কেউ বলেন ইয়ামানে, কেউ আসকালানে; কিন্তু অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মত হলো, ভূমধ্যসাগরের তীরে গাজা শহরে ১৫০ হিজরিতে জন্মগ্রহণ করেন মুহাম্মদ ইবনে ইদরিস আশ শাফেয়ী। যে পরিবারে তাঁর জন্ম, সে পরিবারের স্বর্ণ পরম্পরা গিয়ে মিলিত হয়েছে কুরাইশ বংশের সাথে। এজন্যই তাঁকে মুত্তালিবী বলা হয়। কারণ তাঁর বংশ পরম্পরা মিলিত হয়েছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের পবিত্র বংশের পূর্বপুরুষ আবদে মানাফের সাথে। জাহিলি যুগে এই কুরাইশ বংশের মর্যাদা গৌরব ছিলো সবার শীর্ষে। পরবর্তীতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের নবুওয়ত সেই গৌরব আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। শত শিখা শতদিকে আরও প্রোজ্জ্বলিত করেছে।
নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্মেছিলেন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের তৃতীয় ইমাম, ইসলামি ফিকহে শাফেয়ী মাজহাবের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ ইবনে ইদরিস রহ.। নিম্নবিত্ত পরিবারের টানাপোড়েন আরও বেড়ে গেছে তাঁর এতিম হয়ে যাওয়ায়। বাবার স্পর্শছায়া মাথার ওপর থেকে উঠে যাওয়ায়। বাধ্য হয়ে তাঁর মা তাঁকে নিয়ে চলে আসেন মক্কা মুকাররমায়, তাঁর পূর্বপুরুষের বসতভিটায়। তখন তাঁর বয়স ১০, শৈশবের দম না মানা দিন। বাবাহীন একলা পৃথিবীতে মায়ের ভরসায় পড়ালেখার প্রতি মনোনিবেশ করেন তিনি।
নিজেকে গড়ার দিন
সাত বছর বয়সেই কোরআন হিফজ সম্পন্ন করেন ইমাম শাফেয়ী রহ.। তারপর শুরু করেন হাদিসের অধ্যয়ন, মুখস্থকরণ। যা পড়তেন, সঙ্গে সঙ্গে তা লিখে ফেলার আগ্রহ ছিলো তাঁর। কখনো চিনামটির স্লেটে, কখনো চামড়ায়।
শাফেয়ী রহ. প্রথম কৈশোরেই তাঁর মূল জন্মস্থান থেকে আরবী ভাষা শেখার প্রতি দারুণ উদগ্রীব হয়ে পড়েছিলেন। যেন তাঁর ভাষা থেকে অনারবের যাবতীয় টান, সুর, লেহান, জড়তা কেটে যায়; অনারবদের সঙ্গে মিশতে মিশতে যে টান ও সুরগুলো তৈরী হয়। শাফেয়ী রহ. বলেন, ‘আমি মক্কা থেকে বেরিয়ে নিতান্ত সাধারণ অবস্থায় মরুভূমির মানুষের সাথে থাকতে লাগলাম। তাদের ভাষা ছিলো শুদ্ধতম মার্জিত ভাষা। তাদের বাহনে চড়তাম, তাদের মতো ঘরে থাকতাম, তাদের মতো খাবার খেতাম। তাদের ভাষার যাবতীয় ভঙ্গি আত্মস্থ করে ফিরে এলাম মক্কায়। শুরু করলাম কবিতা, সাহিত্য এবং ইতিহাস।’
অন্য এক জায়গায় বলেন, ‘বিশ বছর আমি আরবের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কাটিয়েছি। তাদের ভাষা, তাদের অনুভূতি আত্মস্থ করেছি। এমন একটি বর্ণও আমার চোখ এড়ায়নি, যার অর্থ এবং মর্ম আমি বুঝিনি।’
দুটি জিনিসে সবচে বেশী আগ্রহ ছিলো তাঁর। ১. তীর চালনা, ২. পড়ালেখা। তিনি নিজেই নিজের সম্পর্কে বলেন, ‘দুটো জিনিসে আমার আগ্রহ ছিলো। তীর চালনা এবং পড়াশোনা। নিশানা ছিলো আমার দশে দশ।’ এরপর নিজের পড়াশোনার ব্যাপারে কিছু বলেননি। তবে সেই মজলিশে উপস্থিত কেউ বলেছেন, ‘আল্লাহর কসম! তীর চালনা থেকেও অনেক বেশী অভিজ্ঞ আপনি পড়াশোনায়।’
