আল মুহতাদী বিল্লাহ

আল মুহতাদী বিল্লাহ খালীফাতুস সালিহ মুহাম্মাদ আবু ইসহাক; ভিন্ন মতে, আবু আব্দুল্লাহ বিন ওয়াসেক বিন মুতাসিম বিন হারুন রশীদ ‘ওরদাহ’ নামের বাঁদির গর্ভে ২১০ হিজরীর পর তার দাদার শাসনামলে জন্মগ্রহণ করেন।

তিনি ২৫৫ হিজরীর রযব মাসের ১৯ তারিখে তখতে খিলাফতপ্রাপ্ত হোন। মুতায সর্বপ্রথম তাকে বাইআত দেন আর নিজ খিলাফত তার উপর অর্পণ করেন। মুতাযের সামনে তাকে বসানো হয়। মুতায কাযীর সামনে সাক্ষ্য দেন। কাযী বলেন, “মুতায খিলাফত পরিচালনায় অপারগ।” মুতায্য কাষীর কথা স্বীকার করেন। মুহতাদী এ কথা শুনে বাইআতের জন্য নিজের হাত বাড়িয়ে দিলে মুতায সর্বপ্রথম বাইআত করেন। এরপর তিনি মজলিসের মধ্যভাগে এসে উপবেশন করেন।

মুহতাদী সুদর্শন,ইবাদতগুজার,দানশীল,বুদ্ধিমান,আল্লাহ তাআলার বিধানাবলী চালু করার ক্ষেত্রে বদ্ধপরিকর আর সাহসী ব্যক্তি ছিলেন। কিন্তু তার কোন সাহায্যকারী ছিল না।

খতীব বলেছেন,“মুহতাদী খলীফা হওয়া থেকে আরম্ভ করে নিহত হওয়া পর্যন্ত প্রতিদিন রোযা রাখতেন।”

হাশিম বিন কাসিম বলেছেনঃ আমি একদিন রমযান মাসে মুহতাদীর কাছে বসেছিলাম,আমি উঠে আসার ইচ্ছা করলে তিনি আমাকে বসিয়ে দিলেন। ইফতার করে তিনি নামায পড়ালেন। এরপর আবার খাবার চাইলেন। এক ডালাভর্তি খাবার এলো। এতে ছিল ময়দার রুটি,এক বাটি সিরকা আর যয়তুন তেল। তিনি আমাকে খেতে বললেন, আমি খেতে আরম্ভ করলাম। আমার মনে হল আরো খাবার আসবে। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,“তুমি কি রোযা ছিলে না ?” আমি বললাম,“ছিলাম।” তিনি বললেন,“আগামীকাল রোযা রাখবে না ?” আমি বললাম,“রমযান শরীফের রোযা কেন রাখবো না ?” তিনি বললেন,“ভালো করে খাও,তবে আর কোন খাবার আসবে না। আমার কাছে এ ছাড়া আর কোন খাবার নেই।” আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম,“আমিরুল মুমিনীন, আল্লাহ তাআলা আপনাকে অনেক নেয়ামত দিয়েছেন।” তিনি বললেন,“এটা তুমি ঠিকই বলেছো। আমি বনু উমাইয়্যার খলীফা উমর বিন আব্দুল আযীযের জীবন নিয়ে চিন্তা করেছি। তিনি স্বল্প ভোজন আর জনগণের চিন্তার কারণে পাতলা ছিলেন, যা তুমি জানো। অতঃপর আমি নিজ খান্দানের প্রতি দৃষ্টি ফিরিয়ে দারুণ মর্মাহত হয়েছি। লোকেরা আমাদের বনু হাশিম বলে। অথচ তারা যা ছিল না আমরা তা গ্রহণ করেছি, যা তুমি দেখছো।”

জাফর বিন আব্দুল ওহেদ বলেছেনঃ মুহতাদীর সাথে আলাপচারিতার এক পর্যায়ে আমি বললাম,“ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) এ কথাই বলেছেন এবং আপনার বাবা ও দাদা এ মাসয়ালার উপরই কাজ করেছেন।” তিনি বললেন,“আল্লাহ তাআলা ইমাম আহমাদের উপর রহম করুন। আমার পিতার সাথে সম্পর্কোচ্ছেদ করা জায়েয হলে সঙ্গে সঙ্গে আমি তা করতাম।” এরপর তিনি আমাকে বললেন,“সর্বদা সত্য কথা বলবে। যে সত্য কথা বলে সে আমার দৃষ্টিতে অধিক প্রিয়।”

তাফতুয়া বলেছেন যে,এক হাশেমী বৰ্ণনা করেছেন,“আমরা মুহতাদীর কাছে একটি পোশাক বক্স দেখেছি, যাতে তিনি একটি জামা আর একটি কম্বল রাখতেন। রাতে তিনি এ দুটো পড়ে নামায আদায় করতেন।”

