নাম সা’দ, ডাক নাম আবূ সা’ইদ। খুদরাহ বংশের সন্তান হওয়ার কারণে খুদারী বা খুদরী বলা হয়। তাঁর পিতা মালিক ইবন সিনান উহুদের অন্যতম শহীদ। এ যুদ্ধে হযরত রাসূলে কারীম সা. আহত হলে তিনি রাসূলের সা. পবিত্র খুন চুষে গিলে ফেলেন। রাসূল সা. তখন মন্তব্য করেনঃ ‘আমার রক্ত যার রক্তে মিশেছে তাকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে না।’ (সীরাতু ইবন হিশাম- ২/৮০, তাজকিরাতুল হুফ্ফাজ- ১/৪৪) তাঁর মা উনায়সা বিনতু আবী হারিসা বনু ’আদী ইবন নাজ্জারের কন্যা। দাদা সিনান ছিলেন মহল্লার রয়িস। তিনি ছিলেন একটি কিল্লার অধিপতি ও ইসলাম পূর্ব যুগের একজন বিচারক।
তাঁর মার প্রথম স্বামী ছিল আউস গোত্রের ’আম্মান নামক এক ব্যক্তি। সে মারা যায়। রাসূলুল্লাহর সা. মদীনায় আগমনের পূর্বে তিনি মালিক ইবন সিনানকে দ্বিতীয় স্বামী হিসাবে গ্রহণ করেন। তাঁদেরই সন্তান আবূ সা’ঈদ হিজরাতের দশ বছর পূর্বে ৬১৩ খ্রীস্টাব্দে ইয়াসরিবে জন্মগ্রহণ করেন। (আল-ইসাবা- ৪/৮৮, আল-আ’লাম- ৩/১৩৮) প্রখ্যাত বদরী সাহাবী কাতাদাহ ইবন নু’মান রা.- উহুদ যুদ্ধে যাঁর চোখ আহত হয় এবং রাসূলুল্লাহর সা. দু’আর বরকতে আবার ভালো হয়ে যায়- আবূ সা’ঈদের বৈপিত্রীয় ভাই। হিজরী ২৩ সনে এই কাতাদাহ মারা গেলে আবূ সা’ঈদ তাঁকে কবরে নামিয়ে দাপন করেন। (আনসাবুল আশরাফ- ১/২৪২, উসুদুল গাবা- ৫/২১১)
বাই’য়াতে আকাবা থেকেই মোটামুটি মদীনায় ইসলাম প্রচারের কাজ শুরু হয়।
মদীনাবাসীদের অনেকেই তখন ইসলামী দা’ওয়াত ও তাবলীগের কাজে আত্ননিয়োগ করেন।
এই সময় মালিক ইবন সিনান ইসলাম কবুল করেন। স্বামীর সাথে স্ত্রীও মুসলমান হন।
সুতরাং আবূ সা’ঈদ মুসলিম মা-বাবার কোলেই বেড়ে উঠেন।
হিজরাতের প্রথম বছরেই মসজিদে নববীর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। আবূ সা’ঈদ এই
নির্মাণ কাজে অংশগ্রহণ করেন। তিনি হযরত রাসূলে কারীমের সা. সাথে মোট বারোটি
যুদ্ধে যোগ দেন। (তাহজীবুল আসমা- ২/২৩৭, আল-আ’লাম- ৩/১৩৮) অল্প বয়সের
কারণে বদর যুদ্ধে যোগ দিতে পারেননি। উহুদ যুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল ১৩ বছর।
যুদ্ধের পূর্বে পিতার সাথে তিনি রাসূলুল্লাহর সা. নিকট যান। রাসূল সা. তার
পা থেকে মাথা পর্যন্ত নিরীক্ষণ করেন এবং এখনও যুদ্ধের বয়স হয়নি- এই বলে
ফিরিয়ে দেন। পিতা মালিক তখন রাসূলুল্লাহর সা. হাত ধরে বলেন, ছেলের বয়স কম
হলে কি হবে, তার হাত দু’টি পুরুষের মত সবল। তবুও রাসূল সা. তাকে যুদ্ধে
যাওয়ার অনুমতি দিলেন না। (আল-ইসাবা- ২/৩৫; আনসাবুল আশরাফ- ১/৩৩০)
এই উহুদ যুদ্ধে হযরত রাসূলে কারীমের সা. পবিত্র মুখমন্ডল আহত হয়ে রক্ত
রঞ্জিত হয়। মালিক ইবন সিনান সেই রক্ত পান করেন। রাসূল সা. মন্তব্য করেনঃ
‘যদি কারও এমন ব্যক্তিকে দেখার ইচ্ছা হয় যার রক্ত আমার রক্তের সাথে মিশেছে,
সে যেন মালিক ইবন সিনানকে দেখে। এরপর বীরের মত যুদ্ধ করে মালিক শাহাদাত
বরণ করেন।
