মু’য়াজ ইবন জাবাল (রা)

নাম মু’য়াজ, ডাকনাম আবু আবদির রহমান এবং লকব বা উপাধি ‘ইমামুল ফুকাহা, কানযুল ’উলামা ও রাব্বানিয়্যূল কুলূব।’ মদীনার খাযরাজ গোত্রের উদায় ইবন সা’দ শাখার সন্তান। অনেকে তাঁকে সালামা ইবন সা’দ শাখার সন্তান বলে উল্লেখ করেছেন। মুহাম্মদ ইবন ইসহাক বলেছেন, প্রকৃত পক্ষে তিনি ছিলেন বনু কুদা’য়া গোত্রের সন্তান, উদায় ইবন সা’দ গোত্রের নাম। এ গোত্রের লোকেরা তাঁকে নিজেদের গোত্রের লোক বলে দাবী করতো। (আনসাবুল আশরাফ- ১/২৪৭, আল-ইসাবা- ৪/৪২৭, সীরাতু ইবন হিশাম- ১/৪৬৪, উসুদুল গাবা- ৪/৩৭৬) হিজরাতের ২০ বছর পূর্বে ৬০৩ খৃষ্টাব্দে ইয়াসরিবে (মদীনায়) জন্মগ্রহণ করেন। (আল-আ’লাম- ৮/১৬৬)

তাঁর বংশের উর্ধ্বতন পুরুষ সা’দ ইবন আলীর ছিল দুই ছেলে। তাদের নাম সালামা ও উদায়। সালামার বংশকে বলা হয় বনু সালামা। এই বংশে আবু কাতাদাহ, জাবির ইবন আবদিল্লাহ, কা’ব ইবন মালিক, ’আবদুল্লাহ ইবন ’আমর ইবন হারাম- এর মত বিখ্যাত সাহাবী জন্মগ্রহণ করেন। উল্লেখিত ব্যক্তিবৃন্দ ছাড়াও আরও বহু বিশিষ্ট ব্যক্তির এই বংশের সাথে সম্পর্ক ছিল। কিন্তু সালামার ভাই উদায়-এর বংশে রাসূলুল্লাহর সা. মদীনায় হিজরাতের সময় শুধু এক মু’য়াজ-ই জীবিত ছিলেন এবং হিজরী ১৮ অথবা ১৯ সনে তাঁর মৃত্যুর সাথে এই বংশধারা চিরদিনের জন্য বিলীন হয়ে যায়।

ইমাম সাম’য়ানী ‘কিতাবুল আনসাব’ গ্রন্থে হুসাইন ইবন মুহাম্মাদ ইবন তাহিরকে এই উদায়-এর বংশের লোক বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এ তথ্য সঠিক নয়। কারণ নির্ভরযোগ্য বর্ণনাসমূহ দ্বারা একথা প্রমাণিত যে, ইসলামের প্রাথমিক পর্বে এই খান্দানের দুই ব্যক্তি জীবিত ছিলেন। তাঁদের একজন মু’য়াজ ইবন জাবাল এবং দ্বিতীয় জন তাঁরই ছেলে ’আবদুর রহমান। আর তাঁরা উভয়ে শামের ‘আমওয়াসের মহামারিতে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। (উসুদুল গাবা- ৪/৩৭৬)

বনু উদায়- এর বাসস্থান তাদের চাচাতো গোষ্ঠী বনু সালঅমের পাশে মসজিদুল কিবলাতাইন- এর ধারে কাছেই ছিল। হযরত মু’য়াজের বাড়ীটিও ছিল এখানে।
হযরত মু’য়াজের পিতা জাবাল ইবন আমর এবং মাতা হিন্দা বিনতু সাহল আল-জুহানিয়্যা। বদরী সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনুল জাদ্দ (রা) তাঁর বৈপিত্রীয় ভাই। (তাবাকাত- ৩/৫৭১, ৫৮৩) মু’য়াজের ছেলের নাম ছিল আবদুর রহমান। এ জন্য তাঁকে আবু ’আবদির রহমান বলে ডাকা হতো। (তাবাকাত- ৩/৫৮৩)

মক্কা থেকে মদীনায় প্রেরিত রাসূলুল্লাহর সা. দা’ঈ-ই-ইসলাম হযরত মুস’য়াব ইবন উমাইরের রা. হাতে নবুওয়াতের দ্বাদশ বছরে হযরত মু’য়াজ যখন ইসলাম গ্রহণ করেন তখন তাঁর বয়স ১৮ বছর। (উসুদুল গাবা- ৪/৩৭৬) তাঁর ইসলাম গ্রহণের পর পরবর্তী হজ্জ মওসুমে মুস’য়াব ইবন ’উমাইর মক্কায় চললেন। মদীনাবাসী নবদীক্ষিত মুসলমান ও মুশরিকদের একটি দলও হজ্জ্বের উদ্দেশ্যে তাঁর সংগী হলো। হযরত মুয়াজও ছিলেন এই কাফিলার একজন সদস্য। মক্কার আকাবায় তাঁরা গোপনে রাসূলুল্লাহর সা. দীদার লাভ করে তাঁর হাতে বাইয়াত করেন। এটা ছিল আকাবার তৃতীয় বা শেষ বাইয়াত। এই দলটি মক্কা থেকে ফিরে আসার পর মদীনার ঘরে ঘরে ইসলামের দা’ওয়াত ছড়িয়ে পড়ে।

অল্প বয়স্ক মু’য়াজ যখন মক্কা থেকে ফিরলেন, ঈমানী আবেগে তাঁর অন্তর তখন ভরপুর। এখন কারও বাড়ী মূর্তি থাকাটা তাঁর নিকট অসহনীয়। মদীনায় ফিরে তিনি এবং তাঁর মত আরও কিছু যুবক সিদ্ধান্ত নিলেন তাঁরা প্রকাশ্যে বা গোপনে যেভাবেই হোক মদীনাকে প্রতীমামুক্ত করবেন। তাঁদের এই আন্দোলনের ফলে হযরত ’আমর ইবনুল জামূহ প্রতীমা পূজা ত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করেন।

’আমর ইবনুল জামূহ ছিলেন মদীনার বনু সালামা গোত্রের অতি সম্মানিত সরদার। অন্য নেতাদের মত তাঁরও ছিল একটি অতি প্রিয় কাঠের প্রতীমা। প্রতীমাটির নাম ছিল মানাত। এই প্রতীমাটির প্রতি ছিল ’আমরের অত্যধিক ভক্তি ও শ্রদ্ধা। তিনি অতি যত্নসহকারে সুগন্ধি মাখিয়ে রেশমী কাপড় দিয়ে সেটি সব সময় ঢেকে রাখতেন।
মক্কা থেকে ফেরা এই তরুণরা রাতের অন্ধকারে একদিন চুপে চুপে মূর্তিটি তুলে নিয়ে বনু সালামা গোত্রের ময়লা-আবর্জনা ফেলার গর্তে ফেলে দেয়। ইবন ইসহাক এই উৎসাহী তরুণদের তিনজনের নাম উল্লেখ করেছেন। তাঁরা হলেনঃ মু’য়াজ ইবন জাবাল, আবদুল্লাহ ইবন উনাইস ও সালামা ইবন গানামা। (সীরাতু ইবন হিশাম- ১/৬৯৯)

সকালে ঘুম থেকে উঠে ’আমর ইবন জামূহ যথাস্থানে প্রতীমাটি না পেয়ে খোঁজা-খুঁজি শুরু করলেন। এক সময় ময়লা-আবর্জনার স্তূপে প্রতীমাটি মুখ থুবড়ে পড়ে থাকতে দেখে ব্যথিত কণ্ঠে বলেনঃ তোমাদের সর্বনাশ হোক! গত রাতে আমাদের ইলাহ’র সাথে কারা এমন আচরণ করলো? তিনি প্রতীমাটি সেখান থেকে তুলে ধুলে মুছে পরিষ্কার করে আতর-সুগন্ধি লাগিয়ে আবার যথাস্থানে রেখে দিলেন। প্রতীমাকে সম্বোধন করে বললেনঃ ওহে মানাত, আমি যদি জানতাম, কারা তোমার সাথে এমন আচরণ করেছে!

পরদিন রাতে আবার একই ঘটনা ঘটলো। সকালে ’আমর খুঁজতে খুঁজতে অন্য একটি গর্ত থেকে প্রতীমাটি উদ্ধার করে ধুয়ে মুছে আগের মত রেখে দেন। পরের রাতে একই ঘটনা ঘটলো। তিনিও আগের মত সেটি কুড়িয়ে এনে একই স্থানে রেখে দিলেন। তবে এ দিন তিনি প্রতীমাটির কাঁধে একটি তরবারি ঝুলিয়ে দিয়ে বলেনঃ
‘‘আল্লাহর কসম! তোমার সাথে কে বা কারা এমন আচরণ করছে, আমি জানিনে। তবে তুমি তাদের দেখেছো। হে মানাত, তোমার মধ্যে যদি কোন ক্ষমতা থাকে তুমি তাদের থেকে আত্মরক্ষা কর। এই থাকলো তোমার সাথে তরবারি।’’

রাত হলো। তরুণরা আজও এলো। তারা প্রতীমার কাঁধ থেকে তরবারি তুলে নিয়ে একটি মৃত কুকুরের সাথে সেটি বাঁধলো। তারপর প্রতীমাসহ কুকুরটি একটি নোংরা গর্তে ফেলে চলে গেল। ’আমর সকালে খুঁজতে বেরিয়ে মূর্তিটির এমন দশা দেখে তাকে লক্ষ্য করে একটি কবিতা আবৃত্তি করেন। তার প্রথম লাইনটি এমনঃ
‘আল্লাহর কসম! তুমি যদি সত্যিই ইলাহ হতে তাহলে এমনভাবে কুকুর ও তুমি এক সাথে গর্তে পড়ে থাকতে না।’ (সীরাতু ইবন হিশাম- ১/৪৫৩-৫৪)
এভাবে ’আমর ইবন জামূহ মূর্তিপূজার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। (দ্রঃ সুওয়ারুম মিন হায়াতিস সাহাবা- ৭/১২২-১২৬, হায়াতুস সাহাবা- ১/২৩০, সীরাতু ইবন হিশাম- ১/৪৫২, ৪৫৩, ৬৯৯)

হযরত মু’য়াজের ইসলাম গ্রহণের অল্পকাল পরে হযরত রাসূলে কারীম সা. মদীনায় হিজরাত করেন। এরপর উহুদ, খন্দকসহ সকল যুদ্ধে রাসূলুল্লাহর সা. সাথে যোগ দেন। (তাবাকাত- ৩/৫৮৪, আল-আলাম- ৮/১৬৬)

হযরত মু’য়াজ রাসূলুল্লাহর সা. জীবদ্দশায় কুরআন মজীদ হিফজ করেন। রাসূলে কারীমের সা. জীবনকালে যে ছয় ব্যক্তি কুরআন সংয়গ্রহ ও সংরক্ষণ করেন তিনি তাঁদের অন্যতম। (আল-আ’লাম- ৮/১৬৬)

রাসূলুল্লাহর সা. জীবদ্দশায় বনু সালামার মহল্লায় একটি মসজিদ নির্মিত হলে হযরত মু’য়াজ এই মসজিদের ইমাম নিযুক্ত হন। একদিন তিনি ’ঈশার নামাযে সূরা বাকারাহ পাঠ করেন। পিছনে মুকতাদীদের মধ্যে ছিলেন কর্মক্লান্ত এক ক্ষেত মজুর। হযরত মু’য়াজের নামায শেষ করার আগেই তিনি নামায ছেড়ে চলে যান। নামায শেষে মু’য়াজ বিষয়টি জানতে পেরে মন্তব্য করেনঃ সে একজন মুনাফিক (কপট মুসলমান)। লোকটি রাসূলুল্লাহর সা. নিকট মু’য়াজের বিরুদ্ধে নালিশ জানালো। রাসূলুল্লাহ সা. মু’য়াজকে ডেকে বললেনঃ মুয়াজ! তুমি কি মানুষকে ফিতনায় ফেলতে চাও? তারপর তিনি বলেনঃ ছোট ছোট সূরা পাঠ করবে। কারণ, তোমার পিছনে বৃদ্ধ, দুর্বল ও ব্যস্ত লোকও থাকে। তাদের সবার কথা তোমার স্মরণে থাকা উচিত। (বুখারী- ১/৯৮)

