আসল নাম হুজাইফা, ডাকনাম আবু ’আবদিল্লাহ, এবং লকব বা উপাধি ‘সাহিবুস সির’।
গাতফান গোত্রের ’আবস শাখার সন্তান। এজন্য তাঁকে আল- ’আবসীও বলা হয়। পিতার
নাম হুসাইল মতান্তরে হাসাল ইবন জাবির এবং মাতার নাম রাবাহ বিনতু কা’ব ইবন
’আদী ইবন ’আবদিল আশহাল, মদীনার আনসার গোত্র আউসের আবদুল আশহাল শাখার কন্যা।
ইবন হাজার রহ. বলেনঃ এ হুজাইফা একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহাবী। (আল-ইসাবা-
১/৩১৭; আল-ইসতী’য়াবঃ আল-ইসাবার পার্শ্বটীকা- ১/২৭৭)
হুজাইফার পিতা
হুসাইল ছিলেন মূলতঃ মক্কার বনী ’আবস গোত্রের লোক। ইসলামপূর্ব যুগে তিনি নিজ
গোত্রের এক ব্যক্তিকে হত্যা করে মক্কা থেকে পালিয়ে ইয়াসরিবে আশ্রয় নেন।
সেখানে বনী ’আবদুল আশহাল গোত্রের সাথে প্রথমে মৈত্রীচুক্তি, পরে বৈবাহিক
সম্পর্ক স্থাপন করে বসবাস করতে থাকেন। মদীনার আনসার গোত্রসমূহের আদি
সম্পর্ক মূলতঃ ইয়ামানের সাথে। হুসাইল তাদের মেয়ে বিয়ে করায় তাঁর গোত্রের
লোকেরা তাঁর পরিচয় দিত ‘আল-ইয়ামান’ বলে। এজন্য হুজাইফা ইবনুল ইয়ামান বলা
হয়। (দ্রঃ শাজারাতুয্ যাহাব- ১/৪৪; আল-ইসাবা- ১/৩১৭; তাহজীবুত তাহজীব-
২/১৯৩) এ ইয়ামান আবদুল আশহাল গোত্রে যে বিয়ে করেন সেখানে তাঁর
নিম্নোল্লেখিত সন্তানগণ জন্মগ্রহণ করেনঃ ১. হুজাইফা, ২. সা’দ, ৩. সাফওয়ান,
৪. মুদলিজ, ৫. লাইলা। এঁরা ইতিহাসে ইয়ামানে বংশধর নামে খ্যাত।
আল-ইয়ামানের
মক্কায় প্রবেশে যে বাধা ও ভয় ছিল ধীরে ধীরে তা দূর হয়ে যায়। তিনি মাঝে
মধ্যে মক্কা-ইয়াসরিবের মধ্যে যাতায়াত করতেন। তবে বেশী থাকতেন ইয়াসরিবে।
এদিকে হযরত রাসূলে কারীম সা. মক্কায় ইসলামের দা’ওয়াত দিতে শুরু করেন। এক
পর্যায়ে হুজাইফার পিতা আল-ইয়ামান বনী ’আবসের এগারো ব্যক্তিকে সংগে করে
রাসূলুল্লাহর সা. নিকট উপস্থিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। হযরত রাসূলে কারীম
সা. তখনও মক্কা থেকে মদীনায় হিজরাত করেননি। সুতরাং হুজাইফা মূলে দিক থেকে
মক্কার তবে মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন এবং সেখানেই বড় হন। (সুওয়ারুন মিন
হায়াতিস সাহাবা- ৪/১২২)
হযরত হুজাইফার পিতা আল-ইয়ামান মুসলমান হন মক্কায়
ইসলামের প্রথম পর্বে। পিতার সাথে মা-ও ইসলাম গ্রহণ করেন। এভাবে হুজাইফা
মুসলিম পিতা-মাতার কোলে বেড়ে ওঠেন। এবং হযরত রাসূলে কারীমকে সা. দেখার
সৌভাগ্য অর্জনের আগেই মুসলিম হন। ভাই-বোনের মধ্যে শুধু তিনি ও সাফওয়ান এ
গৌরবের অধিকারী হন। মুসলিম হওয়ার পর রাসূলকে সা. একটু দেখার আগ্রহ জন্মে।
দিন দিন এ আগ্রহ তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। তিনি সব সময় যাঁরা রাসূলকে
সা. দেখেছেন, তাঁদের কাছে রাসূলে সা. চেহারা- সুরত ও গুণ-বৈশিষ্ট্য কেমন তা
জানার জন্য প্রশ্ন করতেন। শেষে একদিন সত্যি সত্যি মক্কায় রাসূলুল্লাহর সা.
দরবারে হাজির হন এবং হিজরাত ও নুসরাতের ব্যাপারে তাঁর মতামত জানতে চান।
রাসূল সা. তাঁকে দু’টোর যে কোন একটি বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা দান করেন।
হুজাইফা বলেনঃ রাসূল সা. হিজরাত ও নুসরাত (মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে
অবস্থান)- এর যে কোন একটি বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা দান করেন। আমি নুসরাতকে
বেছে নিলাম। (উসুদুল গাবা- ১/৩৯৪; তাহজীবুত তাহজীব- ২/১৯৩; আল-ইসাবা-
১/৩১৮) অন্য একটি বর্ণনায় এসেছেঃ মক্কার প্রথম সাক্ষাতে তিনি প্রশ্ন করেনঃ
ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমি কি মুহাজির না আনসার? রাসূল সা. জবাব দিলেনঃ তুমি
মুহাজির বা আনসার যে কোন একটি বেছে নিতে পার। তিনি বললেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ!
আমি আনসারই হবো। (সুওয়ারুন মিন হায়াতিস সাহাবা- ৪/১২৩-১২৪)
হযরত রাসূলে
কারীম সা. মক্কা থেকে মদীনায় আসার পর মুওয়াখাত বা দ্বীনী ভ্রাতু-সম্পর্ক
প্রতিষ্ঠার বিধান চালু করেন। তিনি হুজাইফা ও ’আম্মার ইবন ইয়াসিরকে পরস্পরের
দ্বীনী ভাই বলে ঘোষণা করেন। (সীরাতু ইবন হিশাম- ১/৫০৬)
হযরত হুজাইফা
বদর যুদ্ধে যোগদান করেননি। ইবন সা’দ তাঁকে যে সকল সাহাবী বদরে যোগদান
করেননি তাঁদের মধ্যে উল্লেখ করেছেন। (তারীখু ইবন ’আসাকির- ১/৯৪) এ যুদ্ধে
হুজাইফা ও তাঁর পিতার যোগদান না করার কারণ সম্পর্কে তিনি নিজেই বলেছেনঃ
আমার বদরে যোগদানে কোন বাধা ছিল না। তবে আমার আব্বার সাথে আমি তখন মদীনার
বাইরে আমাদের দীনায় ফেরার পথে কুরাইশ কাফিররা পথরোধ করে জিজ্ঞেস করেঃ তোমরা
কোথায় যাচ্ছ? বললামঃ মদীনায়। তারা বললোঃ তাহলে নিশ্চয় তোমরা মুহাম্মাদের
কাছেই যাচ্ছে? আমরা বললামঃ আমরা শুধু মদীনায় যাচ্ছি। তা ছাড়া আমাদের আর কোন
উদ্দেশ্য নেই। অবশেষে তারা আমাদের পথ ছেড়ে দিল। তবে এই অঙ্গীকারের
ভিত্তিতে যে, আমরা মদীনায় গিয়ে কুরাইশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মুহাম্মাদকে সা.
কোনভাবে সাহায্য করবো না। তাদের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে আমরা মদীনায় পৌঁছলাম
এবং রাসূলুল্লাহকে সা. কুরাইশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মুহাম্মাদকে সা. কোনভাবে
সাহায্য করবো না। তাদের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে আমরা মদীনায় পৌঁছলাম এবং
রাসূলুল্লাহকে সা. কুরাইশদের নিকট কৃত অঙ্গীকারের কথা বলে জিজ্ঞেস করলামঃ
এখন আমরা কী করবো? বললেনঃ তোমরা তোমাদের অঙ্গীকার পূরণ কর। আর আমরা তাদের
বিরুদ্ধে বিজয়ের জন্য আল্লাহর সাহায্য চাইবো। (তারীখুল ইসলামঃ যাহাবী-
২/১৫৩; সহীহ মুসলিম- ২/৮৯; তাহজীবুত তাহজীব- ২/১৯৩; আল-ইসাবা- ১/৩১৭)
হযরত
হুজাইফা উহুদ যুদ্ধে তাঁর পিতার সাথে যোগদান করেন। তিনি দারুণ সাহসের সাথে
যুদ্ধ করেন এবং নিরাপদে মদীনায় ফিরে আসেন। তবে তাঁর বৃদ্ধ পিতা শাহাদাত
বরণ করেন। আর সে শাহাদত ছিল স্বপক্ষীয় মুসলিম সৈনিকদের হাতে ঘটনাটি এ রকমঃ
উহুদ
যুদ্ধের সময় তাঁর পিতা আল-ইয়ামান ও সাবিত ইবন ওয়াক্শ বার্ধক্যে উপনীত
হয়েছেন। যুদ্ধের আগে নারী ও শিশুদের একটি নিরাপদ দুর্গে রাখা হয়। আর এই দুই
বৃদ্ধকে রাখ হয় ঐ দুর্গের তত্তাবধানে। যুদ্ধ যখন তীব্র আকার ধারণ করে তখন
আল-ইয়ামান সঙ্গী সাবিতকে বললেনঃ তোমার বাপ নিপাত যাক! আমরা কিসের অপেক্ষায়
বসে আছি? পিপাসিত গাধার স্বল্পায়ুর মত আমাদের সবার আয়ুও শেষ হয়ে এসেছে।
আমরা খুব বেশী হলে আজ অথবা কাল পর্যন্ত বেঁচে আছি। আমাদের কি উচিত নয়,
তরবারি হাতে নিয়ে রাসূলুল্লাহর সা. নিকট চলে যাওয়া? হতে পারে, আল্লাহ তাঁর
নবীর সা. সাথে আমাদের শাহাদাত দান করবেন। তাঁরা দু’জন তরবারি হাতে নিয়ে
দুর্গ ছেড়ে বেয়ে পড়লেন।
এদিকে যুদ্ধের এক পর্যায়ে পৌত্তলিক বাহিনী
পরাজয় বরণ করে প্রাণ নিয়ে পালাচ্ছিল। তখন এক দুরাচারী শয়তান চেচিয়ে বলে
ওঠে, দেখ, মুসলমানরা এসে পেড়েছে। একথা শুনে পৌত্তলিক বাহিনীর একটি দল ফিরে
দাঁড়ায় এবং মুসলমানদের একটি দলের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। আল-ইয়ামান ও সাবিত
দু’দলের তুমুল সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে যান। পৌত্তলিক বাহিনীর হাতে সাবিত
শাহাদাত বরণ করেন। কিন্তু হুজাইফার পিতা আল-ইয়ামান শহীদ হন মুসলমানদের
হাতে। না চেনার কারণে এবং যুদ্ধের ঘোরে এমনটি ঘটে যায়। হুজাইফা কিছু দূর
থেকে পিতার মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে চিৎকার দিয়ে ওঠেনঃ ‘আমার আব্বা, আমার
আব্বা’ বলে। কিন্ত সে চিৎকার কারো কানে পৌঁছেনি। যুদ্ধের শোরগোলে তা
অদৃশ্যে মিলিয়ে যায়। ইতিমধ্যে বৃদ্ধ নিজ সঙ্গীদের তরবারির আঘাতে ঢলে পড়ে
গেছেন। হুজাইফা পিতার মৃত্যু নিশ্চিত হয়ে শুধু একটি কথা উচ্চারণ করেঃ
‘আল্লাহ আমাদের সকলকে ক্ষমা করুন। তিনিই সর্বাধিক দয়ালু।’
হযরত রাসূলে
কারীম সা. হুজাইফাকে তাঁর পিতার ‘দিয়াত’ বা রক্তমূল্য দিতে চাইলে তিনি
বললেনঃ আমার আব্বা তো শাহাদাতেরই প্রত্যাশী ছিলেন, আর তিনি তা লাভ করেছেন।
হে আল্লাহ, তুমি সাক্ষী থাক, আমি তাঁর দিয়াত বা রক্তমূল্য মুসলমানদের জন্য
দান করে দিলাম। রাসূল সা. দারুণ খুশী হলেন। (দ্রঃ সহীহ বুখারী- ২/৫৮১;