আবূ সা’ঈদের পিতা কোন সম্পদশালী ব্যক্তি ছিলেন না। এ কারণে পিতার মৃত্যুতে তিনি পর্বত পরিমাণ বিপদের সম্মুখীন হলেন। দারিদ্র ও অনাহারে সময় সময় পেটে পাথর বেঁধে কাটাতেন। একদিন তিনি প্রচন্ড ক্ষুধায় পেটে পাথর বেঁধে আছেন। তখন তাঁর স্ত্রী (মতান্তরে মা অথবা দাসী) তাঁকে বললেনঃ নবীর সা. কাছে যাও, তাঁর কাছে কিছু চাও। অমুক এসে সাহায্য চেয়েছিল, তাকে তিনি দিয়েছেন। আবূ সা’ঈদ বলেনঃ আমি যখন রাসূলুল্লাহর সা. নিকট গেলাম তিনি তখন ভাষণ দিচ্ছেন এবং বলছেনঃ ‘যে নিজেকে গনী বা ধনী মনে করে আল্লাহও তাকে ধনবান করে দেন। আর যে আমার কাছে কোন কিছু চাওয়া থেকে বিরত থাকে সে ঐ ব্যক্তির থেকেও আমার বেশী প্রিয় যে আমার কাছে চায়।’ একথা শুনে আমি আর কিছু চাইলাম না। আমি বাড়ী ফিরে এলাম। অতঃপর আল্লাহ তা’য়ালা আমাদের রিযকে বরকত বা সমৃদ্ধি দান করতে লাগলো। অবশেষে, আনসারদের মধ্যে কোন বাড়ী আমাদের চেয়ে বেশী বিত্তশালী ছিল বলে আমি জানতাম না। (মুসনাদ- ৩/৪৪৯; হায়াতুস সাহাবা- ২/২৫৭)
খন্দক ও বনী মুসতালিকের যুদ্ধে তিনি যোগ দেন। তবে ‘উসুদুল গাবা’ গ্রন্থের একটি বর্ণনায় এসেছেঃ ‘আবূ সা’ঈদ বলেনঃ খন্দকের দিন আমার পিতা আমার হাত ধরে রাসূলুল্লাহর সা. সামনে নিয়ে বলেনঃ ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ! এর হাড় খুব শক্ত।’ এরপরও তিনি আমাকে যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি না দিয়ে ফিরিয়ে দেন। তিনি আরও বলেনঃ ‘আমি রাসূলুল্লাহর সা. সাথে বনী মুসতালিক যুদ্ধে যোগ দিই।’ ওয়াকিদী বলেনঃ ‘তখন আবূ সা’ঈদের বয়স পনেরো বছর।’ (উসুদুল গাবা- ৫/২১১, আনসাবুল আশরাফ- ১/৩৩৪)
ইমাম আহমাদ আবূ সা’ঈদ খুদারী থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আমরা খন্দকের দিন বললামঃ ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমাদের প্রাণ তো গলায় এসে ঠেকেছে। এমন কোন দু’আ কি আছে যা আমরা পাঠ করতে পারি? বললেনঃ হাঁ। বলঃ আল্লাহুম্মা উসতুর ’আওরাতিনা ওয়া আমিন রাও’য়াতিনা- হে আল্লাহ আমাদের গোপন বিষয় গোপন রাখ এবং আমাদের ভীতিকে নিরাপত্তা দান কর।’ (হায়াতুস সাহাবা- ১/৪৮৮)
তিনি ‘বাই’য়াতুশ শাজারা’ বা ‘বাই’য়াতুর রিদওয়ানে’ অংশগ্রহণ করেন।
(শাজারাতুজ জাহাব- ১/৮১; তাজকিরাতুল হুফ্ফাজ- ১/৪৪) হিজরী ৮ম সনের সফর মাসে
’আবদুল্লাহ ইবন গালিব লায়সীর নেতৃত্বে একদল সৈন্য ফিদাক যায়। তিনিও এই
বাহিনীতে ছিলেন। আবদুল্লাহ সৈন্যদের তাকীদ দেন, তারা যেন বিচ্ছিন্ন না হয়।
এই উদ্দেশ্যে তিনি বাহিনীর সদস্যদের পরস্পরের সাথে মাওয়াখাত বা ভ্রাতৃত্ব
প্রতিষ্ঠা করে দেন। তাঁকেও একজন বিশিষ্ট সাহাবীর সাথে ভ্রাতৃত্ব কায়েম করে
দেন।
হিজরী ৯ম সনের বারী’উস সানী মাসে ’আরকামা ইবন মুখাররকে ছোট একটি বাহিনীসহ
একটি অভিযানে পাঠানো হয়। আবূ সা’ঈদ ছিলেন এ বাহিনীর অন্যতম সদস্য। (মুসনাদ-
৩/২৭০; হায়াতুস সাহাবা- ২/৬৭)
উপরোক্ত যুদ্ধগুলি ছাড়াও মক্কা বিজয়, হুনাইন, তাবুক, আওতাস প্রভৃতি অভিযানে তাঁর অংশগ্রহণের কথা সীরাত গ্রন্থসমূহে পাওয়া যায়। সহীহ বুখারীর বর্ণনা অনুযায়ী রাসূলুল্লাহর সা. যুগে সংঘটিত মোট ১২ টি যুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণের গৌরব অর্জন করেন। তিনি তাবুক যুদ্ধে মুসলমানদের চরম অভাব ও দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন। হুনাইন যুদ্ধে লব্ধ গনীমাতের বেশীর ভাগ যখন রাসূল সা. মক্কাবাসী নওমুসলিমদের খুশী (তালীফে কুলুম) করার জন্য দান করেন তখন মদীনার আনসারদের অনেকে একটু ক্ষুণ্ন হন। এ সম্পর্কিত ঘটনা আবূ সা’ঈদ বর্ণনা করেছেন। (হায়াতুস সাহাবা- ১/৩৯৭-৩৯৮; ৩/৬২৫) তাঁর থেকে বর্ণিত হয়েছে, ‘আমরা রাসূলুল্লাহর সা. সাথে যুদ্ধে গিয়েছি রমজান মাসে। আমাদের কেউ সাওম পালন করতো, আবার কেউ করতো না। তবে একে অপরকে কোন রকম হিংসা করতো না। তারা প্রত্যেকেই জানতো যে, যে ব্যক্তি নিজেকে সক্ষম মনে করবে সে সাওম পালন করবে, আর এটাই তার জন্য উত্তম। আর যে নিজেকে দুর্বল ও অক্ষম মনে করবে সে সাওম পালন করবে না। আর এটাই তার জন্য উত্তম।’ (হায়াতুস সাহাবা- ১/৪৭৯)
