হযরত রাসূলে কারীম(সা) একদিন সাহাবীদের নির্দেশ দিলেন, “তোমরা কুরআন শেখ চার ব্যক্তির নিকট থেকেঃ আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ, সালেম মাওলা আবী হুজাইফা, উবাই ইবনে কা’ব ও মুয়ায ইবনে জাবাল।” কে এই সালেম মাওলা আবী হুজাইফা- যাকে কুরআন শিক্ষার ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ(সা) নির্ভরযোগ্য বলে ঘোষণা করেছেন?
তাঁর নাম সালেম, কুনিয়াত আবু আব্দুল্লাহ। পিতার নামের ব্যাপারে মতভেদ আছে। ইবন মুন্দাহ বলেছেন, ‘উবায়েদ ইবনে রাবী’য়া। আবার কারো কারো মতে, মা’কাল। ইরানী বংশোদ্ভূত। পারস্যের ইসতাখরান তাঁর পূর্বপুরুষের আবাসভূমি। হযরত সুবাইতা বিনতু ইউ’য়ার আল আনসারিয়্যার দাস হিসেবে মদীনায় পৌছেন। হযরত সুবাইতা ছিলেন আবী হুজাইফার(রা) স্ত্রী। সুবাইতা তাকে নিঃশর্ত আযাদ করে দিলে আবু হুজাইফা তাকে ছেলে হিসেবে গ্রহণ করেন। তিনি সালেম ইবনে আবু হুজাইফা নামে পরিচিত হন যেমন হয়েছিলেন যায়িদ ইবনে মুহাম্মাদ। কেউ কেউ তাঁকে আবু হুজাইফার দাস হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এসব কারণে তাঁকে মুহাজিরদের মধ্যে গণ্য করা হয়। অন্যদিকে হযরত সুবাইতার আযাদকৃত দাস হিসেবে তাঁকে আনসারীও বলা হয়। আবার মূলে পারস্যের সন্তান হওয়ার কারণে কেউ কেউ তাঁকে আজমী বা অনারব বলেও উল্লেখ করেছেন।
হযরত সালেম মক্কায় হযরত আবু হুজাইফার সাথে বসবাস করতেন। এই আবু হুজাইফা ছিলেন মক্কার কুরাইশ সর্দার ইসলামের চির দুশমন উতবা’র ছেলে। ইসলামী দাওয়াতের সূচনালগ্নেই যারা লাব্বাইক বলে সাড়া দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে আবু হুজাইফা ও তাঁর পালিত পুত্র সালেম ও ছিলেন। তাঁরা পিতা-পুত্র দুজনে নীরবে ও বিনীতভাবে তাঁদের রবের ইবাদত করে চললেন এবং কুরাইশদের নির্মম অত্যাচারের মুখে সীমাহীন ধৈর্য্য অবলম্বন করলেন। একদিন পালিতপূত্র গ্রহণের প্রথা বাতিল করে কুরআনের আয়াত নাযিল হলো-‘উদয়ুহুম লি আবায়িহিম’-তাদেরকে তাদের পিতার নামে সম্পৃক্ত করে ডাক। প্রত্যেক পালিত পুত্র আপন আপন জন্মদাতা পিতার নামে পরিচিতি গ্রহণ করলো। যেমন যায়িদ ইবনে মুহাম্মদ হলো যায়িদ ইবনে হারিসা। কিন্তু সালেম এর পিতৃপরিচয় ছিল অজ্ঞাত। তাই তিনি পরিচিত হলেন ‘সালেম মাওলা আবী হুজাইফা’-আবু হুজাইফার বন্ধু, সাথী, ভাই বা আযাদকৃত দাস সালেম হিসেবে।
ইসলাম পালিত পুত্রের প্রথা বাতিল করে। সম্ভবত ইসলাম একথা বলতে চায় যে, রক্ত, আত্মীয়তা বা অন্য কোনো সম্পর্ককে ইসলামী ভ্রাতৃত্বের সম্পর্কের চেয়ে অধিক গুরুত্ব দেওয়া তোমাদের উচিত নয়। বিশ্বাস বা আকীদার ভিত্তিতেই তোমাদের সম্পর্ক নির্মিত হওয়া উচিত। প্রথম পর্যায়ের মুসলমানরা এ ভাবটি খুব ভাল করে বুঝেছিলেন। তাই, তাঁদের কাছে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পর তাঁদের দ্বীনি ভাই অপেক্ষা অধিক প্রিয় আর কিছু ছিল না। এটা আমরা আনসার ও মুহাজিরদের মধ্যে দেখেছি। তেমনিভাবে দেখে থাকি সম্ভ্রান্ত কুরাইশ আবু হুজাইফা ও তাঁর পিতৃ পরিচয়হীন অজ্ঞাত অখ্যাত দাস সালেমের সম্পর্কের ক্ষেত্রে।
