আল মাকরীজী : যিনি ইসলামী ইতিহাস সংকলন করেছেন

জন্ম

সুলতান নাসির মুহাম্মদ ইবনে কালাঊনের শাসনকাল শেষ হয়েছে ৭৪১ হিজরি, ১৩৪১ খৃস্টাব্দে। তারপর কালের গায়ে আঁচড় কেটে চলে গেছে ২৫ বছর। কায়রো এখন সামরিক শাসনের পর্দায় আবৃত। সংঘাত নেই; বরং প্রাণপ্রাচুর্যে উচ্ছ্বল পথ প্রান্তর। গতির ছোঁয়ায় প্রতিটি মানুষ ছুটছে। তাদের এই চাঞ্চল্য দেখে কে বুঝবে, কয়েকবছর আগে ৭৪৮/৪৯ হিজরিতে কী ভয়ানক সংকট পেরিয়ে এসেছে তারা? একদিকে ৭৪১ হিজরিতে সদ্যই শেষ হয়েছে সুলতান নাসির মুহাম্মদের শাসনকাল, এখনো মানিয়ে নিতে পারেনি সামরিক শাসনের সাথে, অন্যদিকে তখনই প্লেগ মহামারি বাতাসের ডানায় ভর করে ছড়িয়ে পড়েছে মধ্যপ্রাচ্যে, ইউরোপে–সবখানে। টিকতে না পেরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো দুই মিলিয়ন মানুষ। তারা রাজনৈতিক সংকট মোকাবেলা করবে না মানবিক সংকট? প্রশ্নটি অস্থির করে তুলেছিলো সবাইকে।

সময়ের সঙ্গে সংকট কেটে গেছে। এখন ৭৬৬ হিজরি, ১৩৬৫ খৃষ্টাব্দ। জীবনের তাগিদে, কর্মের প্রয়োজনে চঞ্চল এখন কায়রো। বা’লাবাক্ক জেলার মাকরিজ এলাকা থেকে কনস্ট্রাকশনের কাজ করতে এই চঞ্চল শহরে এসে উঠলেন সাধারণ একজন লোক। পরিবার নিয়ে থাকতে শুরু করলেন জামালিয়া জেলার বার্জাওয়ান একাকায়। এই সাধারণ লোকটির ঘর আলো করে একদিন পৃথিবীতে এলো একটি চাঁদ। মা -বাবা দুজন মিলে তাঁর নাম রাখলেন—আহমাদ। পুরো নাম—আহমাদ ইবনে আলী আল মাকরিজি।

পড়াশোনা

শৈশব পেরিয়ে কৈশোর; কৈশোর পেরিয়ে তারুণ্য। কোরআন হিফজ শেষ করে নিয়েছেন দরসে হাদিসের পাঠ। বিজ্ঞান নিয়ে ঘাটাঘাটি, ইতিহাস নিয়ে পড়াশশোনা, নতুন কিছু উদ্ভাবনের প্র্যাকটিস হয়ে উঠলো তাঁর সবচে প্রিয় কাজ। কায়রো তখন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এগিয়ে। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের এক কেন্দ্রও বটে। ডরিস আবু সেফ এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘শিক্ষা এবং বিজ্ঞান গবেষণায় মিসর তখন এতটাই এগিয়ে গিয়েছিলো, প্রতি তিনজন সাধারণ মানুষের মধ্যে একজন গবেষক পাওয়া যেত।’

এই পরিবেশে মাকরিজি পড়লেন ফেকাহ, হাদিস, সাহিত্য, অলংকার শাস্ত্রসহ আরও অনেক শাস্ত্র। আল্লামা সাখাভী রহ. গুনে দেখিয়েছেন মাকরিজির শিক্ষকের সংখ্যা ৬০০। শিক্ষকের আধিক্য থেকেই প্রতীয়মান হয়, কত ইলম অর্জন করেছেন তিনি। কিন্তু সব ছাপিয়ে তার মন-মগজ দখল করে নিলো ইতিহাস। ইতিহাস। ইতিহাস।