সীরাতু ইবন হিশাম- ২/৮৭; হায়াতুস সাহাবা- ১/৫১৯; সুওয়ারুন মিন হায়াতিস
সাহাবা- ৪/১২৫-১২৭)
হযরত হুজাইফা খন্দক যুদ্ধে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
পালন করেন। কুরাইশরা এমন তোড়জোড় করে ধেয়ে আসে যে, মদীনায় ভীতি ও ত্রাস
ছড়িয়ে পড়ে। মদীনার চতুর্দিকে বহুদূর পর্যন্ত কুরাইশ বাহিনীর লোকেরা ছড়িয়ে
পড়ে। রাসুল সা. আল্লাহর কাছে দু’আ করেন, আর সেইসাথে মদীনার প্রতিরক্ষার
জন্য খন্দক খনন করেন। একদিন রাতে এক অভিনব ঘটনা ঘটে গেল। আর তা মুসলমানদের
জন্য এক অদৃশ্য সাহায্য ছাড়া আর কিছুই ছিল না। কুরাইশ মদীনার আশে-পাশের
বাগানগুলিতে শিবির সংস্থাপন করে আছে। হঠাৎ এমন প্রচন্ড বাতাস বইতে শুরু
করলো যে, রশি ছিড়ে তাঁবু ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল, হাঁড়ি-পাতিল উল্টে-পাল্টে গেল
এবং হাড় কাঁপানো শীত আরম্ভ হলো। আবু সুফইয়ান বললো, আর উপায় নেই, এখনই
স্থান ত্যাগ করতে হবে। (তাবাকাত- ২/৫০)
হযরত রাসূলে কারীম সা. কুরাইশ
বাহিনী নিয়ে দারুণ দুশ্চিন্তায় ছিলেন তিনি সেই ভয়াল দুর্যোদময় রাতে
হুজাইফার শক্তি ও অভিজ্ঞতার সাহায্য গ্রহণ করতে চাইলেন। তিনি কোন রকম
সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে রাতের অন্ধকারে কাউকে কুরাইশ বাহিনীর অভ্যন্তরে
পাঠিয়ে তাদের খবর সংগ্রহের ইচ্ছা করলেন। আর এ দুঃসাহসী অভিযানের জন্য তিনি
শেষ পর্যন্ত হাজাইফাকে নির্বাচন করেন। এ অভিযান সম্পর্কে সীরাতের
গ্রন্থসমূহে নানা রকম বর্ণনা দেখা যায়। একটি বর্ণনা মতে রাসূল সা. সঙ্গীদের
বললেনঃ ‘যদি কেউ মুশরিকদের খবর নিয়ে আসতে পারে, তাকে আমি কিয়ামতের দিন
আমার সাহচর্যের খোশখবর দিচ্ছি।’ একে তো দারুণ শীত, তার উপর প্রবল বাতাস।
কেউ সাহস পেল না। রাসুল সা. তিনবার কথাটি উচ্চারণ করলেন; কিন্তু কোন দিক
থেকে কোন রকম সাড়া লেন না। চতুর্থবার তিনি হুজাইফার নাম ধরে ডেকে বললেনঃ
‘তুমি যাও, খবর নিয়ে এসো।’ যেহেতু নাম ধরে ডেকেছেন, সুতরাং আদেশ পালন ছাড়া
উপায় ছিল না।
অন্য একটি বর্ণনা মতে হুজাইফা নিজেই বলেনঃ ‘আমরা সে রাতে
কাতারবন্দী হয়ে বসেছিলাম। আবু সুফইয়ান ও মক্কার মুশরিক বাহিনী ছিল আমাদের
উপরের দিকে, আর নীচে ছিল বনী কুরাইজার ইহুদী গোত্র। আমাদের নারী ও শিশুদের
নিয়ে আমরা ছিলাম শঙ্কিত। আর সেইসাথে ছিল প্রবল ঝড়-ঝঞ্ঝা ও ঘোর অন্ধকার। এমন
দুযোর্গপূর্ণ রাত আমাদের জীবনে আর কখনো আসেনি। বাতাসের শব্দ ছিল বাজ পড়ার
শব্দের মত। আর এমন ঘুঁটঘুঁটে অন্ধকার ছিল যে, আমরা আমাদের নিজের আঙ্গুল
পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছিলাম না।
এদিকে মুনাফিক শ্রেণীর লোকেরা একজন একজন
করে রাসূলুল্লাহর সা. নিকট এসে বলতে লাগলোঃ আমাদের ঘর-দোর শত্রুর সামনে
একেবারেই খোলা। তাই একটু ঘরে ফেরার অনুমতি চাই। মূলতঃ অবস্থা সে রকম ছিল
না। কেউ যাওয়ার জন্য অনুমতি চাইলেই তিনি অনুমতি দিচ্ছিলেন। এভাবে যেতে যেতে
শেষ পর্যন্ত আমরা তিন শো বা তার কাছাকাছি সংখ্যক লোক থাকলাম।
এমন সময়
রাসুল সা. উঠে এক এক করে আমাদের সবার কাছে আসতে লাগলেন। এক সময় আমার কাছেও
আসলেন। শীতের হাত থেকে বাঁচার জন্য আমার গায়ে একটি চাদর ছাড়া আর কিছু ছিল
না। চাদরটি ছিল আমার স্ত্রীর, আর তা খুব টেনেটুটে হাঁটু পর্যন্ত পড়ছিল।
তিনি আমার একেবারে কাছে আসলেন। আমি মাটিতে বসে ছিলাম। জিজ্ঞেস করলেনঃ এই
তুমি কে? বললামঃ হুজাইফা। হুজাইফা? এই বলে মাটির দিকে একটু ঝুঁকলেন, যাতে
আমি তীব্র ক্ষুধা ও শীতের মধ্যে উঠে না দাঁড়াই। আমি বললামঃ হাঁ, ইয়া
রাসূলুল্লাহ! তিনি বললেনঃ কুরাইশদের মধ্যে একটি খবর হচ্ছে। তুমি তাদের
শিবিরে যেয়ে আমাকে তাদের খবর এনে দেবে।
আমি বের হলাম। অথচ আমি ছিলাম
সবার চেয়ে ভীতু ও শীতকাতর। রাসূল সা. দু’আ করলেনঃ ‘হে আল্লাহ! সামনে-পিছনে,
ডানে-বামে, উপর-নীচে, সব দিক থেকে তুমি তাকে হিফাজত কর।’ রাসূলুল্লাহর সা.
এ দু’আ শেষ হতে না হতে আমার সব ভীতি দূর হলো এবং শীতের জড়তাও কেটে গেল।
আমি
যখন পিছন ফিরে চলতে শুরু করেছি তখন তিনি আমাকে আবার ডেকে বললেনঃ হুজাইফা!
আমার কাছে ফিরে না এসে আক্রমণ করবে না। বললামঃ ঠিক আছে। আমি রাতের
ঘুঁটঘুঁটে অন্ধকারে চলতে লাগলাম। এক সময় চুপিসারে কুরাইশদের শিবিরে প্রবেশ
করে তাদের সাথে এমনভাবে মিশে গেলাম যেন আমি তাদেরই একজন।
আমার পৌঁছার
কিছুক্ষণ পর আবু সুফইয়ান কুরাইশ বাহিনীর সামনে ভাষণ দিতে দাঁড়ালেন। বললেনঃ
ওহে কুরাইশ সম্প্রদায়! আমি তোমাদেরকে একটি কথা বলতে চাই। তবে আমার আশঙ্কা
হচ্ছে তা মুহাম্মাদের কাছে পৌঁছে যায় কিনা। তোমরা প্রত্যেকেই নিজের পাশের
লোকটির প্রতি লক্ষ্য রাখ। একথা শোনার সাথে সাথে আমার পাশের লোকটির হাত মুট
করে ধরে জিজ্ঞেস করলামঃ কে তুমি? সে জবাব দিল অমুকের ছেলে অমুক।
আবু
সুফইয়ান বললেনঃ ‘ওহে কুরাইশ সম্প্রদায়! আল্লাহর কসম! তোমরা কোন নিরাপদ গৃহে
নও। আমাদের ঘোড়াগুলি মরে গেছে, উটগুলি কমে গেছে এবং মদীনার ইহুদী গোত্র
বনু কুরাইজাও আমাদের ছেড়ে গেছে। তাদের যে খবর আমাদের কাছে এসেছে তা সুখকর
নয়। আর কেমন প্রচন্ড ঝড়ের মধ্যে পড়েছি, তাও তোমরা দেখছো। আমাদের হাঁড়িও আর
নিরাপদ নয়। আগুনও জ্বলছেনা। সুতরাং ফিরে চলো। আমি চলছি।’ একথা বলে তিনি
উটের রশি খুললেন এবং পিঠে চড়ে বসে তার গায়ে আঘাত করলেন। উট চলতে শুরু করলো।
কোন কিছু ঘটাতে রাসুল সা. যদি নিষেধ না করতেন তাহলে একটি মাত্র তীর মেরে
তাকে হত্যা করতে পারতাম।
আমি ফিরে এলাম। এসে দেখলাম রাসূল সা. তাঁর এক
স্ত্রীর চাদর গায়ে জড়িয়ে নামাযে দাঁড়িয়ে আছেন। নামায শেষ করে তিনি আমাকে
তাঁর দু’পায়ের কাছে টেনে নিয়ে চাদরের এক কোনা আমার গায়ে জড়িয়ে দিলেন। আমি
সব খবর তাঁকে জানালাম। তিনি দারুণ খুশী হলেন এবং আল্লাহ হামদ ও ছানা পেশ
করলেন। হযরত হুজাইফা সে দিন বাকী রাতটুকু রাসূলুল্লাহর সা. সেই চাদর গায়ে
জড়িয়ে সেখানেই কাটিয়ে দেন। প্রত্যুষে রাসূল সা. তাঁকে ডাকেনঃ ইয়া নাওমান-
ওহে ঘুমন্ত ব্যক্তি।’ (দ্রঃ সহীহ মুসলিম- ২/৮৯; তারীখু ইবন আসাকির- ১/৯৮;
সীরাতু ইবন হিশাম- ২/২৩১; হায়াতুস সাহাবা- ১/৩২৮-৩৩০; সুওয়ারুন মিন হায়াতিস
সাহাবা- ৪/১২৯-১৩৬)
একবার কূফার এক লোক হযরত হুজাইফা ইবনুল ইয়ামনকে
বললোঃ আবু ’আবদিল্লাহ! আপনি কি রাসূলুল্লাহকে সা. দেখেছেন? তাঁর সুহবত
সাহচর্য পেয়েছেন? বললেনঃ হাঁ, ভাতিজা। লোকটি আবার প্রশ্ন করলোঃ আপনারা কেমন
আচরণ করতেন? বললেনঃ তাঁর আদেশ পালনের চেষ্টা করতাম। লোকটি বললোঃ আমরা
রাসুলকে সা. পেলে মাটিতে হেঁটে চলতে দিতাম না, কাঁধে করে নিয়ে বেড়াতাম।
তিনি বললেনঃ আমি খন্দকের দিন রাসূলুল্লাহর সা. সাথে নিজেকে দেখেছি। এই বলে
তিনি খন্দকের সেই রাতের ভয়-ভীতি, ঝড় শৈত্য ইত্যাদির এক চিত্র তুলে ধরলেন।
(হায়াতুস সাহাবা- ১/২৬৪)
খন্দক পরবর্তী রাসূলুল্লাহর সা. জীবদ্দশায় বা
তাঁর পরের সকল অভিযানে অংশগ্রহণ করেন। হযরত রাসুলে কারীমের সা. ওফাতের পর
তিনি ইরাকে বসতি স্থাপন করেন। তারপর বিভিন্ন সময় কূফা, নিস্সীবীন ও
মাদায়েনে বসবাস করেন। নিস্সীবীনের ‘আল-জাযীরা’ শহরে একটি বিয়েও করেন।
(উসুদুল গাবা- ১/৩৯৪)
হযরত হুজাইফা যে পারস্যের নিহাওয়ান্দ, দাইনাওয়ার,
হামজান, মাহ্ রায় প্রভৃতি অঞ্চল জয় করেন এবং গোটা ইরাক ও পারস্যবাসীকে
কুরআনের এক পাঠের ওপর সমবেত করেন, একথা খুব কম লোকেই জানে। (আল-ইসতী’য়াব;
আল-ইসাবার টীকা- ১/২৭৮; তাহজীবুত তাহজীব- ২/১৯৩)
ইরাকের বিভিন্ন অঞ্চল
বিজিত হওয়ার পর হযরত ’উমার রা. সেখানকার ভূমি বন্দোবস্ত দেওয়ার সিদ্ধান্ত
নেন। এ কাজের জন্য তিনি দু’জন তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ করেন। ফুরাত নদীর
তীরবর্তী অঞ্চলসমূহে হযরত ’উসমান ইবন হুনাইফ এবং দিজলা নদীর তীরবর্তী
অঞ্চলসমূহে হযরত হুজাইফাকে নিয়োগ করেন। দিজলা তীরবর্তী অঞ্চলের অধিবাসীরা
ছিল ভীষণ দুষ্ট প্রকৃতির। তারা হযরত হুজাইফাকে তার কাজে কোন রকম সাহায্য তো
দূরের কথা বরং নানা রকম বাধার সৃষ্টি করলো। তা সত্ত্বেও তিনি বন্দোবস্ত
দিলেন। এর ফলে সরকারী আয় অনেকটা বেড়ে গেল। এরপর তিনি মদীনায় এসে খলীফা