হিজরী নবম সনে হযরত রাসূলে কারীম সা. তাবুক অভিযান শেষ করে সবে মাত্র মদীনায় ফিরেছেন। এমন সময় রমজান মাসে ইয়ামনের হিময়ার গোত্রের শাসকের দূত মদীনায় খবর নিয়ে আসে যে, ইয়ামনবাসীরা ইসলাম গ্রহণ করেছে। এ খবর পেয়ে রাসূল সা. সেখানকার আমীর হিসাবে মু’য়াজ ইবন জাবালকে মনোনীত করেন।
আমীর মনোনীত হওয়ার পূর্বে হযরত মু’য়াজের সকল সহায় সম্পত্তি ঋণের দায়ে বিক্রী হয়ে গিয়েছিল। হযরত জাবির ইবন ’আবদিল্লাহ বলেনঃ চেহারা-সুরৎ, স্বভাব-চরিত্র ও দানশীলতার দিক দিয়ে মু’য়াজ ছিলেন সর্বোত্তম লোকদের অন্যতম। দরায হস্তের কারণে তিনি প্রচুর ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। পাওনাদাররা তাগাদা দিতে শুরু করলে কিছুদিন তিনি বাড়ীতে লুকিয়ে থাকেন। তারা তাদের পাওনা আদায় করে দেওয়ার জন্য রাসূলুল্লাহকে সা. অনুরোধ করলো। রাসূল সা. মু’য়াজকে ডাকলেন। পাওনাদার হাজির হলো। তাঁরা বললোঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ, মু’য়াজের নিকট থেকে আমাদের পাওনা আদায় করে দিন। রাসূল সা. মু’য়াজের দুর্দশা দেখে পাওনাদারদের বললেনঃ যে তার পাওনা মাফ করে দেবে আল্লাহ তার ওপর রহমত বর্ষণ করবেন। রাসূলুল্লাহর সা. এ কথার পর কিছু পাওনাদার তাদের দাবী ছেড়ে দেয়। তবে অনেকে দাবী ছাড়তে নারাজি প্রকাশ করে। তখন রাসূল সা. বললেনঃ মু’য়াজ, তুমি ধৈর্য ধর। তারপর তিনি মু’য়াজের সকল সম্পদ পাওনাদারদের মধ্যে ভাগ করে দিলেন। তাতেও তার সব ঋণ পরিশোধ হলো না। তখন তিনি পাওনাদারদের বললেনঃ এর অতিরিক্ত তোমরা পাবেনা, এই গুলিই নিয়ে যাও।

রাসূলুল্লাহর সা. দরবার থেকে হযরত মু’য়াজ রিক্ত হস্তে বনু সালামার দিকে ফিরে গেলেন। সেখানে এক ব্যক্তি বললোঃ আবু আবদির রহমান, তুমি রাসূলুল্লাহর সা. নিকট কিছু সাহায্য চাইলে না কেন? আজ তো তুমি একেবারে কপর্দকহীন হয়ে পড়েছ। মু’য়াজ বললেনঃ চাওয়া আমার স্বভাব নয়। মু’য়াজের কথা রাসূলুল্লাহর সা. স্মরণ ছিল। একদিন পর তিনি মু’য়াজকে ডাকলেন এবং তাঁকে ইয়ামনে আমীর হিসাবে নিযুক্তির কথা জানিয়ে বললেনঃ আশা করা যায় আল্লাহ তোমার ক্ষতি পুষিয়ে দেবেন এবং তোমার ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা করবেন। (উসুদুল গাবা- ৪/৩৭৭, তাজকিরাতুল হুফ্ফাজ- ১/২১, তাবাকাত- ৩/৫৮৪)

যদিও হযরত মু’য়াজের আমীর হওয়ার যোগ্যতার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহর সা. পূর্ণ আস্থা ছিল, তবুও তাঁকে ইয়ামনে পাঠানোর পূর্বে একটি পরীক্ষা নেওয়া উচিত মনে করলেন। তিনি মু’য়াজকে ডেকে প্রশ্ন করলেনঃ
– আচ্ছা, তুমি ফায়সালা করবে কিভাবে?
– কুরআনের দ্বারা।
– যদি এমন কোন বিষয় আসে যার সমাধান কুরআনে না পাও, তখন কি করবে?
– আল্লাহর রাসূলের সুন্নাতের দ্বারা ফায়সালা করবো।
– যদি এমন কোন বিষয়ের সম্মুখীন হও যার সমাধান কুরআন অথবা সুন্নাতে পাচ্ছ না, তখন কি করবে?
– আমি নিজেই ইজতিহাদ করে ফায়সালা করবো।

হযরত মু’য়াজ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন। তাঁর জবাবে রাসূল সা. সন্তুষ্ট হয়ে বললেনঃ সকল প্রশংসা আল্লাহর, যিনি তাঁর রাসূলের রাসূলকে (দূত) এমন জিনিসের তাওফীক বা ক্ষমতা দান করেছেন যা তাঁর রাসূলের পছন্দ। (আল-ইসতী’য়াব; আল-ইসাবার পার্শ্বটীকা- ৪/৪৫৮, তাবাকাত- ২/১৪৭-১৪৮)

মু’য়াজের পরীক্ষা শেষ করে রাসূল সা. ইয়ামানবাসীদের উদ্দেশ্যে একটি পত্র লেখেন। তাতে হযরত মু’য়াজের স্থান ও মর্যাদা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। (আল-আ’লাম- ৮/১৬৬) তিনি লেখেনঃ ‘ইন্নি বা’য়াস্তু লাকুম খায়রা আহলী-’- আমি আমার সর্বোত্তম আহল বা পরিজনকে তোমাদের নিকট পাঠালাম। তিনি আরও লিখলেন, তোমরা মু’য়াজ ও অন্য লোকদের সাথে ভালো ব্যবহার করবে। সাদাকা ও জিযিয়ার অর্থ তার নিকট জমা করবে। আমি মু’য়াজ ইবন জাবালকে ইয়ামনে বসবাসরত সকলের ওপর আমীর নিয়োগ করছি। তাকে সন্তুষ্ট রাখবে এবং এমন যেন না হয় যে সে তোমাদের ওপর অসন্তুষ্ট হয়েছে।

সফরের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে হযরত মু’য়াজ গেলেন রাসূলুল্লাহর সা. খিদমতে। সেখানে আরও লোক ছিল। হযরত রাসূলে কারীম সা. তাঁকে কিছুদূর এগিয়ে দিয়ে বিদায় নেন। মু’য়াজ উটের ওপর সাওয়ার ছিলেন, আর তাঁর পাশে রাসূল সা. পায়ে হেঁটে চলছিলেন। দুই জনের মধ্যে কিছু কথাবার্তাও হচ্ছিল। রাসূল সা. বললেনঃ মু’য়াজ তোমার দায়িত্ব অনেক। কেউ কিছু হাদিয়া দিলে তুমি তা গ্রহণ করবে। আমি তোমাকে তা গ্রহণের অনুমতি দিচ্ছি। বিদায়ের পূর্ব মুহূর্তে রাসূল সা. বললেনঃ ‘সম্ভবতঃ তোমার সাথে আমার আর দেখা হবে না। এরপর তুমি মদীনায় ফিরে আমার স্থলে আমার কবর ও মসজিদ যিয়ারত করবে।’ সাথে সাথে মু’য়াজ কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। রাসুল সা. বললেনঃ ‘কেঁদো না। কান্না শয়তানী কাজ। যাও আল্লাহ তোমাকে সব রকম বিপদ-আপদ থেকে হিফাজত করুন।’ একথা বলে রাসূল সা. মু’য়াজকে ছেড়ে দেন। মু’য়াজ অত্যন্ত ব্যথা ভারাক্রান্ত হৃদয়ে মদীনার দিকে তাকিয়ে বলেনঃ মুত্তাকীরাই (খোদাভীরু) আমার নিকটতম মানুষ- তা তারা যে কেউ হোক না কেন এবং যেখানেই থাকুক না কেন। (হায়াতুস সাহাবা- ২/৩৩৬)

হযরত মু’য়াজ ইয়ামনে মাত্র দুই বছর ছিলেন। হিজরী নবম সনে ’আমীরের দায়িত্ব নিয়ে ইয়ামনে যান এবং হিজরী একাদশ সনে সবকিছু ছেড়ে দিয়ে স্বেচ্ছায় মদীনায় ফিরে আসেন।

হযরত মু’য়াজ ইয়ামন যাওয়ার কিছুদিন পর রাসূল সা. ইনতিকাল করেন এবং হযরত আবু বকর রা. খলীফা হন। তিনি আমীরে হজ্জের দায়িত্ব দিয়ে ’উমারকে মক্কায় পাঠালেন। এদিকে হযরত মু’য়াজও হজ্জের উদ্দেশ্যে ইয়ামন থেকে সরাসরি তাঁর লাটবহর সহ মক্কায় পৌঁছলেন। মিনায় দুইজনের সাক্ষাৎ, কুশল বিনিময় ও কোলাকুলি হলো। মু’য়াজের সাথে তাঁর অনেকগুলি দাস ও লাটবহর দেখে ’উমার জিজ্ঞেস করলেনঃ
– আবু ’আবদির রহমান, এসব কি?
– এগুলি আমার। আমি অর্জন করেছি।
– কিভাবে অর্জন করলে?
– লোকেরা আমাকে হাদিয়া দিয়েছে।
– তুমি আবু বকরকে এসব কথা জানাবে এবং সবকিছুই তাঁর হাতে তুলে দেবে। যদি তিনি তোমাকে কিছু দান করেন, তুমি তা গ্রহণ করবে।
– আমি তোমার কথা মানবো না। মানুষ আমাকে দান করেছে, আর আমি তা আবু বকরের হাতে তুলে দেব?

হযরত ’উমার রা. মদীনায় ফিরে খলীফাকে পরামর্শ দিলেন, মু’য়াজের জীবন ধারণের মত কিছু অর্থ তাঁকে দিয়ে অবশিষ্ট সবকিছু বাইতুল মালে জমা করা হোক। আবু বকর জবাব দিলেনঃ তাঁকে ’আমীর নিয়োগ করেন খোদ রাসূলুল্লাহ সা.। সে যদি নিজেই জমা দিতে ইচ্ছা করে এবং আমার কাছে নিয়ে আসে, আমি গ্রহণ করবো। অন্যথায় এক কপর্দকও গ্রহণ করবো না। হযরত ’উমার খলীফার জবাব পেয়ে আবার মু’য়াজের কাছে যান এবং পুনরায় তাঁকে জমা দেওয়ার তাকিদ দেন। এবার মু’য়াজ বলেনঃ আমাকে রাসূল সা. ইয়ামনে শুধু এই জন্য পাঠান যে, আমি যেন সেখানে থেকে নিজের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারি। আমি কিছুই দেব না। হযরত ’উমার নীরবে উঠে চলে আসলেন। তবে তিনি নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন।

হযরত মু’য়াজ তো ’উমারকে ফিরিয়ে দিলেন; কিন্তু শেষ পর্যন্ত অদৃশ্য সাহায্যে তিনি ’উমারের সাথে একমত পোষণ করেন। মু’য়াজ রাতে ঘুমিয়ে গেলেন। সকালে ঘুম থেকে উঠে সোজা ’উমারের নিকট গিয়ে বললেনঃ আপনার কথা মানা ছাড়া আমার আর উপায় নেই। রাতে আমি স্বপ্নে দেখলাম, আমাকে জাহান্নামের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, আর আপনি আমাকে টেনে ধরে রেখেছেন। অন্য একটি বর্ণনা মতে মু’য়াজ পানিতে ডুবে যাচ্ছেন এবং ’উমার তাঁকে উদ্ধার করছেন। তারপর মু’য়াজ সকল দাস-দাসী সংগে করে খলীফা আবু বকরের নিকট হাজির হন এবং পুরো ঘটনা বর্ণনার পর বলেন, আমার কাছে যা কিছু আছে সবই এনে হাজির করছি। আবু বকর রা. বললেনঃ আমি তোমার নিকট থেকে কিছুই গ্রহণ করবো না, সবই তোমাকে হিবা বা দান করলাম। কারণ, আমি রাসূলকে সা. বলতে শুনেছিঃ ‘আশা করা যায় আল্লাহ তোমার ক্ষতি পুরণ করে দেবেন।’ অন্য একটি বর্ণনা মতে আবু বকর তাঁর নিকট থেকে কিছু সম্পদ গ্রহণ করে তাঁর অবশিষ্ট ঋণ পরিশোধ করেন এবং বাকী সম্পদ সবই তাঁকে দান করেন। হযরত ’উমার তখন মু’য়াজকে লক্ষ্য করে বলেনঃ এখন সবই তোমার কাছে রাখ। এখন তুমি অনুমতি প্রাপ্ত।

হযরত মু’য়াজ দাসদের সংগে করে বাড়ী ফিরলেন। তাদের সাথে জামায়াতে নামায আদায় করলেন। সালাম ফিরিয়ে তাদের জিজ্ঞেস করলেনঃ তোমরা কার জন্য নামায আদায় করলে? তারা বললোঃ আল্লাহর জন্য। মু’য়াজ বললেনঃ তাহলে তোমরা মুক্ত, তোমরা তাঁরই জন্য। (তাবাকাত- ৩/৫৮৬-৫৮৮, হায়াতুস সাহাবা- ১৫২-১৫৪)

রাসূলুল্লাহ সা. মু’য়াজকে ইয়ামনে পাঠালেন। একদিকে তিনি ইয়ামনে গভর্ণর, অন্যদিকে সেখানকার তাবলীগ ও দ্বীনী তা’লীমের দায়িত্বশীলও। বিচারের দায়িত্ব ছাড়াও দ্বীনী দায়িত্বও পালন করতেন। তিনি লোকদের কুরআন শিক্ষা দিতেন, ইসলামী বিধি-বিধানের প্রশিক্ষণ দিতেন।

