আনাস ইবন মালিক ছিলেন বিখ্যাত সাহাবী, খাদিমে রাসূল, ইমাম, মুফতী,
মু’য়াল্লিমে কুরআন, মুহাদ্দিস, খ্যাতিমান রাবী, আনসারী, খাযরাজী ও মাদানী।
কুনিয়াত আবু সুমামা ও আবু হামযা। খাদিমু রাসূলিল্লাহ লকব বা উপাধি।
(দায়িরা-ই-মা’য়ারিফ ইসলামিয়া- ৩/৪০২, তাজকিরাতুল হুফ্ফাজ- ১/৪৪) আনাস
বলতেনঃ আমি ‘হামযা’ নামক এক প্রকার সব্জী খুটতাম, তাই দেখে রাসুল সা. আদর
করে আমাকে ডাকেনঃ ‘ইয়া আবা হামযা’। সে দিন থেকে এটাই আমার কুনিয়াত বা
ডাকনাম হয়ে যায়। (তারীখে ইবন ’আসাকির- ৩/১৪১) ইয়াসরিবের (আল-ইসাবা- ১/৭১)
বিখ্যাত খাযরাজ গোত্রের বনু নাজ্জার শাখায় হিজরাতের দশ বছর পূর্বে ৬১২
খ্রীস্টাব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করে। (আল-আ’লাম- ১/৩৬৫, আল-ইসাবা- ১/৭১) এই
গোত্রটি ছিল আনসারদের মধ্যে সর্বাধিক সম্মানিত। আনাসের পিতা মালিক ইবন নাদর
এবং মাতা উম্মু সুলাইম সাহলা বিনতু মিলহান আল-আনসারিয়্যা। উম্মু সুলাইম
সম্পর্কে রাসূলুল্লাহর সা. খালা হতেন। রাসূলুল্লাহর সা. দাদা আবদুল
মুত্তালিবের মা সালমা বিনতু ’আমর-এর নসব ’আমির ইবন গানাম- এ গিয়ে আনাসের
মার বংশের সাথে মিলিত হয়েছে। (উসুদুল গাবা- ১/১২৭, আসাহহুস সীয়াব- ৬০৬)
উম্মু সুলাইমের আসল নামের ব্যাপারে মতভেদ আছে। যেমনঃ সাহলা, রুমাইলা, রুমাইসা, সুলাইকা, আল-ফায়সা ইত্যাদি। (সীরাতু ইবন হিশাম- ২/৩৪০)
আনাসের
চাচা আনাস ইবন নাদর উহুদ যুদ্ধে শহীদ হন। কাফিররা কেটে কুটে তাঁর দেহ
বিকৃত করে ফেলেছিল। তাঁর দেহে মোট আশিটি আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। তাঁর এক
বোন ছাড়া আর কেউ সে লাশ সনাক্ত করতে পারেনি। আনাস বলতেন, আমার এই চাচা
আনাসের নামেই আমার নাম রাখা হয়েছিল। (সীরাতু ইবন হিশাম- ২/৮৩, হায়াতুস
সাহাবা- ১/৫০৪, ৫০৫) আনাসের মামা হারাম ইবন মিলহান বি’রে মা’উনার দুঃখজনক
ঘটনায় শাহাদাত বরণ করেন। (দায়িরা-ই-মা’য়ারিফ ইসলামিয়্যা- ৩/৪০২)
আনাসের
বয়স যখন আট/নয় বছর তখন তাঁর মা ইসলাম গ্রহণ করে। এ কারণে তাঁর পিতা ক্ষোভ ও
ঘৃণায় শামে চলে যায় এবং সেখানে কুফরী অবস্থায় মারা যায়। মা আবু তালহাকে
দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন। আবু তালহা ছিলেন খাযরাজ গোত্রের একজন বিত্তশালী
ব্যক্তি। মা বালক আনাসকেও সাথে করে আবু তালহার বাড়ীতে নিয়ে যান। আনাস
এখানেই প্রতিপালিত হন।
আবু তালহার সাথে তাঁর মার বিয়ে সম্পর্কে আনাস
বর্ণনা করেছেনঃ আবু তালহা যখন উম্মু সুলাইমকে বিয়ের প্রস্তাব দেন তখনও তিনি
ইসলাম গ্রহণ করেননি। উম্মু সুলাইম বললেনঃ আবু তালহা, তুমি কি জাননা, যে
ইলাহ-র ইবাদাত তুমি কর তা মাটি দিয়ে তৈরী? বললেনঃ হাঁ, তা জানি। উম্মু
সুলাইম আরও বললেনঃ একটি গাছের ইবাদাত করতে তোমার লজ্জা হয় না? তুমি যদি
ইসলাম গ্রহণ কর, তোমাকে বিয়ে করতে আমার আপত্তি নেই এবং তোমার কাছে
কোনমোহরের দাবীও আমার থাকবে না। ‘আমি ভেবে দেখবো’- এ কথা বলে আবু তালহা উঠে
গেলেন। পরে ফিরে এসে তিনি উচ্চারণ করলেনঃ ‘আশহাদু আন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ- আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন ইলাহ নেই, মুহাম্মাদ
আল্লাহর রাসূল। তখন উম্মু সুলাইম ছেলে আনাসকে ডেকে বললেনঃ আনাস, তুমি আবু
তালহার বিয়ের কাজটি সমাধা কর। আনাস তাঁর মাকে আবু তালহার সাথে বিয়ে দিলেন।
(হায়াতুস সাহাবা- ১/১৯৫, ১৯৬)
মদ হারাম হওয়ার পূর্বে আবু তালহার বাড়ীতে
মদ পানের আসর বসতো। বালক আনাস সেই আসরে সাকীর দায়িত্ব পালন করতেন এবং নিজেও
মদের অভ্যাস করতেন। এই বালককে মদ পান থেকে বিরত রাখার কেউ ছিল না।
(মুসনাদ- ৩/১৮১)
আনাসের বয়স যখন আট/নয় বছর তখন মদীনায় ইসলামের প্রচার
শুরু হয়ে যায়। ইসলাম কবুলের ব্যাপারে বনু নাজ্জার গোত্র সবার আগে ভাগেই
ছিল। এই খান্দানের বেশীর ভাগ সদস্য রাসূলুল্লাহর সা. মদীনায় আসার পূর্বেই
ইসলাম গ্রহণ করেন। আনাসের মা উম্মু সুলাইম ও তৃতীয় আকাবার পূর্বেই ইসলাম
গ্রহণ করেন। পূর্বেই বলা হয়েছে উম্মু সুলাইম ইসলাম গ্রহণ করায় তাঁর স্বামী
অর্থাৎ আনাসের পিতা স্ত্রী ও সন্তান ত্যাগ করে শামে চলে যায়। স্বামী
পরিত্যক্তা উম্মু সুলাইম আবু তালহাকে বিয়ে করতে রাজী হন এই শর্তে যে, তিনিও
ইসলাম গ্রহণ করবেন। এভাবে উম্মে সুলাইমের চেষ্টায় আবু তালহা ইসলাম গ্রহণ
করে মক্কায় যান এবং তৃতীয় ’আকাবায় শরীক হয়ে রাসূলুল্লাহর হাতে সা. বাইয়াতের
গৌরব অর্জন করেন। এভাবে আনাসের বাড়ী ঈমানের আলোয় আলোকিত হয়ে যায়। তাঁর
জান্নাতী মা উম্মু সুলাইম ইসলামের এক আলোক বর্তিকা, আর তাঁর স্বামী দ্বীনের
এক নিবেদিত প্রাণ কর্মী। এমনই এক আশ্রয়ে আনাস বেড়ে ওঠেন।
আনাস যখন দশ
বছরের বালক তখন হযরত রাসূলে কারীম সা. মদীনায় আসেন। আনাসের বয়স অল্প হলেও
তিনি খুবই উৎসাহী ছিলেন। রাসুল সা. যখন কুবা থেকে মদীনার দিকে আসছিলেন,
সমবয়সী ছোট ছেলে-মেয়েদের সাথে পথের পাশে দাঁড়িয়ে আনাসও স্বাগত সংগীত
গেয়েছিলেন, তাঁরা ছুটে ছুটে ‘রাসূলুল্লাহ এসেছেন, মুহাম্মাদ এসেছেন’- বলে
মদীনাবাসীদের ঘরে ঘরে রাসূলুল্লাহর সা. আগমন বার্তা পৌঁছে দিয়েছিলেন। এক
সময় রাসূলুল্লাহর সা. পাশ থেকে ভীড় একটু কম হলে আনাস তাঁর চেহারা মুবারকে
প্রতি দৃষ্টিপাত করেন এবং সাহাবিয়্যাতের মর্যাদা লাভে ধন্য হন।
হযরত
রাসূলে কারীম সা. যখন মদীনায় আসেন প্রসিদ্ধ মতে আনাসের বয়স তখন দশ বছর।
রাসুল সা. একটু স্থির হওয়ার পর আনাসের মা একদিন তাঁর হাত ধরে রাসূলুল্লাহর
সা. কাছে নিয়ে যান। এ সম্পর্কে আনাস বলেনঃ আমার মা আমার হাত ধরে
রাসূলুল্লাহর সা. কাছে নিয়ে গিয়ে বললেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ! আনসারদের
প্রত্যেক নারী-পুরুষ আপনাকে কিছু না কিছু হাদিয়া দিয়েছে। আমি তো তেমন কিছু
দিতে পারছিনে। আমার এই ছেলেটি আছে, সে লিখতে জানে। এখনও সে বালেগ হয়নি।
আপনি একেই গ্রহণ করুন। সে আপনার খিদমাত করবে। সেই দিন থেকে আমি একাধারে দশ
বছর যাবত রাসূলুল্লাহর সা. খিদমাত করেছিল। এর মধ্যে কখনও তিনি আমাকে
মারেননি, গালি দেননি, বকাঝকা করেননি এবং মুখও কালো করেননি। তিনি সর্বপ্রথম
আমাকে এই অসীয়াতটি করেনঃ ছেলে, তুমি আমার গোপন কথা গোপন রাখবে। তা হলেই
তুমি ঈমানদার হবে। আমার মা এবং রাসূলুল্লাহর সা. সহধর্মিনীগণ কখনও আমার
কাছে রাসূলে সা. গোপন কথা জিজ্ঞেস করলে, বলিনি। আমি তাঁর কোন গোপন কথা কারও
কাছে প্রকাশ করিনি। অবশ্য কোন কোন বর্ণনায় এসেছে, আবু তালহা তাঁকে
রাসূলুল্লাহর সা. নিকট নিয়ে যান। (তারীখে ইবন ’আসাকির- ৩/১৪১, আনসাবুল
আশরাফ- ১/৫০৬, আল-ইসাবা- ১/৭১)
হযরত আনাস রাসূলুল্লাহর সা. জীবনের শেষ
দিন পর্যন্ত প্রায় দশ বছর অত্যন্ত যোগ্যতার সাথে তাঁর খিদমাতের দায়িত্ব
পালন করেন। এ জন্য তাঁর গর্বের শেষ ছিল না। ফজর নামাযের পূর্বেই তিনি
রাসূলুল্লাহর সা. খিদমাতে হাজির হয়ে দুপুরে বাড়ী ফিরতেন। কিছুক্ষণ পর আবার
আসতেন এবং আসরের নামায আদায় করে বাড়ী ফিরতেন। আনাসের মহল্লায় একটি মসজিদ
ছিল, সেখানে মুসল্লীরা তাঁর অপেক্ষায় থাকতো। তাঁকে দেখে তারা আসরের নামাযে
দাঁড়াতো। (মুসনাদে আহমাদ- ৩/২২২)
উপরোক্ত সময় ছাড়াও তিনি সব সময়
রাসূলুল্লাহর সা. যে কোন নির্দেশ পালনের জন্য প্রস্তুত থাকতেন। যখনই
প্রয়োজন পড়তো রাসূলুল্লাহর সা. ডাকে সাড়া দিতেন। এক দিনের ঘটনা, তিনি
রাসূলুল্লাহর সা. প্রয়োজনীয় কাজ সেরে দুপুরে বাড়ীর দিকে চলেছেন। পথে
দেখলেন, তাঁরই সমবয়সী ছেলেরা খেলছে। তাঁর কাছে খেলাটি ভালো লাগলো। তিনি
দাঁড়িয়ে গেলেন তাদের খেলা দেখতে। কিছুক্ষণ পর দেখলেন, রাসূল সা. তাদের দিকে
আসছেন। তিনি এসে প্রথমে ছেলেদের সালাম দিলেন, তারপর আনাসের হাতটি ধরে
তাঁকে কোন কাজে পাঠালেন। আর রাসূল সা. তাঁর অপেক্ষায় একটি দেয়ালের ছায়ায়
দাঁড়িয়ে থাকলেন। আনাস কাজ সেরে ফিরে এলে রাসুল সা. বাড়ীর দিকে ফিরলেন, আর
তিনি চললেন বাড়ীর দিকে। ফিরতে বিলম্ব হওয়ায় তাঁর মা জিজ্ঞেস করলেন, এত দেরী
হলো কেন? তিনি বললেনঃ রাসূলুল্লাহর সা. একটি গোপন কাজে গিয়েছিলাম। এই জন্য
ফিরতে দেরী হয়েছে। মা মনে করলেন, ছেলে হয়তো সত্য গোপন করছে, এই জন্য জানতে
চাইলেনঃ কী কাজ? আনাস জবাব দিলেন একটি গোপন কথা, কাউকে বলা যাবেনা। মা
বললেনঃ তাহলে গোপনই রাখ কারও কাছে প্রকাশ করোনা। আনাস আজীবন এ সত্য গোপন
রেখেছেন। একবার তাঁর বিশিস্ট ছাত্র সাবিত যখন সেই কথাটি জানতে চাইলেন তখন
তিনি বললেন, কথাটি কাউকে জানালে তোমাকেই জানাতাম। কিন্তু আমি তা কাউকে বলবো
না। (আল-ফাতহুর রাব্বাবী মা’য়া বুলুগুল আমানী- ২২/২০৪, হায়াতুস সাহাবা-
১/৩৪৩, ২/৫০৩)
হযরত আনাস সব সময় রাসূলুল্লাহর সা. সংগে থাকতেন।
আবাসে-প্রবাসে, ভিতরে-বাহিরে কোন বিশেষ স্থান বা সময় তাঁর জন্য নির্ধারিত
ছিলনা। হিজাবের আয়াত নাযিল হওয়ার পূর্বে তিনি স্বাধীনভাবে রাসূলুল্লাহর সা.
