নাম যায়িদ, ডাকনাম আবু তালহা। এ নামেই ইতিহাসে প্রসিদ্ধ। হিজরাতের ৩৬ বছর পূর্বে ৫৮৫ খ্রীষ্টাব্দে ইয়াসরিবে জন্মগ্রহণ করেন। (আল-আ’লাম- ৩/৯৮) পিতা সাহল ইবন আল-আসওয়াদ ইবন হারাম। বনু জাজীলার সন্তান। মাতা ’উবাদাহ্ বিনতু মালিক। প্রাচীন জাহিলী যুগে ইয়াসরিবে আবু তালহার খান্দান বিশেষ মর্যাদার অধিকারী ছিল। তাঁর পিতৃ ও মাতৃ বংশের মধ্যেও আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল। বর্তমান মসজিদে নববী সংলগ্ন পশ্চিম দিকে তাঁর খান্দানের বসতি ছিল। তিনি তাঁর সময়ে খান্দানের রয়িস বা নেতা ছিলেন। (আনসাবুল আশরাফ- ১/৪২, আল-ইসতীয়াব- ৪/১১৩, তাহজীবুল আসমা- ১/৪৪৫)
ইসলাম-পূর্ব জীবনে সাধারণ আরববাসীর মত মূর্তি পূজারী ছিলেন। তাঁর মদ পানের আসরটিও ছিল বেশ জাঁকজমকপূর্ণ। পানের আসরে নিয়মিত আড্ডা জমতো। সেই জাহিলী যুগে তিনি ইয়াসরিবের হাতেগোনা গুটি কয়েক সাহসী তীরন্দাযদের মধ্যে গণ্য হতেন। (বুখারী- ২/৬৬৪, আল-আ’লাম- ৩/৯৮)
আবু তালহা যখন কুড়ি/বাইশ বছরের যুবক তখন মক্কায় হযরত রাসূলে কারীম সা. নবুওয়াত লাভ করেন। প্রথম কয়েক বছর ইয়াসরিবে এর কোন প্রভাব তেমন একটা না পড়লেও পরের বছরগুলিতে ধীরে ধীরে পড়তে থাকে। রাসূলুল্লাহর সা. মদীনায় হিজরাতের কয়েক বছর পূর্বে মক্কা থেকে হযরত মুস’য়াব ইবন ’উমাইরকে সেখানে পাঠান ইসলাম প্রচারের জন্য। তাঁরই নিকট মদীনার এক মহিয়সী মহিলা উম্মু সুলাইম ইসলাম গ্রহণ করেন। এই মহিলার প্রচেষ্টায় পরবর্তীকালে আবু তালহা মূর্তি পূজা ত্যাগ করে মুসলিম হন এবং তাঁকে বিয়ে করেন।
আবু তালহা কখন ইসলাম গ্রহণ করেন, বিভিন্ন বর্ণনা পর্যালোচনা করলে সে সম্পর্কে দুইটি ধারণা পাওয়া যায়। একটি এই যে, রাসূলুল্লাহর সা. মদীনায় হিজরাতের পূর্বে মুস’য়াব ইবন ’উমাইরের হাতে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং তাঁর সাথে হজ্জ উপলক্ষে মক্কার গিয়ে সর্বশেষ ’আকাবায় তিহাত্তর মতান্তরে পঁচাত্তর জনের সাথে রাসূলুল্লাহর হাতে বাই’য়াত (আনুগত্যের শপথ) করেন। এই বাই’য়াতে উপস্থিত লোকদের মধ্য থেকে রাসূল সা. যে বারো জন নাকীব বা দায়িত্বশীল মনোনীত করেন তাঁদের একজন ছিলেন আবু তালহা। অন্যটি হলো, রাসূলুল্লাহ সা. মদীনায় আসার পর আবু তালহা ইসলাম গ্রহণ করেন। তবে প্রথম ধারণাটি সর্বাধিক প্রসিদ্ধ এবং অধিকাংশ সীরাত বিশেষজ্ঞ একথাই বর্ণনা করেছেন। (তারীখুল ইসলাম ওয়া তাবাকাতুল মাশাহীর ওয়াল আ’লাম- ২/১১৯, শাজারাতুজ জাহাব- ১/৪০, উসুদুল গাবা- ৫/২৩৪)
আবু তালহার ইসলাম গ্রহণ এবং উম্মু সুলাইমের সাথে বিয়ের ঘটনার মধ্যে একটি যোগসূত্র আছে। হযরত রাসূলে কারীমের সা. খাদিম প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আনাস ইবন মালিকের সম্মানিতা মা হলেন হযরত উম্মু সুলাইম। আনাসের পিতা মালিক ছিল তাঁর ইসলাম-পূর্ব জীবনের স্বামী। উম্মু সুলাইম ইসলাম গ্রহণ করলে দুঃখ ও ক্ষোভে মালিক স্ত্রী-পুত্র ফেলে শামে চলে যায় এবং সেখানে মারা যায়। তারপর আবু তালহা উম্মু সুলাইমকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। এই বিয়ে সম্পর্কিত কয়েকটি বর্ণনা এখানে আমরা তুলে ধরছি।
আনাস থেকে বর্ণিত হয়েছে। আবু তালহা উম্মু সুলাইমকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। উম্মু সুলাইম বললেনঃ ‘কোন মুশরিককে বিয়ে করা আমার উচিত হবে না। আচ্ছা আবু তালহা, তুমি কি দেখনা তোমাদের এইসব ইলাহ যার তোমরা ’ইবাদাত করে থাক, তা তো অমুকের ওখানে তৈরী। আগুন লাগালে তা জ্বলে যায়।’ কথাগুলি শুনে আবু তালহা উঠে চলে গেলেন। তবে অন্তরে একটা ভাবনা দেখা দিল। কিছুতেই ঘুম এলো না। অন্য এক বর্ণনায় এসেছে। উম্মু সুলাইম বলেছিলেনঃ ‘তোমার এই প্রস্তাবে তো আমার কোন আপত্তি নেই। তবে সমস্যা হলো, তুমি যে একজন কাফির ব্যক্তি, আর আমি একজন মুসলিম নারী। তুমি যদি ইসলাম গ্রহণ কর, তবে তো কোন সমস্যাই নেই। তখন তোমার ইসলামই হবে আমার মোহর। তাছাড়া অন্য কিছুই আমি চাইনা।’ আবু তালহা ইসলাম গ্রহণ করেন এবং উম্মু সুলাইমকে বিয়ে করেন। সাবিত বলতেনঃ উম্মু সুলাইমের মোহরের চেয়ে উত্তম মোহরের কথা আমরা আর শুনিনি। তাঁর সেই মোহর ছিল ইসলাম। ইবন ’আসাকির বলেন, তাবারানী, আবু নু’ঈম ও ইবন দুরাসতাওয়াইহ উপরোক্ত কথা বর্ণনা করেছেন। (তারীখে ইবন ’আসাকির- ৬/৫) ’উরওয়া, মূসা ইবন ’উকবা, আল্লামা জাহবী, ইবনুল ’ইমাদ আল-হাম্বলী, ইবনুল আসীর প্রমুখ ঐতিহাসিক বলেন, এটা রাসূলুল্লাহর সা. মদীনায় হিজরাতের পূর্বের ঘটনা। কারণ, আবু তালহা আকাবায় রাসূলুল্লাহর সা. হাতে বাই’য়াত করেন ও নাকীব মনোনীত হন।
