আবু হুজাফাহ আবদুল্লাহ নাম। পিতার নাম হুজাফাহ। কুরাইশ গোত্রের বনী সাহম শাখার সন্তান। ইসলামী দাওয়াতের প্রথম ভাগে মুসলমান হন এবং দীর্ঘদিন যাবত হযরত রাসূলেপাকের (সা) সাহচর্যে অবস্থান করেন। তাঁর ভাই কায়েস ইবন হুজাফাহকে সঙ্গে করে হাবশাগামী মুহাজিরদের দ্বিতীয় কাফিলার সাথে হাবশায় হিজরাত করেন। (আল-ইসতিয়াব)
একমাত্র বদর ছাড়া সকল যুদ্ধেই তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে শরিক হন। আবু সাঈদ আল খুদরী (রা) তাঁকে ‘বদরী’ বা বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বলে উল্লেখ করেছেন। তবে মুসা বিন উকবা, ইবন ইসহাক ও অন্যরা তাঁকে ‘বদরী’ বলে উল্লেখ করেননি। (আল-ইসতিয়াব)
রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁকে একটি অভিযানের আমীর বানিয়ে পাঠান। যাত্রার প্রাক্কালে তাঁর অধীনস্থ সৈনিকদের রাসূল (সা) নির্দেশ দেন, কক্ষণো তার নির্দেশ অমান্য করবে না। নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছার পর হযরত আবদুল্লাহ কোন কারণে ভীষণ রেগে যান। তিনি সৈনিকদের জিজ্ঞেস করেন, রাসুল (সা) কি আমার আনুগত্যের নির্দেশ দেননি? তারা বললোঃ হ্যাঁ দিয়েছে। তিনি বললেন, কাঠ সংগ্রহ করে আগুন জ্বালিয়ে তার মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়। মুজাহিদরা কাঠ সংগ্রহ করে আগুন জ্বালায়। তারপর সেই আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে তারা একে অপরের দিকে তাকায়। অনেকে এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করে বলে, আমরা আগুনের হাত থেকে বাঁচার জন্যই রাসূলুল্লাহর (সা) অনুসরণ করেছি, আর এখন সেই আগুনে জীবন দেব? এই বিতর্ক চলতে থাকে, আর এদিকে আগুন নিভে যায়। আবদুল্লাহর রাগও পড়ে যায়। অভিযান থেকে ফিরে এসে তারা ঘটনাটি রাসূলুল্লাহকে (সা) জানায়। রাসূল (সা) বললেন, যদি তোমরা ঐ আগুনে ঢুকে পড়তে, আর কোনদিন তা থেকে বের হতে পারতে না। আনুগত্য কেবল এমন সব ব্যাপারে ওয়াজিব, যার অনুমতি আল্লাহ দিয়েছেন। (বুখারীঃ কিতাবুল আহকাম, বাবুস সাময়ে ওয়াত তায়াহ, হায়াতুস সাহাবা-১/৬৭)
উল্লেখিত ঘটনাটি কোন কোন বর্ণনায় ভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে। সেই সব বর্ণনা মতে, হযরত আবদুল্লাহর আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশটি প্রকৃত নির্দেশ ছিলনা। তিনি তাঁর সৈনিকদের সাথে একটু রসিকতা করেছিলেন। হযরত আবু সাঈদ আল খুদরী (রা) ঘটনাটি এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ রাসূলুল্লাহ (সা) সাহাবীদের সমন্বয়ে গঠিত একটি বাহিনীকে এক অভিযানে পাঠালেন। তিনি আবদুল্লাহ ইবন হুজাফাহকে এ বাহিনীর আমীর নিয়োগ করলেন। আবদুল্লাহ ছিলেন রসিক লোক। কিছুদূর চলার পর তারা এক স্থানে থামলেন। আবদুল্লাহ তাঁর বাহিনীর সদস্যদের নিকট জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের কি আমার আনুগত্যের নির্দেশ দেওয়া হয়নি? তারা বললোঃ হ্যাঁ। তিনি বললেন, আমি যদি তোমাদের একটি নির্দেশ দিই তোমরা পালন করবে? তারা