যে এমন ব্যক্তির সামনে বিনয় প্রদর্শন করে যে তাকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করে না। এবং যে এমন লোকের প্রশংসায় পরিতৃপ্ত হয় যে তার সম্পর্কে জানে না।”

মুখারিক বলেছেনঃ একদিন আমি মামুনের সামনে এ কবিতাটি আবৃত্তি করলাম,“আমি এমন বন্ধু চাই, চরম হতাশা ও বেদনার সময় যে আমাকে সান্তনা দিবে।” মামুন কবিতাটি পুনঃ পুনঃ আবৃত্তি করতে বললেন। আমি সাতবার আবৃত্তি করলাম। তিনি বললেন,“মুখারিক, আমার গোটা রাজত্ব নিয়ে নাও,পরিবর্তে আমাকে এ ধরনের একটি বন্ধু এনে দাও।”

হুদাবা বিন খালিদ বলেছেনঃ একবার আমি মামুনের সাথে খেতে বসলাম। খাওয়া-দাওয়া শেষে দস্তরখান উঠানোর সময় যেসব দানা মাটিতে পড়ে যায় সেগুলো কুড়িয়ে কুড়িয়ে খেতে লাগিলাম। তা দেখে মামুন বললেন,“তোমার কি পেট ভরেনি ?” আমি বললাম,“জি,পেট ভরেছে। কিন্তু হাম্মাদ বিন সালামা, সাবিত বাসফীর বরাত দিয়ে আনাস (রাঃ) এর একটি হাদীস আমার কাছে বর্ণনা করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন – ‘যে দস্তরখানার নীচে পড়ে থাকা দানা উঠিয়ে খাবে, সে দরিদ্রতা থেকে মুক্ত থাকবে।’ ” এ হাদীস শুনে মামুন আমাকে এক হাজার দিরহাম দিলেন।

হাসান বিন আবদাশ সাফার বলেছেনঃ মামুন বুরান বিনতে হাসান বিন সাদকে বিয়ে করার সময় লোকেরা হাসানকে অনেক উপহার দেয়। এক ফকীর দুটি উপহার পাত্র পাঠায়। সে একটিতে লবণ, অপরটি পাউডার ভর্তি করে এ মর্মে একটি পত্র লিখে হাসানের কাছে পাঠায় – “আমি এক ফকীরের পক্ষ থেকে এ উপহারটুকু পাঠালাম। ধনাঢ্যদের উপহার সামগ্রীর তালিকায় যেন আমার নাম লিখা না হয়। বরকতের জন্য লবণ আর সুগন্ধির জন্য পাউডার পাঠালাম।” হাসান এ পাত্র দুটি মামুনের সামনে পেশ করলো। তিনি তা পছন্দ করলেন আর পাত্র দুটি খালি করে তাতে স্বর্ণমুদ্রা ভরে পাত্র দুটি ফকীরের কাছে পাঠিয়ে দিলেন।

মুহাম্মাদ বিন কাসেম থেকে সূলী বর্ণনা করেছেনঃ আমি মামুনকে এ কথা বলতে শুনেছি যে,“আল্লাহর কসম, ক্ষমা করার মধ্যে আমি এমন মজা পাই যে,এটা বুঝতে পারলে লোকেরা অপরাধ করে এমনিতেই আমার কাছে আসতো।”

হুসাইন আল-খলীহ থেকে সূলী বর্ণনা করেছেনঃ একদা মামুন রেগে আমার ভাতা বন্ধ করে দেন। আমি একটি কবিতা লিখে এক লোকের হাতে মামুনের কাছে পাঠালাম। এতে তার প্রশংসা আর আমার অর্থ সংকটের বিবরণ লিপিবদ্ধ ছিল। তিনি তা পাঠা শেষে বললেন,“কবিতাটি সুন্দর হয়েছে। তবে আমার কাছে সে কিছু পাবে না। কারণ সে আমীনের প্রশংসাগাথায় আমার দুর্নাম করেছে।” এটা শুনে জনৈক প্রহরী বললো,“আমিরুল মুমিনীন, আজ আপনার ক্ষমার প্রবণতা কোথায় ?” এ কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে তিনি আমার ভাতা চালু করে দিলেন।

