আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেছেন,
‘নিশ্চয় আমিই কুরআন নাজিল করেছি আর আমিই তা হেফাজত করব।’ (সূরা হিজর)
এটাই একমাত্র আসমানী কিতাব যার হেফাজতের দায়িত্ব আল্লাহ তাআলা নিজে গ্রহণ করেছেন। এটা আসমানী ওয়াদা। আর কুরআনের ঘোষণা হল,
‘আল্লাহ কখনও ওয়াদা ভঙ্গ করেন না।’ (সূরা আলে ইমরান)
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর এ ওয়াদা পূর্ণ করেছেন এবং তাঁর কিতাব হেফাজতের বিস্ময়কর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। ফলে কুরআনের শব্দ সংরক্ষিত, অর্থ সংরক্ষিত, লিখনপদ্ধতি সংরক্ষিত, কুরআনের আমলিরূপ সংরক্ষিত, যে ভাষায় কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে সে ভাষা সংরক্ষিত, এর পরিবেশ-পারিপার্শ্বিকতা সংরক্ষিত, যে মহান ব্যক্তিত্বের ওপর তা অবর্তীণ হয়েছিল তাঁর জীবনচরিত সংরক্ষিত, এমনকি যাদেরকে সম্বোধন করে তা অবতীর্ণ হয় তাদের জীবনেতিহাস পর্যন্ত সংরক্ষিত আছে। মোটকথা, আল্লাহ তাআলা কুরআনে কারীম হেফাজতের জন্য যত উপায় হতে পারে সকল উপায়ে তা সংরক্ষিত হয়েছে। এভাবে এই পবিত্র কিতাব সর্বদিক থেকে পূর্ণাঙ্গরূপে সংরক্ষিত হয়ে গেছে। আলহামদুলিল্লাহ, আজ চৌদ্দ শতাধিক বছর পরেও এতে বিন্দু পরিমাণ পরিবর্তন-পরিবর্ধনের আঁচড় লাগেনি। লাখো চেষ্টা ও অপচেষ্টা করা হয়েছে কিন্তু কোনোটিই সফল হয়নি। আর কেয়ামত পর্যন্ত হবেও না।
কুরআনে কারীম কীভাবে হেফাযত করা হয়েছে?
কুরআনে কারীম হেফাযতের লক্ষে নয়টি জিনিস হেফাযত করা হয়েছে, নিম্নে সে বিষয়ে আলোচনা করা হল :
এক. কুরআনের মতন অর্থাৎ হুবহু ওই শব্দগুলো যা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ওহীর মাধ্যমে আখেরী নবীর ওপর অবতীর্ণ করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর যখন ওহী নাজিল হত তখন তিনি সঙ্গে সঙ্গে ওহী-লেখক কোনো সাহাবীর দ্বারা তা লিখিয়ে নিতেন। এরপর সাহাবায়ে কেরাম রাসূল সা. এর পবিত্র যবানে তা শুনতেন এবং মুখস্থ করে ফেলতেন। এভাবে তেইশ বছর পর্যন্ত কুরআন নাযিলের সময়ই তা লিখে রাখা হত। এবং সাহাবায়ে কেরাম তা মুখস্থ’ও রাখতেন। কেননা নবী করীম সা. কুরআন হিফজের বিশেষ ফযিলত বর্ণনা করেছেন। এক বর্ণনা মোতাবেক সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে সর্বপ্রথম পূর্ণাঙ্গ কুরআনে কারীম হিফয করেন হযরত উসমান ইবনে আফফান রা.। নবী-যুগের পর হযরত আবু বকর রা.-এর খিলাফতের আমলে হযরত ওমর রা. এবং অন্যান্য সাহাবায়ে কেরামের পরামর্শক্রমে কুরআনে কারীম একত্রে সংকলন করা হয়। আর হযরত উসমান রা.-এর যুগে তা এক মুসহাফে বাঁধাই করে একাধিক নুসখা তৈরি করা হয়। অর্থাৎ এর বিভিন্ন অনুলিপি তৈরি করে কুফা, বসরা, সিরিয়া, মক্কা অর্থাৎ মুসলমানদের কেন্দ্রীয় শহরগুলিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এটা তো হল লিখিত আকারে হেফাযত। এ ছাড়াও শব্দে শব্দে মুখস্থ করার ব্যাপারেও উৎসাহিত করা হয়। এভাবে কুরআন সীনায় ও লিখনি উভয়ভাবে সংরক্ষিত হয়ে যায়। আর এই ধারাবাহিকতা বংশানুক্রমে আজও জারী আছে। কেয়ামত পর্যন্ত জারী থাকবে ইনশাআল্লাহ।