বললোঃ হ্যাঁ। তিনি বললেনঃ আমি আমার অধিকার ও আনুগত্যের দাবীতে নির্দেশ দিচ্ছি, তোমরা এ আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়। নির্দেশ লাভের সাথে সাথে বাহিনীর কোন কোন সদস্য ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করলো। তখন তিনি বললেনঃ থাম, আমি তোমাদের সাথে একটু রসিকতা করেছি মাত্র। বাহিনী মদীনায় ফিরে আসার পর বিষয়টি রাসূলুল্লাহর (সা) কর্ণগোচর হলো। তিনি বললেনঃ কেউ যদি আল্লাহর নাফরমানির নির্দেশ দেয় তোমরা তা মানবে না। (সীরাতু ইবন হিশাম ২/৬৪০)
হিজরী ৬ষ্ঠ মতান্তরে ৭ম সনে হযরত রাসূলে কারীম (সা) আশ-পাশের রাজা বাদশাহ ও শাসকদের নিকট ইসলামের দাওয়াত সম্বলিত পত্রসহ দূত পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি তৎকালীন বিশ্বের দুই পরাশক্তি রোম ও পারস্য সম্রাটদ্বয়ের নিকটও দূত পাঠাবেন বলে স্থির করলেন। কিন্তু কাজটি খুব সহজ ছিলনা। এর অসুবিধার দিকগুলিও রাসূল (সা) অবহিত ছিলেন। যে সকল দেশে দূতগণ যাবে তথাকার ভাষা, সাংস্কৃতি ও মানুষ সম্পর্কে তারা অজ্ঞ। সেখানে তারা সে দেশের রাজা-বাদশাহকে তাদের পৈতৃক ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত দেবে। নিঃসন্দেহে এ দৌত্যগিরি মারাত্মক ঝুকিপূর্ণ কাজ। হয়তো সেখানে যারা যাবে তারা আর কোনদিন ফিরে আসবে না। রাসূলুল্লাহ (সা) সাহাবীদের সমবেত হওয়ার নির্দেশ দিলেন। তিনি ভাষণ দিতে দাড়ালেন। হামদ ও সানার পর কালেমা-ই-শাহাদাত পাঠ করলেন। তারপর বললেনঃ আম্মা বাদ! আমি তোমাদের কিছু লোককে আজমী বা অনারব বাদশাহদের নিকট পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তোমরা আমার সাথে দ্বিমত পোষণ করবে না, যেমন করেছিল বনী ইসরাইল ঈসা ইবন মরিয়মের সাথে।
সাহাবীরা বললেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ, আমরা আপনার ইচ্ছা পূরণ করবো। আপনার যেখানে ইচ্ছা আমাদের পাঠান।
হযরত রাসূলেপাক (সা) আরব-আজমের রাজা-বাদশাহদের নিকট দাওয়াতপত্র বহন করার জন্য ছয়জন সাহাবীকে নির্বাচন করলেন। এই ছয়জনের একজন হলেন আবদুল্লাহ ইবন হুজাফাহ। পারস্য সম্রাট কিসরার নিকট রাসূলুল্লাহর (সা) বাণী বহন করে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাঁকে নির্বাচন করা হয়।
আবদুল্লাহ ইবন হুজাফাহ সফরের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে স্ত্রী-পুত্রের নিকট থেকে বিদায় নিয়ে বের হলেন। উচু-নিচু ভূমির বিচিত্র পথ ধরে তিনি চললেন। সম্পূর্ণ একাকী। এক আল্লাহ ছাড়া সংগে আর কেউ নেই। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে পারস্য পৌঁছলেন। সম্রাটের জন্য একটি পত্র নিয়ে এসেছেন – একথা তাঁর পারিষদবর্গকে জানিয়ে তিনি সম্রাটের সাথে সাক্ষাতের অনুমতি চাইলেন। বিষয়টি সম্রাটের কানে গেল। তিনি দরবার সাজানোর জন্য পারিষদবর্গকে নির্দেশ দিলেন। দরবার সাজানো হলে পারস্যের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে দরবারে ডেকে আনা হলো। তারপর আবদুল্লাহ ইবন হুজাফাহকে প্রবেশের অনুমতি দিলেন।