হাম্মাদ বিন ইসহাক বলেছেন,“মামুন বাগদাদে এলে যুহর পর্যন্ত আদালতে বসে লোকদের প্রতি ইনসাফ করতেন আর মজলুমদের ন্যায়বিচার করে দিতেন।”

মুহাম্মাদ বিন আব্বাস বলেছেনঃ মামুন রশীদের দাবা খেলার প্রতি প্রবল ঝোক ছিল। তিনি বলতেন,এ খেলা মেধাকে সতেজ রাখে। তিনি এ খেলার নতুন নতুন দিক উদ্ভাবন করেন। তিনি বলেন,আমি কাউকে নিয়ে খেলতে চাইলে সকলে বাহানা দিত। আসলে তারা ভালো খেলতে জানোতো না।

হাখাত বলেছেনঃ মামুনের বন্ধু বলেন,তার অবয়ব আর শরীরের রং একই মতো। তবে হাঁটুর নীচের দিকের রং ছিল গাঢ় হলুদ বর্ণের।

ইসহাক মৌসূলী বলেছেনঃ মামুনের কথা হলো – সেই সঙ্গীত উত্তম, যে সঙ্গীতে মাধ্যমে মেহেরবানী আর শিষ্টতার বাণী প্রচারিত হয়।

ইবনে আবু দাউদ বলেছেনঃ একবার রোম সম্রাট মামুনের কাছে ১০০ কেজি মেশক আম্বর উপঢৌকন হিসেবে পাঠালে তিনি দ্বিগুণ উপঢৌকন পাঠানোর নির্দেশ দিয়ে বললেন,যাতে তারা ইসলামের শানশওকত বুঝতে পারেন।

আবু উবাদা বলেছেন, আমার জানা নেই, আল্লাহ তাআলা মামুনের চেয়ে বেশী দানশীলতা ও দয়ার্দ্রতার গুণ দিয়ে আর কাউকে সৃষ্টি করেছেন কিনা।

সুমামা বিন আশরাস বলেছেনঃ বাগ্মীতার দিক থেকে আমি জাফর বিন ইয়াহইয়া এবং মামুনের চেয়ে বড় আর কাউকে দেখিনি।

সালাফী তওরিয়াত গ্রন্থে হাফয মাদায়েনী থেকে বর্ণনা করেছেনঃ এক হাবশী লোক মামুনের কাছে এসে নবুওয়তের দাবী করে বললো,“আমি মূসা বিন ইমরান।” মামুন বললেন,“মূসা (আঃ) হাত দিয়ে ডিম তৈরির মুজিযা দেখিয়েছেন। তুমিও যদি সেই মুজিযা দেখাতে পারো, তাহলে আমরা তোমার প্রতি ঈমান আনবো।” লোকটি বললো,মূসা বিন ইমরানের সামনে ফিরাউন বলেছিলো –

أَنَا رَبُّكُمُ الْأَعْلَىٰ

“আমিই তোমাদের সবচেয়ে বড় রব” (সূরাহ আন-নাযিয়াত, ৭৯ :২৪)

এরপর তিনি মুজিযা দেখিয়েছেন। আপনি সেই দাবী করলে আমি মুজিযা দেখাবো, নাহলে প্রয়োজন নেই।

মামুন বলতেন,“প্রশাসকদের হটকারিতার কারণে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়।”

