ডাক নাম আবু দারদা। কন্যা দারদার নাম অনুসারে এ নাম এবং ইতিহাসে এ নামেই
খ্যাত। আসল নামের ব্যাপারে মত পার্তক্য আছে। যথাঃ ’আমির ও ’উয়াইমির।
আল-আসমা’ঈর মতে, ’আমির, তবে লোকে ’উয়াইমির বলতো। আর এটিই সর্বাধিক
প্রসিদ্ধ। কেউ বলেছেন, ’উয়াইমির তাঁর লকব বা উপাধি। পিতার নামের ব্যাপারেও
বিস্তর মত পার্থক্য আছে। যথাঃ মালিক, ’আমির, সা’লাবা, আবদুল্লাহ, যায়িদ
ইত্যাদি। মায়েল নাম মুহাব্বাত বা ওয়াকিদাহ্। (তাহজীব আত-তাহজীব- ৮/১৫৬;
আল-ইসাবা- ২/৪৫; উসুদুল গাবা- ৫/১৮৫; আল-ইসতী’য়াবঃ পার্শ্ব টীকাঃ আল-ইসাবা-
৪/৫৯) মদীনার বিখ্যাত খাযরাজ গোত্রের ‘বালহারিস’ শাখার সন্তান।
রাসূলুল্লাহর সা. সমবয়সী বা কিছুদিনের ছোট। (দারিয়া-ই-মা’য়ারিফ ইলামিয়্যা
(উর্দ্দু)- ১/৮০০)
তিনি ছিলেন আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী, অশ্বারোহী ও
বিচারক। ইসলাম গ্রহণের পূর্বে ছিলেন মদীনার একজন সফল ব্যবসায়ী। তারপর
সবকিছু ছেড়ে দিয়ে একান্তভাবে আল্লাহর ইবাদাতে আত্মনিয়োগ করেন। এ সম্পর্কে
তিনি নিজেই বলতেনঃ ‘রাসূলুল্লাহর সা. নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বে আমি ছিলাম
ব্যবসায়ী। তারপর যখন ইসলাম এলো, আমি আমার ব্যবসা ও ইবাদাতের মধ্যে সমন্বয়
সাধনের চেষ্টা করলাম। কিন্তু তা সমন্বিত হলোনা। সুতরাং আমি ব্যবসা ছেড়ে
ইবাদাতে আত্মেনিয়োগ করলাম।’ (আজ-জাহাবীঃ তারীখুল ইসলাম- ২/১০৭; আল-আ’লাম-
৫/২৮১; হায়াতুস সাহাবা- ২/২৯৬) শেষে ব্যবসার প্রতি দারুণ বিতৃষ্ণ হয়ে ওঠেন।
অনেক সময় বলতেন, এখন যদি আমার মসজিদে নববীর সামনে একটি দোকান থাকে,
প্রতিদিন তাতে ৪০ দীনার করে লাভ হয় এবং তা সাদাকা করে দিই, আর এ জন্য
নামাযের জামা’য়াতও ফাওত না হয়- তবুও এমন ব্যবসা এখন আমার পসন্দ নয়। লোকেরা
এর কারণ জিজ্ঞেস করলে বলতেনঃ শেষ বিচার দিনের কঠিন হিসাবের ভয়। (তাজকিরাতুল
হুফ্ফাজ- ১/২৫; হায়াতুস সাহাবা- ২/২৯৬; আল-হুলায়্যা- ১/২০৯) ইসলাম গ্রহণের
পর বীরত্ব, খোদাভীরুতা ও পার্থিব ভোগ-বিলাসিতার প্রতি উদাসীনতার জন্য
সাহাবাকুলের মধ্যে বিশেষ খ্যাতি লাভ করেন। (আল-আ’লাম- ৫/২৮১; আল-ইসাবা-
২/৪৫)
আবু দারদার বীরত্ব, অশ্বারোহণ ও বিজ্ঞতার স্বীকৃতি হযরত রাসূলে
কারীমের সা. বাণীতে পাওয়া যায়। বিজ্ঞতা সম্পর্কে রাসূল সা. বলেছেনঃ
’উয়াইমির হাকীমু উম্মাতি- ’উয়াইমির- আমার উম্মাতের একজন মহাজ্ঞানী হাকীম।
তাঁর অশ্বারোহণ সম্পর্কে বলেছেনঃ নি’মাল ফারিসু ’উয়াইমির- ’উয়াইমির একজন
চমৎকার অশ্বারোহী। (তারীখুল ইসলাম- ২/১০৮; আল-ইসাবা- ২/৪৪; আল-ইসতীয়াবঃ
আল-ইসাবার টীকা- ৪/৬০) তাঁর বিজ্ঞতাসূচক অনেক বাণী বিভিন্ন গ্রন্থে পাওয়া
যায়। তার কিছু অংশ ‘আল-ইসতীয়াব’ গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। (টীকা আল-ইসাবা-
২/১৭) এ কারণে ইমাম ইবনুল জাযারী তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য করেছেনঃ ‘কানা
মিনাল ’উলামা আল-হুকামা’- তিনি ছিলেন বিজ্ঞ জ্ঞানীদের একজন। (আল-আ’লাম-
৫/২৮১)
সা’ঈদ ইবন ’আবদুল আযীয বলেনঃ আবু দারদা বদর যুদ্ধের দিন ইসলাম
গ্রহণ করেন। (তারীখুল ইসলাম- ২/১০৯) আবার অনেকে বলেছেন বদর যুদ্ধের পর।
(শাজারাতুজ জাহাব- ৫/৩৯) আল-ইসতী’য়াব গ্রন্থকার বলেনঃ তিনি তাঁর পরিবারের
সকলের শেষে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং উত্তরকালে একজন ভালো মুসলিমে পরিণত হন।
(টীকা- আল-ইসাবা- ৪/৫৯) জুবাইর ইবন নুফাইর বলেন, রাসূল সা. বলেছেনঃ আল্লাহ
আমাকে আবু দারদার ইসলামের অঙ্গীকার করেছেন। জুবাইর বলেনঃ অতঃপর তিনি ইসলাম
গ্রহণ করেন। (তারীখুল ইসলাম- ২/১০৯)
এ খুব বিস্ময়ের ব্যাপার যে, এত বড়
বুদ্ধিমান হওয়া সত্ত্বেও তিনি অন্য শ্রেষ্ঠ আনসারদের সাথে ইসলাম গ্রহণ না
করে হিজরী দ্বিতীয় সন পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। এর একমাত্র কারণ, তার ইসলাম
গ্রহণ অন্যের দেখাদেখি নয়; বরং ভেবে-চিন্তে ও জেনেশুনে ছিল। সম্ভবতঃ
রাসূলুল্লাহর সা. মদীনায় আগমনের পর এক বছর পর্যন্ত তিনি বিষয়টি নিয়ে
গভীরভাবে চিন্তা করেন এবং ভালোমত খোঁজখবর নেন। তবে এই একটি বছর পেছনে পড়ার
কারণে সারা জীবন অনুশোচনা করেছেন। পরবর্তীকালে প্রায়ই বলতেনঃ এক মুহূর্তের
প্রবৃত্তির দাসত্ব দীর্ঘকালের অনুশোচনার জন্ম দেয়।
জাহিলী যুগে
প্রখ্যাত শহীদ সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহার রা. সাতে আবু দারদার
গভীর বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃ সম্পর্ক ছিল। আবদুল্লাহ আগে ভাগেই ইসলাম গ্রহণ
করেন; কিন্তু আবু দারদা পৌত্তলিকতার ওপর অটল থঅকেন। তবে আবদুল্লাহর সাথে
সম্পক পূর্বের মতই বজায় রাখেন। আবদুল্লাহও বন্ধুকে ইসলামের মধ্যে আনার জন্য
আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে থাকেন। তিনি আবু দারদাকে বারবার ইসলামের দাওয়াত দিতে
থাকেন। অবশেষে তাঁরই চেষ্টায় আবু দারদাকে বারবার ইসলামের দাওয়াত দিতে
থাকেন। অবশেষে তাঁরই চেষ্টায় আবু দারদা মুসলমান হন। বিভিন্ন গ্রন্থে তাঁর
ইসলাম গ্রহণের কাহিনীটি এভাবে বর্ণিত হয়েছেঃ
‘সেদিন আবু দারদা ’উয়াইমির
প্রত্যুষে ঘুম থেকে জেগে তাঁর প্রতীমাটির কাছে গেলেন। সেটি থাকতো বাড়ীর
সবচেয়ে ভালো ঘরটিতে। প্রথমে তার প্রতি আদাব ও সম্মান প্রদর্শন। সেটি থাকতো
বাড়ীর সবচেয়ে ভালো ঘরটিতে। প্রথমে তার প্রতি আদাব ও সম্মান প্রদর্শন করলেন।
নিজের বিশাল দোকানের সর্বোত্তম সুগন্ধ তেল তার গায়ে ভালো করে মালিশ করলেন।
তারপর গতকালই ইয়ামন থেকে আগত একজন ব্যবসায়ী তাঁকে যে একখানি উৎকৃষ্ঠ রেশমী
কাপড় উপহার দিয়েছেন তাই দিয়ে খুব সুন্দরভাবে প্রতীমাটি ঢেকে রাখলেন। অতঃপর
একটু বেলা হলে তিনি দোকানের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
যাওয়ার
পথে তিনি দেখলেন, মদীনার রাস্তা-ঘাট, অলি-গলি সর্বত্রই মুহাম্মাদের সা.
সংগী-সাথী গিজ গিজ করছে। তারা দলে দলে বদর যুদ্ধ থেকে ফিরছেন। আর তাঁদের
আগে আগে চলছে কুরাইশ বন্দীরা। তিনি তাঁদের এড়িয়ে চলতে লাগলেন। কিন্তু হঠাৎ
খাযরাজ গোত্রের এক যুবক তাঁর সামনে এসে পড়লো। তিনি যুবকের কাছে আবদুল্লাহ
ইবন রাওয়াহার কুশল জিজ্ঞেস করলেন। যুবক বললেন, বদরে তিনি দারুণ যুদ্ধ
করেছেন এবং গণীমতের মাল নিয়ে নিরাপদে মদীনায় ফিরেছেন। আবু দারদার দোকানে
গিয়ে বরলেন।
এদিকে আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা বদর থেকে ফিরে তাঁর ভাই আবু
দারদার বাড়ীতে গেছেন তার সাথে দেখা করতে। বাড়ীর ভিতরে ঢুকে দেখলেন, আবু
দারদার স্ত্রী বসে বসে চুলে চিরুনী করছেন। সালাম ও কুশল বিনিময়েল পর
আবদুল্লাহ জিজ্ঞেস করলেনঃ আবু দারদা কোথায়? স্ত্রী বললেনঃ আপনার ভাই তো এই
মাত্র বেরিয়ে গেলেন। এ কথা বলে আবদুল্লাহকে ঘরে বসতে দিয়ে তিনি অন্য কাজে
ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। এদিকে আবদুল্লাহ একটি হাতুড়ি হাতে তুলে নিয়ে যে ঘরে
প্রতীমাটি চিল সেখানে ঢুকে গেলেন এবং বিভিন্ন শয়তানের নামের একটি কাসীদা
আবৃত্তি করতে করতে হাতুড়ির আঘাতে মূর্তিটি চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ফেলেন।
কাসীদাটির শেষাংশ ছিল নিম্নরূপঃ
‘ওহে সাবধান! আল্লাহ ছাড়া আর যত কিছুই ডাকা হোক না কেন সবই বাতিল ও অসার।’
আবু
দারদার স্ত্রী হাতুড়ির আঘাতের শব্দ শুনে ছুটে এসে ঘটনাটি দেখে চেঁচিয়ে বলে
ওঠেনঃ ‘ওহে ইবন রাওয়াহা। আপনি আমার সর্বনাশ করেছেন।’ আবদুল্লাহ কোন জবাব
না দিয়ে এমনভাবে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন যেন কিছুই ঘটেনি।
আবু দারদা বাড়ী
ফিরে দেখলেন, স্ত্রী বসে বসে কাঁদছেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ কি হয়েছে?