রাসূলুল্লাহর (সা) দূত হযরত আবদুল্লাহ ইবন হুজাফাহ একটি পাতলা ‘শামলাহ’ (শরীরে পেঁচানো হয় যে চাদর) এবং একটি মোটা ‘আবা’ (লম্বা কোর্তা) গায়ে জড়িয়ে একজন সাধারণ বেদুঈন বেশে কিসরার রাজ দরবারে প্রবেশ করলেন। তিনি ছিলেন লম্বা-চওড়া সুঠাম দেহের অধিকারী। ইসলামের গরিমা ও ঈমানের গর্বে ছিলেন তিনি গর্বিত।
আবদুল্লাহকে ঢুকতে দেখেই কিসরা একজন পারিষদকে তাঁর হাত থেকে পত্রটি নেওয়ার জন্য নির্দেশ দিলেন। কিন্তু আবদুল্লাহ পত্রটি লোকটির হাতে দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বললেনঃ ‘না, রাসূলুল্লাহ (সা) পত্রটি সরাসরি আপনার হাতে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আমি সে নির্দেশের বিরুদ্ধাচরণ করতে পারিনে।’
কিসরা তাঁর লোকদের বললেন, ‘তাঁকে ছেড়ে দাও, আমার নিকট আসতে দাও।’ তিনি এগিয়ে গিয়ে কিসরার হাতে চিঠিটি দিলেন। হীরার অধিবাসী একজন আরাবী ভাষী সেক্রেটারীকে ডেকে পত্রটি খুলে পাঠ করতে বললেন। পত্রটি পাঠ করা শুরু হলঃ
“বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম – করুণাময় দয়ালু আল্লাহর নামে। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর পক্ষ থেকে পারস্য সম্রাট কিসরার প্রতি। সালামুন আলা মান ইত্তাবায়া আল-হুদা – যারা হিদায়াত গ্রহণ করেছে তাদের প্রতি সালাম।”
পত্রটির এতটুকু শুনেই কিসরা ক্রোধে ফেটে পড়লেন; তাঁর চোখ-মুখ লাল হয়ে গেল, ঘাড়ের রগ ফুলে উঠলো। কারণ, রাসূলুল্লাহ (সা) পত্রটির সুচনা করেছেন নিজের নাম দিয়ে, অর্থাৎ কিসরার নামের পূর্বে ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ এসেছে। কিসরা পত্রটি পাঠকের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে টুকরো টুকরো করে ফেললেন। পত্রটির বক্তব্য কি তা আর জানার প্রয়োজন বোধ করলেন না। তিনি চিৎকার করে বললেনঃ ‘সে আমার দাস, আর সে কিনা আমাকে এভাবে লিখেছে?’ তারপর আবদুল্লাহকে মজলিস থেকে বের করে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। তাঁকে বের করে নিয়ে যাওয়া হল।
আবদুল্লাহ ইবন হুজাফাহ কিসরার দরবার থেকে বেরিয়ে গেলেন। তিনি জানেন না তাঁর ভাগ্যে আল্লাহ কি নির্ধারণ করেছেন। তাঁকে কি হত্যা করা হবে, না মুক্তি দেওয়া হবে? নানা রকম চিন্তা তাঁর মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো। মুহূর্তেই তিনি সব দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলে আপন মনে বললেনঃ ‘আল্লাহর কসম, রাসূলুল্লাহর (সা) পত্র পৌঁছানোর পর এখন আমার কপালে যা হয় হোক। আমি কোন কিছুর পরোয়া করিনে।’ একথা বলে তিনি আল্লাহর নাম নিয়ে বাহনে সাওয়ার হয়ে রওয়ানা হলেন। এদিকে কিসরার ক্রোধ কিছুটা প্রশমিত হলে আবদুল্লাহকে আবার হাজির করার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু তাঁকে আর পাওয়া গেল না। তারা তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তাঁর কোন সন্ধান পেল না। আরব উপদ্বীপ অভিমুখী রাস্তায় খোঁজ নিয়ে তারা জানতে পেল তিনি স্বদেশের পথে পাড়ি জমিয়েছেন। তাঁর আর নাগাল পাওয়া গেল না।
