আবু মাস’উদ ডাক নাম, আর এ নামেই তিনি ইতিহাসে প্রসিদ্ধ। আসল নাম ’উকবা এবং পিতার নাম ’আমর ইবন সা’লাবা। সর্বশেষ বাই’য়াতে ’আকাবায় যোগ দিয়ে সেখানেই ইসলাম গ্রহণ করেন। ওয়াকিদী বলেনঃ আবু মাস’উদ আকাবায় অংশগ্রহণ করেন, তবে বদরে অনুপস্থিত ছিলেন। মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক বলেনঃ আকাবায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। (আনসাবুল আশরাফ- ১/২৪৫; সীরাতু ইবন হিশাম- ১/৪৫৯; উসুদুল গাবা- ৫/২৯৬) এ বিষয়টি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন।
উহুদ এবং উহুদ পরবর্তী কাফিরদের বিরুদ্ধে পরিচালিত সকল যুদ্ধে তিনি রাসূলুল্লাহর সা. সাথে যোগ দেন। তবে তাঁর বদর যুদ্ধে যোগদানের ব্যাপারে সীরাত বিশেষজ্ঞদের অনেক মতভেদ আছে। অধিকাংশের মতে, তিনি বদরে যোগ দেন এবং এ কারণেই তাঁকে বদরী বলা হয়। ইমাম বুখারী খুব দৃঢ়তার সাথে বলেছেন, তিনি বদরে যোগ দিয়েছেন। আর এর স্বপক্ষে তিনি তাঁর সহীহ গ্রন্থে দলীল হিসেবে একাধিক হাদীস উপস্থাপন করেছেন। যেমন, বাশীর ইবন আবূ মাস’উদ বর্ণিত একটি হাদীস। তাতে এসেছেঃ মুগীরা আসরের নামায দেরী করে পড়লে আবু মাস’উদ ’উকবা ইবন ’আমর তার প্রতিবাদ করেন। এ আবু মাস’উদ হচ্ছে যায়িদ ইবন হাসানের নানা এবং তিনি বদরে অংশগ্রহণ করেছিলেন। আবু ’উতবা ইবন সালাম এবং মুসলিম ‘আল-কনা’ গ্রন্থে তাঁর বদরে যোগদানের কথা বলেছেন। ইবনুল বারকী বলেনঃ ইবন ইসহাক তাঁকে বদরীদের মধ্যে উল্লেখ করেননি। তাবারানী বলেনঃ কুফাবাসীরা দাবী করেন, তিনি বদরে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু মদীনাবাসীরা তাঁকে বদরীদের মধ্যে উল্লেখ করেন না। ইবন সা’দ আল-ওয়াকিদী থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেনঃ আবু মাস’উদ যে বদরে যোগ দেননি, এ ব্যাপারে আমাদের সংগী-সাথীদের মধ্যে কোন মতভেদ নেই। তিনি বদরে বসবাস করেছিলেন, এ কারণে তাঁকে বদরী বলা হয়। (আল-ইসাবা- ২/৪৯০, ৪৯১; সীরাতু ইবন হিশাম- ১/৪৫৯; উসুদুল গাবা- ৫/২৯৬)
নবুওয়াতের যুদ ও প্রথম তিন খলীফার সময় পর্যন্ত আবু মাস’উদ মদীনায় ছিলেন। জীবনের কোন এক পর্যায়ে কিছু দিনের জন্য বদরের পানির ধারে বসবাস করেছিলেন। হযরত ’আলীর খিলাফতকালে মদীনা ছেড়ে কুফায় চলে যান এবং সেখানে বাড়ী তৈরী করে বসবাস করেন। (আল-ইসাবা- ৪/২৫২; আনসাবুল আশরাফ- ১/২৪৫)
