আবদুল্লাহ নাম, আবুল আব্বাস কুনিয়াত। পিতা আব্বাস, মাতা উম্মুল ফাদল লুবাবা। কুরাইশ বংশের হাশেমী শাখার সন্তান। রাসূলুল্লাহর সা. চাচাতো ভাই এবং উম্মুল মুমিনীন হযরত মায়মুনা রা. তাঁর আপন খালা।
মহান সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রা. নানা দিক থেকেই সম্মান ও গৌরবের অধিকারী ছিলেন। রক্ত-সম্পর্কের দিক দিয়ে তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহর সা. চাচাতো ভাই। অগাধ জ্ঞান পাণ্ডিত্যের জন্য তিনি আরব জাতি তথা উম্মাতে মুহাম্মাদীর ‘হাবর ও বাহর’ (পূণ্যবান জ্ঞানী ও সমুদ্র) উপাধি লাভ করেছিলেন। তাকওয়া ও পরহিযগারীর তিনি ছিলেন বাস্তব নমুনা। তাঁর সম্পর্কে বলা হয়েছে, তিনি দিনে রোযাদার, রাতে ইবাদাত গোযার এবং রাতের শেষে প্রহরে তাওবাহ ও ইসতিগফারকারী। আল্লাহর ভয়ে তিনি এত বেশী কাঁদতেন যে, অশ্রুধারা তাঁর গণ্ডদ্বয়ে দু’টি রেখার সৃষ্টি করেছিল।
ইনি সেই আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস যাঁকে উম্মাতে মুহাম্মাদীর রাব্বানী (আল্লাহকে জেনেছে এমন জ্ঞানী) বলা হয়েছে। আল্লাহর কিতাব পবিত্র কুরআন সম্পর্কে অধিক জ্ঞানী, তার ব্যাখ্যা ও ভাব সম্পর্কে অধিক পারদর্শী এবং তার রহস্য উপলব্ধির ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন সর্বাধিক যোগ্য ব্যক্তি।
রাসূলুল্লাহর সা. মক্কা থেকে মদীনায় হিজরাতের তিন বছর পূর্বে তিনি মক্কার শিয়াবে আবী তালিবে জন্মগ্রহণ করেন। কুরাইশরা তাঁর গোত্র বনু হাশিমকে বয়কট করার কারণে তারা তখন শিয়াবে আবী তালিবে জীবন যাপন করছিল। রাসূলুল্লাহ সা. ওফাতের সময় তিনি তের বছরের একজন কিশোর মাত্র। এতদসত্ত্বেও তিনি রাসূলুল্লাহর সা. এক হাজার ছ’শ’ ষাটটি বাণী বা হাদীস স্মৃতিতে সংরক্ষণ করে মুসলিম জাতির বিশেষ কল্যাণ সাধন করেন, সহীহুল বুখারী ও সহীহ মুসলিমে যার অনেকগুলিই বর্ণিত হয়েছে। হযরত আবদুল্লাহ পিতা হযরত আব্বাস দৃশ্যতঃ মক্কা বিজয়ের অল্প কিছুদিন পূর্বে হিজরী ৮ম সনে ইসলাম গ্রহণ করেন। ইবন সাদের বর্ণনা মতে উম্মুল মুমিনীন হযরত খাদীজার পর উম্মুল ফাদলই মহিলাদের মধ্যে সর্বপ্রথম ঈমান আনেন। তাই হযরত আবদুল্লাহ জন্মের পর থেকেই তাওহীদের পরিবেশে বেড়ে ওঠেন এবং বুদ্ধি বিবেক হওয়ার পর এক মজবুত ঈমানের অধিকারী মুসলমান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
তাঁর মা প্রখ্যাত সাহাবিয়্যা উম্মুল ফাদল লুবাবা বিনতুল হারিস আল-হিলালিয়্যা আবদুল্লাহ ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর তাঁকে কোলে করে রাসূলুল্লাহর সা. নিকট নিয়ে যায়। রাসূল সা. নিজের পবিত্র মুখ থেকে একটু থু থু নিয়ে শিশু আবদুল্লাহর মুখে দিয়ে তাঁর তাহনীক করেন। এভাবে তার পেটে পার্থিব কোন বস্তু প্রবেশের পূর্বেই রাসূলে পাকের পবিত্র ও কল্যাণময় থু থু প্রবিষ্ট হয়। আর সেইসাথে প্রবেশ করে তাকওয়া ও হিকমাত।
তাঁর পিতা হযরত ’আব্বাস হিজরী ৮ম সনে মক্কা বিজয়ের অল্প কিছুদিন পূর্বে সপরিবারে মদীনায় হিজরাত করেন। আবদুল্লাহর বয়স তখন এগারো বছরের বেশী হবে না। কিন্তু তখনও তিনি অধিকাংশ সময় রাসূলুল্লাহর সা. সাহচর্যে কাটাতেন। একবার বাড়ী ফিরে এসে তিনি বর্ণনা করেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহর সা. নিকট এমন এক ব্যক্তিকে দেখেছি, যাকে আমি চিনিনে।’ হযরত আব্বাস একথা রাসূলুল্লাহর সা. নিকট ব্যক্ত করলে রাসূল সা. আবদুল্লাহকে ডেকে নিজের কোলে বসান এবং মাথায় হাত বুলিয়ে দু’আ করেন; ‘হে আল্লাহ, তাকে বরকত দিন এবং তার থেকে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন।’
