ইসলামের দীর্ঘ ইতিহাস নিয়ে অনেক সময় নিয়ে চিন্তা করলাম। ইতিহাসের পরতে পরতে হাতড়িয়ে এলাম। দেখলাম, মুসলিম জাতির এমন দুর্বস্থা আর কখনো ঘটেনি অতীতে। গত দশ শতকের বিভিন্ন সময়ে মুসলিমরা ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে লড়েছে, লড়েছে মূর্তিপুজকদের বিরুদ্ধে। পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত অনেকের সাথেই লড়াই হয়েছে মুসলিমদের। কিন্তু আমেরিকার মতো এত বেশি শত্রুভাবাপন্ন, এমন নিষ্ঠুর ও নিকৃষ্টতর শত্রুর মুখোমুখি হয়নি মুসলিম জাতি কখনো। ইতিহাসের পাঠক অবশ্যই জেনে থাকবেন, মুসলিমদের বিরুদ্ধে সবচে ভয়ঙ্কর আক্রমণ হেনেছিল তাতারগোষ্ঠী। সপ্তম শতকের কথা এটা। ইতিহাস তাদের মতো ভয়ঙ্কর শত্রু দেখেনি ইতপূর্বে। কিন্তু আমেরিকার নিষ্ঠুরতা ও নিকৃষ্টতার সামনে তাতারদের ভয়ঙ্করতা যেন একেবারেই তুচ্ছ!
কারণ—
০১. তাতাররা মুসলিমদের পূর্বাঞ্চলের ভুখণ্ডগুলোতে আক্রমণ করে। কিন্তু আমেরিকানরা পূর্ব থেকে পশ্চিম পুরো মুসলিম বিশ্বে আক্রমণ হেনেছে। তাদের এ আক্রমণ কোথাও প্রত্যক্ষ, কোথাও আবার পরোক্ষ। যদি আমেরিকা এখনও মহাসাগরের অতলে অবস্থিত কোনো মুসলিম দেশের কথা জানতে পারে, যে দেশে ইসলামি শাসন বলবৎ আছে, তবে তারা মহাসাগরের নিচে গিয়ে হলেও সে দেশকেও নিজদের হাতের মুঠোয় নিয়ে নেবে আগ্রাসন চালিয়ে।
০২. তাতাররা যদিও মুসলিম ভূখণ্ডের পূর্বাঞ্চল দখলে সমর্থ হয়েছিল। তবুও তাদের অনেকেই ইসলাম গ্রহণ করে নেয় পরবর্তী সময়ে। ইসলামী বিশ্বের মধ্যবর্তী কিছু অংশ এবং পশ্চিম অংশে ইসলামী শাসন বলবৎ থাকে। কিন্তু আমেরিকানরা ইসলামের বিরুদ্ধে সর্বদিক থেকে লেগেছে। তারা ইসলামকে বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ—দুই দিক থেকেই আক্রমণ করেছে পুরো বিশ্ব জুড়ে। এমন কেউ যদি ঘুমের মধ্যে ইসলামী শাসনব্যবস্থার স্বপ্নও দেখে, তবে আমেরিকা নিদ্রা-স্বপ্নও ভেঙে দিতে তৎপর।
০৩. যদিও তাতাররা লক্ষ লক্ষ মুসলিম হত্যা করেছে -এমনকি বাগদাদে মুসলিম হত্যার সংখ্যা দশ লাখ বা তার চেয়েও বেশি হয়েছিল- তবুও কখনও তা আমেরিকার অপরাধের সমান নয়। আমেরিকার নিষ্ঠুরতা ও অপরাধের সামনে তাতাররা যেন শিশু। অন্য দেশগুলোর কথা বাদ দিই, আমেরিকা কেবল ইরাকে যত সংখ্যক শিশু হত্যা করেছে, তার সামনে তাতারদের পুরো ইতিহাসের অপরাধ কিছুই না।
০৪. যদি তাতারদের সর্বোচ্চ তীব্র হামলা হয়ে থাকে সামরিক ক্রুরতা। তবে আমেরিকার ক্ষেত্রে সে সামরিক ক্রুরতাও হামলার সবচে নগণ্য অংশ। কারণ আমেরিকার সামরিক নিষ্ঠুরতা ইতিহাসের সবচে জঘন্য সামরিক নিষ্ঠুরতা হলেও এ নিষ্ঠুরতাও হার মেনেছে মুসলিম দেশে তাদের ছড়িয়ে দেওয়া ফেতনা-ফাসাদ, অশ্লীলতা, নাস্তিকতা, ধর্মনিরেপক্ষতা ইত্যাদির সামনে। মুসলিমদের প্রাণে হত্যা করার চাইতে জঘন্য হচ্ছে তাদের আকিদা-বিশ্বাসকে হত্যা করা। আর এটাই করেছে আমেরিকা। আকীদা বিনষ্ট করার ভয়ঙ্করতা কোনো কলমই ব্যক্ত করতে সক্ষম নয়। এটা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না।