ইবনে আসাকির ইয়াহইয়া বিন আকতাম থেকে বর্ণনা করেছেনঃ মামুন প্রতি মঙ্গলবারে ফিকাহ শাস্ত্ৰ নিয়ে মতবিনিময়ের জন্য আলেমদের নিয়ে মজলিস করতেন। একদিন এক ব্যক্তি একটি কাপড় পড়ে জুতা হাতে নিয়ে মজলিসের এক কোণে এসে দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,“এ মজলিস কি উম্মতের ইজতেমার জন্য, না বিজয় গাথা ও প্রতিশোধ গ্রহণের উপায় বের করার মজলিস ?” মামুন সালামের জবাব দিয়ে বললেন,“প্রথমটার জন্য দ্বিতীয়টার জন্য নয়;বরং এ মজলিস এ জন্য যে,প্রথমে মুসলিম উম্মাহর কাজের দায়িত্ব আমার ভাইয়ের উপর ছিল। এরপর আমার আর আমার ভাইয়ের মাঝে বিবাদ হওয়ায় এ দায়িত্ব আমার উপর বর্তায়। ইজতেমায় আমি মুসলমানদের মতামতের মোহাতাজ। যাতে তারা আমার প্রতি সন্তুষ্ট হয়। তাদের ধারণা খিলাফত আমার হাত থেকে চলে গেলে ইসলামের ভিত্তি ধ্বসে যাবে,মুসলমানদের কাজ গড়বড় হয়ে পড়বে,এতে বিভাদের সৃষ্টি হবে, জিহাদ ভ্রান্ত হয়ে যাবে,হজ্বের কাজ হবে না,সব পথ বন্ধ হয়ে যাবে। এ লক্ষ্যে সাবধানতার জন্য আমি প্ৰস্তুতি নিয়েছি, যাতে মুসলমানদের মধ্যে খিলাফতের বিষয়ে একজনকে রাজি করে তার উপর খিলাফতের দায়িত্ব দিয়ে আমি পৃথক হয়ে যাবো।” এরপর সে লোকটি সালাম দিয়ে চলে গেলো।

মুহাম্মাদ বিন মুনাযির আল-কিন্দী বলেছেনঃ একদা হারুন রশীদ হাজ্জ করার পর কুফায় এসে সকল মুহাদ্দিসকে আহবান করেন। আব্দুল্লাহ বিন ইদরীস আর ঈসা বিন ইউনুস ছাড়া সকলেই এসে উপস্থিত হোন। হারুন তাদের ডেকে আনার জন্য আমীন আর মামুনকে পাঠালেন। ইবনে ইদরীস তাদের দুইজনের সামনে একশো হাদীস পাঠ করেন। হাদীস পড়া হলে মামুন বললেন,“অনুমতি পেলে সবেমাত্র পাঠকৃত আপনার সকল হাদীস আমি মুখস্থ শুনিয়ে দিবো।” তিনি বললেন,“শোনাও তো দেখি।” তিনি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত হুবহু হাদীসগুলো শুনিয়ে দিলেন। আব্দুল্লাহ বিন ইদরীস মামুনের প্রখর মুখস্থ শক্তি দেখে অস্থির হয়ে পড়লেন।

কোন কোন ওলামায়ে কেরামের মতে, গ্ৰীক দর্শনের অনেক প্রাচীন ও মূল্যবান গ্ৰস্থাদি মামুনের হস্তগত ছিল। যাহাবী সংক্ষিপ্তভাবে এর বিবরণ দিয়েছেন।

ফাকেহী বলেছেনঃ মামুন সর্বপ্রথম কাবা শরীফকে সাদা রেশমের চাদর দিয়ে আচ্ছাদিত করেন। খলীফা নাসেরের যুগ পর্যন্ত সাদা রেশম গিলাফের প্রচলন ছিল। পরবর্তীতে সুলতান মাহমুদ সবক্তগীন তার শাসনামলে হলুদ রেশমের গিলাফে কাবা শরীফ আচ্ছাদিত করেন।

 

মামুনের বাণীগুলো হচ্ছে –

লোকদের জ্ঞান-গরিমা নিয়ে গবেষণা করার মধ্যে যতটুকু লাভ রয়েছে,জীবনী আলোচনায় ততটুকু নেই।

দ্বিতীয় বাণী – যখন কোন বিপদ এসে যায়, তখন এ বিপদ থেকে কেটে উঠা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে।

তৃতীয় বাণী – সবচেয়ে ভালো মজলিস হচ্ছে যেখানে লোকেরা মানুষদের অবস্থা নিয়ে চিন্তাভাবনা করে। মানুষ তিন ধরনের – এক,পেটুক – যে সবসময় খায়; দুই,অসুস্থ – যাকে সবসময় ঔষধ খেতে হয়; তিন, সেই অসুস্থ লোক – যার অবস্থা সবসময় অপ্রীতিকর।