হযরত ’আলী রা. ও হযরত মু’য়াবিয়ার রা. মধ্যে বিরোধের সময় আবু মাস’উদের ভূমিকার বিষয়ে পরস্পর বিরোধী বর্ণনা দেখা যায়। একটি বর্ণনা মতে, তিনি ছিলেন হযরত মু’য়াবিয়ার রা. ঘনিষ্ঠজনদের একজন। হযরত মু’য়াবিয়া রা. যখন সিফ্ফীন যুদ্ধে যান তখন তাঁকে কুফায় নিজের স্থলাভিষিক্ত করে যান। তাঁর না ফেরা পর্যন্ত আবু মাস’উদ কুফার আমীরের দায়িত্ব পালন করেন। (আল-ইসাবা- ২/৪৯১) পক্ষান্তরে অন্য একটি বর্ণনা মতে, তিনি ছিলেন হযরত ’আলীর রা. সহচর। ’আলীর রা. সময়ে তিনি কুফায় যান এবং ’আলী রা. সিফ্ফীনে যাওয়ার সময় তাঁকে কুফার আমীরের দায়িত্ব দিয়ে যান। (আনসাবুল আশরাফ- ১/২৪৫; আল-আ’লাম- ৪/২৪১) শেষের বর্ণনাটিই সঠিক। কারণ সিফ্ফীন যুদ্ধের সময় কুফা ছিল হযরত ’আলীর রা. অধীনে, মু’য়াবিয়ার রা. অধীনে নয়।
হযরত আবু মাস’উদের মৃত্যুর সন ও স্থান সম্পর্কে মতভেদ আছে। কেউ কেউ বলেছেন, সিফ্ফীন যুদ্ধের পর তিনি কুফা থেকে জন্মভূমি মদীনায় ফিরে আসেন এবং সেখানে মারা যান। আবার অনেকে বলেছেন, তাঁর মৃত্যু হয় কুফায়। (আল-ইসাবা- ২/৪৯১; আল-আ’লাম- ৪/২৪১)
তাঁর মৃত্যুর সন সম্পর্কেও মতভেদ আছে। হিজরী ৪১ ও ৪২ দু’টি তাঁর মৃত্যু সন বলে কথিত হয়েছে। আবার অনেকে বলেছেন, হযরত মু’য়াবিয়ার রা. খিলাফতের শেষ দিকে হিজরী ৬০ সনে তাঁর মৃত্যু হয়। (উসুদুল গাবা- ৫/২৯৬) তবে এটা ঠিক যে হযরত মুগীরা ইবন শু’বার রা. কুফার শাসন কর্তৃত্বের সময় তিনি জীবিত ছিলেন। নিশ্চিতভাবে তা ছিল হিজরী ৪০ সনের পরে। (আল-ইসাবা- ২/৪৯১)
হযরত আবু মাস’উদের এক পুত্র ও এক কন্যার পরিচয় জানা যায়। পুত্রের নাম বাশীর এবং কন্যা ছিলেন হযরত ইমাম হাসানের রা. সহধর্মিনী। তাঁরই গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন হযরত যায়িদ ইবন হাসান। বাশীরের জন্ম হয় রাসূলুল্লাহর সা. জীবদ্দশায় বা তার কিছু পরে।
হযরত আবু মাস’উদ রা. রাসূলুল্লাহর সা. হাদীসের প্রচার-প্রসারের দায়িত্ব অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে পালন করেন। হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবীদের তৃতীয় তবকা বা স্তরে তাঁকে গণ্য করা হয়। হাদীসের বিভিন্ন গ্রন্থে তাঁর বর্ণিত ১০২ (একশো দুইটি) হাদীস পাওয়া যায়। (আল-’আলাম- ৪/২৪১) তাবে’ঈদের মধ্যে যাঁরা তাঁর থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন তাঁদের খ্যাতিমান কয়েকজনের নামঃ
বাশীর, আবদুল্লা ইবন ইয়াযীদ খুতামী, আবু ওয়ায়িল, ’আলকামা, কায়স ইবন আবী হাতেম, ’আবদুর রহমান ইবন ইয়াযীদ নাখ’ঈ, ইয়াযীদ ইবন শুরাইক, মুহাম্মাদ ইবন ’আবদিল্লাহ ইবন যায়িদ ইবন ’আবদি রাব্বিহি- আনসারী প্রমুখ।