তিনি ইয়ামনে থাকাকালীন একবার হাওলান গোত্রের এক মহিলা তাঁর নিকট এলো। তার ছিল বারোটি ছেলে। তবে সবচেয়ে ছোট ছেলেটিও তখন শ্মশ্রু মন্ডিত। এর দ্বারাই অনুমান করা যায় মহিলার বয়স কত হতে পারে। স্বামীকে একা বাড়ীতে রেখে বারোটি ছেলের সকলকে সংগে করে সে এসেছে। দুই ছেলে তার দুইটি বাহু ধরে চলতে সাহায্য করেছে। মহিলা মু’য়াজকে প্রশ্ন করলোঃ
– আপনাকে কে পাঠিয়েছে?
– রাসূলুল্লাহ সা.।
– আপনি তাহলে রাসূলুল্লাহর সা. নির্বাচিত প্রতিনিধি? আমি আপনাকে কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে চাই।
– করুন।
– স্ত্রীর ওপর স্বামীর হক বা অধিকার কতটুকু?
– যথাসম্ভব আল্লাহকে ভয় করে তার আনুগত্য করবে।
– আল্লাহর কসম, আপনি একটু ঠিক ঠিক বলবেন।
– আপনি এতটুকুতে সন্তুষ্ট নন?
– ছেলেদের বাবা বৃদ্ধ হয়েছে, আমি তাঁর হক কিভাবে আদায় করবো?
– আপনি তার দায়িত্ব থেকে নিষ্কৃতি পেতে পারেন না। যদি কুষ্ঠ রোগে তার দেহ পঁচে ফেটে যায়, রক্ত ও পুঁজ ঝরতে থাকে, আর আপনি তাতে মুখ লাগিয়ে চুষে নেন, তবুও তার হক পুরোপুরি আদায় হবে না। (মুসনাদ- ৫/২৩৯, সীরাতু ইবন হিশাম- ২/৫৯০-৯০, সীয়ারে আনসার- ২/১৬৬)

হযরত রাসূলে কারীম সা. গোটা ইয়ামনকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করেন; সান’য়া, কিন্দাহ, হাদরামাউত, জানাদ, খুবাইব। ইয়ামনের রাজধানী ছিল জানাদ, আর এখানেই থাকতেন হযরত মু’য়াজ। তিনিই জানাদের জামে’ মসজিদটির নির্মাতা। (শাজারাতুজ জাহাব- ১/৩০) অবশিষ্ট চারটি স্থানে নিম্নলিখিত ব্যক্তিবর্গ শাসক নিযুক্ত হনঃ
সান’য়া- হযরত খালিদ ইবন সা’ঈদ, কিন্দাহ- হযরত মুহাজির ইবন আবী উমাইয়্যা, হাদরামাউত- হযরত যিয়াদ ইবন লাবীদ এবং খুবাইদ ও উপকূলীয় এলাকায়- হযরত আবু মূসা আল-আশয়ারী রা.। উপরোক্ত ব্যক্তিবর্গ নিজ নিজ এলাকায় সাদাকা, জিযিয়া ইত্যাদি আদায় করে হযরত মু’য়াজের নিকট পাঠিয়ে দিতেন। রাজকোষের পূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন হযরত মু’য়াজ। (শাজারাতুজ জাহাব- ১/৩০)

হযরত মু’য়াজ বিভিন্ন সময়ে তাঁর অধীনস্থ শাসকদের এলাকাসমূহ ঘুরে ঘুরে তাঁদের বিচার ও সিদ্ধান্তসমূহ দেখাশুনা করতেন। প্রয়োজনবোধে তিনি নিজেও মুকাদ্দামার শুনানী করতেন। একবার হযরত আবু মূসার অঞ্চলে গিয়ে এভাবে একটি মুকাদ্দামার ফায়সালা করেন। এসব সফরে তিনি তাঁবুতে অবস্থান করতেন। আবু মুসার এখানেও তাঁর জন্য একটি তাঁবু নির্মাণ করা হয়। তিনিও আবু মূসা দুইজনই পাশাপাশি তাঁবুতে অবস্থান করেন। (বুখারী- ২/৬৩৩)

হযরত রাসূলে কালীম সা. যখন মু’য়াজকে ইয়ামনে পাঠান তখন তাঁকে একটি লিখিত নির্দেশনামা দান করেন। তাতে গনীমাত, খুমুস, সাদাকাত, জিযিয়াসহ বিভিন্ন বিধানের বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। হযরত মু’য়াজ সব সময় তারই আলোকে কাজ করতেন।

একবার এক ব্যক্তি একপাল গরু নিয়ে এলো। গরুগুলি সংখ্যায় ছিল তিরিশটি। রাসূল সা. তাঁকে তিরিশটি গরুতে একটি বাছুর নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ কারণে হযরত মু’য়াজ বললেনঃ আমি রাসূলুল্লাহর সা. কাছে না জেনে কিছুই গ্রহণ করবো না। কারণ এ ব্যাপারে রাসূল সা. আমাকে কিছুই বলেননি। এ দ্বারা বুঝা যায় রাসূলুল্লাহর সা. ওয়ালীগণ দুনিয়ার অন্যান্য শাসকদের মত অত্যাচারী ছিলেন না। রক্ষক ও রক্ষিতের মাঝে যে সম্পর্ক ইসলাম ঘোষণা করেছিল, তারা সব সময় তা স্মরণে রাখতেন। আর রক্ষকের ওপর শরীয়াত যেসব দায়িত্ব অর্পন করেছে তারা তা কঠোর ভাবে অনুসরণ করতেন।

বিচার ও সিদ্ধান্তের সময়ও জনগণের অধিকার যাতে খর্ব না হয় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতেন। তাদের আদালত সমূহে সর্বদা সত্য ও সততার বিজয় ছিল। এক ইয়াহুদী মারা গেল। একমাত্র ভাই রেখে গেল উত্তরাধিকারী। সেও ইসলাম গ্রহণ করেছিল। বিষয়টি হযরত মু’য়অজের ’আদালতে উত্থাপিত হলো। তিনি ভাইকে উত্তরাধিকার দান করেন। (মুসনাদ- ৫/২৩০)

হযরত মু’য়াজ ছিলেন জীবনের প্রথম থেকে অতি বুদ্ধিমান। রাসূল সা. মদীনায় আগমনের পর তিনি তাঁর সঙ্গ অবলম্বন করেন। অল্প কিছু দিনের মধ্যে ফায়েজে নববীর বরকতে ইসলামী শিক্ষার সর্বোচ্চ মডেলের রূপ লাভ করেন এবং বিশিষ্ট সাহাবীদের মধ্যে পরিগণিত হন।

হযরত রাসূলে কারীম সা. তাঁকে এত মুহাব্বত করতেন যে, অধিকাংশ সময় তাঁকে নিজেহর বাহনের পিছনে বসার সুযোগ দিয়ে নানা রকম ইলম ও মা’রেফাত শিক্ষা দিতেন। একবার তিনি রাসূলুল্লাহর সা. বাহনের পিছনে বসেছিলেন। রাসূল সা. ডাকলেঃ মু’য়াজ। তিনি জবাব দিলেনঃ লাব্বাইকা ইয়া রাসূলুল্লাহ ও সা’দাইকা- হাজির ইয়া রাসূলুল্লাহ! রাসূল সা. আবার ডাকলেনঃ মু’য়াজ। তনি অত্যন্ত আদব ও শ্রদ্ধার সাথে জবাব দিলেন। এভাবে রাসূল সা. তিনবার ডাকলেন, আর মু’য়াজও প্রতিবার সাড়া দিলেন। তারপর রাসূল সা. বললেনঃ ‘যে ব্যক্তি আন্তরিকভাবে কালিমা-ই-তাওহীদ পাঠ করে আল্লাহ তার জন্য জাহান্নামের আগুন হারাম করে দেন।’ মু’য়াজ আরজ করলেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমি মানুষের কাছে এই সুসংবাদ কি পৌঁছে দেব? তিনি বললেনঃ না। কারণ, মানুষ আমল ছেড়ে দেবে। (বুখারী- ১/২৪)

হযরত মু’য়াজের প্রতি রাসূলুল্লাহর সা. স্নেহের এত আধিক্য ছিল যে, তিনি নিজে কোন প্রশ্ন না করলে রাসুল সা. বলতেন, তুমি একাকী পেয়েও আমার কাছে কিছু জিজ্ঞেস করছো না কেন?

একবার মু’য়াজ রাসূলুল্লাহর সা. সাথে খচ্চরের ওপর সাওয়ার ছিলেন। রাসূল সা. চাবুক দিয়ে খচ্চরের পিঠে মৃদু আঘাত করে বলেনঃ ‘তুমি কি জান বান্দার ওপর আল্লাহর হক কি?’ মু’য়াজ বললেনঃ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। রাসূল সা. বললেনঃ ‘বান্দা তাঁর ইবাদাত করবে এবং শিরক থেকে বিরত থাকবে।’ কিছুদূর যাওয়ার পর আবার জিজ্ঞেস করলেনঃ আচ্ছা বলতে পার, আল্লাহর নিকট বান্দা রহক বা অধিকার কি? মু’য়াজ বললেনঃ এ ব্যাপারে তো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই বেশী জানেন। বললেনঃ ‘তিনি তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।’ (মুসনাদ- ৫/২৩৮)

এভাবে হযরত মু’য়াজ সর্বদা রাসূলুল্লাহর সা. স্নেহ ও আদর লাভে ধন্য হয়েছেন। উঠতে বসতে সর্বক্ষণ রাসূলুল্লাহর সা. নিকট শিক্ষার সুযোগ লাভ করেছেন। একবার তো দরযায় অপেক্ষমান দেখতে পেয়ে রাসুল সা. তাঁকে একটি জিনিস শিখিয়ে দিলেন। আর একবার বললেনঃ আমি কি তোমাকে জান্নাতের দরযার কথা বলে দেব? বললেনঃ হাঁ। ইরশাদ হলঃ ‘লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’ পাঠ করবে। (মুসনাদ- ৫/২৩৮)

একবার এক সফরে তিনি রাসূলুল্লাহর সা. সঙ্গী ছিলেন। একদিন সকালে যখন সৈন্যরা লক্ষ্যস্থলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তখন তিনি রাসূলুল্লাহর সা. কাছে বসা। তিনি আবদার জানালেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমাকে এমন কোন আমল শিখিয়ে দিন যা আমাকে জান্নাতে নিয়ে যায় এবং জাহান্নাম থেকে দূরে রাখে। রাসূল সা. বললেনঃ ‘তুমি একটা কঠিন বিষয় জানতে চেয়েছ। তবে আল্লাহ যাকে তাওফীক বা সামর্থ দান করেন তার জন্য সহজ। শিরক করবে না, ইবাদাত করবে, নামায আদায় করবে, যাকাত দান করবে, রমজান মাসে সিয়াম পালন করবে এবং হজ্জ আদায় করবে।’ তিনি আরও বলেনঃ ‘কল্যাণের কয়েকটি দ্বার আছে। আমি তোমাকে বলছি, শোনঃ সাওম- যা ঢালের কাজ করে, সাদাকা- যা পাপের আগুনকে পানির মতো নিভিয়ে দেয় এবং যে নামায রাতের বিভিন্ন অংশে আদায় করা হয়। এরপর তিনি নীচের আয়াতটি তিলাওয়াত করেনঃ

‘তারা শয্যা ত্যাগ করে তাদের প্রতিপালককে ডাকে আশায় ও আশংকায় এবং আমি তাদেরকে যে রিয্ক দান করেছি তা থেকে তারা ব্যয় করে।’ (সূরা সাজদা- ১৬)
তিনি আরও বলেনঃ ‘ইসলামের মাথা, খুঁটি ও চূড়ার কথা বলছি। মাথা ও খুঁটি হচ্ছে নামায এবং চূড়া হচ্ছে জিহাদ।’ তারপর বললেনঃ ‘এইসব জিনিসের মূল হচ্ছে একটি মাত্র জিনিস। আর তা হলো ‘জিহবা’। তিনি নিজের ‘জিহবা’ বের করে হাত দিয়ে স্পর্শ করে বলেন, একে নিয়ন্ত্রণে রাখবে।’ মু’য়াজ প্রশ্ন করলেনঃ এই যে আমরা যা কিছু বলি, তার সব কিছুরই কি জবাবদিহি করতে হবে? বললেনঃ ‘মু’য়াজ! তোমার মার সর্বনাশ হোক। অনেকে শুধু এর জন্যই জাহান্নামে যাবে।’ (মুসনাদ- ৫/২৩১)

একবার তো রাসূল সা. মু’য়াজকে দশটি বিষয়ের অসীয়াত করলেন। ১. শিরক করবে না। তার জন্য কেউ যদি তোমাকে হত্যা করে অথবা আগুনে পুড়িয়েও মারে, তবুও না। ২. মাতা-পিতাকে কষ্ট দেবে না। তারা যদি তোমাকে তোমার সন্তান-সন্ততি ও বিষয়-সম্পদ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়, তবুও। ৩. ফরজ নামায ইচ্ছাকৃতভাবে কক্ষণও তরক করবে না। যে ইচ্ছাকৃতভাবে নামায তরক করে আল্লাহ তার জিম্মাদারী থেকে অব্যাহতি নিয়ে নেন। ৪. মদ পান করবে না। কারণ, এ কাজটি সকল অশ্লীলতার মূল। ৫. পাপ কর্মে লিপ্ত হবে না। পাপাচারে লিপ্ত ব্যক্তির ওপর আল্লাহর ক্রোধ বৈধ হয়ে যায়। ৬. জিহাদের ময়দান থেকে পালাবে না। যদি সকল সৈন্য রক্ত রঞ্জিত ও ধুলিমলিন হয়ে যায় এবং ব্যাপকভাবে মৃত্যুবরণ করে, তবুও না। ৭. মহামারি আকারে কোন রোগ-ব্যধি দেখা দিলে অটল থাকবে। ৮. নিজের সন্তানদের সাথে সদ্ব্যবহার করবে। ৯. তাদেরকে সর্বদা আদব ও শিষ্টাচার শিক্ষা দেবে। ১০. তাদেরকে খাওফে খোদা (আল্লাহর ভয়) শিক্ষা দেবে।