হযরত আবদুল্লাহ রাসূলুল্লাহর (সা) খিদমতে হাজির হয়ে কিসরার কাণ্ডকারখানা সবিস্তার বর্ণনা করলেন। সব কিছু শুনে রাসূল (সা) মন্তব্য করলেনঃ ‘মাযযাকাহুল্লাহু মুলকাহু – আল্লাহ তার সাম্রাজ্য ছিন্নভিন্ন করে ফেলুন।’ (আল-ইসতিয়ার)
এদিকে ‘কিসরা’ তাঁর প্রতিনিধি, ইয়ামনের শাসক ‘বাজান’কে লিখলেন, “তোমারা ওখান থেকে দু’জন তাগড়া ও শক্তিশালী লোক পাঠিয়ে হিজাযে যে ব্যক্তি নবী বলে দাবী করেছে তাকে ধরে আমার কাছে নিয়ে আসার নির্দেশ দাও।” ‘বাজান’ দু’জন লোক নির্বাচন করে রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট পাঠালো। তাদের হাতে রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট লিখিত একটি পত্রও ছিল। তাতে নির্দেশ ছিল, তিনি যেন কাল বিলম্ব না করে পত্র বাহকদের সাথে কিসরার দরবারে হাজির হন। ‘বাজান’ লোক দু’টিকে আরো নির্দেশ দিল, তারা রাসূলুল্লাহ (সা) সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে ফিরে এসে তাকে অবহিত করবে।
লোক দু’টি ইয়ামন থেকে যাত্রা করে রাত-দিন ক্রমাগত চলার পর তায়েফে উপনীত হল। সেখানে তারা একটি কুরাইশ ব্যবসায়ী দলের সাক্ষাৎ লাভ করলো। তদের কাছে মুহাম্মাদ (সা) সম্পর্কে তারা জিজ্ঞাসাবাদ করলো। তারা জানলো, মুহাম্মাদ এখন ইয়াসরিব (মদীনা) নগরে। কুরাইশরা লোক দু’টির আগমনের উদ্দেশ্য জানতে পেরে মহাখুশী হয়ে মক্কায় ফিরলো। তারা মক্কাবাসীদের সুসংবাদ দিলঃ “তোমরা উল্লাস কর। কিসরা এবার মুহাম্মাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। তার অনিষ্ট থেকে তোমরা এবার মুক্তি পাবে।”
এদিকে লোক দু’টি মদীনায় পৌঁছলো। তারা রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে সাক্ষাৎ করে ‘বাজান’ –এর পত্রটি তাঁর হাতে দিয়ে বললোঃ “শাহানশাহ কিসরা আমাদের বাদশাহ ‘বাজান’কে লিখেছেন, তিনি যেন আপনাকে নেওয়ার জন্য লোক পাঠান। আমরা তাঁরই নির্দেশে আপনাকে নিতে এসেছি। আমাদের আহবানে সাড়া দিলে আপনার যাতে মঙ্গল হয় এবং তিনি যাতে আপনাকে কোন রকম শাস্তি না দেন সে ব্যাপারে আমরা কিসরার সাথে কথা বলবো। আর আমাদের আহবানে সাড়া না দিলে একটু বুঝে শুনে দেবেন। কারণ আপনাকে এবং আপনার জাতিকে ধ্বংস করার ব্যাপারে তাঁর শক্তি ও ক্ষমতাতো আপনার জানা আছে।”
তাদের কথা শেষ হলে রাসূলুল্লাহ (সা) মৃদু হেসে বললেনঃ ‘তোমরা আজ তোমাদের অবস্থানে ফিরে যাও, আগামীকাল আবার একটু এসো।’
পরদিন তারা রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট উপস্থিত হয়ে বললোঃ ‘কিসরার সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে আমাদের সাথে যাওয়ার জন্য কি আপনি প্রস্তুতি নিয়েছেন?’ রাসূল (সা) বললেন! “তোমরা আর কক্ষণো কিসরার দেখা পাবে না। আল্লাহ তাকে ধ্বংস করেছেন। অমুক মাসের অমুক তারিখ তার পুত্র ‘শীরাওয়াইহ’ তাকে হত্যা করে সিংহাসন দখল করেছে।” একথা শুনেবিস্ময়ে চোখ ছানাবড়া করে তারা রাসূলুল্লাহকে (সা) দেখতে লাগলো। তারা বললোঃ
“আপনি কি বলছেন তা-কি ভেবে দেখেছেন? আমরা কি ‘বাজান’কে একথা লিখে জানাবো?”
