নাম যুবাইর, কুনিয়াত আবু আবদিল্লাহ এবং ‘হাওয়ারিয়্যূ রাসূলিল্লাহ’ লকব। পিতার নাম ‘আওয়াম’ এবং মাতা ‘সাফিয়্যা বিনতু আবদিল মুত্তালিব।’ মা হযরত সাফিয়্যা ছিলেন রাসূলুল্লাহর সা. ফুফু। সুতরাং যুবাইর ছিলেন রাসূলুল্লাহর সা. ফুফাতো ভাই। উম্মুল মুমিনীন হযরত খাদিজাতুল কুবরা ছিলেন তাঁর ফুফু। অন্যদিকে হযরত সিদ্দিকে আকবরের কন্যা হযরত আসমাকে বিয়ে করায় রাসূলুল্লাহ সা. ছিলেন তাঁর ভায়রা। হযরত আসমা রা. ছিলেন উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশার রা. বোন। এভাবে রাসূলুল্লাহর সা. সংগে ছিল তাঁর একাধিক আত্মীয়তার সম্পর্ক।
হযরত যুবাইর রা. হিজরাতের আটাশ বছর পূর্বে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর শৈশবকালীন জীবন সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। তবে এটা নিশ্চিত যে প্রথম থেকেই তাঁর মা তাঁকে এমনভাবে প্রতিপালন করেছিলেন, যাতে বড় হয়ে তিনি একজন দুঃসাহসী, দৃঢ়-সংকল্প ও আত্মপ্রত্যয়ী মানুষ হন। এ কারণে প্রায়ই মা তাঁকে মারধোর করতেন এবং কঠোর অভ্যাসে অভ্যস্ত করতেন। একদিন তাঁর চাচা নাওফিল বিন খুওয়াইলিদ তাঁর মা হযরত সাফিয়্যার ওপর ভীষণভাবে ক্ষেপে গিয়ে বলেন, ‘এভাবে মারতে মারতে ছেলেটাকে তুমি মেরেই ফেলবে।’ তাছাড়া বনু হাশিমের লোকদের ডেকে বলেন, ‘তোমরা সাফিয়্যাকে বুঝাওনা কেন?’ জবাবে সাফিয়্যা বলেন, ‘যারা বলে আমি তাকে দেখতে পারিনা, তারা মিথ্যা বলে। আমি তাকে এজন্য মারধোর করি যাতে সে বুদ্ধিমান হয় এবং পরবর্তী জীবনে শত্রুসৈন্য পরাজিত করে গণিমাতের মাল লাভে সক্ষম হয়।
এমন প্রতিপালনের প্রভাব অবশ্যই তাঁর ওপর পড়েছিলো। অল্প বয়স থেকেই তিনি বড় বড় পাহলোয়ান ও শক্তিশালী লোকেদের সাথে কুস্তি লড়তেন। একবার মক্কায় একজন তাগড়া জোয়ানের সাথে তাঁর ধরাধরি হয়ে গেল। তাকে এমন মারই না মারলেন যে, লোকটির হাত ভেঙ্গে গেল। লোকেরা তাঁকে ধরে হযরত সাফিয়্যার নিকট নিয়ে এসে অভিযোগ করলো। তিনি পুত্রের কাজে অনুতপ্ত হওয়া বা ক্ষমা প্রার্থনার পরিবর্তে সর্বপ্রথম তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা যুবাইরকে কেমন দেখলে সাহসী না ভীরু?’