সাত বছর থেকেই তিনি রাসূলুল্লাহর সা. সেবা ও খিদমতে আত্মনিয়োগ করেন। অজুর প্রয়োজন হলে তিনি পানির ব্যবস্থা করতেন, নামাযে দাঁড়ালে তাঁর পেছনে দাঁড়িয়ে ইকদেতা করতেন এবং সফরে রওয়ানা হলে তিনি তাঁর বাহনের পেছনে আরোহন করে তাঁর সফরসংগী হতেন। এভাবে ছায়ার ন্যায় তিনি তাঁকে অনুসরণ করতেন এবং নিজের মধ্যে সর্বদা বহন করে নিয়ে বেড়াতেন একটি সজাগ অন্তঃকরণ, পরিচ্ছন্ন মস্তিষ্ক এবং আধুনিক যুগের যাবতীয় রেকর্ডিং যন্ত্রপাতি থেকে অধিক শক্তিশালী একটি স্মৃতিশক্তি।
হযরত আবদুল্লাহ যদিও স্বভাবগতভাবেই ছিলেন শান্তশিষ্ট, বুদ্ধিমান ও চালাক, তবুও তিনি জীবনের যে অধ্যায় রাসূলুল্লাহর সা. সাহচর্য লাভের সুযোগ লাভ করেন মূলতঃ সে বিষয়টি মানুষের জীবনের খেলাধূলার সময়। তিনি স্মৃতিচারণ করেছেনঃ আমি অন্য ছেলেদের সাথে গলিতে, রাস্তা-ঘাটে খেলা করতাম। একদিন পেছনের দিক থেকে রাসূলুল্লাহকে সা. আসতে দেখলাম। আমি তাড়াতাড়ি একটি বাড়ীর দরজার আড়ালে দিয়ে পালালাম। কিন্তু তিনি আমাকে ধরে ফেললেন। আমার মাথায় হাত রেখে বললেনঃ ‘যাও, মুয়াবিয়াকে ডেকে আন।’ মুয়াবিয়া ছিলেন রাসূলুল্লাহর সা. কাতিব বা সেক্রেটারী। আমি দৌড়ে তাঁর কাছে গিয়ে বললামঃ ‘চলুন, রাসূল সা. আপনাকে ডাকছেন।’
উম্মুল মু’মিনীন হযরত মায়মূনা রা. হযরত আবদুল্লাহর খালা হওয়ার কারনে অধিকাংশ সময়ে তাঁর কাছে কাটাতেন। অনেক সময় রাতে তাঁর ঘরেই শুয়ে পড়তেন। এ কারণে খুব নিকট খেলে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে রাসূলুল্লাহর সা. সাহচর্য লাভে তিনি ধন্য হয়েছেন। রাতে রাসূলুল্লাহর সা. সাথে তাহাজ্জুদ নামায আদায় ও তাঁর অজুর পানি এগিয়ে দেওয়ার সুযোগও লাভ করেছেন। একবার হযরত মায়মূনার ঘরে তাহাজ্জুদ নামাযে রাসূলুল্লাহর সা. বাম দিকে দাঁড়িয়ে গেলে তিনি আবদুল্লাহর মাথা ধরে ডান দিকে দাঁড় করিয়ে দেন।
হযরত আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস নিজের ঘটনা এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ একদিন রাসূলুল্লাহ সা. অজু-করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। আমি দ্রুত পানির ব্যবস্থা করে দিলাম। আমার কাজে তিনি খুব খুশী হলেন। নামাযে যখন দাঁড়ালেন তখন আমাকে তাঁর পাশে দাঁড়াবার জন্য ইংগিত করলেন। কিন্তু আমি তাঁর পেছনে দাঁড়ালাম। নামায শেষ করে আমার দিকে ফিরে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আবদুল্লাহ আমার পাশে দাঁড়াতে কিসে তোমাকে বিরত রাখলো?’ বললামঃ ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ আমার দৃষ্টিতে আপনি মহা সম্মানিত এবং আপনি এতই মর্যাদাবান যে, আমি আপনার পাশাপাশি হওয়ার উপযুক্ত বলে মনে করিনি।’ সাথে সাথে তিনি আকাশের দিকে দু’হাত তুলে দু’আ করলেন, ‘আল্লাহুম্মা আতিহিল হিকমাহ্’- ‘আল্লাহ, আপনি তাকে হিকমাত বা বিজ্ঞান দান করুন।’ আর একবার রাতের বেলা রাসূলুল্লাহর সা. অজুর পানি এগিয়ে দিলে তিনি আবদুল্লাহর জন্য দু’আ করেন এই বলেঃ ‘আল্লাহুম্মা ফাক্কিহ্হু ফিদদীন ওয়া আল্লিমহুত তাবীল- হে আল্লাহ, তাকে দ্বীনের ফকীহ বানিয়ে দাও, তাকে তাবীল বা ব্যাখ্যা পদ্ধতি শিখাও।’
আল্লাহ পাক তাঁর প্রিয় নবীর এ দু’আ কবুল করেন এবং হাশেমী বালককে এত অধিক জ্ঞান দান করেন যে, বড় বড় জ্ঞানীদের তিনি ঈর্ষার পাত্রে পরিণত হন। তাঁর অগাঘ জ্ঞান তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার বিচিত্র ঘটনাবলী ইতিহাস ও জীবনী গ্রন্থসমূহে বর্ণিত হয়েছে।