গৃহে যাতায়াত করতেন। আনাস বলেনঃ আমি রাসূলুল্লাহর সা. গৃহে আসতাম এবং
অন্দর মহলে আযওয়াজে মুতাহ্হারাতদের কাছেও যেতাম। একদিন আমি অন্দরে প্রবেশ
করতে যাব, এমন সময় রাসূল সা. ডাকলেনঃ আনাস, পিছিয়ে এস। হিজাবের আয়াত নাযিল
হয়ে গেছে। (আনসাবুল আশরাফ- ১/৪৬৪) আনাস আরও বলেনঃ আমি যে দিন বালেগ হলাম,
রাসূলকে সা. সে কথা জানালাম। তিনি বললেনঃ এখন থেকে অনুমতি ছাড়া মেয়েদের
কাছে যাবেনা। আনাস বলেনঃ সেই দিনটির মত কঠিন দিন আমার জীবনে আর আসেনি।
(তারীখে ইবন ’আসাকির- ৩/১৪৪)
একদিন ফজরের নামাযের পূর্বে রাসূল সা.
বললেন, আজ রোযা রাখার ইচ্ছা করেছি, আমাকে কিছু খাবার দাও। আনাস খুব
তাড়াতাড়ি কিছু খুরমা ও পানি হাজির করেন। রাসুল সা. তাই দিয়ে সেহরী সেরে
ফজরের নামাযের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। (মুসনাদ- ৩/১৯৭) ওয়াকিদী বলেনঃ
রাসূলুল্লাহর সা. খাদিমদের মধ্যে যাঁরা তাঁর দরজা থেকে দূরে যেত না তাঁদের
মধ্যে আনাস একজন। আবু হুরাইরা রা. বলতেনঃ আমি তো মনে করতাম আনাস
রাসূলুল্লাহর সা. দাস। (আনসাবুল আশরাফ- ১/৪৮৫)
হযরত রাসূলে কারীম সা.
মদীনায় এসে আবু আইউব আল আনসারীর রা. অতিথি হন। সেই সময় তিনি আনাসের পিতা
মালিক ইবন নাদরের কুয়োর পানি সবচেয়ে বেশী তৃপ্তি সহকারে পান করতেন। হযরত
রাসূলে কারীম সা. আবু আইউবের বাড়ী থেকে নিজের বাড়ীতে চলে গেলে আনাস সেই
কুয়োর পানি রাসূলুল্লাহর সা. জন্য বয়ে নিয়ে আসতেন। (আনসাবুল আশরাফ- ১/৫৩৫)
হযরত
আনাস অত্যন্ত নিপুণতার সাথে রাসূলুল্লাহর সা. সকল কাজ সম্পাদন করতেন।
আনুগত্যের মাধ্যমে সর্বক্ষণ তাঁকে খুশী রাখতেন। তিনি নিজেই বলেনঃ আমি দশ
বছর যাবত রাসূলুল্লাহর সা. খিদমাত করেছি। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি কক্ষণও আমার
ওপর নারাজ হননি। আমার কোন কাজের জন্য কক্ষণও বলেননিঃ এ কাজটি তুমি কেন
করলে? আর আমি কোন কাজ করিনি সে জন্যও তিনি প্রশ্ন করেননিঃ কাজটি তুমি কেন
করনি? অথবা তুমি ভুল করেছ বা যা করেছ, খুবই খারাপ করেছ- এমন কথাও আমার কোন
ভুলের জন্য তিনি বলেননি। (আনসাবুল আশরাফ- ১/৪৬৪, ৫০৬) এভাবে আনাস
রাসূলুল্লাহর সা. অন্তরে এক বিশেষ স্থান দখল করেন। রাসুল সা. স্নেহভরে কখনও
‘ছেলে’ আবার কখনও ‘উনাইস’ বলে ডাকতেন। তিনি মাঝে মধ্যে আনাসদের বাড়ীতে
যেতেন, আহার করতেন, দুপুরের সময় হলে বিশ্রাম নিতেন, নামায আদায় করতেন এবং
আনাসের জন্য দু’আও করতেন। এ সম্পর্কিত কয়েকটি হাদীস মুসনাদে আহমাদ গ্রন্থে
বর্ণিত হয়েছে। (আল-ফাতহুর রাব্বানী-২২/২০৩)
আনাস বলেনঃ একদিন আবু তালহা
আমার মা উম্মু সুলাইমকে বললেন, আমি যেন রাসূলুল্লাহর সা. কণ্ঠস্বর একটু
দুর্বল শুনতে পেলাম। মনে হলো তিনি ক্ষুধার্ত। তোমার কাছে কোন খাবার আছে কি?
মা বললেনঃ আছে। তিনি কয়েক টুকরো রুটি আমার কাপড়ে জড়িয়ে দিয়ে আমাকে
রাসূলুল্লাহর সা. নিকট পাঠালেন। আমাকে দেখেই রাসূল সা. জিজ্ঞেস করলেনঃ আবু
তালহা পাঠিয়েছে? বললামঃ হাঁ। বললেনঃ খাবার? বললামঃ হাঁ। রাসূলসা. সাথের
লোকদের বললেনঃ তোমরা ওঠো। তাঁরা চললেন, আমিও তাদের আগে আগে চললাম। আবু
তালহা সকলকে দেখে স্ত্রীকে ডেকে বললেনঃ উম্মু সুলাইম, দেখ, রাসূল সা. লোকজন
সংগে করে চলে এসেছেন। সবাইকে খেতে দেওয়ার মত খাবার তো নেই। উম্মু সুলাইম
বললেনঃ আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সা. সে কথা ভালোই জানেন। আবু তালহা অতিথিদের
নিয়ে বসালেন। রাসূল সা. ঘরে ঢুকে বললেনঃ যা আছে নিয়ে এসো। সামান্য খাবার
ছিল, তাই হাজির করা হলো। তিনি বললেনঃ প্রথম দশজনকে আসতে বল। দশ জন ঢুকে পেট
ভরে খেয়ে বের হয়ে গেল। তারপর আর দশ জন। এ ভাবে মোট সত্তু জন লোক পেট ভরে
সেই খাবার খেয়েছিল। (হায়াতুস সাহাবা- ২/১৯৪)
আনাস আরও বলেন, আমার মা
উম্মু সুলাইমের আবু তালহার পক্ষের আবু ’উমাইর নামে একটি ছোট ছেলে ছিল।
রাসুল সা. আমাদের বাড়ীতে এলে তার সাথে একটু রসিকতা করতেন। একদিন দেখলেন আবু
’উমাইর মুখ ভার করে বসে আছে। রাসুল সা. বললেনঃ আবু ’উমাইর এমন মুখ গোমড়া
করে বসে আছ কেন? মা বললেনঃ তার খেলার সাথ ‘নুগাইর’ টি মারা গেছে। তখন থেকে
রাসুল সা. তাঁকে দেখলে কাব্যি করে বলতেনঃ ‘ইয়া আবা ’উমাইর- মা ফা’য়ালান
নুগাইর’- ওহে আবু ’উমাইর, তোমার নুগাইরটি কি করলো? উল্লেখ্য যে, ‘নুগাইর’
লাল ঠোঁট বিশিষ্ট চড়ুই- এর মত এক প্রকার ছোট্ট পাখী। (তারীখে ইবন ’আসাকির-
৩/১৩৯, হায়াতুস সাহাবা- ২/৫৭০, ৫৭১)
আনাসদের বাড়ীতে রাসূলুল্লাহর সা.
ওপর কুরআনের বহু আয়াত নাযিল হয়েছে। রাসুল সা. ওহী নাযিলের সময় ঘেমে যেতেন
আর তাঁরা সেই ঘাম সংরক্ষণ করতেন। আনাস বলেনঃ একদিন দুপুরে রাসুল সা. আমাদের
বাড়ীতে এসে বিশ্রাম নিলেন এবং ঘেমে গেলেন। আমার মা একটি বোতল এনে সেই ঘাম
ভরতে লাগলেন। রাসুল সা. জেগে উঠে বললেনঃ ’উম্মু সুলাইম, একি করছো? মা
বললেনঃ আপনার এই ঘাম আমাদের জন্য সুগন্ধি। আনাস বলতেনঃ রাসূলুল্লাহর সা.
সুগন্ধি থেকে অধিকতর সুগন্ধিযুক্ত মিশ্ক অথবা আম্বর আমার জীবনে আর শুকিনি।
(তারীখে ইবন ’আসাকির- ৩/১৪৪, ১৪৫)
আমরা আগেই বলেছি, আনাসের কল্যাণময়ী মা
সম্পর্কে রাসূলুল্লাহর সা. খালা। তিনি অন্তর দিয়ে তাঁকে ভালোবাসতেন,
ভক্তি-শ্রদ্ধা করতেন। আর রাসূলও সা. তাঁর কথা কখনও বিস্মৃত হননি। এই
সম্মানিত মহিলাকে রাসূল সা. জান্নাতের সুসংবাদ দান করেছেন।
(দায়িরা-ই-মা’য়ারিফ ইসলামিয়্যা (উর্দু)- ৩/৪০২) খাইবার যুদ্ধে হযরত
সাফিয়্যা রা. বন্দী হলেন এবং রাসুল সা. তাঁকে শাদী করার ইচ্ছা প্রকাশ
করলেন। সাফিয়্যাকে উম্মু সুলাইমের নিকট পাঠিয়ে দেওয়া হলো। তিনিই বিয়ের সকল
ব্যবস্থা সম্পদেন করলেন। এ সম্পর্কে ইবন ইসহাক বলেনঃ খাইবারে অথবা খাইবার
থেকে ফেরার পথে হযরত সাফিয়্যার সাথে রাসূলুল্লাহর সা. শাদী মুবারাক
অনুষ্ঠিত হয়। আনাসের মা উম্মু সুলাইম তাঁর সাজানো, চুল বাঁধা ইত্যাদি
যাবতীয় দায়িত্ব পালন করেন। (সীরাতু ইবন হিশাম- ২/৩৩৯, ৩৪০, আনসাবুল আশরাফ-
১/৪৪৩)
এমনিভাবে হযরত যয়নাবের সাথে যখন রাসূলুল্লাহর সা. বিয়ে হয় তখনও
উম্মু সুলাইম কিছু খাবার তৈরী করে পাঠান। রাসুল সা. সাহাবীদের দা’ওয়াত দিয়ে
একটি সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠান করে সেই খাবার পরিবেশন করেন। (মুসনাদে আহমাদ-
৩/১৬৩)
এই সব বৈশিষ্ট্যই আনাসকে নবী খান্দানের একজন সদস্যে পরিণত করে।
রাসুল সা. মাঝে মধ্যে তাঁর সাথে হালকা মিযাজ হয়ে যেতেন। এই যেমন তাঁকে
ডাকলেন ‘আবু হামযা’ বলে। একবার তো ডাকলেন ‘ইয়া জাল উজনাইন’- ওহে দুই কান
ওয়ালা বলে। (উসুদুল গাবা- ১/১২৭)
আমরা পূর্বেই দেখেছি, রাসূলুল্লাহর সা.
