নাম হানজালা, লকব বা উপাধি ‘গাসীলুল মালায়িকা’ ও তাকী। মদীনার আউস গোত্রের ‘আমর ইবন’ আউফ শাখার সন্তান। পিতার নাম আবু ’আমির ’আমর, মতান্তরে ’আবদু ’আমর, মাতার নাম জানা যায় না। তবে এতটুকু জানা যায় যে, তিনি খাযরাজ নেতা মুনাফিক ’আবদুল্লাহ ইবন ’উবাইয়ের বোন ছিলেন। হানজালার জন্ম ও কৈশোর সম্পর্কে তেমন কোন তথ্য পাওয়া যায় না।
হানজালার পিতা আবূ ’আমির ছিলেন আউস গোত্রের একজন সম্মানিত ও প্রভাবশালী ব্যক্তি। সেই জাহিলী আরবে দ্বীনে হানীফের একজন বিশ্বাসী হিসেবে তিনি নবুওয়াত, রিসালা, কিয়ামাত ইত্যাদি বিশ্বাস করতেন। এই ধর্মীয় বিশ্বাস তাঁকে ‘রুহবানিয়্যাত’ (বৈরাগ্য)- এর দিকে নিয়ে যায় এবং সব রকম পার্থিব নেতৃত্ব ছেড়ে ধর্মীয় নেতৃত্ব অর্জন করেন। জীবনের এক পর্যায়ে গেরুয়া বসন পরিধান করে নির্জনবাস অবলম্বন করেন। একারণে তিনি ‘রাহিব’ (বৈরাগী) হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। (আল-ইসাবা- ১/৩৬১)
এদিকে রাসূলে কারীম সা. নবুওয়াত লাভ করেন এবং মক্কা থেকে মদীনায় হিজরাত করে ইসলামী খিলাফতের ভিত্তি স্থাপন করেন। এতে আবু ’আমির ও ’আবদুল্লাহ ইবন উবাই উভয়ের নেতৃত্বে ভাটা পড়ে। ’আবদুল্লাহ ইবন ’উবাই মুনাফিকী (দ্বিমুখী) নীতি অবলম্বন করে মদীনাতেই বসবাস করতে থাকেন। কিন্তু আবূ ’আমির ততখানি ধৈর্যধরণ করতে পারেননি। তিনি মদীনা ছেড়ে মক্কায় চলে যান এবং সেখানেই বসবাস শুরু করেন। উহুদ যুদ্ধে তিনি কুরাইশ বাহিনীর সাথে যোগ দিয়ে মদীনা আক্রমণে আসেন। একারণে হযরত রাসূলে কারীম সা. তাঁকে ‘ফাসিক’ নামে অভিহিত করেন।
যুদ্ধ শেষে তিনি মক্কায় ফিরে যান এবং সেখানেই বসবাস করতে থাকেন। হিজরী অষ্টম সনে মুসলমানদের দ্বারা মক্কা বিজিত হলে আল্লাহর যমীন তাঁর জন্য আবার সংকীর্ণ হয়ে পড়ে। তিনি মক্কা ছেড়ে রোমান সম্রাট হিরাকলের দরবারে পৌঁছেন এবং সেখানেই হিজরী দশ সনে মারা যান।
এই তো ছিল আবূ ’আমিরের কুফরী বা অবিশ্বাসের চরম অবস্থা। অপর দিকে তাঁর ছেলে হযরত হানজালার ঈমানী মজবুতীর চরম অবস্থাও লক্ষ্যণীয়। তিনি ইসলাম কবুল করে আবেদন জানানঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনি নির্দেশ দিলে আমি আমার পিতা আবূ ’আমিরকে হত্যা করতাম। কিন্তু রাসূল সা. তাঁর এ আবেদন মঞ্জুর করেননি। মুনাফিক সরদার ’আবদুল্লাহ ইবন ’উবাইর ছেলে হযরত ’আবদুল্লাহ রা. তাঁর পিতার ব্যাপারেও অনুরূপ আবেদন জানিয়েছিলেন এবং রাসূল সা. তাঁকেও একইভাবে নিবৃত্ত করেছিলেন।