হযরত সালেমের ঈমান ছিল সিদ্দীকিনদের ঈমানের মত এবং আল্লাহর পথে তিনি চলেছিলেন মুত্তাকীনদের মত। সমাজে তাঁর স্থান কি এবং তাঁর জন্ম-পরিচয়ই বা কি সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করেন নি। ইসলাম যে নতুন সমাজ বিনির্মাণ করেছিল, সেই সমাজ তাঁর তাকওয়া ও ইখলাসের জন্য তাঁকে সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করেছিল। এই মহান পূণ্যময় নতুন সমাজেই আবু হুজাইফা-গতকাল যে তাঁর দাস ছিল তাকে ভাই বা বন্ধুরূপে গ্রহণ করে গৌরব বোধ করেছিলেন। এমনকি তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রী ফাতিমা বিনতুল ওয়ালিদকে তাঁর সাথে বিয়ে দিয়ে নিজ পরিবারকে সম্মান ও গৌরবের আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। যে সমাজ ব্যবস্থা সকল প্রকার যুলুম অত্যাচার দূর করে সব রকম মিথ্যা আভিজাত্যকে বাতিল ঘোষণা করেছিল, সেখানে সালেমের ঈমান, সততা ও দৃঢ়তা তাঁকে প্রথম সারির ব্যক্তিরূপে প্রতিষ্ঠিত করে।
হযরত রাসূলে কারীমের হিজরতের পূর্বেই তিনি তাঁর দ্বীনি বন্ধু আবু হুজাইফার সাথে মদীনায় হিজরত করেন। মদীনায় তিনি হজরত আব্বাদ ইবনে বিশরের অতিথি হন। মক্কায় রাসূলুল্লাহ(সা) আবু উবাইদাহ ইবনুল জাররাহর সাথে তাঁর দ্বীনি ভ্রাতৃত্ব কায়েম করে দেন। কিন্তু মদীনায় তাঁর ভ্রাতৃসম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয় হযরত মুয়াজ ইবনু মায়েজ আল আনসারীর সাথে।
সাহাবীদের যুগে কিরআত শিল্পে যাদেরকে ইমাম গণ্য করা হতো, সালেম তাঁদের অন্যতম। তিনি এমন সুমধুর কন্ঠের অধিকারী ছিলেন যে, কুরআন তিলাওয়াত শুরু করলে শ্রোতারা তা মুগ্ধ হয়ে শুনত। একদিন উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশার রাসূলুল্লাহ(সা) এর নিকট হাজির হতে দেরি হল। রাসূলুল্লাহ(সা) জিজ্ঞেস করলেন- তোমার দেরি হল কেন? আয়িশা বললেন- একজন কারী সুমধুর কন্ঠে কুরআন তিলাওয়াত করছিল, তাই শুনছিলাম। তিনি তাঁর তিলাওয়াতের মাধূর্য্য বর্ণনা করলেন। তাঁর বর্ণনা শুনে রাসূলুল্লাহ(সা) চাদরটি টেনে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে দেখলেন, সেই ক্বারী আর কেউ নয়, তিনি সালেম মাওলা আবু হুজাইফা। রাসূলুল্লাহ(সা)তাঁর তিলাওয়াত শুনে মন্তব্য করলেন, “আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাজী জা’য়ালা ফী উম্মাতী মিছলাক”-আমার উম্মাতের মধ্যে যিনি তোমার মত লোককে সৃষ্টি করেছেন সেই আল্লাহর জন্য সকল প্রশংসা। (উসুদুল গাবা-২/২৪৬)।
সুমধুর কন্ঠস্বর এবং বেশি কুরআন হিফজ থাকার কারণে সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে সালেমকে অত্যধিক সম্মান ও মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখা হতো। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমার(রা) বলেন, “রাসূলুল্লাহ(সা) মদীনায় হিজরতের পূর্বে যারা মদীনায় হিজরত করেছিলেন, মসজিদে কুবায় সালেম তাদের নামাজে ইমামতি করতেন।” (বুখারী) হযরত আবু বাকর ও হযরত উমারের(রা) মত বিশিষ্ট সাহাবীরাও তাঁর পেছনে নামায আদায় করতেন।