একবার হযরত রাসূলে কারীম সা. তাঁদেরকে একটি ছোটখাট অভিযানে পাঠালেন। বাহিনীর সর্বমোট সদস্য তিরিশজন এবং নেতা আবূ সা’ঈদ। যাত্রা পথে তাঁরা একটি স্থানে তাঁবু স্থাপন করে যাত্রা বিরতি করেন। নিকটেই ছিল একটি জনপদ। তাঁরা সেই জনপদের লোকদের বললেন, আমরা আপনাদের অতিথি। কিন্তু তারা অতিথিদের সেবা করতে পরিষ্কার অস্বীকার করলো। ঘটনাক্রমে সেইদিন উক্ত জনপদের প্রধানকে বিচ্ছুতে কামড়ায়। নানা জনে নানা রকম চিকিৎসা চালালো’ কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। তাদেরকে কেউ পরামর্শ দিল, তোমরা এই অতিথিদের কাছে যাও, তাদের মধ্যে কারও হয়তো কোন চিকিৎসা জানা থাকতে পারে। পরামর্শমত তারা এসে বিষয়টি জানালো। আবূ সা’ঈদ বললেন, ‘আমি ঝাড়-ফুঁক জানি, তবে পারিশ্রমিক হিসেবে তিরিশটি ছাগল দিতে হবে। তারা রাজি হয়ে গেল। আবূ সা’ঈদ তাদের সাথে গেলেন এবং সূরা মুহাম্মাদ পাঠ করে দংশিত স্থানে একটু থু থু লাগিয়ে দিলেন। তাতেই লোকটি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেল। সাহাবায়ে কিরাম তিরিশটি ছাগল নিয়ে মদীনার দিকে যাত্রা করলেন। তাঁদের মনে দ্বিধা ও সংশয় ছিল, এভাবে ছাগলগুলি নেওয়া ঠিক কিনা। অবশেষে সিদ্ধান্ত হলো যে, বিষয়টি রাসূলুল্লাহকে সা. জানানো হবে। মদীনায় পৌঁছেই তাঁরা রাসূলুল্লাহকে সা. ঘটনাটি খুলে বলেন। সবকিছু শুনে তিনি একটু মুচকি হাসি দেন। তারপর বলেন, তোমরা কিভাবে জানলে যে, এই সূরা ঝাড়-ফুঁকের কাজ দেয়? তোমরা ঠিকই করেছ। বকরীগুলি তোমরা ভাগ করে নেবে এবং আমাকেও একটি অংশ দিতে ভুল করবে না। (সহীহুল বুখারী- ১/২৫১)
হযরত রাসূলে কারীমের সা. ইনতিকালের পর তিনি মদীনাতেই অবস্থান করেন। খলীফা হযরত ’উমার ও হযরত ’উসমানের রা. যুগে ফাতওয়ার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। যিয়াদ ইবন মীনা’র সূত্রে ইবন সা’দ বর্ণনা করেছেনঃ ইবন ’আব্বাস, ইবন ’উমার, আবূ সা’ঈদ খুদারী, আবূ হুরাইরা, আবদুল্লাহ ’আমর ইবনুল ’আস, জাবির ইবন ’আবদিল্লাহ প্রমুখ আসহাবে রাসূল ’উসমানের মৃত্যুর সময় থেকে তাঁদের মৃত্যু পর্যন্ত মদীনায় ফাতওয়া দিতেন এবং রাসূলুল্লাহর সা. হাদীস বর্ণনা করতেন। (হায়াতুস সাহাবা- ৩/২৫৫)
হযরত আলীর রা. যুগে খারেজীদের বিরুদ্ধে নাহরাওয়ানের যুদ্ধে তিনি যোগ দেন। তখন তিনি বলতেন, তুর্কীদের চেয়ে খারেজীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা আমি বেশী প্রয়োজন মনে করি। (মুসনাদ- ৩/৩৩, ৫৬) হযরত ইমাম হুসাইন যখন মদীনা ছেড়ে কুফায় যাওয়া স্থির করেন, তখন আরও অনেক সাহাবীর মত আবূ সা’ঈদও তাঁকে এই সিদ্ধান্ত থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেন। (সুয়ূতীঃ তারীখুল খুলাফা)
