আল-আরকাম ইবন আবিল আরকাম (রাঃ)

নাম আবু আবদিল্লাহ আল আরকাম। পিতা আবূল আরকাম আবদু মান্নাফ, মাতা উমাইমা।

হযরত আরকামের খান্দান জাহিলী যুগের আরবে বিশেষ মর্যাদা ও ক্ষমতার অধিকারী ছিল। তাঁর দাদা আবু জুনদুব আসাদ ইবন আবদিল্লাহ তার যুগে মক্কার একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ছিলেন।

হযরত আরকাম এগারো অথবা বারো জনের পরে ইসলাম গ্রহণ করেন। আল-বিদায়া গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে, হযরত আবু বকর ইসলাম গ্রহণের পর উসমান ইবন আফ্‌ফান, তালহা ইবন উবাইদিল্লাহ, যুবাইর ইবনুল আওয়াম ও সা’দ ইবন আবী ওয়াক্‌কাসের নিকট ইসলামের দাওয়াত পেশ করেন। তাঁরা সকলে সাথে সাথে এ দাওয়াত কবুল করেন। পরদিন তিনি উসমান ইবন মাজউন, আবু উবাইদা এবং আল-আরকাম ইবন আবিল আরকামকে নিয়ে রাসূলুল্লাহর সা. খিদমতে হাজির হন। তারা সকলেই ইসলাম গ্রহণ করেন।

হযরত আরকাম যখন ইসলাম গ্রহণ করেন তখন রাসূলুল্লাহর সা. সহ সকল মুসলমানের অবস্থা অত্যন্ত সঙ্কটজনক। মক্কার পৌত্তলিক শক্তি চাচ্ছিল, শক্তি অর্জনের পূর্বেই এ আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দিতে। কিন্তু ইসলাম তো নিশ্চিহ্ন হওয়ার জন্য আসেনি। ইসলাম গ্রহণের পর হযরত আরকামের বাড়ীটি ইসলামের গোপন ঘাঁটিতে পরিণত হয়। ইসলামের প্রথম পর্যায়ের ইতিহাস আলোচনা করতে গেলেই ঘুরেফিরে ‘দারুল আরকাম’ বা আরকামের বাড়ীর কথাটি আমাদের সামনে আসে। ইসলামের দাওয়াত ও প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এ বাড়িটির এক মহান ভূমিকা রয়েছে। রাসূল সা. এ বাড়ীতে অবস্থান নিয়ে কুরাইশদের নজর এড়িয়ে গোপনে ইসলামের দাওয়াত দিতেন। তখন পর্যন্ত মুষ্টিমেয় যে ক’জন ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, তাঁরা এখানে রাসূলুল্লাহর সা. সাথে মিলিত হতেন। তাছাড়া রাসূলুল্লাহ সা. ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে এখান থেকে ইসলামের দাওয়াত দিতেন। এ ঐতিহাসিক বাড়িতে বেশ কিছু লোক ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। সর্বশেষ যে ব্যক্তি এ বাড়ীতে ইসলামের ঘোষনা দেন, তিনি হলেন উমার ইবনূল খাত্তাব রা.। ‘হায়াতুস সাহাবা’ গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে, মুসলমানদের সংখ্যা যখন ৩৮ জনে উন্নীত হলো, আবু বকর ও অন্যরা তখন রাসূলুল্লাহকে সা. চাপ দিলেন প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার জন্য। তাঁদের দাবীর মুখে রাসূল সা. রাজী হলেন। তাঁরা আরকামের বাড়ী থেকে বেরিয়ে মসজিদে হারামে বিক্ষিপ্ত ভাবে ছড়িয়ে পড়লেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী হযরত আবু বকর কা’বার চত্বরে উপস্থিত কুরাইশদের সম্বোধন করে ভাষন দিতে দাঁড়ালেন। তাদের সামনে ইসলামের দাওয়াত তুলে ধরতেই কুরাইশ গুণ্ডারা একযোগে আবু বকরের ওপর হামলা চালিয়ে আঘাত হানতে থাকে। নরাধম উতবা পায়ের জুতো খুলে হযরত আবু বকরকে জুতো-পেটা করলো। আবু বকরের অবস্থা আশঙ্কাজনক হয়ে পড়লো। আবু বকরের গোত্র বনু তাইম তাঁকে বাচানোর জন্য এগিয়ে এলো। আবু বকর চেতনা ফিরে পেয়েই রাসূলুললাহ সা. অবস্থা জিজ্ঞেস করলেন। তাঁর মা উম্মুল খায়েরকে পাঠালেন উম্মুল জামিলে কাছে রাসূলুল্লাহর সা. খবর জানার জন্য। উম্মুল জামীল এসে চুপে চুপে খবর দিলেন, রাসূল সা. নিরাপদে আছেন। অতঃপর রাতের অন্ধকারে তাঁরা তিনজন গোপনে রাসূলুল্লাহর সা. নিকট পৌঁছেন। এখানে রাসূলুল্লাহর সা. দু’আর বরকতে হযরত আবু বকরের জননী উম্মুল খায়ের ইসলাম গ্রহণ করেন। সেখানে তাঁরা এক মাস অবস্থান করেন। এর মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা ৪০ এ পৌঁছে যায়। যেদিন আবু বকর রা. আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত দিতে গিয়ে মার খেয়েছিলেন, ঘটনাক্রমে সেদিনই হযরত হামযা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।