হযরত রাসূলে কারীম সা. একবার মু’য়াজকে পাঁচটি জিনিসের তাকিদ দিয়ে বলেছিলেনঃ যে এই ’আমলগুলি করে আল্লাহ তার জামিন হয়ে যান। ১. অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যাওয়া, ২. জানাযার সাথে চলা, ৩. জিহাদে বের হওয়া, ৪. শাসককে ভীতি প্রদর্শন অথবা সম্মান দেখানোর জন্য যাওয়া, ৫. ঘরে চুপচাপ বসে থাকা- যে যেখানে সে নিরাপদ থাকে এবং মানুষও তার থেকে নিরাপদ হয়ে যায়।

রাসুল সা. তাঁকে নৈতিক শিক্ষা দেন এভাবেঃ ‘মু’য়াজ! একটি মন্দ কাজ করার পর একটি নেক কাজ কর। নেক কাজ মন্দ কাজটি বিলীন করে দেয়। আর মানুষের সামনে সর্বোত্তম নৈতিকতার দৃষ্টিতে উপস্থাপন কর।’ (মুসনাদ- ৫/২৩৮)

তিনি মু’য়াজকে এ কথাও শিক্ষা দেনঃ মাজলুম বা অত্যাচারিতের বদ দু’আ থেকে দূরে থাকবে। কারণ, সেই বদ দু’আ ও আল্লাহর মাঝে কোন প্রতিবন্ধক থাকে না। (বুখারী)

রাসূল সা. যখন তাঁকে ইয়ামানের আমীর করে পাঠান তখন বলেছিলেনঃ ‘মু’য়াজ! ভোগ-বিলাসিতা থেকে দূরে থাকবে। কারণ, আল্লাহর বান্দা কক্ষণও আরামপ্রিয় ও বিলাসী হতে পারে না।’ (মুসনাদ-৫/২৪৩) রাসূল সা. তাঁকে সামাজিক জীবনের শিক্ষা দিয়েছেন এভাবেঃ ‘মানুষের নেকড়ে হচ্ছে শয়তান। নেকড়ে যেমন দলছুট বকরীকে ধরে নিয়ে যায় তেমনি শয়তানও এমন মানুষের ওপর প্রভূত্ব লাভ করে যে জামা’য়াত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে। সাবধান! সাবধান! কক্ষণও বিচ্ছিন্ন থাকবে না। সর্বদা জামা’য়াতের সাথে থাকবে। (মুসনাদ- ৫/২৪৩)

ইসলামের তাবলীগ ও দা’ওয়াত সম্পর্কে রাসূল সা. তাকে বলেনঃ ‘মু’য়াজ! তুমি যদি কেবলমাত্র একজন মুশরিককেও মুসলমান বানাতে পার তাহলে সেটা হবে তোমার জন্য দুনিয়ার সবকিছু থেকে উত্তম কাজ।’ (মুসনাদ- ৫/২৩৮)

এমন পবিত্র চিন্তা ও মহোত্তম শিক্ষা লাভ করেছিলেন হযরত মু’য়াজ। একারণে মহান সাহাবী হযরত ইবন মাসউদ তাঁকে শুধু একজন ব্যক্তি নয় বরং একটি উম্মাতই মনে করতেন। তিনি বলেনঃ ‘মু’য়াজ ছিলেন সরল-সোজা একটি আল্লাহ অনুগত উম্মাত। তিনি কখনও মুশরিকদের কেউ ছিলেন না।’ ফারওয়া আল-আশজা’ঈ তাঁকে বললেনঃ ‘এমন কথা তো আল্লাহ তা’আলা ইবরাহীম আ. সম্পর্কেই বলেছেন।’ ইবন মাস’উদ আবারও তাঁর কথার পুনরাবৃত্তি করলেন। ফারওয়া আল-আশজা’ঈ বলেনঃ ‘আমি ইবন মাস’উদকে তাঁর কথার ওপর অটল থাকতে দেখে চুপ থাকলাম। তারপর তিনিই আমাকে প্রশ্ন করলেনঃ তুমি কি জান ‘উম্মাত’ মানে কি, বা ‘কানিত’ কাকে বলে? বললামঃ আল্লাহই ভালো জানেন। তিনি বললেন, ‘উম্মাত’ হচ্ছেন সেই ব্যক্তি যিনি মঙ্গলকে জানেন এবং যার ইকতিদা ও অনুসরণ করা যায়। আর ‘কানিত’ বলে আল্লাহর অনুগত ব্যক্তিকে। এই অর্থে মু’য়াজ ছিলো যথার্থই মঙ্গল বা কল্যাণের শিক্ষাদানকারী এবং আল্লাহ ও রাসূলের সা. অনুগত ব্যক্তি। (আল-ইসতী’য়াব; আল-ইসাবা- ৪/৩৬১, তাহজীবুল আসমা- ২/১০০)

দ্বিতীয় খলীফা হযরত ’উমারের রা. খিলাফতকালেই মজলিসে শূরা প্রকৃতপক্ষে পূর্ণরূপ লাভ করে। তবে প্রথম খলীফার যুগেই তার একটি কাঠামো তৈরী হয়ে গিয়েছিল। ইবন সা’দের বর্ণনা মতে হযরত আবু বকর রা. খিলাফতের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যাঁদের সাথে পরামর্শ করতেন তাঁদের মধ্যে মু’য়াজও ছিলেন। হযরত ’উমারের রা. খিলাফতকালে যখন মজলিসে শূরার নিয়মিত অধিবেশন বসতো তখনও মু’য়াজ সদস্য ছিলেন। (কানযুল ’উম্মাল- ১৩৪)

হযরত ’উমারের খিলাফতকালে শামের ওয়ালী ইয়াযীদ ইবন আবী সুফইয়ান খলীফাকে লিখলেন কিছু কুরআনের মু’য়াল্লিম পাঠানোর জন্য। রাসূলুল্লাহর সা. যুগে যাঁরা কুরআন সংগ্রহ করেছিলেন এমন পাঁচ ব্যক্তিকে খলিফা ডাকলেন। তাঁরা হলেনঃ মু’য়াজ ইবন জাবাল, ’উবাদা ইবনুস সামিত, আবু আইউব আল-আনসারী, উবাই ইবন কা’ব ও আবু দারদা। খলীফা তাঁদেরকে বললেনঃ শামবাসী ভাইয়েরা এমন কিছু লোক পাঠানোর অনুরোধ করেছে যাঁরা তাদেরকে কুরআনের তা’লীম ও দ্বীনের তারবিয়াত দান করবেন। এ ব্যাপারে আপনাদের পাঁচ জনের যে কোন তিনজন আমাকে সাহায্য করুন। আপনারা ইচ্ছা করলে লটারীর মাধ্যমেও তিন জনের নাম নির্বাচন করতে পারেন। অন্যথায় আমিই তিন জনকে বেছে নিব। তাঁরা বললেনঃ লটারী কেন? আবু আইউব একজন বৃদ্ধ মানুষ, আর উবাইতো অসুস্থ। বাকী থাকলাম আমরা তিন জন। ’উমার রা. তাদেরকে হিমস, দিমাশ্ক ও ফিলিস্তিতে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। মু’য়াজ গেলেন ফিলিস্তিনে। (সুওয়ারুম মিন হায়াতিস সাহাবা- ৭/১৩২-১৩৪)

বিভিন্ন ঘটনা দ্বারা একথা স্পষ্ট বুঝা যায় যে, প্রথম খলীফা আবু বকরের রা. যুগেই হযরত মু’য়াজ গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের জন্য শামে চলে যান। হযরত ’উমার রা. যখন খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন তিনি সিরিয়ার এক ফ্রন্টে যুদ্ধরত। সেখানে থেকে তিনি ও আবু ’উবাইদা সমতা ও ন্যায় বিচারের উপদেশ দান করে খলীফাকে একটি পত্র লেখেন। (হায়াতুস সাহাবা- ২/১৩১) খলীফা ’উমারের খিলাফতকালে ইসলামী বিজয়ের প্রবল প্লাবন শামের ওপর দিয়েই বয়ে চলে। হযরত মু’য়াজও একজন সৈনিক হিসাবে রণক্ষেত্রে চরম বীরত্ব ও সাহসিকতা প্রকাশ করেন।

হযরত রাসূলে কারীমের সা. শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ফলে হযরত মু’য়াজের মধ্যে বিচিত্রমুখী প্রতিভার বিকাশ ঘটে। তাঁর মধ্যে দেখা দেয় বহুবিধা যোগ্যতা। তিনি হন একাধারে শরী’য়াতের মুফতী, মজলিসে শূরার সদস্য, কুরআন ও হাদীসের শিক্ষক, প্রদেশের ওয়ালী, দূত, সাহসী সেনাপতি, বিজয়ী যোদ্ধা ও যাকাত উসূলকারী ইত্যঅদি।

দৌত্যগিরির দায়িত্ব যখন তাঁর ওপর অর্পিত হলো তিনি অতি দক্ষতার সাথে তা পালন করলেন। শামের ‘ফাহল’ নামক স্থানে যুদ্ধ প্রস্তুতি চলছিল, এমন সময় প্রতিপক্ষ রোমান বাহিনী সন্ধির প্রস্তাব দিল। সেনাপতি আবু ’উবাইদা আলোচনার জন্য মু’য়াজকে নির্বাচন করলেন। মু’য়াজ চললেন রোমান সেনা ছাউনীতে। সেখানে পৌঁছে তিনি দেখলেন, দরবার অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণভাবে সাজানো হয়েছে। একটি তাঁবু খাটানো হয়েছে যার অভ্যন্তরে সোনালী কারুকাজ করা গালিচা বিছানো। হযরত মু’য়াজ ভিতরে না ঢুকে থমকে বাইরে দাঁড়িয়ে গেলেন। একজন খৃষ্টান সৈনিক এগিয়ে এসে বললোঃ আমি ঘোড়াটি ধরছি, আপনি ভিতরে যান। মু’য়াজ বললেনঃ আমি এমন শয্যায় বসিনা যা দরিদ্র লোকদের বঞ্চিত করে তৈরী হয়েছে। একথা বলে তিনি মাটির ওপর বসে পড়লেন। খৃষ্টানরা দুঃখ প্রকাশ করে বললোঃ আমরা আপনাকে সম্মান করতে চেয়েছিলাম; কিন্তু আপনি তা অবহেলা করলেন। হযরত মু’য়াজ হাঁটুতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে বললেনঃ আমার এমন সম্মানের প্রয়োজন নেই। যদি মাটিতে বসা দাসদের অভ্যাস হয় তা হলে আমার চেয়ে আল্লাহর বড় দাস আর কে আছে? রোমানরা হযরত মু’য়াজের এমন স্বাধীন ও বেপরোয়া আচরণে হতবাক হয়ে গেল। এমনকি তাদের একজন জিজ্ঞেস করেই বসলো, মুসলমানদের মধ্যে আপনার চেয়েও বড় কেউ কি আছে? তিনি জবাব দিলেনঃ ‘মায়াজ আল্লাহ! (আল্লাহর পানাহ্ চাই) আমি হচ্ছি তাদের এক নিকৃষ্টতম ব্যক্তি।’ লোকটি চুপ হয়ে গেল।

হযরত মু’য়াজ কিছুক্ষণ পর দোভাষীকে বললেন; রোমানদের বল, তারা কোন বিষয়ে আলোচনা করতে চাইলে আমরা বসবো, নইলে চলে যাব। আলোচনা শুরু হলো। রোমানরা বললঃ

– আমাদের দেশ আক্রমণ করা হয়েছে কেন? অথচ হাবশা আরবের অতি নিকটে, পারস্যের সম্রাট মারা গেছেন এবং সাম্রাজ্যের কতৃত্ব এক মহিলার হাতে। আপনারা ঐ সকল দেশ ছেড়ে আমাদের দিকে ধাবিত হলেন কেন? অন্যদিকে আমাদের সম্রাট দুনিয়ার সকল সম্রাটদের সম্রাট এবং সংখ্যায় আমরা আসমানের তারকারাজি ও দুনিয়ার বালুকারাশির সমান।

মুয়াজ বললেনঃ আমরা তোমাদেরকে যা বলতে চাই তার সরকথা হলো, তোমরা ইসলাম কবুল করে আমাদের কিবলার দিকে নামায আদায় কর, মদ পান ছেড়ে দাও, শুকরের মাংস পরিহার কর। তোমরা যদি এইসব কাজ কর তাহলে আমরা তোমাদের ভাই। আর যদি একান্তই ইসলাম গ্রহণ করতে না চাও তাহলে জিযিয়া দাও। তাও যদি না মান তাহলে যুদ্ধের ঘোষনা দিচ্ছি। যদি আসমানের তারকারাজি ও যমীনের বালুকারাশির পরিমাণ তোমাদের সংখ্যা হয় তাতেও আমাদের বিন্দুমাত্র পরোয়া নেই।

আর হ্যাঁ, তোমাদের এ জন্য গর্ব যে, তোমাদের শাহানশাহ্ তোমাদের জান-মালের মালিক মুখতার। কিন্তু আমরা যাঁকে বাদশাহ বানিয়েছি কোন ক্ষেত্রেই তিনি নিজেকে আমাদের ওপর প্রাধান্য দিতে পারেন না। তিনি ব্যভিচার করলে তাঁকে দুররা লাগানো হবে, চুরি করলে হাত কাটা হবে। তিনি গোপনে বসেন না, নিজেকে আমাদের চেয়ে বড় মনে করেন না। ধন-সম্পদেও আমাদের ওপর তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব নেই।’