বললেনঃ আপনার ভাই আবদুল্লাহ এসে ঐ দেখুন কি কান্ডই না ঘটিয়ে গেছেন। আবু
দারদা প্রথমতঃ ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়েন। তারপর গভীরভাবে চিন্তা করার পর আপন
মনে বলে ওঠেনঃ যদি এ প্রতীমার মধ্যে সত্যি সত্যিই কোন কল্যাণ থাকতো তাহলে
সে নিজেকে রক্ষা করতো। এমন চিন্তার পর আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহাকে সংগে করে
রাসূলুল্লাহর সা. নিকট যান এবং ইসলাম কবুল করেন।’ (সুওয়ারুন মিন হায়াতুস
সাহাবা- ৩/৯৫-১০০; হায়াতুস সাহাবা- ১/২৩২-২৩৩; ৩/৩৮৪; আল-মুসতাদরিক- ৩/৩৩৬)
রাসূল সা. সালমান আল-ফারেসীর সাথে তাঁর দ্বীনি-ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে
দেন। (আনসাবুল আশরাফ- ১/২৭১; তাজকিরাতুল হুফ্ফাজ- ১/২৫; উসুদুল গাবা-
৫/১৮৫)
বদর যুদ্ধের সময় আবু দারদা অমুসলিম ছিলেন। এ কারণে সে যুদ্ধে
তিনি অংশগ্রহণ করেননি। তবে খলীফা হযরত ’উমার রা. তাঁর খিলাফতকালে সাহাবাদের
যে ভাতার ব্যবস্থা করেন তাতে আবু দারদার ভাতা বদরী সাহাবীদের সমান
নির্ধারণ করেন বলে বর্ণিত হয়েছে। (দারিয়া-ই-মা’য়ারিফ ইসলামিয়্যা- ১/৮০০)
উহুদ যুদ্ধের সময় তিনি মুসলমান। এ যুদ্ধে তিনি যোগদান করেন এবং একজন
অশ্বারোহী সৈনিক হিসাবেই এতে অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। যুদ্ধের এক
পর্যায়ে হযরত রাসূলে কারীম সা. তাঁকে প্রতিপক্ষের একটি অশ্বারোহী বাহিনীকে
তাড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। তিনি একাই তাদের তাড়িয়ে দেন। রাসূল সা. সে দিন
তাঁর বীরত্ব ও সাহসিকতা দেখে দারুণ পুলকিত হন এবং মন্তব্য করেনঃ ‘নি’মাল
ফারিসু ’উয়াইমির’- ’উয়াইমির এক চমৎকার ঘোড় সওয়ার। (তাজকিরাতুল হুফ্ফাজ-
১/২৪; তারীখুল ইসলাম- ২/১০৭) উহুদ ছাড়াও অন্যান্য সকল যুদ্ধ ও অভিযানে তিনি
রাসূলুল্লাহর সা. সাথে অংশগ্রহণ করেন। তবে সে সব ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা
সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায় না।
হযরত রাসূলে কারীমের সা.
ইনতিকালের পর হযরত আবু বকরের খিলাফতকালে আবু দারদা মদীনায় ছিলেন। তাঁর এ
সময়ের কর্মকান্ড সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। হযরত ’উমারের রা.
খিলাফতকালে মদীনা ছেড়ে শামে চলে যান এবং সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করেন।
সীরাত বিশেষজ্ঞরা তাঁর মদীনা ত্যাগের কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছেন। ১. মদীনায়
রাসূলুল্লাহর সা. স্মৃতি তাঁকে সব সময় কষ্ট দিত। ২. তিনি উপলব্ধি
করেছিলেন, ইসলামী শিক্ষার প্রচার-প্রসার নবীর ওয়ারিসদের ওপর ফরজ। এই বোধ
তাঁকে মদীনা ত্যাগে উদ্বুদ্ধ করে। ৩. তিনি রাসূলুল্লাহর সা. নিকট একথা
শুনেছিলেন যে, ফিত্নার অন্ধকারে ঈমানের প্রদীপ শামে নিরাপদ থাকবে। মূলতঃ
এসকল কারণে শামের রাজধানী দিমাশকে তিনি বসতি স্থাপন করেন। (সীয়ারে আনসার-
২/১৯০)
হযরত আবু দারদার মদীনা ত্যাগের ব্যাপারে একটি কাহিনী প্রসিদ্ধ
আছে। তিনি সফরের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে খলীফা হযরত ’উমারের নিকট গেলেন
অনুমতি চাইতে। খলীফা অনুমতি দিতে অস্বীকৃতি জানালেন। তবে একটি শর্তে অনুমতি
দিতে পারেন বলে জানালেন। শর্তটি হলো তাঁকে কোন রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব নিয়ে
যেতে হবে। আবু দারদা জানালেন, শাসক হওয়া তাঁর পছন্দ নয়। খলীফা বললেন, তাহলে
অনুমতির আশা করবে না। আবু দারদা অবস্থা বেগতিক দেখে বললেন, আমি কোন
রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করবো না ঠিক, তবে মানুষকে কুরআন-হাদীস শিখাবো এবং
নামায পড়াবো। তাঁর প্রস্তাবে খলীফা রাজী হলেন এবং তাঁকে মদীনা ত্যাগের
অনুমতি দিলেন। মূলতঃ এ দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যেই তিনি শামের প্রবাস জীবন
গ্রহণ করেন।
আবু দরদার শামে গমন সম্পর্কে ইবন সা’দ ও হাকেম, মুহাম্মাদ
ইবন কা’ব আল-কুরাজী থেকে একটি বর্ণনা নকল করেছেন। তিনি বলেন, হযরত নবী
কারীমের সা. জীবনকালে পাঁচজন আনসার সমগ্র কুরআন সংগ্রহ করেন। তাঁরা হলেনঃ
মু’য়াজ ইবন জাবাল, ’উবাদা ইবনুস সামিত, উবাই ইবন কা’ব, আবু আইউব ও আবু
দারদা রা.। খলীফা ’উমারের খিলাফতকালে হযরত ইয়াযীদ ইবন আবী সুফইয়ান শাম থেকে
খলীফাকে লিখলেনঃ শামের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিটি শহর-বন্দর লোকে
লোকারণ্য হয়ে পড়েছে। এ সকল লোককে কুরআন শিখাতে পারে এমন কিছু ব্যক্তির
প্রয়োজন। চিঠি পেয়ে খলীফা ’উমার রা. উপরোক্ত পাঁচ ব্যক্তিকে ডেকে চিঠির
বক্তব্য তাঁদেরকে জানালেন এবং আবেদন রাখলেন আপনাদের মধ্য থেকে অন্ততঃ তিনজন
এ ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করুন। আর ইচ্ছা করলে সবাই করতে পারেন। ইচ্ছা
করলে আপনাদের মধ্য থেকে নিজেরা তিনজনকে নির্বাচন করতে পারেন, অন্যথায় আমিই
তিনজনকে বেছে নেব। তাঁরা বললেনঃ ঠিক আছে, আমরা যাব। আবু আইউব ছিলেন
বয়োবৃদ্ধ, আবু উবাই পীড়িত, এ জন্য এ দু’জনকে তাঁরা বাদ দিলেন। বাকী তিন
জনকে খলীফা বিভিন্ন স্থানে পাঠালেন। আবু দারদাকে পাঠালেন দিমাশ্কে এবং তিনি
আমরণ সেখানে অবস্থান করেন। (তাবাকাত- ৪/১৭২; হায়াতুস সাহাবা- ৩/১৯৫-১৯৬)
দিমাশ্কে
তাঁর অধিকাংশ সময় ছাত্রদের কুরআন হাদীসে তা’লীম, শরীয়াতের আহকামের
তারবিয়্যাত (প্রশিক্ষণ দান) এবং ইবাদতের মধ্যে অতিবাহিত হতো। যখন শামে
অবস্থানরত সংখ্যাগরিষ্ঠ সাহাবায়ে কিরামের সরল ও অনাড়ম্বর জীবনের ওপর
সেখানকার ঠাঁট ও জৌলুসের কিছু না কিছু ছাপ পড়েছিল তখন আবু দারদা এর থেকে
সম্পূর্ণ মুক্ত এক অকৃত্রিম জীবনধারা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন।
খলীফা
হযরত ’উমার রা. তাঁর ঐতিহাসিক শাম সফরের সময় সেখানে অবস্থানরত প্রখ্যাত
সাহাবা ইয়াযীদ ইবন আবূ সুফইয়ান, ’আমর ইবনুল ’আস ও আবু মুসা আল-’আশ’য়ারী রা.
প্রত্যেকের গৃহে অতর্কিতে উপস্থিত হন এবং তাঁদের জীবন যাপনে জৌলুসের ছাপ
দেখতে পান। তিনি আবু দারদার আবাসস্থলেও যান; কিন্তু সেখানে ভোগ-বিলাসের
চিহ্ন তো দূরের কথা রাতের অন্ধকারে একটি বাতিও দেখতে পেলেন না। একটি
অন্ধকার ঘরে কম্বল মুড়ি দিয়ে তিনি শুয়ে আছেন। তাঁর এ চরম দীন-হীন অবস্থা
দেখে খলীফার চোখ পানিতে ভরে গেল। তিনি জানতে চাইলেন, জীবনের প্রতি এমন
নির্মমতার কারণ কি? আবু দারদা বললেনঃ রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, এ পৃথিবীতে
আমাদের এতটুকু জীবন উপকরণ থাকা উচিত যতটুকু একজন মুসাফিরের প্রয়োজন হয়।
হায়! অবস্থান সা. পরে আমরা কিসের থেকে কি হয়ে গেলাম। তারপর উভয়ে কাঁদতে
কাঁদতে রাত কাটিয়ে দিলেন। (কানযুল ’উম্মাল- ৭/৭৭; হায়াতুস সাহাবা- ২/৮২-৮৪)
খলীফা
হযরত ’উসমানের খিলাফতকালে শামের গভর্ণর হযরত মু’য়াবিয়া রা. খলীফার
নির্দেশে আবু দারদাকে দিমাশ্কের কাজী নিয়োগ করেন। হযরত আমীর মু’য়াবিয়া রা.