মামুন বর্ণনা করেছেনঃ আমি এক ব্যক্তি ছাড়া কারো কাছে নিরুত্তর হইনি। একদিন সে কুফাবাসীকে নিয়ে এসে কুফার প্রশাসকের ব্যাপারে অভিযোগ উত্থাপন করলো। আমি বললাম,“তুমি মিথ্যা বলছো। তিনি তো বড় ইনসাফগার লোক।” সে বলল,“আমিরুল মুমিনীন সত্য বলেছেন আর আমি মিথ্যা বলেছি। তবে এ শাসককে কেন আমাদের জন্যই শুধু নির্দিষ্ট করেছেন ? কেন তাকে অন্য শহরে স্থানান্তর করছেন না, যাতে সে শহরটিকে তিনি ইনসাফে ভরে দিতে পারেন, যেমন আমাদেরকে ন্যায়বিচারেও সৎ শাসনে ভরে দিয়েছেন ?” আমি অবশেষে অপারগ হয়ে বললাম,“তোমরা যাও। আমি তাকে পৃথক করে দিবো।”

মামুনের অনেক কবিতা রয়েছে। তিনি দাবা খেলার প্রশংসায় বহু কবিতা রচনা করেন।

 

মামুন কর্তৃক বর্ণিত হাদীসসমূহ

বায়হাকী বলেনঃ আমি আবু আব্দুল্লাহ হাকিম থেকে শুনেছি যে, তিনি আবু আহমাদ সায়রাফী আর তিনি জাফর বিন আবু উসমান তায়ালাসী থেকে বর্ণনা করেছেনঃ আমি (জাফর বিন আবু উসমান) আরাফার দিন মামুনের পিছনে মেহরাবে দাড়িয়ে নামায পড়লাম। সালাম ফিরিয়ে লোকেরা তাকবীর পাঠ করতে লাগলো। আমি মামুনকে দেখলাম। তিনি বললেন,“চুপ করো। আবুল কাসেম (রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি কুনিয়াত) এর সুন্নত হল আগামীকাল তাকবীর বলা। (রাবী বলেন),ঈদুল আযহার দিন আমি নামায পড়তে গেলাম। মামুন মিম্বরে আরোহণ করে খুৎবা দিলেন। হামদ ও ছানার পর তিনি বললেন,

اللَّهُ أَكْبَرُ كَبِيرًا وَالْحَمْدُ لِلَّهِ كَثِيرًا وَسُبْحَانَ اللَّهِ بُكْرَةً وَأَصِيلاً

আমি হাশিম বিন বাশীর থেকে বর্ণনা করেছি, তিনি ইবনে শবরমা থেকে,তিনি শাবী থেকে,তিনি বারা বিন আযেব থেকে,তিনি আবু বুরদা বিন দিনার থেকে,তিনি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, নবী আকরাম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,যে ঈদুল আযহার নামাযের আগে কুরবানী করবে,সে যাবোহকৃত পশুর গোশত খেতে পারবে। আর যে ঈদুল আযহার নামায্যের পর কুরবানী করবে, সে সুন্নতের পথ ধরে পৌঁছে যাবে।

اللَّهُ أَكْبَرُ كَبِيرًا وَالْحَمْدُ لِلَّهِ كَثِيرًا وَسُبْحَانَ اللَّهِ بُكْرَةً وَأَصِيلاً

হে পৃথিবীর প্রতিপালক, আমাকে যোগ্যতা দিন।

হাকিম বলেছেনঃ আমি এ হাদীসটি আবু আহমাদ ছাড়া অন্য কোন সূত্রে লিপিবদ্ধ করিনি। আমার দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি নির্ভরযোগ্য। আমার মনে তার প্রতি কিছুটা সংশয় ছিল। কিন্তু আমি আবুল হাসান আর দারা কুতনীকে জিজ্ঞেস করলাম। তারা বললেন,“আমাদের দৃষ্টিতে জাফরও বিশুদ্ধ।” আমি বললাম,শায়খ আবু আহমাদ ? বললেন,আমি উযীর আবুল ফজল জাফর বিন ফরাত থেকে,তিনি আবুল হুসাইন মুহাম্মাদ বিন আব্দুর রহমান রুদবারী ত্থেকে, তিনি মুহাম্মাদ বিন  আব্দুল মালিক তারিখী থেকে বর্ণনা করেন। তারা সকলেই নির্ভরযোগ্য। এরপর বললেন,আমার থেকে তায়ালাসী হাদীস বয়ান করেছেন আর তার থেকে ইয়াহইয়া বিন মুঈন। তিনি বলেন,মামুন খুতবায় এ হাদীসটি পড়েন।

