কুরাইশদের মাঝে যখন এ কথাটি ছড়িয়ে পড়লো যে, মুহাম্মাদ সা. মক্কায় নেই তখন একদিকে যেমন কুরাইশ নেতৃবৃন্দ খবরটি বিশ্বাসই করত পারছিলনা, অন্য দিকে মক্কায় একটি ভীতির ভাবও ছড়িয়ে পড়ে। সাথে সাথে তারা বনু হাশিমের প্রতিটি বাড়ীতে তল্লাশী শুরু করে দেয়। মুহাম্মাদের সা. ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের বাড়ী-ঘর তল্লশী করতে করতে তারা আবু বকরের বাড়ীতে উপস্থিত হয়। তাদের সাড়া পেয়ে আবু বকরের মেয়ে আসমা বেরিয়ে আসেন। কুরাইশ নেতা আবু জাহল তাঁকে জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমার আব্বা কোথায়?’ তিনি উত্তর দিলেন, ‘তিনি এখন কোথায় তাতো আমি জানিনা।’
নরাধম আবু জাহল আসমার গালে সজোরে এক থাপ্পড় বসিয়ে দিলে তাঁর কানের দুলটি ছিট্কে পড়ে এবং তিনিও মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।
কুরাইশদের যখন স্থির বিশ্বাস হলো যে, মুহাম্মাদ সা. সত্যি সত্যি মক্কা থেকে চলে গেছেন, তখন তাদের অস্থিরতা আরও বেড়ে যায়। তারা একদল পদচিহ্ন বিশারদকে পদচিহ্ন অনুসরণ করে তাঁদের খুঁজে বের করার জন্য লাগিয়ে দেয়। পদচিহ্ন বিশারদরা ‘সাওর’ পর্বতের গুহার কাছে এসে কুরাইশদের বললেো আল্লাহর কসম, তোমাদের সাথী মুহাম্মাদ সা. এ গুহা ছেড়ে এখনও কোথাও যায়নি।’ আসলে তাদের এ অনুমান সঠিক ছিল। মুহাম্মাদ সা. ও তাঁর সাথী আবু বকর তখনও সেই গুহার মধ্যে। আর কুরাইশরা তাঁদের মাথার ওপরে। এমন কি হযরত আবু বকর সিদ্দিক রা. গুহার ওপরের দিকে তাদের মাথার ওপর বিচরণকারী কুরাইশদের পা-ও দেখতে পাচ্ছিলেন। তাঁর চোখ দু’টি পানিতে ঝাপসা হয়ে গেল। ভালোবাসা, দরদ ও ভর্ৎসনা মিশ্রিত দৃষ্টিতে রাসূলুল্লাহ সা. তাঁর দিকে তাকালেন। ফিস ফিস করে আবু বকর বললেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ, আল্লাহর কসম, আমার নিজের জানের ভয়ে নয়, আপনার প্রতি তাদের কোন দুর্ব্যবহার আমাকে দেখতে হয়, এ ভয়ে আমি কাঁদছি”। তাঁকে আশ্বস্ত করে রাসূল সা. বললেন, ‘আবু বকর, দুশ্চিন্তা করোনা, আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন।’
আল্লাহ তায়ালা আবু বকরের অন্তরে প্রশান্তি দান করলেন। তবে তিনি বার বার মাথার ওপর চলাচলরত কুরাইশদের পায়ের দিকে তাকাতে লাগলেন। এক সময় তিনি রাসূলকে সা. বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ, তাদের কেউ তার দু’পায়ের পাতার দিতে তাকালেই আমাদের দেখে ফেলবে।’ জবাবে রাসূল সা. বললেন, ‘তুমি কি মনে করেছো আমরা মাত্র দু’জন? তৃতীয় একজন, আল্লাহও আমাদের সাথে আছেন।’