রাসূলুল্লাহর সা. জীবনাচারের অনুসরণ এবং ’আমর বিল মা’রূফ ছিল তাঁর
চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য। রাসূলুল্লাহর সা. আদেশ-নিষেধকে অত্যন্ত
শ্রদ্ধাভরে পালন করতেন। একবার তিনি তাঁর এক দাসকে মারছেন। এমন সময় পিছন
থেকে আওয়ায ভেসে এলোঃ ‘আবু মাস’উদ! একটু ভেবে দেখ। যে আল্লাহ তোমাকে তার
ওপর ক্ষমতাবান করেছেন, তিনি তাকেও তোমার ওপর ক্ষমতাবান করতে পারতেন।’
আওয়াযটি ছিল রাসূলুল্লাহর সা.। আবু মাস’উদ ভীষণ প্রভাবিত হন। সেই মুহূর্তে
তিনি শপথ করেন, আগামীতে কোন দিন আর কোন দাসের গায়ে হাত তুলবেন না। আর সেই
দাসটিকে তিনি আযাদ (মুক্ত) করে দেন। (মুসনাদ- ৫/২৭৩, ২৭৪)
আমর বিল মা’রূফের দায়িত্ব পালন থেকেও তিনি কক্ষণো উদাসীন ছিলেন না। আর এ
ব্যাপারে ছোট-বড় কারো পরোয়া করতেন না। হযরত মুগীরা ইবন শু’বা রা. তখন কুফার
আমীর। একদিন তিনি একটু দেরীতে আসরের নামায পড়ালেন। সাথে সাথে আবু মাস’উদ
প্রতিবাদ করলেন। তিনি বললেনঃ আপনার জানা আছে, রাসূল সা. পাঁচ ওয়াক্ত নামায
জিবরীলের বর্ণনা মত সময়ে আদায় করতেন, আর বলতেনঃ এভাবেই আমাকে নির্দেশ দেওয়া
হয়েছে। (বুখারী- ২/৫৭১)
তিনি নিজে রাসূলুল্লাহর সা. সুন্নাতের হুবহু অনুসরণ করতেন। একদিন তিনি লোকদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি জান রাসূলুল্লাহ সা. কিভাবে নামায আদায় করতেন? তারপর তিনি নামায আদায় করে তাদেরকে দেখিয়ে দেন। (মুসনাদ- ৫/১২২)
নামাযের জামা’য়াতে গায়ে গা মিশিয়ে দাঁড়ানো রাসূলের সা. সুন্নাত। তিনি যখন দেখলেন, লোকেরা তা পুরোপুরি পালন করছে না, তখন বলতেনঃ এমনভাবে দাঁড়ানোর ফায়দা এ ছিলো যে, তাঁরা ঐক্যবদ্ধ ছিলেন। এখন তোমরা দূরে দূরে দাঁড়াও, এ জন্যেই তো বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে।
হযরত আবু মাস’উদকে রা. মুফতী সাহাবীদের মধ্যে গণ্য করা হয় না। তবে তিনি মাঝে মধ্যে ফাতওয়া দিতেন। ইবন ’আবদিল বার তাঁর ‘জামি’উল ’ইলম’ গ্রন্থে (২/১৬৬) ইবন সীরীন থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেনঃ খলীফা ’উমার একবার আবু মাস’উদকে বলেনঃ আমাকে কি অবহিত করা হয়নি যে, তুমি ফাতওয়া দান করে থাক? ফাতওয়ার উষ্ণতা তার জন্য ছেড়ে দাও যে তার শৈত্যের স্পর্শ লাভ করেছেন। অর্থাৎ আমীরের জন্য। আর তুমি তো আমীর নও। (হায়াতুস সাহাবা- ২/২৫৩)