হিজরী ৫৯ সনে হযরত উম্মু সালামা রা. ইনতিকাল করলে আবূ সা’ঈদ তাঁর জানাযায় শরীক ছিলেন। (আনসাবুল আশরাফ- ১/৪৩২) হিজরী ৬১ সনে হিজাযবাসীরা ইয়াযীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে রাসূলুল্লাহর সা. ফুফাতো ভাইয়ের ছেলে আবদুল্লাহ ইবন যুবায়ের ইবনুল ’আওয়ামের রা. হাতে বাই’য়াত করে। এই বাই’য়াতকারীদের মধ্যে হযরত আবূ সা’ঈদও ছিলেন।
হিজরী ৬৩ সনে দারুল হিজরাহ্ মদীনার অধিবাসীরা ইয়াযীদের আনুগত্য
প্রত্যাখ্যান করে গাসীলুল মালায়িকা হযরত হানজালার ছেলে হযরত ’আবদুল্লাহর
হাতে বাই’য়াত করে তাঁকে নিজেদের আমীর বলে ঘোষণা দেয়। ইয়াযীদের বাহিনী মদীনা
আক্রমণ করে মদীনাবাসীদের পরাভূত করে। হযরত ’আবদুল্লাহ ইয়াযীদ বাহিনীর
বিরুদ্ধে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে শাহাদাত বরণ করেন। বিজয়ী ইয়াযীদ বাহিনী
সেই সময় মদীনায় হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ ও ধ্বংসের তান্ডবলীলা সৃষ্টি করে।
রাসূলুল্লাহর সা. হারাম বা সম্মানিত শহর মদীনার এমন অসম্মান ও অবমাননা সেই
সময় জীবিত সাহাবীরা দেখে দারুন মর্মাহত হন। আবূ সা’ঈদও এমন দৃশ্য দেখে সহ্য
করতে না পেরে পাহাড়ের এক গুহায় আত্মগোপন করেন। কিন্তু সেখানেও তাঁর খোঁজে
একজন পৌঁছে যায় এবং তাঁকে হত্যার জন্য তরবারি উঠায়। তিনি প্রথমতঃ তাকে ভয়
দেখানোর জন্য তরবারি তুলে ধরেন। কিন্তু সৈন্যটি আরও এগিয়ে এলে তিনি তরবারি
মাটিতে রেখে দিয়ে সূরা আল-মায়িদার ২৮ নং আয়াতটি পাঠ করেনঃ
‘যদি তুমি আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে তোমার হাত বাড়াও তবুও আমি তোমাকে হত্যার
উদ্দেশ্যে আমার হাত বাড়াবো না। কারণ, আমি আল্লাহ রাব্বুল ’আলামীনকে ভয়
করি।’
সৈনিকটি থেমে যায়। সে প্রশ্ন করে, আল্লাহর ওয়াস্তে বলুন তো আপনি কে? বললেনঃ আমি আবূ সা’ঈদ আল খুদারী। আপনি কি রাসূলুল্লাহর সা. সাহাবী? বললেন, হাঁ। সৈনিকটি গুহা ছেড়ে চলে গেল। (আল-ইসাবা- ৩/৫৫) আবূ সা’ঈদ গুহা থেকে বাড়ী আসলেন। নানা রকম জিজ্ঞাসাবাদ চললো এবং বন্দী করা হলো। অবশেষে প্রচন্ড চাপের মুখে ইয়াযীদের প্রতি বাই’য়াত করতে বাধ্য হলেন।
একথা হযরত ’আবদুল্লাহ ইবন ’উমার রা. অবগত হয়ে তাঁর কাছে যান এবং বলেনঃ
শুনেছি আপনি নাকি দুই আমীরের বাই’য়াত বা আনুগত্যের অঙ্গীকার করেছেন? বললেনঃ
হাঁ। প্রথমে ’আবদুল্লাহ ইবন যুবায়ের এবং বন্দী হওযার পরে ইয়াযীদের প্রতি
বাই’য়াত করেছি। ইবন ’উমার বললেনঃ আমি এমনই আশংকা করেছিলাম। আবূ সা’ঈদ
বললেনঃ কিন্তু আমার করার কি ছিল? কারণ, আমি রাসূলুল্লাহকে সা. বলতে শুনেছি,
মানুষের প্রতিটি সকাল ও সন্ধ্যা কোন না কোন আমীরের অধীনে অতিবাহিত হওয়া
উচিত। একথা শুনে ইবন ’উমার বললেন, যাই হোক না কেন, আমি দুই আমীরের প্রতি
বাই’য়াত পছন্দ করিনে। (মুসনাদ- ৩/২৯, ৩০)
বেশী সংখ্যক বর্ণনা মতে তিনি হিজরী ৭৪ বছর জীবন লাভ করেছিলেন। তবে আল্লামা
জাহাবী লিখেছেন, তিনি ৮৬ বছর বয়সে মারা যান এবং এটাই সঠিক। (দ্রঃ
তাজকিরাতুল হুফ্ফাজ- ১/৩৭, তাহজীবুল আসমা ওয়াল লুগাত- ২/২৩৭, আল-আ’লাম-
৩/১৩৮, শাজারাতুজ জাহাব- ১/৮১, উসুদুল গাবা- ৫/২১১)
হযরত আবূ সা’ঈদের ছিল দুই স্ত্রী। একজনের নাম যয়নাব বিনতু কা’ব ইবন আজযাহ্।
কেউ কেউ বলেছেনম তিনি সাহাবিয়্যা ছিলেন। দ্বিতীয়জন উম্মু ’আবদিল্লাহ বিনতু