যুবাইর রা. মাত্র ষোল বছর বয়সেই ইসলাম গ্রহণ করেন। প্রথম পর্বে ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে তিনি ছিলেন অনন্য ও বিশেষ মর্যাদার অধিকারী।
যদিও তাঁর বয়স ছিল কম তবুও দৃঢ়তা ও জীবনকে বাজি রাখার ক্ষেত্রে কারো থেকে পিছিয়ে ছিলেন না। তাঁর ইসলাম গ্রহণের পর একবার কেউ রটিয়ে দিয়েছিলো, মুশরিকরা রাসূলুল্লাহকে সা. বন্দী অথবা হত্যা করে ফেলেছে। একথা শুনে তিনি আবেগ ও উত্তেজনায় এতই আত্মভোলা হয়ে পড়েছিলেন যে তক্ষুণি একটানে তরবারি কোষমুক্ত করে মানুষের ভিড় ঠেলে আল্লাহর রাসূলের সা. দরবারে গিয়ে হাজির হন। রাসূলুল্লাহ সা. তাঁকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হয়েছে যুবাইর?’ তিনি বললেন, ‘শুনেছিলাম, আপনি বন্দী অথবা নিহত হয়েছেন।’ রাসূলে কারীম সা. অত্যন্ত খুশী হয়ে তাঁর জন্যে দুআ করেন। সীরাত লেখকদের বর্ণনা, এটাই হচ্ছে প্রথম তলোয়ার যা আত্মোৎসর্গের উদ্দেশ্যে একজন বালক উন্মুক্ত করেছিলো।
প্রাথমিক পর্যায়ে মক্কার অন্যান্য মুসলমানদের মত তিনিও অত্যাচার ও নিপীড়নের শিকার হন। তাঁর চাচা তাঁকে ইসলাম থেকে ফিরানোর জন্যে চেষ্টার ত্রুটি করেননি। কিন্তু তাওহীদের ছাপ যার অন্তরে একবার লেগে যায় তা কি আর মুছে ফেলা যায়? ক্ষেপে গিয়ে চাচা আরো কঠোরতা শুরু করে দেন। উত্তপ্ত পাথরের উপর চিৎ করে শুইয়ে দিয়ে এমন মারই না মারতেন যে তাঁর প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে যেত। তবুও তিনি বলতেন, ‘যত কিছুই করুন না কনে আমি আবার কাফির হতে পারিনা।’ অবশেষে নিরুপায় হয়ে জন্মভূমি মক্কা ছেড়ে হাবশায় হিজরাত করেন। হাবশায় কিছুকাল অবস্থানের পর মক্কায় ফিরে এলেন। এদিকে রাসূল সা.ও মক্কা থেকে মদীনায় হিজরাত করলেন। তিনিও মদীনায় গেলেন।
রাসূল সা. মক্কায় তালহা ও যুবাইরের মধ্যে ইসলামী ভ্রাতৃ-সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু মদীনায় আসার পর নতুন করে হযরত সালামা ইবন সালামা আনসারীর সাথে তাঁর ভ্রাতৃসম্পর্ক স্থাপিত হয়। সালামা ছিলেন মদীনার এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিত্ব এবং আকাবায় বাইয়াত গ্রহণকারীদের অন্যতম।
যুদ্ধে অংশগ্রহণের ব্যাপারে তিনি ছিলেন অনন্য। তিনি বদর যুদ্ধে অত্যন্ত সাহস ও নিপুণতার পরিচয় দেন। মুশরিকদের প্রতিরোধ ব্যুহ ভেঙ্গে তছনছ করে দেন। একজন মুশরিক সৈনিক একটি টিলার ওপর উঠে। দ্বন্দ্বযুদ্ধের আহ্বান জানালে যুবাইর তাকে মুহূর্তের মধ্যে এমনভাবে জাপ্টে ধরেন যে, দু’জনেই গড়িয়ে নীচের দিকে আসতে থাকেন। তা দেখে রাসূল সা. বলেন, ‘এদের মধ্যে যে প্রথম ভূমিতে পড়বে, সে নিহত হবে।’ সত্যি তাই হয়েছিলো। মুশরিকটি প্রথম মাটিতে পড়ে এবং যুবাইর রা. তরবারির এক আঘাতে তাকে হত্যা করেন। এমনিভাবে তিনি ’উবাইদা ইবন সাঈদের মুখোমুখি হলেন। সে ছিল আপাদ-মস্তক এমনভাবে বর্মাচ্ছাদিত যে কেবল দু’টি চোখই তার দেখা যাচ্ছিলো। তিনি খুব তাক করে তার চোখ লক্ষ্য করে তীর ছুড়লেন। নিশানা নির্ভুল হলো। তীরের ফলা এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে গেল। অতি কষ্টে তিনি তার লাশের উপর বসে ফলাটি বের করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তবে তা কিছুটা বেঁকে গিয়েছিলো। স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে রাসূল সা. এ তীরটি নিজেই নিয়ে নেন এবং তাঁর ইনতিকালের পর তৃতীয় খলীফা হযরত উসমান পর্যন্ত এ তীরটি বিভিন্ন খলীফার নিকট রক্ষিত ছিল। হযরত উসমানের শাহাদাতের পর হযরত আবদুল্লাহ ইবন যুবাইর তীরটি গ্রহণ করেন এবং তাঁর শাহাদাত পর্যন্ত এটি তাঁর নিকট ছিল।
বদরে তিনি এত সাংঘাতিকভাবে লড়েছিলেন যে তাঁর তরবারি ভোঁতা হয়ে গিয়েছিলো এবং আঘাতে আঘাতে তাঁর সারা শরীর ক্ষত বিক্ষত হয়ে গিয়েছিলো। এ দিনের একটি ক্ষত এত গভীর ছিল যে চিরদিনের জন্য তা একটি গর্তের মত হয়ে গিয়েছিলো। তাঁর পুত্র হযরত উরওয়া, বলেন, ‘আমরা সেই গর্তে আংগুল ঢুকিয়ে খেলা করতাম।’ এ যুদ্ধে তিনি হলুদ রঙের পাগড়ী পরিহিত ছিলেন। তা দেখে রাসূল সা. বলেন, ‘আজ ফিরিশতাগণও এ বেশে এসেছে।’
উহুদের ময়দানে সত্য ও মিথ্যার লড়াই যখন চরম পর্যায়ে, তখন রাসূল সা. স্বীয় তরবারি কোষমুক্ত করে বললেন, ‘আজ কে এর হক আদায় করবে?’ সকল সাহাবীই অত্যন্ত আগ্রহের সাথে নিজ নিজ হাত বাড়ালেন। যুবাইর রা.ও তিনবার নিজের হাত বাড়ালেন; কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা লাভের গৌরব অর্জন করেন হযরত আবু দুজানা আনসারী রা.। উহুদের যুদ্ধে তীরন্দাজ সৈনিকদের অসতর্কতার ফলে যখন যুদ্ধের মোড় ঘুরে গেল এবং মুসলিমদের সুনিশ্চিত বিজয় পরাজয়ের রূপ নিল তখন যে চৌদ্দজন সাহাবী নিজেদের জীবনের বিনিময়ে রাসূলে পাককে কেন্দ্র করে প্রতিরোধ ব্যুহ রচনা করেন যুবাইর রা. ছিলেন তাঁদের অন্যতম।
খন্দকের যুদ্ধে মুসলিম নারীরা যেদিকে অবস্থান করছিলেন, সে দিকটির প্রতিরক্ষার দায়িত্বভার লাভ করেন যুবাইর রা.। এ যুদ্ধের সময় মদীনার ইয়াহুদী গোত্র বনু কুরাইজা মুসলিমদের সাথে সম্পাদিত মৈত্রী চুক্তি ভঙ্গ করে। রাসূল সা. তাদের অবস্থা জানার জন্যে কাউকে তাদের কাছে পাঠাতে চাইলেন। তিনবার তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমাদের মধ্যে এমন কে আছে, যে তাদের সংবাদ নিয়ে আসতে পার?’ প্রত্যেকবারই হযরত যুবাইর বলেন, ‘আমি’। রাসূল সা. তাঁর আগ্রহে সন্তুষ্ট হয়ে বলেন, ‘প্রত্যেক নবীরই থাকে হাওয়ারী। আমার হাওয়ারী যুবাইর।’