রাসূলুল্লাহ (সা) বললেনঃ “হাঁ। আর তোমরা তাকে একথাও লিখবে যে, আমার এ দ্বীন কিসরার সাম্রাজ্যের প্রান্তসীমা পর্যন্ত পৌঁছাবে। তুমি যদি ইসলাম গ্রহণ কর, তোমার অধীনে যা কিছু আছে তা-সহ তোমার জাতির কর্তৃত্ব তোমাকে দেওয়া হবে।”
লোক দু’টি রাসূলুল্লাহর (সা) দরবার থেকে বের হয়ে সোজা ‘বাজান’ – এর নিকট পৌঁছলো এবং তাকে রাসূলুল্লাহর (সা) সমস্ত কথা অবহিত করলো। ‘বাজান’ মন্তব্য করলোঃ “মুহাম্মদ যা বলেছেন তা সত্য হলে তিনি অবশ্যই নবী। আর সত্য না হলে, আমরা তাকে উচিত শিক্ষা দেব।”
তদের এ আলোচনা চলছে, এমন সময় ‘বাজানের’ নিকট শীরাওয়াইহ’র পত্র এসে পৌঁছলো। পত্রের বিষয়বস্তু এরূপঃ “অতঃপর আমি কিসরাকে হত্যা করেছি। আমার জাতির পক্ষ থেকে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যই তাকে হত্যা করা হয়েছে। ……… আমার এ পত্র তোমার নিকট পৌঁছার পর তোমার আশে-পাশের লোকদের নিকট থেকে আমার আনুগত্যের অঙ্গীকার নেবে।”
‘বাজান’ শীরাওয়াইহ’র পত্রটি পাঠ করার সাথে সাথে তা ছুঁড়ে ফেলে এবং নিজেকে একজন মুসলমান বলে ঘোষণা দেয়। তার সাথে তার আশে-পাশে ইয়ামনে যত পারসিক ছিল তারা সকলে ইসলাম গ্রহণ করে।
এহলো পারস্য সম্রাট কিসরার সাথে হযরত আবদুল্লাহ ইবন হুজাফাহর (রা) ঘটনাটির সংক্ষিপ্তসার। রোমান কাইসারের সাথে তাঁর যে ঘটনাটি ঘটেছিল, তা আরো চমকপ্রদ। এ ঘটনাটি ঘটে দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমারের খিলাফতকালে।
হিজরী ১৯ সনে খলীফা উমার (রা) রোমানদের বিরুদ্ধে একটি বাহিনী পাঠালেন। এই বাহিনীতে আবদুল্লাহ ইবন হুজাফাহ আস-সাহমীও ছিলেন। কাইসার মুসলিম মুজাহিদদের ঈমান, বীরত্ব এবং আল্লাহ ও রাসূলের জন্য অকাতরে জীবন বিলিয়ে দেওয়ার বহু কাহিনী শুনতেন। তিনি তাঁর সৈন্যদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, কোন মুসলমান সৈনিক বন্দী হলে তাকে জীবিত অবস্থায় তাঁর কাছে পাঠিয়ে দেবে। আল্লাহর ইচ্ছায় হযরত আবদুল্লাহ রোমানদের হাতে বন্দী হলেন। রোমানরা তাকে তাদের বাদশার নিকট হাজির করে বললোঃ “এ ব্যক্তি মুহাম্মাদের একজন সহচর, প্রথম ভাগেই সে তাঁর দ্বীন গ্রহণ করেছে। আমাদের হাতে বন্দী হয়েছে, আমরা আপনার নিকট উপস্থিত করেছি।”
রোমান সম্রাট আবদুল্লাহ ইবন হুজাফাহর দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললোঃ
‘আমি তোমার নিকট একটি বিষয় উপস্থাপন করতে চাই।’ আবদুল্লাহঃ ‘বিষয়টি কি?’