ইবন ’আসাকির বলেনঃ উম্মু সুলাইমের সাথে আবু তালহার বিয়ের যেসব বর্ণনা
এসেছে তাতে ধারণা জন্মে যে, তিনি রাসূলুল্লাহর সা. মদীনায় হিজরাতের পরে
ইসলাম গ্রহণ করেছেন। এ সম্পর্কে তিনি নাদর ইবন আনাস থেকে বর্ণিত হফেজ ও
বায়হাকীর একটি বর্ণনা উদ্ধার করেছেন। নাদর বলেনঃ আনাসের পিতা মালিক একদিন
তাঁর স্ত্রী উম্মু সুলাইমকে বললোঃ এ ব্যক্তি [রাসূল সা.] তো দেখছি মদ হারাম
করেছেন। তারপর সে স্ত্রী ও সন্তান ফেলে শামে চলে যায় এবং সেখানে মারা যায়।
অতঃপর আবু তালহা উম্মু সুলাইমকে বিয়ের প্রস্তাব দেন উম্মু সুলাইম বললেনঃ
‘শোন আবু তালহা, তোমার মত ব্যক্তিকে ফেরানো যায় না। তবে তুমি কাফির, আর আমি
মুসলিম। সমস্যাটি এখানেই। এ বিয়ে হতে পারে না।’ আবু তালহা বললেনঃ ‘তুমি
সোনা-রূপো চাও?’ উম্মু সুলাইম বললেনঃ ‘না, আমি তা চাইনা। আমি শুধু তোমার
ইসলাম চাই।’ আবু তালহা বললেনঃ ‘এ ব্যাপারে আমাকে কে সাহায্য করবে?’ বললেনঃ
‘রাসূলুল্লাহ সা.।’
আবু তালহা চললেন রাসূলুল্লাহর সা. কাছে। তিনি তখন সাহাবীদের নিয়ে বসে ছিলেন। আবু তালহাকে আসতে দেখে বললেনঃ আবু তালহা আসছে। ইসলামের দীপ্তি তার কপালে দেখা যাচ্ছে। আবু তালহা এসে উম্মু সুলাইম যা বলেছিলেন সেই কথাগুলি রাসূলুল্লাহকে সা. বললেন। এভাবে আবু তালহা ইসলাম গ্রহণ করেন এবং উম্মু সুলাইমকে বিয়ে করেন। (তারীখে ইবন ’আসাকির- ৬/৫, হায়াতুস সাহাবা- ১/১৯৬)
রাসূলুল্লাহ সা. মদীনায় এসে মক্কার মুহাজির ও মদীনার আনসারদের মধ্যে দ্বীনী ভ্রাতৃ সম্পর্কের প্রচলন করেন। আবু তালহার দ্বীনী ভাই কে হয়েছিলেন, সে সম্পর্কেও নানা জনের নানা কথা আছে। প্রখ্যাত কুরাইশ মুহাজির আবু ’উবায়দাহ্ ইবনুল জাররাহর রা. সাথে তাঁর ভ্রাতৃ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল- এটা সংখ্যাগরিষ্ঠ সীরাত লেখকের মত। রাসূলুল্লাহর সা. নিকট থেকে এই আবু ’উবায়দাহ্ ‘আমীনুল উম্মাহ’ খিতাবসহ জান্নাতের সুসংবাদ লাভ করেছিলেন। ইবন ’আসাকির বলেনঃ হযরত রাসূলে কারীম সা. আবু তালহা ও বিলালের হাত ধরে তাঁদের ভ্রাতৃ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছিলেন। (তারীখে ইবন ’আসাকির- ৬/৯) ইবন সা’দ এ সম্পর্কে ’আসিম ইবন ’উমারের একটি বর্ণনা পেশ করেছেন। রাসূল সা. আবু তালহা ও আরকাম ইবন আল-আরকাম আল-মাখযূমীর মধ্যে ভ্রাতৃ সম্পর্ক কায়েম করেন। (তাবাকাত- ৩/৫০৫)
বদর, উহুদ, খন্দকসহ সকল যুদ্ধ ও অভিযানে আবু তালহা রাসূলুল্লাহর সা. সাথে যোগ দেন। যুদ্ধের ময়দানে তিনি প্রায়ই এই চরণটি আওড়াতেনঃ ‘আমি আবু তালহা, আমার নাম যায়িদ। প্রতিদিন আমার অস্ত্রে থাকে একটি শিকার।’ (তাহজীবুল আসমা- ১/৪৪৫, তারীখে ইবন আসাকির- ৫/৪)
ইসলামের ইতিহাসের প্রথম যুদ্ধ বদর। আবু তালহা অতি উৎসাহের সাথে এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ইবন সা’দ তাঁর তাবাকাতে বদরী সাহাবীদের নামের তালিকায় তাঁর নামটি উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেনঃ বদরে তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় আমার হাত থেকে তরবারি পড়ে গিয়েছিল। একবার নয়, তিনবার। আর এই সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেনঃ ‘স্মরণ কর, তিনি তাঁর পক্ষ হতে স্বস্তির জন্য তোমাদেরকে তন্দ্রায় আচ্ছন্ন করেন।’ (সূরা আল-আনফাল- ১১) (তারীখে ইবন আসাকির- ৬/৬) উল্লেখ্য যে, বদর যুদ্ধের ময়দানে এক সময় ক্ষণিকের জন্য মুসলিম বাহিনী তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়। এতে তাঁদের ক্লান্তি ও ভয়ভীতি দূর হয়ে যায়।