যৌবনের এই নতুন কিছু জানবার প্রেরণা তাকে তাঁর জীবনের দ্বিতীয় আরেক প্রান্তরে নিয়ে যায়। যেখানে তিনি উসতাদের পদপ্রান্তে বসেছেন ইলমের জন্য। ইলমকে বুকের ভেতরে পোক্ত করার জন্য। তিনি শুনেছিলেন মদিনার ইমাম মালেক ইবনে আনাসের কথা। শুনেছিলেন তাঁর ইলমের রওনক ও রৌশনের কথা। কিন্তু এমনিতেই, তাঁর রচনার সঙ্গে পরিচিত না হয়েই, তাঁর কাছে ছুটে যাবার ইচ্ছে হয়নি শাফেয়ীর। তাই তিনি তাঁর বন্ধু থেকে ধার নিলেন মালেক ইবনে আনাস রহ.-এর বিখ্যাত কিতাব ‘মুয়াত্তা’। কিতাবটি পড়লেন, রেওয়াতগুলো মুখস্থ করলেন, অনুধাবন করলেন। যখন তাঁর মনে হলো মালেক রহ.-এর কিতাবটি তিনি পুরোপুরি ধারণ করতে পেরেছেন নিজের ভেতর, তখন গিয়ে হাজির হলেন মালেক রহ.-এর দরবারে।
তের বছর বয়সে মালেক রহ.-এর দেখা পেলেন শাফেয়ী। একান্ত একনিষ্ঠতায় তাঁর সঙ্গে লেগে থাকলেন। তাঁর ইলম, কৌশল, অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে লাগলেন নিজের ভেতর। মালেক রহ. বললেন, ‘হে মুহাম্মদ, আল্লাহকে ভয় করো। গুনাহ থেকে বেঁচে থাকো। এটাই তোমার সম্মান বাড়াবে। আল্লাহ তায়ালা তোমার হৃদয়ে নূর দিয়েছেন। গুনাহের অন্ধকারে তা নিভিয়ে দিও না।’
মালেক রহ. বললেন, ‘আগামীকাল সকালে এসো। পড়াবো।’
শাফেয়ী রহ. বলেন, ‘এরপর দিন সকালে গেলাম। তাঁর কাছে পড়তে শুরু করলাম। আমার পড়ার ঢং এবং আরবীর বিশুদ্ধতা তাঁকে মুগ্ধ করলো। তিনি বললেন, ‘আরও বেশী করে পড়ো।’
১৭৯ হিজরিতে মালেক রহ.-এর মৃত্যুর দিন পর্যন্ত তাঁর কাছে থাকেন শাফেয়ী রহ.। ততদিনে ইলমের এক উচ্চতর স্থানে পৌঁছে গেছেন তিনি, বয়স মাত্র ২৯। সমাজের নেতৃস্থানীয় লোকেরা ইয়ামানের গভর্নরের কাছে কাজি হিসেবে প্রস্তাব করলো শাফেয়ী রহ.-এর নাম। তারা শাফেয়ী রহ.-কে বললো, নাজরানের কাজির পদটি অলঙ্কৃত করতে।
খলিফা হারুনুর রশীদের মহলে
নাজরানের কাজির পদ গ্রহণ করলেন শাফেয়ী রহ.। প্রতিষ্ঠা করলেন ইনসাফ, ছড়িয়ে দিলেন ন্যায় বিচারের সুরভিত হাওয়া। কিন্তু নাজরানের মানুষ, যারা আগের কাজিদের পা চেটে স্বার্থ হাসিল করতো, তারা নাখোশ হলো। শাফেয়ী রহ.-কে দিয়ে তেমন কিছু করাতে পারলো না। এ প্রসঙ্গে শাফেয়ী রহ. বলেন, ‘আমি নাজরানের দায়িত্ব নিলাম। এখানে বাস করতো বনু হারিছ ইবনে আবদুল মাদান এবং সাকিফ গোত্রের প্রধানরা। কোনো কাজি নিযুক্ত হয়ে এলে, তারা তাকে হাত করে ফেলতো। কিন্তু আমাকে হাত করতে পারেনি।’
শাফেয়ী রহ.-এর পোষ না-মানা স্বভাবে ইয়ামানের গভর্নর বিরক্ত হয়ে বাগদাদে আব্বাসী খলিফা হারুনুর রশীদের কাছে বলে পাঠালেন, ‘যুদ্ধে তরবারি দিয়ে যা করা যায় না, এই লোক জিহ্বা দিয়ে তা করে ফেলে।’
খলিফা হারুনুর রশীদ নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী কিছু লোক এবং শাফেয়ী রহ.-কে ডেকে পাঠালেন। শাফেয়ী রহ.-এর সৌভাগ্য—সেখানে তাঁর পক্ষ হয়ে হারুনুর রশীদের সামনে মধ্যস্থতা করলেন আবু হানিফা রহ.-এর ছাত্র মুহাম্মদ ইবনুল হাসান রহ.।
৩৪ বছর বয়সে, ১৮৪ সালে শাফেয়ী রহ. বাগদাদে প্রবেশ করেন। প্রবেশ করেন বললে ভুল হবে, মূলত তাঁকে জোরপূর্বক আনা হয়েছে সভ্যতা ও জ্ঞানের রাজধানী এই বাগদাদ শহরে।