’উমারের রা সাথে সাক্ষাৎ করলেন। খলীফা তাঁকে বললেনঃ ‘সম্ভবতঃ যমীনের ওপর
অতিরিক্ত বোঝা চাপানো হয়েছে।’ হুজাইফা বললেনঃ আমি অনেক বেশী ছেড়ে দিয়েছি।
(কিতাবুজ খিরাজ- ২১)
হযরত হুজাইফা ইয়ারমুক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
ইয়ারমুক যুদ্ধের বিজয়ের খবর সর্বপ্রথম তিনিই মদীনায় খলীফা ’উমারের নিকট
নিয়ে আসেন। (তারীখু ইবন ’আসাকির- ৪/৯৩,৯৪)
হিজরী ১৮ সনে নিহাওয়ান্দের
ওপর সেনা অভিযান পরিচালনার প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়। অবশ্য আবু ’উবাইদাহ
বলেন, হিজরী ২২ সনে হুজাইফা নিহাওয়ান্দে যান। (তারীখু ইবন আসাকির- ১/১০০)
এই নিহাওয়ান্দের যুদ্ধে পারসিক সৈন্যসংখ্যা ছিল দেড় লাখ। খলীফা হযরত ’উমার
রা. মুসলিম বাহিনীর অধিনায়ক নিয়োগ করেন হযরত নু’মান ইবন মুকাররিনকে। তারপর
তিনি কূফায় অবস্থানরত হযরত হুজাইফাকে একটি চিঠিতে সেখান থেকে একটি বাহিনী
নিয়ে নিহাওয়ান্দের দিকে যাত্রা করার জন্য নির্দেশ দেন। এদিকে খলীফা মুসলিম
মুজাহিদদের প্রতি জারি করা এক ফরমানে বললেন, চারিদিক থেকে মুসলিম সৈন্যরা
যখন এক স্থানে সমবেত হবে তখন প্রত্যেক স্থান থেকে আগত বাহিনীর একজন করে
আমীর থাকবে। আর গোটা বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হবেন, নু’মান ইবন মুকাররিন।
নু’মান যদি শাহাদাত বরণ করেন, হুজাইফা হবেন পরবর্তী আমীর। আর তিনি শহীদ হলে
আমীর হবেন জারীর ইবন ’আবদিল্লাহ আল-বাজালী। এভাবে খলীফা সে ফরমানে একের পর
এক সাতজন সেনাপতির নাম ঘোষণা করেন। হযরত নু’মান নিহাওয়ান্দের অদূরে শিবির
স্থাপন করে বাহিনীর দায়িত্ব বন্টন করেন। সেখানে হযরত হুজাইফাকে দক্ষিণ
ভাগের অফিসার নিয়োগ করা হয।
দু’বাহিনী মুখোমুখি হলো। শত্রুসৈন্য দেড়
লাখ, আর মুসলমান সৈন্য মাত্র তিরিশ হাজার। প্রচন্ড যুদ্ধ হলো। ইতিহাসে এমন
যুদ্ধের নজীর খুব কমই আছে। মুসলিম বাহিনীর এক নম্বর অধিনায়ক নু’মান শাহাদাত
বরণ করলেন। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের পূর্বে তিনিও হুজাইফাকে আমীর নিয়োগের
অসীয়াত করে যান। তাঁর শাহাদাতের পর আশে পাশের সৈনিকরা যখন নতুন আমীরের
সন্ধান করছে তখন হযরত মা’কাল হুজাইফার দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, ইনিই তোমাদের
পরবর্তী আমীর। আশা করা যায়, আল্লাহ তাঁর মাধ্যমে তোমাদের বিজয় দান করবেন।
হযরত
হুজাইফা সেনাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। যুদ্ধ তখন ঘোরতর রূপ ধারণ করেছে।
তিনি পার্শ্ববর্তী লোকদেরকে নু’মানের শাহাদাতের খবর প্রচার করতে নিষেধ করে
দিলেন। আর সাথে সাথে নু’মানের স্থলে ভাই নু’য়াঈমকে দাঁড় করিয়ে দিলেন। যাতে
নু’মানের শাহাদাতে যুদ্ধের ওপর কোন রকম প্রভাব না পড়ে। এ কাজগুলি তিনি
করলেন মুহূর্তের মধ্যে। তারপর তিনি ঝড়ের গতিতে চিরে-ফেঁড়ে পারসিক বাহিনীর
সামনে পৌঁছে চিৎকার দিয়ে বলতে লাগলেনঃ
‘আল্লাহু আকবারঃ সাদাকা ও’য়াদাহ্
আল্লাহ আকবারঃ নাসারা জুনদাহ্’
আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ- তিনি তাঁর অঙ্গীকার পূরণ করেছেন।
আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ- তিনি তাঁর সিপাহীদের সাহায্য করেছেন।
তারপর
তনি নিজের ঘোড়ার লাগাম ধরে টান মেরে শত্রু বাহিনীর দিকে ফিরিয়ে জোরে
চেঁচিয়ে বলতে লাগলেনঃ ‘ওহে মুহাম্মাদের সা. অনুসারীরা! এখানে, এদিকে
জান্নাত তোমাদের স্বাগত জানানোর জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। তোমরা আর দেরী
করোনা।
ওহে বদরের যোদ্ধারা! ছুটে এসো। ওহে খন্দক, উহুদ ও তাবুকের
বীরেরা! সামনে এগিয়ে চলো।’ এভাবে তিনি সেদিন নজীরবিহীন সাহস ও বিজ্ঞতার
পরিচয দান করেন। (দ্রঃ তাবারী- ৫/২৬০১, ২৬০৫, ২৬৩২; যাহাবীঃ তারীখ-
২/৩৯-৪১; রিজালুন হাওলার রাসূল- ১৯৯)
নিহাওয়ান্দে ছিল একটি অগ্নি উপাসনা
কেন্দ্র। তার প্রধান ধর্মগুরু একদিন হুজাইফার নিকট এসে বললেন, যদি আমার
নিরাপত্তার আশ্বাস দেওয়া হয় তাহলে আমি একটি মহামূল্যবান গুপ্ত সম্পদের
সন্ধান দিতে পারি। হযরত হুজাইফা রা. তাঁকে আশ্বাস দিলেন। লোকটি পারস্য
সম্রাটের অতিমূল্যবান মনি-মুক্তা এনে হাজির করলেন। হযরত হুজাইফা রা.
গনীমতের সম্পদের এক পঞ্চমাংশসহ সেই মহামূল্যবান মনি-মুক্তা মদীনায় খলীফা
’উমারের নিকট পাঠিয়ে দিলেন। হযরত ’উমার রা. মনি-মুক্তা দেখে রাগে ফেটে
পড়লেন। ইবন মুলাইকাকে ডেকে বললেন, এক্ষুণি এগুলি নিয়ে যাও। আর হুজাইফাকে
বল, এগুলি বিক্রী করে বিক্রয়লব্ধ অর্থ সৈন্যদের মধ্যে যেন বন্টন করে দেয়।
হযরত হুজাইফা তখন নিহাওয়ান্দের ‘মাহ’ নামক স্থানে অবস্থান করছিলেন। সেখানে
তিনি সেই ধনরত্ন চার কোটি দিরহামে বিক্রী করেন। (তাবারী- ৫/২৬২৭, ২৬৩০)
ইবন
আসাকির বলেন, নিহাওয়ান্দের শাসক বাৎসরিক আট লাখ দিরহাম জিযিয়া দানের
অঙ্গীকার করে হযরত হুজাইফার সাথে সন্ধি করেন। নিহাওয়ান্দের পর তিনি বিনা
বাধায় ‘দায়নাওয়ার’ জয় করেন। হযরত সা’দ ইবন আবী ওয়াক্কাস পূর্বেই এ
দায়নাওয়ার জয় করেছিলেন; কিন্ত অধিবাসীরা বিদ্রোহ করে। তারপর হযরত হুজাইফা
বিনা যুদ্ধে একে একে মাহ্, হামাজান, ও রায় জয় করেন। (তারীখু ইবন ’আসাকির-
১/১০০)
মাহ্- এর অধিবাসীদের সাথে হযরত হুজাইফা রা. যে চুক্তি স্বাক্ষর করেন। তা নিম্নরূপঃ
‘‘হুজাইফা
ইবনুল ইয়ামান মাহবাসীদের জান, মাল ও বিষয়- সম্পত্তির এ নিরাপত্তা দান
করছেন যে, তাদের ধর্মের ব্যাপারে কোন রকম হস্তক্ষেপ করা হবেনা। এবং ধর্ম
ত্যাগের জন্য কোনরূপ জোর-জবরদস্তি করা হবে না। তাদের প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক
ব্যক্তি যতদিন বাৎসরিক জিযিয়া আদায় করবে, পথিকদের পথের সন্ধান দেবে, পথ
চলাচলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, এখানে অবস্থানরত মুসলিম সৈনিকদের একদিন এক
রাত আহার করাবে এবং মুসলমানদের শুভাকাংখী থাকবে, ততদিন তাদের এ নিরাপত্তা
বলবৎ থাকবে। আর যদি তারা এ অঙ্গীকার ভঙ্গ করে বা তাদের আচরণে পরিবর্তন দেখা
দেয়, তাহলে তাদের কোন দায়-দায়িত্ব মুসলমানদের ওপর থাকবে না।’’ হিজরী ১৯
সনের মুহাররাম মাসে এ চুক্তিপত্রটি লেখা হয় এবং তাতে কা’কা’, নু’য়াইম ইবন
মুকাররিন ও মুয়ায়িদ ইবন মুকাররিন সাক্ষী হিসেবে স্বাক্ষর দান করেন।
(তাবারী- ৫/২৬৩৩)
উল্লেখিত অভিযানসমূহ শেষ করে হযরত হুজাইফা তাঁর পূর্বের ভূমি বন্দোবস্তদানকারী অফিসার পদে ফিরে যান। (তাবারী- ৫/২৬৩৮)
বালাজুরীর
বর্ণনা মতে হিজরী ২২ সনে আজারবাইজান অভিযানে হযরত হুজাইফা গোটা বাহিনীর
পতাকাবাহী ছিলেন। তিনি নিহাওয়ান্দ থেকে আজারবাইজানের রাজধানী আরদাবীলে
পৌঁছেন। এখানকার শাসক মাজেরওয়ান, মায়মন্দ, সুরাত, সাব্জ, মিয়াঞ্চ প্রভৃতি
স্থান থেকে একটি বাহিনী সংগ্রহ করে প্রতিরোধের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। অতঃপর
বাৎসরিক আট লাখ দিরহাম জিযিয়া দানের শর্তে সন্ধি করে। হযরত হুজাইফা সেখান
থেকে মুকাম ও রুজাইলার দিকে অগ্রসর হন এবং বিজয় লাভ করেন। ইত্যবসরে মদীনার
খলীফার দরবার থেকে তাঁর বরখাস্তের নির্দেশ হাতে পৌঁছে। তাঁর স্থলে ’উতবা
ইবন ফারকাদকে নিয়োগ করা হয। (তাবারী- ৫/২৮০৬; বিস্তারিত বর্ণনা তারীখে
বালাজুরীতে এসেছে।)
হযরত সা’দ ইবন আবী ওয়াক্কাসের নেতৃত্বে মাদায়েন
বিজিত হওয়ার পর মুসলিম বাহিনী সেখানে অবস্থান করতে থাকে। কিন্তু সেখানকার
আবহাওয়া আরব মুসলমানদের স্বাস্থ্যসম্মত না হওয়ায় খলীফা ’উমার রা. সা’দকে
তাঁর বাহিনী নিয়ে কূফায় চলে যেতে বলেন এবং সেখানে একটি স্বাস্থ্য উপযোগী
স্থান নির্বাচন করে স্থায়ী সেনা ছাওনী তখা শহর পত্তনের নির্দেশ দেন। হযরত
সা’দ রা. শহর পত্তনের জন্য হুজাইফা ইবনুল ইয়ামান ও সালমান ইবন যিয়াদের ওপর
স্থান নির্বাচনের দায়িত্ব অর্পণ করেন। তাঁরা দু’জন গভীরভাবে
পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর একটি স্বাস্থ্যকর স্থান নির্বাচন করেন। আজকের কূফা
শহরটি এ দু’ব্যক্তিরই নির্বাচিত স্থানে অবস্থিত। (রিজালুন হাওলার রাসুল-
২০০)
উল্লেখিত অভিযান সমূহের পর খলীফা হযরত ’উমার রা. তাকে মাদায়েনের
ওয়ালী নিয়োগ করেন। (তারীখু ইবন ’আসাকির- ১/৯৪) একজন নতুন ওয়ালী আসছেন- এ
