নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদিনায় আগমন করেন, তখন এখানকার ইহু্দিদের সাথে একটি শান্তি চুক্তি করেন। তিনি সর্বদা এই চুক্তির প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন।কিন্তু ইহুদিদের মনোভাব ছিলো সম্পূর্ণ উল্টো। নবীজির আগমনের পর ইসলামের ক্রমাগত উন্নতি ও শক্তি-শৌর্য দেখে তাদের মনে হিংসা ও ক্ষোভের সৃষ্টি হতো। বদর যুদ্ধে মুসলমানদের বিস্ময়কর বিজয় ইহুদিদের ক্ষোভ ও হিংসাকে আরও বাড়িয়ে তুললো। সুপ্ত এই বিদ্বেষ শেষ পর্যন্ত প্রকাশ্য হলো। তারা খোলাখুলি চুক্তিলঙ্ঘনের তৎপরতা দেখালো;—তৃতীয় হিজরিতে তাদের গোত্র বনু কায়নুকাযুদ্ধ ঘোষণা করে বসলো,বনু নাযির রাসূলকে হত্যার পাঁয়তারা ও মদিনায় বিদ্রোহ ছড়িয়ে দেওয়ার দুঃসাহস দেখালো; অবস্থাদৃষ্টে রাসূল এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেন। মদিনা থেকে তাড়িয়ে দিলেন বনু কায়নুকা ও বনু নাযিরকে। এদিকে মক্কার কুরাইশরা তো প্রথম থেকেই মদিনার ইহুদি ও মোনাফিকদের চিঠি-পত্র লিখে মুসলমানদের বিরুদ্ধচারণের ইন্ধনই জোগাচ্ছিলোই;মোটকথা, ইসলামের বিরোধিতায় তাদের পারস্পরিক কুটিলতা তাদের ভেতরে ঐক্য ও সেতু-বন্ধনের কাজ করছিলো। এই ঐক্যের ধারাবাহিক পরিণতি হিসেবেই পঞ্চম হিজরিতে গাজওয়ায়ে যাতুর রিকা, দাওমাতুল জানদাল ও বনি মুস্তালিক সংঘটিত হয়; এগুলো মূলত ছিলো একটি চরম আঘাতের পূর্বাভাস। গাজওয়ায়ে আহযাবের তোড়জোড় ও রণপ্রস্তুতি এই পূর্বাভাসেরই ফল।
গাযওয়ায়ে আহযাব
মক্কা থেকে মদিনার কেউ বাকি রইলো না, ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করার দুরভিসন্ধিতে সকলে একজোট বাঁধলো। পঞ্চম হিজরির যিলকদে সম্মিলিত বাহিনী তাদের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে একযোগে মদীনা আক্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো। দশ হাজার লোকের সমন্বয়ে গঠিতবিশাল সশস্ত্র বাহিনী মুসলমানদেরকে পৃথিবীর বুক হতে চিরতরে উচ্ছেদ করার লক্ষ্যে মদিনার দিকে অগ্রসর হলো।
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরামর্শ সভা ডাকলেন। সব শুনে হযরত সালমান ফারসি রাযিয়াল্লাহু আনহু খোলা ময়দানে বের হয়ে যুদ্ধ করা সমীচীন হবে না বলে মত প্রকাশ করলেন। তিনি মদিনার চতুর্দিকে পরিখা খননের পরামর্শ দিলেন। গৃহীত পরামর্শ মোতাবেক নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিন হাজার সাহাবাকে সাথে নিয়ে পরিখা খনন করার জন্য প্রস্তুত হলেন। ৬ দিনের মধ্যে ১০ হাত গভীর পরিখা খননের কাজ সমাপ্ত হয়ে গেলো।
এদিকে কাফেরদের সম্মিলিত বাহিনী উপস্থিত হয়ে মদিনা অবরোধ করে। শেষ চাল দেয় বনু কুরাইযা। মদিনার অভ্যন্তর থেকে তারা চুক্তি ভঙ্গ করে সম্মিলিত বাহিনীর সাথে যোগ দেয়। সম্মিলিত বাহিনীর অবরোধ আর ভেতরে বনু কুরাইযার বিদ্রোহ চরম অস্থিতিশীল অবস্থার সৃষ্টি করে; কিন্তু হলেও কাফের-বাহিনী পরিখা অতিক্রম করতে বারবার ব্যর্থ হয়; নিরাপদ ও নিরাপত্তা এ-ই ছিলো বাহ্যিক একটি দিক।
পরিখা অতিক্রম করতে না পেরে কাফের-বাহিনী তির ও পাথর বর্ষণ করতে শুরু করলো। উভয় পক্ষ হতে অবিরাম তির-বিনিময় চলতে থাকলো। অবস্থা এমন সংকটাপন্ন ও শ্বাসরুদ্ধকর ছিলো যে, সামাল দিতে দিতে নবীজির চার ওয়াক্ত নামায কাযা হয়ে গেলো।
অবশেষে মহান আল্লাহর সাহায্য এলো। কাফেরদের ধ্বংস হয়ে ঘূর্ণিময় ঝড়ো বায়ু সজোরে বাহিত হলো। কাফেরদের তাঁবুর খুঁটিসহ উড়ে গেলো, চুলার উপরে থাকাডেগ-পাতিল উল্টে পড়লো। কাফের-বাহিনী হতবুদ্ধি হয়ে গেলো। ওদিকে অবরোধে দিন পার করে তাদের রসদও ফুরিয়ে এসেছিলো। পালানো ছাড়া তাদের আর গত্যন্তর রইলো না। নিদারুণ পরাজয়ের দাগ নিয়ে তারা ফিরে গেলো…
বিবিধ ঘটনা
এ বছর হজ ফরয হয়। মদিনায় ভূমিকম্প আর চন্দ্রগ্রহণ হয় এ বছরই।
তথ্যসূত্র :আর-রাহিকুল মাখতুম, সফিউর রহমান মোবারকপুরি; সিরাতে খাতামুল আম্বিয়া, মুফতি শফি।