উহুদ যুদ্ধে তিনি আল্লাহর নবীর জন্য আত্মত্যাগের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। এ যুদ্ধে তিনি ছিলেন তীরন্দায বাহিনীর সদস্য। (আনসাবুল আশরাফ- ১/১২৫) প্রচন্ড যুদ্ধের এক পর্যায়ে মুসলিম বাহিনী বিক্ষিপ্ত ও বিপর্যস্ত হয়ে রাসূলুল্লাহর সা. নিকট থেকে দূরে ছিটকে পড়ে। তখন আবু তালহাসহ মুষ্টিমেয় কিছু সৈনিক নিজেদের জীবন বাজি রেখে রাসূলুল্লাহকে সা. ঘিরে শত্রু বাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করেন। এদিন তিনি রাসূলুল্লাহকে সা. নিজের পেছনে আড়াল করে রেখে শত্রুদের দিকে তীর ছুড়ছিলেন। একটি তীর ছুড়লে রাসুল সা. একটু মাথা উঁচু করে দেখছিলেন, তা কোথায় গিয়ে পড়ছে। আবু তালহা রাসূলুল্লাহরর সা. বুকে হাত দিয়ে বসিয়ে দিয়ে বলছিলেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ! বসুন! এভাবে থাকুন। তাহলে আপনার গায়ে কোন তীর লাগবে না। তিনি একটু মাথা উঁচু করলেই আবু তালহা খুব দ্রুত তাঁকে আড়াল করে দাঁড়াচ্ছিলেন। সেদিন তিনি রাসূলকে সা. আরও বলেছিলেন, আমার এ বুক আপনার বুকের সামনেই থাকবে। এক পর্যায়ে তিনি রাসূলকে সা. বলেনঃ আমি শক্তিশালী সাহসী মানুষ। আপনার যা প্রয়োজন আমাকেই বলুন। তিনি শত্রুদের বুক লক্ষ্য করে তীর ছুড়ছিলেন আর গুন গুন করে কবিতার একটি পংক্তি আওড়াচ্ছিলেনঃ
‘আমার জীবন হোক আপনার জীবনের প্রতি উৎসর্গ, আমার মুখমন্ডল হোক আপনার মুখমন্ডলের ঢাল।’ আবু তালহা ছিলেন বলবান বীর পুরুষ। এই উহুদ যুদ্ধে তিনি দুই অথবা তিনখানি ধনুক ভেঙ্গেছিলেন।
আক্রমণের প্রচন্ডতায় তাঁর হাত দুইখানি অবশ হয়ে পড়ছিল। তবুও তিনি একবারও
একটু উহ্ শব্দ উচ্চারণ করেননি। কারণ, তখন তাঁর একমাত্র চিন্তা ছিল
রাসূলুল্লাহর সা. হিফাজত ও নিরাপত্তা। (উসুদুল গাবা- ৫/২৩৪, তারীখে ইবন
’আসাকির- ৬/৭, তাবাকাত- ৩/৫০৭, বুখারী-কিতাবুল মাগাযী)
হযরত আবু তালহা খাইবার যুদ্ধে যোগদান করেন। এই যুদ্ধের সময় তাঁর ও
রাসূলুল্লাহ সা. উভয়ের উট খুবই নিকটে পাশাপাশি ছিল এবং রাসূল সা. গাধার
গোশত হারাম ঘোষণা করার জন্য ঘোষক হিসেবে তাঁকেই মনোনীত করেন। (মুসনাদে
আহমাদ- ৩/১২১)
এই অভিযান থেকে ফেরার সময় হযরত রাসূলে কারীম সা. ও হযরত সাফিয়্যা ছিলেন এক উটের ওপর। মদীনার কাছাকাছি এসে উটটি হোঁচট খায় এবং আরোহীদ্বয় ছিটকে মাটিতে পড়ে যান। আবু তালহা দ্রুত নিজের উট থেকে লাফিয়ে পড়ে রাসূলুল্লাহর সা. কাছে পৌঁছে বলেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমাকে আল্লাহ আপনার প্রতি উৎসর্গ করুন! আপনি কি কষ্ট পেয়েছেন? বললেনঃ না। তবে মহিলার খবর লও। আবু তালহা রুমাল দিয়ে মুখ ঢেকে হযরত সাফিয়্যার নিকটে যান এবং উটের হাওদা ঠিক করে আবার তাঁকে বসিয়ে দেন। (মুসনাদে আহমাদ- ৩/১৮০)
হুনাইন যুদ্ধেও তিনি দারুণ বাহাদুরী দেখান। এ যুদ্ধে তিনি একাই বিশ
মতান্তরে একুশজন কাফিরকে হত্যা করেন। রাসূল সা. ঘোষণা করেছিলেন কেউ কোন
কাফিরকে হত্যা করলে সে হবে নিহত ব্যক্তির সকল জিনিসের মালিক। এ দিন আবু
তালহা একুশ ব্যক্তির সাজ-সরঞ্জামের অধিকারী হন। হিজরী অষ্টম সনে সংঘটিত এই
যুদ্ধ ছিল রাসূলুল্লাহর সা. জীবনের সর্বশেষ যুদ্ধ। (তারীখুল ইসলাম ওয়া
তাবাকাতুল মাশাহীর- ২/১১৯, তারীখে ইবন ’আসাকির- ৬/৭, উসুদুল গাবা- ৫/২৩৫)
এই যুদ্ধের সময় তিনি হাসতে হাসতে রাসূলুল্লাহর সা.কাছে এসে বললেনঃ ইয়া
রাসূলুল্লাহ! উম্মু সুলাইমের হাতে একটি খঞ্জর, আপনি কি তা দেখেছেন? রাসূল
সা. বললেন, উম্মু সুলাইম, এই খঞ্জর দিয়ে কি করবে? বললেনঃ মুশরিকরা কেউ আমার
নিকটে এলে এটা দিয়ে তাঁর পেট ফেঁড়ে ফেলবো। একথা শুনে রাসুল সা. হাসতে
লাগলেন। (সীরাতু ইবন হিশাম- ২/৪৪৬, ৪৪৭, হায়াতুস সাহাবা- ১/৫৯৭)
বিদায় হজ্জে আবু তালহা রাসূলুল্লাহর সা. সাথে ছিলেন। মিনায় রাসূল সা. মাথা ‘হলক’ (চুল ছেঁচে ফেলা) করছিলেন। তিনি মাথার ডান দিকের কর্তিত চুল একটি/দুইটি করে পাশে বসা সাহাবীদের মধ্যে বন্টন করে দেন। কিন্তু মাথার বাম পাশের চুলগুলির সবই আবু তালহাকে দান করেন। (তারীখে ইবন ’আসাকির- ৬/৭) ইমাম মুসলিমও একথা বর্ণনা করেছেন।
হযরত রাসূলে কারীমের সা. ইনতিকালের কাছাকাছি সময় মদীনায় সাধারণতঃ দুই
ব্যক্তি কবর খুঁড়তেন। মুহাজিরদের মধ্যে আবু ’উবায়দাহ্ ইবনুল জাররাহ। তিনি
খুঁড়তেন মককাবাসীদের মত। আর আনসারদের মধ্যে আবু তালহা। তিনি খুঁড়তেন
মদীনাবাসীদের মত। হযরত রাসূলে কারীমের সা. ওফাতের পর সাহাবায়ে কিরাম মসজিদে
নববীতে বসে দাফন-কাফনের বিষয় পরামর্শ শুরু করলেন। প্রশ্ন দেখা দিল, কে এবং
কোন পদ্ধতিতে কবর তৈরী করবে? উপরোক্ত দুই ব্যক্তি তখন এই মজলিসে উপস্থিত
ছিলেন না। হযরত ’আব্বাস রা. একই সময়ে দুইজনের নিকট লোক পাঠালেন, তাঁদেরকে
ডেকে আনার জন্য। সিদ্ধান্ত হলো, এই দুইজনের মধ্যে যিনি আগে পৌঁছবেন তিনিই
এই সৌভাগ্যের অধিকারী হবেন। তাঁদের ডাকার জন্য লোক পাঠিয়ে দিয়ে হযরত