সুলতান বারবুক ৭৮৪ হিজরিতে ক্ষমতার মসনদে আরোহণ করলে মরক্কো থেকে মিসরে চলে আসেন ঐতিহাসিক ইবনে খালদুন। বারবুক তাকে রাজ্যের কাজির দায়িত্বে নিয়োগ দেন। মাকরিজি যাদের সঙ্গে দেখা করেছেন এবং ইলম অর্জন করেছেন, তাদের মধ্যে প্রচণ্ড দুর্বল ছিলেন ইবনে খালদুনের প্রতি। তিনি ‘আস সুলুক’ গ্রন্থে ইবনে খালদুনকে ‘শাইখুনা’ তথা আমাদের মুরুব্বি বলে সম্বোধন করেছেন। ‘আল খুতাত’ গ্রন্থে ইবনে খালদুনের নাম নিতে গিয়ে বলেন, ‘আমাদের মুরুব্বি, শিক্ষক, আলেম, কাজিদের কাজি, অলিউদ্দিন আবু যায়েদ আবদুর রহমান ইবনে মুহাম্মদ ইবনে খালদুন হাজরামি ইশবিলি।’

নানা শামসুদ্দিন ইবনে সায়াগ ছিলেন হানাফি মাজহাবের ফকিহ। কিন্তু বাবা-দাদার অনুসরণ নয়, নিজ বিবেচনায় বিশ বছর বয়সে মাকরিজি আপাদমস্তক হয়ে উঠলেন শাফেয়ী মাজহাবের অনুসারী।

কর্মের ময়দানে

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠলেন মাকরিজি রহ.। রাজনীতি এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের অঙ্গনে শাঁই শাঁই করে উঠলো তাঁর নাম-যশ। তখন কায়রোর হিসাব বিভাগের দায়িত্ব নিলেন তিনি। তাঁর প্রধান কাজ ছিলো বাজার নিরীক্ষণ এবং জনসাধারণের নৈতিক দিক পর্যবেক্ষণ। তারপর উত্তর কায়রোর জামে’ হাকিমির দেখাশোনার দায়িত্ব নেন। এরপর জামে’ আমর ইবনুল আসে লেকচারারের দায়িত্ব পান। তখন কাজির দায়িত্ব নেবার জন্য তাকে অফার করা হয়, তিনি দ্বিধাহীনভাবে তা প্রত্যাখ্যান করেন।

দামেশকের বিভিন্ন মাদরাসায় তিনি শিক্ষকতা করেছেন। দামেশকের নুরুদ্দিন মাহমুদ হসপিটালের দায়িত্বও পালন করেছেন কিছুদিন।

১৪৩০ হিজরিতে মাকরুজি সপরিবারে হজ করার জন্য মক্কায় যান। পবিত্র মদিনায় পুরো পাঁচ বছর থাকেন। হাদিসের পাঠদান এবং ইতিহাস সংকলনে ব্যস্ত থাকেন। একসময় শিক্ষকতা ছেড়ে দেন। ঐতিহাসিক রচনাগুলো সম্পন্ন করার জন্য এ’তেকাফের নিয়ত করেন। যেন মনোযোগ বিচ্ছিন্ন না হয়, কেবল মন জমে থাকে ইবাদাতে, আমলে, রচনায়। বাস্তবিক অর্থে তার এই পদক্ষেপ দারুণ কাজ দিয়েছিলো। অনেক রচনার কাজ সম্পন্ন করেছিলেন এই সময়ে।

রচনাবলী

প্রায় দুইশো কিতাব লিখেছেন মাকরিজি রহ.। এরমধ্যে ইতিহাস বিষয়ে লিখিত কিতাব সবচে বেশি। তাঁর সবচে গুরুত্বপূর্ণ কিতাব—’ইকদু জাওয়াহিরিল আসফাত মিন আখবারি মাদিনাতিল ফুসতাত’। এই কিতাবে মিসরে ইসলাম বিজয়ের পর থেকে ফাতেমি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার আগের সময়ের ইতিহাস বলা হয়েছে। ফাতেমি শাসনকালের ইতিহাস তুলে এনেছেন ‘ইত্তিআজুল হুনাফা বিআখবারিল আইম্মাতিল ফাতিমিয়্যিনাল খুলাফা’ কিতাবে। ফাতেমি শাসনামলের পর থেকে তাঁর বর্তমান কাল পর্যন্ত সময়ের ঐতিহাসিক আলাপ করেছেন ‘আস সুলুক লি মা’রিফাতিল মুলুক’ কিতাবে।