খবর মাদায়েনবাসীদের কাছে পৌঁছে গেল। নতুন আমীরকে স্বাগত জানানোর জন্য তারা
দলে দলে শহরের বাইরে সমবেত হলো। তারা এ মহান সাহাবীর তাকওয়া, খোদাভীতি,
সরলতা ও ইরাক বিজয়ের অনেক কথা শুনেছিল। তারা তাঁর একটি জাঁকজমকপূর্ণ
কাফিলার সাথে আগমণের প্রতীক্ষায় ছিল। না, কোন কাফিলার সাথে নয়। তারা দেখতে
পেল কিছু দূরে গাধার ওপর সাওয়ার হয়ে দীপ্ত চেহারার এক ব্যক্তি তাদের দিকে
এগিয়ে আসছেন। গাধার পিঠে অতি পুরনো একটি জিন। তার ওপর বসে বাহনের পিঠের
দু’পাশের পা ছেড়ে দিয়ে এক হাতে রুটি ও অন্য হাতে লবণ ধরে মুখে ঢুকিয়ে
চিবোচ্ছেন। আরোহী ধীরে ধীরে জনতার মাঝখানে এসে পড়লেন। তারা ভালো করে তাকিয়ে
দেখে বুঝলো, ইনিই সেই ওয়ালী যার প্রতীক্ষায় তারা দাঁড়িয়ে আছে। এই
প্রথমবারের মত তাদের কল্পনা হোঁচট খেল। পারস্যের কিসরা বা তাঁর পূর্ব থেকে
তাদের দেশে এমন ওয়ালীর আগমণ আর কক্ষণো ঘটেনি।
তিনি চললেন এবং লোকেরাও
তাঁকে ঘিরে পাশাপাশি চললো। তিনি আবাস স্থলে পৌঁছে উপস্থিত জনতাকে তাদের
প্রতি লেখা খলীফার ফরমান পাঠ করে শোনালেন। খলীফা হযরত ’উমারের রা. নিয়ম
ছিল, নতুন ওয়ালী বা শাসক নিয়োগের সময় সেই এলাকার অধিবাসীদের প্রতি বিভিন্ন
নির্দেশ ও ওয়ালীর দায়িত্ব ও কর্তব্য স্পষ্টভাবে বলে দেওয়া। কিন্তু হযরত
হুজাইফার রা. নিয়োগ পত্রে মাদায়েনবাসীর প্রতি শুধু একটি নির্দেশ ছিলঃ
‘তোমরা তাঁর কথা শুনবে ও আনুগত্য করবে।’ তিনি যখন তাদের সামনে খলীফার এ
ফরমান পাঠ করে শোনালেন, তখন চারদিক থেকে আওয়ায উঠলো, বলুন, আপনার কী
প্রয়োজন। আমরা সবই দিতে প্রস্তুত। রাসূলুল্লাহর সা. সাহাবী ও খুলাফায়ে
রাশেদার পদাঙ্ক অনুসরণকারী হযরত হজাইফা বললেনঃ ‘আমার নিজের পেটের জন্য শুধু
কিছু খাবার, আর আমার গাধাটির জন্য কিছু ঘাস-খড় প্রয়োজন। যতদিন এখানে
থাকবো, আপনাদের কাছে শুধু এতটুকুই চাইবো।’ তিনি সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে আরো
বললেনঃ ‘তোমরা ফিতনার স্থানগুলি থেকে দূরে থাকবে। লোকেরা জানতে চাইলো,
ফিতনার স্থানগুলি কি? বললেনঃ আমীর বা শাসকদের বাড়ীর দরযাসমূহ। তোমাদের কেউ
আমীর বা শাসকের কাছে এসে মিথ্যা দ্বারা তার সত্যায়িত করবে এবং তার মধ্যে যা
নেই তাই বলে তার প্রশংসা করবে- এটাই মূলতঃ ফিত্না।’ এ পদে কিছু দিন থাকার
পর কোন এক কারণে খলীফা হযরত ’উমার রা. তাঁকে রাজধানী মদীনায় তলব করেন।
খলীফার ডাকে সাড়া দিয়ে হযরত হুজাইফা রা. যে অবস্থায় একদিন মাদায়েন
গিয়েছিলেন ঠিক একই অবস্থায় মদীনার দিকে যাত্রা করেন। হুজাইফা আসছেন, এ খবর
পেয়ে খলীফা মদীনার কাছাকাছি পথের পাশে এক স্থানে লুকিয়ে থাকেন। নিকটে আসকেই
হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়ান এবং তাঁকে জড়িয়ে ধরে বলেনঃ ‘হুজাইফা, তুমি আমার
ভাই, আর আমিও তোমার ভাই।’ তারপর সেই পদেই তাঁকে বহাল রাখেন।
(দ্রঃ তারীখু ইবন ’আসাকির- ১/১০০; আল-আ’লাম- ২/১৭১; তাহজীবুত তাহজীব-২/১৯৩; উসুদুল গাবা- ১/৩৯২; হায়াতুস সাহাবা- ৩/২৬৬, ২/৭৩)
হযরত
শাহ ওয়ালী উল্লাহ দিহ্লবী রহ. হযরত ইমাম আবু হানীফার রহ. একটি বর্ণনা নকল
করেছেন। হযরত হুজাইফা ইবনুল ইয়ামন রা. মাদায়েন থাকাকালে এক ইহুদী নারীকে
বিয়ে করেন। খবর পেয়ে আমীরুল মুমিনীন ’উমার রা. তাঁকে উক্ত মহিলা থেকে
বিচ্ছিন্ন হওয়ার নির্দেশ দেন। হুজাইফা রা. খলীফাকে প্রশ্ন করেনঃ কিতাবী
নারী বিয়ে করা কি হারাম? জবাবে ’উমার রা. বলেনঃ হুজাইফা! আমি তোমাকে তাকীদ
দিচ্ছি, আমার এ নির্দেশ হাত থেকে রাখার পূর্বেই যেন মহিলাকে বিদায় করে দেয়া
হয়। আমার আশঙ্কা হচ্ছে, তোমার দেখাদেখি অন্য মুসলমানরাও জিম্মী নারীর রূপ ও
গুণের কারণে মুসিলম মহিলাদের ওপর তাদেরকে প্রাধান্য দিতে শুরু করে না দেয়।
আর এমন হলে তা মুসলিম মেয়েদের জন্য একটি মারাত্মক ফিত্না বলে প্রমাণিত
হবে। (ফিক্হে ’উমারঃ শাহ ওয়ালী উল্লাহ দিহলবী, উর্দু অনুবাদ)
মাদায়েনে
ওয়ালী থাকাকালে একবার জনতার উদ্দেশ্যে প্রদত্ত এক ভাষয়ে তিনি বলেনঃ ‘হে
জনমন্ডলী! তোমরা তোমাদের দাসদের ব্যাপারে খোঁজ-খবর রাখ। দেখ, তারা কোথা
থেকে কিভাবে উপার্জন করে তোমাদের নির্ধারিত মজুরী পরিশোধ করছে। কারণ, হারাম
উপার্জন খেয়ে দেহে যে গোশ্ত তৈরী হয় তা কক্ষণো জান্নাতে প্রবেশ করবে না।
আর এটাও জেনে রাখ, মদ বিক্রেতা, ক্রেতা ও তাঁর প্রস্তুতকারক, সকলেই তা
পানকারীর সমান।’ (হায়াতুস সাহাবা- ৩/৪৮২)
হযরত ’উসমানের রা. খিলাফতকালের
পুরো সময়টা এবং হযরত আলীর রা. খিলাফতের কিছু দিন, একটানা এ দীর্ঘ সময় তিনি
মাদায়েনের ওয়ালী পদে আসীন ছিলেন। (আল-ইসাবা- ১/৩১৭) হযরত ’উসমানের
খিলাফতকালে হিজরী তিরিশ সনে হযরত সা’ঈদ ইবন ’আসের সাথে কূফা থেকে খুরাসানের
উদ্দেশ্যে বের হন। ‘তুমাইস নামক বন্দরে শত্রু বাহিনীর সাথে প্রচন্ড সংঘর্ষ
হয়। এখানে সা’ঈদ ইবন ’আস সালাতুল খাওফ (ভীতিকালীন নামায) আদায় করেন। তিনি
নামায পড়ানোর পূর্বে হযরত হুজাইফার নিকট থেকে তার পদ্ধতি জেনে নেন।
(মুসনাদ-৫/৩৮৫; রাবীয়া- ৫/৩৮৩৬-৩৭) এরপর তিনি ‘রায়’- এ যান এবং সেখান থেকে
সালমান ইবন রাবীয়া ও হাবীব ইবন মাসলামার সাথে আরমেনিয়ার দিকে অগ্রসর হন। এ
অভিযানে তিনি কুফী বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ছিলেন। (তাবারী- ৫/২৮৯৩)
হিজরী
৩১ সনে ‘খাকানে খাযার’- এর বাহিনীর সাথে বড় ধরণের একটি সংঘর্ষ হয়। এতে
সালমানসহ প্রায় চার হাজার মুসলিম শহীদ হন। সালমানের শাহাদাতের পর হযরত
হুজাইফা গোটা বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হন। কিন্তু অল্প কিছুদিন পর তাঁকে
অন্যত্র বদলী করা হয় এবং তাঁর স্তলে হযরত মুগীরা ইবন শু’বাকে নিয়োগ করা
হয। হযরত হুজাইফা রা. ‘বাব’- এর ওপর তিনবার অভিযান চালান। (তাবারী- ৫/২৮৯৪)
তৃতীয় হামলাটি ছিল হিজরী ৩৪ সনে। (তাবারী- ৫/২৯৩৬) এ অভিযান ছিল হযরত
’উসমানের রা. খিলাফতের শেষ দিকে। এ সকল অভিযান শেষ করে তিনি মাদায়েনে নিজ
পদে ফিরে আসেন।
মাদায়েনে পৌঁছার পর তিনি হযরত ’উসমানের রা. শাহাদাতের
ঘটনা অবগত হন। খলীফা ’উসমানের রা. শাহাদাতের মাত্র চল্লিশ দিন পর তিনিও
ইনতিকাল করেন। এটা হিজরী ৩৬ সন মুতাবিক ৬৫৮ খ্রীস্টাব্দের ঘটনা। ওয়াকিদী ও
আল-হায়সাম ইবন ’আদী এ ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণ করেছেন। (দ্রঃ আল-ইসাবা- ১/৩১৮;
শাজারাতুয্ যাহাব- ১/৪৪; আল-আ’রাম- ২/১৭১; তারীখু ইবন ’আসাকির- ১/৯৪)
মৃত্যুর
পূর্বে তাঁর মধ্যে এক আশ্চর্য অবস্থার সৃষ্টি হয়। তাঁর সাদাসিধে ভাব আরো
বেড়ে যায় এবং দারুণ ভীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েন। সব সময় কান্নাকাটি করতেন। লোকে এর
কারণ জিজ্ঞেস করলে বলতেন, দুনিয়া ছেড়ে যাওয়ার দুঃখে এ কান্না নয়। কারণ,
মৃত্যু আমার অতি প্রিয়। তবে এ জন্য কাঁদছি যে, মৃত্যুর পর আমার যে কী
অবস্থা হবে এবং আমার পরিণতিই বা কী হবে, তা তো আমার জানা নেই। শেষ নিঃশ্বাস
ত্যাগের পূর্বে তিনি বলেনঃ ‘হে আল্লাহ! তোমার সাক্ষাত আমার জন্য কল্যাণময়
কর। তুমি তো জান আমি তোমায় কত ভালোবাসি।’ (উসুদুল গাবা- ১/৩৯২)
তাঁর
অন্তিম সময় ঘনিয়ে এলে রাতের বেলা কয়েকজন সাহাবী তাঁকে দেখতে গেলেন। হুজাইফা
তাঁদেরকে প্রশ্ন করলেনঃ এটা কোন্ সময়? তাঁরা বললেনঃ প্রভাতের কাছাকাছি
সময়। তিনি বললেনঃ আমি সেই সকালের ব্যাপারে আল্লাহর পানাহ্ চাই যা আমাদের
জাহান্নামে নিয়ে যাবে। এ কথাটি তিনি কয়েকবার উচ্চারণ করলেন। তারপর জিজ্ঞেস
করলেনঃ আপনারা কি কাফন এনেছেন? তাঁরা বললেনঃ হাঁ, এনেছি। বললেনঃ কাফনের
ব্যাপারে বেশী বাড়াবাড়ি করবেন না। কারণ, আল্লাহর কাছে যদি আমার কিছু ভালো
থেকে থাকে তাহলে এ কাফন পরিবর্তন করে দেওয়া হবে, আর যদি খারাপ থাকে এ ভালো
কাফন ছিনিয়ে নেওয়া হবে।
তিনি কাফন দেখতে চাইলে তা দেখানো হলো। যখন
দেখলেন, তা নতুন ও দামী তখন ঠোঁটে একটু বিদ্রুপের হাসি ফুটিয়ে বললেনঃ এ
আমার কাফন নয়। কামিস ছাড়াই দু’প্রস্থ সাদা কাপড়ই আমার জন্য যথেষ্ট। কারণ
কবরে আমাকে বেশী সময় বিরতি দেওয়া হবে না। খুব তাড়াতাড়ি আমাকে তার চেয়ে
ভালো অথবা মন্দ স্থানে স্থানান্তর করা হবে। তারপর দু’আ করলেনঃ ‘হে আল্লাহ!