’আব্বাস রা. সহ উপস্থিত সাহাবীরা দু’আ করতে লাগলেনঃ হে আল্লাহ, আপনার নবীর
জন্য এই দুই জনের একজনকে নির্বাচন করুন। কিছুক্ষণের মধ্যে যে ব্যক্তি আবু
তালহার খোঁজে গিয়েছিল, তাঁকে সংগে করে ফিরে আসে। অতঃপর আবু তালহা
মদীনাবাসীদের নিয়ম অনুযায়ী রাসূলুল্লাহর সা. কবর তৈরী করেন। (আনসাবুল
আশরাফ- ১/৫৭৩, আসাহ আস-সীয়ার- ৫৮৭)
হযরত রাসূলে কারীমের সা. ওফাতের পর বহু সাহাবী মদীনা ছেড়ে শামে আবাসন গড়ে
তোলেন। আবু তালহাও তথাকার অধিবাসীদের একজন। তবে যখনই কোন দুঃখ ও
দুশ্চিন্তায় পিষ্ট হতেন, তখনই এই মাসাধিক কালের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে
রাসূলুল্লাহর সা. পবিত্র মাযারে হাজির হতেন এবং মানসিক প্রশান্তি লাভ
করতেন। (তারীখে ইবন আসাকির- ৬/৪)
হযরত আবু বকরের রা. খিলাফত কাল আবু তালহা মোটামুটি শামে (সিরিয়া) কাটান। হযরত ফারুকে ’আজমের খিলাফত কালের বেশীর ভাগ সময় সেখানেই ছিলেন। হযরত উমারের রা. বাইতুল মাকদাস সফরের সময় তিনি শামে ছিলেন। আনাস থেকে বর্ণিত। ’উমার ইবনুল খাত্তাব শাম সফরে গেছেন। আবু তালহা ও আবু ’উবায়দাহ্ ইবনুল জাররাহ তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে এসে বললেনঃ আপনার সাথে রাসূলুল্লাহর সা. বাছা বাছা সাহাবীরা আছেন। অথচ আমরা পিছনে রেখে এসেছি এক প্রজ্জ্বলিত আগুন। (তাঁরা মহামারি আকারে প্লেগের দিকে ইঙ্গিত করেছেন।) আপনি এ যাত্রা শামে প্রবেশ না করে মদীনায় ফিরে যান। ’উমার ফিরে গেলেন। পরের বছর তিনি এই স্থগিত সফর শেষ করেন।’ (তারীখে ইবন ’আসাকির- ৬/৪)
হযরত ’উমারের রা. অন্তিম সময়ে আবু তালহা মদীনায় ছিলেন। তাঁর ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদার প্রতি খলীফা ’উমারের রা. প্রবল আস্থা ও বিশ্বাস ছিল। তিনি যখন জীবনের প্রতি হতাশ হয়ে পড়লেন, তখন পরবর্তী খলীফা পদের জন্য ছয়জন সর্বজনমান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিকে মনোনয়ন দান করলেন। তারপর আবু তালহাকে ডেকে বললেনঃ আপনাদের দ্বারাই আল্লাহ তা’য়ালা ইসলামের সম্মান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছেন। আমার মৃত্যুর পর আপনি ৫০ জন আনসারকে সংগে নিয়ে এই ছয় ব্যক্তির কার্যকলাপের প্রতি লক্ষ্য রাখবেন। যদি তাঁদের চারজন এক দিকে যায় আর দুই জন বিরোধিতা করে তাহলে ঐ দুইজনের গর্দান উড়িয়ে দিবেন। আর তাঁরা সমান দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেলে যে দলে ’আবদুল রহমান ইবন ’আউফ থাকবে না সে দলকে হত্যা করবেন। তিন দিনের মধ্যে কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হতে না পারলে তাদের সকলের দেহ থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে ফেলবেন। আমার মৃত্যুর পর পরবর্তী খলীফা নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত আপনিই হবে অন্তরবর্তীকালীন খরীফা। (কানযুল ’উম্মাল- ৩/১৫৬, ১৫৭, হায়াতুস সাহাবা- ২/৩৪)
হযরত মিসওয়ার ইবন মাখরামার গৃহে ঐ ছয় ব্যক্তির বৈঠক বসলো। আবু তালহা সঙ্গীদের নিয়ে নিরাপত্তা প্রহরী হিসেবে বাড়ীর দরযায় দাঁড়িয়ে গেলেন। বনু ’হাশিম প্রথম থেকেই এই পরামর্শের বিরোধী ছিল। কারণ, তার ছিল ’আলীকে রা. খলীফা বানানোর অভিলাষী। হযরত ’আব্বাস রা. সেই সময় চুপে চুপে ’আলীকে রা. বলেছিলেন, আপনি নিজের বিষয়ট ঐ লোকদের হাতে ছেড়ে দেবেন না। আপনি নিজেই ফায়সালা করুন। ’আলী রা. কিছু একটা জবাব দিয়েছিলেন। আবু তালহা পাশে দাঁড়িয়ে তাঁদের এ সংলাপ শুনেছিলেন। হঠাৎ তাঁর প্রতি ’আলীর দৃষ্টি পড়তেই তিনি কিছু একটা যেন চিন্তা করলেন। আবু তালহা তা বুঝতে পেরে বলেছিলেনঃ আবুল হাসান, ভয়ের কিছু নেই।