’আবদিল্লাহ নামে প্রসিদ্ধ। তাঁর সন্তানদের নামঃ আবদুর রহমান, হামযাহ্ ও
সা’ঈদ।
হযরত আবূ সা’ঈদ ছিলেন আহলুস্ সুফ্ফার অন্যতম সদস্য। তিনি ছিলেন তাঁর সময়ের একজন শ্রেষ্ঠ ফকীহ। কোন ক্বারীর নিকট কুরআন তিলাওয়াত শিখেছিলেন। তাঁর শিক্ষা জীবনে আনসারদের কয়েকটি হালকায়ে দারস ছিল। সেখানে আনসারদের ’আলিম ব্যক্তিরা দারস দিতেন। আবূ সা’ঈদের ছাত্র জীবনের যুগটি ছিল ইসলামের প্রথম যুগ। সেই সময় মানুষ ঠিক মত শরীর ঢাকার মত কাপড়ও সংগ্রহ করতে পারতো না। হালকায়ে দারসে একজন আর একজনের আড়ালে আবডালে চুপে চুপে বসে যেত। একদিন এমন একটি হালকায়ে দারসে হযরত রাসূলে কারীম সা. উপস্থিত হলেন। তাঁকে দেখে ক্বারীর কিরাত থেমে গেল। তিনি সবাইকে গোল হয়ে বসতে বলে নিজেও তাদের সাথে বসে গেলেন। সেই হালকায় সে দিন যারা উপস্থিত ছিল তাদের মধ্যে একমাত্র আবূ সা’ঈদকে রাসূল সা. চিনতেন। (মুসনাদ- ৩/৬৩, হায়াতুস সাহাবা- ৩/২০৪)
হাদীস ও ফিকাহর জ্ঞান তিনি সরাসরি রাসূল সা. ও অন্য সাহাবীদের নিকট থেকে অর্জন করেন। চার খলীফা ও যায়িদ ইবন সাবিতের নিকট থেকে তিনি হাদীস শোনেন। অসংখ্য হাদীস তাঁর মুখস্থ ছিল। তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা মোট ১১৭০ টি। যাঁরা বহু সংখ্যক হাদীস বর্ণনা করেছেন তিনি এমন একজন হাফেজে হাদীস। তাঁর বর্ণিত হাদীসের মধ্যে ৪৩ টি মতান্তরে ৪৬ টি মুত্তাফিক ’আলাইহি (বুখারী ও মুসলিম সম্মিলিতভাবে বর্ণনা করেছেন।) এবং বুখারী ও মুসলিম প্রত্যেকেই এককভাবে যথাক্রমে ১৬ টি ও ৫২ টি হাদীস বর্ণনা করেছেন। যে সকল বিখ্যাত সাহাবী ও তাবে’ঈ তাঁর নিকট থেকে হাদীস শোনেন ও বণৃনা করেন তাঁদের কয়েকজন নাম নিম্নে দেওয়া গেলঃ
যায়িদ ইবন সাবিত, ’আবদুল্লাহ ইবন ’আব্বাস, আনাস ইবন মালিক, ইবন ’উমার, ইবন যুবাইর, জাবির, আবূ কাতাদাহ, ইবন ’আমর, মাহমূদ ইবন লাবীদ, আবুত তুফায়েল, আবূ উমামা ইবন সাহল, সা’ঈদ ইবনুল মুসায়্যিব, তারিক ইবন শিহাব, ’আতা, মুজাহিদ, আবূ ’উসমান আন-নাহদী, ’উবায়দ ইবন ’উমায়র, ’আয়্যাদ ইবন আবী সারাহ, বুসর ইবন সা’ঈদ, আবূ নুদবাহ, ইবন সীরীন প্রমুখ। (দ্রঃ আল-ইসাবা- ২/৩৫, তাজকিরাতুল হুফফাজ- ১/৪৪, তাহজীবুল আসমা ওয়াল লুগাত- ২/২৩৭, আল-আ’লাম- ৩/১৩৮)
তাঁর হালকায়ে দারস সব সময় ছাত্রে পরিপূর্ণ থাকতো। কেউ কোন প্রশ্ন করতে চাইলে অনেক প্রতীক্ষার পর সুযোগ পেত। (মুসনাদ-৩/৩৫) দারসের সময় ছাড়াও যে কোন সময় লোকে তাঁর কাছে বিভিন্ন মাসয়ালা জানতে পারতো। প্রশ্ন করলে তিনি উত্তর দিতেন। একবার ইবন ’আব্বাস ছেলে ’আলী ও দাস ’আকরামাকে বললেন, যাও তো আবূ সা’ঈদের নিকট থেকে হাদীস শুনে এস। তারা যখন পৌঁছলেন, আবূ সা’ঈদ তখন বাগিচায়, তিনি তাদের সাথে বসেন এবং হাদীস শোনান। (মুসনাদ- ৩/৯০, ৯১)
হাদীস বর্ণনার সাথে সাথে কিভাবে তিনি সে হাদীস শুনেছিলেন সে অবস্থারও বর্ণনা দিতেন। হযরত ’আবদুল্লাহ ইবন ’উমার রা. কোন এক ব্যক্তির নিকট থেকে একটি হাদীস শোনেন। এই লোকটি আবূ সা’ঈদের সূত্রে হাদীসটি বর্ণনা করে। ইবন ’উমার ঐ লোকটিকে সংগে করে আবূ সা’ঈদের নিকট যান এবং প্রশ্ন করেনঃ এই ব্যক্তি কি অমুক হাদীসটি আপনার নিকট থেকে শুনেছে? আর আপনি কি তা রাসূলুল্লাহর সা. মুখ থেকে শুনেছেন? তিনি বললেনঃ আমার দু’চোখ দেখেছে এবং দু’কান শুনেছে। (মুসনাদ- ৩/৪)
