(আম্মুরিয়ার যুদ্ধকে বিবেচনা করা হয় আব্বাসি খেলাফতের সবচেয়ে বড় লড়াই হিসেবে। রোমান বাহিনীর হাতে বন্দী এক মুসলিম নারীর আর্তনাদের জবাবে ইতিহাসের অন্যতম এ যুদ্ধের দামামা বাজান আব্বাসি খলিফা মুতাসিম বিল্লাহ। একজন মাত্র মুসলিম নারীর আর্তনাদের দাম মুসলিম সিপাহসালার ও সেনাবাহিনীর কাছে কত বেশি, খলিফা মুতাসিম বিল্লাহ তা দেখিয়ে দিয়ে গেছেন পৃথিবীকে। রোমান সাম্রাজ্যের অধিভুক্ত অজেয় শহর আম্মুরিয়া অবরোধ করেন তিনি ৬ রমজান।)
মৃত্যুর আগে খলিফা মামুনের অসিয়ত ছিল, যেভাবেই হোক বিদ্রোহী বাবাক খুররামিকে শায়েস্তা করতে হবে। মামুন নিজে বহুবছর চেষ্টা করেছেন বাবাককে দমন করতে, কিন্তু তিনি সফল হননি, বরং হারিয়েছেন নিজের বিখ্যাত সেনাপতিদের অনেককে। পরবর্তী খলিফা মু’তাসিম বিল্লাহ শাসনক্ষমতা পেয়েই বাবাকের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযান পরিচালনা করতে থাকেন। ২২২ হিজরির দিকে বাবাক কোণঠাসা হয়ে যায়। সে রোমান সম্রাট তোফাইল বিন মিখাইলকে পত্র লিখে আব্বাসি সাম্রাজ্যে হামলার আহ্বান করে। বাবাকের পত্রের ভাষ্য ছিল এমন–‘খলিফার বাহিনী এখন আমাকে নিয়ে ব্যস্ত। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে আপনি আব্বাসিদের এলাকায় হামলা করে তা দখল করে নিন।’
তোফাইল বিন মিখাইল এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে জিবাত্রা শহরে হামলা করে। তাবারির বর্ণনা মতে, এ সময় তোফাইলের বাহিনীর সেনাসংখ্যা ছিল প্রায় এক লাখ। এই বাহিনী জিবাত্রা শহরে প্রচণ্ড লুটপাট ও হত্যাযজ্ঞ চালায়। তারা অনেক মুসলমানকে বন্দী করে নাক-কান কেটে দেয়। প্রায় এক হাজার মুসলমান মহিলাকে বন্দী করে (১)। বন্দী মহিলাদের মধ্যে একজন হাশেমি মহিলাও ছিলেন। তাঁকে বন্দী করার সময় তিনি ওয়া মু’তাসিমা, ওয়া মু’তাসিমা (হায় মু’তাসিম, হায় মু’তাসিম) বলে চিৎকার দেন (২)।
রোমানরা ফিরে যায়। এদিকে বাবাকের পতন ঘটে। তাকে বন্দী করে সামাররায় এনে হত্যা করা হয়। ২২৩ হিজরিতে খলিফা মু’তাসিম সামাররা শহরে অবস্থান করছিলেন। বাবাককে হত্যার কয়েকদিন পরেই তাঁর কাছে জিবাত্রার পতনের সংবাদ পৌঁছে। একই সঙ্গে তাঁকে সেই হাশেমি নারীর চিৎকারের কথাও বলা হয়। ইবনু খালদুন লিখেছেন, ‘এই কথা শুনে মু’তাসিম লাব্বাইক লাব্বাইক বলে সিংহাসন থেকে দাঁড়িয়ে যান। তিনি তখনই যুদ্ধের প্রস্তুতির ঘোষণা দেন। দ্রুত তিনি আলেম ও আমিরদের ডেকে পাঠান। বাগদাদের কাজি আবদুর রহমান বিন ইসহাকও উপস্থিত হন। খলিফা সবার সামনে নিজের সম্পদের তালিকা করেন। সম্পদ তিন ভাগ করে এক ভাগ সন্তানদের জন্য, আরেক ভাগ খাদেমদের জন্য এবং অপরভাগ ওয়াকফ করে দেন। কাগজপত্র লিখে ফেলা হয় (৩)। খলিফা যুদ্ধের জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেন।’ ইবনু কাসির লিখেছেন, ‘খলিফা এমন বাহিনী প্রস্তুত করেন যা ইতিপূর্বে আর কেউ করতে সক্ষম হয়নি। বাহিনীর সাথে প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র ও জিনিসপত্র নেয়া হয়। এত বেশি সরঞ্জাম নেয়া হয় যার কথা ইতিপূর্বে কেউ শোনেওনি (৪)।