সেই মুহূর্তে তাঁরা দু’জন কুরাইশদের এক যুবককে বলতে শুনলেন, ‘তোমরা সবাই গুহার দিকে এসো, আমরা একটু ভেতরটা দেখবো।’ উমাইয়্যা ইবন খালফ তাকে একটু বিদ্রুপ করে বললো, ‘গুহার মুখে এই মাকড়সা ও তার বাসা দেখতে পাওনা? এগুলি মুহাম্মাদের জন্মেরও আগে থেকে এখানে আছে।’ তবে আবু জাহল বললো, লাত ও উজ্জার শপথ, আমার মনে হচ্ছে তারা আমাদের ধারে কাছে কোথাও আছে। আমাদের কথা তারা শুনছে এবং আমাদের কার্যকলাপও তারা দেখছে। কিন্তু তার ইন্দ্রজালেও আমাদের দৃষ্টিশক্তি আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। তাই আমরা তাদের দেখতে পাচ্ছি না।’
যা হোক, কুরাইশরা মুহাম্মাদকে সা. খুঁজে বের করার ব্যাপারে একেবারে হাত গুটিয়ে নিলনা এবং তাঁর পিছু ধারওয়া করার সিদ্ধান্তেও তাদের কোন নড়চড় হলো না। মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী স্থানে বসবাসরত গোত্রগুলিতে তারা ঘোষণা করে দিল, কোন ব্যক্তি মুহাম্মাদকে জীবিত বা মৃত যে কোন অবস্থায় ধরে দিতে পারলে তাকে একশ’টি উন্নত জাতের উট পুরস্কার দেয়া হবে।
সুরাকা ইবন মালিক আল-মাদলাজী তখন মক্কার অনতিদূরে ‘কুদাইদ’ নামক স্থানে তার গোত্রের একটি আড্ডায় অবস্থান করছিল। এমন সময় কুরাইশদের একজন দূত সেখানে উপস্থিত হয়ে মুহাম্মাদকে সা. জীবিত বা মৃত অবস্থায় ধরে দেয়ার ব্যাপারে কুরাইশদের ঘোষিত পুরস্কারের কথা প্রচার করলো।
একশ’ উটের কথঅ শুনে সুরাকার মধ্যে লালসার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো। কিন্তু অন্যের মধ্যেও এ লালসা সঞ্চার হতে পারে এ ভয়ে সে কোন কথা না বলে নিজেকে সামলে নিল।
সুরাকা আড্ডা থেকে ওঠার আগেই সেখানে তার গোত্রের অন্য একটি লোক এসে বললো, ‘আল্লাহর শপথ, আমার পাশ দিয়ে এখনও তিন জন লোক চলে গেল, আমার ধারণা তারা মুহাম্মাদ, আবু বকর ও তাদের গাইডই হবে।’
সুরাকা বললো, ‘না, তা না। তারা হচ্ছে অমুক গোত্রের লোক। তাদের উট হারিয়ে গেছে তাই তারা তালাশ করছে।’ ‘তা হতে পারে’- এ কথা বলে লোকটি চুপ করে গেল।
আড্ডা থেকে সংগে সংগে উঠে গেলে অন্যদের মনে সন্দেহ হতে পারে, এ কারণে সে আরও কিছুক্ষণ সেখানে বসে থাকলো। আড্ডায় উপস্থিত লোকেরা অন্য প্রসঙ্গে আলোচনায় লিপ্ত হলে এক সুযোগে সে চুপে চুপে বেরিয়ে গেল। আড্ডা থেকে বেরিয়েই সে বাড়ীর দিকে গেলো। বাড়ীতে পৌঁছেই দাসীকে বললো, ‘তুমি চুপে চুপে মানুষে না দেখে এমনভাবে আমার ঘোড়াটি অমুক উপত্যকায় বেঁধে রাখবে।’ আর দাসকে বললেো ‘তুমি এ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বাড়ীর পিছন দিক থেকে এমনভঅবে বেরিয়ে যাবে যেন কেউ না দেখে এবং ঘোড়ার আশে পাশে কোন একস্থানে রেখে দেবে।’
সুরাকা বর্ম পরে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হলো এবং মুহাম্মাদকে পাকড়াও করার জন্য দ্রুত ঘোড়া হাঁকালো, যাতে মুহাম্মাদকে সা. ধরে দিয়ে অন্য কেউ এ পুরস্কার ছিনিয়ে নিতে না পারে। সে ছিল তার গোত্রের দক্ষ ঘোড় সওয়ারদের অন্যতম। সে ছিল দীর্ঘদেহী, বিশাল বপুধারী, পদচিহ্ন বিশারদ ও বিপদে দারুণ ধৈর্যশীল। সর্বোপরি সে ছিল একজন বুদ্ধিমান কবি। তার ঘোড়াটি ছিল উন্নত জাতের।
সুরাকা সামনে এগিয়ে চললো। কিছুদূর যাওয়ার পর ঘোড়াটি হোঁচট খেলো এবং সে পিঠ থেকে দূরে ছিট্কে পড়লো। এটাকে সে অশুভ লক্ষণ মনে করে বলে উঠলো, ‘একি? ওরে ঘোড়া, তুই নিপাত যা।’ এই বলে সে আবার ঘোড়ার পিঠে উঠলো। কিছু দূর যেতে না যেতেই ঘোড়াটি আবার হোঁচট খেলো। এবার তার অশুভ লক্ষণের ধারণা আরও বেড়ে গেল। সে ফিরে যাওয়ার চিন্তা করলো; কিন্তু এক শ’ উটের লোভ তাকে এ চিন্তা থেকে বিরত রাখলো।
দ্বিতীয়বার ঘোড়াটি যেখানে হোঁচট খেয়েছিল সেখান থেকে সামান্য দূরে সে দেখতে পেল মুহাম্মাদ সা. তাঁর দু’সঙ্গীকে, সংগে সংগে সে তার হাত ধনুকের দিকে বাড়ালো; কিন্তু সে হাতটি যেন একেবারে অসাড় হয়ে গেল। সে দেখতে পেল তার ঘোড়ার পা যেন শুকনো মাটিতে দেবে যাচ্ছে এবং সামনে থেকে প্রচণ্ড ধোঁয়া উঠে ঘোড়া ও তার চোখ আচ্ছন্ন করে ফেলছে। সে দ্রুত ঘোড়াটি হাঁকানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু ঘোড়াটি এমন স্থির হয়ে গেল, যেন তার পা লোহার পেরেক দিয়ে মাটিতে গেঁথে দেয়া হয়েছে।
অতঃপর সুরাকা রাসূল সা. ও তাঁর সঙ্গীদ্বয়ের দিকে ফিরে অত্যন্ত বিনীত কণ্ঠে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বললো, ‘ওহে’ তোমরা তোমাদের প্রভুর দরবারে আমার ঘোড়ার পা মুক্ত হওয়ার জন্য দুআ করো। আমি তোমাদের কোন অকল্যাণ করবো না।’ রাসূল সা. দুআ করলেন। তার ঘোড়া মুক্ত হয়ে গেল। সংগে সংগে তার লালসাও আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। সে তার ঘোড়াটি আবার রাসূলের সা. দিকে হাঁকালো। এবার পূর্বের চেয়েও মারাত্মকভাবে তার ঘোড়ার পা মাটিতে আটকে গেল। এবারও সে রাসূলের সা. সাহায্য কামনা করে বললেো ‘আমার এ খাদ্য সামগ্রী, আসবাবপত্র ও অস্ত্রশস্ত্র তোমরা নিয়ে নাও। আমি আল্লাহর নামে অঙ্গীকার করছি, মুক্তি পেলে আমি আমার পেছনে ধাবমান লোকদের তোমাদের থেকে অন্য দিকে হটিয়ে দেব।’