বদর, উহুদ, খন্দকসহ সকল যুদ্ধেই তিনি রাসূলে কারীমের(সা) সাথে ছিলেন।(উসুদুল গাবা-২/২৪৬) বদর যুদ্ধে তিনি কাফের উমাইর ইবন আবী উমাইরকে নিজ হাতে হত্যা করেন। (ইবন হিশাম-১/৭০৮)।
মক্কা বিজয়ের পর রাসূলুল্লাহ(সা) মক্কার চারিদিকের গ্রাম ও গোত্রগুলিতে কতকগুলি দাওয়াতী প্রতিনিধি দল পাঠালেন। তিনি তাদেরকে বলে দিলেন, “যোদ্ধা হিসেবে নয়, বরং দায়ী বা আহবানকারী হিসেবে তোমাদের পাঠানো হচ্ছে।” এমন একটি দলের নেতা ছিলেন হযরত খালিদ ইবনু ওয়ালীদ। খালীদ তাঁর গন্তব্যস্থানে পৌছার পর এমন এক ঘটনা ঘটলো যে, তিনি তরবারী চালালেন এবং তাতে প্রতিপক্ষের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলো। এ খবর রাসূলুল্লাহ(সা) এর কানে পৌছলে তিনি দীর্ঘক্ষণ আল্লাহর কাছে এই বলে ওজর পেশ করলেন-“হে আল্লাহ, খালিদ যা করেছে, তার দায় দায়িত্ব থেকে আমি তোমার কাছে অব্যাহতি চাই।” এ অভিযানে হযরত সালেম হযরত খালিদের সহগামী ছিলেন। খালিদের এ কাজ সালেম নীরবে মেনে নেন নি। তিনি খালিদের এ কাজের তীব্র প্রতিবাদ করেন। তাঁর প্রতিবাদের মুখে মহাবীর খালিদ কখনো লা-জওয়াব হয়ে যান, আবার কখনও আত্মপক্ষ সমর্থন করে যুক্তি উপস্থাপনের চেষ্টা করেন। আবার কখনও সালেম এর সাথে প্রচন্ড বাক বিতন্ডায় জড়িয়ে পড়েন। কিন্তু সালেম স্বীয় মতের উপর অটল থাকেন। খালিদের ভয়ে সেদিন তিনি সত্য বলা হতে চুপ থাকেন নি।
সালেম কদিন আগেও যিনি ছিলেন মক্কার এক দাস, আজ তিনি খালিদের মত মক্কার এক সম্ভ্রান্ত কুরাইশ সিপাহশালারের কোনো পরোয়াই করেন নি। খালিদও কোনোপ্রকার বিরক্তিবোধ করেন নি। কারণ, ইসলাম তাঁদের উভয়কে সমমর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। নেতার প্রতি অহেতুক ভক্তি ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে সালেম সেদিন খালিদ এর ভুল মেনে নেননি। বরং তিনি দায়িত্বের অংশীদার হিসেবে প্রতিবাদমুখর হয়েছিলেন। তিনি আত্মতৃপ্তি বা নামের জন্য এ কাজ করেন নি বরং বারংবার তিনি রাসূলুল্লাহ(সা) এর কাছে শুনেছিলেন, “আদ-দ্বীন আন নাসীহা”- দ্বীনের অপর নাম সতোপদেশ। এ উপদেশই সেদিন তিনি খালিদকে দান করেছিলেন।
হযরত খালিদের এ বাড়াবাড়ির কথা রাসূলুল্লাহ(সা) এর কানে পৌছলে তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন- “কেউ কি তার এ কাজের প্রতিবাদ বা নিন্দে করে নি?” রাসূলে পাকের ক্রোধ পরে গেল যখন তিনি শুনলেন, “হ্যাঁ, সালেম প্রতিবাদ করেছিল। তাঁর সাথে ঝগড়া হয়েছিল।”
হযরত রাসূলে কারীম(সা) আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে গেলেন। হযরত আবু বকরের খিলাফত মুরতাদ বা ধর্মত্যাগীদের ষড়যন্ত্রের সম্মুখীন হলো। তাদের সাথে সংঘটিত হয় ভয়াবহ ইয়ামামার যুদ্ধ। এমন ভয়াবহ যুদ্ধ ইতোপূর্বে ইসলামের ইতিহাসে আর সংঘটিত হয় নি। মুসলিম বাহিনী মদীনা হতে ইয়ামামার উদ্দেশ্যে বের হলো। সালেম এবং তাঁর দ্বীনি ভাই আবু হুজাইফা অন্যদের সাথে বেরিয়ে পড়লেন। যুদ্ধের প্রথম পর্বে মুসলিম বাহিনী