একদিন এই ছয় ব্যক্তির গোপন বৈঠক চলছে। আবু তালহাও তাঁর বাহিনী নিয়ে দরযায় দাঁড়িয়ে। এমন সময় ’আমর ইবনুল ’আস ও মুগীরা ইবন শু’বা এসে দরযায় বসে পড়েন। আবু তালহা তাঁদেররকে তেমন কিছু বললেন না; তবে সা’দ ইবন আবী ওয়াক্কাস ছিলেন অত্যন্ত কঠোর প্রকৃতির মানুষ। তিনি ওঁদের দুইজনের ভাব-ভঙ্গিমায় স্থির থাকতে পারলেন না। তিনি কঙ্কর উঠিয়ে তাঁদের প্রতি নিক্ষেপ করে বললেনঃ এরা এসেছে মদীনায় একথা প্রচার করতে যে, আমরাও শূরার সদস্য ছিলাম। কঙ্কর নিক্ষেপ করায় ’আমর ও মুগীরা ক্ষুব্ধ হন এবং ঝগড়া শুরু করেন। আবু তালহা বিরক্ত হয়ে বললেনঃ আমার আশংকা হচ্ছে, আপনারা এমন অহেতুক ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়ে আসল বিষয়টি ছেড়ে না দেন। সেই সত্তার নামে শপথ, যিনি ’উমারকে মৃত্যু দান করেছেন, আমি তিনদিনের বেশী একটুও সময় দেব না। খলীফা নির্বাচনের ব্যাপারটি শেষ হওয়ার পর আবু তালহা মন্তব্য করেনঃ খিলাফতের দায়িত্ব লাভের জন্য এই ছয় ব্যক্তি প্রতিযোগিতা করবে, এমন আশংকার চেয়ে আমার বেশী ভয় ছিল তাঁরা এই দায়িত্ব থেকে দূরে সরে থাকে কিনা। কারণ, ’উমারের মৃত্যুর পর প্রতিটি গৃহে দ্বীন ও দুনিয়ার ঘাটতি দেখা দিয়েছিল। (হায়াতুস সাহাবা- ২/৪৭৩)
খলিফা নির্বাচনের পর আবু তালহা সম্পূর্ণ নির্জনে চলে যান এবং বাকী জীবন একাগ্রচিত্তে আল্লাহর ইবাদাতে কাটিয়ে দেন। হযরত উম্মু সুলাইমের রা. গর্ভে আবু তালহার একাধিক সন্তান হয়; কিন্তু তাদের কেউই বেশী দিন বাঁচেনি। তাঁর এক ছেলের নাম ছিল আবু ’উমাইর। ছোট বেলায় তার ছিল একটি ছোট পাখী। পাখীটি মারা গেল। একদিন রাসূল সা. তাদের বাড়ীতে গিয়ে তাকে খুবই বিমর্ষ দেখতে পেলেন। তার এমন অবস্থার কারণ জানতে চাইলে লোকেরা রাসূলকে সা. প্রকৃত ঘটনা খুলে বললে রাসূল সা. তাকে হাসানের জন্য একটু কাব্য করে বললেনঃ ‘ইয়া আবা ’উমাইর, মা ফা’য়ালান নুগাইর’- ওহে আবু উমাইর তোমার ছোট পাখীটি কী করলো? (হায়াতুস সাহাবা- ২/৫৭০, আল-ইসতী’য়াব)
আবু তালহার অন্য একটি ছেলে কিছু দিন রোগ ভোগের পর মারা যায়। ছেলেটির অসুস্থতার মধ্যে আবু তালহা একদিন মসজিদে নববীতে যান এবং তখন সে মারা যায়। উম্মু সুলাইম ছেলের বাবার জন্য অপেক্ষা না করে তাকে দাফন করে দেন এবং বাড়ীতে লোকদের বলেন, তারা যেন ছেলের দাফন-কাফনের কথা আবু তালহাকে না বলে। এদিকে আবু তালহা মসজিদ থেকে আরও কয়েকজন মেহমানসহ বাড়ী ফিরলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ছেলে কেমন আছে? ছেলের মা বললেনঃ আগের চেয়ে ভালো। আবু তালহা মেহমানদের সাথে কথা বলতে লাগলেন। খাবার এলো এবং সবাই এক সাথে বসে খেয়ে নিলেন। মেহমান বিদায় নিলে আবু তালহা ভিতর বাড়ীতে আসলেন। রাতে স্বামী-স্ত্রী এক বিছানায় কাটালেন এবং মিলিত হলেন। শেষ রাতে উম্মু সুলাইম ছেলের মৃত্যুর খবর সহ কাফন-দাফনের কথা প্রকাশ করে বললেনঃ সে ছিল আমাদের কাছে আল্লাহর এক আমানত। তিনি সেই আমানত ফিরিয়ে নিয়েছেন। এতে কার কি আপত্তি থাকতে পারে? আবু তালহা ’ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজউন’ উচ্চারণ করলেন তবে এভাবে খবরটি গোপন করাতে তিনি একটু ক্ষুব্ধ হলেন। পরদিন সকালে আবু তালহা বিষয়টি রাসূলুল্লাহকে সা. অবহিত করলে তিনি বলেনঃ আল্লাহ তোমাদের গত রাতের বরকত দান করুন। সেই রাতেই উম্মু সুলাইম গর্ভবতী হন। গর্ভের এই সন্তান প্রসব করার পর উম্মু সুলাইম তাকে আনাসের হাতে রাসূলুল্লাহর সা. নিকট পাঠান। রাসূল সা. একটু খেজুর চিবিয়ে শিশুর গালে দেন এবং সে মুখ নেড়ে একটু চুষতে থাকে। তাই দেখে তিনি বললেনঃ দেখ, আনসারদের খেজুরের প্রতি স্বভাবগত টান রয়েছে। তিনি এই শিশুর নাম রাখে ’আবদুল্লাহ। রাসূলুল্লাহর সা. এই পবিত্র লালার বদৌলতে উত্তরকালে এই ছেলে অন্যান্য আনসার নওজোয়ানদের মধ্যে সর্বক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেন। এই ’আবদুল্লাহর মাধ্যমে আবু তালহার বংশধারা চলেছে। ইসহাক ও ’উবাইদুল্লাহ নামে তাঁর ছিল দুই ছেলে, আর ইয়াহইয়া নামে ইসহাকের এক ছেলে। এঁরা সবাই ছিলেন তাঁদের যুগের অন্যতম হাদীস বিশারদ। (মুসনাদে আহমাদ- ৩/২৫৭, তারীখ ইবন ’আসাকির- ৬/৬, বুখারী ও মুসলিমেও বিভিন্নভাবে উপরোক্ত ঘটনা বর্ণিত হয়েছে।)
হযরত আবু তালহার মৃত্যুসন সম্পর্কে মতভেদ আছে। ইমাম নাওয়াবী বলেনঃ ‘তিনি হিজরী ৩২ অথবা ৩৪ সনে ৭০ বছর বয়সে মদীনায় মারা যান। তাঁর মদীনায় মৃত্যুর কথা অধিকাংশ সীরাত বিশেষজ্ঞ বলেছেন। তবে আবু যুর’য়া আদ-দিমাশ্কী বলেছেন, তিনি শামে মারা গেছেন। আবার কেউ বলেছেন, তিনি সমুদ্র পথে অভিযানে বেরিয়ে মারা যান। আবু যুর’য়া আদ-দিমাশকী থেকে বর্ণিত হয়েছে, আবু তালহা রাসূলুল্লাহর সা. ইনতিকালের পর চল্লিশ বছর একাধারে রোযা রেখে জীবন কাটান। এই বর্ণনা উপরে উল্লেখিত মৃত্যুসনের পরিপন্থী। কারণ, তিনি যদি হিজরী ৩২ অথবা ৩৪ সনে মারা যান তাহলে রাসূলুল্লাহর সা. ওফাতের পর ৪০ বছর রোযা রেখে বাঁচার প্রশ্নই ওঠে না। যাঁরা বলেছেন তিনি মদীনায় মারা গেছেন, তাঁরা একথাও বলেছেন যে, খলীফা হযরত ’উসমান রা. তাঁর জানাযার নামায পড়ান। (তাহজীবুল আসমা ওয়াল লুগাত- ১/৪৪৫, ৪৪৬)