তুমি জান আমি ধনের পরিবর্তে দারিদ্রকে, ইয্যতের পরিবর্তে জিল্লতীকে এবং
জীবনের পরিবর্তে মৃত্যুকে ভালোবাসতাম।’ তার শেষ কথাটি ছিলঃ ‘অতি আবেগের
সাথে বন্ধু এসেছে, যে অনুশোচনা করবে তার সফলতা নেই।’ (দ্রঃ উসুদুল গাবা-
১/৩৯৩; তারীখু ইবন ’আসাকির- ১/১০৩; রিজালুন হাওলার রাসূল- ২০১; সুওয়ারুন
মিন হায়াতিস সাহাবা- ৪/১৩৮)
তাঁর জানাযায় বহু লোক উপস্থিত ছিল। এক
ব্যক্তি তাঁর প্রতি ইঙ্গিত করে বললো, আমি এই খাটিয়ার ওপর শায়িত ব্যক্তিকে
বলতে শুনেছি, রাসূলসা. যা কিছু বলেছেন তা বর্ণনা করতে কোন দোষ নেই। আর
তোমরা যদি পরস্পর যুদ্ধের দিকে ধাবিত হও তাহলে আমি ঘরে বসে থাকবো। তারপরেও
যদি কেউ সেখানে উপস্থিত হয় তাহলে তাকে বলবো, এগিয়ে এসো, আমার ও তোমার পাপের
বোঝা কাঁধে তুলে নাও। (মুসনাদ- ৫/৩৮৯; হায়াতুস সাহাবা- ২/৪০৪, ৪০৫)
মৃত্যুর
পূর্বে তিনি ’আলীর রা. নিকট বাই’য়াত করার জন্য দুই ছেলেকে অসীয়াত করে যান।
তাঁরা দু’জনই ’আলীর রা. বাই’য়াত করেন এবং সিফ্ফীন যুদ্ধে শাহাদাত বরণ
করেন। (আল-ইসতীয়াবঃ আল-ইসাবার টীকা- ১/২৭৮) হযরত হুজাইফা রা. নিজেও ’আলীর
নিকট বাই’য়াত করেছিলেন বলে বর্ণিত হয়েছে।
আবু ’উবাইদাহ, বিলাল, সাফওয়ান
ও সা’ঈদ নামে তাঁর চার ছেলে ছিল। ‘তাবাকাত’ গ্রন্থকার ইবন সা’দের সময়
মাদায়েনে তাঁর বংশধরগণ জীবিত ছিলেন। (তাবাকাত- ৬/৮) হযরত হুজাইফার দুই
স্ত্রী ছিল বলে প্রসিদ্ধি আছে।
দৈহিক আকৃতিক দিক দিয়ে হযরত হুজাইফাকে
রা. হিজাযী বলে চেনা যেত। মধ্যমাকৃতির একহারা গড়ন এবং সামনের দাঁতগুলি ছিল
অতি সুন্দর। দৃষ্টিশক্তি এতই প্রখর ছিল যে, ভোরের আবছা অন্ধকারেও তীরের
নিশানা (লক্ষ্যস্থল) নির্ভুলভাবে দেখতে পেতেন।
হযরত হুজাইফা রা. ছিলেন
শ্রেষ্ঠ ’আলিম সাহাবীদের একজন। ফিকাহ ও হাদীস ছাড়াও কিয়ামত পর্যন্ত ইসলামে
যে সকল আবর্তন-বিবর্তন হবে সে সম্পর্কেও একজন শ্রেষ্ঠ বিশেষজ্ঞ ছিলেন।
মুনাফিকদের সম্পর্কে তাঁর জানা ছিল অনেকে। এ কারণে তাঁকে রাসূলুল্লাহর সা.
গোপন জ্ঞানের অধিকারী বা ‘সাহিবুস সির’ বলা হতো। হুজাইফা বলেনঃ অতীতে
পৃথিবীতে যা ঘটেছে এবং ভবিষ্যতে কিয়ামত পর্যন্ত যা ঘটবে তা সবই রাসূল সা.
আমাকে বলেছেন। (তাহজীবুত তাহজীব- ২/১৯৩)
একবার তিনি প্রখ্যাত ’আলিম
সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবন মাস’উদের নিকট বসে ছিলেন। আরো অনেকে সেখানে
ছিলেন। আলোচনার এক পর্যায়ে দাজ্জালের কথা উঠলে তিনি বললেন, আমি এ বিষয়ে
তোমাদের থেকে অনেক বেশী জানি। (সহীহ মুসলিম- ২/৫১৪)
একদিন হযরত রাসূলে
কারীম সা. এক ভাষণে সাহাবীদের সামনে কিয়ামত পর্যন্ত পৃথিবীর যাবতীয় ঘটনার
বর্ণনা দান করেন। হযরত হুজাইফার সেই ভাষণটি স্মরণ ছিল। তবে কিছু কথা ভুলে
যান। যখনই কোন ঘটনা ঘটতো তখন সে কথা মনে পড়তো। (সহীহ মুসলিম- ৫/৪৯) তিনি
নিজেই বলেছেন, রাসূল সা. তাঁকে সব ঘটনা অবহিত করেন। শুধু একটি কথা বলা বাকী
চিল। তা হলো, মদীনাবাসীদের মদীনা থেকে বের হওয়ার কারণ কী হবে? (সহীহ
মুসলিম- ৫/৪৯)
’আলকামা বলেনঃ একবার আমি শামে গেলাম। সেখানে আমি এই বলে
দু’আ করলামঃ হে আল্লাহ! আমাকে একজন নেক্কার সঙ্গী দাও। এরপর আমি একজন লোকের
পাশে বসলাম। ঘটনাক্রমে তিনি ছিলেন আবু দারদা রা.। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস
করলেনঃ তুমি কোথাকার লোক? বললামঃ কুফার। তিনি বললেনঃ তোমাদের ওখানে
‘সাহিবুস সির’ বা গোপন রহস্যের অধিকারী ব্যক্তি, যিনি ছাড়া অন্য কেউ সে
রহস্য জানোনা- সেই হুজাইফা কি নেই? (তারীখু ইবন ’আসাকির- ৪/৯৬)
হযরত
হুজাইফা রা. সম্পর্কে একবার হযরত ’আলীকে রা. জিজ্ঞেস করা হলে বললেন, তিনি
তো মুনাফিকদের সম্পর্কে সর্বাধিক জ্ঞানী। অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে- তিনি তো
মুনাফিকদের সম্পর্কে মুহাম্মাদের সা. সাহাবীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী জ্ঞানী।
(তারীখু ইবন ’আসাকির- ৪/৯৭; হায়াতুস সাহাবা- ৩/২৫৭)
আর একবার হুজাইফা
সম্পর্কে হযরত আবু যারকে রা. জিজ্ঞেস করা হলে বললেনঃ তিনি যেমন যাবতীয় জটিল
ও বিস্তারিত বিষয়ে জ্ঞান রাখেন, তেমনিভাবে মুনাফিকদের নামও জানেন।
মুনাফিকদের সম্পর্কে যদি তুমি জানতে চাও তাহলে এ বিষয়ে তাঁকে একজন বিজ্ঞ
ব্যক্তিই পাবে। (তারীখু ইবন ’আসাকির- ৪/৯৭)
সাহাবায়ে কিরাম সাধারণতঃ
রাসূলুল্লাহর সা. নিকট বিভিন্ন ’আমলের ফজীলাত, নামায, রোযা বা এ জাতীয় বিষয়
সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেন। কিন্তু হুজাইফা রা. তা করতেন না। তিনি বলেনঃ
মুহাম্মাদের সা. সাহাবীরা সব সময় ভালো কি, তাই জিজ্ঞেস করতেন। আর আমি
জিজ্ঞেস করতাম, খারাপ কি, তা জানার জন্য। প্রশ্ন করা হলো, কেন এমন করতেন?
বললেনঃ যে খারাপকে জানে সে ভালোর মধ্যে থাকে। অন্য একটি বর্ণনা মতে, তিনি
বলেন, ‘যাতে আমি খারাপের মধ্যে না পড়ি সেই ভয়ে।’ (বুখারী- ২/১০৪৯; তারীখু
ইবন ’আসাকির- ১/১০১; তাহজীবুত তাহজীব- ২/১৯৩)
একবার হযরত ’উমারের রা.
নিকট বহু সাহাবী বসে ছিলেন। তিনি প্রশ্ন করলেনঃ ফিত্না সম্পর্কে কারো কি
কিছু জানা আছে? হুজাইফা বললেনঃ ধন-সম্পদ, পরিবার-পরিজন ও প্রতিবেশীর
ব্যাপারে মানুষের যা কিছু ভুল-ত্রুটি হয়ে যায়, নামায, সাদাকা, আমর বিল
মা’রূফ ও নাহি আনিল মুনকার দ্বারা তার কাফ্ফারা হয়ে যায়। ’উমার বললেনঃ আমার
প্রশ্ন করার উদ্দেশ্য এ নয়। আমাকে সে ফিত্নার কথা বল যা সাগরের মত
বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠবে।’ হুজাইফা বললেনঃ আপনার ও সেই ফিত্নার মধ্যে একটি দরযার
বাধা আছে। এ জন্য আপনার দ্বিধান্বিত হওয়ার কারণ নেই। ’উমার রা. জানতে
চাইলেনঃ দরযা খোলা হবে না ভেঙ্গে ফেলা হবে? বললেনঃ ভেঙ্গে ফেলা হবে। ’উমার
রা. বললেনঃ তাহলে তো আর কক্ষণো থামবে না। হুজাইফা বললেনঃ হাঁ, তাই।
হযরত
হুজাইফা রা. উল্লেখিত ঘটনাটি পরবর্তীকালে অন্য একটি মজলিসে বর্ণনা করলেন।
তখন সেখানে প্রখ্যাত তাবে’ঈ ‘শাকীক’ উপস্থিত ছিলেন। তিনি প্রশ্ন করলেনঃ
’উমার কি দরযা সম্পর্কে জানতেন? বললেনঃ তোমরা যেমন জান দিনের পর রাত হয়,
ঠিক তেমনি তিনিও দরযা সম্পর্কে জানতেন। লোকেরা জিজ্ঞেস করলোঃ দরযার অর্থ
কি? বললেনঃ ’উমার নিজেই। (বুখারী)
হযরত হুজাইফা রা. থেকে এ ধরণের বর্ণনা
পাওয়া যায়। নবুওয়াতের যেসব গোপন কথা তাঁর জানা ছিল তার বেশীল ভাগ ইসলামী
রাজনীতির সাথে সম্পর্কিত। সাহাবীদের মধ্যে তিনি ছাড়া আরো অনেকে এসব গোপন
কথা জানতেন। হুজাইফার রা. বর্ণনা থেকে সে কথা জানা যায়। সহীহ মুসলিমে তাঁর
থেকে বর্ণিত হয়েছেঃ ‘আমি বর্তমান সময় হতে কিয়ামত পর্যন্ত সময়ের সকল ফিত্না
সম্পর্কে জানি। তবে একথা দ্বারা কেউ যেন না বোঝে যে, আমি ছাড়া আর কেউ
বিষয়টি জানতো না। রাসূল সা. এক মজলিসে কথাগুলি বলেছিলেন। ছোট-বড় সকল ঘটনার
সংবাদ দিয়েছিলেন। তবে সেই মজলিসে উপস্থিত লোকদের মধ্যে একমাত্র আমি ছাড়া আজ
আর কেউ বেঁচে নেই।’ (মুসলিম- ২/৩৯৭)
হযরত হুজাইফা রা. মাঝে মাঝে নিজের এ
জ্ঞান কাজে লাগাতেন এবং মুসলিম উম্মাহ্কে তাদের ভবিষ্যত সম্পর্কে সতর্ক
করে দিতেন। একবার ’আমের ইবন হানজালার গৃহে প্রদত্ত এক খুতবায় তিনি বলেনঃ
‘একটি সময়ে কুরাইশরা দুনিয়ার কোন নেক্কার বান্দাহ্কে ছেড়ে দেবে না। তারা
সকলকে ফিত্নায় জড়িয়ে ধ্বংস করে ফেলবে। অতঃপর আল্লাহ তাঁর বান্দাহদের একটি
বাহিনী দিয়ে তাদেরকে একেবারেই নির্মূল করে ফেলবেন।’ লোকেরা বললোঃ আপনি
নিজেও তো একজন কুরাইশী। বললেনঃ আমার করার কী আছে? আমি রাসূলুল্লাহর সা.