কখনও সফরে গেলে তাঁকেই স্থলাভিষিক্ত করে যেতন। এটি ছিল দিমাশ্কের প্রথম
কাজীর পদ। (শাজারাতুজ জাহাব- ৫/৩৯; আল-আ’লাম- ৫/২৮১) ইবন হিব্বানের মতে,
খলীফা ’উমারে নির্দেশে হযরত মু’য়াবিয়া রা. তাঁকে কাজীর পদে নিয়োগ করেন।
(লিসানুল মীযান- ৭/৪৪) ’আল-ইসতী’য়াব’ গ্রন্থকার প্রথম মতটি সঠিক বলে উল্লেখ
করেছেন। (আল-ইসাবার পার্শ্ব টীকা- ২/১৭; ৪/৬০)
হযরত আবু দারদার দুই
স্ত্রী ছিল। দু’জনই ছিলেন সম্মান ও মর্যাদা উঁচু আসনের অধিকারিনী। প্রথম
জনের নাম উম্মু দারদা কুবরা খাযরা বিন্তু আবী হাদরাদ আল-আসলামী এবং
দ্বিতীয়জনের নাম উম্মু দারদা সুগরা হাজীমা হায়ওয়াস্ সাবিয়্যা। উম্মু দারদা
কুবরা ছিলেন একজন প্রখ্যাত সাহাবিয়্যা, প্রখর বুদ্ধিমতী, উঁচু স্তরের ফকীহা
ও শ্রেষ্ঠ ’আবিদাহ্। হাদীসের গ্রন্থসমূহে তাঁর সূত্রে বর্ণিত বহু হাদীস
পাওয়া যায়। তবে উম্মু দারদা সুগরা সাহাবিয়্যা ছিলেন না। স্বামীর মৃত্যুর পর
দীর্ঘদিন জীবিত ছিলেন। হযরত মু’য়াবিয়া রা. তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দেন;
কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন।
হযরত আবু দারদার বিয়ে সম্পর্কিত এক
বর্ণনা সীরাত গ্রন্থসমূহে পাওয়া যায়। সাবিত আল-বুনানী থেকে বর্ণিত হয়েছে।
আবু দারদা তাঁর দ্বীনী ভাই সালমান আল-ফারেসীকে বিয়ে দেওয়ার জন্য তাঁকে সংগে
করে একটি কনের পিতার গৃহে গেলেন। তিনি সালমানকে বাইরে বসিয়ে রেখে ভিতর
বাড়ী ঢুকলেন। কনের অভিভাবকদের নিকট সালমানের দ্বীনদারী ও দ্বীনের জন্য
তাঁকে সংগে করে একটি কনের পিতার গৃহে গেলেন। তিনি সালমানকে বাইরে বসিয়ে
রেখে ভিতর বাড়ী ঢুকলেন। কনের অভিভাবকদের নিকট সালমানের দ্বীনদারী ও দ্বীনের
জন্য তাঁর ত্যাগের কথা উল্লেখ করে তাঁর পরিচয় তুলে ধরেন এবং তাদের মেয়ের
সাথে তাঁর বিয়ের প্রস্তাব পেশ করেন। পাত্রীপক্ষ বলেনঃ আমরা সারমানকে মেয়ে
দেব না, তবে তোমাকে দেব। এই বলে তাঁরা আবু দারদার সাথে মেয়ের বিয়ে দিয়ে
দেন। বিয়ের কাজ শেষ হলে আবু দারদা বাড়ীর ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে অত্যন্ত
লজ্জার সাথে সালমানকে খবরটি দেন। তবে এটা আবু দারদার কোন বিয়ে সে সম্পর্কে
তেমন কোন তথ্য পাওয়া যায় না। (হায়াতুস সাহাবা- ২/৬৭৪)
হযরত আবু দারদা
ছিলেন একজন সুপুরুষ। বার্ধক্যে দাড়িতে খিজাব লাগাতেন। সব সময় আরবী পোশাক
পরতেন। মাথায় ‘কালানসুয়া’ নামক এক প্রকার উঁচু টুপি ও পাগড়ী পরতেন। আবু
দারদার সন্তানদের মধ্যে কয়েকজনের নাম জানা যায়। তাঁরা হলেনঃ বিলাল, ইয়াযীদ,
দারদা ও নুসাইবা। প্রথমজন বিলাল। তিনি ইতিহাসে বিলাল আবু মুহাম্মাদ
দিমাশকী নামে খ্যাত। তিনি ইয়াযীদ ও পরবর্তী খলীফাদের সময়ে দিমাশ্কের কাজী
ছিলেন। খলীফা ’আবদুল মালিক তাঁকে বরখাস্ত করেন। হিজরী ৯২ সনে তাঁর ওফাত হয়।
কন্যা
দারদা ছিলেন মক্কার এক সম্ভ্রান্ত সংশীয় ও প্রখ্যাত তাবে’ঈ সাফওয়ান ইবন
’আবদিল্লাহ আল কুরাইশীর সহধর্মিনী। এই দারদার বিয়ে সম্পর্কে একটি ঘটনা
বিভিন্ন গ্রন্থে দেখা যায়। ইয়াযীদ ইবন মু’য়াবিয়া দারদাকে বিয়ে করার জন্য
প্রস্তাব পাঠান। আবু দারদা সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। পরে এক অতি
সাধারণ দীনদার মুসলমানের সাতে তাঁকে বিয়ে দেন। তখন লোকে বলাবলি করতে লাগলো,
আবু দারদা, ইয়াযীদের সাথে মেয়ের বিয়ে দিলেন না; অথচ তাঁর চেয়ে নিচু স্তরের
একজন সাধারণ মুসলমানের সাথে মেয়ের বিয়ে দিলেন। একথা আবু দারদার কানে গেলে
তিনি বললেনঃ আমি দারদার প্রতি লক্ষ্য করেছি। যখন দারদার মাথার ওপর
চাকর-বাকর দাঁড়িয়ে থাকবে এবং ঘরের বিপুল দ্রব্যের প্রতি নজর পড়বে তখন তাঁর
দ্বীনের কি অবস্থা হবে? (সিফাতুস সাফওয়াহ্- ১/২৬০; হায়াতুস সাহাবা- ২/৬৭৪)
হযরত
আবু দারদার মৃত্যুসন সম্পর্কে সীরাত বিশেষজ্ঞদের বিস্তর মতভেদ আছে।
বিভিন্নজন বিভিন্ন গ্রন্থে হিজরী ৩১, ৩২, ৩৩ ও ৩৪ সনগুলি উল্লেখ করেছেন।
আবার কারো কারো মতে তিনি হযরত আলী ও হযরত মু’য়াবিয়ার রা. মধ্যে সংঘটিত
সিফ্ফীন যুদ্ধের পর ইনতিকাল করেন। তবে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ মতে তিনি হিজরী ৩২
সন মুতাবিক ৬৫২ খ্রীস্টাব্দে দিমাশ্কে ইনতিকাল করেন। ওয়াকিদী, আবু মাসহার
সহ প্রমুখ ইতিহাসবিদ এমত পোষণ করেছেন। দিমাশ্কের ‘বাবুস সাগীর’-এর নিকট
তাঁকে দাফন করা হয় এবং তাঁরই পাশে তাঁর সহধর্মীনী উম্মু দারদাকেও সমাহিত
করা হয় বলে প্রসিদ্ধি আছে। (দ্রঃ আল-ইসতী’য়াবঃ টীকা আল-ইসাবা- ২/৪৬; ৪/৬০;
উসুদুল গাবা- ৫/১৮৬; ’আল-আ’লাম- ৫/২৮১; তারীখুল ইসলাম- ২/১১১;
দায়িরা-ই-মা’য়ারিফ ইসলামিয়্যা- ১/৮০১; তাহজীবুত তাহজীব- ৮/১৫৬; শাজারাতুজ
জাহাব- ৫/৩৯)
হযরত আবু দারদার রা. মৃত্যুর ঘটনাটি ছিল একটু ব্যতিক্রম
ধরণের জীবনের শেষ মুহূর্তে তিনি ব্যাকুলভাবে কাঁদছেন। স্ত্রী উম্মু দারদা
বললেন, আপনি রাসূলুল্লাহর সা. একজন সাহাবী হয়ে এত কাঁদছেন? বললেনঃ কেন
কাঁদবো না? কিভাবে মুক্তি পাব আল্লাহই ভালো জানেন। এ অবস্থায় ছেলে বিলালকে
ডেকে বললেন, দেখ, একদিন তোমাকেও এমন অবস্থার সম্মুখীন হতে হবে। সে দিনের
জন্য কিছু করে রাখ। মৃত্যুর সময় যতই ঘনিয়ে আসতে লাগলো তাঁর হাহুতাশ ও
অস্থিরতা তথই বৃদ্ধি পেয়ে চললো। ঈমান সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে, ঈমান হচ্ছে
ভীতি আশার মাঝখানে। আবু দারদার ওপর খোদাভীতির প্রাবল্য ছিল।
স্ত্রী পাশে
বসে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। তিনি এক সময় বললেন, আপনি তো মৃত্যুকে খুবই
ভালোবাসতেন। এখন এত অস্থির কেন? বললেনঃ তোমার কথা সত্য। কিন্তু যখন মৃত্যু
অবধারিত বুঝেছি তখনই এ অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। এতটুকু বলে তিনি কান্নায়
ভেঙ্গে পড়লেন। তারপর বললেন, এখন আমার শেষ সময়। আমাকে কালিমার তালকীন দাও।
লোকেরা কালিমার তালকীন দিল। তিনি তা উচ্চারণ করতে করতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ
করলেন।
হযরত আবু দারদা যখন অন্তিম রোগ শয্যায় তখন একদিন ইউসফ ইবন
’আবদিল্লাহ ইবন সালাম আসলেন তাঁর নিকট ইল্ম হাসিলের জন্য। তিনি জিজ্ঞেস
করলেন, কি উদ্দেশ্যে আসা হয়েছে? তাঁর সেই মুমূর্ষু অবস্থা দেখে ইউসুফ জবাব
দিলেন আপনার সাথে আমার আব্বার যে গভীর সম্পর্ক ছিল সেই সূত্রে আমি আপনার
সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে এসেছি। তিনি বললেন, মিথ্যা অতি নিকৃষ্ট জিনিস। কিন্তু
কেউ মিথ্যা বলে ইসতিগফার করলে তা মাফ হতে পারে। (মুসনাদ- ৬/৪৫০)
হযরত
আবু দারদার ওফাত পর্যন্ত ইউসুফ অবস্থান করেন। মৃত্যুর পূর্বে তাঁকে ডেকে
বললেন, আমার মৃত্যু আসন্ন, একথা মানুষকে জানিয়ে দাও। তিনি খবর ছড়িয়ে দিতেই
বন্যার স্রোতের মত মানুষ আসতে শুরু করলো। ঘরে বাইরে শুধু মানুষ আর মানুষ।
তাঁকে প্রচুর লোক সমাগমের কথা জানানো হলে তিনি বললেন, আমাকে বাইরে নিয়ে
চলো। ধরে বাইরে আনা হলে তিনি উঠে বসলেন এবং জনগণের উদ্দেশ্যে একটি হাদীস
বর্ণনা করলে। (মুসনাদ- ৬/৪৪৩) এভাবে রাসূলুল্লাহর সা. হাদীস প্রচারের আবেগ
জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁর মধ্যে পূর্ণ মাত্রায় বিদ্যমান ছিল।
হযরত
আবু দারদাকে আলিম সাহাবীদের মধ্যে গণ্য করা হয়। সাহাবায়ে কিরাম তাঁকে অতি
সম্মানের দৃষ্টিতে দেখতেন। হযরত ’আবদুল্লাহ ইবন ’উমার রা. বলতেনঃ তোমরা
দু’জন বা- ’আমল আলি- মু’য়াজ ও আবু দারদার কিছু আলোচনা কর। ইয়াযীদ ইবন
মু’য়াবিয়া বলতেনঃ আবু দারদা এমন আলিম ও ফকীহদের অন্তর্ভুক্ত যাঁরা রোগের
নিরাময় দান করে থাকেন। (আল-ইসতী’য়াবঃ আল-ইসাবা- ৪/৫০) মৃত্যুর পূর্বে হযরত
মু’য়াজ ইবন জাবালও আবু দারদার গভীর জ্ঞানের সাক্ষ্য দিয়ে গেছেন। তাঁর
অন্তিম সময় ঘনিয়ে এসেছে। এমন সময় এক ব্যক্তি তাঁর শিয়রে দাঁড়িয়ে কান্না
জুড়ে দিল। তিনি প্রশ্ন করলেনঃ এত কান্না কেন? লোকটি বললোঃ আমি আপনার নিকট
থেকে ইলম হাসিল করতাম; কিন্তু এখন আপনি চলে যাচ্ছেন। তাই আমার কান্না
পাচ্ছে। তিনি বললেনঃ কেঁদো না। আমার মৃত্যুর পর তোমরা ইলম হাসিলের জন্য আবু
দারদা, সালমান, ইবন মাস’উদ ও আবদুল্লাহ ইবন সালাম- এ চার ব্যক্তির কাছে
যাবে। (কানযুল ’উম্মাল- ২/৩২৫; হায়াতুস সাহাবা- ২/৫৮১, ৫৮২; তারীখুল ইসলাম-
২/১০৯) একবার হযরত আবুজার আল-গিফারী রা. আবু দারদাকে লক্ষ্য করে বলেনঃ ওহে
আবু দারদাঃ যমীনের ওপর এবং আসমানের নীচে আপনার চেয়ে বড় কোন ’আলিম নেই।
(তারীখুল ইসলাম- ২/১০৯); হযরত মাসরূক, যিনি একজন উঁচু মর্যাদার তাবে’ঈ এবং
তাঁর যুগের একজন বিশিষ্ট ইমাম-বলেনঃ আমি সকল সাহাবীর জ্ঞানরাশি মাত্র
ছ’ব্যক্তির মধ্যে একত্রে দেখতে পেয়েছি। তাঁদের একজন আবু দারদা। মিসয়ার থেকে
বর্ণিত। কাসেম ইবন ’আবদির রহমান বলেনঃ যাঁদেরকে ইলম দান করা হয়েছে, আবু
দারদা তাঁদের একজন। (আল-ইসতয়’য়াবঃ আল-ইসাবা- ৪/৫০) তাঁর এ বিশাল জ্ঞানের