দুই. আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনের শব্দাবলি যেমন হেফাযত করেছেন, তেমনি এর অর্থ ও মর্ম হেফাযতেরও ব্যবস্থা করেছেন। কারণ শুধু শব্দাবলি সংরক্ষিত থাকাটা যথেষ্ট নয়। অর্থ ও মর্মার্থ হেফাযত না হলে এর বিকৃতি ও অপব্যাখ্যা অনেকটা অবধারিত। পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবসমূহের ক্ষেত্রে এমনই হয়েছে। সেগুলোতে যেমন শব্দের বিকৃতি ও প্রক্ষেপ ঘটেছে তেমনি অর্থগত বিকৃতি ও অপব্যাখ্যাও হয়েছে। কেননা, শব্দের মতো মর্মের সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা কার্যকর হয়নি। তারা তাদের নবীদের কথা, কাজ ও জীবনী সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। ফলে ছিঁটে ফোটা কিছু শব্দ কোথাও থেকে গেলেও তা কোনো কাজে আসেনি। উদাহরণস্বরূপ খৃষ্টধর্মের কথা বলা যায়। তারা বলে থাকেন, আমাদেরকে দুটি মৌলিক বিষয়ের শিক্ষা দেওয়া হয়েছে এবং আমরা এর ধারক-বাহক : ১. ন্যায় ও সুবিচার, ২. মহব্বত ও ভালবাসা। কিন্তু আপনি যদি তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন যে, ন্যায় ও সুবিচার অর্থ কী? তারা এর মর্মার্থ বয়ান করতে পারবে না। একই অবস্থা মহব্বত ও ভালবাসার ক্ষেত্রেও। ফলে লাখো নয়, কোটি মানুষকে খৃষ্টবাদে দীক্ষিত না হওয়ার কারণে নির্দয়ভাবে তারা হত্যা করে দিয়েছে। আর এর ধারাবাহিকতা আজো পর্যন্ত থামেনি। এমনিভাবে ইহুদী ধর্মের মৌলিক বুনিয়াদ হল, তোমরা তোমাদের প্রতিবেশীদের জন্য সেটাই পছন্দ কর যা নিজেদের জন্য পছন্দ করে থাক। কিন্তু আপনি যদি ইহুদীদের ইতিহাস অধ্যয়ন করেন তাহলে জানতে পারবেন যে, তারা তাদের প্রতিবেশীদের যত কষ্ট দিয়েছে এত কষ্ট দুনিয়ার আর কেউ তাদের প্রতিবেশীদের দেয়নি। সে ধারা আজো বহমান, যা ইসরাইলী বর্বরতার মাধ্যমে কিছুটা প্রকাশ পাচ্ছে। পক্ষান্তরে ইসলাম, সুন্নাতে নববীর দ্বারা নিখুঁতভাবে সংরক্ষিত অর্থাৎ সম্পূর্ণ কুরআনী শিক্ষা সুন্নতে নববীর দ্বারা সুস্পষ্টরূপে ব্যাখ্যাত হয়ে সংরক্ষিত হয়ে আসছে। এমনিভাবে আল্লাহ তাআলা সুন্নাতে রাসূল দ্বারা অর্থ, মর্মার্থ ও প্রভুর উদ্দেশ্য হেফাযতের ব্যবস্থা করেছেন। কারণ নবী করীম সা. কুরআনের যে তাফসীর করেছেন, যাকে ‘তাফসীর বিল মাছুর’ বলা হয়, যার ওপর ইমাম সুয়ূতী, ইমাম ইবনে কাসীর প্রমুখ অসংখ্য ওলামায়ে কেরাম তাফসীর লিখেছেন, প্রতিটি আয়াতের তাফসীর হাদীসে রাসূল দ্বারা করে দেখিয়েছেন, তা মূলত আল্লাহরই পক্ষ থেকে। কেননা কুরআনে বলে দেয়া হয়েছে, ‘এ কুরআনের ব্যাখ্যাও আমি আমার জিম্মায় নিয়েছি।’ (সূরা কিয়ামাহ) অন্যত্র আছে, ‘কুরআন জমা করার দায়িত্বও আমার।’ অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘(মুহাম্মদ সা.) কোনো কথা নিজের প্রবৃত্তি থেকে বলেন না। বরং এসব কিছু আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী।’ উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, তাফসীর বিল মাছুর মূলত আল্লাহর পক্ষ হতে কৃত তাফসীর। আর একথা স্পষ্ট যে, আল্লাহই তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে সম্যক অবগত। সুতরাং হাদীসের হেফাযত দ্বারা আল্লাহর কালামের অর্থ ও মর্মও সংরক্ষিত হয়ে গেছে। আল্লাহ আমাদেরকে কিতাবুল্লাহ ও সুন্নতে রাসূলের ওপর অটল থাকার তাওফীক দিন।
তিন. কুরআনের শব্দ ও অর্থের পাশাপাশি তা যে ভাষায় নাযিল হয়েছে অর্থাৎ আরবী ভাষা, তা-ও সংরক্ষিত। এর জন্যও আল্লাহ তাআলা আশ্চর্য ব্যবস্থা করেছেন। আপনি যদি বিভিন্ন ভাষার ইতিহাস অধ্যয়ন করেন তাহলে দেখবেন, দুনিয়ার কোনো ভাষা তিন চারশ বছরের বেশি টিকে থাকেনি। হয়ত ভাষাটি বিলুপ্ত হয়ে গেছে কিংবা অন্য কোনো ভাষার সঙ্গে মিশে গেছে। অথবা এত পরিবর্তিত হয়ে গেছে যে, আগের নিয়মে এর পাঠোদ্ধার করা সুকঠিন। কিন্তু আরবী ভাষা মুসলমানদের এমন যত্ন ও মনোযোগ লাভ করেছে যা বলে শেষ করার নয়। প্রথমত নবী করীম সা. নিজে সাহাবায়ে কেরামের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে আরবী ভাষার বিশুদ্ধতার প্রতি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছেন। এরপর সাহাবায়ে কেরামও এদিকে মনোনিবেশ করেছেন। যেমন হযরত আবু বকর রা., হযরত ওমর রা. প্রমুখ সাহাবীর জীবনচরিত অধ্যয়ন করলে জানা যায়। এমনকি হযরত আলী রা. তো আরবী ভাষায় ছরফ ও নাহু শাস্ত্রের উদ্ভাবন করে তাকে মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেন। তাঁর পরে উম্মতের এমন একটি শ্রেণী অস্তিত্ব লাভ করে যারা তাদের গোটা জীবন এ ভাষার সংরক্ষণ ও বিকাশের জন্য ওয়াকফ করে দিয়েছেন। আবুল আসওয়াদ দুয়ালী, ইমাম সিবাওয়াইহ, ইমাম খলীল ফারাহেদী, ইমাম কিসায়ী, ইমাম ফাররা, ইমাম মুবাররাদ, ইমাম আখফাশ, ইমাম সা’লাব, ইমাম ইবনে হাজিব, ইমাম ইবনে হিশাম, ইমাম ইবনে আকীল, ইমাম ইবনে জিন্নী প্রমুখ তাদের গোটা জীবন ছরফ, নাহু, বায়ান তথা আরবী ভাষার জন্য ওয়াকফ করে দিয়েছেন। যার বরকতে আরবী ভাষা আজও ওই অবস্থায় টিকে আছে যে অবস্থায় ছিল কুরআন নাযিলের সময়। কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত যতক্ষণ আল্লাহ তাআলা কুরআনকে টিকিয়ে রাখতে চান-উম্মতের একটি জামাত এ মহৎ কাজে মশগুল থাকবে ইনশাআল্লাহ। চার. শুধু শব্দ, অর্থ এবং কুরআনী ভাষার হেফাযতের উপরই নির্ভর করা হয়নি; বরং এর প্রায়োগিকরূপ সংরক্ষণেরও পুরোপুরি ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর পদ্ধতি হলো, কুরআন যে শব্দে অবতীর্ণ হয়েছে নবী করীম সা. এর মর্মার্থ ওহীর আলোকে সাহাবায়ে কেরামকে বুঝিয়েছেন। এরপর তা বাস্তবে প্রয়োগ করে দেখিয়েছেন। আজকের ভাষায় বললে ‘থিউরির সঙ্গে প্র্যাকটিক্যাল মুসালসাল। যেমন নামাযের ব্যাপারে কুরআনে শুধু বলা হয়েছে, ‘তোমরা সালাত আদায় কর।’ কিন্তু কুরআনের কোথাও বিস্তারিত ও ধারাবাহিকভাবে নামাযের পদ্ধতি উল্লেখ করা হয়নি। কোথাও কিয়াম, কোথাও রুকু, কোথাও সেজদার কথা বিচ্ছিন্নভাবে আছে। নবী করীম সা. এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা সাহাবায়ে কেরামকে বলেছেন। এরপর বাস্তবে আদায় করে দেখিয়েছেন এবং বলেছেন, ‘তোমরা নামায আদায় কর এমনভাবে যেমন আমাকে নামায আদায় করতে দেখেছ।’ সাহাবায়ে কেরাম সেভাবেই করেছেন। রাসূলের পরও তারা এর ওপর আমল অব্যাহত রেখেছেন। এরপর তাবেয়ীরাও সাহাবায়ে কেরামের মতোই করেছেন। এরপর তাবে তাবেয়ীন ও প্রতি যুগের মনীষী ও মুসলিম উম্মাহ যুগের পর যুগ এভাবে আমল করে আসছে। এভাবে আমলের বাস্তব রূপটাও সংরক্ষিত হয়ে গেছে। এটা তো একটি উদাহরণ, এছাড়াও সালাতুল ঈদ, সালাতুর জানাযা, যাকাত, সদকা, কুরবানী, কুরআন তেলাওয়াত সবগুলোরই প্রায়োগিক রূপ আজ পর্যন্ত উম্মতের মাধ্যমে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হেফাযত করেছেন। এজন্য যখন কেউ কুরআনের তাফসীর ও ব্যাখ্যায় মনগড়া কিছু করার অপচেষ্টা করে তখন উম্মতের মধ্যে তা গ্রহণযোগ্যতা পায় না। তবে কিছু লোক যারা কায়েমী স্বার্থবাদী অথবা যাদের ইসলামের প্রকৃত দীক্ষা হাসিল হয়নি অথবা প্রয়োজনীয় ইলমে দীন নেই-তারা ওই লোকদের অনুসারী হয়ে যায়। আরবীতে একটি প্রবাদ আছে, ‘পড়ে থাকা প্রতিটি বস্তু কেউ না কেউ উঠিয়ে নেয়।’ মোটকথা, কুরআনের মর্মার্থ ও উদ্দেশ্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীন উম্মাহর ধারাবাহিক আমলের মাধ্যমেও হেফাযত করেছেন। বস্তুত দুনিয়ার কোনো শক্তি আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সিদ্ধান্তে প্রতিবন্ধক হতে পারবে না। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ তাআলা প্রতিটি বিষয়ে বিজয়ী, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না।’ (সূরা ইউসূফ)
পাঁচ. আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার কিতাব সংরক্ষণের জন্য এমন এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন যে, চিন্তার গতি থমকে যায়। এবং মানুষ তাঁর অলৌকিক কর্ম-কুশলতায় অভিভূত হয়ে যায়। এর একটি দৃষ্টান্ত হল, যে পরিবেশে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছিল এবং কুরআনের আয়াতগুলো নাযিল হওয়ার যে প্রেক্ষাপট ছিল সেই পরিবেশ ও প্রেক্ষাপটকে পর্যন্ত অমরত্ব দান করেছেন। হাদীসের বিশাল ভাণ্ডার সেই সম্পূর্ণ পরিবেশ, আমাদের চোখের সামনে মূর্ত করে দিয়েছে। হাদীসের কোনো ছাত্র যখন তা পাঠ করে তখন সেই দৃশ্য জীবন্ত হয়ে সামনে এসে যায়। একটি দৃষ্টান্ত দিচ্ছি : এক ধরনের হাদীস আছে যাকে পরিভাষায় ‘হাদীসে মুসালসাল’ বলা হয়; এর