ইরাকে ইসলামি মননবিশ্বের সর্বশেষ গ্রন্থগুলো তিনি পড়তে শুরু করেন। পড়তে শুরু করেন মুহাম্মদ ইবনুল হাসান রহ.-এর কিতাবগুলোও। এইভাবে তিনি একসঙ্গে নিজের ভেতর ধারণ করেন হিজাজের পাঠ ও ইমাম মালেক রহ. এবং ইরাকের পাঠ, ইমাম আবু হানিফা ও তাঁর ছাত্র মুহাম্মদ রহ.। অভিভূত হয়ে ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী রহ. বলেন, ‘তাঁর ভেতর একত্রিত হয়েছে আহলে রায় তথা ইরাকের ইলম এবং আহলে হাদীস তথা হিজাজের ইলম। এগুলো গবেষণা করে তিনি উসূল বের করেছেন। নিয়ম-কানুন তৈরী করেছেন। অতঃপর তাঁর কাজ প্রসিদ্ধ হয়ে গেছে। তাঁর নাম-যশ ছড়িয়ে গেছে। মার্যাদা বাড়তে বাড়তে বাড়তে যা হওয়ার ছিল, তিনি তা-ই হয়েছেন।’
মক্কায় প্রত্যাবর্তন
ইলমি মজলিশ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নিয়ে মক্কায় ফিরে আসেন শাফেয়ী রহ.। এখানে সবচে লক্ষণীয় ব্যাপার হলো—ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ. তাঁর সঙ্গে দেখে করতে এসেছেন। তাঁর হাত ধরে প্রশংসা করেছেন।
প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ইমাম ইসহাক ইবনে রাহওয়াইহ বলেন, ‘আমরা মক্কায় সুফিয়ান ইবনে উয়াইনার মজলিশে বসে আমর ইবনে দিনারের হাদিস লিখছিলাম। আহমদ ইবনে হাম্বল রহ. আমাকে এসে বললেন, ‘চলো। তোমাকে এমন একজন লোক দেখাবো, যাকে কখনো তুমি দেখোনি।’ আমি তাঁর সঙ্গে জমজম প্রাঙ্গনে চলে এলাম। সেখানে সাদা কাপড় পরিহিত একজন লোক বসে আছেন। আমাকে তাঁর পাশে বসিয়ে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ. বললেন, ‘হে আবু আব্দুল্লাহ! এর নাম ইসহাক ইবনে রাহওয়াইহ হানজালা।’ লোকটি আমাকে অভিবাদন জানালেন। এরপর তাঁর সঙ্গে আলাপ আলোচনা করলাম। তাঁর স্মৃতিশক্তি, ইলমের দ্যুতি আমাকে মুগ্ধ করলো।
‘অনেক্ষণ পর আমি আহমদ রহ. কে বললাম, ‘যে লোকটির কাছে নিয়ে যাবেন বলেছিলেন, এবার তাঁর কাছে নিয়ে চলেন।’
‘আহমদ রহ. বললেন, ‘এই সেই লোক।’
‘আমি বললাম, ‘সুবহানাল্লাহ! এমন একজন লোকের কাছ থেকে উঠিয়ে এনেছেন, যে ‘হাদদ্দাসানা যুহরী’ (যুহরী আমাদেরকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। যুহরী মক্কার বড় আলেম) বলে হাদীস বর্ণনা করেন। তারপর নিয়ে নিয়ে এসেছেন এমন একজন লোকের কাছে, যিনি যুহরীর মতোই অবিকল কিংবা তাঁর কাছাকাছি। এ কোন যুবকের কাছে নিয়ে আসলেন আপনি।’
আহমদ রহ. বললেন, ‘তিনি মুহাম্মদ ইবনে ইদরিস আশ শাফেয়ী। তাঁর কাছ থেকে ইলম অর্জন করো। তাঁর মতো কাউকে আমি দেখিনি।’
আহমদ রহ. এবং ইসহাক রহ.-এর মতো মহান দুই ইমামের বক্তব্য উল্লেখ করেই শেষ করলাম শাফেয়ী রহ.-এর যুবক বয়সের কারনামা। শৈশব থেকে কৈশোর, কৈশোর থেকে তারুণ্য, তারুণ্য পেরিয়ে যৌবন; ইলমি মগ্নতায়, উসতাদের সৌরভ সান্নিধ্যে তিনি কেবল উঁচুতেই উঠেছেন। যে বয়সে ঝরে পড়ার ভয়, সে বয়সে তিনি শেকড় ও শক্তির খুঁজে মালেক রহ.-এর দরবারে হাজির হয়েছিলেন। সংসার ও সমাজের তুচ্ছতা তাঁকে পিছু টানতে পারেনি। যিনি হয়ে উঠবেন জাতির ইমাম, বিভ্রান্ত মুসাফিরের চৌকস রাহবার, এমন তো তিনি হবেনই।
আল জাজিরা অবলম্বনে
রাকিবুল হাসান
সূত্রঃ fateh24