সাথে আনাসের কত গভীর সম্পর্ক ছিল। এই সম্পর্কে কারণেই ঘরে-বাইরে,
আবাসে-প্রবাসে সর্বক্ষণ রাসূলুল্লাহর সা. সংগে থাকতেন। যুদ্ধের ময়দানেও সেই
সংগ ত্যাগ করেননি। বদর যুদ্ধের সময় আনাসের বয়স এমন কিছু হয়নি। মাত্র বারো
বছর। তাসত্ত্বেও মুসলিম মুজাহিদদের পাশাপাশি যুদ্ধের ময়দানে উপস্থিত ছিলেন।
সেখানে তিনি রাসূলুল্লাহর সা. সেবা ও সৈনিকদের সাজ-সরঞ্জাম ও মাল-সামান
দেখার দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় বয়স অতি অল্প থাকার কারণে তাঁর এ যুদ্ধে
যোগদান সম্পর্কে পরবর্তীকালে অনেকের মনে সংশয় দেখা দিয়েছে। একবার তো সংশয়ের
সুরে এক ব্যক্তি তাঁকে প্রশ্ন করেই বসেঃ আপনি কি বদরে হাজির ছিলেন? জবাব
দিলেনঃ আমি কিভাবে গায়ের হাজির থাকতে পারি? (আল-ইসাবা- ১/৭১,
দায়িরা-ই-মা’য়ারিফ ইসলামিয়্যা- ৩/৪০২)
বদরের এক বছর পর উহুদ যুদ্ধ হয়।
তখনও আনাস অল্প বয়স্ক। হিজরী ষষ্ঠ সনে হুদাইবিয়ায় বাইয়াতে শাজারার গৌরব
অর্জন করেন। তখন তাঁর বয়স ষোল বছর। যুদ্ধের ময়দানে যাওয়ার যোগ্য হয়ে
উঠেছেন। হিজরী সপ্তম সনে রাসূল সা. ’উমরাতুল কাদা (কাজা ’উমরাহ) আদায় করেন।
আনাস সংগে ছিলেন। এ বছরই খাইবার বিজিত হয়। এই অভিযানে আনাস আবু তালহার
সাথে উটের পিঠে সাওয়ার ছিলেন। এক পর্যায়ে বিজয়ীর বেশে হযরত রাসূলে কারীম
সা. খাইবারে প্রবেশ করছিলেন তখন আনাস তাঁর এত নিকটে ছিলেন যে তাঁর পা
রাসূলে সা. পবিত্র পা স্পর্শ করে। এর ফলে রাসূলুল্লাহর সা. ইযার হাঁটুর
ওপরে উঠে যায় এবং তা মানুষের দৃষ্টিগোচর হয়। (মুসনাদ- ৩/১০২) এরপর মক্কা
বিজয়, তায়িফ ও হুনাইন অভিযানে যোগ দেন। সর্বশেষ হিজরী দশ সনে বিদায় হজ্জে
রাসূলুল্লাহর সা. সাথে ছিলেন।
আনাস বলেনঃ হুনাইন যুদ্ধের দিন আবু তালহা
হাসতে হাসতে রাসূলুল্লাহর সা. নিকট গিয়ে বললেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনি কি
দেখেছেন, উম্মু সুলাইমের হাতে খঞ্জর? রাসুল সা. বললেনঃ উম্মু সুলাইম খঞ্জর
দিয়ে কি করবে? জবাব দিলেনঃ কেউ আমার দিকে এগিয়ে এলে এটা দিয়ে আমি আঘাত
করবো। (হায়াতুস সাহাবা- ১/৫৯৭)
হযরত রাসূলে কারীমের সা. অভিযানের সংখ্যা
ছিল ২৬ অথবা ২৭ টি। তবে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে এমন অভিযানের সংখ্যা মাত্র
৯টি। যেমনঃ বদর, উহুদ, খন্দক, কুরায়জা, মুসতালিক, খাইবার, হুনাইন ও তায়িফ।
আনাস এর সব ক’টিতে উপস্থিত ছিলেন। এক ব্যক্তি আনাসের ছেলে মূসাকে জিজ্ঞেস
করেছিল, আপনার সম্মানিত পিতা কতটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন? তিনি জবাব
দিয়েছিলেনঃ আটটি যুদ্ধে। সম্ভবতঃ বদর যুদ্ধটি বাদ দিয়েছিলেন। তার কারণ এই
হতে পারে যে, সে সময় জিহাদে যাওয়ার যে বয়স নির্ধারণ করা হয়েছিল, আনাস তার
চেয়ে ছোট ছিলেন।
হযরত রাসূলে কারীমের সা. ইনতিকালের পর হযরত আবু বকর
রা. খলীফা হলেন। এ সময় ভন্ড নবীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত ইয়ামামার যুদ্ধে
আনাসের অংশগ্রহণের কথা জানা যায়। (হায়াতুস সাহাবা- ১/৫৩৭) খলীফা আনাসকে
বাহরাইনে ‘আমিলে সাদাকা’র পদে নিয়োগ দান করতে চান। এ ব্যাপারে ’উমারের
পরামর্শ চাইলে তিনি বলেনঃ আনাস বুদ্ধিমান ও লেখাপড়া জানা মানুষ। তার জন্য
যে খিদমতের প্রস্তাব আপনি করেছেন আমি তা সমর্থন করি। খলীফা আনাসকে ডেকে
পাঠান এবং আমিলে সাদাকার দায়িত্ব দিয়ে তাঁকে বাহরাইনে পাঠিয়ে দেন। (বুখারী,
কিতাবুয যাকাত, আল-ইসাবা- ১/৭২) তিনি যখন বাহরাইন থেকে ফিরে আসেন তখন আবু
বকর রা. আর নেই। তাঁর স্থলে ’উমার রা. খলীফা। তিনি বাহরাইন থেকে আনীত অর্থ
থেকে চার হাজার দিরহাম আনাসকে দান করেন। আনাস বলেনঃ আমি সেই অর্থ পেয়ে
মদীনাবাসীদের মধ্যে একজন অধিক অর্থশালী ব্যক্তি হয়ে যাই। (হায়াতুস সাহাবা-
২/২২)
আনাস আরও বলেনঃ আবু বকরের রা. মৃত্যুর পর ’উমার খিলাফতের
দায়িত্বভার হাতে নিলে আমি মদীনায় এসে তাঁকে বললামঃ দেখি, আপনার হাতটি একটু
বাড়িয়ে দিন। যে কথার ওপর আপনার পূর্ববর্তী বন্ধুর হাতে আপনি বাই’য়াত
করেছিলেন সেই কথার ওপর আমি আপনার হাতে বাই’য়াত করবো। এভাবে তিনি ’উমারের
রা. হাতে বাই’য়াত করেন। (হায়াতুস সাহাবা- ১/২৫৮)
খলীফা হযরত আবু বকর রা.
ইয়ামনবাসীদের উদ্দেশ্যে লেখা একটি পত্রসহ আনাসকে ইয়ামনেও পাঠান। সেই পত্রে
তিনি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদে বেরিয়ে পড়ার জন্য তাদের প্রতি আহ্বান জানান।
(হায়াতুস সাহাবা- ১/৪৪১, ৪৪২)
হযরত মুগীরা ইবন শু’বা রা. বসরার গভর্ণর
ছিলেন। সেখানে তাঁর বিরুদ্ধে হযরত আবু বাকরার রা. নেতৃত্বে এক মারাত্মক
অভিযোগ উত্থাপিত হয়। (দ্রঃ আনসাবুল আশরাফ- ১/৪৯০-৪৯২) খলীফা হযরত ’উমার রা.
তাঁকে বরখাস্ত করে আবু মূসা আল-আশ’য়ারীকে তাঁর স্থলে নিয়োগ করেন। ঘটনার
তদন্তের জন্য তাঁর সহকারী হিসাবে আরও চার ব্যক্তিকে বসরায় পাঠান। তারা
হলেন, ১. আনাস ইবন মালিক, ২. আনাসের ভাই আল-বারা’ ইবন মালিক, ৩. ইমরান
ইবনুল হুসাইন, ৪. আবু নাজীদ আল-খুযা’ঈ। (আনসাবুল আশরাফ- ১/৪৯১)
এই বসরা
শহরে হযরত আনাস স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেন। খলীফা ’উমার রা. যাঁদের ওপর
এখানকার ফিকাহ ও ফাতওয়ার দায়িত্ব অর্পণ করেন তাঁদের মধ্যে আনাস একজন।
জীবনের বাকী অংশ তিনি এই বসরা শহরেই কাটিয়ে দেন। এখানে ফিকাহ ও ফাতওয়ার
দায়িত্ব পালন ছাড়াও যখন যে দায়িত্ব তাঁকে দেওয়া হয়েছে তিনি দক্ষতার সাথে তা
পালন করেন। এই সময় পরিচালিত সকল অভিযানে তিনি অংশগ্রহণ করেন। ‘তুসতার’
অভিযানে পদাতিক বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন। তুসতার বিজিত হয় এবং পারস্য সেনাপতি
হুমুযানকে সপরিবারে বন্দী করে মুসলিম সেনাপতি আবু মূসা আল-আশয়ারীর রা.
সামনে হাজির করা হয়। হযরত আবু মূসা রা. তিনশো সদস্যের একটি বাহিনীর হিফাজতে
হুরমুযানকে মদীনায় খলীফার দরবারে পাঠিয়ে দেন। আনাস রা. ছিলেন এ বাহিনীর
আমীর এবং তিনি তাঁর দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেন। এভাবে দীর্ঘদিন পর প্রিয়
জন্মভূমির যিয়ারত লাভের সুযোগ পান। (হায়াতুস সাহাবা- ১/৬৬,
দায়িরা-ই-মা’য়ারিফ ইসলামিয়্যা- ৩/৪০২)
কিছুদিন মদীনায় অবস্থান করার পর
আনাস আবার বসরায় ফিরে গেলেন। হিজরী ২৩ সনের জ্বিলহজ্জ মাসে হযরত ’উমার রা.