রাসূলুল্লাহর সা. ওফাতের সময় আবদুল্লাহর বয়স মাত্র তের বছর। এর সোয়া দুই বছর পর প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর ইনতিকাল করেন। দ্বিতীয় খলীফা হযরত ’উমারের খিলাফতকালে তিনি যৌবনে পদার্পণ করেন। খলীফা ’উমার রা. তাঁকে স্বীয় সান্নিধ্যে তত্ত্বাবধানে রাখেন। তাকে গুরুত্বপূর্ণ মজলিসে বড় বড় সাহাবীদের সাথে বসার অনুমতি দিতেন। বদরী সাহাবীদের সাথেও বসার অনুমতি তাঁকে দেওয়া হয়। মুহাদ্দিস ইবন আবদিল বার বলেনঃ ‘উমার ইবন আব্বাসকে ভালোবাসতেন এবং তাঁকে সান্নিধ্য দান করতেন।
তৃতীয় খলীফা হযরত উসমানের রা. যুগে হিজরী ২৭ সনে মিসরের ওয়ালী আবদুল্লাহ ইবন আবী সারাহর নেতৃত্বে আফ্রিকায় একটি অভিযান পরিচালিত হয়। হযরত আব্দুল্লাহ মদীনা থেকে একটি বাহিনী নিয়ে এ অভিযানে অংশগ্রহণ করেন এবং মুসলিম পক্ষের দূত হিসাবে আফ্রিকার বাদশাহ জারজীরের সাথে আলোচনা করেন। বাদশাহ তাঁর প্রখর মেধা ও বুদ্ধিমত্তা দেখে মন্তব্য করেনঃ ‘আমার ধারণা, আপনি আরবদের একজন মহাজ্ঞানী ব্যক্তি।’
হিজরী ৩৫ সনে হযরত উসমান রা. বিদ্রোহীদের দ্বারা গৃহবন্দী হলে তিনি আবদুল্লাহকে স্বীয় প্রতিনিধি হিসাবে আমীরে হজ্জ নিয়োগ করে মক্কায় পাঠান। সে বছর তারই নেতৃত্বে হজ্জ অনুষ্ঠিত হয়। হজ্জ থেকে যখন মদীনায় ফিরে আসলেন, মদীনা তখন উত্তপ্ত। খলীফা উসমান রা. বিদ্রোহীদের হাতে শাহাদাত বরণ করেছেন এবং মদীনা বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে। তাঁরা খিলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণের জন্য হযরত আলীকে চাপ দিচ্ছে। হযরত আলী রা. আবদুল্লাহর সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। আবদুল্লাহ পরিস্থিতির বিস্তারিত বিশ্লেষণের পর দয়িত্বভার গ্রহণ না করার জন্য আলীকে রা. পরামর্শ দেন। হযরত আলী দায়িত্ব গ্রহণ করলে যেসব পরিস্থিতির উদ্ভব হবে বলে তিনি ধারণা করেন, পরবর্তীকালে তা সবই সত্যে পরিণত হয়।
উটের যুদ্ধে হযরত আবদুল্লাহ হযরত আীলর পক্ষে হিজাযী বাহিনীর পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন। হযরত আলী তাঁকে বসরার ওয়ালী নিয়োগ করেন। বসরা থেকে একটি বাহিনী নিয়ে তিনি সিফফিনের যুদ্ধে আলীর রা. পক্ষে অংশগ্রহণ করেন। উল্লেখ্য যে, হযরত আলী ও হযরত মুয়াবিয়ার রা. মধ্যে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয। সিফ্ফিনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হযরত আলী রা. হযরত আবদুল্লাহকে তাঁর পক্ষে সালিশ নিযুক্ত করতে চান, কিন্তু অন্যদের আপত্তির কারণে তাঁর সে চাওয়া বাস্তবায়িত হতে পারেনি।
হযরত আলী ও হযরত মুয়াবিয়ার রা. মধ্যে দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের সময় আলীর রা. কিছু সংগী যখন তাঁকে ছেড়ে চলে গেল, তখন আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস আলীকে বললেন, ‘আমীরুল মুমিনীন, আপনি আমাকে তাঁদের কাছে গিয়ে একটু কথা বলার অনুমতি দিন।’ তিনি বললেন, ‘আমি তাদের পক্ষ থেকে আপনার ওপর যে কোন ধরনের বাড়াবাড়ির আশংকা করছি।’ আবদুল্লাহ বললেন, ‘ইনশাআল্লাহ তেমন কিছু হবে না।’