সম্রাটঃ “আমি প্রস্তাব করছি তুমি খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণ কর। যদি তা কর, তোমাকে মুক্তি দেব এবং তোমাকে সম্মানিত করবো।”
বন্দী আবদুল্লাহ খুব দ্রুত ও দৃঢ়তার সাথে বললেনঃ
‘আফসুস! যেদিকে আপনি আহবান জানাচ্ছেন তার থেকে হাজার বার মৃত্যু আমার অধিক প্রিয়।’
সম্রাটঃ ‘আমি মনে করি তুমি একজন বুদ্ধিমান লোক। আমার প্রস্তাব মেনে নিলে আমি তোমাকে আমার ক্ষমতার অংশীদার বানাবো, আমার কন্যা তোমার হাতে সমর্পণ করবো এবং আমার এ সম্রাজ্য তোমাকে ভাগ করে দেব।’
বেড়ী পরিহিত বন্দী মৃদু হেসে বললেনঃ “আল্লাহর কসম, আপনার গোটা সাম্রাজ্য এবং সেই সাথে আরবদের অধিকারে যা কিছু আছে সবই যদি আমাকে দেওয়া হয়, আর বিনিময়ে আমাকে বলা হয় এক পলকের জন্য মুহাম্মাদের (সা) দ্বীন পরিত্যাগ করি, আমি তা করবো না।”
সম্রাটঃ ‘তাহলে আমি তোমাকে হত্যা করবো।’
বন্দীঃ ‘আপনার যা খুশী করতে পারেন।’
সম্রাটের নির্দেশে বন্দীকে শূলীকাষ্ঠে ঝুলিয়ে কষে বাঁধা হল। দু’হাতে ঝুলিয়ে বেঁধে খৃষ্টধর্ম পেশ করা হল, তিনি অস্বীকার করলেন। তারপর দু’পায়ে ঝুলিয়ে বেঁধে ইসলাম পরিত্যাগের আহবান জানানো হল, তিনি দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করলেন।
সম্রাট তাঁর লোকদের থামতে বলে তাঁকে শূলীকাষ্ঠ থেকে নামিয়ে আনার নির্দেশ দিলেন। তারপর বিশাল এক কড়াই আনিয়ে তার মধ্যে তেল ঢালতে বললেন। সেই তেল আগুনে ফুটানো হল। টগবগ করে যখন তেল ফুটতে লাগলো তখন অন্য দু’জন মুসলমান বন্দীকে আনা হল। তাদের একজনকে সেই উত্তপ্ত তেলের মধ্যে ফেলে দেওয়া হল। ফেলার সাথে তার দেহের গোশত ছিন্নভিন্ন হয়ে হাড় থেকে পৃথক হয়ে গেল।
সম্রাট আবদুল্লাহর দিকে ফিরে তাকে আবার খৃষ্টধর্ম গ্রহণের আহবান জানালেন। আবদুল্লাহ এবার পূর্বের চেয়ে আরো বেশী কঠোরতার সাথে প্রত্যাখ্যান করলেন। সম্রাটের নির্দেশে এবার আবদুল্লাহকে সেই উওপ্ত তেল ভর্তি কড়াইয়ের কাছে আনা হল। এবার আবদুল্লাহর চোখে অশ্রু দেখা দিল। লোকেরা সম্রাটকে বললো, ‘বন্দী এবার কাঁদছে।’ সম্রাট মনে করলেন, বন্দী ভীত হয়ে পড়েছে। তিনি নির্দেশ দিলেন, ‘বন্দীকে আমার কাছে নিয়ে এস।’ তাঁকে আনা হল। এবারও তিনি ঘৃণাভরে খৃষ্টধর্ম প্রত্যাখ্যান করলেন। সম্রাট তখন আবদুল্লাহকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘তোমার ধ্বংস হোক! তাহলে কাঁদছো কেন?’ আবদুল্লাহ জবাব দিলেনঃ “আমি একথা চিন্তা করে কাঁদছি যে, এখনই আমাকে এই কড়াইয়ের মধ্যে নিক্ষেপ করা হবে এবং আমি শেষ হয়ে যাব। অথচ আমার বাসনা, আমার দেহের পশমের সমসংখ্যক জীবন যদি আমার হতো এবং সবগুলিই আল্লাহর রাস্তায় এই কড়াই’য়ের মধ্যে বিলিয়ে দিতে পারতাম।”