শাহাদাত বরণ করলে হযরত ’উসমান রা. তাঁর স্থলাভিষিক্ত হলেন। তাঁর খিলাফতের
প্রথম কয়টি বছর খুবই শান্ত ছিল। তবে কিছুকাল পরে নানারকম ফিত্না ও অশান্তি
মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। চতুর্দিকে স্বার্থন্বেষী, হাঙ্গামাবাজ লোকেরা বিদ্রোহের
পতাকা উড়িয়ে দেয় এবং তারা মদীনা অভিমুখে যাত্রা করে।
তখনও কিন্তু
ইসলামী খিলাফতের বিভিন্ন স্থানে এমন বহু ব্যক্তি ছিলেন যাঁরা কোন রকম
বিদ্রোহ ও হুমকির পরোয়া করতেন না। সুতরাং মাজলুম খলীফার আর্ত চিৎকার
সর্বপ্রথম এই সত্যের সৈনিকদের কাছে পৌঁছে। তাঁরা তাঁর সাহায্যের জন্য গা
ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ান।
ইরাকের রাজধানী বসরাতেও এমন লোকের অভাব ছিলনা।
এমন ভয়াবহ অবস্থার খবর যখন সেখানে পৌঁছলো তখন আনাস ইবন মালিক, ’ইমরান ইবন
হুসাইনসহ বহু বিশিস্ট ব্যক্তি দ্বীনের সাহায্যের জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলেন।
তাঁরা বক্তৃতা-ভাষণের দ্বারা গোটা বসরাকে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত
করে তোলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ তাঁদের সাহায্য মদীনায় পৌঁছার পূর্বেই
বিদ্রোহীদের হাতে খলীফা ’উসমান রা. শাহাদাত বরণ করেন।
হযরত ’উসমানের
রা. পর হযরত আলী রা. খিলাফতের দায়িত্ব ভার গ্রহণ করলেন। ছয় মাস যেতে না
যেতেই তাঁর বিরুদ্ধে এক মস্ত বড় ফিত্না এই বসরাতেই মাথা তুলে দাঁড়ায়। আর
তাতে বিশিস্ট সাহাবা-ই-কিরামও জড়িয়ে পড়েন। বসরা ছিল আনাসের আবাস স্থল।
সেখানে তার বিশেষ প্রভাবও চিল। কিন্তু তিনি সকল আন্দোলন থেকে নিজেকে দূরে
রাখেন। যতদিন পর্যন্ত পরিস্থিতি শান্ত না হয়, তিনি আরও বহু বিশিষ্ট সাহাবীর
মত নির্জনতা অবলম্বন করেন। এ কারণে, হযরত আলী ও হযরত ’আয়িশার রা. উটের
য্রুদ্ধ, যা এই বসরার অনতি দুরে সংঘটিত হয়- তাতে কোন পক্ষে আনাসের রা. কোন
ভূমিকা দেখা যায় না। এসব ঘটনায় তিনি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থাকেন।
হযরত
’আলীর রা. খিলাফতের পরেও হযরত আনাস বহুদিন জীবিত ছিলেন। এই দীর্ঘ সময়ে নানা
রকম দৃশ্য ও অবস্থা অবলোকন করেন; কিন্তু সব সময় নির্জনতাকে প্রাধান্য দান
করেন। কোন অবস্থাতেই নিজেকে জাহির করা তিনি মোটেই পছন্দ করেননি। তা
সত্ত্বেও পরবর্তীকালে স্বৈরাচারী উমাইয়্যা শাসকদের নির্যাতন থেকে বাঁচতে
পারেননি। খলীফা আবদুল মালিকের সময় উমাইয়্যা সাম্রাজ্যের পূর্ব অঞ্চলের
গভর্ণর ছিলেন হাজ্জাজ ইবন ইউসুফ। অত্যাচারী ও নিপীড়ক হিসেবে ইতিহাসে তিনি
খ্যাতিমান। একবার তিনি বসরায় এসে আনাসকে ডেকে শাসান এবং জনগণের মাঝে হেয়
করার জন্য তাঁর ঘাড়ে ছাপ মেরে দেন। ওয়াকিদী ইসহাক ইবন ইয়াযীদ থেকে বর্ণনা
করেছেন, তিনি বলেনঃ আমি এই ছাপ মারা অবস্থায় আনাসকে দেখেছি। (আল-ইসতী’য়াবঃ
আল-ইসাবার পার্শ্বটীকা- ১/৭২)
হাজ্জাজ ধারণা করেছিলেন, আনাস রাজনৈতিক
বাতাস বুঝে কাজ করেন। তাই আনাসকে দেখেই তিনি বলে ওঠেনঃ ওহে খবীস! এটা একটা
চালবাজি। আপনি মুখতার আস-সাকাফীর সাথেও থাকেন, আবার কখনও থাকেন ইবনুল
আশয়াসের সাথে। আমি আপনাদের জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করে রেখেছি। এমন
কঠিন মুহূর্তেও আনাস নিজেকে আয়ত্বে রাখেন। শান্তভাবে তিনি বলেনঃ আল্লাহ
আমীরকে সাহায্য করুন। আপনার শাস্তি কার জন্য? বললেনঃ আপনার জন্য। হযরত আনাস
চুপচাপ বাড়ী ফিরে এলেন এবং খলীফা ’আবদুল মালিকের নিকট হাজ্জাজের আচরণের
বিবরণ দিয়ে একটি চিঠি পাঠিয়ে দিলেন। চিঠি পড়ে ’আবদুল মালিক রাগে ফেটে পলেন।
সাথে সাথে তিনি হাজ্জাজকে লিখলেন, তুমি খুব তাড়াতাড়ি আনাসের বাড়ীতে গিয়ে
ক্ষমা চাও, নইলে তোমার সাথে খুব খারাপ আচরণ করা হবে। খলীফার চিঠি পেয়ে
হাজ্জাজ তাঁর পরিষদবর্গসহ আনাসের খিদমতে হাজির হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
তিনি আনাসের নিকট আরও আবেদন জানান, তিনি যে হাজ্জাজকে ক্ষমা করেছেন, সেই
কথা যেন খলীফাকে একটু জানিয়ে দেন। আনাস তাঁর আবেদন মঞ্জুর করেন এবং সেই
মর্মে একটি চিঠি দিমাশ্কে পাঠিয়ে দেন। মূলতঃ ফিত্না ও বিশৃঙ্খলার ভয়ে আনাস
এমন কঠিন ধৈর্য অবলম্বন করেন। (তারীখে ইবন ’আসাকির- ৩/১৪৮, আল-ফাতহুর
রাব্বানী মা’য়া বুলুগিল আমানী- ২২/২০৫, হায়াতুস সাহাবা- ২/৬৪৭, ৬৪৮)
হযরত
’আবদুল্লাহ ইবন যুবাইরের রা. কর্তৃত্বের সময় হযরত আনাস কিছুদিনের জন্য
বসরার ইমাম ছিলেন। খলীফা ওয়ালিদ ইবন ’আবদিল মালিকের সময় তিনি একবার দিমাশকে
যান। (তারীখে ইবন ’আসাকির- ৩/১৩৯) তবে অন্য একটি বর্ণনা মতে তিনি প্রথমে
দিমাশকে যান এবং সেখান থেকে বসরায় পৌঁছেন। (আল-আ’লাম- ১/৩৬৫)
হযরত
আনাসের মৃত্যু সন ও মৃত্যুর সময় বয়স সম্পর্কে প্রচুর মতভেদ আছে। সর্বাধিক
প্রসিদ্ধ মতে হিজরী ৯৩ সনে মৃত্যুবরণ করেন এবং তখন তাঁর বয়স হয়েছিল এক শো
বছরের উর্দ্ধে। কারণ, হিজরাতের পূর্বে তাঁর বয়স ছিল দশ বছর। (তাহজীবুল
আসমা- ১/১২৮, আল-আ’লাম- ১/৩৬৫, তাজকিরাতুল হুফ্ফাজ- ১/৪৫, উসুদুল গাবা-
১/১২৮) মৃত্যুর পূর্বে তিনি কয়েক মাস অসুস্থ অবস্থায় শয্যাশায়ী ছিলেন।
দেখার জন্য ভক্ত-অনুরক্তদের ভীড় লেগেই থাকতো। দূর থেকে দলে দলে মানুষ তাঁকে
এক নজর দেখার জন্য আসতো। মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এলে তাঁর একান্ত শাগরিদ সাবিত
নাবানীকে বলেন, আমার জিহবার নীচে রাসূলুল্লাহর সা. একটি পবিত্র চুল রেখে
দাও। পবিত্র চুল রাখা হলো। এ অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এবং সেই
অবস্থায় দাফন করা হয়। রাসূলুল্লাহর সা. একটি লাঠি ছিল তাঁর কাছে। মৃত্যুর
পূর্বে লাঠিটি কবরে তাঁর সাথে দাফনের নির্দেশ দিয়ে যান। সে নির্দেশ পালন
করা হয়। (উসুদুল গাবা- ১/১২৮, আল-ইসাবা- ১/৭১, আল-ইসতীয়াব- ১/৭৩) ইবন
কুতায়বা ‘আল-মা’য়ারিফ’ গ্রন্থে বলেন, বসরার তিন ব্যক্তির প্রত্যেকেই এক শোন
বছর জীবন পেয়েছিলেন। তাঁরা হলেনঃ আনাস ইবন মালিক, আবু বাকরাহ্ ও খীলফা ইবন
বদর রা.। (তাহজীবুল আসমা ওয়াল লুগাত- ১/১২৮)
হযরত আনাস ছিলেন দুনিয়া
থেকে বিদায় গ্রহণকারী বসরার শেষ সাহাবী। সম্ভবতঃ একমাত্র আবুত তুফাইল রা.
ছাড়া তখন পৃথিবীতে দ্বিতীয় কোন সাহাবী জীবিত ছিলেন না। (আল-ইসাবা- ১/৭১,
আল-আ’লাম- ১/৩৬৫, আল-ইসতী’য়াবঃ আল-ইসাবা- ১/৭৩) অবশ্য আল্লামা জাহাবী
‘তাজকিরাতুল হুফ্ফাজ’ গ্রন্থে বলেনঃ ‘কানা (আনাস) আখিরাস সাহাবাতি মাওতান’-
আনাস মৃত্যুবরণকারী সর্বশেষ সাহাবী।’ সাহাবীদের মধ্যে দুনিয়া থেকে তিনিই
সর্বশেষ বিদায় নেন। (তাজকিরাতুল হুফ্ফাজ- ১/৪৪) হযরত আনাস নিজেও শেষ জীবনে
বলতেনঃ কিলাতাইন বা দুই কিবলার দিকে মুখ করে নামায আদায় করেছেন, এমন
ব্যক্তিদের মধ্যে একমাত্র আমি ছাড়া এখন আর কেউ বেঁচে নেই। (তারীখে ইবন
’আসাকির- ৩/১৪৫)
পরিবারের সদস্য, ছাত্র ও ভক্তবৃন্দ ছাড়াও আশ-পাশের
লোকেরা তাঁর জানাযায় শরীক হন। কুতন ইবন মুদরিক আল-কিলাবী জানাযার নামায
পড়ান। বসরার উপকণ্ঠে ‘তিফ্’ নামক স্থানে তাঁর বাসস্থানেরে পাশেই কবর দেওয়া
হয়। (উসুদুল গাবা- ১/১২৯)
হযরত আনাসের মৃত্যুতে গোটা মুসলিম উম্মাহ
দারুণ শোকাকিভূত হয়ে পড়েছিল। বাস্তবেও তেমন হওয়ার কথা। কারণ, রাসূলুল্লাহর
সা. সাহাবীরা এক এক করে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে চলে গিয়েছিলেন। মাত্র দুই
ব্যক্তি যাঁদেরকে দেখে মানুষ প্রশান্তি লাভ করতো, তাঁদের একজন চলে গেলেন।
হযরত
আনাসের ইনতিকালের পর ‘মাওরিক’ নামক এক তাবঈ ব্যক্তি আফসোস করে বলেনঃ
‘আল-ইউয়াম জাহাবা নিসফুল ’ইলম- আজ অর্ধেক ’ইলম (জ্ঞান) চলে গেল।’ লোকেরা
প্রশ্ন করলোঃ তা কেমন করে? বললেনঃ আমার কাছে একজন প্রবৃত্তির অনুসারী লোক
আসতো। সে যখন হাদীসের বিরোধীতা করতো, আমি তাঁকে আনাসের নিকট নিয়ে যেতাম।
আনাস তাঁকে হাদীস শুনিয়ে নিশ্চিন্ত করতেন। এখন কার কাছে যাব? (তাহজীবুল
আসমা ওয়াল লুগাত- ১/১২৮, তারীখে ইবন ’আসাকির- ৩/১৪১)
আনসার সম্প্রদায়ের
মধ্যে হযরত আনাসের সন্তান সন্ততির সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশী। আর এটা হয়েছিল
হযরত রাসূলে কারীমের সা. দু’আর বরকতে। এ সম্পর্কে আনাস বলেনঃ একদিন
রাসুলসা. উম্মু সুলাইমের (আনাসের মা) বাড়ীতে এলেন। উম্মু সুলাইম খুরমা ও ঘি
খেতে দিলেন। কিন্তু রাসুল সা. সে দিন সাওম পালন করছিলেন। তিনি বললেনঃ
এগুলি নিয়ে যাও এবং খুরমার পাত্রে খুরমা ও ঘিয়ের পাত্রে ঘি রেখে দাও। তারপর
তিনি উঠে ঘরের এক কোণে গিয়ে দুই রাকা’য়াত নামায আদায় করেন। আমরাও তাঁর
সাথে নামায আদায় করলাম। তারপর তিনি উম্মু সুলাইম ও তাঁর পরিবারের কল্যাণ
কামনা করে দু’আ করলেন। উম্মু সুলাইম ’আরজ করলেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমার
কিছু নিশেষ নিবেদন আছে। তিনি জানতে চাইলেনঃ কী? বললেনঃ এই আপনার খাদিম
আনাস। আনাস বলেনঃ তারপর রাসূল সা. আমার জন্য এমন দু’আ করলেন যে, দুনিয়া ও
আখিরাতের কোন কল্যাণই বাদ দিলেন না। শেষের দিকে তিনি বলেনঃ ‘হে আল্লাহ
আনাসের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে সমৃদ্ধি দান কর এবং তাঁকে জান্নাতে
প্রবেশ করাও।’ আনাস বলতেনঃ রাসূলুল্লাহ সা. যে তিনটি জিনিসের জন্য দু’আ
করেছিলেন, তার দুইটি আমি পেয়ে গেছি এবং বাকী একটি (জান্নাত) অপেক্ষায় আছি।
আনাস আরও বলতেনঃ ‘আজ আনসারদের মধ্যে আমার চেয়ে বেশী সম্পদশালী ব্যক্তি আর
কেউ নেই।’ ঐতিহাসিকরা বলছেন, রাসূলুল্লাহর সা. এই দু’আর পূর্বে একটি মাত্র
