নবুওতের পঞ্চম বছর নবীজির জীবনের একটি তাৎপর্যবহ কাল। এ বছর তাঁকে এমন দুটি বর্ণাঢ্য সম্মানে সম্মানিত করা হয়, যা নানা বিচারে গুরুত্বপূর্ণ;—ইসরা ও মেরাজ হলো সেই দুটি অভাবিত সম্মাননা। মেরাজ একটি বিস্ময়কর ভ্রমণপর্বের নাম, যার ব্যাপ্তি এই পার্থিব জগতের সীমায় সীমিত নয়—বরং তার শুরু ও শেষ অন্য জগতের সাথে সম্পৃক্ত; পক্ষান্তরে এই ভ্রমণের আরেকটি পর্ব—অর্থাৎ ইসরা,—এর সীমারেখা এই পার্থিব জগতের সাথে সংশ্লিষ্ট। এখানে আমাদের আলোচ্য, মেরাজ।
এক রাতে জিবরাঈল ও মিকাঈল ফেরেশতাদ্বয় নবীজিকে নিয়ে পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়কর ভ্রমণ করেন; কাবার হাতিম থেকে অদ্ভুত জান্নাতি বাহন বোরাকে করে তাঁরা নিমেষে পৌঁছে যান বাইতুল মাকদিসে,—আকসা তখন নবী-রাসূলগণের অভূতপূর্ব এক সম্মিলনস্থল হয়ে ছিলো; নবীজির সম্বর্ধনায় এ ছিলো কুদরতের অভাবিত এক নেজাম; নবীজি সকল নবী-রাসূলগণ ও ফেরেশতা কর্তৃক সম্বর্ধিত হন এবং মোবারক এই জামাতের নামাযের ইমামতি করেন। নবীজি বিরলতম যে দুটি বিস্ময়কর ভ্রমণ করেছিলেন, এই পর্যন্ত এটি হলো এই ভ্রমণের প্রথম পর্ব—একে ইসরা বলে; এরপর তিনি আলমে আজায়েবের উদ্দেশে রওনা হন—ভ্রমণের এই পর্বের নাম মেরাজ—আর এটিই আমাদের আলোচনা-প্রসঙ্গ।
পৃথিবীর সফর শেষে ক্রমানুযায়ী তাঁকে আসমানসমূহে ভ্রমণ করানো হয় । প্রথম আকাশে হযরত আদম আলাইহিস সালামের সাথে সাক্ষাত হয়। দ্বিতীয় আকাশে হযরত ঈসা ও ইয়াহইয়া আলাইহিমাস সালাম, তৃতীয় আকাশে হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম, চতুর্থ আকাশে হযরত ইদরিস আলাইহিস সালাম, পঞ্চম আকাশে হারুন আলাইহিস সালাম, ষষ্ঠ আকাশে হযরত মুসা আলাইহিস সালাম এবং সপ্তম আকাশে হযরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের সাথে সাক্ষাৎ লাভ করেন।
এরপর নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিদরাতুল মুনতাহার দিকে তাশরিফ নিয়ে যান। পথিমধ্যে হাউজে কাউসার অতিক্রম করেন। অতঃপর জান্নাতে প্রবেশ করেন। সেখানে মহান আল্লাহর সেসব অপূর্ব সৃষ্টি ও বিস্ময়কর বিষয়সমূহ অবলোকন করেন, যা আজ পর্যন্ত কোনো চক্ষু দেখেনি, কোনো কান শ্রবণ করেনি এবং কোনো মানুষের চিন্তা ও কল্পনা যে পর্যন্ত পৌঁছেনি। অতঃপর জাহান্নামকে তাঁর সামনে উপস্থিক করা হলো, যা সব ধরনের শাস্তি এবং কঠোর ও তীব্র লেলিহান আগুনে ভরপুর ছিল,—যার সম্মুখে লোহা ও পাথরের ন্যায় কঠিনতর বস্তুরও কোনো অস্তিত্ব ছিলো না। সেখানে তিনি একদল লোককে দেখতে পেলেন, তারা মৃত জন্তু ভক্ষণ করছে; তিনি জানতে চাইলেন, ‘এরা কারা?’ হযরত জিবরইল বললেন, ‘এরা সেসব লোক, যারা লোকদের গোশত ভক্ষণ করতো—অর্থাৎ গিবত করত বা পরনিন্দা করে বেড়াতো।’ এখানে তিনি এছাড়াও নানা কিসিমের অপরাধীদের এবং তাদের জন্য নির্ধারিত ভিন্ন-ভিন্ন শাস্তির ভয়ালতম অবস্থা চাক্ষুষ করলেন। অতঃপর জাহান্নমের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হলো।
তারপর নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সামনে অগ্রসর হলেন এবং হযরত জিবরাঈল আমিন এখানেই থেমে গেলেন; কেননা, এরচেয়ে সামনে অগ্রসর হওয়ার অনুমতি তাঁর জন্য ছিলো না। এ সময় নবীজি মহান আল্লাহর দিদার বা দর্শন লাভ করেন। সঠিক মতানুযায়ী এই দর্শন অন্তর দ্বারা নয়, বরং চোখের দ্বারা সম্পন্ন হয়েছে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুসহ সকল মুহাক্কিক সাহাবায়ে কেরাম ও ইমামগণের অভিমতও তা-ই। সেখানে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সিজদায় লুটিয়ে পড়েন এবং মহান আল্লহর সাথে কথোপকথনের সৌভাগ্য লাভ করেন। তখনই নামায ফরয হয়। এরপর তিনি প্রত্যাবর্তন করেন।