এবার খোদাদ্রোহী সম্রাট বললেনঃ ‘অন্ততঃপক্ষে তুমি যদি আমার মাথায় একটা চুম্বন কর, তোমাকে আমি ছেড়ে দেব।’
আবদুল্লাহ প্রথমে এ প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করলেন। তবে শর্ত আরোপ করে বললেন, ‘যদি আমার সাথে অন্য মুসলিম বন্দীদেরও মুক্তি দেওয়া হয়, আমি রাজি আছি।’
সম্রাট বললেনঃ হ্যাঁ, অন্যদেরও ছেড়ে দেওয়া হবে।’
আবদুল্লাহ বলেনঃ ‘আমি মনে মনে বললাম, বিনিময়ে অন্য মুসলিম বন্দীদেরও মুক্তি দেওয়া হবে, এতে কোন দোষ নেই।’ তিনি সম্রাটের দিকে এগিয়ে গিয়ে তাঁর মাথায় চুম্বন করলেন। রোমান সম্রাট মুসলিম বন্দীদের একত্র করে আবদুল্লাহর হাতে তুলে দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। সর্বমোট বন্দীর সংখ্যা ছিল ৮০ জন।
হযরত আবদুল্লাহ (রা) মদীনায় ফিরে এসে খলীফা উমারের (রা) নিকট ঘটনাটি আনুপূর্বিক বর্ণনা করলেন। আনন্দে খলীফা ফেটে পড়লেন। তিনি উপস্থিত সেই বন্দীদের প্রতি তাকিয়ে বললেনঃ ‘প্রতিটি মুসলমানের উচিত আবদুল্লাহ ইবন হুজাফাহর মাথায় চুম্বন করা এবং আমিই তার সুচনা করছি।’ এই বলে তিনি উঠে দাঁড়িয়ে তাঁর মাথায় চুম্বন করলেন। (দ্রষ্টব্যঃ হায়াতুস সাহাবা – ১/৩০২, আল-ইসাবা-২/২৯৬-৯৭, আল-ইসতিয়ার, সুওয়ারুম মিন হায়াতিস সাহাবা – ১/৫১-৫৬, উসুদুল গাবাহ-৩/১৪৩)
মক্কা বিজয়ের পর রাসূলুল্লাহ (সা) খালিদ ইবনুল ওয়ালিদকে বনী জুজাইমা গোত্রে ইসলামের দাওয়াত দানের জন্য পাঠান। ভুল বুঝাবুঝির কারণে খালিদ তাদের ওপর আক্রমণ চালান এবং তাদের বেশ কিছু লোক হতাহত হয়। এ ঘটনায় রাসূল (সা) মর্মাহত হন। তিনি নিহত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ দান করেন এবং খালিদকেও ক্ষমা করে দেন। ইবন ইসহাক বলেন, এ ব্যাপারে খালিদকে নিন্দামন্দ করা হলে তিনি বলেছিলেন, ‘আবদুল্লাহ ইবন হুজাফাহ আস-সাহামী আদেশ দিয়েছিলেন বলেই আমি তাদের সাথে যুদ্ধ করেছিলাম। তিনি বলেছিলাম। তিনি বলেছিলেনঃ যদি তারা ইসলাম গ্রহণ থেকে বিরত থাকে, রাসূলুল্লাহ (সা) তাদের সাথে যুদ্ধের নির্দেশ তোমাকে দিয়েছেন।’ (সীরাতু ইবন হিশাম – ২/৪৩০)