আবদুল্লাহ তাদের কাছে গিয়ে উপলব্ধি করলেন তাদের চেয়ে এত বেশী একাগ্রচিত্তে ইবাদাতে নিমগ্ন অন্য কোন সম্প্রদায় ইতিপূর্বে আর কখনও তাঁর দৃষ্টিগোচর হয়নি। তারা বলল, ‘ইবন আব্বাস, আপনাকে খোশ আমদেদ! তবে আপনি কি জন্য এসেছেন?’ বললেন, ‘আপনাদের সাথে কিছু আলোচনার জন্য।’ তাদের কেউ কেউ বলল, ‘এর সাথে আলোচনার প্রয়োজন নেই।’ তবে কেউ কেউ বলল, ‘ঠিক আছে, বলুন, আপনার কথা আমরা শুনি।’ তিনি বলেলেন, ‘রাসূলুল্লাহর সা. চাচাতো ভাই, তাঁর জামাই এবং তাঁর ওপর প্রথম পর্যায়ে ঈমান পোষণকারী ব্যক্তি অর্থাৎ আলীর প্রতি এমন চরম মনোভাব পোষণ করছেন কেন?’ তারা বলল, ‘আমরা তাঁর তিনটি কাজের বদলা নিতে চাই।’ তিনি বরলেন, ‘সে তিনটি কাজ কি কি?’ তারা বলল,
১. সিফফিনের যুদ্ধক্ষেত্রে আবু মুসা আশয়ারী ও আমর ইবনুল আসকে শালিশ নিযুক্ত করে তিনি আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে মানুষকে বিচারক নিযুক্ত করেছেন।
২. আয়িশা ও মুয়াবিয়ার সাথে তিনি যুদ্ধ করেছেন, কিন্তু তাদের ধন-সম্পদ গণিমাত হিসাবে এবং যুদ্ধবন্দীদেরকে দাস-দাসী হিসাবেও গ্রহণ করেননি।
৩. মুসলমানরা তাঁর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করে তাঁকে আমীর হিসাবে মেনে নেওয়া সত্ত্বেও তিনি ‘আমীরুল মুমিনীন’ উপাধি পরিহার করেছেন।
জবাবে ইবন আব্বাস বললেন,
‘যদি আমি আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের হাদীস থেকে এমন কিছু কথা আপনাদের সামনে পেশ করতে পারি যা আপনারা অস্বীকার করতে পারেন না, তাহলে আপনারা যে বিশ্বাসের ওপর আছেন তা থেকে কি প্রত্যাবর্তন করবেন?’ তাঁরা সম্মতিসূচক জবাব দিলে তিনি বললেন,
‘আপনাদের অভিযোগ, তিনি দ্বীনের ব্যাপারে মানুষকে বিচারক বিযুক্ত করে অপরাধ করেছেন। অথচ আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
‘‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা ইহরাম অবস্থায় শিকার করো না। তোমাদের মধ্যে কেউ যদি স্বেচ্ছায় কোন কিচু শিকার করে, তাহলে তোমাদের অন্তর্গত দুইজন সুবিচারক সে সম্পর্কে যে আদেশ করে সে অনুযায়ী অনুরূপ একটি পশু বিনিময় হিসাবে কাবায় উপস্থিত করবে।’’ (আল-মায়িদাঃ ৯৫)
‘আল্লাহর নামে আমি শপথ করে বলছি, চার দিরহাম মূল্যের একটি নিহত খরগোশের ব্যাপারে বিচারক নিয়োগ করা থেকে মানুষের রক্ত ও জীবন রক্ষা এবং তাদের পারস্পরিক ঝগড়া-বিবাদ মীমাংসার উদ্দেশ্যে মানুষকে বিচারক নিয়োগ করা অধিক যুক্তিসংগত নয় কি?’
তারা বলল, ‘হাঁ, মানুষের রক্তের নিরাপত্তা ও তাদের পারস্পরিক বিবাদ নিষ্পত্তির জন্য বিচারক নিয়োগ অধিক সংগত।’ ইবন আব্বাস বললেন, ‘আমরা তাহলে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম?’ তারা বলল, ‘হ্যাঁ।’
ইবন আব্বাস বললেন, ‘আপনারা বলছেন, আলী যুদ্ধ করেছেন আয়িশা ও মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে, কিন্তু তাদের বন্দী করে দাস-দাসী বানাননি। আপনারা কি চান আপনাদের মা আয়িশাকে দাসী বানানো হোক এবং অন্যান্য দাসীদের সাথে যেমন আচরণ করা হয় তাঁর সাথেও তেমন করা হোক? উত্তরে যদি হাঁ বলেন তাহলে আপনারা কাফির হয়ে যাবেন। (কারণ শরীয়াতে দাসীর সাথে স্ত্রীর ন্যায় আচরণ বৈধ।)’
আর যদি বলেন, ‘আয়িশা’ আমাদের মা নন, তাহলেও আপনারা কাফির হবেন। কারণ, আল্লাহ বলছেনঃ
‘‘নবী মুমিনদের ওপর তাদের নিজেদের অপেক্ষা অধিকতর স্নেহশীল এবং তাঁর সহধর্মিনীগণ তাদের জননী।’’ (সূরা আল-আহযাবঃ ৩৬)
‘এখন এ দুটি জবাবের যে কোন একটি আপনারা বেছে নিন।’ তারপর তিনি বললেন, ‘আমরা তাহলে এ ব্যাপারেও সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম?’ তারা বলল, ‘হাঁ।’