২২৩ হিজরির জমাদিউল উলার ২ তারিখে এই বাহিনী দজলা নদীর পশ্চিম প্রান্ত থেকে যাত্রা শুরু করে। বাহিনীর সেনাপতি ছিলেন উজাইফ বিন আনবাসা, জাফর ইবনু দিনার ও আফশিন। এই বাহিনী ঝড়ের বেগে জিবাত্রা শহরে উপস্থিত হয়। ততদিনে রোমানরা সেই এলাকা ত্যাগ করেছে। খলিফা রাগে ফুঁসছিলেন। তিনি সভাসদদের জিজ্ঞেস করেন, রোমানদের সবচেয়ে সমৃদ্ধ ও সুরক্ষিত শহর কোনটি? সবাই বললো, রোমানদের কাছে সবচেয়ে সম্মানিত ও সুরক্ষিত শহর হলো আম্মুরিয়া। এই শহর তাদের কাছে কনস্টান্টিনোপলের চেয়েও সম্মানিত। ইসলামের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত মুসলমানেরা কখনো এই শহর নিজেদের আয়ত্তে নিতে পারেনি (৫)।
‘আমাদের পরবর্তী গন্তব্য আম্মুরিয়া। এই শহরকে আমরা দখল করবো।’–দৃঢ় কণ্ঠে নিজের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন খলিফা মু’তাসিম বিল্লাহ।
মুসলিম বাহিনী চলল আম্মুরিয়ার উদ্দেশ্যে। আম্মুরিয়ার বর্তমান নাম আমোরিয়াম। এটি তুরস্কের ফ্রিজিয়া অঞ্চলে অবস্থিত। মুসলিম বাহিনী পৌঁছে গেল রোমানদের সীমান্তে। সালুকিয়া নামক স্থানে পৌঁছে সিন নদীর তীরে শিবির স্থাপন করা হয়। এখানে একদিন অবস্থান করে মুসলিম বাহিনী আবার রওনা হয়। শাবানের ২৫ তারিখে রোমানদের হাত থেকে আনকারা শহর জয় করা হয়। এখানে খলিফা বাহিনীকে তিন ভাগে বিভক্ত করেন। বাম বাহিনীর নেতৃত্ব দেন আশনাসকে। আফশিন ছিলেন ডান বাহিনীর নেতৃত্বে। খলিফা নিজে থাকেন মধ্যবর্তী বাহিনীতে। এই তিন বাহিনী রওনা হয় আম্মুরিয়ার দিকে। প্রতিটি বাহিনী একে অপরের থেকে দুই ক্রোশ দুরত্ব বজায় রাখছিল। সবার উপর আদেশ ছিল আনকারা থেকে আম্মুরিয়ার মধ্যবর্তী সকল এলাকা নিজেদের দখলে নিতে হবে।
এই তিন বাহিনীর মধ্যে আফশিনের বাহিনী প্রথম আম্মুরিয়া পৌঁছে। এরপর খলিফা ও আশনাসের বাহিনী পৌঁছে। রোমানরা শহরের ফটক বন্ধ করে দেয়। মুসলমানরা শহর অবরোধ করেন। দিনটি ছিল রমজানের ৬ তারিখ। অবরোধ চলতে থাকে। এ সময় শহরের একজন বাসিন্দা মুসলিম শিবিরে চলে আসেন। তাবারির বর্ণনামতে, এই লোকটি আগে মুসলমান ছিল। পরে ধর্ম পরিবর্তন করে খ্রিষ্টান হয়ে যায়। সে মুসলিম সেনাপতিকে জানায়, শহরের প্রতিরক্ষা প্রাচীরের একাংশ বন্যার কারণে দুর্বল হয়ে গেছে। সেখানে হামলা করলে সহজেই প্রাচীর ভেঙে ফেলা যাবে। খলিফা আদেশ দেন প্রাচীরের সেদিকে মিনজানিক স্থাপন করার জন্য। এরপর প্রাচীরের সেই অংশে একটানা পাথর নিক্ষেপ চলতে থাকে। এ সময় শহরবাসী রোমান সম্রাটের কাছে সাহায্য চেয়ে দুজন দূত প্রেরণ করে। তারা দুজনই মুসলিম বাহিনীর হাতে বন্দী হয়। এবং দুজনেই ইসলাম গ্রহণ করে। এদিকে খলিফার নির্দেশে পাথর নিক্ষেপ জোরদার করা হয়। একদিন বিকট শব্দে প্রাচীরের একাংশ ধ্বসে পড়ে।