রোমানরা মনোযোগ সহকারে তাঁর কথা শুনলো। তাঁর মুখে ইসলামী শিক্ষা ও সাম্যের কথা শুনে তারা হতবাক হয়ে গেল। তারা প্রস্তাব দিলঃ ‘আমরা আপনাদেরকে ‘বালকা’- এর সম্পূর্ণ এলাকা এবং ‘দূন’- এর যে অংশ আপনাদের অঞ্চলের সাথে মিশেছে, ছেড়ে দিচ্ছি। আপনারা আমাদের এই দেশ ছেড়ে পারস্যের দিকে চলে যান।’

এটা কোন কেনা-বেচার বিষয় ছিল না। তাই হযরত মু’য়াজ নেতিবাচক জবাব দিয়ে সেখান থেকে উঠে আসেন। (সীয়ারে আনসার- ২/১৬৯-১৭১) যুদ্ধ প্রস্তুতি শুরু হলো। এ যুদ্ধে তিনি এক গুরুত্বপূর্ণ পদ লাভ করেন। হযরত আবু ’উবাইদা তাঁকে ‘মায়মানা’ (দক্ষিণ ভাগ)- এর কমান্ডিং অফিসার নিয়োগ করেন।
হিজরী ১৫ সনে ইয়ারমুকের যুদ্ধ হয়। খুবই ভয়াবহ যুদ্ধ। এ যুদ্ধেও তাঁকে ‘মায়মানা’-র দায়িত্ব দেওয়া হয়। শত্রুপক্ষের আক্রমণ এত তীব্র ছিল যে মুসলমানদের ‘মায়মানা’ মূল বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় হযরত মু’য়াজ অত্যন্ত দৃঢ়তা ও স্থির চিত্ততার পরিচয় দেন। তিনি ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে পড়ে হুংকার দিয়ে বলেনঃ আমি পায়ে হেঁটে লড়বো। কোন সাহসী বীর যদি ঘোড়ার হক আদায় করতে পারে, সে এই ঘোড়া নিতে পারে। রণক্ষেত্রে তাঁর পুত্রও ছিলেন। তিনি চিৎকার করে বলে ওঠেন, আমিই এ ঘোড়ার হক আদায় করবো। তারপর বাপ-বেটা দু’জন রোমান বাহিনীর ব্যুহ ভেদ করে ভিতরে ঢুকে যান এবং এমন সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করেন যে, বিক্ষিপ্ত মুসলিম বাহিনী আবার দৃঢ় অবস্থান ফিরে পায়।

হযরত ফারুকে আ’জমের খিলাফতকালে সিরিয়ায় যুদ্ধরত গোটা মুসলিম বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন হযরত আবু ’উবাইদা। হিজরী ১৮ সনে সিরিয়ায় মহামারি আকারে প্লেগ বা ‘তা’উন’ দেখা দেয়। ইতিহাসে এই মহামারি ‘আমওয়াসের ‘তা’উন’ নামে প্রসিদ্ধ। ’আমওয়াস হচ্ছে রামলা ও বাইতুল মাকদাসের মধ্যবর্তী একটি গ্রামের নাম। সেনাপতি হযরত আবু ’উবাইদা সহ বহু মুসলিম সৈনিক এই মহামারিতে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। হযরত আবু ’উবাইদা সহ বহু মুসলিম সৈনিক এই মহামারিতে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। হযরত আবু ’উবাইদা মৃত্যুর পূর্বে হযরত মু’য়াজকে নিজের স্থলাভিষিক্ত করে যান। হযরত মু’য়াজ আবু ’উবাইদার জানাযার নামায পড়ান এবং অন্যদের সাথে কবরে নেমে তাঁকে কবরে শায়িত করেন। এ সময় তিনি সকলের উদ্দেশ্যে এক হৃদয়গ্রাহী ভাষণ দেন। আবু ’উবাইদার ইনতিকালের পর তিনি কিছু দিনের জন্য সেনাপতির দায়িত্ব পালন করেন। (হায়াতুস সাহাবা- ১/৪৮, আল-ইসতীয়াব; আল ইসাবা- ৪/৩৫৭, ৩৫৯)

মহামারি মারাত্মক আকারে ছড়িয়ে পড়লে মানুষ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। হযরত ’আমর ইবনুল আস বললেনঃ আমাদের উচিত এ স্থান ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যাওয়া। এ রোগ নয়, এ যেন আগুন। তাঁর এ কথায় হযরত মু’য়াজ দারুণ অসন্তুষ্ট হলেন। তিনি সকলকে সম্বোধন করে একটি ভাষণ দেন। ভাষণের মধ্যে তিনি ’আমরের নিন্দাও করেন। তারপর বলেন, এই মহামারি আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন বালা-মুসীবত নয়; বরং তাঁর রহমত ও নবীর দু’আ। আমি রাসূলুল্লাহর সা. বলতে শুনেছিলাম, মুসলমানরা শামে হিজরাত করবে। শাম ইসলামী পতাকাতলে আসবে। সেখানে একটি রোগ দেখা দেবে যা ফোঁড়ার মত হয়ে শরীরে ক্ষতের সৃষ্টি করবে। কেউ তাতে মারা গেলে শহীদ হবে। তাঁর সকল ’আমল পাক হয়ে যাবে। হে আল্লাহ, যদি আমি একথা রাসূলুল্লাহর সা. মুখ থেকে শুনে থাকি তাহলে এই রহমত আমার ঘরেও পাঠাও এবং আমাকেও তার যথেষ্ট অংশ দান কর।’ (উসুদুল গাবা- ৪/৩৭৭, হায়াতুস সাহাবা- ২/৫৮১, ৫৮২)

ভাষণ শেষ করে তিনি পুত্র আবদুর রহমানের নিকট গেলেন। তখন তাঁর দু’আ কবুল হয়ে গেছে। দেখেন, পুত্র রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। পুত্র পিতাকে দেখে কুরআনের এ আয়াতটি তিলাওয়াত করলেনঃ ‘আল-হাক্কু মির রাব্বিকা ফালা তাকূনান্না মিনাল মুমতারীন-’ এই মৃত্যু যা সত্য, আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে। সুতরাং কক্ষণও আপনি সন্দেহ পোষণকারীদের মধ্যে হবেন না। যেমন পুত্র তেমনই পিতা। পিতা জবাব দিলেনঃ ‘সাতাজিদুনী ইনশাআল্লাহ মিনাস সাবিরীন’- ইনশাআল্লাহ তুমি আমাকে ধৈর্যশীলদের মধ্যেই পাবে। হযরত আবদুর রহমান মারা গেলেন। পুত্রের মৃত্যুর পূর্বেই তাঁর দুই স্ত্রীও একই রোগে মারা যান। এখন হযরত মু’য়াজ একাকী। নির্দিষ্ট সময়ে তিনিও আল্লাহর এই রহমাতের অংশীদার হন। তাঁর ডান হাতের শাহাদাত আংগুলে একটি ফোঁড়া বের হয়। তিনি অত্যন্ত খুশী ছিলেন। বলছিলেন, দুনিয়ার সকল সম্পদ এর তুলনায় মূল্যহীন। প্রচন্ড ব্যথায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলছিলেন। যখনেই চেতনা ফিরে পাচ্ছিলেন, বলছিলেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমাকে আমার ব্যথায় ব্যথিত কর। আমি যে তোমাকে কত ভালোবাসি তা তুমি ভালোই জান।’

হযরত মু’য়াজ যে রাতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন খুব অস্থিরভাবে সেই রাতটি কাটান। বার বার শুধু জিজ্ঞেস করেনঃ দেখতো সকাল হলো কিনা? লোকরো জবাব দেনঃ এখনও হয়নি। যখন বলা হলো, হ্যাঁ, সকাল হয়েছে, তিনি বললেনঃ এমন রাত থেকে আল্লাহর পানাহ চাই যার প্রভাত জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়। স্বাগতম মৃত্যু, স্বাগতম। তুমি সেই বন্ধুর কাছে এসেছ যে একেবারে রিক্ত ও নিঃস্ব। ইয়া ইলাহী, আমি তোমাকে কতটুকু ভালোবাসি তা তুমি জান। আজ তোমার কাছে আমার বড় আশা। আমি কখনও দুনিয়া এবং দীর্ঘ জীবন এই জন্য কামনা করিনি যে তা বৃক্ষ রোপণ ও নদী খননে ব্যয় করবো; বরং যদি কামনা করে থাকি তবে তা এ জন্য যাতে প্রচন্ড গরমে মানুষের তৃষ্ণা নিবারণ করতে পারি, উদারতা ও দানশীলতার প্রসার ঘটাতে এবং জিকিরের মজলিসসমূহে আলেমদের সাথে বসতে পারি। (হায়াতুস সাহাবা- ৩/১৬২, তাহজীব আল আসমা- ১/৩০) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের পূর্বে তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। লোকেরা সান্ত্বনা দিয়ে বলেঃ আপনি রাসূলুল্লাহর সা. সাহাবী, উঁচু মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ব্যক্তি, আপনি কাঁদছেন কেন? তিনি বললেনঃ আমার না আছে মরণ ভয়, আর না আছে দুনিয়া ছেড়ে যাওয়ার দুঃখ। তবে তার দুইটি মুষ্টি আছে আমার জানা নেই আমি তার কোন মুষ্টিতে থাকবো। এই ভয়েই আমি কাঁদছি। এই অবস্থায় তাঁর পবিত্র রূহ দেহ থেকে বেরিয়ে যায়। (উসুদুল গাবা- ৪/৩৭৮, সীয়ারে আনসার- ২/১৭৪, ১৭৫)

হযরত মু’য়াজের মৃত্যুসন এবং মৃত্যুর সময় বয়স সম্পর্কে বিস্তর মতভেদ আছে। তবে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ মতে হিজরী ১৮ অথবা ১৯ সনে ৩৮ বছর বয়সে বাইতুল মাকদাস ও দিমাশকের মধ্যবর্তী এবং জর্দান নদীর তীরবর্তী ‘বীনা’ নামক স্থানে মারা যান। এরই নিকটবর্তী একটি স্থান যেখান থেকে আল্লাহ তা’আলা হযরত ’ঈসাকে আ. আসমানে উঠিয়ে নেন, সেখানেই তাঁকে দাফন করা হয়। (আল-আ’লাম- ৮/১৬৬, উসুদুল গাবা- ৪/৩৭৮, তাজকিরাতুল হুফ্ফাজ- ১)

হযরত মু’য়াজের গায়ের রং ছিল সাদা, চেহারা উজ্জ্বল, দৈহিক কাঠামো দীর্ঘাকৃতির, চোখ কালো ও বড়, চুল খুব ঘন এবং সামনের দাঁত ধবধবে সাদা। কথা বলার সময় যেন মুক্তা ঝরতো। কণ্ঠস্বর ছিল খুবই মিষ্টি-মধুর। দৈহিক সৌন্দর্যের দিক দিয়ে ছিলেন সাহাবা সমাজের মধ্যমনি। জাবির ইবন আবদিল্লাহ রা. বলেনঃ মু’য়াজ ছিলেন সবার চেয়ে সুন্দর, সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী এবং সর্বাধিক দানশীল ব্যক্তি। আবু নু’ঈম বলেনঃ বিচক্ষণতা, লজ্জাশীলতা, ও বদান্যতার দিক দিয়ে তিনি ছিলেন আনসারদের সর্বোত্তম যুবক। ওয়াকিদী বলেনঃ তিনি ছিলেন সুন্দরতম পুরুষ। (আল-ইসাবা- ৪/৪২৭, তাজকিরাতুল হুফ্ফাজ- ১/১৯, উসুদুল গাবা- ৪/৩৭৭)
হযরত মু’য়াজ ৩৮ বছর বয়সে মারা যান। আল-মাদায়িনী, ওয়াকিদী প্রমুখ ঐতিহাসিক বলেছেন, তাঁর কোন সন্তানাদি হয়নি। তবে বিশ্বস্ত বর্ণনা সমূহে জানা যায় তাঁর এক পুত্র, মতান্তরে দুই পুত্র ছিল। তাদের একজনের নাম আবদুর রহমান এবং অন্যজনের নাম জানা যায় না। এই আবদুর রহমান ইয়ারমুক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং হিজরী ১৮ সনে ‘আমওয়াসের’ মহামারিতে পিতার আগে মারা যান। (আল-ইসতী’য়াব; আল-ইসাবা- ৪/৩৫৬)

কুরআন, হাদীস ও ফিকাহ শাস্ত্রে হযরত মু’য়াজ ছিলেন একজন বিশেষজ্ঞ। ’আবদুল্লাহ ইবন ’আমর ইবনুল ’আস থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে জানা যায়, সাহাবাদের মধ্যে যে চারজনের নিকট থেকে কুরআন গ্রহণের জন্য রাসূলুল্লাহ সা. নির্দেশ দিয়েছেন, মু’য়াজ তাঁদের অন্যতম। ’আবদুল্লাহ ইবন ’উমার থেকেও এ ধরণের একটি বর্ণনা আছে। এর কারণ হলো, রাসূলুল্লাহর সা. জীবদ্দশায় তিনি কুরআন হিফ্জ করেছিলেন। খাযরাজীরা বলতোঃ আমাদের চার ব্যক্তি রাসূলুল্লাহর সা. যুগে কুরআন সংগ্রহ করেছে যা অন্যরা করেনি। তাঁদের একজন মু’য়াজ। (আনসাবুল আশরাফ- ১/২৬৪, হায়াতুস সাহাবা- ১/৩৯৫)