আংটি ছাড়া তিনি কোন সোনা বা রূপোর মালিক ছিলেন না। এভাবে রাসুল সা. আনাস ও
তাঁর পরিবারের কল্যাণ চেয়ে বহুবার দু’আ করেছেন। (আল-ফাতহুর রাব্বানী- মা’য়া
বুলুগিল আমানী- ২২/২০৩, আল-ইসাবা- ১/৭২, তারীখে ইবন ’আসাকির- ৩/১৪২, ১৪৩)
মৃত্যুকালে
হযরত আনাস মোট ৮২ (বিরাশি) জন ছেলে মেয়ে-রেখে যান। তাদের মধ্যে ৮০ (আশি)
জন ছেলে এবং হাফসা ও উম্মু ’আমর নামে দুই মেয়ে। তাছাড়া নাতি-নাতনীর সংখ্যা
ছিল আরও অনেকে। (উসুদুল গাবা- ১/১২৮) খলীফা ইবন খাইয়্যাত বলেনঃ আনাস যখন
মারা যান তখন তাঁর চারটি বাড়ী। একটি বসরার জামে মসজিদের সামনে, একটি
ইসতাফনুস গলিতে এবং একটি বসরা থেকে দুই ফারসাখ দূরে। তাছাড়া আরও একটি বাড়ী
ছিল। (তারীখে ইবন ’আসাকির- ৩/১৪১)
সন্তানদের প্রতি ছিল হযরত আনাসের
দারুণ স্নেহ-মমতা। সব সময় যে তিনি বাড়ীতে থাকতেন- এই স্নেহ-মমতার
প্রাবাল্যও তার একটি কারণ। ছেলে-মেয়েদের নিজেই শিক্ষা দিতেন। মেয়েদেরও
হালকায়ে দারসে বসার অনুমতি ছিল। তাঁর কয়েকটি ছেলে হাদীস শাস্ত্রের শায়খ ও
ইমাম রূপে স্বীকৃত হন। তাবঈদের তাবকায় (শ্রণী) তাদেরকে সম্মানের দৃষ্টিতে
দেখা হয়। হযরত আনাসই তাদেরকে গড়ে তোলেন।
হযরত আনাস ছিলেন একজন দক্ষ
তীরন্দাজ। সন্তানদেরও এর অনুশীলন করাতেন। ছেলেরা প্রথমে নিশানা ঠিক করে তীর
ছুড়তো। তারা লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে তিনি ছুড়তেন এবং সঠিকভাবে তা লক্ষ্যভেদ
করতো। তীর ছোড়ার অনুশীলনী সেই প্রাচীন জাহিলিয়্যাতের সময় থেকেই আনসারদের
মধ্যে প্রচলিত ছিল। একথা তাবারী উল্লেখ করেছেন। (উসুদুল গাবা- ১/১২৮)
হযরত
আনাসের পরিপূর্ণ হুলিয়া বা অবয়ব জানা যায় না। এতটুকু জানা যায় যে, তিনি
মধ্যম আকৃতির সুদর্শন ব্যক্তি ছিলেন। চুল-দাড়িতে মেহেন্দীর খিযাব লাগাতেন।
হাতে সব সময় হলুদ বর্ণের ‘খালুক’ নামক এক রকম সুগন্ধি ব্যবহার করতেন।
‘উসুদুল গাবা’ গ্রন্থকার বলেনঃ সিংহের ছবি অঙ্কিত একটি আংটি হাতে পরতেন।
ছোট বেলায় মাথায় একটা জটা ছিল। রাসুল সা. যখন মাথায় হাত দিতেন, সেই জটা
স্পর্শ করতেন। পরে সেটি কেটে ফেলার ইচ্ছা করলে মা বললেনঃ রাসূল সা. এটি
স্পর্শ করেছেন, সুতরাং কেটো না। (উসুদুল গাবা- ১/১২৭, ১২৮) মাথায় পাগড়ী
বাঁধতেন।
তিনি ছিলেন দারুণ সৌখিন ও পরিচ্ছন্ন প্রকৃতির একজন মার্জিত
রুচির মানুষ। দুনিয়ার বিত্ত-বৈভবও তাঁর অনুকূলে সাড়া দেয়। এ কারণে তাঁর
জীবন ছিল অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ। অতি যত্নে একটি উদ্যান তৈরী করেছিলেন, তাতে
বছরে দুইবার ফল আসতো। সেখানে একটি ফুল ছিল যা মিশকের মত সুগন্ধি ছড়াতো।
(আল-ইসাবা- ১/৭১)
তিনি বসরার দুই ফারসাখ (মাইল) দূরে ‘তিফ’ নামক স্থানে
একটি বাড়ী বানিয়ে বসবাস করতেন। এতে বুঝা যায়, নগর জীবনের চেয়ে পল্লীতে বাস
করা বেশী পসন্দ করতেন। ভালো খাবার খেতেন। খাবার তালিকায় সব সময় রুটি ও
শুরবা থাকতো। তিনি উদার প্রকৃতির ছিলেন। আহারের সময় ছাত্র বা অন্য কেউ কাছে
থাকলে, আহারে শরীক করাতেন। সকালে নাশতা করতেন এবং তিন অথবা পাঁচটি খেজুর
খেতেন। কথা খুব কম বলতেন। প্রয়োজন হলে কথা তিনবার করে বলতেন। কারও বাড়ীতে
ঢুকবার আগে তিনবার অনুমতি চাইতেন। (মুসনাদ- ৩/১২৮, ১৮০, ২২১, ২৩২)
আত্মীয়-বন্ধুদের কেউ সাক্ষাৎ করতে এলে কিছু না কিছু খাবার তাদের সামনে
উপস্থিত করতেন। একবার তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে কিছু লোক তাঁকে দেখতে আসে। তিনি
দাসীকে ডেকে বললেনঃ রুটির সামান্য একটি টুকরো হলেও আমার বন্ধুদের জন্য
নিয়ে এসো। কারণ, আমি রাসূলুল্লাহকে সা. বলতে শুনেছিঃ উত্তম নৈতিকতা
জান্নাতের কাজ। (হায়াতুস সাহাবা- ২/১৮২)
তিনি অত্যন্ত বিনয়ী ও নম্র
প্রকৃতির ছিলেন। মানুষের সাথে উদারভাবে মিশতেন। ছাত্রদের সাথেও ছিলেন ভীষণ
আন্তরিক। প্রায়ই বলতেনঃ রাসূলুল্লাহর সা. সময় আমরা বসা থাকতাম, তিনি আসতেন;
কিন্তু তাঁর সম্মানে আমরা কেউই উঠে দাঁড়াতাম না। অথচ রাসূলুল্লাহর সা.
চেয়ে অধিকতর প্রিয় আমাদের আর কে হতে পারে? এর কারণ, রাসূল সা. এ সব
কৃত্রিমতা একটু পসন্দ করতেন না।
সবরের গুণটি তাঁর মধ্যে পূর্ণমাত্রায়
বিকশিত হয়েছিল। তিনি যে পর্যায়ের লোক ছিলেন, মুসলমানদের অন্তরে তার প্রতি
যে ভক্তি ও শ্রদ্ধা ছিল, হযরত রাসূলে কারীম সা. তাঁর যে মর্যাদার কথা
বলেছেন এবং খোদ রাসূলুল্লাহর সা. যে নৈকট্য তিনি লাভ করেছিলেন তাতে প্রতিটি
মানুষ তাঁকে সম্মান, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার দৃষ্টিতে দেখতো। তাঁর ছাত্র
প্রখ্যাত তাবঈ সাবিত নাবানী ভক্তি ও শ্রদ্ধার আতিশয্যে হযরত আনাসের দুই
চোখের মাঝখানে চুমু দিতেন। একবার আনাস আবুল ’আলিয়্যাকে একটি সেব দিলেন।
সেবটি হাতে নিয়ে তিনি শুকতে, চুমু খেতে ও মুখে ঘষতে লাগলেন। তারপর বললেনঃ
এই সেবে এমন হাতের স্পর্শ লেগেছে যে হাত রাসূলের সা. পবিত্র হাত স্পর্শ
করেছে। (তারীখে ইবন ’আসাকির- ৩/১৪৪) কিন্তু এতকিছু সত্ত্বেও উমাইয়্যা
শাসকদের অনেকের কাছে এর কোন গুরুত্বই ছিল না। এসব স্বেচ্ছাচারী দুষ্টমতিদের
নেতা ছিলেন হাজ্জাজ ইবন ইউসুফ। তাঁর উদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের কথা পূর্বেই বলা
হয়েছে। হযরত আনাস তখন চরম ধৈর্য অবলম্বন করেন। তিনি ছাড়া অন্য কারও সাথে
এমন আচরণ করা হলে বসরায় আগুন জ্বলে যেত। তিনি কোন্ নীতি অবলম্বন করে এত
ধৈর্য ধারণ করতেন? এর একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায় তাঁর নিজের কথার মধ্যে। তিনি
বলতেনঃ মুহাম্মাদের সা, বিশিষ্ট সাহাবীরা আমাদেরকে বলেছেনঃ তোমরা তোমাদের
আমীরদেরকে গালাগালি করবেনা, তাঁদেরকে ধোকা দেবে না এবং তাঁদের অবাধ্য হবে
না। আল্লাহকে ভয় করবে ও ধৈর্য ধারণ করবে। (হায়াতুস সাহাবা- ২/৭২)
ছেলেবেলা
থেকেই তিনি ছিলেন ভয়-ডর শূণ্য দুঃসাহসী। খুব দৌড়াতে পারতেন। একবার ‘মাররুজ
জাহরান’ নামক স্থানে একটি খরগোশ তাড়া করে ধরে ফেলেন। অথচ তাঁর সমবয়সী
ছেলেরা খরগোশটির পিছনে ধাওয়া করে ফিরে আসে। বড় হয়ে নিপুণ অশ্বারোহী ও দক্ষ
তীরন্দাজ হন।
হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবীদের সংখ্যা বিপুল। তাঁদের মধ্যে
আবার এমন একদল আছেন যাঁরা বর্ণনার ক্ষেত্রে মূল ভিত্তি বলে বিবেচিত। আনাস
ছিলেন এই দলেরই একজন। তাঁর বর্ণনা সমূহ বিশ্লেষণ করলে নীচের মূলনীতিগুলি
পাওয়া যায়ঃ
১. হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে দারুণ সতর্কতা অবলম্বন। মুসনাদে
আহমাদ গ্রন্থে এসেছেঃ ‘আনাস ইবন মালিক হাদীস বর্ণনার সময় ভীত হয়ে পড়তেন।
বর্ণনার শেষে বলতেনঃ এই রকম অথবা এই যেমনটি রাসূল সা. বলেছেন’ মুহাদ্দিসগণ
হাদীস বর্ণনার শেষে যে বলে থাকেন- ‘আও কামা কালা-অথবা যেমন তিনি বলেছেন’-
এবং আজকের যুগ পর্যন্ত যে ধারাটি অব্যাহত রয়েছেন, তার প্রচলন হযরত আনাস
থেকে। (তারীখে ইবন ’আসাকির- ৩/১৪৮)
২. যে হাদীস বুঝতে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকতো, তিনি তা বর্ণনা করেননি।
৩.
যে সকল হাদীস তিনি সাহাবীদের নিকট থেকে এবং যেগুলি খোদ রাসূলুল্লাহর সা.
মুখ থেকে শুনেছিলেন এই দুই প্রকারের মধ্যে পার্থক্য করেছিলেন।
প্রকৃতপক্ষে
কোন জ্ঞানের সেবা বা খিদমাত হলো সেই জ্ঞানের প্রচার ও প্রসার ঘটানো, হযরত
আনাস এ ক্ষেত্রে কোন সাহাবী থেকে পিছিয়ে ছিলেন না। সারাটি জীবন তিনি
অভিনিবেশ সহকারে ইলমে হাদীসের প্রচার-প্রসারে অতিবাহিত করেন। তিনি হাদীস
শিক্ষা দানের আওতা থেকে কক্ষণও বাইরে যাননি। যে যুগে তাঁর সমসাময়িক সাহাবা
যুদ্ধ-বিদ্রহে ব্যস্ত ছিলেন তখনও রাসূলুল্লাহর সা. এই খাদিম দুনিয়া থেকে
সম্পূর্ণ পৃথক হয়ে বসরার জামে মসজিদে বসে মানুষকে হাদীস শোনাতেন।
তাঁর
জ্ঞানের প্রসারতা তাঁর শাগরিদদের সংখ্যা দ্বারাই অনুমান করা যায়। তাঁর
হালকায়ে দারসে মক্কা, মদীনা, কূফা, বসরা, সিরিয়াসহ বিভিন্ন অঞ্চলের ছাত্রের
সমাবেশ ঘটতো তাঁর সন্তান সংখ্যার মত ছাত্র সংখ্যাও অগণিত। হযরত আনাস হযরত
রাসূলে কারীম সা. থেকে এবং বিশিস্ট সাহাবীদের নিকট থেকেও হাদীস বর্ণনা
করেছেন। প্রায় এক শো রাবী তাঁর থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। তাঁর বর্ণিত
হাদীসের সংখ্যা মোট ২২৮৬ (দুই হাজার দুই শো ছিয়াশি)। মুত্তাফাক আলাইহি-
১৮০, বুখারী এককভাবে ৮০ এবং মুসলিম এককভাবে ৭০টি হাদীস বর্ণনা করেছেন। তাঁর
ছেলে এবং নাতীদের থেকেও বহু হাদীস বর্ণিত হয়েছে। বসরার বিখ্যাত মুহাদ্দিস
আবু ’উমাইর ’আবদুল কাবীল ইবন মুহাম্মাদ ইবন আবদুল্লাহ ইবন হাফ্স ইবন হিশাম
(২৯১ হিঃ) তাঁরই বংশধর। (দারিয়া-ই-মা’য়ারিফ ইসলামিয়্যা- ৩/৪০১) অবশ্য তাঁর
বর্ণিত মুত্তাফাক আলাইহি হাদীসের ব্যাপারে মতভেদ আছে। কেউ বলেছেন- ১৬৮,
আবার কেউ বলেছেন- ১২৮। (তাজকিরাতুল হুফ্ফাজ- ১/৪৫, তাহজীবুল আসমা- ১/১২৭)
হযরত
আনাস প্রথমতঃ রাসূলে পাকের সা. সাহচার্যে থেকে ইল্ম হাসিল করেন। রাসূলে
সা. ওফাতের পর যে সকল সাহাবীর নিকট থেকে হাদীস শোনেন তারা হলেনঃ উবাই ইবন
কা’ব, ’আবদুর রহমান ইবন ’আউফ, ’আবদুল্লাহ ইবন মাস’উদ, আবু জার, আবু তালহা,
মু’য়াজ ইবন জাবাল, ’উবাদাহ্ ইবনুস সামিত, ’আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা, সাবিত
ইবন কায়েস, মালিক ইবন সা’সা’, উম্মু সুলাইম (তাঁর মা), উম্মু হারাম (তাঁর
খালা), উম্মুল ফাদল (হযরত ’আব্বাসের স্ত্রী), আবু বকর, ’উমার, ’উসমান রা.