বসরাবাসীরা বলেন, তিনি শেষ জীবনে সমুদ্র পথে অভিযানে বেরিয়ে পথিমধ্যে মারা যান। এই মতে তাঁর মৃত্যুসন হিজরী ৫১। বিভিন্ন গ্রন্থে আবু তালহার এই জিহাদে যাওয়ার চমকপ্রদ ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায়। একদিন সূরা ‘তাওবাহ’ তিলাওয়াত করছেন। যখন ‘ইনফিরূ খিফাফান ওয়া সিকালান’- অভিযানে বের হয়ে পড়, ভারি অবস্থায় হোক অথবা হালকা অবস্থায় (আয়াত ৪১)- এ পর্যন্ত পৌঁছেন তখন তাঁর মধ্যে জিহাদের প্রবল উদ্দীপনা সৃষ্টি হয। তিনি পরিবারের লোকদের বললেনঃ আল্লাহ যুবক-বৃদ্ধ সকলের ওপর জিহাদ ফরয করেছেন। আমি জিহাদে যেতে চাই, তোমরা আমার সফরের ব্যবস্থা কর। একথা দুইবার উচ্চারণ করেন। একেতো বার্ধক্য, তাছাড়া ক্রমাগত সিয়াম পালন করতে করতে তিনি শীর্ণকায় ও দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। পরিবারের লোকেরা বললোঃ আল্লাহ আপনার ওপর রহম করুন। আপনি রাসূলুল্লাহর সা. যুগের সকল যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, আবু বকর ও ’উমারের যুগেও ধারাবাহিকভাবে জিহাদে লিপ্ত থেকেছেন। এখনও আপনার জিহাদের লোভ আছে? আপনি বাড়ীতে থাকুন, আমরা আপনার পক্ষ থেকে জিহাদে বেরিয়ে পড়ছি। শাহাদাতের অদম্য আবেগ যাঁকে ধাক্কাচ্ছে তাঁকে ঠেকাচ্ছে কে? বললেনঃ আমি যা বলছি তাই কর। নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাঁর সফরের ব্যবস্থা করা হয়। সত্তুর বছরের এই বৃদ্ধ আল্লাহর নাম নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েন। মুসলিম বাহিনী প্রস্তুত ছিল। অভিযানটি ছিল সাগর পথে। আবু তালহাজাহাজে চড়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন। তীব্র প্রতীক্ষা, কখন শত্রুসেনার মুখোমুখি হবেন। এমন সময় তাঁর ডাক এসে যায়। তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
সাগর পথে কোথাও একটু ভূমির চিহ্ন দেখা গেল না। প্রবল বায়ু ও বিক্ষুব্ধ সাগর জাহাজটি অজানা লক্ষ্যের দিকে ঠেলে নিয়ে গেল। এই মুমিন মুজাহিদের লাশ সাত দিন জাহাজের ডেকে পড়ে রইল। অবশেষে একটি অজানা দ্বীপ পাওয়া গেল এবং সেখানেই দাফন করা হলো এত দিনেও লাশে পচন ধরেনি বা সামান্য বিকৃতি ঘটেনি। (তাবাকাত- ৩/৫০৭, তারীখু ইবন ’আসাকির- ৬/৭, তারীখুর ইসলাম ওয়া তাবাকাতুল মাশাহীর- ২/১২০, উসুদুল গাবা- ৫/২৩৫, আনসাবুল আশরাফ- ১/২৪২)
হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে আবু তালহা অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করতেন। তাঁর বর্ণিত হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে আবু তালহা অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করতেন। তাঁর বর্ণিত হাদীস সমূহে বিভিন্ন মাসয়ালা অথবা যুদ্ধ-বিগ্রহের আলোচনা থাকতো। দীর্ঘ দিন তিনি রাসূলুল্লাহ সা. সাহচর্য লাভে ধন্য হয়েছেন, অথবা ’আমলের ফজীলাত বিষয়ক কোন বর্ণনা তাঁর থেকে পাওয়া যায় না। তাঁর বর্ণিত হাদীসের মোট সংখ্যা ৯২ টি (বিরানব্বই)। তার মধ্যে বুখারী ও মুসলিম প্রত্যেকে একটি করে হাদীস বর্ণনা করেছেন। ’আবদুল্লাহ ইবন ’আব্বাস ও আনাস ইবন মালিকসহ সাহাবীদের একটি দল এবং বিশিষ্ট তাবে’ঈদের একটি দলও তাঁর নিকট থেকে হাদীস শুনেছেন ও বর্ণনাও করেছেন। (তাহজীবুল আসমা- ১/৪৪৫, তারিখে ইবন ’আসাকির- ৬/৪)
হযরত আবু তালহার এক দল ছাত্র ও ভক্ত একবার তাঁর অসুস্থ অবস্থায় দেখতে
আসলো। তারা দেখলো, দরযায় একটি ছবিযুক্ত পর্দা টাঙ্গানো। তারা পরস্পর
পরস্পরের দিকে তাকাতে লাগলো। একটু সাহস করে যায়িদ ইবন খালিদ বলেই ফেললেনঃ
গতকাল তো আপনি ছবি নিষিদ্ধ হওয়া সম্পর্কি হাদীস বর্ণনা করলেন। তিনি
’উবাইদুল্লাহ খাওলানীকে বললেনঃ হাঁ, তা করেছিলাম। তবে এ কথাও তো বলেছিলাম,
কাপড়ে যে ছবি থাকে তা এর আওতায় পড়বে না। (মুসনাদ- ৪/২৮)
একদিন আবু তালহা আহার করছেন। সাথে উবাই ইবন কা’ব এবং আনাস ইবন মালিকও আছেন।
আহার শেষে আনাস অজুর জন্য পানি চাইলেন। আবু তালহা ও ’উবাই দুই জনই বললেনঃ
গোশত খাওয়ার কারণে হয়তো অজুর কথা মনে হয়েছে? আনাস বললেনঃ জী হাঁ! আবু তালহা
বললেনঃ তোমরা ‘তায়্যিবাত’- পবিত্র বস্তুসমূহ খেয়ে অজু করছো অথচ রাসূল সা.
