নাম আবদুল্লাহ, ডাক নাম বা কুনিয়াত আবু সুহাইল। পিতা সুহাইল এবং মাতা ফাখতা বিনতু আমের।
ইসলামের প্রথম পর্বে ঈমান আনেন এবং হাবশা অভিমূখী দ্বিতীয় কাফিলার সাথে হাবশায় হিজরাত করেন। কিছুদিন হাবশায় অবস্থানের পর মক্কায় ফিরে এলে পিতা তাকে বন্দী করে এবং তার ওপর নির্দয় অত্যাচার চালায়। আবদুল্লাহ অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে ইসলাম ত্যাগ করে পুনরায় মুশরিকী জীবনে বা পৌত্তলিকতায় ফিরে যাওয়ার ভান করেন। মাতা পিতা ও মক্কার মুশরিকরা তার বাহ্যিক আচরণ দেখে ইসলাম পরিত্যাগ সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হয়ে যায়।
এদিকে হযরত রাসূলে কারীম সা: মক্কা ছেড়ে মদীনায় চলে যান। মক্কা ও মদীনার মাঝে সামরিক সংঘর্ষ শুরু হয়। মক্কাবাসীরা আবদুল্লাহকে তাদের সহযোদ্ধা হিসেবে বদরে মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়বার জন্য নিয়ে যায়। কিন্তু যে হৃদয়ে একবার ঈমানের নুর প্রবেশ করে সেখানে যে কক্ষনো শিরকের অন্ধকার প্রবেশ করতে পারে না- এ কথাটি তাদের জানা ছিল না। মূলত: আবদুল্লাহ কোনদিন ইসলাম ত্যাগ করেননি। তিনি শুধু সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। বদরে মুসলিম বাহিনীতে যোগদান করেন।
এক আকস্মিক ঘটনায় আবদুল্লাহর পিতা ক্রোধে ফেটে পড়ে। সে এর প্রতিশোধকল্পে প্রচণ্ড বেগে আক্রমণ চালায়। কিন্তু তাতে কোন লাভ হলোনা। আবদুল্লাহ তখন স্বাধীন, তাঁর দ্বীনী ভাইদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পিতার বাহিনীর বিরুদ্ধে বীরত্বের সাথে লড়ছেন। অবশেষ বিজয় হলো মুসলমানদের। বদরের পর সকল প্রসিদ্ধ যুদ্ধেই হযরত আবদুল্লাহ রা: রাসুলুল্লাহ’র সা: সংগে থেকে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেন। হুদাইবিয়ার সন্ধি ও বাইয়াতে রিদওয়ানেও তিনি শরীক ছিলেন। (আল ইসাবা-২/৩২৩)।
মক্কা বিজয়ের সময়ও হযরত আবদুল্লাহ রা: রাসুলুল্লাহর সা: সফরসঙ্গী ছিলেন। তার পিতা সুহাইল তখনও মক্কায় কাফির অবস্থায় জীবিত। হযরত আবদুল্লাহ রা: পিতার জন্য রাসুলুল্লাহ সা: এর নিকট আমান বা নিরাপত্তা চাইলেন। এ সম্পর্কে তার পিতা সুহাইল বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সা: যখন মক্কায় প্রবেশ করেন, আমি আমার ঘরে প্রবেশ করে দরযা বন্ধ করে দিলাম। তারপর আমার ছেলে আবদুল্লাহকে আমার নিরাপত্তার আবেদন জানানোর জন্য মুহাম্মাদের সা: নিকট পাঠালাম। কারণ, আমি যে নিহত হবোনা, এমন বিশ্বাস আমার ছিল না। আবদুল্লাহ রাসুলুল্লাহর সা: নিকট গিয়ে বললো, ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ, আমার পিতাকে কি আমান বা নিরাপত্তা দান করছেন?’ রাসুলুল্লাহ সা: বললেন: ‘হাঁ। তাকে আল্লাহর আমানে আমান বা নিরাপত্তা দেওয়া গেল। সে আত্মপ্রকাশ করুক।’ অত:পর রাসুলুল্লাহ সা: তার আশে পাশের লোকদের বললেন, ‘সুহাইল ইবন আমরকে কেউ যেন হেয় চোখে না দেখে। আল্লাহর কসম, সে একজন সম্মানী ও বুদ্ধিমান ব্যক্তি। এমন ব্যক্তি কক্ষণো ইসলামের সৌন্দর্য থেকে অজ্ঞ থাকতে পারে না। এখন তো সে দেখতে পেয়েছে, সে যার সাহায্যকারী ছিল তাতে কোন কল্যাণ নেই।’
হযরত আবদুল্লাহ রা: পিতার নিকট উপস্থিত হয়ে রাসুলুল্লাহ’র সা: নির্দেশ শুনিয়ে সুসংবাদ দিলেন। পিতা পুত্রের সৌভাগ্যে আনন্দে বিগলিত হয়ে বলে ওঠেন, ‘ আল্রাহর কসম, তুমি ছোটবেলা ও বড় হয়ে উভয় জীবনে সতকর্মশীল।’ রাসুলুল্লাহ সা: এ আশ্বাসের পর সুহাইল দ্বিধা-দ্বন্দ্বে দোদুল্যমান অবস্থায় তাঁর দরবারে হাজির হন। হুনাইন যুদ্ধে যোগদানের উদ্দেশ্যে রাসুলুল্লাহ সা: সাথে মক্কা থেকে রওয়ানা হন। পথে মক্কার অনতিদূরে ‘জি’রানা’ নামক স্থানে পৌঁছে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। হযরত রাসূলে কারীম সা: হুনাইনের গণীমত থেকে তাঁকে ১০০ (একশো) উট দান করেন। (হায়াতুস সাহাবা-১/১৭৩-১৭৪)।
খলীফা আবু বকর সিদ্দীক রা: এর খিলাফত কালে আরব উপদ্বীপে যাকাত অস্বীকারকারী ও ভন্ড নবীদের যে বিদ্রোহ দেখা দেয়, হযরত আবদুল্লাহ রা: সেই বিদ্রোহ দমনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। হিজরী ১২ সনে ইয়ামামার প্রান্তরে ভন্ড নবী মুসাইলামার সাথে যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়, আবদুল্লাহ সেখানেই শাহাদত বরণ করেন। সর্বাধিক প্রসিদ্ধ মতানুসারে মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র আটত্রিশ বছর।
আবদুল্লাহর রা: পিতা সুহাইল তখনও মক্কায় জীবিত। এ ঘটনার পর খলীফা হযরত আবু বকর রা: হজ্জের উদ্দেশ্যে মক্কায় আসেন। তিনি আবদুল্লাহর পিতার সাথে দেখা করে তাঁকে সান্তনা দেওয়ার চেষ্ঠা করেন। আবদুল্লাহর পিতা খলীফাকে বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ সা: বলেছেন, একজন শহীদ ব্যক্তি তার পরিবারের সত্তর (৭০) জনের শাফায়াত বা সুপারিশ করবে। আমার আশা আছে, সে সময় আমার ছেলে আমাকে ভুলবে না।’