খন্দকের পর বনু কুরাইজার যুদ্ধ এবং বাইয়াতে রিদওয়ানেও তিনি অংশগ্রহণ করেন। খাইবারের যুদ্ধে তিনি অসীম সাহসিকতা ও বীরত্বের পরিচয় দেন। খাইবারের ইয়াহুদী নেতা মুরাহহিব নিহত হলে বিশাল দেহ ও বিপুল শক্তির অধিকারী তার ভাই ইয়াসির ময়দানে অবতীর্ণ হয়ে হুঙ্কার ছেড়ে দ্বন্দ্বযুদ্ধের আহ্বান জানায়। হযরত যুবাইর রা. লাফিয়ে পড়লেন। তখন তাঁর মা হযরত সাফিয়্যা বললেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ, নিশ্চয় আজ আমার কলিজার টুকরা শহীদ হবে।’ রাসূল সা. বললেন, ‘না। যুবাইরই তাকে হত্যা করবে।’ সত্যি সত্যি অল্পক্ষণের মধ্যে যুবাইর তাকে হত্যা করেন।
খাইবার বিজয়ের পর মক্কা বিজয়ের প্রস্তুতি চলছে। মানবীয় কিছু দুর্বলতার কারণে প্রখ্যাত সাহাবী হাতিব বিন আবী বালতাআ (রা) সব খবর জানিয়ে মক্কার কুরাইশদের নিকট একটি চিঠি লিখলেন। চিঠিসহ গোপনে একজন মহিলাকে তিনি মক্কায় পাঠান। এদিকে ওহীর মাধ্যমে সব খবর রাসূল সা. অবগত হলেন। তিনি চিঠিসহ মহিলাটিকে গ্রেফতারের জন্যে যে দলটি পাঠান, হযরত যুবাইরও ছিলেন সে দলের একজন। চিঠিসহ মহিলাকে গ্রেফতার করে মদীনায় নিয়ে আসা হলো। হাতিব বিন বালতায়া লজ্জিত হয়ে তওবাহ করেন। রাসূলও সা. তাঁকে ক্ষমা করেন।
মক্কা বিজয়ের দিন রাসুল সা. মুসলিম সেনাবাহিনীকে কয়েকটি দলে বিভক্ত করেন। সর্বশেষ ও ক্ষুদ্রতম দলটিতে ছিলেন রাসূল সা. নিজে। আর এ দলটির পতাকাবাহী ছিলেন যুবাইর রা.। রাসূল সা. মক্কায় প্রবেশ করলেন। চারদিকে শান্তি শৃঙ্খলা ফিরে এলে হযরত মিকদাদ ও হযরত যুবাইর রা. নিজ নিজ ঘোড়ার ওপর সওয়ার হয়ে রাসূলে পাকের নিকট উপস্থিত হলেন। রাসূল সা. উঠে দাঁড়িয়ে নিজ হাতে তাঁদের উভয়ের মুখমণ্ডলের ধুলোবালি ঝেড়ে দেন।
হুনাইন যুদ্ধের সময় হযরত যুবাইর কাফিরদের একটি গোপন ঘাঁটির নিকটে পৌঁছলে তারা তাঁকে অতর্কিত আক্রমণ করে। অত্যন্ত সাহসের সাথে অল্প সময়ের মধ্যে তিনি ঘাঁটিটি সাফ করে ফেলেন। তায়িফ ও তাবুকের যুদ্ধেও তিনি অংশগ্রহণ করে। দশম হিজরীতে বিদায় হজ্জেও তিনি রাসূলুল্লাহর সা. সফরসঙ্গী ছিলেন।
দ্বিতীয় খলীফা হযরত ’উমারের রা. খিলাফতকালে সিরিয়ার ইয়ারমুক প্রান্তরে বিশাল রোমান বাহিনীর সাথে মুসলিম বাহিনীর ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত য়। এটা ছিল সিরিয়ার ভাগ্য নির্ধারণী যুদ্ধ। হযরত যুবাইর এ যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধের এক চরম পর্যায়ে মুসলিম সৈনিকদের এক দল সিদ্ধান্ত নিল, হযরত যুবাইর রোমান বাহিনীর মধ্যভাগে প্রচণ্ড আক্রমণ চালাবেন এবং অন্যরা তাঁর সমর্থনে পাশে পাশে থাকবেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হযরত যুবাইর রা. ক্ষিপ্রতার সাথে প্রচণ্ডভাবে আক্রমণ চালিয়ে রোমান বাহিনীর ব্যুহ ভেদ করে অপর প্রান্তে চলে যান কিন্তু অন্যরা তাঁকে অনুসরণ করতে সক্ষম হলেন না। একাকী আবার রোমান বাহিনী ভেদ করে ফিরে আসার সময় প্রচণ্ডভাবে আক্রান্ত হয়ে ঘাড়ে দারুণভাবে আঘাত পান। হযরত ’উরওয়া বলেন, বদরের পর এটা ছিল দ্বিতীয় যখম যার মধ্যে আংগুল ঢুকিয়ে ছেলে বেলায় আমরা খেলতাম। তাঁর এ দুঃসাহসী আক্রমণের ফলে রোমান বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে।