সবশেষে তিনি বললেন, ‘‘আলী ‘আমীরুল মুমিনীন’ উপাধিটি পরিহার করেছেন, আপনারা এ অভিযোগ তুলেছেন। অথচ হুদাইবিয়ার সন্ধির সময়ে রাসূলুল্লাহ সা. ও মক্কার মুশরিকদের মধ্যে যে চুক্তিটি সম্পাদিত হয়, তাতে ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ বাক্যটি লেখা হলে কুরাইশরা বলেছিলঃ আমরা যদি বিশ্বাসই করতাম আপনি আল্লাহর রাসূল, তাহলে আমরা আপনার কা’বা শরীফে পৌঁছার পথে প্রতিবন্ধক হতাম না বা আপনার সাথে সংঘর্ষেও লিপ্ত হতাম না। আপনি বরং এ বাক্যটির পরিবর্তে ‘মুহাম্মাদ ইবনু আবদিল্লাহ’ কথাটি লিখুন। সেদিন কিন্তু রাসূল সা. এ কথা বলতে বলতে তাদের দাবী মেনে নিয়েছিলেন- ‘আল্লাহর কসম, আমি সুনিশ্চিতভাবে বলছি, আমি আল্লাহর রাসূল- তা তোমরা আমাকে যতই অস্বীকার করনা কেন।’ আলী ঠিক একই কারণে ‘আমীরুল মুমিনীন’ লকবটি পরিহার করেছেন। কারণ, মুয়াবিয়া যদি তঁঅকে ‘আমীরুল মুমিনীন’ বলে স্বীকারই করে নিতেন তাহলে তো কোন বিরোধই থাকতো না।’’ একথার পর তিনি বললেন, ‘তাহলে আমরা এ ব্যাপারেও সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম?’ তারা বলল, ‘হাঁ।’
হযরত আলীর পক্ষত্যাগীদের সাথে আবদুল্লাহ ইবন আব্বাসের এ জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় তাঁরা তৃপ্ত হল এবং তাঁর বলিষ্ঠ যুক্তিকে তাঁরা অকুণ্ঠচিত্তে মেনে নিল। এ সাক্ষাতকারের পর বিশ হাজার লোক আবার আলীর দলে প্রত্যাবর্তন করে এবং অবশিষ্ট চার হাজার লোক আলীর শত্রুতার হঠকারী সিদ্ধান্তে অটল থাকে।
চরমপন্থী খারেজীদের সাথে ‘নাহরাওয়ান’ নামক স্থানে হযরত আলীর রা. যে যুদ্ধ হয়। আবদুল্লাহ বসরা থেকে সাত হাজার সৈন্যসহ এ যুদ্ধে যোগদান করেন। হযরত আলী বসরার সাথে অধিকৃত সমগ্র ইরানেও আবদুল্লাহকে ওয়ালী নিয়োগ করেন। তিনি ইরানের খারেজী বিদ্রোহ নির্মূল করেন।
একটি বর্ণনা মতে, আলীর রা. খিলাফতকালেই হযরত আবদুল্লাহ বসরার গভর্নরের দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করে মক্কায় চলে যান। কারণ স্বরুপ বলা হয়েছে, বসরার কাজী আবূর আসওয়াদ দুয়ালী ও তাঁর মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়ায় তিনি পদত্যাগ করেন। তবে অন্য একটি বর্ণনা মতে, তিনি হযরত আলীর রা. খিলাফতের শেষ পর্যন্ত বসরার ওয়ালীর দায়িত্ব পালন করেন এবং হযরত মুয়াবিয়ার রা. খিলাফতের সূচনাতে তিনি মক্কায় চলে যান এবং নির্জনে বসবাস করতে থাকেন।
হযরত ইমাম হুসাইন রা. কুফাবাসীদের আমন্ত্রণে যখন মদীনা থেকে মক্কা হয়ে কুফায় রওয়ানা হচ্ছিলেন, হযরত আবদুল্লাহ তাঁকে কুফাবাসীদের গাদ্দারীর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন। কারবালার ইমাম হুসাইনের সপরিবারে শাহাদাত বরণে হযরত আবদুল্লাহ ভীষণ আঘাত পান। মক্কায় অবস্থান করলেও হযরত আবদুল্লাহ ইবন যুবাইরের রা. হাতে বাইয়াত করতে অস্বীকৃতি জানান। তবে তাঁকে খিলাফতের হকদার বলে মনে করতেন। বুখারী শরীফের একটি হাদীসের ভিত্তিতে একথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ কারণে তাঁর মক্কায় অবস্থান কিছুটা কষ্টকর হয়ে পড়ে। তিনি তায়েফে চলে যান। শেষ জীবনে অসুস্থ হয়ে যান এবং তায়েফেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
হযরত আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস জ্ঞানার্জনের জন্য অক্লান্ত সাধনা ও পরিশ্রম করেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি সব ধরণের পথ ও পন্থা অবলম্বন করেন। রাসূলের সা. জীবদ্দশায় তিনি তাঁর অমিয় ঝর্ণাধারা থেকে দু’টি অঞ্জলি ভরে গ্রহণ করেন এবং তাঁর ওফাতের পর বিশিষ্ট সাহাবীদের নিকট থেকে জ্ঞানতৃষ্ণা মেটাতে থাকেন। জ্ঞান আহরণের ক্ষেত্রে তিনি যে কত বিনয়ী ও কষ্টসহহিষ্ণু ছিলেন তাঁর নিজের একটি বর্ণনা থেকেই তা অনুমান করা যায়। তিনি বলেনঃ