হযরত হানজালা বদর যুদ্ধে যোগ দেন নি। এর কারণ জানা যায় না। তবে উহুদ যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। আর এটাই ছিল তাঁর ইসলামী জীবনের প্রথম ও শেষ যুদ্ধ।
তিনি স্ত্রী উপগত হয়ে ঘরে শুয়ে আছেন। এমন সময় ঘোষকের কণ্ঠ কানে গেলঃ ‘এক্ষুনি জিহাদে বের হতে হবে।’ জিহাদের ডাক শুনে ‘তাহারাতের’ (পবিত্রতা) গোসলের কথা ভুলে গেলেন। সেই অশুচি অবস্থায় কোষমুক্ত তরবারি হাতে উহুদের প্রান্তরে উপস্থিত হলেন। যুদ্ধ শুরু হলো। তিনি কুরাইশ নেতা আবু সুফইয়ান ইবন হারবের সাথে দ্বন্দ্ব যুদ্ধে লিপ্ত হলেন। তাকে কাবু করে তরবারির আঘাত করবেন, ঠিক সেই সময় নিকট থেকে শাদ্দাদ ইবন আসওয়াদ আল-লায়সী দেখে ফেলে এবং দ্রুত হানজালার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তরবারির এক আঘাতে তাঁর মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন। অনেকে বলেছেন, আবূ সুফইয়ান ও শাদ্দাদ দু’জনে একযোগে তাঁকে হত্যা করেন। তবে ‘রাওদুল আন্ফ’ গ্রন্থকার নাফে’ ইবন আবী নু’ঈম- মাওলা জা’উনা ইবন শা’উবকে হানজালার ঘাতক বলে উল্লেখ করেছেন। (সীরাতু ইবন হিশাম- ২/৭৫, ১২৩)
বদর যুদ্ধে আবূ সুফইয়ানের পুত্র ‘হানজালা’ মুসলিম বাহিনীর হাতে নিহত হয়। তাই উহুদে এই হানজালাকে হত্যার পর সে মন্তব্য করেঃ ‘হানজালার পরিবর্তে হানজালা।’
হযরত হানজালা রা. নামাক অবস্থায় শহীদ হন। শাহাদাতের পর ফিরিশতারা তাঁকে গোসল দেয়। তাই দেখে হযরত রাসূলে কারীম সা. সাহাবীদের বললেন, তোমরা তার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস কর তো ব্যাপার কি? হিশাম ইবন ’উরওয়া বর্ণনা করেছেন। রাসূল সা. হানজালার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেনঃ হানজালার ব্যাপারটি কি? স্ত্রী বললেনঃ হানজালা নাপাক ছিল। আমি তাঁর মাথার একাংশ মাত্র ধুইয়েছি, এমন সময় জিহাদের ডাক তাঁর কানে গেল। গোসল অসম্পূর্ণ রেখেই সেই অবস্থায় বেরিয়ে গেলেন এবং শাহাদাত বরণ করলেন। একথা শুনে রাসূল সা. বললেনঃ এই জন্য আমিক ফিরিশতাদেরকে তাঁকে গোসল দিতে দেখেছি। (আল-ইসতীয়াবঃ আল-ইসাবার টীকা- ১/২৮১; হায়াতুস সাহাবা- ৩/৫৪৪) আর এখান থেকৈই ‘গাসীলুল মালায়িকা’ (ফিরিশতাকুল কর্তৃক গোসলকৃত) লকব বা উপাধিতে ভূষিত হন।
হযরত হানজালা মৃত্যুর সময় ’আবদুল্লাহ নামে এক ছেলে রেখে যান। হযরত রাসুলে কারীমের সা. মদীনায় আগমনের পর এই ’আবদুল্লাহর জন্ম হয় এবং রাসূলে কারীমের সা. ওফাতের সময় তাঁর বয়স হয় মাত্র সাত-আট বছর। পরিণত বয়সে তিনি পিতার সুযোগ্য উত্তরসুরী বলে নিজেকে প্রমাণ করেন। উমাইয়্যা শাসক ইয়াযিদ ইবন মু’য়াবিয়ার কলঙ্কজনক কর্মকান্ডের প্রতিবাদে তাঁর