প্রমুখ। (তাজকিরাতুল হুফ্ফাজ- ১/৪৪)
হযরত আনাসের ছাত্র ও শাগরিদদের নামে
তালিকা অনেক দীর্ঘ। তাঁর মধ্যে হাদীস শাস্ত্রে যাঁরা বিশ্বজোড়া খ্যাতি
অর্জন করেছেন এখানে তাঁদের কয়েকজন জনের নাম উল্লেখ করা গেলঃ হাসান বসরী,
ইবন শিহাব যুহরী, সুলাইমান তায়মী, আবু কিলাবা, ইসহাক ইবন আবী তালহা, আবু
বকর ইবন ’আবদিল্লাহ মুযানী, কাতাদাহ, সাবিত নাবানী, হুমাইদ আতত্বাবীল,
সুমামাহ্ ইবন ’আবদিল্লাহ, (আনাসের পৌত্র) জা’দ, আবু ’উসমান, মুহাম্মাদ ইবন
সীরীন আনসারী, আনাস ইবন সীরীন আযহারী, ইয়াহইয়া ইবন সা’ঈদ আনসারী,
রাবী’য়াতুর রায়, সা’ঈদ ইবন জুবাইর এবং সুলাইমান ওয়ারদান রাহিমাহুমুল্লাহ।
(তাজহকিরাতুল হুফ্ফাজ- ১/৪৫)
ইলমে হাদীসের মত ফিকাহ শাস্ত্রেও হযরত
আনাসের পান্ডিত্য ছিল। ফকীহ সাহাবীদেরকে তিনটি তাবকা বা স্তরে ভাগ করা হয়।
আনাসের স্থান দ্বিতীয় স্তরে। তাঁর ইজতিহাদ ও ফাতওয়াসমূহ সংকলিত হলে একটি
স্বতন্ত্র পুস্তকের রূপ লাভ করতে পারে। হযরত ’উমার রা. ফকীহ সাহাবীদের একটি
দলের সাথে তাঁকে বসরায় পাঠান। ফিকাহ শাস্ত্রে তাঁর বিশেষজ্ঞ হওয়ার জন্য এর
চেয়ে বড় প্রমাণ আর কি হতে পারে?
সাহাবীদের যুগে শিক্ষাদান সাধারণতঃ
হালকা-ই-দারসের মধ্যেই সীমিত ছিল। হযরত আনাসও এই হালকার পদ্ধতিতেই দারস
দিতেন। কোন ছাত্র প্রশ্ন করলে তিনি জবাব দিতেন। তাঁর দারসের এ ধরণের
সাওয়াল-জাওয়াবের একটি সংকলন আছে। এখানে কয়েকটি মাসয়ালা উদ্ধৃত হলো যার
মাধ্যমে তাঁর ইজতিহাদ পদ্ধতি, সূক্ষ্ণদৃষ্টি, স্বচ্ছ বোধশক্তি, সঠিক
সিদ্ধান্ত ইত্যাদির একটা ধরণা লাভ করা যেতে পারে।
বিশেষ কয়েকটি বরতনে
নাবীজ (আংগুর বা খেজুরের রস) পান করা মাকরূহ। এ ব্যাপারে সাহাবায়ে কিরাম
একমত। হযরত আনাস স্পষ্ট করে তার কারণগুলির প্রতি ইঙ্গিত করেছেন।
একবার
কাতাদাহ জিজ্ঞেস করলেন, ঘড়া বা কলসে কি নাবীজ বানানো যায়? আনাস বললেনঃ যদিও
রাসূলে কারীম সা. এ সম্পর্কে কোন মত প্রকাশ করে যাননি, তবুও আমি মাকরুহ
মনে করি। কারণ, যে জিনিসের হারাম বা হালাল হওয়া সম্পর্কে সন্দেহ আছে, তাতে
হারাম হওয়ার দিকটিই প্রাধান্য পাবে।
একবার মুখতার ইবন ফিলফিল জানতে
চাইলেন, কোন্ কোন্ পাত্রে নাবীজ পান করা উচিত নয়? বললেন, যাতে নেশা হয় তা
সবই হারাম। মুখতার বললেন, কাঁচ অথবা আলকাতরার পাত্রে কি পান করা যায়?
বললেনঃ হাঁ। আবার প্রশ্ন করা হলোঃ মানুষ যে মাকরূহ মনে করে? বললেনঃ যাতে
সন্দেহ হয় তা পরিহার কর। তারপর একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করা হলোঃ নেশা হয়
এমন জিনিস তো হারাম; কিন্তু এক দুই ঢোক পানে আপত্তি কি? আনাস বললেনঃ যে
জিনিসের বেশী পরিমাণ নেশা সৃষ্টি করে তার অল্প পরিমাণও হারাম। দেখ-আংগুর,
খুরমা, গম, যব ইত্যাদি থেকে মদ তৈরী হয়। তার মধ্যে যে জিনিসে নেশা সৃষ্টি
হয় তা মদ হয়ে যায়।
হযরত আনাস যদিও সুন্দরভাবে এই মাসয়ালাটি বর্ণনা
করেছেন; তবুও এর আরও একটু ব্যাখ্যা প্রয়োজন। হযরত রাসূলে কারীম সা. পান ও
পানীয় সম্পর্কে যে বিধি-বিধান দান করেছেন সংক্ষেপে তা নিম্নরূপঃ
১. প্রত্যেক শরাব বা পানীয় যা নেশা সৃষ্টি করে তা হারাম। সাহীহাইনে হযরত ’আয়িশা রা. থেকে এ হাদীস বর্নিত হয়েছে।
২. প্রত্যেক নেশা সৃষ্টিকারী বস্তুই খমর এবং প্রত্যেক খমর (মদ) হারাম। ইবন ’উমার রা. থেকে সাহীহ মুসলিমে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে।
৩.
‘যে সব জিনিসের বেশী পান করলে নেশা হয় তার অল্প একটুও হারাম।’ (সুনানু ইবন
’উমার)। এর মধ্যে প্রথম হাদীসটির মর্ম হলো, যে সকল পানীয়ের মধ্যে নেশা বা
মাদকতা এসে যায় তা হারাম। দ্বিতীয়টির অর্থ হলো, প্রত্যেক নেশা সৃষ্টিকারী
বস্তুই খমর, আর প্রত্যেক খমরই হারাম। সুতরাং সিদ্ধান্ত এই দাঁড়ায়; প্রত্যেক
নেশা সৃষ্টিকারী বস্তুই হারাম। তৃতীয়টির অর্থ হলোঃ যে সব জিনিসের বেশী পান
করলে নেশা হয় তার অর্প একটুও হারাম। হযরত আনাস রা. তাঁর উপরোক্ত জবাবে এই
কথাটিই বলেছেন।
এখন প্রশ্ন হলো বিশেষ কয়েকটি পাত্রে নাবীজ পান করতে
নিষেধ করা হয়েছে কেন? এর প্রকৃত রহস্য এই যে, আধুনিক বিশ্ব মদ তৈরী ও
সংরক্ষণের জন্য সুন্দর কাঁচের যে সব পাত্র আবিষ্কার করেছে, তৎকালীন আরবে তা
ছিলনা। সেখানে সাধারণভাবে লাউ-এর খোল ও সুরাহী বোতলের কাজ দিত। অথবা এ
জাতীয় আরও কয়েকটি পাত্র ছিল যা প্রাকৃতিক ফল শুকিয়ে ও সাফ করে মদের কাজে
ব্যবহার করা হতো। ঐ সব পাত্রে মদ রাখলে স্বাভাবিকভাবেই তাতে মদের ক্রিয়া
পড়তো, আর তা ধোয়ার পরেও দূর হতো না। ইসলামের প্রথম যুগে যখন মদ হারাম হয়
তখন এইসব পাত্রের ব্যবহার হারাম হওয়ার প্রকৃত রহস্য এটাই। অবশ্য
পরবর্তীকালে এ জাতীয় পাত্র যাতে মদ রাখা হয়নি, তার ব্যবহার জায়েয হতে পারে।
কিন্তু হিজরী প্রথম শতকের ঈমানী চেতায় উজ্জীবিত মুসলমানরা ধারণা করে যে, ঐ
সব পাত্র ব্যবহার করলে শরাব পানের কথা নতুন করে মানুষের স্মরণ হতে পারে।
একবার
এক ব্যক্তি হযরত আনাসকে প্রশ্ন করলোঃ রাসূল সা. কি জুতো পরে নামায আদায়
করতেন? বললেনঃ হাঁ। জুতো পরে নামায আদায় করা যায়। তবে শর্ত হলেো পাক হতে
হবে, নাজাসাত থেকে পরিষ্কার হতে হবে। কেউ নতুন জুতো পরে নামায পড়লে ক্ষতি
নেই।
একবার ইয়াহইয়া ইবন ইয়াযীদ হান্নায়ী প্রশ্ন করলেনঃ নামাযে কখন কসর
করা উচিত? বললেনঃ আমি যখন কুফা যেতাম, তখন কসর করতাম। আর রাসূল সা. তিন
মাইল বা তিন ফারসাখ পথ চলার পর কসর করেছিলেন। হযরত আনাসের কথার অর্থ এই নয়
যে, তিন মাইল সফর করলেই কসর করতে হবে। বরং প্রকৃত ঘটনা হলো, রাসূল সা.
মক্কার উদ্দেশ্যে বের হয়ে পথে সর্বপ্রথম জুলহুলায়ফা নামক স্থানে যাত্রা
বিরতি করেন। সাহীহ বর্ণনা মতে, তা মদীনা থেকে তিন মাইল দূরে অবস্থিত। আর এ
জন্যই তিনি সেখানে কসর আদায় করেন।
মুখতার ইবন ফিলফিল একবার প্রশ্ন করলেনঃ অসুস্থ ব্যক্তি কিভাবে নামায আদায় করবে? আনাস বললেনঃ বসে বসে।
’আবদুর
রহমান ইবন দারদান এবং তাঁর সাথে আরও কিছু লোক মদীনায় আনাসের কাছে আসলেন।
আনাস জিজ্ঞেস করলেনঃ তোমরা কি ’আসরের নামায আদায় করেছ? তাঁরা বললেনঃ হাঁ।
তাঁরা পাল্টা প্রশ্ন করলোঃ রাসূল সা. ’আসরের নামায পড়তেন কোন সময়? বললেনঃ
সূর্য তখনও উজ্জ্বল ও উপরে থাকতো।
একবার তিনি একটি জানাযার নামায
পড়ালেন। জানাযাটি ছিল পুরুষের। এজন্য মাইয়্যেতের মাথা বরাবর দাঁড়ালেন।
একবার এক মহিলার জানাযা আনা হলো। এবার তিনি কোমর সোজা দাঁড়ালেন। ’আল ইবন
যিয়াদ ’আদাদীও সেই নামাযে উপস্থিত ছিলেন। তিনি দুইটি জানাযায় দুই রকম
দাড়ানোর কারণ জানতে চাইলেন। আনাস বললেনঃ রাসূল সা. এমনটিই করতেন। ‘আলা’
সমবেত লোকদের বললেনঃ ওহে, তোমরা কথাটি মনে রেখ।
একবার এক ব্যক্তি প্রশ্ন
করলোঃ হযরত ’উমার রা. রুকু’র পরে কুনুত পড়েছিলেন? বললেনঃ হাঁ। রাসূল সা. ও
পড়েছিলেন। তবে এটা হযরত আনাসের নিজস্ব মতামত। কারণ, সাহীহ হাদীস দ্বারা
একথা প্রমাণিত যে, রাসূল সা. এবং সাধারণভাবে প্রায় সকল সাহাবা ‘বিতর’
নামাযে রুকু’র পূর্বে কুনুত পড়তেন। এই মাসয়ালায় ইমাম শাফে’ঈ হযরত আনাসের
অনুসারী। তিনি নিজের মতের স্বপক্ষে প্রমাণ হিসেবে একটি হাদীস গ্রহণ করেছেন।
হাদীসটি হলো, হযরত ’আলীও রুকু’র পরে কুনুত পড়তেন। কিন্তু হাদীসটি মুনকাতা’
ও দুর্বল সনদ বিশিষ্ট।
তাছাড়া ইবন মুনজির ‘আল-আশরাফ’ গ্রন্থে লিখেছেন,
আনাস এবং অমুক অমুক সাহাবী থেকে বর্ণিত যে সকল হাদীস আমার কাছে পৌঁছেছে,
তার প্রত্যেকটিতে রুকু’র পূর্বে কুনুত পড়ার কথা এসেছে। আর এটাই সঠিক। কারণ,
সাহীহ মুসলিম গ্রন্থে আনাস থেকে যে সকল রিওয়ায়াত এসেছে তাতে এ্ মিাসয়ালার
স্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। ’আসিম হযরত আনাসকে জিজ্ঞেস করলেনঃ কুনুত রুকু’র
পূর্বে না পরে পড়া উচিত? বললেনঃ রুকু’র পূর্বে। ’আসিম বললেনঃ মানুষের তো
ধারণা রাসূল সা. রুকু’র পরে পড়তেন। আনাস বললেনঃ সে একটা সাময়িক ঘটনা।
কয়েকটি গোত্র মুরতাদ হয়ে যায় এবং বেশ কিছু সাহাবাকে হত্যা করে। এজন্য হযরত
রাসূলে কারীম সা. একমাস রুকু’র পরে কুনুত পড়ে তাদের ওপর বদ দু’আ করেছিলেন।
(মুসনাদে আহমাদ- ৩/১০০, ১১২, ১১৮, ১২৬, ১২৯, ২০৪, ২০৯)
উল্লেখিত আলোচনা
থেকে আমরা দেখতে পেলাম হযরত আনাস কেমন সঠিক সিদ্ধান্তের অধিকারী ছিলেন।
তাঁর ইজতিহাদী মাসয়ালার বিশেষ বৈশিষ্ট্য এই যে, তা অন্যান্য সাহাবার
ইজতিহাদের সাথে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এজন্য তা সঠিক। (দ্রঃ
সীয়ারে আনসার- ১/১৩৭-১৪২)
হযরত আনাসের চারটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য তাঁর
চারিত্রিক সৌন্দর্যকে আরও শোভা দান করেছিল, হুব্বে রাসূল,
ইত্তেবা-ই-সুন্নাত, আমর বিল মা’রূফ ও হক কথা বলা- এগুলিই হলো সেই
বৈশিষ্ঠ্য। হযরত রাসূলে কারীমের সা. প্রতি তাঁর ভালোবাসার চিত্র তো আমরা
তুলে ধরেছি। তিনি যখন মাত্র দশ বছরের এক অবুঝ বালক তখনই রাসূলে সা. প্রতি
এত গভীর মুহাব্বত যে, প্রতিদিন প্রত্যুষে রাসূলের সা. দীদার লাভে তাঁর চোখ
দুটি ধন্য হতো। সেই সুবহে সাদিকের পূর্বে রাতের অন্ধকারে উম্মু সুলাইমের এই
ছেলে শয্যা ত্যাগ করে তাঁর হাবীবের অজুর পানির বন্দোবস্ত করার জন্য মসজিদে
নববীর পথ ধরতেন। যৌবনে তাঁর এই ভালোবাসার কোন সীমা ছিল না। রাসূলুল্লাহর
সা. একটিমাত্র দৃষ্টি আনাসের জন্য চরম আনন্দ ও প্রশান্তি বয়ে নিয়ে আসতো।
রাসূলুল্লাহর সা. ওফাতের পর যদিও তিনি বাহ্যতঃ তাঁর দীদার থেকে বঞ্চিত হন,
তবুও প্রায়ই স্বপ্নে তাঁর দীদার লাভে ধন্য হতেন। সকালে ঘুম থেকে উঠে কাঁদতে
কাঁদতে মানুষের কাছে সেই অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতেন। রাসূলুল্লাহর সা. কথা যখন
তিনি স্মরণ করতেন তখন বড় অস্থির ও কাতর হয়ে পড়তেন। একদিন রাসূলুল্লাহর সা.