‘‘আমি যখনই অবগত হয়েছি, রাসূলুল্লাহর সা. কোন সাহাবীর নিকট তাঁর একটি হাদীস সংরক্ষিত আছে, আমি তাঁর ঘরের দরজায় উপনীত হয়েছি। মধ্যাহ্নকালীন বিশ্রামের সময় উপস্থিত হলে তাঁর দরজার সামনে চাদর বিছিয়ে শুয়ে পড়েছি। বাতাস ধূলাবালি উড়িয়ে আমার জামা-কাপড় ও শরীর হয়তো একাকার করে ফেলেছে। অথচ আমি সাক্ষাতের অনুমতি চাইলে তখনই অনুমতি দিতেন। শুধুমাত্র তাঁকে প্রশ্ন করার উদ্দেশ্যেই আমি এমনটি করেছি। তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে আমার এ দুরবস্থা দেখে বলেছেনঃ রাসূলুল্লাহর সা. চাচাতো ভাই, আপনি কি উদ্দেশ্যে এসেছেন? আমাকে খবর দেননি কেন, আমি নিজেই গিয়ে দেখা করে আসতাম। বলেছি, আপনার নিকট আমারই আসা উচিত। কারণ জ্ঞান এসে গ্রহণ করার বস্তু, গিয়ে দেয়ার বস্তু নয়। তারপর তাঁকে আমি হাদীস সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছি।’’
জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে ইবন আব্বাস ছিলেন বিনয়ী। তিনি জ্ঞানীদের উপযুক্ত কদরও করতেন। এ প্রসংগে একটি ঘটনা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। একদিন কাতিবে ওহী ও বিচার, ফিকাহ, কিরায়াত ও ফারায়েজ শাস্ত্রে মদীনাবাসী পণ্ডিতদের নেতা যায়িদ বিন সাবিত রা. তাঁর বাহনের পিঠে আরোহন করবেন, এমন সময় হাশেমী যুবক আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস মনিবের সামনে দাসের দাঁড়াবার ভংগিতে তাঁর সামনে এসে দাঁড়ালেন এবং বাহনের লাগাম ও জিনটি ধরে তাঁকে আরোহণ করতে সাহায্য করলেন। যায়িদ রা. তাঁকে বললেন, ‘রাসূলের সা. চাচাতো ভাই, এ আপনি কি করছেন, ছেড়ে দিন।’ ইবন আব্বাস বললেন, ‘আমাদের উলামা ও জ্ঞানী ব্যক্তিদের সাথে এরূপ আচরণ করার জন্যই আমরা আদিষ্ট হয়েছি।’ যায়িদ রা,. বললেন, ‘আপনার একটি হাত বাড়িয়ে দিন।’ তিনি একখানা হাত বাড়িয়ে দিলে যায়িদ রা. ঝুঁকে পড়ে তাতে চুমু খেলেন এবং বললেন, ‘আমাদের নবী-পরিবারের লোকদের সাথে এরূপ আচরণ করার জন্যও আমরা আদিষ্ট হয়েছি।’
জ্ঞান অন্বেষণে হযরত ইবন ইবন আব্বাসের অভ্যাস, একাগ্রতা কর্মপদ্ধতি দেখে সে যুগের বড় বড় জ্ঞানী ও মনীষীরা চরম বিস্ময়বোধ করেছেন। ‘মাসরুক ইবনুল আজদা’- একজন শ্রেষ্ঠ তাবেয়ী, বলেন, ‘‘আমি যখন ইবন আব্বাসকে দেখলাম, বললাম, ‘সুন্দরতম ব্যক্তি।’ যখন তিনি কথা বললেন, বললাম, ‘সর্বোত্তম প্রাঞ্জলভাষী’ এবং যখন তিনি আলোচনা করলেন, বললাম, ‘সর্বাধিক জ্ঞানী ব্যক্তি।’’
জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে যখন তিনি কিছুটা আত্মতৃপ্তি অনুভব করলেন তখন মানুষকে শিক্ষাদানের ব্রত কাঁধে তুলে নিলেন। আর তখন থেকেই তাঁর বাড়িটি একটি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। যে অর্থে আজ আমরা বিশ্ববিদ্যালয় শব্দটি ব্যবহার করে থাকি সে অর্থে তার বাড়ীটিকে বিশ্ববিদ্যালয় বললে অত্যুক্তি হয়না। তবে আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় ও ইবন আব্বাস বিশ্ববিদ্যালয়ে মধ্যে পার্থক্য এখানে যে আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকেন বহু শিক্ষক আর সেখানে ছিলেন একজন শিক্ষক। তিনি ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু।