প্রতি কৃত ‘বাই’য়াত’ (আনুগত্যের অঙ্গীকার) প্রত্যাখ্যান তিনি হযরত ’আবদুল্লাহ ইবন যুবায়রের রা. প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। ইয়াযীদের বাহিনী মদীনা আক্রমণ করে। হযরত ’আবদুল্লাহ অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে মদীনাবাসীদের সাথে নিয়ে নিজেই সেনাপতি হিসেবে আক্রমণকারীদের বাধা দেন। অসংখ্য মদীনাবাসী শাহাদাত বরণ করেন। একের পর এক হযরত ’আবদুল্লাহর আট পুত্র ইয়াযীদ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে শহীদ হন। এই হৃদয়বিদারক দৃশ্য হযরত ’আবদুল্লাহ স্বচক্ষে অবলোকন করেন। অবশেষে তিনি নিজেই অগ্রসর হন। উহুদে শাহাদাতপ্রাপ্ত পিতার রক্তরঞ্জিত পোশাক পরে তিনি শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং শাহাদাত বরণ করেন। এ ছিল হিজরী ৬৩ সনের জ্বিলহজ্জ মাসের ঘটনা।
হযরত হানজালার পিতা ‘ফাসিক’ ছিলেন। আর এই ‘ফাসিক’ পিতার সন্তান হানজালা ‘তাকী’ (আল্লাহ ভীরু) উপাধি লাভ করেন। এর দ্বারাই প্রমাণিত হয় যে তিনি কত উন্নত চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। ইবন ’আসাকির বর্ণনা করেছেন, খলীফা ’উমার যখন লোকদের ভাতার ব্যবস্থা করেন তখন হানজালার ছেলে ’আবদুল্লাহর জন্য দুই হাজার দিরহাম নির্ধারণ করেন। হযরত তালহা তাঁর ভাইয়ের ছেলের হাত ধরে খলীফার নিকট নিয়ে গেলেন। খলীফা তাঁর জন্য কিছু কম অংক নির্ধারণ করলেন। তালহা বললেনঃ আমীরুল মুমিনীন। আপনি এই আনসারীকে আমার ভাতীজার চেয়ে বেশি দিলেন? খলীফা বললেনঃ হ্যাঁ। কারণ, তাঁর পিতা হানজালাকে আমি উহুদে অসির নীচে এমনভাবে হারিয়ে যেতে দেখেছি যেমন একটি উট হারিয়ে যায়। (হায়াতুস সাহাবা- ২/২১৮)
একবার আনসারদের দুই গোত্র- আউস ও খাযরাজ নিজেদের গৌরব ও সম্মানের কথা বর্ণনা করছিল। তারা নিজ নিজ গোত্রের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নাম উচ্চারণ করল। আউস গোত্র সর্বপ্রথম উচ্চারণ করল হানজালা ইবন আবী আমিরের পুণ্যময় নামটি। হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত। একবার আউস গোত্রের লোকেরা গর্ব করে বললঃ আমাদের আছে হানজালা- যাঁকে ফিরিশতারা গোসল দিয়েছেন; আসিম ইবন সাবিত- আল্লাহ যাঁর দেহ মৌমাছি ও ভীমরুলের দ্বারা মুশরিকদের হাত থেকে হিফাজত করেছিলেন; খুযায়মা ইবন সাবিত- যাঁর একার সাক্ষ্য দুইজনের সাক্ষ্যের সমান; আর আছে সা’দ ইবন ’উবাদা- যার মৃত্যুতে আল্লাহর ’আরশ কেঁপে উঠেছিল।
(দ্রঃ আল-ইসাবা- ১/৩৬১, আল-ইসতীয়াবঃ আল-ইসাবা টীকা- ১/২৮০-২৮২, সীরাতু ইবন হিশাম- ২/৭৫, ১২৩)