এমনটি করতেন না। (মুসনাদ- ৪/৩)
আবু তালহা একদিন নফল রোযা রেখেছিলেন। ঘটনাক্রমে সেই দিনই বরফ পড়েছিল। তিনি কয়েকটি তুষার খন্ড হাতে নিয়ে খেয়ে ফেলেন। ‘আপনি তো রোযার মধ্যে খাচ্ছেন’- লোকেরা এ কথা বললে তিনি মন্তব্য করেনঃ এ একটা রবকত, এ কিছু অর্জন করা উচিত। এ কোন খাদ্যও নয়, পানীয়ও নয়।’ (মুসনাদ- ৩/২৭৯, তারিখু ইবন ’আসাকির- ৬/১০)
হযরত আবু তালহার মধ্যে কাব্য-প্রীতি ও প্রতিভা ছিল। তিনি কবিতা রচনা
করতেন, আবৃত্তিও করতেন। প্রচন্ড যুদ্ধের সময় তিনি গুন গুন করে কবিতার
পংক্তি আওড়াতেন। সীরাতের বিভিন্ন গ্রন্থে তাঁর কিছু পংক্তি সংকলিত হয়েছে।
(দ্রঃ আল-ইসাবা- ৪/১১৩, তারিখু ইবন ’আসাকির- ৬/৭, আল-ইসতীয়াব)
হযরত আবু তালহার চরিত্রের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হুব্বে রাসূল- বা
রাসূলুল্লাহর সা. প্রতি গভীর প্রেম ও ভালোবাসা। যুদ্ধের ময়দানে শত্রু
পক্ষের প্রচন্ড আক্রমণে যখন সাথীরা বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছে তখনও তিনি
রাসূলুল্লাহর সা. জন্য নিচের জীবনকে বাজি রেখে রুখে দাঁড়িয়েছেন। নিজের
গোটাদেহ আঁড় করে দিয়ে তাঁকে হিফাজত করেছেন। প্রিয় নবীর গায়ে যেন আঁচড় লাগতে
না পারে- এই আশায় তীর-বর্শার আঘাত নিজের বুকে ধারণ করেছেন। তাঁর প্রেমের
গভীরতা এর দ্বারাই কিছুটা মাপা যায়। তিনি সাধারণতঃ সকল অভিযানে
রাসূলুল্লাহর সা. সাথে থাকতেন এবং দুই জনের উটও প্রায় পাশাপাশি চলতো।
একবার মদীনায় শত্রুর আক্রমণের ভীতি ছড়িয়ে পড়ে। হযরত রাসূলে কারীম সা. আবু তালহার ‘মানদূর’ নামক ঘোড়াটি চেয়ে নিলেন এবং যে দিক থেকে শত্রুর আক্রমণের আশঙ্কা ছিল সেই দিকেই যাত্রা করলেন। আবু তালহাও রাসূলুল্লাহর সা. নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে পিছনে পিছনে চললেন। কিন্তু তাঁর পৌঁছতে না পৌঁছতেই রাসূল সা. আবার ফিরে আসলেন এবং পথে আবু তালহার সাথে দেখা হয়ে গেল। তিনি আবু তালহাকে বললেনঃ সেখানে কিছু না। তোমার ঘোড়াটি খুব দ্রুতগতি সম্পন্ন।
হযরত রাসূলে কারীমের সা. প্রতি যে তাঁর গভীর ভালোবাসা ছিল, খুব ছোট ছোট ব্যাপারেও তা প্রকাশ পেত। তাঁর বাড়ীতে কোন জিনিস এলে তার কিছু রাসূলুল্লাহর সা. বাড়ীতেও পাঠিয়ে দিতেন। একবার হযরত আনাস একটি খরগোশ ধরে আনলেন। আবু তালহা খরগোশটি জবেহ করে তার একটি রান নবীগৃহে পাঠিয়ে দিলেন। একবার আবু তালহার স্ত্রী উম্মু সুলাইম এক থালা খেজুর পাঠালেন। রাসূল সা. খেজুরগুলি আযওয়াজে মুতাহ্হারাত ও অন্যান্য সাহাবীদের মধ্যে ভাগ করে দিলেন। (মুসনাদ- ৩/১২৫, ১৭১)
হযরত রাসূলে কারীমের সা. শেষ রোগ যন্ত্রণায়- যাতে তিনি ইন্তিকাল করেন,
একদিন আবু তালহা গেলেন তাঁকে দেখতে। রাসূল সা. তাঁকে বললেনঃ তোমার কাওমকে
(আনসার) আমার সালাম বলবে। কারণ, তারা যা বৈধ ও উচিত নয় তা থেকে নিজেদেরকে
দূরে রাখে এবং ধৈর্য ধারণ করে। (হায়াতুস সাহাবা- ১/৪০১)
আবু তালহা বরেনঃ আমি একদিন রাসূলুল্লাহর সা. কাছে গেলাম। তখন তাঁর চামড়া ও
চেহারায় এমন এক অবস্থা দেখলাম যা এর পূর্বে আর কখনও দেখিনি। ইয়া
রাসূলুল্লাহ! এমন অবস্থায় আমি আপনাকে আর কক্ষণও দেখিনি। বললেনঃ আবু তালহাঃ
এমন অবস্থা হবে না কেন। এইমাত্র জিবরীল বেরিয়ে গেলেন। তিনি আমার রবের পক্ষ
থেকে সুসংবাদ নিয়ে এসেছিলেন। তিনি বলে গেলেনঃ আল্লাহ আমাকে আপনার কাছে এই
সুসংবাদ দিয়ে পাঠিয়েছেন যে, আপনার উম্মাতের কেউ আপনার ওপর একবার দরুদ ও
সালাম পেশ করলে আল্লাহ ও তাঁর ফিরিশতাগণ তার ওপর দশবার দরূদ ও সালাম পাঠ
করবেন। (উসুদুল গাবা- ৫/২৩৫) আহমাদ ও নাসাঈ অন্যভাবে হাদীসটি বর্ণনা
করেছেন। তাতে আছে, জিবরীল বললেন, আপনার উম্মাতের মধ্যে যে ব্যক্তি আপনার
ওপর দরূদ ও সালাম পাঠ করবে আল্লাহ তার জন্য ১০ টি নেকী লিখবেন, তার ১০ টি
গুনাহ মাফ করবেন এবং তার ১০ টি মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন। (হায়াতুস সাহাবা-
৩/৩১৩)
মদ হারাম হওয়ার পূর্বে একদিন তিনি খেজুর থেকে তৈরী ‘ফাদীখ’ নামক এক প্রকার মদ পান করেছিলেন। এমন সময় এক ব্যক্তি এসে খবর দিল, মদ হারাম ঘোষিত হয়েছে। সাথে সাথে তিনি আনাসকে বললেনঃ মদের এই কলসটি ভেঙ্গে ফেল। আনাস নির্দেশ পালন করলেন। (বুখারী- ২/১০৭)