একবার কুয’য়া নামক একজন ছাত্রের নিকট একটি হাদীস খুব ভালো লাগে। তিনি জিজ্ঞেস করে বসলেন, হাদীসটি কি আপনি রাসূলুল্লাহর সা. মুখ থেকে শুনেছেন? এমন প্রশ্নে তিনি একটু ক্ষুব্ধ হলেন। বললেনঃ তাহলে কি না শুনেই আমি বর্ণনা করছি? হাঁ, আমি শুনেছি। (মুসনাদ- ৩/৯১)
যে সকল হাদীস রাসূলুল্লাহর সা. মুখ থেকে শোনা শব্দাবলীর ওপর আস্থা না
হতো সেগুলি বর্ণনার ব্যাপারে দারুন সতর্কতা অবলম্বন করতেন। যেমন একবার একটি
হাদীস বর্ণনা করলেন; কিন্তু রাসূলুল্লাহর সা. নামটি উচ্চারণ করলেন না। এক
ব্যক্তি প্রশ্ন করে বসলো, এটা কি রাসূলুল্লাহ সা. থেকে বর্ণিত? বললেনঃ আমিও
জানি।
আবূ সা’ঈদ হযরত রাসূলে কারীমের সা. উপদেশ মত তাঁর ছাত্রদের আন্তরিকভাবে
স্বাগতম জানাতেন। ইমাম তিরমিযী আবূ হারুন থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেনঃ
আমরা আবূ সা’ঈদের কাছে গেলে বলতেনঃ রাসূলুল্লাহর সা. অসীয়াতের (উপদেশ)
প্রতি স্বাগতম। নবী সা. বলেছেনঃ মানুষ তোমাদের অনুসরণ করবে। কিছু লোক নানা
স্থান থেকে দ্বীনের গভীর জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যে তোমাদের কাছে আসবে। তারা
যখন তোমাদের কাছে আসবে তোমরা তাদের ভালো উপদেশ দেবে। অন্য বর্ণনায় এসেছে,
‘তাদেরকে শিক্ষা দেবে এবং বলবে মারহাবা, মারহাবা, নিকটে এস।’ (হায়াতুস
সাহাবা- ৩/২০২, কানযুল ’উম্মাল- ৫/২৪৩)
আবূ সা’ঈদ আরও বর্ণনা করেন। ‘রাসূল সা. আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন, আমরা যেন তাদের (ছাত্রদের) মজলিসে বসার স্থান করে দিই, তাদের হাদীস শিখাই।’ কারণ, তোমরাই তো আমাদের পরবর্তী প্রতিনিধি, আমাদের পরবর্তী মুহাদ্দিস। তিনি তাঁর ছাত্রদের আরও বলতেনঃ তুমি কোন বিষয় না বুঝলে তা বুঝার জন্য বার বার প্রশ্ন করবে। কারণ, তুমি বুঝে আমার মজলিস থেকে উঠে যাও- এটা তোমার না বুঝে উঠে যাওয়া থেকে আমার নিকট অধিক প্রিয়। (হায়াতুস সাহাবা- ৩/২০৩, কানযুল ’উম্মাল- ৫/২৪৩)
তিনি ছাত্রদের হাদীস লিখে দিতেন না। তাবরানী আবূ নাদরাহ্ থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেনঃ আমি আবূ সা’ঈদকে বললাম, আপনি আমাদেরকে হাদীস লিখে দিন। তিনি বললেনঃ আমরা কক্ষণও লিখে দেবনা এবং কক্ষণও হাদীসকে কুরআন বানাবো না। তোমরা বরং আমাদের নিকট থেকে এমনভাবে গ্রহণ কর যেমন আমরা রাসূলুল্লাহর সা. নিকট থেকে গ্রহণ করেছি। (হায়াতুস সাহাবা- ৩/২১৭)
হানজালা ইবন আবী সুফইয়ান আল-জুমাহী তাঁর শায়খদের নিকট থেকে বর্ণনা করেছেন। তাঁরা বলেছেন! আবূ সা’ঈদ আল-খুদারী অপেক্ষা রাসূলুল্লাহর সা. ঘটনাবলীর অধিকতর সমঝদার ব্যক্তি আর কেউ নেই। (তাহজীবুল আসমা ওয়াল লুগাত- ২/২৩৭)
অত্যন্ত সত্যভাষী ছিলেন তিনি। বলতেনঃ আমি রাসূলকে সা. সত্য ভাষণের প্রতি জোর তাকীদ দিতে শুনেছি। হায়, যদি তা না শুনতাম! (মুসনাদ- ৩/৫) একবার সত্য ভাষণের হাদীসটির আলোচনা উঠলে তিনি কেঁদে ফেলেন। তারপর বলেনঃ হাদীসটি তো অবশ্যই শুনেছি; কিন্তু তার ওপর ’আমল মোটেও হচ্ছেনা। (মুসনাদ- ৩/৬১, ৭১)
হযরত আমীর মু’য়াবিয়ার রা. শাসনকালে অনেক বিদ’য়াতের প্রচলন হতে থাকে। তিনি দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে মু’য়াবিয়ার রা. কাছে যান এবং এক এক করে সকল বিদ’য়াতের কথা তাঁর কর্ণগোচর করেন। (মুসনাদ- ৩/৮৪) একবার আমীর মু’য়াবিয়ার সাথে তাঁর আনসারদের সম্পর্কে কথা হয়। তিনি বলেন, রাসূল সা. আমাদের কষ্টে ধৈর্য ধরার নির্দেশ দিয়েছেন। তখন আমীর মু’য়াবিয়া বললেনঃ তাহলে তোমরা ধৈর্য ধর। (মুসনাদ- ৩/৮৯)