হাদীস বর্ণনার ব্যাপারে তিনি ছিলেন খুবই সতর্ক। তাছাড়া রাসূলুল্লাহর সা. যুগ থেকে আমরণ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বসমূহ পালনের জন্য সব সময় মদীনা থেকে দূরে ছিলেন। এ কারণে তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। তবে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত হাদীস বর্ণনার ধারাবাহিকতা তিনি চালু রাখেন। প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু শয্যায়ও এ মহান দায়িত্ব পালন করে গেছেন। (মুসনাদ- ৫/২৩৩)

শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের পূর্বে জাবির ইবন ’আবদিল্লাহ রা. ও আরও কিছু লোক তাঁর পাশে ছিলেন। অন্তিম সময় ঘনিয়ে এলে তিনি বললেন, আমি এমন একটি হাদীস বর্ণনা করবো যা আজ পর্যন্ত এই জন্য গোপন রেখেছিলাম যে তা শুনলে মানুষ হয়তো ’আমল ছেড়ে দিবে । তারপর তিনি হাদীসটি বর্ণনা করেন। (মুসনাদ- ৫/৩৩৬)
হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবীদের মধ্যে হযরত মু’য়াজের নামটি তৃতীয় তবকায় গণনা করা হয়। তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা মোট ১৫৭ টি। তার মধ্যে দুইটি মুত্তাফাক আলাইহি, তিনটি বুখারী ও একটি মুসলিম এককভাবে বর্ণনা করেছেন। (আল-আ’লাম- ৮/১৬৬), তাহজীবুল আসমা- ২/৯৮)

হাদীস শাস্ত্রে তাঁর ছাত্রদের সংখ্যা অনেক। উঁচু মর্যাদার সাহাবীদের বড় একটি দল তাঁর সূত্রে হাদীস বর্ণনা করেছেণ। যেমনঃ ’উমার, আবু কাতাদাহ আল-আনসারী, আবু মূসা আল-আশ’য়ারী, জাবির ইবন ’আবদিল্লাহ, আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস, আবদুল্লাহ ইবন ’উমার, আবদুল্লাহ ইবন ’আমর ইবনুল ’আস, আনাস ইবন মালিক, আবু উমামা আল-বাহিলী, আবু লায়লা আল-আনসারী, আবু তুফাইল ও আরও অনেকে। (আল-ইসাবা- ৪/৪২৭, তাহজীবুল আসমা- ২/৯৮)

বিশিষ্ট তাবে’ঈ ছাত্রদের মধ্যে ইবন ’আদী, ইবন আবী-আউফা আল-আশয়ারী, আবদুর রহমান ইবন সুমরা লা’বাসী, জাবির ইবন আনাস, আবু সা’লাবা খুশানী, জাবির ইবন সুমরা, মালিক ইবন নীহামীর, আবদুর রহমান ইবন গানাম, আবু মুসলিম খাওলানী, আবদুল্লাহ ইবন সানাবিহী, আবু ওয়ায়িল মাসরূক, জুনাদাহ ইবন আবী উমাইয়্যা, আবু ইদরীস খাওলানী, আসলাম মাওলা ’উমার, আসওয়াদ ইবন হিলাল, আসওয়াদ ইবন ইয়াযীদ প্রমুখ সর্বাধিক খ্যাতি সম্পন্ন। (উসুদুল গাবা- ৪/৩৭৮, তাজকিরাতুল হুফ্ফাজ- ১/১৯)

রাসূলুল্লাহর সা. জীবন কালেই হযরত মু’য়াজ শ্রেষ্ঠ ফকীহদের মধ্যে পরিগণিত হন। খোদ রাসূলে কারীম সা. তাঁর ফকীহ হওয়ার সাক্ষ্য দিয়েছেন, এর চেয়ে বড় সম্মান আর কী হতে পারে? তিনি বলেছেনঃ ‘আ’লামুহুম বিল হালালি ওয়াল হারামি মু’য়াজ ইবন জাবাল- তাদের মধ্যে মু’য়াজ ইবন জাবাল হালাল ও হারামের সবচেয়ে বড় ’আলিম।’ (তাজকিরাতুল হুফ্ফাজ- ১/১৯) কা’ব ইবন মালিক বলেনঃ রাসূল সা. ও আবু বকরের রা. যুগে তিনি মদীনায় ফাতওয়া দিতেন। (হায়াতুস সাহাবা- ১/৪৫২) ইবনুল আসীর বলেনঃ রাসূলুল্লাহর সা. জীবদ্দশায় মুহাজিরদের মধ্যে ’উমার, ’উসমান, আলী এবং আনসারদের মধ্যে মু’য়াজ, ’উবাই ইবন কা’ব ও যায়িদ ইবন সাবিত ফাতওয়া দিতেন। (উসুদুল গাবা- ৪/৩৭৭, তাবাকাত- ২/৩৫০)

হযরত ’উমার রা. একবার মু’য়াজ সম্পর্কে বলেনঃ ‘লাওলা মু’য়াজ লাহালাকা ’উমার- মু’য়াজ না থাকলে ’উমার বিনাশ হতো।’ এই মন্তব্য দ্বারা তাঁর ইজতিহাদী যোগ্যতা ও গবেষণা শক্তি সম্পর্কে ধারণ লাভ করা যায়। এছাড়া বিভিন্ন সময় হযরত ’উমার তাঁর ফকীহ মুজতাহিদ হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি জাবিয়ায় প্রদত্ত খুতবায় বলেনঃ কেউ ফিকাহ শিখতে চাইলে সে যেন মু’য়াজের কাছে যায়। (তাজকিরাতুল হুফ্ফাজ- ১/২০)

প্রশ্ন হতে পারে এই বিশাল জ্ঞান তিনি কিভাবে অর্জন করলেন? উত্তরে বলা যায় তাঁর স্বভাবগত আগ্রহ ও তীক্ষ্ণ মেধার বলে তিনি এ যোগ্যতা অর্জন করেন। তাছাড়া এমন প্রতিভাবান ছাত্রের প্রতি রাসূলুল্লাহর সা. বিশেষ যত্ন ও মনোযোগ দানও এর কারণ। হযরত মু’য়াজ অধিকাংশ সময় রাসূলুল্লাহর সা. আশেপাশে হাজির থাকতেন। তাছাড়া রাসূলুল্লাহর সা. প্রত্যেকটি মজলিস ছিল শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের এক একটি বৈঠক। তিনি সব সময় এই মজলিসের সুযোগ গ্রহণ করতেন।

হযরত মু’য়াজ সুযোগ পেলেই রাসূলুল্লাহর সা. সাথে একাকী থাকতেন। রাসূল সা. এই একাকীত্বের সুযোগে তাঁকে বিভিন্ন বিষয় শিক্ষা দিতেন। কখনও কোন মাসয়ালা জানার প্রয়োজন হলে তখনই তিনি রাসূলুল্লাহর সা. খিদমতে হাজির হতেন। তখন রাসূলকে সা. না পেলে বহু দূর পর্যন্ত খোঁজাখুঁজি করতেন। একবার তিনি গেলেন রাসূলুল্লাহর সা. গৃহে। যেয়ে শুনলেন তিনি কোথাও বেরিয়ে গেছেন। তিনি মানুষের কাছে রাসূলুল্লাহর সা. কথা জিজ্ঞেস করতে করতে এগুতে লাগলেন। এক সময় দেখলেন তিনি নামাযে দাঁড়িয়ে আছেন। মু’য়াজও রাসূলুল্লাহর সা. পিছনে দাঁড়িয়ে গেলেন। রাসূলুল্লাহ সা. দীর্ঘ নামায আদায় করলেন। নামায শেষে মু’য়াজ বললেনঃ আপনি আজ দীর্ঘ নামায আদায় করেছেন। রাসূল সা. বললেনঃ এটা ছিল আশা ও ভীতির নামায। আমি আল্লাহর কাছে তিনটি জিনিস চেয়েছিলাম। দুইটি দেওয়া হয়েছে এবং একটি দেওয়া হয়নি। তারপর তিনি সেই তিনটি প্রার্থনার কথা মু’য়াজকে বলেন। (মুসনাদ- ৫/২৪০)

হযরত মু’য়াজ সব সময় সুযোগের সন্ধানে থাকতেন। সুযোগ পেলেই তিনি জানার জন্য রাসূলুল্লাহর সা. নিকট প্রশ্ন করতেন। তবে রাসূলুল্লাহর সা. মেজায ও মর্জির প্রতি সর্বদা সতর্ক দৃষ্টি রাখতেন। তাবূক যুদ্ধের পূর্বে লোকেরা সূর্যোদয়ের সময় বাহনের পিঠে ঘুমাচ্ছিল এবং উটগুলি এদিক সেদিক চরছিল। হযরত মু’য়াজ এমন একটি সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইলেন না। তিনি রাসূলুল্লাহর সা. নিকট গেলেন। তিনি তখন ঘুমিয়ে এবং উটটিও চরছে। মু’য়াজের উটটি হোঁচট খেলো এবং তিনি লাগাম ধরে টান দিলেন। উটটি আরও ক্ষেপে গিয়ে লাফালাফি করতে লাগলো। রাসূলুল্লাহর সা. ঘুম ভেঙ্গে গেল। তিনি পিছনের দিকে তাকিয়ে মু’য়াজকে দেখে ডাক দিলেন! মু’য়াজ! মু’য়াজ সাড়া দিলেন। রাসূল সা. বললেনঃ কাছে এস। মু’য়াজ এত নিকটে গেলেন যে রাসূলুল্লাহ সা. ও তাঁর উট একদম পাশাপাশি এসে গেল। তিনি বললেন, দেখ তো মানুষ কত দূরে? মু’য়াজ বললেনঃ সবাই ঘুমিয়ে আছে আর পশুগুলি চরছে। রাসূল সা. বললেনঃ আমিও ঘুমাচ্ছিলাম। মু’য়াজ বললেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ! অনুমতি দিলে আমি আপনাকে এমন একটি বিষয়ে জিজ্ঞেস করতাম যা আমাকে ভীষণ চিন্তিত ও পীড়িত করে তুলেছে। রাসূল সা. বললেন, তোমার যা ইচ্ছা প্রশ্ন করতে পার।

হযরত মু’য়াজের স্বভাবেই ছিল জানার আগ্রহ। একবার এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহর সা. নিকট একটি বিশেষ মাসয়ালা জিজ্ঞেস করলো। রাসূল সা. যে জবাব দিলেন তা একজন সাধারণ লোকের জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু হযরত মু’য়াজ ততটুকু যথেষ্ট মনে করতে পারলেন না। তিনি বললেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ! এই হুকুম কি বিশেষ এই ব্যক্তির জন্য, না সাধারণভাবে সকল মুসলমানের জন্য? রাসূল সা. বললেন, না, এটা একটি সাধারণ হুকুম। (মুসনাদ- ৫/২৪৪)

জ্ঞান ও বিভিন্ন বিষয়ে ইজতিহাদ ও গবেষণার যোগ্যতা অর্জন করে তিনি ফকীহ, মুজতাহিদ ও মু’য়াল্লিমের আসনে সমাসীন হন। রাসূলে কারীমের সা. জীবনেই তিনি শিক্ষকের পদে নিযুক্তি লাভ করেন। হিজরী অষ্টম সনে মক্কা বিজয়ের পর মক্কাবাসীদের ফিকাহ ও সুন্নাতের তা’লীম দানের জন্য রাসূল সা. তাঁকে সেখানে রেখে আসেন। (আনসাবুল আশরাফ- ১/৩৬৫, সীরাতু ইবন হিশাম- ২/৫০০, তাবাকাত- ১/৯৯) তাছাড়া- হিজরী নবম সনে রাসূল সা. তাঁকে ইয়ামনে পাঠান। ইয়ামনের অন্যান্য দায়িত্বের সাথে সেখানকার লোকদের শিক্ষার দায়িত্বও তাঁর ওপর অর্পণ করেন।

মু’য়াজ যখন ফিলিস্তিনে তখন তাঁর শিক্ষাদানের গন্ডি ফিলিস্তিনের বাইরেও বিস্তৃত ছিল। দিমাশ্ক, হিমস প্রভৃতি স্থানেও তাঁর হালকা-ই-দারস ছিল। এ সকল স্থানে তিনি ঘুরে ঘুরে দারস দিতেন। তাঁর দারসের পদ্ধতি ছিল, একটি বৈঠকে কিছু সাহাবী কোন একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন, আর হযরত মু’য়াজ চুপ করে বসে শুনতেন। আলোচকরা কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হতে না পারলে তিনি সিদ্ধান্ত ব্যক্ত করতেন।