নিকট থেকে এমনই শুনেছি। (মুসনাদ- ৫/৩৯০, ৩৯৫, ৪০৪)
একবার হযরত হুজাইফা
বললেনঃ রাসূল সা. আমাদেরকে দু’টি কথা বলেছিলেন। যার একটি আমি দেখেছি, আর
অন্যটির প্রতীক্ষায় আছি। এমন এক সময় ছিল যখন আমি যে আমীরের হাতেই বাই’য়াত
করতাম, তার ব্যাপারে আমার মধ্যে কোন রকম দ্বিধা-সংকোচ দেখা দিতনা। আমি
বিশ্বাস করতাম, তার ব্যাপারে আমার মধ্যে কোন রকম দ্বিধা-সংকোচ দেখা দিতনা।
আমি বিশ্বাস করতাম, সে মুসলিম হলে ইসলামের দ্বারা, আর খ্রীস্টান হলে মুসলিম
কর্মচারী দ্বারা আমাদেরকে শাসন করবে। কিন্তু এখন আমি বাই’য়াতের ব্যাপারে
দ্বিধাবোধ করি। আমার দৃষ্টিতে বাই’য়াতের জন্য যোগ্য ব্যক্তি মাত্র
মুষ্টিমেয় কয়েকজন আছে। আমি কেবল তাদের হাতে বাই’য়াত করতে পারি। (বুখারী)
কিয়ামত
সম্পর্কে তিনি একটি আগাম কথা বলে গেছে। তিনি বলেছেনঃ ‘যতদিন প্রতিটি
গোত্রের মুনাফিকরা তার নেতা না হবে ততদিন কিয়ামত হবে না।’ (আল-ইসতী’য়াব,
আল-ইসাবা- ১/২৭৮) আর একবার তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো, কোন্ ফিত্না সবচেয়ে বড়?
বললেনঃ যদি তোমার সামনে ভালো ও মন্দ দু’টোই পেশ করা হয় আর তুমি কোন্টি
গ্রহণ করবে তা ঠিক করতে না পার, তাহলে সেটাই বড় ফিত্না। (আল-ইসতীয়’য়াবঃ
আল-ইসাবা- ১/২৭৮) আর একবার বললেনঃ মানবজাতির জন্য এমন একটা সময় বা কাল আসবে
যখন কেউ ফিত্না থেকে মুক্তি পাবে না। শুধু তারাই মুক্তি পাবে যারা পানিতে
নিমজ্জমান ব্যক্তির ডাকার মত আল্লাহকে ডাকবে। (হায়াতুস সাহাবা- ৩/৫১৭)
তিনি
সরাসরি রাসূল সা. ও ’উমার রা. থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। (তাহজীবুত
তাহজীব- ২/১৯৩) ‘খুলাসা’ গ্রন্থের লেখক তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা এক শো’র
(১০০) বেশী বলে উল্লেখ করেছেন। যে সকল সাহাবী তাঁর থেকে হাদীস বর্ণনা
করেছেন, তাঁদের মধ্যে খ্যাতিমান কয়েকজনের নামঃ জাবির ইবন আবদিল্লাহ, জুনদুব
ইবন ’আবদিল্লাহ আল-বাজালী, ’আবদুল্লাহ ইবন ইয়াযীদ আল-খুতামী, আবুত তুফাইল,
’আলী ইবন আবী তালিব, ’উমার ইবন খাত্তাব প্রমুখ সাহাবী। (উসুদুল গাবা-
১/৩৯০; তাহজীবুত তাহজীব- ২/১৯৩)
তাবে’ঈদের একটি বিরাট দল তাঁর থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। তাঁদের কয়েকজনের নাম এখানে উল্লেখ করা হলোঃ
কায়স
ইবন আবী-হাযেম, আবু ওয়ায়িল, যায়িদ ইবন ওয়াহাব, রিব’ঈ ইবন খিরাশ, যার ইবন
হুবাইশ, আবু জাবইয়ান, হুসাইন ইবন জুনদুব, সিলা ইবন যুফার, আবু ইদরীস
আল-খাওলানী, ’আবদুল্লাহ ইবন ’উকাইম, সুওয়াইদ ইবন ইয়াযীদ নাখ’ঈ, ’আবদুর
রহমান ইবন ইয়াযীদ, আবদুর রহমান ইবন আবী লাইলা, হাম্মাম ইবন আল-হারেস,
ইয়াযীদ ইবন শুরাইত আত-তাঈমী, বিলাল ইবন হুজাইফা প্রমুখ। (আল-ইসাবা- ১/৩১৮;
আয্-যাহাবী, তারীখ- ২/১৫২; তাহজীবুত তাহজীব- ২/১৯৩)
রাষ্ট্রীয়
গুরুত্বদায়িত্ব পালনের পর তিনি সময় খুব কম পেতেন। তা সত্ত্বেও যখনই সুযোগ
হতো হাদীসের দারস দিতে বসে যেতেন। কূফার মসজিদে দারসের হালকা বসতো এবং তিনি
সেখানে হাদীস বর্ণনা করতেন। (মুসনাদ- ৫/৪০৩) জাবির ইবন ’আবদিল্লাহ বলেনঃ
হুজাইফা রা. আমাদের বলতেন, আমাদের ওপর এই ইলমের দায়িত্ব চাপানো হয়েছে। আমরা
তোমাদের কাছে তো পৌঁছাবো- যদিও তার ওপর আমরা ’আমল না করি। (হায়াতুস
সাহাবা- ৩/২৬৮; কানযুল ’উম্মাল- ৭/২৪)
ছাত্ররা তাঁকে যেমন অতিরিক্ত
ভক্তি ও সম্মান দেখাতো তেমনি ভয়ও পেত। ‘বাশকারী’ একবার মসজিদে এসে দেখেন,
গোটা মজলিস সম্পূর্ণ নীরব এবং একই ব্যক্তির দিকে একাগ্রচিত্তে চেয়ে আছে।
যেন সকলের মাথা কেটে ফেলা হয়েছে। (মুসনাদ- ৫/৩৮৬) ছাত্ররা যে তাঁকে কী
পরিমাণ ভয় ও সম্মানের চোখে দেখতো তা একটি ঘটনা দ্বারা বুঝা যায়। একবার তিনি
হযরত ’উমার রা. সম্পর্কিত ফিত্নার হাদীসটি বর্ণনা করলেন। হাদীসটি ছিল গোপন
রহস্য বিষয়ক ও ইশারা-ইঙ্গিতে পরিপূর্ণ। কিন্তু তার অর্থ জিজ্ঞেস করার
হিম্মত কোন ছাত্রের হলো না। অবশেষে তাঁরা হযরত আবদুল্লাহ ইবন মাস’উদের
যোগ্য ছাত্র ‘মাসরূক’ কে হাদীসটির অর্থ জিজ্ঞেস করার জন্য রাজী করান। তিনি
তা জিজ্ঞেস করেন।
একবার হযরত হুজাইফা রা. মি’রাজের হাদীস বর্ণনা করেছেন।
এমন সময় যার বিন হুবাইশ আসলেন। হুজাইফা বললেনঃ হযরত রাসূলে কারীম সা.
বাইতুল মাকদাসের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেননি। যার বললেনঃ রাসূল সা. ভিতরে
ঢুকেছিলেন এবং নামাযও আদায় করেছিলেন। হুজাইফা বললেনঃ তোমার নাম কি? আমি
তোমাকে চিনি তবে নামটি জানিনে। তিনি নাম বললেনঃ হুজাইফা বললেনঃ রাসুল সা.
যে নামায আদায় করেছিলেন, সেকথা তুমি কিভাবে জানলে? যার বললেনঃ কুরআন থেকে।
হুজাইফা বললেনঃ আয়াতটি পাঠ কর তো। যার সূরা আল-ইসরার সেই আয়াতটি পাঠ করলেন
যাতে মি’রাজের বর্ণনা এসেছে। হুজাইফা বললেনঃ এর মধ্যে নামাযের কথা কোথায়
আছে? যার কোন উত্তর খুঁজে না পেয়ে নিজের ভুল স্বীকার করেন। (মুসনাদ- ৫/৩৮৭)
হাদীস
বর্ণনার ক্ষেত্রে তিনি দারুণ সতর্ক ও সংরক্ষণবাদী ছিলেন। আবদুর রহমান ইবন
আবী লাইলা বলেনঃ আমরা তাঁর কাছে হাদীস শুনতে চাইলে তিনি বর্ণনা করতেন না।
(মুসনাদ- ৫/৩৯৭)
এ কারণে মানুষও সুযোগের অপেক্ষায় থাকতো। যখন কোন ঘটনা
ঘটতো, আর তিনি হাদীস বর্ণনা করতেন তখন গোটা সমাবেশকে অতি গুরুত্বের সাথে
চুপ করানো হতো। (মুসনাদ- ৫/৩৯৭) একবার তিনি ও আবু মাস’উদ একসাথে ছিলেন।
একজন অন্যজনের কাছে হাদীস শুনতে চাইলেন। কিন্তু প্রত্যেকেই বলছিলেন, না,
আপনি বলুন। (মুসনাদ- ৫/৪০৭)
তিনি পার্থিব ভোগ-বিলাসের প্রতি ছিলেন দারুণ
উদাসীন। এ ব্যাপারে তাঁর অবস্থা এমন ছিল যে, মাদায়েনের ওয়ালী থাকাকালেও
তাঁর জীবন যাপনে কোনরূপ পরিবর্তন হয়নি। অনারব পরিবেশ এবং সেইসাথে ইমারাতের
পদে অধিষ্ঠিত থাকা- এত কিছু সত্ত্বেও তাঁর কোন সাজ-সরঞ্জাম ছিল না। বাহনের
জন্য সব সময় একটি গাধা ব্যবহার করতেন। এমন কি জীবনধারণের জন্য ন্যূনতম
খাবার ছাড়া কাছে আর কিছুই রাখতেন না। একবার খলীফা হযরত ’উমার রা. তাঁর কাছে
কিছু অর্থ পাঠালেন। সাথে সাথে তিনি সবই মানুষের মধ্যে বন্টন করে দিলেন।
(উসুদুল গাবা- ১/৩৯২) তবে তিনি দুনিয়া ও আখিরাত সমানভাবে গ্রহণের পক্ষপাতী
ছিলেন। তিনি বলতেনঃ তোমাদের মধ্যে তারাই সর্বোত্তম নয় যারা আখিরাতের জন্য
দুনিয়া ত্যাগ করেছে, আবার তারাও নয় যারা দুনিয়ার জন্য আখিরাত ছেড়ে দিয়েছে।
বরং যারা এখান থেকে কিছু এবং ওখান থেকে কিছু গ্রহণ করে তারাই মূলতঃ সবচেয়ে
ভালো। (রিজালুন হাওলার রাসূল- ২০০; হায়াতুস সাহাবা- ৩/৫১৭)
দুনিয়ার
প্রতি উদাসীনতার সাথে সাথে ইবাদাত-বন্দেগীতে গভীরভাবে মশগুল থাকতেন। একবার
তিনি রাসূলুল্লাহর সা. সাথে সারা রাত নামায আদায় করেন। এর মধ্যে একবারও
‘উহু’ শব্দটি উচ্চারণ করেননি। (মুসনাদ- ৫/৪০০) হুজাইফা রা. বলেনঃ আমি একদিন
রাতে রাসূলুল্লাহর সা. সাথে নামায পড়েছি। তিনি সূরা বাকারাহ দিয়ে শুরু
করলেন। ভাবলাম, এক শো আয়াতের মাথায় হয়তো রুকু’ করবে; কিন্তু তার পরেও পড়ে
যেতে লাগলেন। মনে করলাম, সূরা বাকারাহ্ এক রাকা’য়াতে শেষ করবেন। কিন্তু না,
সূরা নিসা শুরু করলেন। নিসার পর আলে ’ইমরানও শেষ করলেন। তারপরও রুকু’র কোন
লক্ষণ দেখা গেল না। বিভিন্ন সূরা পড়তে লাগলেন। কোন তাসবীহর আয়াত তিলাওয়াত
করছেন, সাথে সাথে সুবহানাল্লাহ পড়ছেন। দু’আর আয়াত এলে দু’আ করছেন, আবার
তা’য়াউজের আয়াত এলে আ’উজুবিল্লাহ পড়ছেন। এক সময় রুকু’তে গেলেন এবং সুবহানা
রাব্বীয়াল ’আজীম পড়তে লাগলেন। সে রুকু’র যেন শেষ নেই। তা ছিল কিয়ামের মতই
দীর্ঘ। এক সময় ‘সামি’য়া আল্লাহু লিমান হামিদা’ বলে উঠে দাড়ালেন এবং রুকু’র
মতই দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকলেন। তারপর সিজদায় গেলেন এবং তাও ছিল কিয়ামের মত
দীর্ঘ। এভাবে নামায শেষ হলে বিষয়টির প্রতি আমি রাসূলুল্লাহর সা. দৃষ্টি
আকর্ষন করলাম। তিনি বললেনঃ তুমি যে আমার পিছনে আছ একথা জানতে পেলে আমি
নামায সংক্ষেপ করতাম। (মুসনাদ-৫/৩৮২, ৩৮৪; হায়াতুস সাহাবা- ৩/৯১)
সর্ব
অবস্থায় সকলকে তিনি আমর বিল মা’রূফ বা ভালো কাজের আদেশ দিতেন। হযরত আবু
মূসা আল-আশ’য়ারী রা. ছিলেন একজন উঁচু স্তরের সম্মানিত সাহাবী। তিনি কাপড়ে
প্রস্রাবের ছিটা লাগার ভয়ে সতর্কতা স্বরূপ বোতলে প্রস্রাব করা শুরু করেন।
হযরত হুজাইফা এ কথা জানতে পেরে তাঁকে বললেনঃ এমন কঠোরতা ঠিক নয়। রাসুল সা.