তাঁরা বললেন, ‘তোমার খাদ্য সামগ্রী ও আসবাবপত্রের প্রয়োজন আমাদের নেই। তবে তুমি লোকদের আমাদের থেকে দূরে হটিয়ে দেবে।’ অতঃপর রাসূল সা. তার জন্য দুআ করলেন। তার ঘোড়াটি মুক্ত হয়ে গেল। সে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে রাসূল সা. ও তাঁর সঙ্গীদ্বয়কে ডেকে বললো, ‘তোমরা একটু থাম, তোমাদের সাথে আমি কিছু কথা বলতে চাই। আল্লাহর কসম, তোমাদের কোন অকল্যাণ আমি করবো না।’
রাসূল সা. ও আবু বকর উভয়ে বলে উঠলেন, ‘তুমি আমাদের কাছে কী চাও?’ সে বললো, ‘আল্লাহ কসম, হে মুহাম্মাদ, আমি নিশ্চিতভাবে জানি শিগগিরই তোমার দ্বীন বিজয়ী হবে। আমার সাথে তুমি ওয়াদা কর, আমি যখন তোমার সাম্রাজ্যে যাব, তুমি আমাকে সম্মান দেবে। আর এ কথাটি একটু লিখে দাও।’
রাসূল সা. আবু বকরকে লিখতে বললেন। তিনি একখন্ড হাড়ের ওপর কথাগুলি লিখে তার হাতে দিলেন সুরাকা ফিরে যাবার উপক্রম করছে, এমন সময় রাসূল সা. তাকে বললেন, ‘সুরাকা, তুমি যখন কিসরার রাজকীয় পোশাক পরবে তখন কেমনে হবে?’
বিস্ময়ের সাথে সুরাকা বললো, ‘কিসরা ইবন হুরমুয?’ রাসূল সা. বললেন, হ্যাঁ, কিসরা ইবন হুরমুয।’
সুরাকা পেছন ফিরে চলে গেল। ফেরার পথে সে দেখতে পেল লোকেরা তখনও রাসূলকে সা. সন্ধান করে ফিরছে। সে তাদেরকে বললো, ‘তোমরা ফিরে যাও।’ আমি এ অঞ্চলে বহুদূর পর্যন্ত তাকে খুঁজেছি। আর তোমরা তো জান পদ-চিহ্ন অনুসরণের ক্ষেত্রে আমার যোগ্যতা কতখানি। তার এ কথায় লোকেরা ফিরে গেল।
মুহাম্মাদ সা. ও তাঁর সঙ্গীদ্বয়ের খবর সে সম্পূর্ণরূপে চেপে গেল। যখন তার স্থির বিশ্বাস হলো এত দিনে তাঁরা মদীনায় পৌছে কুরাইশদের শত্রুতা থেকে নিরাপত্তা লাভ করেছেন, তখন সে তার ঘটনাটি প্রচার করলো। রাসূলুল্লাহর সা. সঙ্গে সুরাকার ভূমিকা ও আচরণের খবর যখন আবু জাহলের কানে গেল সে তার ভীরুতা ও সুযোগের সদ্ব্যবহার না করার জন্য ভীষণ তিরস্কার করলো। উত্তরে সে তার স্বরচিত দু’টি শ্লোক আবৃত্তি করলোঃ
‘আল্লাহর শপথ, তুমি যদি দেখতে আবু হিকাম,
আমার ঘোড়ার ব্যাপারটি, যখন তার পা ডুবে যাচ্ছিল, তুমি জানতে
এবং তোমার কোন সংশয় থাকতো না, মুহাম্মাদ প্রকৃত রাসূল-
সুতরাং কে তাঁকে প্রতিরোধ করে?’