আবু ইদরীস আল-খাওলানী একবার জামে’ দিমাশ্ক- এ গিয়ে দেখলেন, এক সুদর্শন যুবককে ঘিরে লোকেরা গোল হয়ে বসে আছে। কোন বিষয়ে তাদের মতভেদ হলে সেই যুবকের দৃষ্টি আকর্ষন করা হচ্ছে আর তিনি সন্তোষজনক জবাব দিচ্ছেন। তিনি যখন জিজ্ঞেস করলেন, যুবকটি কে? বলা হলো- মু’য়াজ ইবন জাবাল।
আবু মুসলিম আল-খাওলানী একবার জামে’ হিম্স- এ গিয়ে দেখলেন, বত্রিশ জন প্রবীণ সাহাবী গোল হয়ে বসে আছেন। তাঁদের প্রত্যেকেই বার্ধক্যে পৌঁছে গেছেন। তাঁদের মধ্যে একজন যুবকও আছেন। কোন মাসয়ালায় তাঁদের মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি হলে এই যুবক মিমাংসা করে সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন। পরে তিনি জানতে পারেন এই যুবক মু’য়াজ ইবন জাবাল। (তাজকিরাতুল হুফ্ফাজ- ১/২০, হায়াতুস সাহাবা- ২/৬৩১, ৬৩৮) শহর ইবন হাওশাব থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহর সা. সাহাবীরা যখন কোন বিষয়ে আলোচনা করতেন, তাঁদের মধ্যে মু’য়াজ ইবন জাবাল উপস্থিত থাকলে সকলে তাঁর প্রতি সম্ভ্রমের দৃষ্টিতে তাকাতেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবন মাস’উদ রা. বলতেন, দুনিয়ায় ’আলিম মাত্র তিনজন। তাঁদের একজন শামে বসবাসরত। একথা দ্বারা তিনি মু’য়াজের দিকেই ইঙ্গিত করতেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবন ’উমার রা. মানুষের কাছে জিজ্ঞেস করতেন, তোমরা কি জান ’আলিম মতান্তরে ’আকিল কারা? লোকেরা অজ্ঞতা প্রকাশ করতে বলতেন, ’আলিম হলেন মু’য়াজ ইবন জাবাল ও আবুদ দারদা। (তাবাকাত- ২/৩৫০)

একজন মুজতাহিদের সবচেয়ে বড় গুণ সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া। হযরত মু’য়াজ এমন সঠিক সিদ্ধান্তের অধিকারী ছিলেন যে খোদ রাসূলসা. কোন কোন ক্ষেত্রে তাঁর সিদ্ধানেরত জন্য সন্তুষ্টি ব্যক্ত করেছেন। রাসূল সা. তাঁকে ইয়ামনে পাঠানোর পূর্বে যে পরীক্ষা গ্রহণ করেন সে সময় তিনি যে জবাব দেন তাতে রাসূল সা. দারুণ সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। মূলতঃ তাঁর এই জবাবের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় যে, ইসলামী শরী’য়াতের মৌলিক উৎস তিনটিঃ ১. কিতাবুল্লাহ, ২. সুন্নাহ ও ৩. কিয়াস।
ইসলামের প্রথম যুগে যারা একটু দেরীতে নামাযের জামা’য়াতে হাজির হতো এবং দুই এক রাকা’য়াত ছুটে যেত। তারা নামাযে দাঁড়ানো লোকদের কাছে ইশারায় জিজ্ঞেস করে জেনে নিত কত রাকা’য়াত হয়েছে। নামাযীরাও ইশারায় তা জানিয়ে দিত। দেরীতে আসা লোকটি প্রথমে তার ছুটে যাওয়া নামায আদায় করে জামা’য়াতে শরীক হতো। এভাবে একদিন নামায হচ্ছে এবং প্রথম বৈঠক চলছে, এমন সময় মু’য়াজ আসলেন এবং প্রচলিত নিয়মের খিলাফ প্রথমে জামা’য়াতে শরীক হয়ে গেলেন। রাসূল সা. সালাম ফিরানোর পর মু’য়াজ উঠে ছুটে যাওয়া রাকা’য়াতগুলি আদায় করলেন। তাঁর এ কাজ দেখে রাসূল সা. বললেনঃ ‘কাদ সান্না লাকুম ফা হাকাজা ফাসনা’য়’- মু’য়াজ তোমাদের জন্য একটি নতুন পদ্ধতি বের করেছে, তোমরাও এমনটি করবে। (মুসনাদ- ৫/২৩৩, ২৪৬) হযরত মু’য়াজের জন্য এটা অতি সম্মান ও গৌরবের বিষয় যে, তাঁরই একটা ’আমল গোটা মুসলিম জাতির জন্য ওয়াজিব করে দেওয়া হয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত তা জারী থাকবে।

একবার এক গর্ভবতী মহিলার স্বামী দুই বছর নিরুদ্দেশ থাকে। এর মধ্যে মহিলা গর্ভবর্তী হয়, মানুষের মনে সন্দেহ হলে তারা বিষয়টি খলীফা ’উমারের নিকট উত্থাপন করে। ’উমার রা. মহিলাকে রজম করার (যিনার শাস্তি) নির্দেশ দেন। মু’য়াজ বললেনঃ মহিলাকে রজম করার অধিকার আপনার আছে। কিন্তু পেটের সন্তানের রজম করার অধিকার আপনাকে কে দিয়েছে? ’উমার মহিলাকে তখনকার মত ছেড়ে দিয়ে সন্তান প্রসবের পর রজমের নির্দেশ দেন।

মহিলা একটি পুত্র সন্তান প্রসব করে। সন্তানটি ছিল অবিকল তাঁর পিতার ’আদলের। তখন পিতা সন্তান দেখে শপথ করে দাবী করে এ তো আমারই সন্তান। এ কথা শুনে ’উমার রা. মন্তব্য করেনঃ ‘মু’য়াজের মত সন্তান মহিলারা আর জন্ম দিতে পারবে না। মু’য়াজ না থাকলে ’উমার ধ্বংস হয়ে যেত।’ তিনি আরও বলতেনঃ ‘মু’য়াজের মত সন্তান জন্ম দিতে মহিলারা অক্ষম হয়ে গেছে।’ সাহাবী সমাজে রমধ্যে তাঁর বিশাল মর্যাদা সম্পর্কে এমনই একটা ধারণা বিদ্যমান ছিল।

খলীফা ’উমারের অন্তিম সময় ঘনিয়ে এলে লোকেরা তাঁর নিকট পরবর্তী খলীফা মনোনয়নের জন্য ’আরজ করলো। তখন তিনি একটি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন। তার মধ্যে এ কথাটিও বলেন যে, ’আজ মু’য়াজ ইবন জাবাল বেঁচে থাকলে তাঁকেই খলীফা বানিয়ে যেতাম। আল্লাহ আমাকে জিজ্ঞেস করলে বলতাম, আমি এমন এক ব্যক্তিকে খলীফা বানিয়ে এসেছি যার সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেনঃ ‘কিয়ামতের দিন মু’য়াজ সব ’আলিমদের থেকে এক অথবা দুই তীর নিক্ষেপের দূরত্ব আগে থাকবে। (উসুদুল গাবা- ৪/৩৭৮, তাজকিরাতুল হুফ্ফাজ- ১/১৯)

খলীফা হযরত আবু বকর রা. ইয়াযীদ ইবন আবী সুফইয়ানকে একবার অসীয়াত করেনঃ ‘মু’য়াজ ইবন জাবালের প্রতি লক্ষ্য রাখবে। রাসূলুল্লাহর সা. সাথে আমি তাঁর সকল অভিযান প্রত্যক্ষ করেছিল। রাসূল সা. একদিন তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেনঃ কিয়ামতের দিন মু’য়াজ ’আলিমদের থেকে এক তীর নিক্ষেপের দূরত্ব আগে থাকবে। সে এবং আবু ’উবাইদার সাথে পরামর্শ ছাড়া কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে না। তাতে তোমার মঙ্গল হবে না। (হায়াতুস সাহাবা- ২/১১৮) অপর একটি বর্ণনায় এসেছেঃ কিয়ামতের দিন সকল ’আলিম মু’য়াজের পতাকাতলে উঠবে। (শাজারাত- ১/৩০)

একবার খলীফা হযরত ’উমার রা. মু’য়াজকে পাঠালেন বনু কিলাম গোত্রে যাকাত আদায় করে গরীবদের মধ্যে বন্টনের জন্য মু’য়াজ সেখানে গিয়ে দায়িত্ব পালন করে স্ত্রীর নিকট ফিরে আসলেন। যাওয়ার সময় হাতে করে যে জিনিসগুলি নিয়ে গিয়েছিলেন ফেরার সময় শুধু সেইগুলিই হাতে করে ফিরলেন। স্ত্রী কাছে এসে বললেনঃ অন্যান্য শাসকরা ঘরে ফেরার সময় তাঁদের পরিবারের লোকদের জন্য নানা রকম উপঢৌকন নিয়ে আসে, দেখি তুমি আমার জন্য কি নিয়ে এসেছ? মু’য়াজ বললেনঃ আমার সাথে সবসময় একজন পাহারাদার ছিল। সে সতর্কভাবে আমাকে পাহারা দিয়েছেন। স্ত্রী বললেনঃ তুমি ছিলে রাসূলুল্লাহর সা. ও আবু বকরের পরম বিশ্বাসভাজন ব্যক্তি। আর ’উমার কিনা তোমার পিছনে পাহারাদার নিয়োগ করেছে?

স্বামী-স্ত্রীর এ আলোচনা ’উমারের রা. মেয়ে মহলের মাধ্যমে তাঁর কানে গেল। তিনি মু’য়াজকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেনঃ আমি তোমার পিছনে পাহারাদার নিয়োগ করেছি? মু’য়াজ বললেনঃ না, আপনি তা করবেন কেন? তবে আমার স্ত্রীকে বুঝ দেওয়ার জন্য এমন কথা না বলে উপায় ছিলনা। ’উমার একটু হেসে দিলেন। তারপর মু’য়াজের হাতে কিছু অর্থ দিয়ে বলেন, যাও, এইগুলি দিয়ে তোমার স্ত্রীকে খুশী কর। (সুওয়ারুম মিন্ হায়াতিস সাহাবা- ৭/১৩১-১৩২)

তিনি ছিলেন অত্যন্ত দানশীল একারণে তাঁর সকল বিষয়-সম্পত্তি একবার নিলামে উঠে বিক্রী হয়েছিল। তাঁর এই দানশীলতায় ইসলামের যথেষ্ট কল্যাণ সাধিত হয়েছে।
খলীফা ’উমার রা. একদিন সংগীদের বললেনঃ আচ্ছা বলতো তোমরা কে কি নেক আশা কর। একজন বললো, আমার বাসনা হলো, আমি যদি এই ঘর ভর্তি দিরহাম পেতাম এবং সবই আল্লাহর রাস্তায় খরচ করতে পারতাম। আরেকজন বললোঃ আমি যদি এই ঘর ভর্তি সোনাদানা পেতাম এবং আল্লাহর রাস্তায় বিলিয়ে দিতে পারতাম। এভাবে একেক জন একেক রকম সৎ বাসনা প্রকাশ করলো। সবশেষে ’উমার রা. বললেনঃ আমার বাসনা কি জান? আমি যদি এই ঘর ভর্তি পরিমাণ আবু ’উবাইদা ইবনুল জাররাহ, মু’য়াজ ইবন জাবাল ও হুজায়ফা ইবনুল ইয়ামানের মত লোক পেতাম এবং তাদের সকলকে আল্লাহর আনুগত্যের কাজে লাগাতে পারতাম। তারপর তিনি বলেন, এখনই আমি পরীক্ষা করে প্রমাণ করে দিচ্ছি।

তিনি চাকরকে ডেকে চারশত দীনার ভর্তি একটি থলি তার হাতে দিয়ে বলেন, এগুলি আবু ’উবাইদাকে দিয়ে তার ব্যক্তিগত প্রয়োজনে খরচ করতে বলে এস। আবু ’উবাইদা থলিটি হাতে নিয়ে খলীফার চাকর স্থান ত্যাগের পূর্বেই দীনারগুলি বিভিন্ন থলিতে ভরলেন এবং অভাবীদের মধ্যে বন্টন করে দিলেন। অনুরূপভাবে খলীফা আর একটি দীনার ভর্তি থলি পাঠালেন মু’য়াজ ইবন জাবালের কাছে। মু’য়াজও তক্ষুণি দাসীকে ডেকে দীনারগুলি বিভিন্ন লোকের মধ্যে বন্টন শুরু করলেন। থলিতে যখন মাত্র দুইটি দীনার বাকী তখন তাঁর স্ত্রী খবর পেলেন এবং দৌড়ে এসে বললেন, আমিও তো একজন মিসকীন, আমাকেও কিছু দাওনা। মু’য়াজ দীনার দুইটি সহ থলিটি স্ত্রীর দিকে ছুড়ে মেরে বলেনঃ এই নাও। খলীফা চাকরের মুখে আবু ’উবাইদা ও মু’য়াজের এই আচরণের কথা শুনে দারুণ পুলকিত হন এবং মন্তব্য করেনঃ তারা প্রত্যেকেই পরস্পরের ভাই। (হায়াতুস সাহাবা- ২/২৩১-২৩৩)