ইবন আব্বাসের এক সংগী বর্ণনা করেন, ‘আমি ইবন আব্বাসের এমন একটি মাহফিল দেখেছি যা গোটা কুরাইশ গোত্রের জন্য অত্যন্ত গর্বের বিষয়। দেখলাম তাঁর বাড়ীর সম্মুখের রাস্তাটি লোকে লোকারণ্য। আমি তাঁর কাছে উপস্থিত হয়ে বাড়ীর দরজায় মানুষের প্রচণ্ড ভীড়েরর কথা জানালাম। তিনি অজুর জন্য পানি আনালেন। অজু করলেন। তারপর বসে বললেনঃ ‘তুমি বাইরে গিয়ে অপেক্ষমান লোকদের বল, যারা কুরআন ও কিরায়াত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে চাও, ভেতরে যাও।’ আমি বেরিয়ে গিয়ে তাদেরকে একথা বললাম। বলার পর এত বিপুল সংখ্যক লোক ভেতরে প্রবেশ করল যে, কক্ষটি এমনকি সম্পূর্ণ বাড়ীটি পূর্ণ হয়ে গেল। তারা যা কিছু জানতে চাইলো তিনি তাদেরকে অবহিত করলেন। তারপর বললেন, তোমাদের অপেক্ষমান ভাইদের জন্য পথ ছেড়ে দাও।’ তারা চলে গেল।
অতঃপর তিনি আমাকে বললেন, ‘বাইরে গিয়ে বল, যারা কুরআনের তাফসীর ও তাবীল সম্পর্কে জানতে চাও, ভেতরে যাও।’ আমি বেরিয়ে গিয়ে তাদেরকে একথা বললাম। বলার পর লোকে ঘর ভরে গেল। তাদের সব জিজ্ঞাসারই তিনি জবাব দিলেন এবং অতিরিক্ত অনেক কিছুই অবহিত করলেন। তারপর বললেন, ‘তোমাদের অপেক্ষমান ভাইদের জন্য পথ ছেড়ে দাও।’ তারা বেরিয়ে গেল।
তিনি আমাকে আবার বললেন, ‘তুমি বাইরে গিয়ে যারা হালাল, হারাম ও ফিকাহ সম্পর্কে জানতে চায় তাদেরকে ভেতরে পাঠিয়ে দাও।’ আমি বেরিয়ে গিয়ে তাদেরকে পাঠালাম। তাদের সংখ্যাও এত ছিল যে ঘরটি সম্পূর্ণরূপে ভরে গেল। তাদের সকল জিজ্ঞাসার জবাব দানের পর তাদেরকে পরবর্তী লোকদের জন্য স্থান ছেড়ে দিতে বললেন। তারা চলে গেল।
তিনি আমাকে আবার পাঠালেন এবং ফারায়েজ ও তৎসংক্রান্ত মাসলা-মাসায়েল সম্পর্কে যারা জানতে চায় তাদেরকে আহ্বান জানালেন। এবারও ঘরটি ভরে গেল। তাদের সকল জিজ্ঞাসার সন্তোষজনক জবাব দানের পর পরবর্তী লোকদের জন্য স্থান ছেড়ে দিতে বললেন। তারা চলে গেল। তিনি আমাকে আবার পাঠালেন। বললেন, ‘যারা আরবী ভাসা, কবিতা এবং আরবদের বিস্ময়কর সাহিত্য সম্পর্কে জানতে ইচ্ছুক তাদেরকে পাঠিয়ে দাও।’ আমি তাদেরকে পাঠালাম। এবারো ঘর ভরে গেল। তিনি তাদের সব প্রশ্নের জবাব দিয়ে তুষ্ট করে বিদায় দিলেন। বর্ণনাকারী মন্তব্য করেন, ‘সমগ্র কুরাইশ গোত্রের গৌরব ও গর্বের জন্য এই একটিমাত্র সমাবেশই যথেষ্ট।’
এমন ভীড়ের কারণেই ইবন আব্বাস পরবর্তীকালে একেকটি বিষয়ের জন্য সপ্তাহের একটি দিন নির্ধারণ করেছিলেন। ফিকাহ্, মাগাযী, কবিতা, প্রাচীন আরবের ইতিহাস প্রভৃতি বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন দিতে তিনি আলোচনা করতেন। তাঁর এসব আলোচনার মজলিসে যত বড় জ্ঞানীই উপস্থিত হতেন না কেন, তিনি পরিতৃপ্ত হয়ে ফিরতেন।
হযরত ইবন আব্বাস তাঁর অপরিসীম জ্ঞান ও চিন্তাশক্তির কল্যাণে অল্পবয়স্ক হওয়া সত্ত্বেও খিলাফতে রাশেদার মজলিসে শূরার সদস্য হওয়ার গৌরব লাভ করেছিলেন। হযরত উমার রা. কোন কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হলে প্রবীণ ও বিদ্বান সাহাবীদের আহ্বান জানাতেন। সেই সাথে আবদুল্লাহ ইবন আব্বাসকেও ডেকে পাঠাতেন। তিনি উপস্থিত হলে হযরত উমার তাঁর যথেষ্ট সম্মান প্রদর্শন করে বলতেন, ‘আমরা এক কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছি, তুমি ও তোমার মত আর যারা আছ সমাধান বের কর।’
একবার প্রবীণ ও বয়োজ্যেষ্ঠ সাহাবীদের মজলিসে হযরত উমার অন্যদের তুলনায় আবদুল্লাহ ইবন আব্বাসকে একটু বেশী গুরুত্ব ও প্রাধান্য দিলেন। তখন আবদুল্লাহ একজন যুবক। এ ব্যাপারে তিনি প্রবীণ সাহাবীদের সমালোচনার সম্মুখীন হন। কেউ কেউ বলেন, ‘আমাদেরও তো তার বয়সী ছেলে ও নাতিরা রয়েছে, আমরাও তো তাদেরকে নিয়ে আসতে পারি।’ হযরত উমার তখন কুরআনের একটি আয়াতের ব্যাখ্যা জিজ্ঞেস করে আবদুল্লাহকে পরীক্ষা করেন। সে পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ হন। তখন উমার বলে, ‘আবদুল্লাহ তো বুদ্ধদের মত যুবক। তার আছে একটি জিজ্ঞাসু যবান ও সচেতন অন্তঃকরণ।’