ইবন হাজার ‘আল ইসাবা’ গ্রন্থে শ্লোক দু’টি উল্লেখ করেছেনর।
সময় দ্রুত বয়ে চললো। একদিন যে মুহাম্মাদ সা. মক্কা থেকে রাতের অন্ধকারে গোপনে সরে গিয়েছিলেন, আবার তিনি বিজয়ীর বেশে হাজার হাজার সশস্ত্র সঙ্গীসহ প্রবেশ করলেন সেই মক্কা নগরীতে। অত্যাচারী ও অহংকারী কুরাইশ নেতৃবৃন্দ, যাদের দৌরাত্মে সর্বদা প্রকম্পিত থাকতো মক্কা, ভীত-বিহ্বল চিত্তে হাজির হলো মুহাম্মাদের সা. নিকট করুণা ভিক্ষার জন্য।
মহানুভব নবী সা. তাদের বললেন, ‘যাও তোমরা সবাই মুক্ত স্বাধীন।’
সুরাকা ইবনমালিক চললো রাসূলুল্লাহর সা. কাছে তার ইসলামের ঘোষনা দানের জন্য। সে সঙ্গে নিল দশ বছর পূর্বে প্রদত্ত রাসূলুল্লাহর সা সেই অঙ্গীকার পত্রটি। পরবর্তীকালে সুরাকা বর্ণনা করেছেনঃ
‘আমি জি’রারা (মক্কার নিকটবর্তী একটি স্থান) থেকে রাসূলুল্লাহর সা. নিকট আসলাম। আনসারদের একদল সৈনিকের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়লে তারা আমাকে তীরের বাট দিয়ে পিটাতে শুরু করে এবং বলতে থাকে, ‘দূর হও, দূর হও, কি চাও?’ তবুও আমি তাদের সারির মধ্যে ঢুকে পড়লাম এবং রাসূলুল্লাহর সা. কাছাকছি গেলাম। তিনি তখন তার উটনীর ওপর সওয়ার। আমি সেই অঙ্গীকার পত্রটিসহ হাত উঁচু করে বললাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ, আমি সুরাকা ইবন মালিক। আর এই হলো আপনার অঙ্গীকার পত্র।’
রাসূল সা. বললেন, ‘সুরাকা, আমার কাছে এসো, আজ প্রতিশ্রুতি পালন ও সদ্ব্যবহারের দিন।’
আমি রাসূলুল্লাহর সা. কাছাকছি গিয়ে তাঁর সামনে ইসলামের ঘোষনা দিলাম। এভাবে আমি তাঁর কল্যাণ ও বরকত লাভে ধন্য হলাম।’
রাসূলুল্লাহর সা. ওফাতে হযরত সুরাকা রা. ব্যথিত ও শোকাভিভূত হন। একশটি উটের লোভে যেদিন রাসূলুল্লাহকে সা. হত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সে দিনটির কথা ঘুরে ফিরে তাঁর স্মৃতিতে ভেসে উঠতে থাকে। এখন পৃথিবীর সকল উটও রাসূলুল্লাহর সা. একটি নখাগ্রেরও সমান নয়। তিনি রাসূলুল্লাহর সা. সেই প্রশ্নটি বার বার আওড়াতেন, ‘সুরাকা, যেদিন তুমি কিসরার পোশাক পরবে, কেমন হবে?’ কিসরার পোশাক যে সত্যি তিনি পরবেন সে ব্যাপারে তাঁর বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিলনা।
সময় বয়ে চললো। ইসলামী খিলাফাতের দায়িত্ব হযরত উমার ফারুকের রা. হাতে ন্যস্ত হলো। তাঁর গৌরবমসয় যুগে মুসলিম সেনাবাহিনী ঝড়ের গতিতে পারস্য সাম্রাজ্যে প্রবেশ করলো। তাঁর পারস্যের দুর্গসমূহ তছনছ করে দিয়ে তাদের বাহিনীকে পরাজিত করে পারস্য-সিংহাসন দখল করলো।