প্রাচীরের একাংশ ধ্বসে যাওয়ার পর মুসলিম বাহিনীর সামনে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল প্রাচীরের বাইরের পরিখা পার হওয়া। পরিখা বেশ গভীর ও প্রশস্ত ছিল। এই সমস্যার সমাধানের জন্য খলিফা একটি পদ্ধতি অবলম্বন করেন। মুসলিম বাহিনী রসদ হিসেবে প্রচুর ভেড়া নিয়ে এসেছিল। খলিফার আদেশে সবগুলো ভেড়া জবাই করে গোশত সংরক্ষণ করা হয়। এরপর ভেড়ার চামড়ার ভেতর মাটি ঢুকিয়ে চামড়া সেলাই করে ফেলা হয়। এরপর মাটিভর্তি চামড়াগুলোকে পরিখায় ফেলা হয়। পরিখার কিছু অংশ ভরাট হয়ে গেলে মুসলিম সেনাদের চলার পথ হয়ে যায়। পরদিন মুসলিম সেনারা এই পথে শহরে প্রবেশের চেষ্টা চালান। শহরবাসী তির নিক্ষেপ করে তাঁদের আটকে দেয়ার চেষ্টা করে। সারাদিন প্রচণ্ড লড়াই হয়। দু পক্ষেই হতাহতের সংখ্যা বাড়ছিল। যুদ্ধে কোনোপক্ষই সুবিধে করতে পারছিল না।
যুদ্ধের তৃতীয় দিনে (১৭ রমজান ২২৩ হিজরি, ১২ আগস্ট ৮৩৮ খ্রিষ্টাব্দ) মুসলিম বাহিনী শহরে প্রবেশ করে। অল্পসময়ে পুরো শহর তাদের দখলে চলে আসে। খলিফার আদেশে পাইকারি হারে রোমান সেনাদের হত্যা করা হয়। গির্জার দরজা পুড়িয়ে দেয়া হয়। ইবনু খালদুন লিখেছেন, একেকজন মুসলমান সেনা পাঁচ-ছয়জন রোমান সেনাকে বকরির মতো বেঁধে নিয়ে যাচ্ছিল। প্রচুর যুদ্ধলব্ধ সম্পদ মুসলমানদের হাতে আসে। খলিফার আদেশ ছিল যা বহন করা যাবে তা সাথে নিতে আর বাকি সব জ্বালিয়ে দিতে। রোমানদের অস্ত্রশস্ত্রও জ্বালিয়ে দেয়া হয় (৬)।
২৫ দিন আম্মুরিয়াতে অবস্থান করে শাওয়ালের শেষদিকে খলিফা তরতুসের পথ ধরেন। ঐতিহাসিকরা আম্মুরিয়ার যুদ্ধকে গণনা করেছেন আব্বাসি শাসনামলের শ্রেষ্ঠ যুদ্ধ হিসেবে।
এক নজরে আম্মুরিয়া যুদ্ধ
পক্ষ : আব্বাসিয়া বাহিনী
সেনাপতি : খলিফা মুতাসিম বিল্লাহ, আফশিন, আশনাস
সেনাসংখ্যা : ৮০ হাজার
নিহতের সংখ্যা : অজ্ঞাত
বিপক্ষ : রোমান বাহিনী
সেনাপতি : তোফাইল বিন মিখাইলের প্রতিনিধি
সেনাসংখ্যা : ৩০ হাজার
ক্ষয়ক্ষতি : প্রায় সকল সৈন্য নিহত
সূত্র
* মুতাসিম বিল্লাহ ছিলেন ৮ম আব্বাসি খলিফা। ৮৩৩ সাল থেকে ৮৪২ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি শাসন করেন। খলিফা মামুনের মত তিনিও ছিলেন মুতাযিলা মতবাদের অনুসারী। নিজের মতবাদ টিকিয়ে রাখার জন্য ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল সহ আহলুস সুন্নাহর অন্যান্য আলেমদের উপর তিনি প্রচন্ড নির্যাতন চালান।
১। তাবারী, আবু জাফর মুহাম্মদ বিন জারির (মৃত্যু ৩১০ হিজরি), তারিখুর রুসুল ওয়াল মুলুক, ৯/৫৫ (কায়রো, দারুল মাআরিফ, ১৩৮৭ হিজরি)
২। ইবনু খালদুন, আবদুর রহমান (মৃত্যু ৮০৮ হিজরি), তারিখু ইবনি খালদুন , ৩/৩২৭, (বৈরুত, দারুল ফিকর, ১৪২১ হিজরি)
৩। প্রাগুক্ত, ৩/৩২৮
৪। ইবনু কাসীর, হাফেজ ইমাদুদ্দিন আবুল ফিদা ইসমাইল ইবনু উমর (মৃত্যু ৭৭৩ হিজরি), আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ১৪/২৫২, (দার হিজর, ১৪১৯ হিজরি)
৫। তাবারী, আবু জাফর মুহাম্মদ বিন জারির (মৃত্যু ৩১০ হিজরি), তারিখুর রুসুল ওয়াল মুলুক, ৯/৫৭ (কায়রো, দারুল মাআরিফ, ১৩৮৭ হিজরি)
৬। প্রাগুক্ত, ৯/৫৮-৬০
ইমরান রাইহান