হিশাম ইবন উরওয়া তাঁর পিতা উরওয়াহকে ইবন আব্বাসের জ্ঞানের গভীরতা ও তাঁর মর্যাদা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলেন। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘ইবন আব্বাসের তুল্য জ্ঞানী লোক আমার নযরে পড়েনি।’
আমর ইবন হাবশী বলেন, ‘আমি ইবন উমারকে একটি আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেনঃ তুমি ইবন আব্বাসের কাছে যাও এবং তাকেও জিজ্ঞেস কর। কারণ মুহাম্মাদের সা. ওপর যা কিছু অবতীর্ণ হয়েছে সে সম্পর্কে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের যাঁরা অবশিষ্ট আছেন তাঁদের মধ্যে তিনিই অধিক জ্ঞানী।’’
তাফসীর শাস্ত্র ও অন্যান্য ইসলামী বিষয়সমূহে তাঁর অসাধারণ পাণ্ডিত্যের মূলে ছিল প্রথমত তাঁর রাসূলে করীমের সা. সান্নিধ্য লাভ ও সেবার সুযোগ। দ্বিতীয়ত তাঁর জন্য রাসূলুল্লাহর সা. দু’আ। তৃতীয়তঃ জ্ঞান অর্জনের প্রতি তাঁর অপরিসীম আগ্রহ এবং অক্লান্ত চেষ্টা সাধনা।
যায়িদ ইবন সাবিত মারা গেলে হযরত আবু হুরাইরা মন্তব্য করেছিলেন ‘এই উম্মাতের বিজ্ঞ আলিম মৃত্যুবরণ করলেন এবং আশা করি আল্লাহতা’আলা আবদুল্লাহ ইবন আব্বাসকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করবেন।’
হযরত ইবন আব্বাস বিশিষ্ট ছাত্র ও ব্যক্তিদের শিক্ষাদানের সাথে সাথে সাধারণ লোকদের সম্পর্কেও সচেতন ছিলেন। মাঝে মাঝে বিশেষ মাহফিলের মাধ্যমে তিনি জনসাধারণকে ওয়াজ-নসিহত করতেন।
নিজে না করে অন্যকে করতে বলেন, ইবন আব্বাস এ ধরণের লোক ছিলেন না। তিনি ছিলেন দিনে রোযাদার ও রাতে ইবাদাত গোযার। আবদুল্লাহ ইবন মুলাইকা বলেন ‘‘একবার আমি ইবন আব্বাসের সাথে মক্কা থেকে মদীনা পর্যন্ত সফর করলাম। বিশ্রামের জন্য যখনই কোথাও তাঁবু গেড়েছি, রাতের একটি বিশেষ অংশ তিনি নামাযে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাটিয়ে দিতেন। অথচ অন্য সফরসংগীরা তখন ক্লান্তি ও শ্রান্তিতে গভীর ঘুমে অচেতন। একদিন রাত্রে একাগ্রচিত্তে তাঁকে আমি পাঠ করতে শুনলামঃ
وَجَاءَتْ سَكْرَةُ الْمَوْتِ بِالْحَقِّ ۖ ذَٰلِكَ مَا كُنتَ مِنْهُ تَحِيدُ
‘এবং মৃত্যুর বিকার সত্যভাবেই সমুপস্থিত। এ হচ্ছে তা-ই যা থেকে তুমি পালিয়ে বেড়াতে।’ (ক্বাফঃ ১৯)
বারবার তিনি এ আয়াতটি আওড়াচ্ছেন আর কাঁদছেন। সুবহে সাদিক পর্যন্ত তিনি এভাবে কাটিয়ে দিলেন।’’
৬৮ হিজরী মুতাবিক ৬৮৬/৮৮ খ্রীস্টাব্দে তায়েফ নগরে তিনি ইনতিকাল করেন। ওফাতের সময় তাঁর বয়স হয়েছিল একাত্তর বছর। মুহাম্মাদ ইবনুল হানাফিয়্যা তাঁর জানাযার ইমামতি করেন। তায়েফ নগরে ‘মসজিদে ইবন আব্বাস’ নামক বিশাল মসজিদটি আজও তাঁর স্মৃতি বহন করে চলেছে। এ মসজিদেরই পেছনের দিকে এক পাশে এ মহান সাহাবীর কবর। তাঁকে কবরে সমাহিত করার পর কুরআনের এ আয়াতটি পঠিত হয়েছিলঃ
يَا أَيَّتُهَا النَّفْسُ الْمُطْمَئِنَّةُ – ارْجِعِي إِلَىٰ رَبِّكِ رَاضِيَةً مَّرْضِيَّةً – فَادْخُلِي فِي عِبَادِي – وَادْخُلِي جَنَّتِي –
‘হে পরিতুষ্ট আত্মা! তুমি প্রসন্ন ও সন্তুষ্ট অবস্থায় তোমার প্রতিপালকের দিকে প্রত্যাবর্তন কর। অতঃপর আমার বান্দাগণের মধ্যে প্রবিষ্ট হও এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ কর।’ (আল-ফজরঃ ২৭-৩০)