তাঁর ঐতিহাসিক অন্যান্য কিতাবগুলো হলো—’আল বয়ান ওয়াল ই’রাব আম্মা ফি আরদি মিসরা মিনাল আ’রাব’ ‘আল ইলমাম ফিমান তাআখখারা বিআরদিল হাবশাতি মিন মুলুকিল ইসলাম’ ‘আত তুরফাতুল গারিবাহ ফি আখবারি হাজরামাউতিল আজিবাহ’ ইত্যাদি।

এইসব কিতাগুলোতে তিনি তাঁর পূর্বকালের ইতিহাস বিধৃত করেছেন। যে সমস্ত ঐতিহাসিক গ্রন্থগুলোর ওপর নির্ভর করে তিনি কিতাব লিখেছেন, তার অধিকাংশই এখন বিলুপ্ত। তাই মাকরিজির কিতাবগুলোর গুরুত্ব বেড়ে গেছে শতগুণ। বিশেষ করে তাঁর কিতাব ‘আল মাওয়াইয ওয়াল ই’তিবার বিযিকরিল খুতাতি ওয়াল আছার’ মধ্যযুগীয় সময়ে কায়রোর বৃহত্তম এক টপোগ্রাফিক (স্থান বিবরণ সম্বন্ধীয়) কাজ।

ইতিহাসের পাশাপাশি অর্থনীতিতেও আগ্রহ ছিলো মাকরিজি রহ. এর। এই আগ্রহের বিচ্ছুরণ ঘটেছে তার কিতাবে, বিশেষ কাউকে লেখা চিঠিতে। এ বিষয়ে লিখিত তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কিতাবগুলো হলো—’ইগাসাতুল উম্মাহ বিকাশফিল গুম্মাহ’ ‘আল আওযান ওয়াল আকইয়ালুশ শরইয়্যাহ’ ‘শুযুযুল উকুদ ফি যিকরিন নুকুদ’ ইত্যাদি।

সবসময় তিনি পণ্যের দাম এবং মুদ্রাস্ফীতির দিকে লক্ষ রাখতেন। বর্তমান কালের অর্থনৈতিক সংকটের কারণ অনুসন্ধান করে জানতেন। সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা করতেন। তাই ফকিহ এবং আলেমদের জন্য যেমন কিতাব লিখেছেন তেমনি ব্যবসায়ীদের জন্যও কিতাব লিখেছেন।

ইন্তেকাল

মাকরিজি রহ. ছিলেন ইতিহাস-প্রেমিক। পুরো জীবনটাই ব্যয় করেছেন ইতিহাসের পাঠদান, সংকলন, বিভিন্ন উৎস থেকে একত্রিতকরণে। ইবনে হাজার রহ. বলেন, ‘ইতিহাসের সঙ্গে খুব বেশি সম্পৃক্ত থাকার কারণে তিনি অনেক কিছুই মুখস্থ বলতে পারতেন। তিনি ছিলেন দক্ষ ইমাম, বিজ্ঞ পণ্ডিত।’

মাকরিজির ছাত্র জালালুদ্দিন ইবনে তিগরি বারদি বলেন, ‘তিনি ছিলেন বিশেষজ্ঞ ইমাম। নিজ হাতে অনেক কিতাব লিখেছেন। অনেক কিছু পড়াশুনা করেছেন। যাচাই বাছাই করে কিতাবে জমা করেছেন। এতটাই প্রসিদ্ধি পেয়েছেন তিনি, এখন তাকে দিয়ে উদাহরণ দেয়া হয়। ভালো বক্তৃতা দিতে পারতেন। বিশেষ করে আলেম-উলামা এবং রাজা-বাদশাহদের বিষয়ে। তিনি ইবাদতে ডুবে থাকতেন। প্রয়োজন ছাড়া কারো সঙ্গে কথা বলতেন না।’

এমন ইবাদতের মগ্নতা এবং ইলমি মনোনিবেশেই কেটেছে তাঁর পুরো জীবন। পাতায় পাতায় ইতিহাসের সৌরভ ছড়িয়ে এ মহান ঐতিহাসিক ৮৪৫ হিজরির ২৬ রমজান, ১৪৪১ খৃস্টাব্দে পাড়ি জমান জীবনের ওপারে। যেখানে জান্নাত, প্রভুর সঙ্গে সাক্ষাতের আয়োজন।

আল জাজিরা অবলম্বনে


রাকিবুল হাসান
সূত্রঃ fateh24