সূলী বলেছেনঃ আমার কাছে তায়ালাসী ইয়াহইয়া বিন মুঈনের বরাত দিয়ে বয়ান করেন,“বাগদাদে আরাফার দিন, সেদিন শুক্রবার ছিল মামুন খুতবা দেন। সালাম ফেরানোর পর লোকেরা তাকবীর দেয়। মামুন তা প্রত্যাখ্যান করেন আর লাফ দিয়ে মেহরাবের লাঠি হাতে নিয়ে বললেন,এটা কিসের আওয়াজ ? অসময়ে কেন তাকবীর দিচ্ছো ? আমাকে হাশিম বিন বশীর,তিনি মুজাহিদ থেকে,তিনি ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণনা করেছেন – রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জমরাতুল উকবা পর্যন্ত তালবীয়া পাঠ করতেন, আর দ্বিতীয় দিন যুহর পর্যন্ত তালবীয়া ও তাকবীর বলতেন।

সূলী বলেছেনঃ আহমাদ বিন ইবরাহীম মৌসূলীর বরাত দিয়ে আবুল কাসেম আমার কাছে বর্ণনা করেছেন যে,একদিন এক ব্যক্তি মামুনের কাছে এসে বললো,“হে আমিরুল মুমিনীন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন – আল্লাহ তাআলার সৃষ্টি বালবাচ্চা। আল্লাহ তাআলার দৃষ্টিতে ঐ ব্যক্তি সবচেয়ে প্রিয়, যে তার সৃষ্ট বালবাচ্চাদের উপকার করবে।” মামুন চিৎকার দিয়ে বলে উঠলেন,“চুপ করো, আমি হাদীসের দিক থেকে তোমার চেয়ে বড় আলেম। আমার নিকট ইউসুফ বিন আতীয়া সাফায়ী বর্ণনা করেন,তিনি সাবিত থেকে,তিনি আনাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন – আল্লাহ তাআলার সৃষ্টি বালবাচ্চা,আল্লাহ তাআলার দৃষ্টিতে সবচেয়ে প্রিয় ঐ ব্যক্তি, যে তার বালবাচ্চাদের উপকার করে।”

ইবনে আসাকিরও এ হাদীসটি অভিন্ন সূত্রে বর্ণনা করেছেন,যা আবু ইয়ালা মৌসূলী স্বরচিত মসনদ গ্রন্থে ইউসুফ বিন আতীয়ার সূত্রে বর্ণনা করেছেন।

সূলী বলেছেনঃ মাসীহ বিন হাতিম আল আকলী আমার কাছে বৰ্ণনা করেছেন যে, আব্দুল জব্বার বিন আব্দুল্লাহ বলেছেনঃ আমি মামুনের খুতবা শুনেছি। তিনি লজ্জার উপর বয়ান রাখছিলেন। তিনি এর অনেক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে বললেন,“হাশিম আমার কাছে বয়ান করেন, তিনি মানসুর থেকে,তিনি হাসান থেকে,তিনি আবু বকরাহ থেকে,তিনি ইমরান বিন হুসাইন থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন – লজ্জা হলো ঈমান,আর ঈমান হল জান্নাত; বেলজ্জা হলো বাড়াবাড়ি,আর বাড়াবাড়ি হলো জাহান্নাম। ইবনে আসাকির এটি ইয়াহইয়া বিন আকতাম আল মামুন থেকে বর্ণনা করেছেন।