একবার একটি ঘোড়ার ওপর দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করেন। আমিও তখন তাঁর সাথে। আমি একটু
দূরে সরে যেতে চাইলে বললেন, কাছেই থাক। আমি তাঁর পিঠের কাছেই দাঁড়িয়ে
থাকলাম। (মুসনাদ- ৫/৩৮২)
একবার কিছু লোক এক স্থানে জটলা করে বসে কথা
বলছিল। হুজাইফা তাদের কাছে এসে বললেন, রাসূলের সো. সময়ে এমন জটলা করে কথা
বলা ‘নিফাকের’ (কপটতা) মধ্যে গণ্য করা হতো। (মুসনাদ- ৫/৩৮৪)
একদিন এক
ব্যক্তি মসজিদে এসে খুব তাড়াতাড়ি নামায আদায় করছিল। হযরত হুজাইফা রা. কাছে
এসে বললেন, তুমি কতকাল এভাবে নামায আদায় করছো? লোকটি বললোঃ চল্লিশ বছর।
হুজাইফা বললেন, তোমার এ চবল্লিশ বছরের নামায একেবারে মিছেমিছি হয়ে গেছে।
যদি এভাব নামায আদায় করতে করতে মারা যাও তাহলে সে মরণ দ্বীনে মুহাম্মদীর
ওপর হবে না। তারপর তাকে নামাযের নিয়ম-কানুন শিখিয়ে দিলে বলে, ছোট ছোট সূরাহ
পড়, তবে রুকু’-সিজদা ঠিকমত কর। (মুসনাদ- ৫/৩৮৪; কানযুল ’উম্মাল- ৪/২৩০;
হায়াতুস সাহাবা- ৩/১৮০)
একবার এক ব্যক্তিকে মজলিসের মাঝখানে এসে বসতে দেখে তিনি বললেন, রাসূল সা. এমন ব্যক্তির ওপর লা’নত (অভিশাপ) করেছেন। (মুসনাদ- ৫/৩৯৮)
হযরত
’উসমান রা. যখন মদীনায় বিদ্রোহীদের দ্বারা ঘেরাও অবস্থায় আছেন তখন একবার
রিব’ঈ হযরত হুজাইফার রা. সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে মাদায়েন আসলেন। হুজাইফা
তাঁর কাছে জিজ্ঞেস করলেন, ’উসমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে কারা? রিব’ই
কতিপয় লোকের নাম বললেন। তখন তিনি বললেন, আমি রাসূলুল্লাহর সা. কাছে শুনেছি,
যে ব্যক্তি জামা’য়াত (দল) ছেড়ে দিয়েছে এবং ইমারাত বা নেতৃত্বকে হেয়
প্রতিপন্ন করেছে, আল্লাহর নিকট সে একেবারেই গুরুত্বহীন। (মুসনাদ- ৫/৩৮৭)
সত্যবাদিতা
ছিল তাঁর চরিত্রের বিশেষ গুণ। তাঁর ছাত্র হযরত রিব’ঈ যখন হযরত হুজাইফার
রা. সূ্ত্রে হাদীস বর্ণনা করতেন তখন বলতেনঃ ‘হাদ্দাসানী মান লাম
ইউকাজ্জিব্নী- আমাকে এমন ব্যক্তি এ হাদীস বর্ণনা করেছেন, যিনি আমাকে মিথ্যা
বলেননি।’ তাঁর এ কথা দ্বারা লোকেরা বুঝে যেত যে তিনি হুজাইফা ছাড়া আর কেউ
নন। (মুসনাদ- ৫/৩৮৫, ৪০১)
হযরত রাসূলে কারীমের সা. সাথে তাঁর গভীর
নৈকট্য ও অন্তরঙ্গতা ছিল। বহু ঘটনায় তার প্রমাণ পাওয়া যায়। একবার রাসূল সা.
তাঁর বুকে ঠেস দিয়ে বসেছিলেন। (মুসনাদ- ৫/৩৮৩) আর একবার ইযারের (পাজামা)
সীমা বলতে গিয়ে তাঁর পবিত্র হাত হুজাইফার রা. পায়েল নালা স্পর্শ করেছিল।
(মুসনাদ-৫/৩৮২) খন্দকের সেই দুর্যোগপূর্ণ রাতে মুশরিকদের খবর নিয়ে এলে
রাসুল সা. নিজের কম্বলের একাংশ তাঁর গায়ে জড়িয়ে দেন, টেনে নিজের কাছে বসান।
একরাত নিজের হুজরায় থাকার ব্যবস্থা করেন। (মুসনাদ-৫/৩৯৩) তিনি বিশিষ্ট
সাহাবীদের সাথে বসে রাসূলুল্লাহর সা. নিকট থেকে নানা বিষয়ে ইলম বা জ্ঞান
অর্জন করতেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবন ’উমারের রা. একটি বর্ণনা থেকে একথা জানা
যায়। (সীরাতু ইবন হিশাম- ২/৬৩১)
হযরত রাসূলে কারীমের সা. সাথে তাঁর কতটা
ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল তা আরেকটি ঘটনা দ্বারা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একবার রমজান
মাসে তিনি রাসূলুল্লাহর সা. সাথে নামায আদায় করেন। রাতে রাসূল সা. গোসল
করেন। তখন হুজাইফা রা. পর্দা করে দাঁড়ান। কিন্তু পানি বেঁচে গেল এবং তা
দিয়ে হুজাইফা গোসল করার ইচ্ছা প্রকাশ করলে রাসূল সা. অনুমতি দিলেন। তিনি
গোসল শুরু করলে রাসূল সা. পর্দা করে দাঁড়ালেন। এতে তিনি আপত্তি জানালে
রাসুল সা. বললেনঃ তুমি যেমন আমার পর্দা করেছ, আমিও তেমন তোমার পর্দা করবো
(তারীখু ইবন ’আসাকির- ১/৯৮; হায়াতুস সাহাবা- ২/৬৮৮)
হযরত হুজাইফা ছিলেন
ক্ষমা ও সহনশীলতার মূর্ত প্রতীক। তার পিতাকে যাঁরা ভুলক্রমে হত্যা করেছিল
তিনি তাদের প্রতি উত্তেজিত বা তাদের থেকে প্রতিশোধ গ্রহণের ইচ্ছা ব্যক্ত
করেননি; বরং আল্লাহ তা’য়ালার দরবারে তাদের এ ভুলের মাগফিরাত কামনা করেছেন।
হযরত ’উরওয়া ইবন যুবাইর রহ. বলেনঃ ক্ষমা ও সহনশীলতার গুণটি হযরত হুজাইফার
রা. মধ্যে আমরণ বিদ্যমান ছিল। (বুখারী- ২/৫৮১)
রাসূলুল্লাহর সা. প্রতি
তাঁর আনুগত্যের অবস্থা যে কেমন ছিল তা বুঝা যায় খন্দক যুদ্ধের ঘটনাটি
দ্বারা। সে সময় একজ সাহাবীও শত্রু শিবিরে যেতে সাহস করেনি। কিন্তু তিনি
রাসূলের সা. আদেশ পালনের জন্য জীবন বাজি রেখে সেখানে যান এবং জান্নাতের
সুসংবাদ লাভ করেন।
একবার পথে রাসূলুল্লাহর সা. সাথে তাঁর দেখা হলো।
রাসুল সা. হাত মিলানোর জন্য তাঁর দিকে এগিয়ে গেলে তিনি বললেন, আমি অপবিত্র।
রাসুল সা. বললেনঃ মুমিন ব্যক্তি কখনো নাজাস বা অপবিত্র হয়না। (মুসনাদ-
৫/৩৮৪) অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, রাসূল সা. বলেনঃ একজন মুসলিম যখন তার
ভাইয়ের সাথে হাত মেলায় তখন তাদের দু’জনের গুনাহ গাছের শুকনো পাতার মত ঝরে
পড়ে। (হায়াতুস সাহাবা- ২/৪৯৫) হযরত রাসূলে কারীমের সা. সাথে যখন তাঁর আহার
করার সৌভাগ্য হতো, তিনি কখনো আগে শুরু করতেন না। রাসুল সা. আগে শুরু করতেন।
(মুসনাদ- ৫/৩৮৩)
হযরত রাসূলে কারীমের সা. সাহচর্যে যে দিন আসতেন সেদিন
যুহর, ’আসর, মাগরিব ও ’ইশার নামায তার সাথে আদায় করতেন। মাঝের এ সময়টুকু
সুহবতের সৌভাগ্য অর্জন করতেন। (মুসনাদ- ৫/৩৯২) যখনই সময় ও সুযোগ পেতের
রাসূলুল্লাহর সা. খিদমাত করতেন এবং ওযু-গোসলের পানি এগিয়ে দিতেন। তিনি
বর্ণনা করেছেনঃ একদিন রাসুল সা. ময়লা-আবর্জনা ফেলার স্থলে দাঁড়িয়ে পেশাব
করলেন। তারপর আমার কাছে পানি চাইলেন। আমি পানি এগিয়ে দিলে তিনি ওযু করে
মোযার ওপর মাসেই করলেন। (মুসনাদ- ৫/৩৮২) তিনি এ খবরও দিয়েছেন যে, রাসূল সা.
রাতে যখন নামাযের জন্য উঠতেন তখন মিসওয়াক করতেন। (মুসনাদ- ৫/৩৮২) এ সকল
বর্ণনা দ্বারা বুঝা যায় তিনি সময় ও সুযোগ পেলে সব সময় রাসূলুল্লাহর সা.
আশে-পাশে থাকতেন।
একদিন হুজাইফার রা. সম্মানিত মা ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন,
কতদিন তুমি রাসূলুল্লাহর সা. দরবারে যাওনি? ছেলে সময়-সীমা বলার পর তিনি
ক্ষেপে গিয়ে তাকে বকাঝকা করেন। তখন হুজাইফা মাকে বলেন, মা, আপনি থামুন। আমি
আজই মাগরিবের নামায রাসূলুল্লাহর সা. আদায় করছি এবং তাঁর দ্বারা আমার ও
আপনার মাগফিরাত কামনা করে দু’আ করাচ্ছি। তিনি রাসূলুল্লাহর সা. দরবারে
গেরেন এবং নামায আদায় করলেন। নামায শেষ করে রাসূল সা. বের হলেন। হুজাইফাও
পিছনে পিছনে চলতে লাগলেন। এক সময় রাসুল সা. ঘাড় ফিরিয়ে তাঁকে দেখে বলে
উঠলেনঃ কে, হুজাইফা? আল্লাহ তোমাকে ও তোমাকে মাকে ক্ষমা করুন। (মুসনাদ-
৫/৩৯১; তারীখু ইবন ’আসাকির- ১/৯৫)
হযরত হুজাইফা খুব কমই উত্তেজিত হতেন।
তবে শরী’য়াতের হুকুম যথাযথভাবে পালিত হতে না দেখলে তাঁর রোগের কোন সীমা
থাকতো না। শরী’য়াতের বিন্দুমাত্র এদিক ওদিক হওয়া সহ্য করতেন না। মাদায়েনে
থাকাকালে একবার এক রয়িসের (সর্দার) গৃহে পানি চাইলেন। রয়িস রূপোর পাত্রে
পানি দিলে তিনি ভীষণ ক্ষেপে যান। পাত্রটি রয়িসের হাত থেকে নিয়ে তার গায়ে
ছুড়ে মারেন। তারপর বলেন, আমি কি তোমাকে সতর্ক করে দিইনি যে, রাসুল সা.
সোনা-রূপোর পাত্রের ব্যবহার নিষেধ করেছেন?