হযরত আমর ইবনুল ’আস মিসরে আক্রমণ চালিয়ে ফুসতাতের কিল্লা অবরোধ করে রেখেছেন। আমীরুল মু’মিনীন হযরত ’উমার তাঁর সাহায্যে দশ হাজার সিপাহী ও চার হাজার অফিসার পাঠালেন। আর চিঠিতে লিখলেন, এসব অফিসারের এক একজন এক হাজার অশ্বারোহীর সমান। হযরত যুবাইর ছিলেন এ চার হাজার অফিসারের একজন। মুসলিম সৈন্যরা সাত মাস ধরে কিল্লা অবরোধ করে আছে। জয়-পরাজয়ের কোন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। বিরক্ত হয়ে হযরত যুবাইর একদিন বললেন, ‘আজ আমি মুসলিমদের জন্য আমার জীবন কুরবান করবো।’ এ কথা বলে উন্মুক্ত তরবারি হাতে সিঁড়ি লাগিয়ে কিল্লা প্রাচীরের মাথার ওপর উঠে পড়লেন। আরো কিছু সাহাবীও তাঁর সঙ্গী হলেন। প্রাচীরের ওপর থেকে অকস্মাৎ তাঁরা ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি দিতে শুরু করেন। এ দিকে নিচ থেকে সকল মুসলিম সৈনিক এক যোগে আল্লাহু আকবর ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত করে তোলেন। খৃস্টান সৈন্যরা মনে করলো, মুসলিমগণ কিল্লায় ঢুকে পড়েছে। তারা ভীত-বিহ্বল হয়ে পড়লো। এক পর্যায়ে অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সাথে হযরত যুবাইর কিল্লার অভ্যন্তরে প্রবেশ করে ফটক উন্মুক্ত করে দেন এবং সঙ্গে সঙ্গে মুসলিম বাহিনী অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। উপায়ন্তর না দেখে মিসরের শাসক মাকুকাস সন্ধির প্রস্তাব দেয় এবং তা গৃহীত হয়। সকলকে আমান দেওয়া হয়।
হিজরী ২৩ সনে দ্বিতীয় খলীফা হযরত ’উমার রা. এক অগ্নি উপাসকের ছুরিকাঘাতে মারাত্মকভাবে আহত হয়ে শাহাদাত বরণ করেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি ছয়জন প্রখ্যাত সাহাবীর সমন্বয়ে একটি বোর্ড গঠন করে তাদের ওপর পরবর্তী খলীফা নির্বাচনের দায়িত্ব অর্পণ করে যান। তিনি বলেন, ‘জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রাসূল সা. এদের প্রতি সন্তুষ্ট ছিলেন।’ হযরত যুবাইর ছিলেন এ বোর্ডের অন্যতম সদস্য।
তৃতীয় খলীফা হযরত ’উসমানের খিলাফতকালে হযরত যুবাইর রা. নিরিবিলি জীবন যাপন করছিলেন। কোন রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব গ্রহণ করেননি। আসলে বয়সও বেড়ে গিয়েছিলো। ৩৫ হিজরীতে বিদ্রোহীদের দ্বারা হযরত ’উসমান অবরুদ্ধ হলে তাঁর নিরাপত্তার জন্য হযরত যুবাইর স্বীয় পুত্র হযরত আবদুল্লাহকে নিয়োগ করেন। হযরত ’উসমান শহীদ হলে রাতের অন্ধকারে গোপনে তিনি তাঁর জানাযার নামায আদায় করে দাফন করেন।
হযরত আলীর রা. শাসনকালে তিনি এবং হযরত তালহা মক্কায় যেয়ে হযরত আয়িশার রা. সাথে মিলিত হন। সেখানে তাঁরা মুসলিম উম্মাহর তৎকালীন পরিস্থিতি নিয়ে গভীরভাবে আলোচনা করেন এবং মদীনায় না গিয়ে বসরার দিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। বিপুল সংখ্যক লোক তাঁদের সহযোগী হয়। এদিকে হযরত আলী রা. তাঁদেরকে প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে সেনাবাহিনীসহ অগ্রসর হন এবং হিজরী ৩৬ সনের ১০ই জমাদিউল উখরা বসরার অনতিদূরে ‘যীকার’ নামক স্থানে দুই মুসলিম বাহিনী মুখোমুখি হয। ইতিহাসে এটি উটের যুদ্ধ নামে পরিচিতি।