কিছুটা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এতে তাঁরা বুঝতে পারে, যুদ্ধ যুদ্ধই এবং দায়িত্ব দায়িত্বই। হযরত খালিদ ইবনু ওয়ালিদ নতুন করে তাদের সংগঠিত করেন এবং অভূতপূর্ব কায়দায় তিনি বাহিনীকে বিন্যস্ত করেন। প্রথমতঃ যখন মুসলিম বাহিনী পিছু হটে যাচ্ছিল, তখন হযরত সালেম চিৎকার করে উঠলেন, “আফসুস, রাসূলুল্লাহ(সা) এর সময়ে আমাদের অবস্থা তো এমন ছিল না।” তিনি নিজের জন্য একটি গর্ত খুঁড়ে তার মধ্যে অটল হয়ে দাঁড়িয়ে যান।(উসুদুল গাবা-২/২৪৬)।
ইয়ামামার যুদ্ধে প্রথমে হযরত যায়িদ ইবনুল খাত্তাবের হাতে ছিল মুসলিম বাহিনীর পতাকা। তিনি শাহাদাত বরণ করলে পতাকাটি মাটিতে পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে সালেম তা তুলে ধরেন। কেউ কেউ তাঁর পতাকা বহনে আপত্তি করে বলে, “আমরা তোমার দিক থেকে শত্রুবাহিনীর আক্রমণের আশঙ্কা করছি।” সালেম বলেন, “তাহলে তো আমি হয়ে যাব কুরআনের এক নিকৃষ্ট বাহক।”(হায়াতুস সাহাবা-১/৫৩৫)।
শত্রু বাহিনীকে আক্রমণের পূর্বে দুই দ্বীনি ভাই-আবু হুজাইফা ও সালেম পরস্পর বুক মেলালেন এবং দ্বীনে হকের পথে শহীদ হওয়ার জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ হলেন। তারপর উভয়ে শত্রুবাহিনীর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। আবু হুজাইফা একদিকে চিৎকার করে বলছেন, “ওহে কুরআনের ধারকরা, তোমরা তোমাদের আমল দ্বারা কুরআনকে সজ্জিত কর।” আর অন্যদিকে মুসাইলামা কাজ্জাবের বাহিনীর উপর তরবারির আঘাত হানছেন। আর একদিকে সালেম চিৎকার করে বলছেন, “আমি হব কুরআনের নিকৃষ্ট বাহক-যদি আমার দিক হতে শত্রুবাহিনীর আক্রমণ আসে।” মুখে তিনি একথা বলছেন আর দুহাতে তরবারী শত্রু সৈন্যের গর্দানে মারছেন।
এক ধর্মত্যাগীর অসির তীব্র আঘাত তাঁর ডান হাতে পড়লো। হাতটি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। তিনি বাম হাতে পতাকাটি উঁচু করে ধরেন। বাম হাতটিও শত্রুর আঘাতে কেটে পড়ে গেলে পতাকাটি গলার সাথে পেঁচিয়ে ধরেন। এ অবস্থায় তিনি উচ্চারণ করতে থাকেন কুরআনের এ আয়াত, “ওয়ামা মুহাম্মাদুন ইল্লা রাসূল, ওয়াকা আইয়্যিন মিন নাবিয়্যিন কা-তালা মা’য়াহু রিব্বিয়ূনা কাসীর।”….“মুহাম্মাদুর আল্লাহর এক রাসূল ছাড়া আর কিছু নন। অতীতে কত নবীর সহযোগী হয়ে কত আল্লাহওয়ালা ব্যক্তিই না যুদ্ধ করেছে। আল্লাহর পথে তাদের উপর যে বিপদ মুসীবত আপতিত হয়েছে, তাতে তাঁরা দুর্বল হয়ে পড়েনি এবং থেমেও যায়নি। আল্লাহ ধৈর্য্যশীলদের ভালবাসেন।” এই ছিল তাঁর মৃত্যুর পূর্বমুহুর্তের শ্লোগান।
কিছুক্ষণের মধ্যেই মুরতাদদের একটি দল সালেমকে ঘিরে ফেলে। মহাবীর সালেম লুটিয়ে পড়েন। তখনও তাঁর দেহে জীবনের স্পন্দন অবশিষ্ট ছিল। মুসাইলামা কাজ্জাবের নিহত হওয়ার সাথে মুসলমানদের বিজয় ও মুরতাদদের পরাজয়ের মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। মুসলমানরা আহত নিহতদের খোঁজ করতে লাগলো। সালেমকে তাঁরা জীবনের শেষ অবস্থায় খুঁজে পেল। এ অবস্থায় সালেম তাঁদের জিজ্ঞেস করেন- আবু হুজাইফার অবস্থা কি?