এমনিভাবে তিনি সুন্নাতের
হেরফের হওয়া বিন্দুমাত্র পসন্দ করতেন না। একবার বনী উসাইদের আযাদকৃত দাস
আবু সা’ঈদ কিছু খাবার তৈরী করে আবু যার, হুজাইফা ও ইবন মাস’উদকে দা’ওয়াত
দিলেন। তিনজন যখন তাঁর বাড়ী পৌঁছলেন তখন নামাযের সময় হয়েছে। আবু যার
ইমামতির জন্য এগিয়ে গেলে হুজাইফা বলে উঠলেনঃ আবু যার পিছনে সরে এসো।
ইমামতির অগ্রাধিকার গৃহকর্তার। আবু যার বললেনঃ ইবনে মাস’উদ, কথাটি কি
সত্যি? ইবন মাস’উদ বললেনঃ হাঁ। আবু যার পেছনে সরে এলেন। (হায়াতুস সাহাবা-
৩/১৩১)
জাহিলী আরবে কারো মৃত্যু হলে তা খুব ঘটা করে প্রচার করা হতো।
রাসুল সা. এমনটি করতে নিষেধ করেন। হযরত হুজাইফা এত কঠোরভাবে তা পালন করতেন
যে, কেউ মারা গেলে কাউকে সে খবরটি পর্যন্ত দিতে চাইতেন না। তিনি ভয় করতেন,
সেই আগের অবস্থায় আবার ফিরে না আসে। (মুসনাদ- ৫/৪০৬)
তিনি নির্জনতা
পসন্দ করতেন, কিন্তু সেভাবে থাকতে পারতেন না। তিনি বলতেনঃ আমার ইচ্ছা হয়,
বিষয়-সম্পদ দেখা-শুনার মত কেউ থাকলে আমি ঘরের দরযা বন্ধ করে দিতাম। তাহলে
কেউ আমার কাছে ঘেঁষতে পারতো না এবং আমিও মানুষের কাছে যেতাম না। আর এভাবে
আমি আল্লাহর সাথে মিলিত হতাম। (হায়াতুস সাহাবা- ২/৬৪৯)
তিনি ঝগড়া-বিবাদ,
পরনিন্দা, দোষ অন্বেষণ, রক্তপাত ইত্যাদি ধরণের খারাপ কাজ খুবই ঘৃণা করতেন।
একবার তিনি এক ব্যক্তিকে বললেনঃ তুমি কি একজন মস্তবড় পাপীকে হত্যা করতে
পারলে খুশী হবে? সে বললোঃ হাঁ। তিনি বললেনঃ তাহলে তুমি হবে তখন তার চেয়েও
বড় পাপাচারী। (হায়াতুস সাহাবা- ২/৪০৮) এক ব্যক্তি খলীফা হযরত ’উসমানের রা.
কাছে মানুষের নানা কথা পৌঁছে দিত। লোকটি একদিন যখন হুজাইফার রা. সামনে দিয়ে
যাচ্ছিল, তখন লোকেরা বললেঃ এ ব্যক্তি আমীরের নিকট সকল সংবাদ পৌঁছে দেয়।
তিনি বললেনঃ এমন লোক জান্নাতে যেতে পারে না। (মুসনাদ- ৫/৩৮৯)
যায়িদ ইবন
ওয়াহাব বলেনঃ একবার একটি ব্যাপারে কোন এক আমীরের প্রতি মানুষ ক্ষেপে গেল।
হযরত হুজাইফা মসজিদে দারস দিচ্ছিলেন। এমন সময় এক ব্যক্তি মানুষের ভীড় ঠেলে
হুজাইফার রা. মাথার কাছে এসে দাড়িয়ে বললোঃ ‘হে রাসূলুল্লাহর সাহাবী! আপনি
কি মানুষকে ভালো কাজের আদেশ ও মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করবেন না? হুজাইফা রা.
লোকটির উদ্দেশ্য বুঝতে পারলেন। তিনি মাথা সোজা করে তাকে বললেনঃ ’আমর বিল
মা’রূফ ও নাহি ’আনিল মুনকার অতি ভালো কাজ- এতে সন্দেহ নেই। তবে এ জন্য
আমীরের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ সুন্নাত সম্মত নয়। (হায়াতুস সাহাবা- ২/৬৬)
তিনি
সকল শ্রেণীর মানুষের সাথে মিষ্টি-মধুর আলাপ করতেন। কিন্তু বাড়ীতে স্ত্রীর
সাথে কথাবার্তায় ছিলেন একটু কর্কশ। বিষয়টি তিনি নিজেই উপলব্ধি করেন। এ
প্রসঙ্গে তিনি বলছেন, ‘আমি নবীর সা. কাছে এসে বললামঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার
একটি জিহবা আছে, আমার স্ত্রীর প্রতি তা বড় কঠোর। ভয় হচ্ছে, তা আমাকে
জাহান্নামে নিয়ে না যায়। রাসূল সা. বললেনঃ তুমি আল্লাহর কাছে ইসতিগ্ফার
(ক্ষমা চাওয়া) করনা কেন? এই যে আমি, প্রতিদিন শতবার আল্লাহর কাছে ইসতিগফার
করি। (রিজালুন হাওলার রাসুল- ১৯৬; হায়াতুস সাহাবা- ৩/৩১৬)
একবার লোকেরা
বললো, আপনি রাসূলুল্লাহর সা. এমন একজন সাহাবীর নাম বলুন যিনি চলন-বলন,
আকীদা-বিশ্বাস, তথা প্রতিটি বিষয়ে আপনার মত। বললেনঃ এমন ব্যক্তি শুধূ ইবন
মাস’উদ। তবে যতক্ষণ তিনি ঘরের বাইরে থাকেন। ঘরের ভিতরের অবস্থা আমার জানা
নেই। (মুসনাদ- ৫/২৮৯, ৩৯৪)
হযরত ’আলী রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে। রাসুল সা.
বলেছেনঃ ‘আমার পূর্বের নবীদেরকে সাতজন উযীর ও বন্ধু দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু
আমাকে দেওয়া হয়েছে চৌদ্দজন।’ এই বলে তিনি চৌদ্দ জনের নাম উচ্চারণ করেন।
তাদের মধ্যে হুজাইফার নামটিও ছিল। (তারীখু ইবন ’আসাকির- ৪/৯৬)
তিনি সব
সময় হিংসা-বিদ্বেষের উর্ধে থাকার চেষ্টা করতেন। কারো সাথে কোন রকম তিক্ততার
সৃষ্টি হলে তাড়াতাড়ি মিটমাট করে নিতেন। ’আকাবায় অংশগ্রহণকারী কোন এক
সাহাবীর সাথে একটি ব্যাপারে তাঁর তিক্ততার সৃষ্টি হয়। তাদের কথা বলাবলি
বন্ধ হয়ে যায়। হযরত হুজাইফা রা. সবকিছু ভুলে প্রথমে তাঁর সাথে কথা বলেন।
তারপর সে সাহাবীও নিজের আচরণে পরিবর্তন আনতে বাধ্য হন। (মুসনাদ- ৫/৩৯০)
তিনি ছিলেন খুবই সামাজিক ও উদার। খাওয়ার সময় কেউ উপস্থিত হলে তাকেও ডেকে সংগে বসাতেন। (মুসনাদ- ৫/৩৯২)
হযরত
রাসূলে কারীম সা. অন্তিম রোগ শয্যায় শায়িত। সাহাবীরা তাঁর মৃত্যু-পরবর্তী
একজন খলীফা নিয়োগ করে যাওয়ার আবেদন জানান। তিনি তাদের সে আবেদন
প্রত্যাখ্যাত করে যে সব উপদেশ দান করেন তার মধ্যে এ কথাটিও ছিলঃ ‘হুজাইফা
তোমাদেরকে যা বলবে তা মেনে নিবে।’ (তারীখু ইবন ’আসাকির- ৪/৯৬)
খলীফা
হযরত ’উসমান রা. পবিত্র কুরআনের যে স্ট্যান্ডার্ড কপি তৈরী করেন এবং
খিলাফতের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠান, তার নেপথ্যে প্রধান ভূমিকা পালন করেন মূলত”
হযরত হুজাইফা রা.। ইমাম বুখারী হযরত আনাসের রা. একটি বর্ণনা নকল করেছেন।
আনাস বলেন, ‘হুজাইফা ইবনুল ইয়ামান সিরিয়াবাসীদের সাথে ইরাক, আরমেনিয়া ও
আজারবাইজান অভিযানে অংশগ্রহণ করেন। তিনি এ সকল এলাকার নবদীক্ষিত অনারব
মুসলিমদের কুরআন পাঠে তারতম্য লক্ষ্য করে শঙ্কিত হয়ে পড়েন। সেখান থেকে
মদীনায় ফিরে খলীফাকে বললেন, ‘আমি আরমেনিয়া ও আজারবাইজানের লোকদের দেখেছি,
তারা সঠিকভাবে কুরআন পড়তে জানেনা। তাদের কাছে কুরআনের স্ট্যান্ডার্ড কপি
পৌঁছাতে না পারলে ইয়াহুদ ও নাসারার হাতে তাওরাত ও ইনজীলের যে দশা হয়েছে, এ
উম্মতের হাতে কুরআনের দশাও অনুরূপ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’ খলীফা বিশিষ্ট
সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করে হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা. কর্তৃক প্রস্তুতকৃত
‘মাসহাফ’ এনে তার হুবহু নকল করে বিভিন্ন এলাকায় প্রচার করেন। এভাবে পবিত্র
কুরআনের হিফাজতের ব্যাপারে হযরত হুজাইফা রা. পরোক্ষভাবে বিরাট অবদান রাখেন।
(দ্রঃ সহীহ বুখারীঃ জাম’উল কুরআন অধ্যায়; আত-তিব ইয়ান ফী উলুমিল কুরআন-
৫৭)
উল্লেখিত বৈশিষ্ট্যসমূহ ও গুণাবলীর কারণে হযরত ’উমার রা. তাঁকে খুব
সম্মান করতেন। যেহেতু হুজাইফা রাসূলুল্লাহর সা. নিকট থেকে মুনাফিকদের নাম
জেনেছিলেন, তাই সকলে এ ব্যাপারে তাঁরই শরণাপন্ন হতেন। খলীফা ’উমারের রা. তো
অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল কোন মুসলমান মারা গেলে এ কথা জিজ্ঞেস করা যে, হুজাইফা
কি এর জানাযায় শরীক হয়েছে? যদি বলা হতো ‘হ্যাঁ’ তাহলে তিনিও পড়তেন। আর যদি
বলা হতো ‘না’ তাহলে তাঁর সন্দেহ হতো এবং তিনি তার জানাযা পড়তেন না। (উসুদুল
গাবা- ১/৩৯১; শাজারাতুজ জাহাব- ১/৪৪)
একবার খলীফা ’উমার রা. তাঁকে
জিজ্ঞেস করলেনঃ আচ্ছা আমার কর্মকর্তাদের মধ্যে কি কোন মুনাফিক আছে? হুজাইফা
বললেনঃ একজন আছে। খলীফা বললেনঃ আমাকে তার একটু পরিচয় দাও না। বললেনঃ আমি
তা দেব না। হুজাইফা বলেনঃ তবে অল্প কিছু দিনের মধ্যে ’উমার তাকে বরখাস্ত
করেন। সম্ভবতঃ তিনি সঠিক হিদায়াত পেয়েছিলেন। (সুওয়ারুন মিন হায়াতিস সাহাবা-
৪/১৩৬-১৩৭)
হুজাইফা রা. বলেনঃ আমি একদিন মসজিদে বসে আছি। ’উমার রা.
আমার পাশ দিয়ে যেতে যেতে বললেনঃ হুজাইফা, অমুক মারা গেছে, তার জানাযায় চলো।
একথা বলে তিনি চলে গেলেন। মসজিদ থেকে বের হতে যাবেন, এমন সময় পিছন ফিরে
তাকিয়ে দেখেন, আমি নিজ স্থানে বসে আছি। তিনি বুঝতে পেরে আমার কাছে ফিরে এসে
বললেনঃ হুজাইফা, আমি তোমাকে আল্লাহর কসম দিয়ে বলছি, সত্যি করে বল তো আমিও
কি তাদের (মুনাফিকদের) একজন? আমি বললামঃ নিশ্চয়ই না। আপনার পরে আর কাউকে
কক্ষণো আমি এমন সনদ দেব না। (তারীখু ইবন ’আসাকির- ১/৯৭; যাহাবীঃ তারীখ-
২/১৫৩)
একবার খলীফা হযরত ’উমার রা. তাঁর পাশে বসা সাহাবীদের বললেন,
আচ্ছা আপনারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষার কথা একটু বলুন তো! প্রায়
সকলেই বললেন, আমাদের একান্ত ইচ্ছা এই যে, আমরা যদি ধন-রত্নে ভরা একটি ঘর
পেতাম, আর তার সবই আল্লাহর রাস্তায় বিলিয়ে দিতে পারতাম। সবার শেষে ’উমার
রা. বললেন, আমার বাসনা এই যে, আমি যদি আবু ’উবাইদাহ, মুয়াজ ও হুজাইফার রা.
মত মানুষ বেশী বেশী পেতাম, আর তাদের ওপর রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব অর্পণ করতে
পারতাম। একথা বলে তিনি দীনার ভর্তি একটি থলে একজন লোকের হাতে দিয়ে বলেন,
এগুলি হুজাইফার নিকট নিয়ে যাও, আর তাকে বল, খলীফা এগুলি আপনার প্রয়োজনে
খরচের জন্য পাঠিয়েছেন। তাকে আরো বলে দেন, তুমি একটু অপেক্ষা করে দেখে
আসবে, সে দীনারগুলি কি করে। লোকটি থলেটি নিয়ে হুজাইফার নিকট গেল। আর
হুজাইফা সাথে সাথে তা গরীব-মিসকীনের মধ্যে বন্টন করে দিলেন। (দ্রঃ তারীখু
ইবন ’আসাকির- ১/৯৯, ১০০; উসুদুল গাবা- ১/৩৯২; হায়াতুস সাহাবা- ২/২৩৩)
হযরত হুজাইফার রা. এমনি ধরণের অনেক ফজীলাত ও মহত্বের কথা বিভিন্ন গ্রন্থে ছড়িয়ে আছে যা ছোট কোন প্রবন্ধে প্রকাশ করে শেষ করা যাবে না।