একদিন রাসূলুল্লাহ (সা) মিম্বরের ওপর বসে ঘোষণা করেন, “আমি এখানে বসে থাকাকালীন তোমাদের যে কোন ব্যক্তি যে কোন প্রশ্ন করলে তার জবাব দেওয়া হবে।” আবদুল্লাহ ইবন হুজাফাহ উঠে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘আমার পিতা কে?’ রাসূলুল্লাহ (সা) ‘বললেন, তোমার পিতা হুজাফাহ।’ (আল-ইসাবা – ২/২৯৬) তাঁর মা একথা শুনে বলেন, ‘তুমি রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট কী মারাত্মক প্রশ্নই না করেছিলে। আল্লাহ না করুন, তিনি যদি অন্য কিছু বলতেন, আমার অবস্থা কেমন হতো?’
আবদুল্লাহ জবাব দিলেন, “আমি নসবের সত্যতা যাচাই করছিলাম। তিনি যদি আমাকে কোন হাবশী দাসের সাথে সম্পৃক্ত করতেন, আমি তা মেনে নিতাম।” (আল-ইসতিয়াব)
হযরত আবদুল্লাহ ইবন হুজাফাহ থেকে বেশ কয়েকটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তম্মধ্যে একটি বুখারী বর্ণনা করেছেন। উল্লেখযোগ্য যারা তাঁর থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন তাঁরা হলেন – আবু ওয়ায়িল, সুলাইমান ও ইবন ইয়াসার।
ইবন ইউনুস বলেন, আবদুল্লাহ মিসর অভিযানে অংশ গ্রহণ করেন এবং হযরত উসমানের খিলাফতকালে মিসরেই ইনতিকাল করেন। তিনি মিসরেই সমাহিত হন। (আল-ইসাবা – ২/২৯৬)
জাবির (রা) থেকে বর্ণিত। এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট কিছু সাহায্য চাইলেন। তিনি দান করলেন। তারপর আরেক ব্যক্তি চাইলো। তিনি অঙ্গীকার করলেন। উমার ইবনুল খাত্তাব উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমার কাছে সাহায্য চাওয়া হয়েছে, আমি দিয়েছি। আবার চাওয়া হয়েছে, আবারো দিয়েছি। তারপর আবার চাওয় হয়েছে, অঙ্গীকার করেছি।” মনে হলো। তাঁর কথাটি রাসূলুল্লাহর (সা) পছন্দ হলোনা। আবদুল্লাহ ইবন হুজাফাহ, তখন উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, আপনি খরচ করুন, আরশের অধিকারী যিনি তার কাছে স্বল্পতার আশংকা করবেন না।” রাসূল (সা) বললেনঃ ‘আমাকে একথারই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’ (হায়াতুস সাহাবা – ২/১৪৫)
ইবন আসাকির যুহরী থেকে বর্ণনা করেছেন। রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট আবদুল্লাহর বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হলো, ‘তিনি একজন রসিক ও হাস্য-কৌতুকপ্রিয় মানুষ।’ তিনি বললেন, “তার কথা ছেড়ে দাও। কারণ, তার একটি বড় পেট আছে। সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে বড় ভালোবাসে।” (হায়াতুস সাহাবা – ২/৩২১)