কারণে তাঁর সময়ে মক্কা-মদীনা তথা গোটা হিজাযে বহু বড় বড় সাহাবী ফাতওয়া ও
ইমামতের পদে অধিষ্ঠিত থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন স্থান থেকে জ্ঞানপিপাসু
ছাত্ররা দলে দলে আবু দারদার দারসগাহে ভিড় জমাতেন।
হযরত আবু দারদার
দারসগাহে সব সময় ছাত্রদের ভিড় জমে থাকতো। ঘর থেকে বের হলেই দেখতে পেতেন
পথের দু’ধারে ছাত্ররা সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। একদিন মসজিদের যাচ্ছেন।
পিছনে এত ভিড় জমে গেল যে, মানুষ মনে করলো হয়তো এটা কোন শাহী মিছিল হবে।
তাদের প্রত্যেকেই কিছুনা কিছু জিজ্ঞেস করছিল। (তাজকিরাতুল হুফ্ফাজ- ১/১২৫)
হযরত
আবু দারদা সব সময় মানুষকে ইলম হাসিলের প্রতি উৎসাহ দান করতেন। হযরত হাসান
বলেছেন, আবু দারদা বলতেনঃ তোমরা ’আলিম, ইলবে ইলম, তাঁদের প্রতি ভালোবাসা
পোষণকারী অথবা তাঁদের অনুসারী- এ চারটির যে কোন একটি হও। এর বাইরে পঞ্চম
কিছু হয়ো না। তাহলে ধ্বংস হয়ে যাবে। হাসানকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল পঞ্চমটি
কি? বললেনঃ বিদ’য়াতী। (হায়াতুস সাহাবা- ২/১৬০) তিনি আরও বলতেন, জ্ঞানী
ব্যক্তিদের সাথে প্রবেশ করা ও বের হওয়া একজন মানুষের বিজ্ঞতার পরিচায়ক।
(হায়াতুস সাহাবা- ৩/২৯)
দাহ্হাক থেকে বর্ণিত হয়েছে আবু দারদা শামবাসীদের
বলতেনঃ ওহে দিমাশ্কের অধিবাসীরা! তোমরা আমার দ্বীনী ভাই, বাড়ীর পাশের
প্রতিবেশী এবং শত্রুর বিরুদ্ধে সাহায্যকারী। আমার সাথে প্রীতির বন্ধন
সৃষ্টি করতে তোমাদের বাঁধা কিসের? তোমাদের কি হয়েছে যে, তোমাদের ’আলিমরা
চলে যাচ্ছেন অথচ তোমাদের জাহিলরা শিখছেনা? তোমরা শুধু জীবিকার ধান্দায়
ঘুরছো অথচ তোমাদেরকে যা কিছুর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তা ছেড়ে দিচ্ছ? শুনে
রাখ, একটি জাতি বড় বড় অট্টালিকা তৈরী করেছিল, বিশাল সম্পদ পুঞ্জিভূত
করেছিল। এভাবে তারা বড় উচ্চাভিলাষী হয়ে পড়েছিল। অবশেষে তাদের সেই সুউচ্চ
অট্টালিকা তাদের কবরে পরিণত হয়, তাদের উচ্চাভিলাষ তাদেরকে প্রতারিত করে এবং
তাদের পুঞ্জিভূত সম্পদ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। ওহে, তোমরা শেখ এবং অন্যকে
শিখাও। কারণ, শিক্ষাদানকারী ও গ্রহণকারীর প্রতিদান সমান সমান। এ দু’শ্রেণীর
মানুষ ছাড়া আর কারও মধ্যে অধিকতর কল্যাণ নেই।
হযরত হাসান থেকে বর্ণিত
হয়েছে। একবার তিনি দিমাশ্কবাসীদের উদ্দেশ্যে বলেনঃ ওহে, তোমরা বছরের পর বছর
পেট ভরে শুধু গমের রুটি খাবে- এতেই খুশী থাকবে? তোমাদের মজলিশ ও
সভা-সমিতিতে কি তোমরা আল্লাহকে স্মরণ করবে না? তোমাদের কী হয়েছে যে,
তোমাদের ’আলীমগণ চলে যাচ্ছেন আর তোমাদের জাহিলগণ তাঁদের নিকট থেকে কিছুই
শিখছে না? (হায়াতুস সাহাবা- ৩/১৬০, ১৬১)
হযরত আবু দারদা ছিলেন একজন
বা-’আমল আলিম। যা শিখেছিলেন তা যথাযথভাবে পালন করতেন। ইবন ইসহাক বর্ণনা
করে, সাহাবায়ে কিরাম বলতেনঃ আমাদের মধ্যে আবু দারদা ইলম অনুযায়ী সর্বাধিক
আমলকারী। আবু দারদা বলতেনঃ যে জানে তার ধ্বংস একবার, আর যে জেনে ’আমল করেনা
তার ধ্বংস সাতবার। সালেম ইবন আবিল জা’দ থেকে বর্ণিত। আবু দারদা বলতেনঃ
তোমরা আমার কাছে প্রশ্ন কর। আল্লাহর কসম! আমাকে হারালে তোমরা একজন মহান
ব্যক্তিকে হারাবে। (তারীখুল ইসলাম- ২/১০৯, ২১১)
হযরত আবু দারদার
শিক্ষাদানের নিয়ম ছিল ফজরের নামাযের পর জামে’ মসজিদে দারসের জন্য বসে
যেতেন। ছাত্ররা তাঁকে ঘিরে বসে প্রশ্ন করতো, আর তিনি জবাব দিতেন। যদিও তিনি
হাদীস ও ফিকাহ শাস্ত্রে বিশেষজ্ঞ ছিলেন, তবে তাঁর মূল বিষয় ছিল কুরআন
মজীদের দারস ও তা’লীম। হযরত রাসূলে কারীমের সা. জীবদ্দশায় যাঁরা সম্পূর্ণ
কুরআন মুখস্থ ও সংগ্রহ করেছিলেন, তিনি তাদের একজন। ইমাম বুখারী হযরত আনাস
রা. থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেনঃ আবু দারদা, মু’য়াজ, যায়িদ ইবন সাবিত ও
আবু যায়িদ আল-আনসারী- এ চারজন ছাড়া রাসূলুল্লাহর সা. মৃত্যু পর্যন্ত আর কেউ
সম্পূর্ণ কুরআন সংগ্রহ করেননি। ইমাম শা’বী অবশ্য উবাই ইবন কা’ব ও সা’ঈদ
ইবন ’উবায়েদ- এ দু’জনের নাম সংযোগ করে মোট ছয়জনের কথা বলেছেন। ইবন হাজার
ফাতহুল বারী (৯/৪৩) গ্রন্থে এমন ২৯ জন হাফেজে কুরআনের নাম উল্লেখ করেছেন।
(তারীখুল ইসলাম- ২/১০৮; আল-আ’লাম- ৫/২৮১; তাজকিরাতুল হুফ্ফাজ- ১/২৫)
যাইহোক, রাসূলুল্লাহর সা. জীবনকালের হুফ্ফাজে কুরআনদের অন্যতম সদস্য ছিলেন
আবু দারদা। এ কারণে খলীফা হযরত ’উমার রা. শামে কুরআনের তা’লীম ও তাবলীগের
জন্য তাঁকে নির্বাচন করেন। দিমাশ্কের জামে’ ’উমারী’তে তিনি কুরআনের দারস
দিতেন। অবশেষে এটা একটি শ্রেষ্ঠ কুরআন শিক্ষা কেন্দ্রে পরিণত হয়। তাঁর
অধিীনে আরো অনেক শিক্ষক ছিলেন। ছাত্রসংখ্যাও ছিল কয়েক হাজার। দূর-দূরান্ত
থেকে ছাত্ররা এসে তাঁর দারসে শরীক হতো।
ফজর নামাযের পর তিনি দশজন করে
একটি গ্রুপ করে দিতেন। প্রত্যেক গ্রুপের জন্য একজন করে ক্বারী থাকতেন।
ক্বারী কুরআন পড়াতেন। তিনি টহল দিতেন এবং ছাত্রদের পাঠ কান লাগিয়ে শুনতেন।
এভাবে কোন ছাত্রের সম্পূর্ণ কুরআন মুখস্থ হয়ে গেলে তাঁকে বিশেষভাবে
প্রশিক্ষণ দানের জন্য নিজের তত্ত্বাবধানে নিয়ে নিতেন। গ্রুপ শিক্ষক
ছাত্রদের কোন প্রশ্নের জবাব দিতে অক্ষম হলে তাঁর নিকট থেকেই জেনে নিতেন।
দারসে প্রচুর ছাত্র সমাগম হতো। একদিন গুণে দেখা গেল কেন্দ্র থেকে ১৬০০
ছাত্র বের হচ্ছে।
ইবন ’আমির ইয়াহসাবী, উম্মু দারদা সুগরা, খলীফা ইবন
সা’দ, রাশেদ ইবন সা’দ, খালিদ ইবন সা’দ প্রমুখ এই কুরআন শিক্ষা কেন্দ্রের
খ্যাতিমান ছাত্র-ছাত্রী। ইবন ’আমির ইয়াহসাবী ছিলেন খলীফা ওয়ালীদ ইবন আবদুল
মালিকের সময়ে মসজিদ বিষয়ক দফতরের রয়িস বা নেতা। আবু দারদার স্ত্রী উম্মু
দারদা সুগরা ছিলেন কিরাত শাস্ত্রের একজন অপ্রতিদ্বন্দ্বী বিশেষজ্ঞ। মূলতঃ
স্বামী নিকট থেকেই তিনি এ জ্ঞান অর্জন করেন। আতীয়্যা ইবন কায়েস কিলাবীকে
তিনিই কিরাত শেখান। খলীফা ইবন সা’দের এমন বৈশিষ্ট্য ছিল যে, লোকে তাঁকে আবু
দারদার সার্থক উত্তরাধিকারী বলতো। শামের বিখ্যাত ক্বারীদের মধ্যে তাঁকে
গণ্য করা হতো।
তাফসীর শাস্ত্রে যে সকল সাহাবী প্রসিদ্ধ তাঁদের মধ্যে
যদিও আবু দারদার নামটি পাওয়া যায় না, তবুও বেশ কিছু আয়াতের তাফসীর তাঁর
থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলতেন, মানুষ যতক্ষণ না কুরআনের নানা দিক বিবেচনায়
আনবে ততক্ষণ ফকীহ হতে পারবে না। জটিল আয়াতসমূহের ভাব তিনি রাসূলুল্লাহর
সা. নিকট জিজ্ঞেস করে জেনে নিতেন।
হযরত আবু দারদার নিকট কোন আয়াতের
তাফসীর জিজ্ঞেস করলে তিনি সন্তোষজনক জবাব দিতেন। একবার এক ব্যক্তি প্রশ্ন
করলোঃ وَلِمَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ جَنَّتَانِ এর মধ্যে কি ব্যভিচারী ও
চোর শামিল হবে? তিনি জবাব দিলেন, তার রব বা প্রভুর ভয় থাকলে সে কিভাবে
ব্যভিচার ও চুরি করতে পারে?
সূরা الْقَلَمِ- এ এক কাফির সম্পর্কে এসেছে
عُتُلٍّ بَعْدَ ذَٰلِكَ زَنِيمٍ এখানে ‘উ’তুল’ শব্দটির অর্থের ব্যাপারে
‘মুফাসসিরগণ নানা কথা বলেছেন। আবু দারদা তার ব্যাপক অর্থ বলেছেন। তিনি
বলেছেনঃ বড় পেট ও শক্ত হলক বিশিষ্ট অতিরিক্ত পানাহারকারী, সম্পদ
পুঞ্জিভূতকারী ও অতি কৃপণ ব্যক্তিকে ‘উতুল’ বলে।
এমনিভাবে সূরা তারিক-এ السَّرَائِرُ শব্দটি এসেছে। হযরত আবু দারদা এ শব্দটিরও একটি বিশেষ অর্থ বর্ণনা করেছেন।
আল্লাহর
কালাম কুরআন মজীদের তা’লীম ও খিদমতে পরে সাহাবায়ে কিরাম সবচেয়ে বেশী
গুরুত্ব দিয়েছেন রাসূলুল্লাহর সা. হাদীসের প্রচার ও প্রসারের ব্যাপারে।
হযরত আবু দারদা অতি সার্থকভাবে এ দায়িত্ব পালন করেন। হাদীস বর্ণনার
ক্ষেত্রে আবু দারদার এক বিশেষ স্টাইল ছিল। তাবারানী ইদরীস আল-খাওলানী থেকে
বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, আমি আবু দারদাকে দেখেছি, রাসূলের সা. কোন
হাদীস বর্ণনা শেষ করে তিনি বলতেনঃ এই অথবা এই রকম অথবা এ ধরণের। (হায়াতুস
সাহাবা- ৩/২৩৯)
ইবন ’আসাকির ইবরাহীম ইবরাহীম ইবন আবদুর রহমান ইবন আ’উফ
থেকে বর্ণনা করেছেন। খলীফা ’উমার রা. বিভিন্ন স্থানে অবস্থানরত বিশিষ্ট
সাহাবা- আবদুল্লাহ ইবন হুজাইফা, আবু দারদা, আবু জার ও ’উকবা ইবন ’আমিরকে
ডেকে পাঠান। তাঁরা হাজির হলে বলেনঃ এই যে আপনারা রাসূলের সা. হাদীসের নামে
যা কিছু প্রচার করছেন, এসব কী? তাঁরা বললেনঃ আপনি প্রচার করতে নিষেধ করেন?
’উমার বললেনঃ না। তবে আপনারা আমার পাশে থাকবেন। আমি আপনাদের থেকে গ্রহণ
অথবা বর্জন করবো। এ ব্যাপারে আমরা বেশী জানি। (হায়াতুস সাহাব- ৩/৪৪০, ৪৪১)
একবার
তিনি হযরত সা’দান ইবন তালহার নিকট একটি হাদীস বর্ণনা করলেন। দিমাশ্কের
মসজিদে তখন হযরত রাসূলে কারীমের সা. আযাদকৃত দাস হযরত সাওবান উপস্থিত
ছিলেন। হযরত সা’দান একটু বেশী আশ্বস্ত হওয়ার জনর্য হাদীসটি সম্পর্কে তাঁর
নিকট জিজ্ঞেস করলেন। সাওবান বললেন, আবু দারদা সত্য বলেছেন। আমিও সে সময়
রাসূলুল্লাহর সা. নিকট উপস্থিত ছিলাম। (মুসনাদ- ৬/৪৪২)
হযরত মু’য়াজ রা.