হাকিম বলেছেনঃ মুহাম্মাদ বিন আহমাদ বিন তামীম ইয়াহইয়া বিন আকতামের বরাত দিয়ে বলেছেনঃ একদিন মামুন আমাকে বললেন,“ইয়াহইয়া, আমার মন চাইছে যে,আমি হাদীস বর্ণনা করবো।” আমি বললাম,“আমিরুল মুমিনীনের চেয়ে এ কাজ করার বেশী হকদার আর কে আছে ?” তিনি মিম্বর আনতে বললেন,মিম্বর আনা হলো। তিনি মিম্বরে আরোহণ করলেন। সর্বপ্রথম এ হাদীসটি তিনি বয়ান করেন, তিনি বলেন, “হাশিম আমাকে,তিনি আবুল জাহাম থেকে, তিনি যহরী থেকে,তিনি আবু সালামা থেকে,তিনি আবু হুরায়রা থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন – জাহান্নামে ইমরাউল কায়েস কবিদের পতাকাবাহী হবে।” এরপর তিনি আরো তিনটি হাদীস বর্ণনা করার পর মিম্বর থেকে নেমে এসে আমাকে বললেন,“ইয়াহইয়া, আমার এ মজলিসটি কেমন লাগলো ?” আমি বললাম, “আমিরুল মুমিনীন, আপনার মজলিসটি খুবই চমৎকার হয়েছে।” এরপর তিনি বলতে লাগলেন, “তোমার কসম,এ মজলিসে লোকদের মাঝে কোন মিষ্টতা ছিল না। এ মজলিস তালিযুক্ত কাপড় পরিহিতদের মজলিস ছিল। যারা কলম কালি নিয়ে এসেছিলো।”

খতীব বলেছেনঃ আবুল হাসান আলী বিন কাসেম আমার কাছে ইবরাহীম বিন সাঈদ আল জাওহারী থেকে বর্ণনা করেছেনঃ মামুন মিসর জয় করলে এক ব্যক্তি তাকে বললো,“সেই প্রতিপালকের শোকর,হে আমিরুল মুমিনীন, যিনি আপনার দুশমনদের পরাজিত করেছেন এবং ইরাক,সিরিয়া ও মিসরবাসীকে আপনার অনুগত করে দিয়েছেন। সাবাশ, আপনি রাসূলুল্লাহ’র (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চাচার সন্তান।” মামুন বললেন,“এখনো আমার একটি অভিপ্রায় বাকী থেকে গেছে,আর তা হলো – আমি একই সভায় বসে ইয়াহইয়ার মত বরেণ্য মুহাদ্দিসদের সাথে মতবিনিময় করবো,তারা বলবেন,আল্লাহ তাআলা আপনার প্রতি সন্তুষ্ট -এ বিষয়ে আপনি কি বৰ্ণনা করতে পারেন ? আমি বলবো,“আমার কাছে হাদীস বর্ণনা করেছেন হাম্মাদ বিন সালামা আর হাম্মদ বিন যায়েদ। তারা সাবিত বানানী থেকে,তিনি আনাস বিন মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন যে,নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন – যে দুই সন্তান অথবা এর চেয়ে বেশী সন্তান লালনপালন করবে,তারা তার সামনে লালিতপালিত হবে আর তার সামনে মারা যাবে, তাহলে সে ব্যক্তি জান্নাতে আমার সাথে এভাবে থাকবে – এ কথা বলে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দুটি আঙুল ফাঁক করে দেখালেন।

খতীব বলেছেনঃ এ বর্ণনাটি ভুল। আর ভুলটি হলো, মামুন হাম্মাদ থেকে বর্ণনা করেছেন, অথচ মামুন ১৭০ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেছেন, আর হাম্মাদ বিন সালামা ১৬৭ হিজরীতে ও হাম্মাদ বিন যায়েদ ১৭৯ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন।

হাকিম বলেছেনঃ মুহাম্মাদ বিন ইয়াকুব বিন ইসমাঈল আমার কাছে মুহাম্মদ বিন সহল বিন আসকার থেকে বর্ণনা করেছেন,একদিন মামুন আযান দেওয়ার জন্য দাড়ালেন। আমরাও তার পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। এমন সময় এক মুসাফির, যার হাতে কালির দাওয়াত ছিল, সে এসে বললো,“আমিরুল মুমিনীন, আমি মুহাদ্দিস।” মামুন বললেন, “তুমি এ কি বলছো ? তোমার অমুক অধ্যায়টি মনে আছে ?” এরপর মামুন হাদীস বয়ান করতে শুরু করলেন। পরিশেষে মামুন লোকদের উদ্দেশ্য করে বললেন,“তোমরা তিনদিন হাদীস পড়ে মুহাদ্দিস বলতে লেগেছো!”

