উমাইয়া মসজিদ : হাজার বছরের ইতিহাসের সাক্ষী

আবু জর

ইসলামি ইতিহাসের শুরু থেকেই সুদর্শন মসজিদ নির্মাণের প্রবণতা মুসলিম সমাজে লক্ষ করা যায়। মুসলিম সমাজে প্রচলিত রীতি অনুসারে প্রতিটি মসজিদকেন্দ্রিক মহল্লার সকল ঘরবাড়ির চেয়ে মসজিদের ভবনটি বেশি মুল্যবান কিংবা একই মানের হওয়া কাম্য। মুসলিম সমাজে এই বিধান পালিত হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। কিছু কিছু মসজিদ সভ্যতার স্থাপত্যশৈলীতে জায়গা করে নিয়েছে এক অনন্য নিদর্শন হিসেবে। কিছু মসজিদ ইতিহাসকে করেছে ঋণী। তেমনি একটি মসজিদ হলো সিরিয়ার উমাইয়া জামে মসজিদ।

দামেস্কে অবস্থিত উমাইয়া মসজিদ বা দামেস্ক গ্র্যান্ড মসজিদ বিশ্বের বৃহত্তম মসজিদগুলোর মধ্যে অন্যতম। খলিফা ওয়ালিদ ইবনে আবদুল মালিকের শাসনকালে নির্মিত এই মসজিদটি একইসাথে খোলাফায়ে রাশেদিনের পরবর্তী উমাইয়া যুগের স্থাপনা। সেদিক থেকে মসজিদটি প্রাচীনতম ইসলামি স্থাপনা-নিদর্শনসমূহের মধ্যে অন্যতম।

৬৩৬ ঈসায়িতে খলিফা হজরত উমর (রা.)-এর শাসনামলে হজরত খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা.)-এর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী দামেস্ক জয় করার পর মুসলমানরা এই স্থানে ছোট একটি মসজিদ তৈরি করেন। পরবর্তীতে প্রায় সত্তর বছর পর উমাইয়া খলিফা ওয়ালিদ বিন আবদুল মালিকের শাসনামলে ৭০৫ ঈসায়িতে এখানে নতুন করে একটি মসজিদের নির্মাণকাজ শুরু করা হয়। নয় বছর পরিশ্রমের পর ৭১৪ ঈসায়িতে মসজিদিটির নির্মাণকাজ সমাপ্ত হয়।

মসজিদে নববির অনুকরণে এই মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। নামাজের জন্য স্থান ছাড়াও এখানে বিদ্যালয়, বিচারালয় এবং নিঃস্ব, গৃহহীন ও মুসাফিরদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্রের ব্যবস্থা ছিল। মসজিদটি নির্মাণের জন্য পারসিক, ভারতীয়, উত্তর আফ্রিকান, মিসরীয়সহ বিভিন্ন স্থানের শ্রমিক ও কারিগরদের কাজে লাগানো হয়। এ সছাড়া মসজিদের দেওয়ালের বিভিন্ন মোজাইকের নকশা করার জন্য গ্রিক ও রোমান শিল্পীদের নিয়োগ করা হয়।

Image result for উমাইয়া মসজিদ

মসজিদটির দক্ষিণ-পূর্ব, দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ এবং উত্তর দিকে মোট তিনটি মিনার রয়েছে। এরমধ্যে উত্তরদিকের মাদহাত আল-আরুস বা নববধূর মিনারটি প্রাচীনতম। দক্ষিণ দিকের দুইটি মিনার পরবর্তীকালে সংযুক্ত করা হয়।

মসজিদের উপরের মূল গম্বুজটি ৩৬ মিটার উঁচু। মূল নামাজকক্ষের উপরে অবস্থিত এই গম্বুজটি ‘কুব্বাতুন নাসর’ বা ঈগল গম্বুজ নামে পরিচিত।

মসজিদে প্রবেশের জন্য উত্তর, পূর্ব ও পশ্চিমে তিনটি দরজা রয়েছে। এদের মধ্যে উত্তরের দরজাটিই মসজিদটির প্রশস্ততম প্রবেশপথ এবং এটিই মসজিদে প্রবেশের প্রধান দরজা।

খলিফা ওয়ালিদের পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে মসজিদটির বিভিন্ন সংষ্কার কাজ সম্পন্ন করা হয়। ১২৬০ ঈসায়িতে মোঙ্গলরা দামেস্ক দখল করলে তারা এই মসজিদটিকে সেনাবাহিনীর ব্যারাকে পরিণত করে। পরবর্তীতে আইন জালুতের যুদ্ধে মোঙ্গলদের পরাজিত করার পর মামলুক সুলতান সাইফুদ্দিন কুতুজ ও সেনানায়ক রুকুনুদ্দিন বাইবার্স মোঙ্গলদের হাত থেকে দামেস্ককে মুক্ত করে মসজিদটিকে পুনরুদ্ধার করেন। পরবর্তীতে রুকনুদ্দিন বাইবার্সের শাসনামলে ১২৭০ ঈসায়িতে মসজিদটিকে সম্পূর্ণ নতুনভাবে সংস্কার করা হয়।

মসজিদটির অভ্যন্তরে মূল নামাজকক্ষের বাইরে একটি প্রশস্ত আঙ্গিনা রয়েছে। আঙ্গিনার মাঝামাঝি ওজু করার জন্য একটি ফোয়ারা এবং দুইপ্রান্তে গম্বুজযুক্ত দুইটি স্থাপনা রয়েছে।

মসজিদটির অভ্যন্তরে হজরত ইয়াহইয়া (আ.)-এর কবর অবস্থিত। এ ছাড়া মসজিদটির উত্তরদিকের দেওয়ালের সাথে ক্রুসেড যুদ্ধকালীন বিখ্যাত মুসলিম সেনানায়ক সুলতান সালাহউদ্দিন আল-আইয়ুবির কবরের অবস্থান রয়েছে।

পুরাতন দামেস্ক শহরের অংশ হিসেবে মসজিদটি ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের নিদর্শন তালিকার অর্ন্তভুক্ত। তেরোশত বছরের পুরাতন এই মসজিদটি এখনো সিরিয়ার প্রতীকায়িত স্থাপত্যনিদর্শন হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।


আবু জর
সূত্রঃ fateh24