একবার উমাইয়্যা খলীফা মারওয়ানের দরবারে বসে সাহাবীদের ফজীলাত ও মর্যাদা
সম্পর্কে তাঁকে রাসূলুল্লাহর সা. হাদীস শোনালেন। মারওয়ান বিশ্বাস করতে
চাইলেন না। উক্ত বৈঠকে হযরত যায়িদ ইবন সাবিত ও রাফে ’ইবন খাদীজও উপস্থিত
ছিলেন। আবূ সা’ঈদ প্রথমে তাদের দুইজনকে স্বাক্ষী মানলেন। তারপর বললেনঃ
তাঁরাই বা কেন বলবে? একজনের তো সাদাকার দায়িত্ব থেকে অপসারণের ভয় আছে, আর
অন্যজনের আপনার একটু ইশারাতেই গোত্রের নেতৃত্ব চলে যাওয়ার ভয়। এমন স্পষ্ট
কথা শুনে মারওয়ান তাঁকে কোড়া দিয়ে মারার জন্য উদ্যত হয়। তখন ঐ ব্যক্তিদ্বয়
তাঁর কথার সত্যতা স্বীকার করেন। (মুসনাদ- ৩/২৩)
এমনিভাবে এক ’ঈদের দিনে মারওয়ান মিম্বার বের করেন এবং নামাযের পূর্বে খুতবা
দেন। এক ব্যক্তি উঠে প্রতিবাদ করে বলে, এ দু’টি কাজই সুন্নাতের পরিপন্থী
বিদ’য়াত। মারওয়ান বললেনঃ পূর্বের পদ্ধতি পরিত্যক্ত হয়েছে। সেখানে আবূ সা’ঈদ
উপস্থিত ছিলেন। তিনি বললেন, যা কিছুই হোক না কেন, লোকটি তার দায়িত্ব পালন
করেছে। আমি হযরত রাসূলুল্লাহকে সা. বলতে শুনেছিঃ যদি কোন ব্যক্তি কোন খারাপ
কাজ করতে দেখে তাহলে তার উচিত শক্তি প্রয়োগে তা প্রতিরোধ করা। যদি তা
সম্ভব না হয় তাহলে উচিত মুখে প্রতিবাদ করা, আর তাও সম্ভব না হলে কমপক্ষে
অন্তরে তা ঘৃণা করা উচিত। (মুসনাদ- ৩/১০)
আমর বিল মারূফের (সৎকাজের আদেশ) আবেগ এত তীব্র ছিল যে, একবার মারওয়ান হযরত আবূ হুরাইরার রা. সাথে বসে ছিলেন। এমন সময় তাঁদের সামনে দিয়ে একটি লাশ অতিক্রম করলো। এই লাশের সাথে আবূ সা’ঈদও ছিলেন। মারওয়ান লাশ দেখেও উঠলেন না। তখন আবূ সা’ঈদ তাঁকে বললেনঃ আমীর, জানাযার জন্যে ওঠো। কারণ, রাসূল সা. উঠতেন। একথা শুনে মারওয়ান দাঁড়িয়ে যান। (মুসনাদ- ৩/৪৭, ৯৭) ইবন সা’দের মতে এই জানাযাটি ছিল উম্মুল মুমিনীন হযরত হাফসার রা.। (আনসাবুল আশরাফ- ১/৪২৮)
হযরত মুস’য়াব ইবন ’উমাইর যখন মদীনার গভর্ণর তখন একবার ’ঈদুল ফিতরের দিন জিজ্ঞেস করলেন, নামায এবং খুতবার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহর সা. কর্মপন্থা কি ছিল? আবূ সা’ঈদ বললেনঃ রাসূল সা. খুতবার আগে নামায পড়াতেন। মুস’য়াব তাঁর কথামত কাজ করেন। (মুসনাদ- ৩/৪)
একবার শাহর ইবন হাওশাব ‘তূর’ পাহাড় ভ্রমণের ইচ্ছা করেন। তিনি আবূ সা’ঈদের সাথে দেখা করতে আসেন। আবূ সা’ঈদ তাঁকে বলেন, তিনটি মসজিদ ছাড়া অন্য কোন পবিত্র ভূমির প্রতি সফর নিষেধ করা হয়েছে।
ইবন আবী সা’সার জঙ্গল খুব পছন্দ ছিল্ আবূ সা’ঈদ তাঁকে বললেনঃ তুমি সেখানে এমন জোরে আযান দেবে যেন গোটা জঙ্গলে তাকবীরের ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়ে ওঠে। (মুসনাদ- ৩/৯৫, ৪/৯৩)
তাঁর বোন কোন কিছু পানাহার ছাড়াই ধারাবাহিকভাবে সাওম পালন করতেন। রাসূলুল্লাহ সা. এ ধরণের সাওম পালনে নিষেধ করতেন। আবূ সা’ঈদও সব সময় তাঁকে এ কাজ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করতেন।