আল্লাহর প্রতি গভীর মুহাব্বত ও ভালোবাসা, তাঁর ইতা’য়াত ও আনুগত্য, ’ইবাদাত ও বন্দেগী এবং তাঁর ওপর তাওয়াককুল ও নির্ভরতা হচ্ছে একজন মুমিনের অন্যতম বৈশিষ্ট ও পরিচয়। হযরত মু’য়াজের মধ্যে এসব বৈশিষ্ট্যপূর্ণরূপ লাভ করে। গভীর রাতে তিনি আল্লাহর ইবাদাতে মশগুল হয়ে যেতেন। কাঁদতে কাঁদতে আল্লাহর দরবারে হাত উঠিয়ে দু’আ করতেনঃ ‘হে আল্লাহ! এখন সকল চক্ষু নিদ্রিত। কিন্তু তুমি চিরজাগ্রত, চিরঞ্জীব। হে আল্লাহ। জান্নাতের দিকে আমার যাত্রা বড় মন্থর এবং জাহান্নাম থেকে পলায়ন বড় দুর্বল। তুমি আমার জন্য তোমার কাছে একটি হিদায়াত নির্দিষ্ট রাখ যা কিয়ামতের দিন আমি লাভ করতে পারি।’ (উসুদুল গাবা- ৪/৩৭৭) তিনি যে কত বড় আল্লাহনির্ভর লোক ছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় ’আমওয়াসের মহামারির সময়। হযরত ’আমর ইবনুল ’আস যখন সৈন্যদের স্থান ত্যাগের পরামর্শ দেন তখন তাঁর পরামর্শকে তাওয়াক্কুলের পরিপন্থী মনে করে তিনি ভীষণ ক্ষেপে যান। শেষ পর্যন্ত তাওয়াক্কুলের ওপর অটল থেকেই সেই মহামারিতে মৃত্যুবরণ করেন।
একদিন হযরত ’উমার রা. দেখলেন, মু’য়াজ কাঁদছেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন। তুমি কাঁদছো কেন? মু’য়াজ বলেনঃ আমি রাসূলুল্লাহকে সা. বলতে শুনেছিঃ বিন্দুমাত্র ‘রিয়া’ ও এক ধরণের শিরক। আর আত্মগোপনকারী-মুত্তাকীরাই হচ্ছে আল্লাহর সর্বাধিক প্রিয় বান্দা। তাঁরা অদৃশ্য হলে হারায় না এবং দৃশ্যমান হলে চেনা যায়না। তাঁরাই হলেন হিদায়াতের ইমাম ও ইলমের মশাল বা প্রদীপ। (হায়াতুস সাহাবা- ২/৬২৪)

তাউস থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, একবার মু’য়াজ ইবন জাবাল আমাদের অঞ্চলে আসেন। আমাদের নেতারা বললোঃ আপনার অনুমতি পেলে আমরা পাথর ও ইট দিয়ে আপনার জন্য একটি মসজিদ বানিয়ে দিতাম। মু’য়াজ বললেনঃ কিয়ামতের দিন এই মজদি আমার পিঠে বহন করতে বলা হয় কিনা সে ব্যাপারে আমি শঙ্কিত। (হায়াতুস সাহাবা- ২/৬২১)

ইসলামী সাম্য ও ন্যায় বিচারে তিনি ছিলেন এক বাস্তব নমুনা। ছোট খাট ব্যাপারেও তিনি ইনসাফ থেকে বিচ্যুত হতেন না। ইয়াহইয়া ইবন সা’ঈদ থেকে বর্ণিত হয়েছে। মু’য়াজের দুই স্ত্রী ছিল। তিনি তাদের মধ্যে সমতা বিধানের প্রতি ছিলেন দারুণ সতর্ক। যেদিন তিনি এক স্ত্রীর ঘরে অবস্থান করতেন সেদিন অন্যের ঘরে অজু করা বা এক গ্লাস পানিও পান করতেন না। দুই স্ত্রীই ’আমওয়াসের মহামারিতে এক সাথে মারা যান। দুইজনকে একই কবরে দাফন করা হয়। কবর খোড়া হলে কাকে আগে কবরে রাখা হবে সে ব্যাপারেও লটারী করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। (হায়াতুস সাহাবা- ২/৬১২)

রাসূলুল্লাহর সা. প্রতি মু’য়াজের যে কত গভীর ভালোবাসা ছিল তার কিছু পরিচয় পূর্ববর্তী আলোচনায় পরিস্ফুট হয়েছে। কখনও তাঁকে না পেলে তিনি অস্থির হয়ে তাঁর খোঁজে বেরিয়ে পড়তেন। রাসূলুল্লাহর সা. নিয়ম ছিল সফরে রাত্রি যাপনের সময় মুহাজির সঙ্গীদের নিজের কাছেই রাখা। একবার তিনি কোন এক সফরে গেলেন। সাহাবীরাও সংগে ছিলেন। এক স্থানে রাত্রি যাপনের জন্য থামলেন। রাসূল সা. মু’য়াজহ সহ কতিপয় সাহাবীর একটি বৈঠক থেকে কিছু না বলে কোথাও চলে গেলেন। মু’য়াজ অস্থির হয়ে পড়লেন। সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন। তারপর আবু মূসাকে সংগে করে রাসূলুল্লাহর সা. খোঁজে বেরিয়ে পড়লেন। পথে রাসূলুল্লাহর সা. কণ্ঠস্বর শুনে এগিয়ে গেলেন। রাসূল সা. তাঁদের দেখে প্রশ্ন করেনঃ তোমাদের কি অবস্থা? তাঁরা বললেনঃ আপনাকে না পেয়ে আমরা শঙ্কিত হয়ে পড়লাম। তাই খুঁজতে বেরিয়েছি। (মুসনাদ- ৫/২৩২)

হযরত রাসূলে কারীমের সা. প্রতি ছিল তাঁর সীমাহীন ভক্তি ও শ্রদ্ধা। একবার তিনি সফর থেকে ফিরে এসে রাসূলকে সা. বললেনঃ আমরা ইয়ামানে একজন অন্যজনকে সিজদাহ করতে দেখেছি। আমরা কি আপনাকে সিজদাহ করতে পারিনে? রাসূল সা. বললেনঃ আমি যদি কোন মানুষের জন্য সিজদাহর বিধানই রাখতাম তাহলে মহিলাদেরকে বলতাম তাদের নিজ নিজ স্বামীদেরকে সিজদাহ করতে। (মুসনাদ- ৫/২২৭)

একবার মুনাফিক কায়েস ইবন মুতাতিয়্যা একটি মজলিসে উপস্থিত হলো। সেই মজলিসে হযরত সালমান আল-ফারেসী, সুহাইব আর রূমী ও বিলাল আল-হাবশী উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের প্রতি ইঙ্গিত করে কায়েস বললো, এই আউস ও খাযরাজ না হয় এই ব্যক্তিকে (রাসূলুল্লাহকে) সাহায্য করলো; কিন্তু এই সব লোক সাহায্য করছে কেন? একথা বলার সাথে সাথে মু’য়াজ ইবন জাবাল লাফ দিয়ে উঠে তার বুকের ও গলার কাপড় মুট করে ধরে টানতে টানতে সোজা রাসূলুল্লাহর সা. নিকট নিয়ে গেলেন। এ অবস্থা দেখে রাসূল সা. রাগে ফেটে পড়লেন। তিনি লোকদের মসজিদে সমবেত হওয়ার আহবান জানাতে বললেন। জনগণ মসজিদে সমবেত হলে তিনি ঐক্য ও সংহতির ওপর এক ভাষণ দান করেন। ভাষণ শেষ হলে মু’য়াজ বলেন, কিন্তু এই মুনাফিকের ব্যাপারে আপনি কি বলেন? রাসূল সা. জবাব দিলেনঃ তাঁকে জাহান্নামের জন্য ছেড়ে দাও। মু’য়াজ ছেড়ে দিলেন। পরবর্তীকালে এই কায়েস মুরতাদ হয়ে ইসলামী খিলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয় এবং এ অবস্থায় মুসলিম মুজাহিদদের হাতে নিহত হয়। (হায়াতুস সাহাবা- ২/৪৭৬, ৪৭৭)

একবার হযরত মু’য়াজ রাসূলুল্লাহর সা. সংগে ছিলেন। রাসূল সা. তাঁর একখানি হাত ধরে বললেনঃ মু’য়াজ, তোমার প্রতি আমার গভীর ভালোবাসা। উত্তরে মু’য়াজ বললেনঃ আমার মা-বাবা আপনার প্রতি কুরবান হোক। আমিও অন্তর দিয়ে আপনাকে ভালোবাসি। রাসূল সা. বললেনঃ আমি তোমাকে একটি উপদেশ দিচ্ছি কক্ষণও তা অবহেলা করবে না। তারপর তাঁকে একটি দু’আ শিখিয়ে দিলেন। হযরত মু’য়াজ আমরণ সেই দু’আটি পাঠ করতেন। (মুসনাদ- ৫/২৪৫)

হিজরী ১৬ সনে খলীফা হযরত ’উমার যখন বাইতুল মাকদাস সফর করেন তখন সেখানে হযরত বিলাল ও মু’যাজও ছিলেন। ’উমার আযান দেওয়ার জন্য বিলালকে অনুরোধ করলেন। বিলাল বললেনঃ রাসূলুল্লাহর সা. ওফাতের পর আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আর কারও অনুরোধে কক্ষণও আযান দেবনা। কিন্তু আজ আপনার অনুরোধ রক্ষা করবো। তিনি আযান দিতে শুরু করলেন। আযানের ধ্বনিতে সাহাবীদের মনে রাসূলে পাকের সা. জীবনকালের স্মৃতি ভেসে ওঠে। তাঁদের মধ্যে ভাবান্তর সৃষ্টি হয়। হযরত মু’য়াজ তো কাঁদতে কাঁদতে অস্থিত হয়ে পড়লেন।

হযরত মু’য়াবিয়া রা. যখন শামের গভর্ণর তখন মু’য়াজ একবার সেখানে গিয়ে দেখলেন, লোকেরা ‘বিতর’ নামায আদায় করে না। তিনি মুয়াবিয়ার কাছে এর কারণ জানতে চাইলেন। বিষয়টি তাঁরও জানা ছিল না। তাই তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেনঃ বিতর কি ওয়াজিব? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ। এভাবে আমর বিল মা’রূফের ব্যাপারে তিনি কারও পরোয়া করতেন না। (মুসনাদ- ৫/২৪২)

তিনি ছিলেন সত্যবাদী। খোদ রাসূলুল্লাহ সা. তাঁর সত্যবাদিতার সাক্ষ্য দিয়েছেন। একবার হযরত মু’য়াজ হযরত আনাসের নিকট একটি হাদীস বর্ণনা করলেন। তারপর আনাস রাসূলুল্লাহর সা. নিকট গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি মু’য়াজকে একথা বলেছেন? জবাবে রাসূল সা. তিনবার বললেনঃ মু’য়াজ সত্য বলেছেন। (উসুদুল গাবা- ৪/৩৭৭)

তাঁর মরণ-সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে লোকেরা এই বলে বিলাপ শুরু করে দিল যে, ইল্ম উঠে যাচ্ছে। তারা মু’য়াজকে বললো, আপনি আমাদের বলে যান, আপনার মৃত্যুর পর আমরা কার নিকট যাব। তিনি বললেনঃ আমাকে একটু উঠিয়ে বসাও। বসানো হলে বললেনঃ শোন, ইলম ও ঈমান- এ দুইটি উঠার জিনিস নয়। যারা তালাশ করবে তারা লাভ করবে। কথাটি তিনবার বললেন। তারপর বললেনঃ তোমরা আবু দারদা, সালমান আল-ফারেসী, ইবন মাস’উদ ও আবদুল্লাহ ইবন সালাম- এই চার জনের নিকট থেকে ইলম হাসিল করবে। (মুসনাদ- ৫/২৪৩)

সীরাত গ্রন্থসমূহে দেখা যায় পবিত্র কুরআনের বেশ কয়েকটি আয়াত নাযিলের ঘটনার সাথে হযরত মু’য়াজও প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। একবার হযরত মু’য়াজ ইবন জাবালসহ আউস ও খাযরাজ গোত্রের কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি ইহুদীদের কয়েকজন আহবারের নিকট তাওরাতের কয়েকটি বিষয় সম্পর্কে জানার জন্য প্রশ্ন করেন। কিন্তু তারা সত্যকে গোপন করার উদ্দেশ্যে তা জানাতে অস্বীকার করে। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ পাক সূরা বাকারার ১৫৯ নং আয়াতটি নাযিল করেন। (সীরাতু ইবন হিশাম- ১/৫৫১)

হযরত রাসূলে কারীম সা. মদীনার ইহুদীদেরকে ইসলাম গ্রহণের জন্য উৎসাহিত করেন। আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে শরীক করার পরিণতি সম্পর্কে তাদেরকে সতর্ক করে দেন। তা সত্ত্বেও তারা রাসূলুল্লাহর সা. কথা মানতে অস্বীকার করতে থাকে। তাদের এ অবস্থা দেখে হযরত মু’য়াজ সহ কতিপয় সাহাবী ইহুদীদেরকে বললেনঃ ইহুদী সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। আল্লাহ কসম! তোমরা অবশ্যই জান যে তিনি আল্লাহর রাসূল। আর একথা তো তোমরা তাঁর নবুওয়াত লাভের পূর্বেই আমাদেরকে বলতে এবং তাঁর পরিচয়ও আমাদের কাছে তুলে ধরতে। একথার উত্তরে রাফে ইবন হুরায়মালা ও ওয়াহাব ইবন ইহাজা বললোঃ না, আমরা কক্ষণও তোমাদেরকে এমন কথা বলিনি। মূসার কিতাবের পর আর কোন কিতাব আল্লাহ নাযিল করেননি এবং আর কোন সুসংবাদ দানকারী ও ভীতি প্রদর্শনকারীও আল্লাহ পাঠাননি। তখন আল্লাহ পাক সূরা আল-মায়িদার ১৯ নং আয়াতটি নাযিল করে ইহুদীদের কথার প্রতিবাদ করেন। (সীরাতু ইবন হিশাম- ১/৫৬৪)

হাদীস ও সীরাত গ্রন্থসমূহে হযরত মু’য়াজ ইবন জাবাল সম্পর্কে এ ধরণের বহু খন্ড খন্ড তথ্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে যা মুসলিম সমাজ চেতনায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।