মৃত্যুর পূর্বক্ষণে একটি হাদীস বর্ণনা করে বলেছিলেন, এর জন্য সাক্ষী চাইলে
’উয়াইমির (আবু দারদা) আছেন, তাঁর কাছে তোমরা জিজ্ঞেস করতে পার। লোকেরা তাঁর
নিকট গেল। তিনি হাদীসটি শুনে বললেনঃ আমার ভাই (মু’য়াজ) সত্য বলেছেন।
(মুসনাদ- ৬/৪৫০)
সম্মানিত সাহাবায়ে কিরামের অভ্যাস ছিল, একে অপরের সাথে
মিলিত হলে তাঁরা রাসূলুল্লাহর সা. হাদীস সম্পর্কে আলোচনা করতেন। একবার একটি
সমাবেশে ’উবাদা ইবনুস সামিত, হারিস আল-কিন্দী ও মিকদাদ ইবন মা’দিকারিবের
সাথে আবু দারদাও উপস্থিত ছিলেন। তিনি ’উবাদাকে প্রশ্ন করলেন, অমুক যুদ্ধের
সময় রাসূল সা. কি খুমুস সম্পর্কে কিছু বলেছিলেন? ’উবাদার স্মরণ হলো। তিনি
পুরো ঘটনা বর্ণনা করলেন।
হযরত আবু দারদার গোটা জীবন কেটেছে আল্লাহর
কালাম ও হাদীসে নববীর শিক্ষাদান ও প্রচারে। তাঁর মৃত্যুর পূর্বক্ষণে শহরের
নানা শ্রেণীর অধিবাসীদের সমবেত করে তাদেরকে ঠিকমত নামায আদায়ের শেষ অসীয়াত
করে যান। তাঁর নিকট হাদীসের যে ভান্ডার ছিল তা তিনি সরাসরি রাসূলুল্লাহর
সা. নিকট থেকে সংগ্রহ করেন। রাসূলুল্লাহর সা. ইনতিকালের পর কিছু হাদীস তিনি
যায়িদ ইবন সাবিত ও ’আয়িশা রা. থেকেও বর্ণনা করেন।
হাদীস শাস্ত্রে তাঁর
ছাত্র এবং তাঁর থেকে হাদীস বর্ণনাকারীদের গন্ডি ছিল সীমিত। আনাস ইবন মালিক,
ফুদালা ইবন ’উবাইদ, আবু উমামা, ’আবদুল্লাহ ইবন ’উমার, ’আবদুল্লাহ ইবন
’আব্বাস, উম্মু দারদা প্রমুখের ন্যায় বিশিষ্ট সাহাবীরা তাঁর থেকে হাদীস
বর্ণনা করেছেন।
অধিকাংশ খ্যাতিমান ’আলিম তাবে’ঈ তাঁর নিকট ইলমে হাদীস
হাসিল করেছেন এবং তাঁর সূত্রে হাদীস বর্ণনাও করেছেন। এখানে সর্বাধিক
খ্যাতিমান কয়েকজনের নাম উল্লেখ করা হলোঃ
সা’ঈদ ইবন মুসায়্যিব, বিলাল ইবন
আবু দারদা, ’আলকামা ইবন কায়স, আবু মুররা মাওলা উম্মে হানী, আবু ইদরীস
খাওলী, জুবাইর ইবন নাদীর, সুওয়ায়িদ ইবন গাফলা, যায়িদ ইবন ওয়াহাব, মা’দান
ইবন আবী তালহা, আবু হাবীবা তাঈ, আবুস সাফার হামাদানী, আবু সালামা ইবন
’আবদির রহমান, সাফওয়ান ইবন ’আবদিল্লাহ, কুসায়্যিব ইবন কায়স, আবু বাহরিয়্যা
’আবদুল্লাহ ইবন কায়স, কুসায়্যিব ইবন মুররা, মুহাম্মাদ ইবন সীরীন, মুহাম্মাদ
ইবন সুওয়াইদ আবী ওয়াক্কাস, মুহাম্মাদ ইবন কা’ব আল-কুরাজী, হিলাল ইবন
ইয়াসাফ প্রমুখ। (তাহজীবুত তাহজীব- ৮/১৫৬; তাজকিরাতুল হুফ্ফাজ- ১/২৪;
তারীখুল ইসলাম- ২/১০৭)
হযরত আবু দারদার সূত্রে বর্ণিত হাদীস, যা হাদীসের
বিভিন্ন গ্রন্থে পাওয়া যায় তার মোট সংখ্যা- ১৭৯ (এক শো উনাশি)। এর মধ্যে
বুখারী শরীফে ১৩টি ও মুসলিম শরীফে ৮টি সংকলিত হয়েছে। (আল-আ’লাম- ৫/২৮১;
তারীখুল ইসলাম- ২/১০৭)
ফিকাহ শাস্ত্রেও তিনি এক বিশেষ স্থানের অধিকারী
ছিলেন। মানুষ বহু দূর-দূরান্ত থেকে মাসয়ালা জানার জন্য তাঁর কাছে আসতো। এক
ব্যক্তি তো শুধু একটি মাসয়ালা জানার জন্য সুদূর কুফা থেকে দিমাশ্কে তাঁর
নিকট আসেন। সেই বিশেষ মাসয়ালাটি ছিল এ রকমঃ
উক্ত ব্যক্তি প্রথমে বিয়ে
করতে রাজী ছিলনা। কিন্তু পরে মায়ের চাপাচাপিতে বিয়ে করে। বিয়ের পর যখন
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে গভীর ভালোবাসা গড়ে ওঠে তখন মা আবার স্ত্রীকে তালাক
দেওয়ার জন্য চাপাচাপি শুরু করে দেন। এখন সে তালাক দিতে চায়না। সবকিছু শুনে
আবু দারদা বলরেন, আমি সুনির্দিষ্টভাবে কারো সাথে- না মায়ের সাথে, না
স্ত্রীর সাথে, সম্পর্ক ছেদ করার কথা বলবো না। আমি তোমার স্ত্রীকে তালাক
দেওয়ার কথাও বলবো না, আবার মায়ের নাফরমানীও জায়েয মনে করবো না। তোমার ইচ্ছা
হলে তালাকও দিতে পার, আবার এখন যেমন আছ তেমন থাকতেও পার। তবে একথা যেন
স্মরণ থাকে যে, রাসূলুল্লাহ সা. মাকে জান্নাতের দরজা বলে অভিহিত করেছেন।
(মুসনাদ- ৫/৯৮; সীয়ারে আনসার- ২/২০০)
আবু হাবীব তাঈ একবার তাকে জিজ্ঞেস
করলেন, আমার ভাই কিছু দীনার ‘ফী সাবীলিল্লাহ’ (আল্লাহর রাহে) দান করেন এবং
মরণকালে অসীয়াত করে যান, দীনারগুলি যেন দানের খাতসমূহের কোন একটিতে দিয়ে
দিই। এখন আপনি বলুন, সবচেয়ে উত্তম খাত কোনটি? তিনি জবাব দিলেন, আমার নিকট
উত্তম খাত ‘জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহ (আল্লাহর পথে জিহাদ)।
হযরত আবু দারদা
ছিলেন স্বভাবগতভাবেই সৎ ও সত্যনিষ্ঠ প্রকৃতির। ইসলামী শিক্ষা তাঁর এ
প্রকৃতিকে আরো দীপ্ত ও স্বচ্ছ করে তোলে। গোটা সাহাবাকুলের মধ্যে হযরত আবু
জার আল গিফারী ছিলেন সবচেয়ে বড় স্পষ্টভাষী ও স্বাধীনচেতা। প্রথম পর্যায়ে
তিনিও শামে থাকতেন। সেখানে খুব কম লোকই তাঁর কঠোরতার হাত থেকে রেহাই
পেয়েছেন। হযরত আমীর মা’য়াবিয়াকে রা. তিনি তাঁর দরবারে কঠোর সমালোচনা
করেছেন। ইসলামী বিধি-নিষেধের ব্যাপারে এহেন কঠোর ব্যক্তি একদিন আবু দারদাকে
বললেনঃ আপনি যদি রাসূলুল্লাহর সা. সাক্ষাৎ নাও পেতেন অথবা রাসূলুল্লাহর
সা. ওফাতের পর ইসলাম গ্রহণ করতেন তাহলেও নেককার মুসলমানদের মধ্যে গণ্য
হতেন। হযরত আবু দারদার রা. আখলাকের পবিত্রতার জন্য এর চেয়ে বড় সনদ আর কী
হতে পারে?
তিনি ছিলেন নবীর সা. সহচর। মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ তা’য়ালার
ভয়ে তাঁর দেহে কম্পন সৃষ্টি হতো। একবার তো মসজিদের মিম্বরে দাঁড়িয়ে খুতবার
মধ্যে বলতে লাগলেন, আমি সেই দিনের ব্যাপারে খুবই ভীত যেদিন আল্লাহ আমাকে
জিজ্ঞেস করবেন, তুমি কি তোমার ইল্ম অনুযায়ী ’আমল করেছো? যে দিন কুরআনের
প্রতিটি আয়াত জীবন্তরূপে আমার সামনে এসে দাঁড়াবে এবং আমার কাছে জিজ্ঞেস
করবে তুমি কুরআনের নির্দেশের কতটুকু অনুসরণ করেছো? নির্দেশসূচক আয়াত তখন
আমার বিরুদ্ধে স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়াবে এবং বলবে, কোন কিছুই করেনি। তারপর
প্রশ্ন করা হবে নিষেধ থেকে কতটুকু দূরে থেকেছো? নিষেধসূচক আয়াত তখন বলে
উঠবে, কিছুই করেনি। ওহে জনমন্ডলী! আমি কি সেদিন মুক্তি পাব? (কানযুল
’উম্মাল- ৭/৮৪; হায়াতুস সাহাবা- ৩/৪৮৮,৪৮৯)
পরকালের ভয়ে সব সময় তিনি ভীত
থাকতেন। হিযাম ইবন হাকীম বলেন, আবু দারদা বলতেনঃ মরণের পর যে কী হবে তা
যদি তোমরা উপলব্ধি করতে তাহলে তৃপ্তির সাথে পানাহার করতে পারতে না এবং রোদ
থেকে বাঁচার জন্য ছাদওয়ালা ঘরেও প্রবেশ করতে না। বরং রাস্তায় বেরিয়ে বুক
চাপড়াতে আর কাঁদতে। তিনি আরো বলতেনঃ হায়! আমি যদি গাছ হতাম, আর গরু-ছাগলে
খেয়ে ফেলতো। আমি যদি আমার পরিবারের ছাগল হতাম, আর তারা আমাকে জবেহ করে
টুকরো টুকরো করে অতিথি-মেহমানদের নিয়ে খেয়ে ফেলতো। অথবা আমি যদি এই খুঁটি
হয়ে জন্মাতাম। তাহলে হিসাব নিকাশের কোন ভয় থাকতো না। (কানযুল ’উম্মাল-
২/১৪৫; হায়াতুস সাহাবা- ২/৬২০,৬২১)
ইবাদাতের ক্ষেত্রে পাঞ্জেগানা ও
কিয়ামুল লাইল ছাড়াও তিনটি জিনিস অত্যন্ত কঠোরভাবে পালন করতেন। ১. প্রত্যেক
মাসে তিন দিন সাওম পালন করতেন। ২. বিতর নামায আদায় করতেন। ৩. আবাসে-প্রবাসে
সকল অবস্থায় চাশ্তের নামায আদায় করতেন। এগুলি সম্পর্কে রাসূল সা. তাঁকে
অসীয়াত করেছিলেন।
তিনি প্রত্যেক ফরজ নামাযের পর তাসবীহ পাঠ করতেন।
তাসবীহ ৩৩ বার, তাহমীদ ৩৩ বার এবং তাকবীর ৩৪ বার। (মুসনাদ- ৫/১৯৬) উম্মু
দারদা থেকে বর্ণিত। একবার আবু দারদার নিকট একটি লোক এলো। আবু দারদা তাঁকে
জিজ্ঞেস করলেন আপনি থাকবেন না চলে যাবেন? থাকলে বাতি জ্বালাই, নইলে আপনার
বাহনের খাদ্য দিই। লোকটি চললোঃ চলে যাব। আবু দারদা বললেনঃ আমি আপনাকে পাথেয়
দান করবো। যদি এর চেয়ে উত্তম কোন পাথেয় পেতাম তাহলে তাই আপনাকে দিতাম।
একবার আমি রাসূলুল্লাহর সা. নিকট গিয়ে বললামঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ! ধনীরা
দুনিয়া ও আখিরাত দুটোই লুটে নিল। আমরাও নামায পড়ি, তারা পড়ে, আমরাও রোযা
রাখি, তারাও রাখে। কিন্তু তারা সাদাকা করে, আমরা তা করতে পারিনা। রাসূল সা.