-সে শাহাদাত বরণ করেছে।
-যে ব্যক্তি আমার দিক হতে শত্রু বাহিনীর আক্রমণের আশঙ্কা করেছিল তাঁর অবস্থা কি?
-শহীদ হয়েছে।
-আমাকে তাঁদের মাঝখানেই শুইয়ে দাও।
-তাঁরা দুজন তোমার দুপাশেই শহীদ হয়েছে।
হযরত সালেম শেষবারের মত শুধু একটু মুচকি হাসি দিয়েছিলেন। আর কোনো কথা বলেন নি। সালেম এবং আবু হুজাইফা উভয়ে যা আন্তরিকভাবে কামনা করেছিলেন, লাভ করেন। তাঁরা একসাথে ইসলাম গ্রহণ করেন, একসাথে জীবন যাপন করেন এবং একসাথে একস্থানে শাহাদাত বরণ করেন।
হযরত সালেমের কাহিনী বিলাল ও অন্যান্য অসংখ্য অসহায় দাসদের কাহিনীর মতই। ইসলাম তাঁদের সকলের কাঁধ হতে দাসত্বের জোয়াল ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তাঁদেরকে সত্য ও কল্যাণময় সমাজে ইমাম, নেতা ও পরিচালকের আসনে বসিয়ে দেয়। তাঁর মধ্যে মহান ইসলামের যাবতীয় গুণের সমাবেশ ঘটেছিল। তাঁর সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল যে, তিনি যা সত্য বলে জানতেন অকপটে তা প্রকাশ করে দিতেন, তা বলা হতে কক্ষনো বিরত থাকতেন না। তাঁর মুমিন বন্ধুরা তাঁর নাম রেখেছিল-‘সালেম মিনাস সালেহীন’-সত্যনিষ্ঠদের দলভুক্ত সালেম।
হযরত উমার ইবনুল খাত্তাব(রা) সালেমের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। মৃত্যুর পূর্বে খলিফা নির্বাচনের ব্যাপারে বলেছিলেন, “আজ সালেম জীবিত থাকলে শুরার পরামর্শ ছাড়াই আমি তাঁকে খিলাফতের দায়িত্ব দিতাম।”(উসুদুল গাবা-২/২৪৬)।
হযরত সালেম ছিলেন নিঃসন্তান। তাই মৃত্যুর পর তাঁর পরিত্যক্ত সম্পত্তির ব্যাপারে ওসীয়ত করে যান। এক তৃতীয়াংশ দাসমুক্তি ও অন্যান্য ইসলামী কাজের জন্য এবং এক তৃতীয়াংশ পূর্বতন মনিব হযরত সুবাইতার অনুকূলে। হযরত আবু বাকর(রা) অসীয়ত মত এক তৃতীয়াংশ সুবাইতার কাছে পাঠালে তিনি এই বলে তা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান যে, আমি তো তাঁকে নিঃশর্ত মুক্তি দিয়েছি, বিনিময়ে কোনো কিছু আশা করিনি। পরে খলীফা উমার(রা) তা বায়তুল মালে জমা দেন।(আল ইসতিয়াব, উসুদুল গাবা-২/২৪৭)।
হযরত সালেম থেকে রাসূলুল্লাহর(সা) হাদীস বর্ণিত হয়েছে। আবার অনেক সাহাবী তাঁর নিকট হতে হাদীস বর্ণনা করেছেন।