হযরত উমারের রা. খিলাফাতকালের শেষ দিকে পারস্য জয়ের সুসংবাদ নিয়ে সেনাপতি সা’দ বিন আবী ওয়াক্কাসের দূত পৌঁছলেন মদীনায়। তিনি সংগে নিয়ে এলেন পারস্যের গনীমাতের এক পঞ্চমাংশ। গনীমাতের ধন-দৌলত উমারের সামনে স্তূপীকৃত করা হলে তিনি বিস্ময়ের সাথে সেদিকে তাকিয়ে থাকলেন। তার মধ্যে ছিল কিসরার মণি-মুক্তা খচিত মুকুট, সোনার জরি দেয়া কাপড়, মুক্তার হার এবং তার এমন চমৎকার দু’টি জামা যা ইতিপূর্বে আর কখনও হযরত উমার দেখেননি। তাছাড়া আর ছিল বহু অমূল্য জিনিস। হযরত উমার হাতের লাঠিটি দিয়ে এই মূল্যবান ধন-রত্ন উল্টাতে লাগলেন। তারপর চারপাশে উপস্থিত লোকদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘যারা এসব জিনিস থেকে হাত গুটিয়ে নিয়ে জমা দিয়েছে, নিশ্চয় তারা অত্যন্ত বিশ্বাসভঅজন।
হযরত আলী রা., তিনি তখন সেখানেই উপস্থিত ছিলেন, বলেন, আমীরুল মু’মিনীন, আপনি বিশ্বাস ভঙ্গ করেননি, আপনার প্রজারাও ভঙ্গ করেনি। আপনি যদি অন্যায়ভাবে খেতেন, তাহলে তারা খেত।
অতঃপর হযরত উমার রা. সুরাকা ইবন মালিককে ডেকে নিজ হাতে তাঁকে কিসরার জামা, পাজামা, জুতো ও অন্যান্য পোশাক পরালেন। তাঁর কাঁধে ঝুলালেন কিসরার তরবারি, কোমরে বাঁধলেন বেল্ট, মাথায় রাখলেন মুকুট এবং তাঁর হাতে পরালেন বালা। কতই না চমৎকার!
হযরত উমার রা. সুরাকাকে পরাচ্ছেন কিসরার পোশাক, আর এ দিকে মুসলমানদের মুহূর্মুহু তাকবীর ধ্বনিতে মদীনার আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে উঠছে।
কিসরার পোশক পরা শেষ হলে সুরাকার দিকে ফিরে হযরত উমার রা. বললেন, ‘সাবাশ, সাবাশ, মুদলাজ গোত্রের ক্ষুদে এক বেদুঈনের মাথায় শোবা পাচ্ছে শাহানশাহ কিসরার মুকুট এবং হাত বালা।’ তারপর তিন আসমানের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘হে আল্লাহ, এ সম্পদ তুমি রাসূলুল্লাহকে সা. দাওনি, অথচ তিনি ছিলেন তোমার কাছে আমার থেকে অধিক প্রিয় সম্মানিত। তুমি দাওনি এ সম্পদ আবু বকরকেও। তিনিও ছিলেন তোমার নিকট আমার থেকেও অধিকতর প্রিয় মর্যাদাবান। আর তা দান করেছো আমাকে পরীক্ষার জন্য। আমি তোমার কাছে আশ্রয় চাই।’ অতঃপর তিনি সূরা মুমিনূনের নিম্নোক্ত আয়াত দু’টি পাঠ করলেন, ‘তারা কি মনে করে, আমি তাদেরকে সাহায্য স্বরূপ যে ধনৈশ্বর্য ও সন্তান-সন্ততি দান করি তা দ্বারা তাদের সকল প্রকার মঙ্গল ত্বরান্বিত করছি? না, তারা বুঝে না।’ (সূরা মু’মিনূনঃ ৫৫-৫৬)
সকল সম্পদ মুসলমানদের মধ্যে বণ্টন না করা পর্যন্ত তিনি সে মজলিস ত্যাগ করলেন না।
হযরত সুরাকা ইবন মালিকের এ কাহিনী ইমাম বুখারী বর্ণনা করেছেন। ইমাম আহমদও আল-বারা ইবন আযিব ও আবু বকর সিদ্দীকের সূত্রে বর্ণনা করেছেন।
আবু আমর বলেন, সুরাকা ইবন মালিক খলীফা ’উসমানের খিলাফতকালে ২৪ হিজরীতে ইনতিকাল করেন। কেউ কেউ বলেছেন, হযরত উসমানের পরে তিনি ইনতিকাল করেন।