বললেনঃ আমি কি তোমাকে একটি জিনিস বলে দেব না, যদি তুমি তা কর তাহলে তোমার
পূর্বের ও পরের কেউ তোমাকে অতিক্রম করতে পারবেনা? তবে যে তোমার মত করবে,
কেবল সেই তোমার সমান হবে। সে জিনিসটি হলোঃ প্রত্যেক নামাযের পর ৩৩ বার
তাসবীহ, ৩৩ বার আল-হামদুলিল্লাহ এবং ৩৪ বার আল্লাহু আকবার পাঠ করবে।
(হায়াতুস সাহাবা- ৩/৩০৫)
আর একবার আবু দারদা বলেনঃ এক শো দীনার সাদাকা
করার চেয়ে এক শো বার তাকবীর পাঠ করা আমার নিকট অধিকতর প্রিয়। (হায়াতুস
সাহাবা- ৩/২৭৯) তিনি প্রতি মুহূর্ত তাসবীহ পাঠে নিরত থাকতেন। একবার তাঁকে
প্রশ্ন করা হলো, আপনি প্রতিদিন কতবার তাসবীহ পাঠ করেন? বললেনঃ এক রাখ বার।
তবে আমার আংগুল যদি ভুল করে তবে তা ভিন্ন কথা। (তারীখুল ইসলাম- ২/১১০)
একবার
আবু দারদাকে বলা হলোঃ আবু সা’দ ইবন মুনাব্বিহ্ এক শো দাস মুক্ত করেছে।
তিনি বললেনঃ একজন লোকের সম্পদের জন্য এক শো দাস অনেক। তুমি শুনতে চাইলে এর
চেয়ে উত্তম জিনিসের কথা আমি তোমাকে শোনাতে পারি। আর তা হলোঃ দিবা-রাত্রির
অবিচ্ছিন্ন ঈমান, আর সেই সাথে আল্লাহর জিক্র (স্মরণ) থেকে তোমার জিহ্বা
বিরত না থাকা। (হায়াতুস সাহাবা- ৩/১২)
একবার এক ব্যক্তি আবু দারদার নিকট
এসে বললো, আমাকে কিছু অসীয়াত করুন। বললেনঃ সুখের সময় আল্লাহকে স্মরণ কর,
তিনি তোমার দুঃখের সময় স্মরণ করবেন। দুনিয়ার কোন জিনিসের প্রতি যখন তাকাবে
তখন তার পরিণতির প্রতি একটু দৃষ্টি দেবে। (হায়াতুস সাহাবা- ৩/২৭৬)
হযরত
রাসূলে কারীম সা. তাঁকে জিকর শিক্ষা দিয়েছেন। একদিন রাসূল সা. বললেনঃ আবু
দারদা, তুমি কী পাঠ কর? বললেনঃ আল্লাহর জিক্র করি। রাসূল সা. বললেনঃ আমি কি
রাত-দিনে আল্লাহর যে জিক্র করা হয় তার থেকে কিছু শিখিয়ে দেব না? আবু দারদা
বললেন হাঁ, শিখিয়ে দিন। তখন রাসূল সা. তাঁকে একটি জিক্র শিখিয়ে দেন।
(হায়াতুস সাহাবা- ৩/৩০২)
রাসূলুল্লাহর সা. নিকট থেকে শ্রুত বাণীর প্রতি
তাঁর পূর্ণ বিশ্বাস ও ইয়াকীন ছিল। একবার এক ব্যক্তি তাঁর কাছে এসে বললোঃ
আবু দারদা। আপনার বাড়ীটি আগুনে পুড়ে গেছে। তিনি বললেনঃ না পুড়েনি। এরপ
দু’ব্যক্তি একের পর এক একই খবর নিয়ে এলো। তিনিও একই জবাব দিলেন। চতুর্থ এক
ব্যক্তি এসে বললো, আগুন লেগে ছিল; কিন্তু আপনার ঘর পর্যন্ত এসে তা নিভে
যায়। একথা শুনে তিনি বলেন, আমি জেনেছি, আল্লাহ অবশ্যই তা করেন না। তখন
লোকটি বললোঃ ওহে আবু দারদা! আপনি যে বললেন, ‘আমার ঘর পুড়েনি’ এবং ‘আমি
জেনেছি, আল্লাহ অবশ্যই তা করেন না’- এ দু’টি কথার মধ্যে কোনটি সর্বাধিক
বিস্ময়কর? তিনি বললেনঃ আমি রাসূলুল্লাহর সা. নিকট থেকে কিছু বাক্য শিখেছি,
কেউ সেগুলি সকালে পাঠ করলে সন্ধ্যা পর্যন্ত কোন বিপদে পড়েনা। তারপর তিনি
সেই বাক্যগুলি উচ্চারণ করেন। (বায়হাকীঃ আসমা ও সিফাত অধ্যায়- ১২৫; হায়াতুস
সাহাবা- ৩/৭০)
হযরত আবু দারদার জীবন ছিল অতি সরল ও অনাড়ম্বর। দুনিয়ার
কোন চাকচিক্য, জৌলুষ, ভোগ-বিলাস তাঁর গায়ে কক্ষণো দাগ কাটতে পারেনি। তিনি
বলতেন, দুনিয়ায় মানুষের একজন মুসাফিরের মত থাকা উচিত। সূফীরা তাঁকে ‘আসহাবে
সুফ্ফা’র সদস্যদের মধ্যে গণ্য করে থাকেন এবং ‘যুহুদ ও তাকওয়া’র বিষয়েল ওপর
তাঁর বহু মূল্যবান বাণী- তারা বর্ণনা করেছেন। (দায়িরা-ই-মা’য়ারিফ
ইসলামিয়্যা- ১/৮০০)
একবার হযরত সালমান আল-ফারেসী রা. সাক্ষাতের জন্য
তাঁর গৃহে আসলেন। তাঁরা ছিলেন পরস্পর দ্বীনি ভাই। তিনি আবু দারদার স্ত্রীকে
অতি সাধঅরণ বেশভূষায় দেখতে পেয়ে তাঁর এমন দীন-হীন অবস্থার কারণ জানতে
চাইলেন। তিনি বললেন, আপনার ভাই আবু দারদা দুনিয়ার প্রতি সম্পূর্ণ উদাসীন
হয়ে গেছেন। এখন আর তাঁর কোন কিছুর প্রতি কোন রকম আগ্রহ নেই। আবু দারদা ঘরে
ফিরলেন। সালাম বিনিময়ের পালা শেষ হলে খাবার এলো। সালমান আবু দারদাকে
খাবারের জন্য ডাকলেন। আবু দারদা বললেন, আমি সাওম পালন করছি। সালমান কসম
খেয়ে বললেন, আপনাকে অবশ্যই আমার সাথে খেতে হবে, অন্যথায় আমিও খাব না।
সালমান আবু দারদার বাড়ীতে রাত্রি যাপন করলেন। রাতে আবু দারদা নামায পড়ার
জন্য উঠলেন। সালমান তাঁকে বাধা দিয়ে বললেনঃ ভাই আপনার ওপর আল্লাহর যেমন হক
আছে, তেমনি স্ত্রীরও আছে। আপনার দেহেরও আছে। সুতরাং আপনি ইফতার করবেন,
নামায পড়বেন, স্ত্রীর কাছে যাবেন এবং সকলের হক আদায় করবেন। শেষ রাতে সালমান
তাঁকে ঘুম থেকে জাগালেন, দুইজন এক সাথে নামায পড়লেন এবং এক সাথে মসজিদে
নববীতে চলে গেলেন। সকালে আবু দারদা রাসূলুল্লাহর সা. নিকট সালমানের ঘটনা
বর্ণনা করলেন। রাসূল সা. বললেন, সালমান ঠিক বলেছে। সে তোমার চেয়ে বেশী
বুদ্ধিমান। (তারীখুল ইসলাম- ২/১০৯; হায়াতুস সাহাবা- ২/৬৯২,৬৯৩)
বিলাল
ইবন সা’দ বলেন। আবু দারদা প্রায়ই দু’আ করতেনঃ হে আল্লাহ! আমার অন্তরের
বিক্ষিপ্ততা থেকে আমি আপনার পানাহ চাই। প্রশ্ন করা হলোঃ অন্তরের
বিক্ষিপ্ততা আবার কী? বললেনঃ প্রতিটি উপত্যকায় আমার সম্পদ ছড়িয়ে থাকাই
হচ্ছে অন্তরের বিক্ষিপ্ততা। (হায়াতুস সাহাবা- ৩/৩৮৩)
আবু নু’য়াইম ‘আল
হুলইয়্যা’ গ্রন্থে (১/২২২) খালিদ ইবন হুদাইর আল-আসলামী থেকে বর্ণনা করেছেন।
একবার তিনি আবু দারদার ঘরে গিয়ে দেখলেন, তিনি চামড়া অথবা পশমের বিছানার
ওপর বসে আছেন। তাঁর গায়ে মোটা পশমের কাপড় এবং পায়েও পশমের জুতো। আর তিনি
তখন অসুস্থ। এ অবস্থায় তিনি শুধু ঘামছেন। খালিদ বললেনঃ আপনি অনুমতি দিলে
আমীরুল মুমিনীদের নিকট থেকে প্রেরিত উত্তম বিছানা ও পোশাক আপনার জন্য আনতে
পারি। জবাবে তিনি বললেনঃ আমার তো অন্য একটি বাড়ী আছে। আমি সেখানেই চলে যাব
এবং সেখানে যাওয়ার জন্যই কাজ করছি। সুতরাং এতকিছুর প্রয়েঅজন কি? (হায়াতুস
সাহাবা- ২/২৯৬)
একবার আবু দারদার গৃহে কয়েকজন মেহমান এলো। সময়টি ছিল
শীতকাল। তিনি গরম খাবার তো দিলেন; কিন্তু গরম বিছানা দিলেন না। মেহমানদের
একজন তার সঙ্গীদের বললেনঃ আমাদের গরম খাবার তো দিলেন, কিন্তু শীত নিবারণের
জন্য কোন কিছু তো দিলেন না। এভাবে থাকা যাবে না। তাঁর কাছে চাইতে হবে। অন্য
একজন বললোঃ বাদ দাও। কিন্তু এক ব্যক্তি কারো কথা না শুনে সোজা বাড়ীর ভিতরে
ঢুকে গেল। সে দেখলো, আবু দারদার পাশেই তাঁর স্ত্রী বসে আছেন; কিন্তু তাদের
গায়েও তেমন কোন শীতের কাপড় নেই। লেকাটি ফিরে গেল। পরে সে আবু দারদাকে
জিজ্ঞেস করলোঃ আপনি আমাদের মতই শীত বস্ত্র ছাড়াই রাত কাটালেন কেন? জবাব
দিলেন, আমাদের অন্য একটি বাড়ী আছে। আর সেখানেই আমরা চলে যাব। আমাদের
বিছানাপত্র ও লেপ-তোষক সবই সেখানে পাঠিয়ে দিয়েছি। তার কিছু আমাদের কাছে
থাকলে অবশ্য তোমাদের কক্ষে পাঠিয়ে দিতাম। (সিফাতুস সাফওয়া- ১/২৬৩; হায়াতুস
সাহাবা- ২/২৯৭)
মু’য়াবিয়া ইবন কুররা বরেন, আবু দারদা বলতেনঃ আমি তিনটি
জিনিস পসন্দ করি, অথচ মানুষ সেগুলি অপসন্দ করে। দারিদ্র, রোগ ও মৃত্যু।
মৃত্যুকে আমি পসন্দ করি আমার রব বা প্রভুর সাথে মিলিত হওয়ার জন্য,
দারিদ্রকে পসন্দ করি প্রভুর সামনে বিনীতভাবে প্রকাশের জন্য, আর রোগ পসন্দ
করি আমার পাপের কাফ্ফারার জন্য। (তাজকিরাতুল হুফ্ফাজ- ১/২৫; তারীখুল ইসলাম-
২/১১০)
রাসূলুল্লাহর সা. দারসগাহে যাঁরা শিক্ষা পেয়েছিলেন, তাঁরা সবাই
বুঝেছিলেনঃ ’আমর বিল মা’রূফ বা সৎ কাজের আদেশ তাঁদের ওপর ফরজ। হযরত আবু
দারদা এ ফরজের ব্যাপারে উদাসীন ছিলেন না। একবার হযরত মু’য়াবিয়া একটি রূপোর
পাত্র খরীদ করলেন। বিনিময়ে তিনি কিছু কম-বেশী রূপোর মুদ্রা বিক্রেতাকে
দিলেন। শরীয়াতের দৃষ্টিতে এটা ছিল অবৈধ। বিষয়টি আবু দারদা অবগত হওয়ার সাথে
সাথে প্রতিবাদ করে বলেন, ওহে মু’য়াবিয়া! এমন কেনা-বেচা জায়েজ নয়। রাসূল সা.
সোনারূপোর বিনিময়ে সমতার নির্দেশ দিয়েছেন।
ইউসুফ ইবন আবদিল্লাহর
ঘটনাটি পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি আবু দারদার কাছে এসেছিলেন এক
উদ্দেশ্যে, আর বলেছিলেন ভিন্ন কথা। এ কারণে আবু দারদা সংগে সংগে তাঁকে
শুধরে দিয়ে বলেছিলেনঃ মিথ্যা বলা খুবই খারাপ কাজ। (মুসনাদ- ৬/৪৫০)
আমীর
মু’য়াবিয়া রা. হযরত আবু জারকে রা. শাম থেকে বের করে দিলেন। পথ চলা কালে আবু
দারদার কানে খবরটি পৌঁছালে অবলীলাক্রমে তাঁর মুখ দিয়ে ‘ইন্নালিল্লাহ’
উচ্চারিত হলো। তারপর তিনি বললেনঃ উটের সাথীদের সম্পর্কে যেমন বলা হয়েছে,
তেমনি তাদের ব্যাপারে অপেক্ষা কর। (উটের সাথী দ্বারা হযরত সালেহর আ. সংগী
সাথী বুঝিয়েছে।) তারপর অত্যন্ত আবেগের সাথে বলতে লাগলেন, হে আল্লাহ! তারা
আবু জারকে মিথ্যাবাদী বলেছেন, কিন্তু আমি তা বলি না। লোকে তাঁর ওপর মিথ্যা
দোষারোপ করেছে, কিন্তু আমি তা করিনা। তারা তাঁকে দেশ থেকে বের করে দিয়েছে,
কিন্তু আমি এ ব্যাপারে তাদের সাথে নই। কারণ আমি জানি, রাসূল সা. ধরাপৃষ্ঠে
তাঁর মত আর কাউকে সত্যবাদী মনে করতেন না এবং তাঁর মত আর কারো নিকট গোপন কথা
বলতেন না। যার হাতে আমার জীবন সেই সত্তার শপথ, যদি আবু জার আমার হাতও কেটে
দেন তবুও আমি তাঁর প্রতি কোন কেম বিদ্বেষ পোষণ করবো না। কারণ, রাসুল সা.