০৫. তাতাররা মুসলিমদের প্রকাশ্য কিছু সম্পদ লুট-পাট করে ক্ষান্ত হয়েছে। কিন্তু আমেরিকানরা প্রকাশ্য সম্পদেই খুশি হয়নি। বরং তারা খনিজ সম্পদের মতো সম্পদগুলোতেও হানা দিয়েছে। ফলে তারা আজ মালিক বনে গেছে পৃথিবীর অর্ধেক সম্পদের।
যারা মুসলমানদের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন, তারা আরো অনেক কিছুই জেনে থাকবেন আমেরিকার আগ্রাসন সম্বন্ধে। যদি আমেরিকা ও আমাদের মাঝে দ্বীনগত কোনো পার্থক্য নাও থাকতো; যে দ্বীন ধারণ করে আমরা আমেরিকার বিরুদ্ধে শত্রুতাপোষণ করি, তাদের হিংসা করি, তাদের প্রতি বৈরিতা পোষণ করি; যদি দ্বীনগত এ পার্থক্য নাও থাকতো। তারপরেও তাদের এ জঘন্য অপরাধগুলোই তাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ করার জন্য কারণ হিসেবে যথেষ্ট হতো।
যদি কেউ মুসলিমও না হয়, তবুও তার আত্মসম্মান, তার পৌরুষ, তার বীরত্ব আমেরিকার মতো শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে লিপ্ত করবে তাকে; এটা নিশ্চিত।
আজ আমেরিকার আগ্রাসন ও হঠকারিতা কল্পনার চাইতেও বেশি বেড়ে গেছে। কোনো শহর, পৃথিবীর কোনো স্থানই তাদের অনিষ্টতা থেকে মুক্ত নয়। প্রতিটি জায়গাতেই আমেরিকানরা আক্রমণ করেছে মুসলিমদের উপর। যদিও আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য এতটুকু অপরাধই যথেষ্ট যে, তারা কিউবাতে আমাদের বন্দি ভাইদের উপর নির্যাতন করে যাচ্ছে নিষ্ঠুরভাবে।
জাহিলি যুগের আরবরাও কখনো তাদের শত্রুদের সামনে মাথানত করেনি। চাই সে শত্রু অধিক শক্তির অধিকারীই হোক না কেন। এক্ষেত্রে তাদের নিদর্শন ছিল, ‘‘চাই না লাঞ্ছনার জীবন। মরলে সম্মানের মরণ।’’ জাহিলি যুগের যুদ্ধগুলোতে এমন অসংখ্য ঘটনা পাবো আমরা।
এবার ইসলামের যুগের কথা বলি। রাসুল সা. একবার সাহাবিদের সাথে পরামর্শে বসলেন। বিষয় : গাতফান গোত্রকে ঠেকিয়ে রাখতে তাদের মদিনার ফসলের একতৃতীয়াংশ দেওয়া হবে কিনা। তখন সাদ বিন মুআজ রা. দাঁড়িয়ে বললেন, ‘‘আল্লাহর রাসুল, আমরা এ সম্প্রদায় ছিলাম শিরকে লিপ্ত। লিপ্ত ছিলাম প্রতীমা পূজায়। আমরা না আল্লাহকে চিনতাম, না তার ইবাদত করতাম। তবুও বিক্রি-বাট্টা ছাড়া আমরা তাদের এক কণা শস্যও দিতাম না। আর এখন তো আল্লাহ আমাদের ইসলাম দিয়ে সম্মানিত করেছেন; আমাদের হেদায়াত দিয়েছেন; আপনাকে আমাদের মাঝে প্রেরণ করে, আমাদেরকে ইসলাম গ্রহণের সৌভাগ্য দিয়ে মর্যাদামণ্ডিত করেছেন; এখন তাদেরকে আমরা আমাদের খাদ্য দেবো?! আল্লাহর কসম, সে প্রয়োজন আমাদের নেই। আল্লাহর কসম, তারা আমাদের কাছ থেকে এক কণা খাদ্যও পাবে না। পাবে কেবল তলোয়ারের আঘাত।’’
অনুবাদ : আবিদ হাসান