তিনি ছিলেন পরিপূর্ণভাবে রাসূলুল্লাহর সা. সুন্নাতের অনুসারী। হযরত আবূ হুরাইরাহ এক মসজিদে নামায পড়াতেন। একবার তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন বা কোন কারণে আসতে পারলেন না। তাঁর পরিবর্তে আবূ সা’ঈদ নামায পড়ালেন। তাঁর নামাযের পদ্ধতির সাথে লোকেরা কিছুটা দ্বিমত পোষণ করলো। তিনি মিম্বারের কাছে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন, আমি যেভাবে রাসূলুল্লাহকে সা. নামায আদায় করতে দেখেছি ঠিক সেইভাবে পড়িয়েছি। এখন তোমরা আমার সাথে দ্বিমত পোষণ করলে তাতে আমার কিছু যায় আসেনা।
তিনি ছিলেন ধৈর্যশীল। একবার তাঁর পায়ে ব্যথা হলো। তিনি পায়ের ওপর পা রেখে শুয়ে ছিলেন। তাঁর ভাই এসে হঠাৎ সেই পায়ে হাত দিয়ে একটি থাবা মারেন। তাতে ব্যথা আরও বেড়ে যায়। তিনি অত্যন্ত নরমভাবে বললেন, আমাকে ব্যথা দিলে? তুমি তো জানতে আমার পায়ে ব্যথা। ভাই বললেনঃ হাঁ, জানতাম। তবে এভাবে শুতে রাসূল সা. নিষেধ করেছেন।
সরলতা ছিল তাঁর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। একবার একটি জানাযার নামাযের জন্য তাঁকে ডাকা হয়। সবার শেষে একটু দেরীতে তিনি পৌঁছলেন। লোকেরা তাঁর অপেক্ষায় বসে ছিল। তাঁকে দেখে সবাই উঠে দাঁড়িয়ে তাঁর জন্য স্থান খালি করে দেয়। তিনি বললেনঃ এ উচিত নয়। মানুষের উচিত ফাঁকা জায়গায় বসা। একথা বলে তিনি একটি ফাঁকা স্থানে বসে পড়েন।
আবূ সালামা নামে তার এক ছাত্র ছিলেন। তিনি ছিলেন তাবে’ঈ। তাঁর সাথে ছিল
চমৎকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। একবার আবূ সালামা তাঁকে ডাক দিলেন। তিনি
গায়ে চাদর জড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন। আবূ সালামা বললেন, একটু বাগিচা পর্যন্ত
চলুন। আপনার সাথে কিছু কথা আছে। তিনি আবূ সালামার সাথে চললেন।
তিনি ইয়াতীমদের প্রতিপালন করতেন। লায়স ও সুলায়মান ইবন ’আমর তাঁরই পালিত।
তিনি হাতে একটি ছড়ি নিয়ে ঘুরতেন। হালকা-পাতলা ছড়ি তাঁর পছন্দ ছিল। খেজুরের
ডাল সোজা করে তিনি ছড়ি বানাতেন। এক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহর সা.
অনুসারী। (মুসনাদ- ৩/৬৫)
আনাস বলেনঃ আনসারদের ২০ জন যুবক সর্বক্ষণ রাসূলুল্লাহর সা. সেবায় নিয়োজিত থাকতো। যে কোন প্রয়োজনে রাসূল সা. তাদের কাউকে পাঠাতেন। আবদুর রহমান ইবন ’আউফ বলেন, চার অথবা পাঁচজন সাহাবী তো কক্ষণও রাসূলুল্লাহর সা. বাড়ীর দরযা থেকে উঠতো না। আবূ সা’ঈদ বলেন, আমরা পালাক্রমে রাসূলুল্লাহর সা. কাছে থাকতাম। (হায়াতুস সাহাবা- ২/৬৮৭)
একবার এক ওয়ালিমার অনুষ্ঠানে তাঁকে দা’ওয়াত করা হয়। তিনি উপস্থিত হয়ে দেখেন, নানা পদের খাবার প্রস্তুত। বাড়ীর লোকদের বললেন, তোমরা কি জাননা, রাসূল সা. যে দিন দুপুরে খেতেন সে দিন রাতে উপোস যেতেন এবং সকালে নাস্তা করলে দুপুরে খেতেন না? (হায়াতুস সাহাবা- ২/৩০৮)
সিফ্ফীন যুদ্ধে হযরত ’আবদুল্লাহ ইবন ’আমর ইবনুল ’আস পিতা ’আমর ইবনুল ’আসের সাথে হযরত ’আলীর রা. বিরুদ্ধে রনাঙ্গনে যান। এ কারণে হযরত হাসান ইবন ’আলী বহুদিন যাবত তাঁর সাথে কথা বলা বন্ধ রাখেন। হযরত আবূ সা’ঈদ রা. এ কথা জানতে ’আবদুল্লাহকে সংগে নিয়ে হাসানের নিকট যান এবং তাঁদের দু’জনের মনোমালিন্য দূর করে সম্প্রীতি ও সৌহার্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে দেন। (হায়াতুস সাহাবা- ২/৪৩৪)