বলেছেনঃ আসমানের নীচে ও যমীনের ওপরে আবু জার অপেক্ষা অধিকতর সত্যবাদী আর
কেউ নেই।
ইবন ’আসাকির বর্ণনা করেছেন। আবু দারদা একবার মাসলামা ইবন
মুখাল্লাদকে লিখলেনঃ বান্দা যখন আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করে তখন
আল্লাহ তাকে ভালোবাসেন। আর আল্লাহ যখন তাঁকে ভালোবাসেন তখন তার সকল বান্দার
প্রিয়পাত্র করে দেন। অপর দিকে বান্দা যখন আল্লাহর নাফরমানির কাজ করে তখন
তার ওপর আল্লাহর ক্রোধ পতিত হয়। যখন সে আল্লাহর ক্রোধে পতিত হয় তখন সে তার
সৃষ্টিরও ক্রোধের পাত্রে পরিণত হয়। (কানযুল ’উম্মাল- ৮/২২৭, হায়াতুস
সাহাবা- ৩/৫১৪)
হযরত রাসূলে কারীম সা. একদিন বললেন, যে ব্যক্তি তাওহীদের
কালেমা উচ্চারণ করবে সে জান্নাতে যাবে। আবু দারদা প্রশ্ন কররেন- সে যদি
যিনা বা চুরি করে, তবুও? রাসূল সা. বললেনঃ হাঁ, তবুও। এমন একটা খোশখবর
মানুষের কাছে পৌঁছানো উচিত। আবু দারদা তিনবার জিজ্ঞেস করে মানুষের নিকট এ
খবর পৌঁছানোর জন্য বেরিয়ে পড়লেন। পথে ’উমারের সাথে সাক্ষাত। তিনি বললেনঃ
এমন কাজ করো না। এতে মানুষ ’আমল ছেড়ে দেবে। আবু দারদা ফিরে বিষয়টি রাসুলকে
সা. জানালেন। তিনি বললেন, ’উমার ঠিক বলেছে। (মুসনাদ- ৫/৪১)
একদিন তিনি
বাহির থেকে ঘরে ফিরলেন। চোখে-মুখে উত্তেজনার ছাপ। স্ত্রী জিজ্ঞেস করলেনঃ কী
হয়েছে? বললেনঃ আল্লাহর কসম! শুধুমাত্র জামায়াতে নামায আদায় ছাড়া
রাসূলুল্লাহর সা. একটি কাজও আর পালিত হচ্ছে না। মানুষ সব ছেড়ে দিয়েছে।
(হায়াতুস সাহাবা- ৩/১২৩)
একবার সা’দান ইবন আবী তালহার সাথে তাঁর দেখা
হলে জিজ্ঞেস করেনঃ আপনার বাড়ী কোথায়? সা’দান বললেনঃ গ্রামে। তবে শহরের
কাছাকাছি। তখন তিনি বললেনঃ তাহলে আপনি শহরে নামায পড়বেন। যেখানে আযান এবং
নামায হয়না সেখানে শয়তানের আধিপত্য বিস্তার লাভ করে। দেখ, নেকড়ে সেই মেষকে
ধরে যে দলছুট হয়ে যায়। (মুসনাদ- ৬/৪৫৯)
গোটা মুসলিম সমাজ তাঁকে অত্যন্ত
সমীহ ও সম্মান করতো। উত্তেজিত অবস্থায়ও তিনি যা কিছু বলতেন, মানুষ অন্তর
দিয়ে তা শুনতো। একবার এক কুরাইশী এক আনসারীর দাঁত ভেঙ্গে দেয়। হযরত আমীর
মু’য়াবিয়ার রা. দরবারে বিচার গেল। তিনি কুরাইশীকে অপরাধী ঘোষনা করলেন। তখন
সে বললো, আনসারী লোকটি প্রথমে আমার দাঁতে ব্যথা দেয়। একথা শুনে আমীর
মু’য়াবিয়া বললেনঃ একটু থাম, আমি আনসারীকে রাজী করাচ্ছি। কিন্তু
আনসারী-কিসাসের দাবীতে অটল রইল। সে রাজী হলো না। আমীর মু’য়াবিয়া বললেন, এই
যে আবু দারদা আসছেন, তিনি যে ফায়সালা করেন তাই মেনে নাও। আবু দারদা ঘটনাটি
শুনে এই হাদীসটি বর্ণনা করেনঃ কোন ব্যক্তি কাউকে দৈহিক কষ্ট দিলে
কষ্টপ্রাপ্ত ব্যক্তি যদি তাকে ক্ষমা করে দেয় তাহলে আল্লাহ তার মর্যাদা
বৃদ্ধি করে দেন এবং তার গুনাহ মাফ হয়ে যায়। আবু দারদার মুখ থেকে এ হাদীসটি
শোনার সাথে সাথে আনসারী লোকটি- যে তখন দারুণ উত্তেজিত ছিল, রাজী হয়ে গেলে।
সে আবু দারদাকে জিজ্ঞেস করলো, হাদীসটি কি আপনি রাসূলুল্লাহর সা. মুখ থেকে
শুনেছেন? তিনি বললেন- হাঁ! আনসারী বললেন, তাহলে আমি তাঁকে মাফ করে দিলাম।
(মুসনাদ- ৬/৪৪৮)
তিনি সব সময় সব রকম ফিত্না ও অশান্তি থেকে দূরে থাকতেন।
হিজায অপেক্ষা শাম কোন দিক দিয়েই ভালো ছিল না। তবে ফিত্না ও অশান্তি থেকে
দূরে থাকার জন্যই শামে বসবাস করতেন। তিনি বলতেন, যেখানে দু’জন লোকও একহাত
পরিমাণ ভূমির জন্য বিবাদ করে সে স্থানও ত্যাগ করা আমি পসন্দ করি।
তিনি
আরো বলতেন তোমরা বাজারের মজলিস থেকে দূরে থাক। কারণ, এসব মজলিস তোমাদেরকে
খেলা ও হাসি-তামাশার দিকে নিয়ে যায়। (কানযুল ’উম্মাল- ২/১৫৯; হায়াতুস
সাহাবা- ২/৬৫০)
তিনি সব সময় চুপচাপ থাকতে এবং চিন্তা-অনুধ্যানে সময়
কাটাতে পসন্দ করতেন। ’আউন ইবন ’আবদিল্লাহ একবার উম্মু দারদাকে জিজ্ঞেস
করলেনঃ আবু দারদার সর্বোত্তম আমল ছিল কোনটি? বললেনঃ গভীর চিন্তা ও
অনুধ্যান। আবু দারদা আরও বলতেনঃ এক ঘন্টা চিন্তা করা সারারাত ইবাদাত
অপেক্ষা উত্তম। (সিফাতুস সাফওয়অ- ১/২৫৮; কানযুল ’উম্মাল- ২/১৪২; হায়াতুস
সাহাবা- ২/৬২৭) তিনি আরও বলতেনঃ তোমরা যেমন কথা বলা শেখ, তেমনি চুপ থাকাও
শেখ। কারণ, চুপ থাকা বিরাট সহনশীলতা। বলার চেয়ে শোনার প্রতি আগ্রহী হও।
অহেতুক কোন কথা বলো না। (হায়াতুস সাহাবা- ২/৬৩২)
তিনি সব সময় হাসি মুখে
থাকতেন এবং মানুষের সাথে খোশ-মেযাজে মিশতেন। কথা বলার সময় ঠোঁটে হাসি ঝরতো।
আর এ হাসিকে স্ত্রী উম্মু দারদা মর্যাদার পরিপন্থী মনে করতেন। একদিন তো
বলেই বসলেন, এই যে আপনি প্রতি কথায় মুচকি হাসি দেন এতে লোকে আপনাকে নির্বোধ
মনে না করে। আবু দারদা বললেনঃ রাসূল সা. তো কথা বলার সময় মৃদু হাসতেন।
(হায়াতুস সাহাবা-৩/২০৩)
তাঁর স্বভাব ছিল সরল ও অনাড়ম্বর। দিমাশ্কের
মসজিদ চত্বরে নিজ হাতে গাছ লাগাতেন। রাসূলুল্লাহর সা. সাহাবী ও মসজিদের
হালকায়ে দারসের ইমাম হয়ে এত ছোট ছোট কাজ নিজ হাতে করাতে লোকে অবাক হয়ে যেত।
এক ব্যক্তি তো একবার তাঁকে বিস্ময়ের সাথে প্রশ্ন করে বসে, আপনি নিজেই এমন
কাজ করেন? আবু দারদা তাঁর বিস্ময়ের জবাবে বলেন, এতে খুব সওয়াব।
তিনি
অত্যন্ত দানশীল ও অতিথিপরায়ণ ছিলেন। অভাব-অনটন সত্ত্বেও মেহমানের খিদমতের
কোন প্রকার ত্রুটি কক্ষণো করতেন না। অধিকাংশ সময় তাঁর বাড়ীতে লোক থাকতেন।
কোন মেহমান এলে তিনি জিজ্ঞেস করতেনঃ থাকবেন না চলে যাবেন? যদি যাওয়ার ইচ্ছা
ব্যক্ত করতো, তাহলে তিনি তার পাথেয় দিয়ে দিতেন। কোন কোন লোক কয়েক সপ্তাহ
অবস্থান করতো। হযরত সালমান আল-ফারেসী-দিমাশ্কে গেলে তাঁরই বাড়ীতে অবস্থান
করতেন।
তাঁর অন্তরটি ছিল বড় কোমল ও উদার। কাউকে ঘৃণা করা বা গালি দেওয়া
পসন্দ করতেন না। একদিন কোথায় যেন যাচ্ছিলেন। দেখলেন, বেশ কিছু লোক এক
ব্যক্তিকে গালি দিচ্ছে। জিজ্ঞেস করে জানলেন যে, সে কোন পাপ কাজ করেনে। হযরত
আবু দারদা লোকদের বললেন, কেউ কুয়ায় পড়ে গেলে তাকে টেনে তোলা উচিত। গালি
দেওয়াতে কোন কল্যাণ নেই। তোমরা যে এ পাপ থেকে বেঁচে থাকতে পেরেছ, সেটাই
সৌভাগ্য মনে কর। লোকেরা তখন প্রশ্ন করলেো আপনি কি এ ব্যক্তিকে খারাপ মনে
করেন না? বললেনঃ স্বভাবগতভাবে লোকটির মধ্যে কোনরকম খারাবি নেই’ তবে তার এ
কাজটি খারাপ। যখন সে এ কাজ ছেড়ে দেবে তখন সে আবার আমার ভাই। (উসুদুল গাবা-
৪/১৫০; কানযুল ’উম্মাল- ২/১৭৪; হায়াতুস সাহাবা- ২/৪২৮)
তাঁর স্বভাবটি
ছিল বড় ঐশ্বর্যমন্ডিত। কারো নিকট থেকে কোন কিছু গ্রহণ করা ছিল তাঁর প্রকৃতি
বিরোধী। একবার ’আবদুল্লাহ ইবন ’আমির আসলেন শামে। বহু সাহাবী তাঁর কাছে
গিয়ে নিজ নিজ ভাতা গ্রহণ করলেন। কিন্তু আবু দারদা গেলেন না। বাধ্য হয়ে
’আবদুল্লাহ নিজেই ভাতা নিয়ে তাঁর গৃহে হাজির হলেন এবং বললেনঃ আপনি যাননি
তাই আমি নিজেই ভাতা নিয়ে হাজির হয়েচি। তিনি বললেনঃ রাসুল সা. আমাকে বলেছেন,
যখন আমীরগণ নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে নেয় তখন তোমরাও নিজেদেরকে
পরিবর্তন করে নেবে। (কানযুল ’উম্মাল- ২/১৭১)
তাঁর আধ্যাত্মিক উৎকর্ষতা
সম্পর্কে অনেক কথা বিভিন্ন গ্রন্থে পাওয়া যায়। আবুল বাখতারী থেকে বর্ণিত।
একবার আবু দারদা একটি হাঁড়িতে কিছু জ্বাল দিচ্ছিলেন। পাশেই হযরত সালমান
আল-ফারেসী বসেছিলেন। এমন সময় আবু দারদা ছোট বাচ্চাদের আওয়াযের মত হাঁড়ির
মধ্যে তাসবীহ পাঠের আওয়ায শুনতে পেলেন। তিনি চিৎকার করে সালমানকে ডেকে
বললেনঃ সালমান! দেখ, দারুণ বিস্ময়ের ব্যঅপার। তুমি বা তোমার বাপ-দাদা কেউ
কক্ষণো এমন ঘটনা দেখনি। সালমান বললেনঃ তুমি যদি চুপ থাকতে তাহলে আল্লাহর এর
থেকে বড় নিদর্শন দেখতে পেতে। (হায়াতুস সাহাবা- ৩/৫৮৬)
আবু নু’য়াইম
‘আল-হুলইয়্যা’ গ্রন্থে (১/২১০) ’আউফ ইবন মালিক থেকে বর্ণনা করেছেন। আউফ
স্বপ্নে একটি চামড়ার নির্মিত গম্বুজ ও একটি চারণক্ষেত্র দেখলেন। গম্বুজের
পাশে একপাল ছাগল শুয়ে শুয়ে জাবর কাটছিল। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এগুলি কার?