চেহারা মুবারক ও দৈহিক গঠনের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন।
তখন শুধু উদাস চাহনিতে রাসূলুল্লাহর সা. জীবদ্দশার সেই সৌভাগ্যে ভরা
দিনগুলির কথা স্মরণ করতে লাগলেন। তিনি যখন রাসূলুল্লাহর সা. খিদমতের কথা
বলতেন, তখন দেখা যেত অকস্মাৎ তাঁর মধ্যে ভাবান্তর ঘটে গেছে। অবলীলাক্রমে
মুখ থেকে বেরিয়ে পড়েছেঃ কিয়ামতের দিন আমি যখন রাসূলুল্লাহর সা. সামনে
উপস্থিত হবো তখন বলবো, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনার সেই নিকৃষ্ট খাদিম আনাস
উপস্থিত।
হযরত আনাসের প্রতিটি মজলিস হযরত রাসূলে কারীমের সা. ঘটনাবলী
স্মরণে ভরপুর থাকতো। নবুওয়াতের সময়কালের ঘটনাবলী ছাত্র ও ভক্তদের কাছে
বর্ণনা করতেন। এই বর্ণনার মধ্যেই অন্তরে এটা প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করতেন এবং
তাতে তিনি অস্থির হয়ে পড়তেন। তিনি বাড়ী ফিরে যেতেন এবং রাসূলুল্লাহর সা.
যে সকল জিনিস তাঁর কাছে ছিল তা বের করে বার বার দেখতেন এবং মনকে সান্ত্বনা
দিতেন। তাঁর ছাত্রদের সকলের মধ্যে এই রাসূল-প্রেমের প্রভাব পড়েছিল। সাবিত
ছিলেন হযরত আনাসের অন্যতম ছাত্র। তিনি একেবারেই উস্তাদের রংগে রংগিত ছিলেন।
তিনি উস্তাদের নিকট সব সময় নবুওয়াতী যুগ সম্পর্কে প্রশ্ন করতেন। একদিন
প্রশ্ন করলেন, আপনি কি হযরতের পবিত্র হাত স্পর্শ করেছেন? আনাস বললেনঃ হাঁ।
অথবা তিনি বললেনঃ রাসূলুল্লাহর সা. হাত অপেক্ষা অধিকতর কোমল হাত আর কক্ষণও
স্পর্শ করিনি। (আনসাবুল আশরাফ- ১/৪৬৪) একথা শুনে সাবিতের অন্তরে প্রেমের
আগুন জ্বলে উঠলো। তিনি উস্তাদকে বললেনঃ আপনার হাতটি একটু বাড়িয়ে দিন, একটু
চুমু দিই।
প্রকৃত ভালোবাসার দাবী হলো প্রিয়জনের প্রতিটি জিনিস ও আচরণই
পছন্দ করা। হযরত আনাস তা করতেন। তাঁর জীবনের অসংখ্য ঘটনাও একথা প্রমাণ করে।
আনাস বলেনঃ একবার এক দর্জি রাসূলকে সা. আহারের দা’ওয়াত দিল। আমিও সাথে
গেলাম। যবের রুটি এবং শুকনো গোশত ও লাউ-এর তরকারি উপস্থিত করা হলো। আমি
দেখলাম, রাসূল সা. বেছে বেছে লাউ খাচ্ছেন। সেইদিন থেকে আমি লাউ খেতে
ভালোবাসি। (হায়াতুস-সাহাবা- ২/১৯০)
আনাস বলেন, একবার এক ব্যক্তি
রাসূলুল্লাহকে সা. জিজ্ঞেস করলোঃ কিয়ামত কখন হবে? তিনি পাল্টা প্রশ্ন
করলেনঃ তুমি তার জন্য কি প্রস্তুতি নিয়েছ? লোকটি বললোঃ কিছুই না। তবে
আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে মুহাব্বত করি। রাসুল সা. বললেনঃ তুমি যাদের ভালোবাস
তাদের সাথেই থাকবে। আনাস বলেনঃ সেদিন রাসূলুল্লাহর সা. এ কথায় আমরা দারুণ
খুশী হয়েছিলাম। আমি- নবী সা., আবু বকর ও উমারকে ভালোবাসি এবং আশা করি
ভালোবাসার বিনিময়ে আমি তাঁদের সাথেই থাকবো। (হায়াতুস সাহাবা- ২/৩১৮)
কালিমা
তাওহীদের পর ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রুকন নামায। হযরত রাসূলে কারীম
সা. যে খুশু’- খুদু’ (ভয় ও বিনয়) ও আদবের সাথে নামায আদায় করতেন সাহাবীরাও
সেই পদ্ধতি অনুসরণের চেষ্টা করতেন। বহু সাহাবীর নামায তো ছিল প্রায় রাসূলে
পাকের সা. নামাযের কাছাকাছি। তবে রাসূলুল্লাহর সা. নামাযের সাথে আনাসের
নামাযের সাদৃশ্য ছিল বিশেষ বৈশিষ্ট্য মন্ডিত। একবার তো হযরত আবু হুরাইরা
রা. আনাসকে রা. নামায পড়তে দেখে বলেছিলেন, আমি ইবন উম্মে সুলাইমের (আনাস)
নামায অপেক্ষা রাসূলুল্লাহর সা. নামাযের সাথে অধিকতর সাদৃশ্যপূর্ণ আর কারও
নামায দেখিনি।
নামায ছাড়াও রাসূলুল্লাহর সা. প্রতিটি কথা ও কাজ
সাহাবায়ে কিরামের সামনে ছিল। হযরত আনাস দশ বছর যাবত রাসূলুল্লাহর সা.
সার্বক্ষণিক খাদেম ছিলেন। এই সময় কালে রাসূলুল্লাহর সা. কোন কাজ আনাসের
নিকট গোপন থাকতে পারে না। রাসূল সা. যা কিছু বলতেন অথবা ’আমলের মাধ্যমে যা
প্রতিষ্ঠিত করতেন তার সবই আনাস স্মৃতিতে ধরে রাখতেন এবং সেই অনুযায়ী ’আমল
করতেন। একবার খলিফার আমন্ত্রণে তিনি দিমাশকে গেলেন। ফেরার পথে ‘আইনুত
তামার’ নামক স্থানে যাত্রা বিরতির ইচ্ছা করলেন। ছাত্র ও ভক্তদের কাছে সে
খবর পৌঁছে গেল। তারা নির্ধারিত দিনে উক্ত স্থানে সমবেত হলো, লোকালয়ের বাইরে
একটি বিস্তীর্ণ ময়দানের মধ্য দিয়ে তাঁর উট এগিয়ে আসছিল। তখন ছিল নামাযের
সময়। লোকেরা দেখলো, তিনি উটের পিঠে নামাযরত; কিন্তু উটটি কিবলামুখী নয়।
ছাত্ররা বিস্ময়ের সুরে প্রশ্ন করলেনঃ আপনি এ কেমনভাবে নামায আদায় করছিলেন?
হযরত আনাস বললেনঃ আমি যদি রাসূলুল্লাহকে সা. এভাবে নামায আদায় করতে না
দেখতাম, কক্ষণও আদায় করতাম না।
একবার ইবরাহীম ইবন রাবীয়া’ হযরত আনাসের
নিকট আসলেন। হযরত আনাস একখানা কাপড়ের একপাশ পরে অন্য পাশ গায়ে জড়িয়ে নামাযে
মশগুল ছিলেন। নামায শেষ হলে ইবরাহীম জিজ্ঞেস করলেনঃ আপনি এভাবে এক কাপড়ে
নামায পড়েন? আনাস বললেনঃ হাঁ, আমি এভাবে রাসুলকে সা. নামায পড়তে দেখেছিলাম।
উল্লেখ্য যে, হযরত রাসূলে কারীম সা. জীবেনের সর্বশেষ নামায- যে নামায হযরত
আবু বকরের রা. পিছনে পড়েছিলেন, তা এক কাপড়েই ছিল। (মুসনাদ- ৩/১৫৯)
হযরত
রাসূলে কারীমের সা. পবিত্র জীবনের প্রতিটি আচরণ ও পদক্ষেপ ছিল হযরত আনাসের
জীবন পথের দিশারী। ফরজ ছাড়াও ওয়াজিব ও সুন্নাত সমূহেও রাসূলুল্লাহ সা.