ইসলামপূর্ব যুগে রাসূলুল্লাহ সা. নেতৃত্বে মক্কায় ‘হিলফুল ফুজুল’ নামে যে কল্যাণ সংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, আরকাম ছিলেন তার অন্যতম সদস্য।

নবুওয়াতের ত্রয়োদশ বছরে হিজরাতের আদেশ হলে অন্যান্য সাহাবীদের সাথে হযরত আরকাম মদীনায় পৌঁছেন। হযরত আবু তালহা ইবন সাহলের সাথে তাঁর ভ্রাতৃ-সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য রাসূল সা. তাঁকে মদীনার বনু যারাইক মহল্লায় এক খণ্ড ভূমি দান করেন।

হক ও বাতিলের প্রথম সংঘর্ষ বদর-যুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করেছিলেন। এ যুদ্ধে রাসূল সা. তাঁকে একখানি তরবারি দান করেন। উহুদ, খন্দক, খাইবারসহ সকল গুরুত্বপূর্ণ অভিযানে অংশগ্রহণ করে বীরত্ব ও সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করেন। রাসূল সা. তাঁকে যাকাত আদায়কারী হিসাবে নিয়োগ করেছিলেন।

হিজরী ৫৩/৫৫ সনে ৮৩ বছর বয়সে তিনি মদীনায় ইনতিকাল করেন। মৃত্যুর পূর্বে অসিয়ত করে যান, হযরত সা’দ ইবন আবী ওয়াক্কাস তাঁর জানাযার নামায পড়াবেন। কিন্তু হযরত সা’দ মদীনা থেকে একটু দূরে ‘আকীক’ নামক স্থানে ছিলেন। তাঁর উপস্থিত হতে একটু বিলম্ব হলে মদীনার তৎকালীন ওয়ালী মারওয়ান ইবন হিকাম প্রতিবাদ করে বলেন, এক ব্যক্তির প্রতীক্ষায় জানাযা কতক্ষণ পড়ে থাকবে। তিনি ইচ্ছা করলেন, নিজেই এগিয়ে গিয়ে জানাযার ইমামতি শুরু করে দেন। কিন্তু উবাইদুল্লাহ ইবন আরকাম অনুমতি দিলেন না। বনী মাখযুম গোত্রও উবাইদুল্লাহর সাহায্য ও সমর্থনে এগিয়ে আসে। বাকবিতণ্ডা চলছে, এমন সময় হযরত সা’দ ইবন আবী ওয়াক্কাস রা. এসে উপস্থিত হলেন। তিনি জানাযার নামায পড়ালেন এবং লাশ মদীনার বাকী গোরস্থানে দাফন করা হলো।