বলা হলো, আবদুর রহমান ইবন আউফের। কিছুক্ষণ পর আবদুর রহমান ইবন আউফ বের হয়ে
আসলেন। বললেনঃ হে আউফ, কুরআনের বিনিময়ে আল্লাহ আমাকে এ সবকিছু দান করেছেন।
যদি তুমি এ রাস্তার দিকে একটু তাকাও তাহলে এমন সব জিনিস দেখতে পাবে যা
তোমার চোখ কখনো দেখেনি, তোমার কান কখনো সে সম্পর্কে কিছু শোনেনি এবং তোমার
অন্তরে তার কল্পনাও কখনো উদয় হয়নি। আল্লাহ তা’য়ালা তা আবু দারদার জন্য
প্রস্তুত করে রেখেছেন। কারণ, তিনি দু’হাত ও বুক দিয়ে দুনিয়অকে দূরে ঠেলে
দিয়েছেন। (উসুদুল গাবা- ৫/১৮৫; হায়াতুস সাহাবা- ৩/৬৭২)
তিনি
বন্ধু-বান্ধবদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতেন। তাঁর দ্বীনী-ভাই হযরত সালমান
আল-ফারেসীর সাথে আজীবন গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। তাবারানী বর্ণনা করেছেন।
আশ’য়াস ইবন কায়স ও জারীর ইবন আবদুল্লাহ আল-বাজালী একবার সালমান আল-ফারেসীর
নিকট আসলেন। তিনি তখন মাদায়েনের একটি দূর্গে অবস্থান করছিলেন। তাঁরা সালাম
দিয়ে জিজ্ঞেস করলেনঃ আপনি কি সালমান আল-ফারেসী? বললেনঃ হা। আপনি কি
রাসূলুল্লাহর সা. সাহাবী? বললেনঃ জানিনে। তখন তাঁর সন্দেহের মধ্যে পড়ে গেল।
তাঁরা মনে করলেন, আমরা যাঁকে খুঁজছি, এ তিনি নন। তাঁদের এ ইতস্ততঃ ভাব
দেখে সালমান বললেনঃ তোমরা যাঁকে খুজছো আমি সেই ব্যক্তি। আমি রাসূলুল্লাহকে
সা. দেখেছি, তাঁর সাথে উঠা-বসা করেছি। আর সাহাবী তো সেই যে রাসূলের সা.
সাথে জান্নাতে যাবে। যাই হোক, তোমাদের কী প্রয়োজন? তাঁরা বললেনঃ শামে
অবস্থানরত আপনার এক ভাইয়ের নিকট থেকে আমরা এসেছি। তিনি জানতে চাইলেনঃ কে
সে? তারা বললেনঃ আবু দারদা। তখন তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ তাহলে তোমাদের সাথে
পাঠানো তাঁর উপহার সামগ্রী কোথায়? তাঁর বললেনঃ আমাদের সাথে তো কোন উপহার
পাঠাননি। আবু দারদা বললেনঃ আল্লাহকে ভয় কর এবং যথাযথভাবে আমানত আদায় কর।
তাঁর নিকট থেকে যেই এসেছে, তার সাথে কিছু না কিছু হাদিয়া তিনি আমার জন্য
পাঠিয়েছেন। তাঁরা বললেনঃ এভাবে আমাদেরকে দোষারোপ করবেন না। এই আমাদের
অর্থকড়ি থেকে যা খুশী আপনি গ্রহণ করুন। তিনি বললেনঃ আমি তোমাদের অর্থকড়ি
চাইনা। যে হাদিয়া পাঠিয়েছেন শুধু তাই চাই। তখন তাঁরা শপথ করে বললেন, কোন
হাদিয়া তিনি পাঠাননি। তবে তিনি আমাদেরকে একথা বলেছেন যে, তোমাদের মধ্যে এমন
এক ব্যক্তি আছেন, রাসূল সা. যখন প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে যেতেন তখন তাঁকে
ছাড়া আর কাউকে ডাকতেন না। তোমরা যখন তাঁর কাছে যাবে, তাঁকে আমার সালাম
পৌঁছে দেবে। আবু দারদা বললেনঃ এছাড়া আর কি হাদিয়া আমি তোমাদের কাছে চাচ্ছি?
সালামের চেয়ে উত্তম হাদিয়া আর কী হতে পারে? (হায়াতুস সাহাবা- ২/৪৯২-৪৯৫)
হযরত
’আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা রা. ছিলেন তাঁর জাহিলী যুগের অন্তরঙ্গ বন্ধু বা
ভাই। তাঁরই দাওয়াত ও চেষ্টায় তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। আজীবন তিনি সে সম্পর্ক
অটুট রেখেছিলেন। তিনি প্রায়ই দু’আ করতেনঃ হে আল্লাহ! আমার ভাই ’আবদুল্লাহ
ইবন রাওয়াহা লজ্জা পায় আমার এমন কোন ’আমল তাঁর কাছে উপস্থাপনের ব্যাপারে আ
আপনার পানাহ্ চাই। (হায়াতুস সাহাবা- ৩/৩৮৪)
এছাড়া হযরত আবু দারদার বহু
দ্বীনী ইয়ার-বন্ধু ছিলেন। তিনি নামাযের পর তাঁদের সকলের মঙ্গল কামনা করে
আল্লাহর কাছে দু’আ করতেন। তাঁর স্ত্রী হযরত উম্মুল দারদা রা. বলেনঃ আবু
দারদার ৩৬০ জন আল্লাহর পথের বন্ধু ছিলেন। নামাযে তাঁদের প্রত্যেকের জন্য
দু’আ করতেন। আমি তাঁকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তনি বললেনঃ কোন মানুষ দূর
থেকে যখন তার কোন ভাইয়ের জন্য দু’আ করে তখন আল্লাহ তার জন্য দু’জন ফিরিশতা
নিয়োগ করেন। তারা বলতে থাকেঃ তোমার ভাইয়েল জন্য তুমি যা কামনা করছো,
আল্লাহ তোমাকেও তা দান করুন। ফিরিশতারা আমার জন্য দু’আ করুক, তাকি আমি
চাইবো না? (তারীখুল ইসলাম- ২/১১১)
তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহর সা. একজন
একনিষ্ঠ ভক্ত ও ’আশেক। রাসূলের সা. জীবদ্দশায় তাঁকে এত বেশী ভালোবাসতেন যে,
রাতে তাঁর ঘরের সামনে শুয়ে থাকতেন, যাতে তিনি প্রয়োজন হলে তাঁকে জাগিয়ে
তুলে তাঁকে কাজে লাগাতে পারেন। (হায়াতুস সাহাবা- ২/৬৮৮)
পরোক্ষভাবে
কুরআনের একটি আয়াতও তাঁর শানে নাযিল হয়েছে। শুরাইহ ইবন ’উবাইয়দ থেকে বর্ণিত
হয়েছে। এক ব্যক্তি একদিন আবু দারদাকে বিদ্রুপ করে বললোঃ ওহে ক্বারীদের দল!
তোমাদের হয়েছে কি যে, তোমরা আমাদের চেয়ে বেশী ভীরু ও বেশী কৃপণ? কিন্তু
খাওয়ার সময় তোমাদের গ্রাসটি তো হয় সবচেয়ে বড়। আবু দারদা তার কথার কোন উত্তর
দিলেন না। বিষয়টি ’উমারের কানে গেল। তিনি আবু দারদাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি
বললেনঃ আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিন। তাদের সব কথাই কি আমরা ধরবো? তখন ’উমার
সেই লোকটির নিকট গিয়ে তার গলায় কাপড় পেঁচিয়ে টানতে টানতে রাসূলুল্লাহর সা.
নিকট নিয়ে যান। লোকটি বললোঃ আমরা একটু হাসি-মাশ্কারা করছিলাম। তখন সূরা
তাওবার ৬৫ নং আয়াতটি নাযিল হয়। (হায়াতুস সাহাবা- ২/৪৬৩)
মু’য়াবিয়া ইবন
কুররা বলেনঃ একবার আবু দারদা অসুস্থ হলেন। বন্ধুরা দেখতে গেলেন। তাঁরা
বললেনঃ আপনার অভিযোগ কিসের বিরুদ্ধে? বললেনঃ আমার গুনাহ্র বিরুদ্ধে। আপনার
সর্বশেষ কামনা কী? বললেনঃ জান্নাত। তাঁরা বললেনঃ আমরা কি একজন ডাক্তার
ডাকবো? বললেনঃ প্রয়োজন নেই। শ্রেষ্ঠতম ডাক্তারই তো আমাকে এ কষ্ট দিয়েছেন।
(হায়াতুস সাহাবা- ২/৫৮১)
আবু নু’য়াইম ‘আল-হুলাইয়্যা’ গ্রন্থে (১/২১২)
জুবাইর ইবন নুফাইর রা. থেকে বর্ণনা করেছেন। ভূমধ্য সাগরীয় দ্বীপ ‘কিবরিস’
বিজয়ের দিন অনেক মুজাহিদ কেঁদে ফেলেন। আমি দেখলাম, আবু দারদা একাকী বসে বসে
কাঁদছেন। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, যে দিন আল্লাহ ইসলাম ও মুসলমানদের
সম্মানিত করলেন, সে দিন এভাবে কাঁদার কারণ কি? বললেনঃ জুবাইর, তোমার ধ্বংস
হোক। যে মানুষ আল্লাহর হুকুম ছেড়ে দেয় সে কতই না নিকৃষ্ট জীব। এই জাতি ছিল
শক্তিশালী ও বিজয়ী। তাদের ছিল একটি রাষ্ট্র। তারা আল্লাহর আদেশ ছেড়ে দেয়।
তাই তাদের এ পরিণতি। (হায়াতুস সাহাবা- ৩/৬৮১)
একবার হযরত মুয়াবিয়া আবু
দারদাকে লিখলেনঃ আপনি আমাকে দিমাশ্কের ফাসিকদের একটা তালিকা দিন। জবাবে
তিনি বললেনঃ তাদের সাথে আমার সম্পর্ক কি? আমি কিভাবে তাদের চিনবো? কিন্তু
তাঁর ছেলে বিলাল বললেনঃ আমিই তাদের তালিকা পাঠাবো। সত্যিই তিনি তালিকা তৈরী
করলেন। তখন আবু দারদা বললেনঃ কিভাবে তুমি তাদেরকে চিনলে? তুমি তাদের দলের
একজন না হলে তাদেরকে চিনতে পার না। তোমার নামটি দিয়েই তালিকা শুরু কর।
একথার পর বিলাল আর তালিকা পাঠাননি। (হায়াতুস সাহাবা- ২/৪২৪)
হযরত আবু
দারদা মানুষকে বলতেনঃ তোমরা দুনিয়া থেকে দূরে থাক। কারণ, এ দুনিয়া হারূত ও
মারূত অপেক্ষা বড় জাদুকর। (লিসানুল- মীযান- ৭/৪৪) তিনি প্রায়ই দু’আ করতেনঃ
হে আল্লাহ! আমাকে পূর্ণবানদের সাথে মরণ দিন এবং পাপাচারীদের সাথে বাঁচিয়ে
রাখবেন না। তিনি আরো দু’আ করতেনঃ হে আল্লাহ! আমি আলিমদের অভিশাপ থেকে আপনার
পানাহ চাই। যখন জানতে চাওয়অ হলো, তারা কিভাবে আপনাকে অভিশাপ দেবে? বললেনঃ
আমাকে ঘৃণা করবে। (হায়াতুস সাহাবা- ৩/৩৮৪)
হযরত আবু দারদা রা. সম্পর্কে
অনেক টুকরো টুকরো কথা বিভিন্ন গ্রন্থে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে যা
খুবই চমকপ্রদ ও শিক্ষণীয়। ইবন হাজারের রহ. মত আমরাও বলি, তাঁর মাহাত্ম্য ও
গুণাবলী অনেক যা ছোটখাট কোন প্রবন্ধে প্রকাশ করা যাবে না। (তাহজীবুত
তাহজীব- ৮/১৫৬)