ছিলেন তাঁর আদর্শ। তিনি ছোট-বড় সকলকে সালাম করতেন। সব সময় অজু অবস্থায়
থাকতেন। তিনি বলতেন, আমাকে রাসুল সা. বলেছেনঃ আনাস, তুমি যখন ঘর থেকে বের
হবে, তারপর যার সাথে দেখা হবে, সকলকে সালাম করবে। এতে তোমার নেকী বা
মুহাব্বত বৃদ্ধি পাবে। আর সম্ভব হলে সব সময় অজু অবস্থায় থাকবে। কারণ, তুমি
জান না তোমার মৃত্যু কখন আসবে। (আনসাবুল আশরাফ- ১/৪৬৪)
প্রত্যেক সচ্ছল
ব্যক্তির জন্য কুরবানী প্রয়োজন। হযরত আনাস ছিলেন একজন বিত্তশালী রয়িস বা
নেতা। যতগুলি জানোয়ার ইচ্ছা, কুরবানী করতে পারতেন। কিন্তু ‘খায়রুল কুরূন’-
সর্বোত্তম যুগের লোকদের নিকট নাম-কামের চেয়ে রাসূলের সা. পায়রুবী ও অনুসরণ
ছিল সব কিছুর উর্দ্ধে। সে যুগের লোকেরা খ্যাতির জন্য; বরং সাওয়াবের জন্যই
কুরবানী করতেন। হযরত রাসূলে কারীম সা. দুইটি পশু কুরবানী করতেন, এই জন্য
হযরত আনাসও দুইটিই করতেন।
উমাইয়্যা শাসন আমলে হযরত ’উমার ইবন ’আবদিল
’আযীয র. যুবরাজ থাকাকালে একবার মদীনার গভর্ণর ছিলেন। যেহেতু শাহী
খান্দানের সদস্য ছিলেন, এ কারণে জাতীয় জীবনের অনেক কিছুই তাঁর জানা ছিল না।
সে যুগের প্রচলন অনুযায়ী নিজেই নামাযের ইমামতি করতেন এবং মাঝে মধ্যে কিছু
ভুল-ত্রুটিও হয়ে যেত। হযরত আনাস প্রায়ই তাঁর ভুল ধরিয়ে দিতেন। তিনি একবার
হযরত আনাসকে বললেন, আপনি এভাবে আমার বিরোধীতা করেন কেন? হযরত আনাস বললেনঃ
আমি যেভাবে রাসূলুল্লাহকে সা. নামায পড়তে দেখেছি আপনি যদি সেইভাবে নামায
পড়ান তাহলে আমি সন্তুষ্ট হবো। অন্যথায় আপনার পিছনে নামায আদায় করবো না।
হযরত ’উমার ইবন ’আবদিল ’আযীয ছিলেন বুদ্ধিমান ও সৎ স্বভাব- বিশিষ্ট
ব্যক্তি। হযরত আনাসের কথায় তিনি প্রভাবিত হলেন। তিনি আনাসকে উস্তাদ হিসেবে
গ্রহণ করলেন। কিছুদিন তাঁর সাহচর্য ও শিক্ষার প্রভাবে তিনি এমন সুন্দর
নামায পড়াতে লাগলেন যে, খোদ আনাসই বলতে লাগলেন, এই ছেলের নামাযের চেয়ে আর
কারও নামায রাসূলুল্লাহর সা. নামাযের সাথে অধিকতর সাদৃশ্যপূর্ণ নয়।
(হায়াতুস সাহাবা- ৩/১৩৩, ১৩৪)
একবার খলীফা ’আবদুল মালিক হযরত আনাসসহ আরও
চল্লিশজন আনসারী ব্যক্তিকে দিমাশ্কে ডেকে পাঠান। সেখান থেকে ফেরার পথে
‘ফাজ্জুন নাকাহ’ নামক স্থানে পৌঁছলে আসর নামাযের সময় হয়ে যায়। যেহেতু সফর
তখনও শেষ হয়নি, এই কারণে হযরত আনাস দুই রাকা’য়াত নামায পড়ান (কসর করেন)।
তবে কিছু লোক আরও দুই রাকা’য়াত পড়ে চার রাকা’য়াত পুরো করেন। একথা হযরত আনাস
জানতে পেরে দারুণ ক্ষুব্ধ হন এবং বলেন, আল্লাহ যখন কসরের অনুমতি দিয়েছেন
তখন এ সুবিধা গ্রহণ করবে না কেন? আমি রাসূলকে সা. বলতে শুনেছি, এমন একটি
সময় আসবে যখন মানুষ দ্বীনের ব্যাপারে অহেতুক বাড়াবাড়ি করবে। আসলে তারা
দ্বীনের প্রকৃত রহস্য সম্পর্কে থাকবে গাফিল।
সত্যকথা বলা এবং সত্যকে
পছন্দ করা ছিল হযরত আনাসের চরিত্রের এক উজ্জ্বল বৈশিষ্ট্য। খিলাফতে রাশেদার
প্রথম দুই খলীফার পর এমন অনেক যুবক সরকারের উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হয় যারা
ইসলামী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত ছিল। এজন্য তাদের অনেক
কাজই কুরআন-সুন্নাহর পরিপন্থী হতো। যে সাহাবায়ে কিরাম জীবনের বিনিময়ে ইসলাম
খরীদ করেছিলেন তাঁরা এটা সহ্য করতে পারতেন না। তাঁরা ভয়-ভীতির উর্ধ্বে উঠে
সব সময় সত্য কথাটি স্পষ্টভাবে বলে দিতেন। হযরত আনাস রাসূলুল্লাহর সা.
ওফাতের পর দীর্ঘ দিন জীবিত ছিলেন। তাঁর দীর্ঘ জীবনে বহু স্বৈরাচারী শাসকের
সাক্ষাৎ লাভ করেছেন যারা প্রকাশ্যে শরীয়াতের প্রতি অবহেলা করতো। হযরত আনাস এ
অবস্থায় চুপ থাকেননি। তিনি প্রকাশ্যে জনসমাবেশে তাদের সতর্ক করে দিতেন।
ইয়াযীদের
সময়ে আবদুল্লাহ ইবন যিয়াদ ছিলেন ইরাকের গভর্ণর। তাঁর নির্দেশে হযরত ইমাম
হুসাইনের পবিত্র মাথা সামনে আনা হলে তিনি হাতের ছড়িটি দিয়ে হযরত হুসাইনের
চোখে টোকা দিয়ে তাঁর সৌন্দর্য সম্পর্কে কিছু অশালীন কটাক্ষ করেন। হযরত আনাস
নিজেকে আর সম্বরণ করতে পারলেন না। ক্রোধে উত্তেজিত হয়ে বললেনঃ এই চেহারা
রাসূলুল্লাহর সা. চেহারার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।
উমাইয়্যা রাজবংশের বিখ্যাত
স্বৈরাচারী গভর্ণর হাজ্জাজ ইবন ইউসুফ আস-সাকাফী নিজের ছেলেকে বসরার কাজী
নিয়োগ করতে চায়। হাদীস শরীফে বিচারক অথবা আমীরের পদের আকাঙক্ষা হবার
নিষেধাজ্ঞা এসেছে। তাই হযরত আনাস হাজ্জাজের এই ইচ্ছার কথা জানতে পেরে বলেনঃ
এমনটি করতে রাসূল সা. নিষেধ করেছেন।
উমাইয়্যা শাসকদের আর এক আমীর হাকাম
ইবন আইউব। তাঁর নৃশংসতা মানুষের সীমা অতিক্রম করে জীব-জন্তু পর্যন্ত পৌঁছে
যায়। একবার হযরত আনাস তাঁর বাড়ীতে গিয়ে দেখেন, মুরগীর পায়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে
তীরের নিশানা বানানো হচ্ছে। তীর লাগলে মুরগীটি ছটফট করছে। হযরত আনাস এ
দৃশ্য দেখে খুবই মর্মাহত হলেন এবং মানুষকে তাদের এ কাজের জন্য ধিক্কার
দিলেন। (সাহীহ মুসলিম- ২/১৫৮)
একবার কিছু লোক জুহরের নামায আদায় করে
হযরত আনাসের সাক্ষাতের জন্য আসে। তিনি তখন চাকরের নিকট অজুর পানি চাইলেন।
লোকেরা জানতে চাইলো, এ কোন নামাযের প্রস্তুতি? বললেনঃ ’আসর নামাযের। এক
ব্যক্তি বললোঃ আমরা তো এখনই ‘জুহর’ পড়ে এলাম। হযরত আনাস আমীর উমরাহের
দ্বীনের প্রতি উদাসীনতা এবং জনগণের দ্বীন সম্পর্কে অজ্ঞতা দেখে দারুণ
ক্ষুব্ধ হলেন। তিনি বললেনঃ এ তো হবে মুনাফিকদের নামায। মানুষ বেকার বসে
থাকবে, তবুও নামাযের জন্য উঠবে না। যখন সূর্য অস্ত যেতে থাকবে তখন খুব
তাড়াতাড়ি মোরগের মত চারটি ঠোকর মেরে দেবে। সেই ঠোকরে আল্লাহর স্মরণ থাকবে
অতি অল্পই।
প্রকৃত দ্বীনদারের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ‘আমর বিল মা’রূফ’-
সৎ কাজের আদেশ দান করা। আর এজন্যই কুরআন মজীদে উম্মাতে মুসলিমাকে সর্বোত্তম
উম্মাত হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। হযরত আনাসের মধ্যে এই গুণটির বিশেষ বিকাশ
ঘটেছিল। একবার ’উবাইদুল্লাহ ইবন যিয়াদের একটি মজলিসে হাউজে কাওসার
প্রসঙ্গে আলোচনা হয়। উবাইদুল্লাহ এর বাস্তবতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেন।
একথা হযরত আনাসের কানে গেল। তিনি সরাসরি উবাইদুল্লাহর দরবারে উপস্থিত হয়ে
তাঁকে প্রশ্ন করেনঃ তোমার এখানে কি ‘হাউজে কাওসার’ প্রসঙ্গে কিছু আলোচনা
হয়েছিল? বললেনঃ হাঁ। কেন, রাসূল সা. কি এ সম্পর্কে কিছু বলেছেন? হযরত আনাস
রা. হাউজে কাওসার সম্পর্কে রাসূলের সা. হাদীস তাঁকে শুনিয়ে ফিরে আসেন।
হযরত
মুস’য়াব ইবন ’উমাইর রা. একজন আনসারী ব্যক্তির ষড়যন্ত্রের রিপোর্ট পেলেন।
এই অপরাধের জন্য তিনি লোকটিকে পাকড়াও করার চিন্তা করলেন। লোকেরা হযরত
আনাসকে কথাটি জানালেন। তিনি সোজা মুস’য়াবের কাছে গিয়ে বললেনঃ রাসূলুল্লাহ
সা. আনসারদের প্রতি ভালো ব্যবহার করার জন্য আমীরদের অসীয়াত করেছেন। তাদের
ভালো লোকদের সাথে উত্তম আচরণ এবং খারাপ লোকদের ক্ষমা করতে বলেছেন। এই হাদীস
শুনা মাত্র মুস’য়াব ইবন ’উমাইর রা. খাট থেকে নীচে নেমে এসে মাটিতে কপাল
ঠেকিয়ে বলেনঃ রাসূলুল্লাহর সা. আদেশের স্থান আমার চোখের ওপর। আমি লোকটিকে
ছেড়ে দিচ্ছি।
সাবিত আন-নাবানী বলেনঃ একদিন আমি বসরার ‘যাবিয়া’ নামক
স্থানে আনাসের সঙ্গে চলছিলাম। এমন সময় আজান শোনা গেল। সাথে সাথে আনাস মন্থর
গতিতে চলতে শুরু করলেন এবং এভাবে আমরা মসজিদে প্রবেশ করলাম। তারপর তিনি
আমাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ
তুমি কি বলতে পার কেন আমি এভাবে হেঁটে মসজিদে
এলাম? তারপর নিজেই বললেনঃ নামাযের জন্য আমার পদক্ষেপ যাতে বেশী হয়, সেই
জন্য। (হায়াতুস সাহাবা- ৩/১০৪)
হযরত আনাস ’ইলম হাসিলের চেয়ে অর্জিত ’ইলম
অনুযায়ী ’আমলের ওপর বেশী জোর দিতেন। তিনি বলতেনঃ যত ইচ্ছা ’ইলম বা জ্ঞান
হাসিল কর। তবে আল্লাহর কসম, ’আমল না করলে সে সব ’ইলমের প্রতিদান দেওয়া হবে
না। তিনি আরও বলতেনঃ প্রকৃত ’আলেমের কাজ বুঝাও সেই অনুযায়ী কাজ করা। আর
মূর্খদের কাজ শুধু বর্ণনা করা। (হায়াতুস সাহাবা- ৩/২৪১, ২৪৪)
তিনি
রাসূলুল্লাহর সা. সুন্নাতের প্রতি অপরিসীম গুরুত্ব দিতেন। এ সম্পর্কে তিনি
রাসূলুল্লাহর সা. হাদীস বর্ণনা করেছেন। রাসূল সা. বলেছেনঃ যে আমার সুন্নাত
ছেড়ে দেবে সে আমার উম্মাতের কেউ নয়। তিনি আরও বলেছেনঃ যে আমার সুন্নাত
অনুসরণ করবে সে আমার দলভুক্ত। (হায়াতুস সাহাবা- ১/৩৫)
হযরত আনাস রা.
রাসূলুল্লাহর সা. ব্যবহৃত বেশ কিছু জিনিস স্মৃতি হিসেবে সংরক্ষণ করেছিলেন,
যেমনঃ জুতো, একটি চাদর, একটি পিয়ালা, তাঁবুর কয়েকটি খুঁটি ইত্যাদি। আনাস
বলতেনঃ আমার মা উম্মু সুলাইম মৃত্যুকালে আমার জন্য রেখে যান রাসূলুল্লাহর
সা. একটি চাদর, একটি পিয়ালা যাতে তিনি পানি পান করতেন, তাঁবুর কয়েকটি খুঁটি
এবং একটি শীলা যা ওপর আমার মা রাসূলুল্লাহর সা. ঘাম মিশিয়ে সুগন্ধি
পিষতেন। (তারিখে ইবন আসাকির- ৩/১৪৪, ১৪৫)
এভাবে হযরত আনাস ইবন মালিক রা.
সম্পর্কে টুকরো টুকরো তথ্য হাদীস ও সীরাতের গ্রন্থ সমূহে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে
যা খুবই চমকপ্রদ এবং মুসলিম সমাজের জন্য কল্যাণকরও বটে।