মুহতাদী লোকদের ক্রীড়া-কৌতুক ও খেলাধুলা করতে নিষেধ করেন, এর সামগ্ৰীগুলো ফেলে দেন। গান বাজনা হারাম ঘোষণা করেন। প্রশাসকদের অত্যাচার থেকে জনগণকে রক্ষা করেন। তিনি নিজেই বিচারালয়ে বসতেন। তিনি নিজেই কেরানীদের কাছ থেকে হিসাব নিতেন। সোমবার ও বৃহস্পতিবারে অবকাশে থাকতেন। রুসার একটি দলকে বোত্রাঘাত করেন। রাফেয়ী হয়ে যাওয়ার সংবাদ পেয়ে দারুণ ঘৃণায় তিনি জাফর বিন মাহমুদকে বাগদাদে পাঠিয়ে দেন।

মুতাযের রক্তের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মূসা বিন বাগা রায় থেকে একদল সৈন্যসহ খিলাফতের রাজধানী সারমন রায়ে সালিহ বিন ওসীফকে হত্যা করার জন্য আসে। মূসার আগমন সংবাদ পেয়ে জনগণ ওসীফকে লক্ষ্য করে বললো,হে ফিরাউন, তোমার জন্য এক মূসা এসে পড়েছে। মূসা এসে খলীফার কাছে অনুমতি চাইলো, তিনি প্ৰত্যাখ্যান করলেন। সে সময় তিনি আদালতে বসেছিলেন। মূসা তার উপর জনতাকে লেলিয়ে দিলো। তার সৈন্যরা খলীফাকে একটি দুর্বল ঘোড়ায় উঠিয়ে প্রাসাদ লুণ্ঠন করে। খলীফা বললেন,“মূসা, আল্লাহ তাআলাকে ভয় করো। তোমার উদ্দেশ্য কি ?” সে বললো,“আল্লাহর কসম,আমার উদ্দেশ্য ভালো,আপনি আমাদের কাছে প্রতিশ্রুতি দিন যে,আপনি সালিহ বিন ওসীফের পক্ষপাতিত্ব করবেন না।” মুহতাদী শপথ করলেন। মূসা সদলবলে খলীফার বাইআত করলো। এরপর সালিহ বিন ওসীফের কৃত অপরাধের শাস্তি দেওয়ার জন্য তাকে ডাকা হয়। সে আত্মগোপন করে। মুহতাদী তার সাথে সন্ধি করার চেষ্টা শুরু করেন। এতে জনতার কথা বলার সুযোগ হলো যে,সালিহ কোথায় আত্মগোপন করেছে তা খলীফা জানেন। আমিরুল মুমিনীনকে অপসারণের চক্রান্ত হয়। এটা জানোতে পেয়ে মুহতাদী একদিন সকালে তলোয়ার হাতে বেরিয়ে এসে বললেন,“আমাকে মুসতায়িন আর মুতায ভেবো না। আল্লাহর কসম, আমি রাগান্বিত হলে জীবনের কোনো মায়া নেই। এটা আমার তলোয়ার,এটা আমার হাতে থাকা অবস্থায় হত্যা করেই যাবো; দ্বীন,শরম আর তাকওয়া বলতে কিছু জিনিস রয়েছে। খলীফাদের সাথে শক্ৰতা মানে আল্লাহ তাআলার বিরোধিতা করা। আমার কাছে সালিহ’র কোন সংবাদ নেই।” এ কথা শুনে লোকেরা সন্তুষ্ট হয়ে ফিরে যায়। মূসা বিন বাগা সালিহকে ধরে আনতে পারলে দশ হাজার দিনার পুরস্কার ঘোষণা করে, কিন্তু কেউ তাকে ধরে আনতে পারলো না।

গ্ৰীষ্মকাল,প্রচণ্ড গরমের কারণে এক যুবক একটি ভূগর্ভস্থ কক্ষে ঢুকে পড়ে। সেখানে সালিহকে দেখে সে চিনতে পারে। যুবকটি এসে মূসাকে জানিয়ে দেয়। সে কয়েকজন লোক পাঠিয়ে তার মাথা কেটে আনে। এতে মুহতাদী দারুণ মর্মাহত হোন। মূসা বাকিয়ালের সাথে সন-এ গেলে মুহতাদী মূসাকে হত্যা করার জন্য বাকিয়ালের কাছে লিখিত ফরমান পাঠান। বাকিয়াল তা মূসার সামনে পেশ করলে সে তেলেবেণ্ডনে জ্বলে উঠলো। সে-ই মুহতাদীকে হত্যা করার জন্য ফিরে এলো। উভয়ের মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে গেলো। একদিনেই নিহত হল চার হাজার তুর্কী,যুদ্ধ দীর্ঘায়িত খলীফার বাহিনী পরাজিত হলো। তিনি বন্দী হলেন, তাকে মেরে ফেলা হলো।

মুহতাদী ২৫৬ হিজরীর রযব মাসে নিহত হোন। এ হিসাবে তিনি পনেরো দিন কম এক বছর খিলাফতেরা তখতে সমাসীন ছিলেন। তুর্কীরা যখন মুহতাদীকে আক্রমণ করে, তখন প্রজাবৃন্দ মসজিদগুলোতে এ কথাটি লিখে ঝুলিয়ে দেয় –“হে মুসলমানগণ, উমর বিন আব্দুল আযীযের মতো ন্যায়পরায়ণ খলীফাকে সাহায্য করো এবং তার বিজয়ের জন্য আল্লাহ তাআলার কাছে প্রার্থনা করো।”