তাকওয়া, দ্বীনদারী, দুনিয়াবী ভোগ-বিলাসের প্রতি অনীহা ও সততা ছিল হযরত আরকামের চরিত্রের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। ইবাদাত ও শববিদারীর প্রতি ছিল তাঁর প্রবল আকর্ষণ। একবার তিনি বাইতুল মাকদাস সফরের ইচ্ছা করলেন। সফরের প্রস্তুতি শেষ করে রাসূলুল্লাহর সা. কাছে এলেন বিদায় নিতে। রাসূল সা. জিজ্ঞেস করলেন, ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে, না অন্য কোন প্রয়োজনে? উত্তরে আরকাম বললেন, ‘আমার মা-বাবা, আপনার প্রতি কুরবান হোক, অন্য কোন প্রয়োজন নেই। শুধু বাইতুল মাকদাসে নামায আদায় করতে চাই।’ ইরশাদ হলো, ‘আমার এ মসজিদের একটি নামায একমাত্র মসজিদে হারাম ছাড় অন্য যে কোন মসজিদের হাজার নামায অপেক্ষা উত্তম।’ একথা শোনামাত্র হযরত আরকাম বসে পড়েন এবং সফরের ইরাদা করেন।

হযরত আরকামের মূল পেশা ছিল ব্যবসা বাণিজ্য। হিজরাতের পর তিনি মদীনায় স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেন। মক্কার ঐতিহাসি বাড়ীটি তিনি সন্তান-সন্ততিদের জন্য ওয়াক্‌ফ করে যান। দীর্ঘ দিন যাবত এ বাড়ীটি ভ্রমণকারীদের দর্শনস্থল হিসাবে বিবেচিত হতো।

হযরত আরকামের এ বাড়িটি ছিল সাফা পাহাড়ের পাদদেশে। সাফা ও মারওয়ার মাঝখানে সাঈ’ করার সময় ঠিক বাড়িটির দরজার সামনে দিয়ে অতিক্রম করতে হতো। আব্বাসী খলিফা মানসুরের সময়-১৪০ হিজরী পর্যন্ত বাড়ীটি অবিকৃত অবস্থায় ছিল। কিন্তু এ বছরই মুহাম্মাদ ইবন আবদুল্লাহ ইবন হাসান মদীনায় আব্বাসী শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। হযরত আরকামের পৌত্র আবদুল্লাহ ইবন ’উসমানও ছিলেন এ বিদ্রোহের একজন সমর্থন ও সহযোগী। এ কারণে খলীফা মানসুরের নির্দেশে শিহাব উদ্দীন ইবন আবদে বরকে পাঠালেন আবদুল্লাহর কাছে এই বাড়িটি ক্রয়ের প্রস্তাব দিয়ে। আবদুল্লাহ প্রথমতঃ বিক্রী করতে অস্বীকার করেছিলেন; কিন্তু কয়েদ থেকে মুক্তির শর্তে এবং উচ্চ মূল্যেল লোভে শেষ পর্যন্ত বিক্রী করতে সম্মত হন। মানসুর সতেরো হাজার দীনারের বিনিময়ে এ মহান, কল্যাণময় ঐতিহাসিক বাড়িটির মালিকানা লাভ করেন। বাড়ীটির অন্য শরীকরা প্রথমতঃ রাজী না হলেও আস্তে আস্তে তাঁরাও রাজী হয়ে যান।

খলীফা মানুসরের পর খলীফা মাহদী এ বাড়ীটি তাঁর প্রিয়তমা দাসী খায়যুরানকে দান করেন। তিনি বাড়িটির পুরনো কাঠামো ভেঙ্গে সম্পূর্ণ নতুন অট্টালিকা তৈরী করেন। এভাবে যুগে যুগে এ বাড়িটির সংস্কার সাধিত হয় এবং ধীরে ধীরে এই মহান গৃহটি যেখানে ইসলামের সংকট পর্বে আল্লাহর রাসূল সা. ও মুসলমানরা আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত অহী ও ফিরিশতাদের অবতরণ স্থল ছিল, নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।