ইবনে আসাকির বলেছেন যে,মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম ইয়াহইয়া বিন আকতাম থেকে বর্ণনা করেছেনঃ আমি একদিন রাতে মামুনের পাশে শুয়েছিলাম। গভীর রাতে পিপাসার কারণে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। আমি পাশ পরিবর্তন করলাম। মামুন বললেন,“ইয়াহইয়া, কি হয়েছে ?” আমি বললাম,“পিপাসা লেগেছে।” এ কথা শুনে তিনি এক গ্লাস পানি এনে আমাকে পান করালেন। আমি বললাম,“হে আমিরুল মুমিনীন, আপনি খাদেমকেও ডাকলেন না,কোন গোলামকেও জাগালেন না।” তিনি বললেন, “আমাকে আমার বাবা,তিনি আমার দাদা থেকে,তিনি উকবা বিন আমের থেকে বর্ণনা করেছেন যে,রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন – কাওমের সর্দার হবেন তার খাদেম।

খতীব এ বর্ণনাটি মামুনের সূত্রে এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ আমার কাছে হারুন রশীদ,তিনি মাহদী থেকে,তিনি মানসুর থেকে,তিনি তার পিতা থেকে,তিনি ইকরামা থেকে,তিনি ইবনে আব্বাস থেকে,তিনি জারীর বিন আব্দুল্লাহ থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন – কাওমের সর্দার হবেন তার খাদেম।

ইবনে আসাকির আবু হুযায়ফা থেকে বর্ণনা করেছেনঃ আমি মামুনের থেকে শুনেছি,তিনি আমার কাছে এ হাদীস বর্ণনা করেছেন,আমার বাবা আমাকে,তিনি আমার দাদা থেকে,তিনি ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণনা করেছেন যে, নবী আকরাম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন – কাওমের গোলাম এ কাওমের মধ্য থেকেই হবে।

মুহাম্মাদ বিন কাদামা বলেছেনঃ যখন মামুন এ সংবাদ পেলেন যে,আমার থেকে আবু হুযায়ফা এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন,তখন তিনি আবু হুযায়ফাকে ১০ হাজার দিরহাম পুরস্কার দিলেন।

মামুনের যুগে ২০০ হিজরীতে আদমশুমারির হিসাব অনুযায়ী বনু আব্বাসের জনসংখ্যা ছিল ৩৩ হাজার।

মামুনের যুগে যে সকল ওলামায়ে কেরাম ইন্তেকাল করেন তারা হলেন – সুফিয়ান বিন আয়নাহ,ইমাম শাফী (রহঃ), আব্দুর রহমান বিন মাহদী,ইয়াহইয়া বিন সাইদ আল কাতান,ইউনুস বাকের (মাগাযীর বর্ণনাকারী), ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) এর ছাত্র আবু মতীহ বলখী,দানশীল মারুফ কারখী,আল মুবতাদা গ্রন্থের লেখক ইসহাক বিন বশীর,ইমাম মালিক (রহঃ) এর গুরুত্বপূর্ণ ছাত্র এবং মিশরের কাযী ইসহাক বিন ফরাত,আবু উমর শিবানী,ইমাম মালিক (রহঃ) এর ছাত্র আললাগবী আশহাব,ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) এর ছাত্র হাসান বিন মীয়াদ লুলুয়ী, হাম্মাদ বিন উসামা,হাফেয রুহ বিন উবাদা,যায়েদ বিন হিব্বান,আবু দাঊদ তায়ালাসী,ইমাম মালিক (রহঃ) এর ছাত্র গাযী বিন কায়েস,প্রসিদ্ধ দানশীল আবু সুলায়মান দারানী, আলী রেযা বিন মূসা কাযেম,আরবের ইমাম ফারা,কায়তাবা বিনা মিহরান,নাহুবিদ কতরব, ওয়াকেদী, আবু উবায়দা, মুয়াম্মার বিন মুসনা, নযর বিন শামীল, সাইয়্যেদা নফীসা,কুফী নাহুবিদ হিশাম, ইয়াযিদী, ইয়াযিদ বিন হারুন,বসরার কাযী ইয়াকুব বিন ইসহাক হাযরামী,আব্দুর রাজ্জাক,আবুল আতাহীয়া,আবু আসেম,আবদুল মালিক বিন মাজশুন,আব্দুল্লাহ বিন হাকাম,আবু যায়েদ আনসারী, আসমায়ী প্রমুখ।