অর্থ হল, যখন বর্ণনাকারী হাদীসটি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছ থেকে শুনেছেন অথবা তাঁকে সেই কাজ করতে দেখেছেন তখন যে অবস্থা ছিল, বর্ণনা করার সময়ও ওই অবস্থা অনুসরণ করা। উদাহরণস্বরূপ, ‘হাদীসে মুসালসাল বিত-তাশবীক’ এর কথা বলা যায়। তা এই যে, একবার নবী করীম সা. সাহাবায়ে কেরামের সামনে গোনাহ ও তওবার সময় ঈমানের অবস্থার বর্ণনা দিচ্ছিলেন। তিনি বলেন, বান্দা যখন গোনাহ করে তখন ঈমান তার দিল থেকে চলে যায়। আর যখন তওবা করে তখন পুনরায় তা প্রবেশ করে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের হাতের আঙ্গুলগুলো আলাদা করে বললেন, গোনাহের সময় ঈমান এভাবে বেরিয়ে যায়। আর যখন তওবা করে পুনরায় তা ফিরে আসে-একথা বলার সময় এক হাতের আঙ্গুল অন্য হাতের আঙ্গুলের মাঝে প্রবেশ করালেন (যাকে আরবীতে তাশবীকুল আসাবিঈ বলে)। সাহাবায়ে কেরাম যখন এ হাদীস বর্ণনা করেন তখন তারাও তেমনি করেছেন যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে করতে দেখেছেন। এভাবে হাদীসটি বর্ণনার সময় আঙ্গুল দ্বারা ওই অবস্থা দেখানোর ধারাবাহিকতা আজ পর্যন্ত চলে এসেছে। বক্তব্য বোঝানোর জন্য এই অনুকরণের তেমন প্রয়োজন না থাকলেও এতে এই ফায়দা আছে যে, এর দ্বারা মানুষ ওই পরিবেশে চলে যায় যে পরিবেশে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। যে স্থানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ হাদীস বর্ণনা করেছিলেন, মনে হতে থাকে যে, আমি সেখানে স্বশরীরে বিদ্যমান। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এই আমলকে সাহাবা, তাবেয়ীন, তাবে তাবেয়ীন এবং হাদীসের উস্তাদ-শাগরেদদের মাধ্যমে দেখে এসেছি। ঠিক এমনি অবস্থা ‘আসবাবে নুযুলে আয়াত’ বলার ও শোনার সময়ও হয়ে থাকে। সববে নুযুল বলা হয় হাদীসে উল্লিখিত ওই সব ঘটনাকে যা কোনো আয়াত নাযিলের সময় সংঘটিত হয়েছিল। এর দ্বারা কুরআনের ভাবার্থ বোঝার ক্ষেত্রে বড় সহযোগিতা পাওয়া যায়। কেননা আয়াত নাযিল হওয়ার কারণ ও প্রেক্ষাপট যখন জানা যাবে তখন এতে আলোচিত আহকামের স্তরও বুঝা যাবে। যদিও এটা জরুরী নয় যে, প্রতিটি আয়াতেরই শানে নুযুল থাকবে, তবুও ওলামায়ে কেরাম এর ওপর স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনা করেছেন। যেমন ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী, ইমাম ওয়াহেদী প্রমুখ।
ছয়. কুরআনে কারীম সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে সীরাতে নববী তথা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবনচরিত সংরক্ষণের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। কেননা স্বয়ং নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআন মোতাবেক আমল করে দেখিয়ে দিয়েছেন, যাতে পরবর্তী কেউ বলতে না পারে যে, কুরআন মোতাবেক আমল করা কঠিন। অতএব আমরা তা করতে পারব না। এজন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমল করে দেখিয়ে দিয়েছেন। আর আমলও এমন পর্যায়ের যেভাবে আমল করা চাই। তাই তো হযরত আয়েশা রা.-কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আমলের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি উত্তরে বলেছিলেন, ‘তোমরা কি কুরআন পড়নি?’ সাহাবায়ে কেরাম বললেন, হ্যাঁ। আয়েশা রা. বললেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআনের জীবন্ত নমুনা ছিলেন।’ যখনই কোনো আহকাম নাজিল হত তিনি সবার আগে এর ওপর আমল করতেন। এজন্যই কুরআন ঘোষণা দিয়েছে, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবনে তোমাদের জন্য রয়েছে উত্তম নমুনা।’ (সূরা আহযাব) দুনিয়ার কোনো ব্যক্তিত্বের ওপর এত কাজ হয়নি যত কাজ হয়েছে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর। আর এখনও অনবরত হচ্ছে। আজও এর ফায়দায় কোনো কমতি অনুভব করা যাচ্ছে না। উপরন্ত এর ফায়দা শুধু দিনদিন বেড়েই চলেছে। হে আল্লাহ! তুমি আমাদেরকে রাসূলের প্রতি আনুগত্যশীল ও তাঁর প্রকৃত অনুসারী বানিয়ে দাও।
সাত. নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র সত্তাকে আল্লাহ তাআলা তার আখেরী কিতাব কুরআন নাযিলের জন্য মনোনীত করেছেন এবং তাঁর জন্য আখেরী দীন-দীনে ইসলামকে নির্বাচন করেছেন। কুরআনের সত্যতা টিকিয়ে রাখার জন্য এবং এর উচ্চ মর্যাদা প্রমাণ করার জন্য যিনি কুরআনের বাহক তার মর্যাদা ও সম্মান অক্ষুণ্ন রাখাও অনিবার্য ছিল। আল্লাহ তাআলা এর জন্য বিস্ময়কর ব্যবস্থা করেছেন। প্রথমত তাঁর বংশ মোবারককেও সংরক্ষণ করেছেন। আরবের লোকেরা যদিও উম্মী ছিল, লেখাপড়া জানত না, তবুও বংশপরম্পরা স্মরণ রাখার প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করত। পরবর্তী সময়ে এটি এক স্বতন্ত্র শাস্ত্রের মর্যাদা লাভ করে। ইলমুল আনসাব বা নসব-শাস্ত্র এমন এক রেকর্ড যাতে বংশ ও বংশ ধারা সংক্রান্ত বিস্তারিত বিবরণ সংরক্ষণ করা হয়। কেউ হয়তো বলতে পারেন, আরবদের এ বিষয়ে বিশেষ ঝোঁক থাকতে পারে। অথবা এ ধরনের ভাণ্ডার সংরক্ষণে তারা উৎসাহী ছিল। ড. মাহমুদ আহমদ গাজী এ সম্পর্কে বিস্ময়কর এক তথ্য দিয়েছেন। তিনি লেখেন, ‘যখন আমরা নসবশাস্ত্রের কিতাবাদি পর্যালোচনা করি তখন এমন একটি বিষয় আমাদের সামনে আসে, যা অতি মাত্রায় আশ্চর্যের। একে নিছক কাকতালীয় বলা যাবে না। তা এই যে, এ বিষয়ে যত জ্ঞানভাণ্ডার আমাদের সামনে আসে তা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ব্যক্তিত্ব ও তাঁর বংশকে ঘিরেই আবর্তিত। অথচ যে সময় বংশ পরম্পরা সংরক্ষণের কাজ শুরু হয় ওই সময় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জন্মই গ্রহণ করেননি। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা এই ছিল যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বংশ পরম্পরা পূর্ণাঙ্গ ও সবিস্তরে হেফাযত করবেন, যাতে তাঁর পূর্বপুরুষদের উঁচু মর্যাদা পরিস্ফুট হয় এবং তাদের নিষ্কলুষতার দ্বারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বংশীয় সম্ভ্রান্তা প্রমাণিত হয়। আর এতে কুরআনের বাহকের শানও কুরআনের মতোই উচ্চতর প্রমাণিত হয়। এছাড়া চেতনাসম্পন্ন ও বুদ্ধিমান কারো জন্য তাঁকে মিথ্যারোপ করার কোনো অবকাশ যেন থেকে না যায়। হ্যাঁ, যাদের মধ্যে হিংসা ও উগ্রতা রয়েছে তাদের কথা ভিন্ন। এভাবেই কুরআনের মর্যাদা সংরক্ষণ এবং এর সত্যতা প্রমাণের জন্য আল্লাহ তাআলা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বংশ ধারা সংরক্ষণ করেছেন। নিশ্চয়ই ‘আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান।’ ‘আল্লাহ তার কর্মে বিজয়ী কিন্তু অধিকাংশ লোক তা জানে না।’
আট. কুরআন নাযিলের সময় তার প্রথম সম্বোধিত এবং প্রথম ধারক ছিলেন হযরত সাহাবায়ে কেরাম। কুরআন হেফাযতের একটি দিক এই যে, সাহাবায়ে কেরামের জীবনচরিতও হেফাযত করা হয়েছে। এক পরিসংখ্যান মতে সাহাবায়ে কেরামের সংখ্যা ছিল লক্ষাধিক। কিন্তু তাদের অধিকাংশই জীবনের শেষ প্রানে- এসে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। প্রথম পর্যায়ে যাদেরকে ইসলাম বা মুমিনদের প্রথম সারির বলে গণ্য করা হয় তাদের সংখ্যাও প্রায় পনের, বিশ হাজার। যে সাহাবীগণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে অধিক ফয়েয হাসিল করেছেন তাদের জীবনচরিতও আল্লাহ তাআলা হেফাযত করেছেন। যাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পাশাপাশি তাদের জীবনচরিত সম্পর্কেও ধারণা লাভ করা যায় এবং ঈমানী দাবী ও ইসলামী চাহিদা মোতাবেক তারা তাদের আমলকে কিভাবে সুসজ্জিত করেছিলেন তা একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে বিদ্যমান থাকে। যেন কেউ বলতে না পারে যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো রাসূল ছিলেন, আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ ও রহমত তার সহায় ছিল, তিনি আমল করলে সেটা তাঁর নিজস্ব বিশেষত্ব হতে পারে। কিন্তু যখন সাহাবায়ে কেরামের জীবনেও কুরআনের পূর্ণ অনুসরণ দেখা যায় তখন প্রমাণ হয়ে যায় যে, বিষয়টি আসলে এমন নয়। বস্তুত যে কোনো মানুষ ইচ্ছে করলে ঈমানের দাবি পুরা করতে পারে, যেমন করেছেন সাহাবায়ে কেরাম। এজন্য কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা ঈমান আন যেমন ঈমান এনেছে ওই সব মানুষ।’ এখানে ‘ওই সব মানুষ’ বলে সাহাবায়ে কেরামকে বোঝানো হয়েছে। সাহাবায়ে কেরামের জীবনচরিতের মাঝে বিস্ময়কর একটি দিক হচ্ছে, যে সাহাবী নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যত ঘনিষ্ঠ ছিলেন তার জীবনচরিত তত সবিস্তারে পাওয়া যায়। সাহাবায়ে কেরামের জীবনচরিত হেফাযতের একটি উদ্দেশ্য এটাও ছিল যে, কুরআনের বাহকের সঙ্গীদের ব্যাপারে যখন জানা যাবে তখন বাহকের (রাসূলুল্লাহর) সর্বাঙ্গীন সৌন্দর্যেরও কিছুটা অনুমান করা যাবে। কেননা মানুষকে জানা যায় তার বন্ধুদের মাধ্যমে। মানবতার ইতিহাসে নবীদের পরে সর্বোত্তম মর্যাদাবান ও উত্তম সমপ্রদায়ের নাম যদি নিতে হয় তাহলে তা সাহাবায়ে কেরাম। সুতরাং কুরআন ও কুরআনের বাহককে জানার জন্য এটাও জানা জরুরি ছিল যে, কুরআনের ওপর সামষ্টিক আমল কিভাবে হবে? সুন্নাত ও কুরআনের সম্মিলিত রূপায়ন কিভাবে হবে? কুরআন ও হাদীসের আলোকে উম্মত কিভাবে জন্ম নিয়েছে? এসব প্রশ্নের জবাব পূর্ণাঙ্গ হত না যদি না সাহাবায়ে কেরামের জীবনচরিত জানা যেত। আল্লাহ তাআলা সে ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। কুরআনের প্রথম পর্যায়ের ধারক ও আমলকারী প্রায় পনের হাজার পবিত্র সত্তার জীবনচরিত নাম-বংশসহ বিস্তারিতভাবে সংরক্ষিত। আলহামদুলিল্লাহ, উম্মত সে সময় থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত এবং কিয়ামত পর্যন্ত তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে উপকৃত হবে। আর কুরআনের ওপর আমল করার ক্ষেত্রে এটাকে অত্যন্ত সহায়ক মনে করবে।
নয়. সাহাবায়ে কেরাম যারা কুরআনের শব্দ ও অর্থের পাশাপাশি ব্যক্তি ও সামষ্টিকভাবে আমলকারী ছিলেন, যারা দুনিয়াকে একথা জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, কুরআন শুধু আমলযোগ্যই নয়, দুনিয়া ও আখেরাতের সাফল্যের চাবিকাঠি-তাদের পূর্ণ ইতিহাস জানার জন্য তাদের সহচর, যাদেরকে তাবেয়ীন বলা হয়, তাদের জীবনচরিত লিখিত হওয়াও জরুরি ছিল। যাতে সাহাবায়ে কেরামের জীবনচরিত পরবর্তীদের কাছে সঠিকভাবে পৌঁছে। এজন্য তাবেয়ীন ও তাবে তাবেয়ীনের জীবনচরিতও সঙ্কলিত হওয়ার প্রয়োজন ছিল। আল্লাহর কারিশমা দেখুন, এ পর্যায়ের ছয় লাখ লোকের পূর্ণাঙ্গ বায়োডাটাও আল্লাহ তাআলা হেফাজত করেছেন। আর তা অনুমাননির্ভর কোনো তথ্য নয়, বরং পূর্ণ প্রামাণ্যের সঙ্গে ও বিস্তারিতভাবে তিনি কে ছিলেন, তার ইলম ও প্রজ্ঞা কোন পর্যায়ের ছিল, তিনি কার কার নিকট থেকে ইলম হাসিল করেছেন, তার স্মৃতিশক্তি কেমন ছিল, তার তাকওয়া-পরহেযগারী ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্য কেমন ছিল ইত্যাদি সকল বিষয় তাতে সন্নিবেশিত হয়েছে। একে ‘আসমায়ে রিজাল শাস্ত্র’ নামে অভিহিত করা হয়। এটা এমন এক শাস্ত্র, যার দৃষ্টান্ত অন্য কোনো জাতির মাঝে খুঁজে পাওয়া যায় না।
কুরআন সংরক্ষণের জন্য আল্লাহ তাআলা বিস্ময়কর যে ব্যবস্থা করেছেন সেগুলো সংক্ষিপ্তাকারে এখানে আলোকপাত করা হল। আল্লাহ আমাদেরকে তাওফীক দিন আমরা যেন কুরআনের যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতে পারি। আর তিনি যেন আমাদের জাহের ও বাতেনকে কুরআনের চাহিদা মোতাবেক বানিয়ে দেন। আমীন। ‘মাসিক দারুল উলূম’ থেকে লেখাটি অনুবাদ করেছেন: জহির উদ্দিন বাবর
সফর ১৪৩১ – ফেব্রুয়ারী ২০১০
মাসিক আলকাউসার