যখন সূরা আলে ইমরানের এই আয়াত- ‘তোমরা কোন কল্যাণই লাভ করতে পারবে না যতক্ষণ না তোমরা এমন সব জিনিস (আল্লাহর রাস্তায়) খরচ কর যা তোমাদের নিকট সর্বাধিক প্রিয়’- নাযিল হলো তখন আনসারদের যার কাছে যে সব মূল্যবান জিনিস ছিল সবই রাসূলুল্লাহর সা. নিকট নিয়ে গেল এবং আল্লাহর রাস্তায় বিলিয়ে দিল। আবু তালহা রাসূলুল্লাহর সা নিকট উপস্থিত হয়ে তাঁর ‘বীরাহ’ নামক বিশাল ভূ-সম্পত্তি আল্লাহর রাস্তায় ওয়াক্ফ করে দিলেন। এখানে তাঁর একটি কুয়ো ছিল। কুয়োটির পানি ছিল সুস্বাদু এবং রাসূল সা. এর পানি খুব পছন্দ করতেন। আবু তালহার এই দানে রাসূল সা. খুব খুশী হয়েছিলেন। (শাজারাতুজ জাহাব- ১/৪০, তারীখু ইবন ’আসাকির- ৬/৮, হায়াতুস সাহাবা- ২/১৫৭)
আবদুল্লাহ ইবন আবী বকর থেকে বর্ণিত। একদিন আবু তালহা তাঁর একটি বাগিচার দেয়ালের পাশে নামাযে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এমন সময় একটি ছোট্ট পাখি- এদিক ওদিক উড়ে বেরোনোর পথ খুঁজতে থাকে; কিন্তু ঘন খেজুর গাছের জন্য বেরোনোর পথ পেল না। আবু তালহা নামাযে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ এই তামাশা দেখলেন। এদিকে নামায কত রাকায়াত পড়েছেন তা আর স্মরণ করতে পারলেন না। ভাবলেন, এই সম্পদই আমাকে ফিতনায় (বিপর্যয়ে) ফেলেছে। নামায শেষ করে তিনি ছুটে গেলেন রাসূলুল্লাহর সা. কাছে। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বললেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ! এ সবই আমি সাদাকা (দান) করে দিলাম। এই সম্পদ আপনি আল্লাহর পথে কাজে লাগান। রাসূল সা. তাঁকে বললেনঃ এই সম্পদ তোমার নিকট আত্মীয়দের মধ্যে বন্টন করে দাও। নির্দেশমত তিনি যাঁদের মধ্যে বন্টন করে দেন তাঁদের মধ্যে হাসসান ইবন সাবিত ও উবাই ইবন কা’বও ছিলেন। (তারীখু ইবন ’আসাকির- ৬/৮, হায়াতুস সাহাবা- ৩/৯৭, মুসনাদে আহমাদ- ৩/১৪১)
একবার এক ব্যক্তি মদীনায় এলো, সেখানে থাকা-খাওয়ার কোন সংস্থান তার ছিল না। রাসূল সা. ঘোষণা করলেন, যে এই লোকটিকে অতিথি হিসেবে গ্রহণ করবে আল্লাহ তার ওপর সদয় হবেন। আবু তালহা সাথে সাথে বললেনঃ আমিই নিয়ে যাচ্ছি। বাড়ীতে ছোট ছেলে-মেয়েদের খাবার ছাড়া অতিরিক্ত কোন খাবার ছিল না। আবু তালহা স্ত্রীকে বললেনঃ এক কাজ কর, তুমি ভুলিয়ে-ভালিয়ে বাচ্চাদের ঘুম পাড়াও। তারপর মেহমানের সামনে খাবার হাজির করে কোন এক ছুতোয় আলো নিভিয়ে দাও। অন্ধকারে আমরা খাওয়ার ভান করে শুধু মুখ নাড়াচাড়া করবো, আর মেহমান একাই পেট ভরে খেয়ে নেবে। যেই কথা সেই কাজ। স্বামী-স্ত্রী মেহমানকে পরিতৃপ্তি সহকারে আহার করালেন; কিন্তু ছেলে-মেয়ে সহ নিজেরা উপোস থাকলেন। সকালে আবু তালহা আসলেন রাসূলুল্লাহর সা. নিকট। তিনি ‘তাদের তীব্র প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও তারা অন্যকে নিজেদের ওপর প্রাধান্য দান করে’ (সূরা হাশর- ৯)
– এই আয়াতটি তাঁকে পাঠ করে শোনান। তারপর আবু তালহাকে বলেন, অতিথির সাথে তোমাদের রাতের আচরণ আল্লাহর খুব পছন্দ হয়েছে। (মুসলিম- ২/১৯৮, হায়াতুস সাহাবা- ২/১৬০, ১৬১)
নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা ছিল আবু তালহার বিশেষ গুণ। খ্যাতি ও প্রদর্শনী থেকে তিনি সব সময় দূরে থাকতেন। ‘বীরাহা’ সম্পত্তি দান করার সময় তিনি কসম খেয়ে রাসূলুল্লাহকে সা. বললেন, একথা যদি গোপন রাখতে সক্ষম হতাম তাহলে কক্ষণও প্রকাশ করতাম না। (মুসনাদ- ৩/১১৫)
আবু তালহা ছিলেন বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বরের অধিকারী। আনাস রা. বলেনঃ রাসূল সা. বলতেন, সৈন্যদের মধ্যে আবু তালহার একটি জোর আওয়ায একদল সৈনিক থেকেও উত্তম। অন্য বর্ণনা মতে ‘এক হাজার মানুষের চেয়েও উত্তম।’ অন্য একটি বর্ণনায় এসেছেঃ ‘মুশরিকদের জন্য আবু তালহার একটি হুংকার একদল সৈন্যের চেয়েও ভয়ংকর।’ (তারীখুল ইসলাম ওয়া তাবাকাতুল মাশাহীর- ২/১১৯, তারীখু ইবন ’আসাকির- ৬/৭, উসুদুল গাবা- ৫/২৩৫)
হযরত রাসূলে কারীম সা. আবু তালহার পরিবারের জন্য দু’আ করেছেন। (তারীখু ইবন ’আসাকির- ৬/৯) হযরত আনাস রা. বলেনঃ রাসূলুল্লাহর সা. ওফাতের পর সারা বছরই আবু তালহা রোযা পালন করতেন। শুধু দুই ’ঈদ ছাড়া কখনও রোযা ত্যাগ করতেন না। কারণ রাসূলের সা. জীবদ্দশায় সব সময় জিহাদে ব্যস্ত থাকায় তখন রোযা রাখতে পারতেন না। (তাহজীবুল আসমা- ১/২৪৬)
ইবন হাজার ‘আল-ইসাবা’ গ্রন্থে আবু তালহার সম্মান ও মর্যাদার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন এই বলে, তিনি ছিলেন উঁচু স্তরের মর্যাদাবান সাহাবীদের অন্যতম।