ইসলামী ইতিহাসের এ দুঃখজনক অধ্যায়ের বিশ্লেষণ আমাদের এ প্রবন্ধের মুখ্য বিষয় নয়। তবে একদিন যাঁরা ছিলেন ভাই ভাই, আজ তাঁরা একে অপরের খুনের পিপাসায় কাতর। ব্যাপারটি যাই হোক না কেন, এটা যে তাঁদের ব্যক্তিগত ঝগড়া ও আক্রোশের কারণে নয়, তা আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি। সত্য ও সততার আবেগ-উৎসাহ ও উদ্দীপনায় তাঁরা এমনটি করেছিলেন। এ কারণে আমরা দেখতে পাই, একই গোত্রের লোক তখন দু’দিকে বিভক্ত। তাছাড়া দু’পক্ষের নেতৃবৃন্দের মূল লক্ষ্যই ছিল একটা সমঝোতায় উপনীত হওয়া। আর এ কারণেই দু’পক্ষের মধ্যে দূত বিনিময়ের মাধ্যমে আলাপ-আলোচনা হয়েছিলো। আর একই কারণে আমরা দেখতে পাই, হযরত আলী একাকী ঘোড়ায় চড়ে রণাঙ্গণের মাঝখানে এসে হযরত যুবাইরকে ডেকে বলছেন, ‘আবু আবদুল্লাহ! তোমার কি সে দিনটির কথা মনে আছে, যে দিন আমরা দু’জন হাত ধরাধরি করে রাসূলুল্লাহর সা. সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম। রাসূল সা. তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেনঃ তুমি কি আলীকে মুহাব্বত কর? বলেছিলেঃ হ্যাঁ ইয়া রাসূলাল্লাহ! স্মরণ কর, তখন রাসূল সা. বলেছিলেনঃ ‘একদিন তুমি অন্যায়ভাবে তার সাথে লড়বে।’ হযরত যুবাইর জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ এখন আমার স্মরণ হচ্ছে।’
একটি মাত্র কথা। কথাটি বলে হযরত আলী রা. তাঁবুতে ফিরে গেলেন। এ দিকে যুবাইরের অন্তরে ঘটে গেল এক বিপ্লব। তাঁর সকল সংকল্প ও দৃঢ়তা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়িশার রা. কাছে এসে বললেনঃ আমি সম্পূর্ণ ভুলের ওপর ছিলাম। আলী আমাকে রাসূলুল্লাহর সা. একটি বাণী স্মরণ করে দিয়েছে। আয়িশা রা. জিজ্ঞেস করলেন, ‘তাহলে এখন ইচ্ছা কি?’ তিনি বললেনঃ ‘আমি এ ঝগড়া থেকে দূরে সরে যাচ্ছি।’ পুত্র পুত্র আবদুল্লাহ বললেন, ‘আব্বা আপনি আমাদেরকে গর্তে ফেলে আলীর ভয়ে এখন পালিয়ে যাচ্ছেন?’ তিনি বললেন, ‘আমি কসম করেছি, আলীর সাথে আর লড়বো না।’ আবদুল্লাহ বললেন, ‘কসমের কাফ্ফারা সম্ভব।’ এই বলে তিনি স্বীয় গোলাম মাকহুলকে ডেকে আযাদ করে দেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহর সা. হাওয়ারী যুবাইর বললেনঃ ‘বেটা, আলী আমাকে এমন কথা স্মরণ করে দিয়েছে যাতে আমার সকল উদ্যম-উৎসাহ স্তিমিত হয়ে পড়েছে। আমি সুনিশ্চিত যে, আমরা হকের ওপর নেই। এসো তুমিও আমার অনুগামী হও।’ হযরত আবদুল্লাহ অস্বীকার করলেন। হযরত যুবাইর একাকী বসরার দিকে রওয়ানা হলেন।
হযরত যুবাইরকে যেতে দেখে আহনাফ বিন কায়েস বললেনঃ ‘কেউ জেনে এসো তো তিনি যাচ্ছেন কেন?’ আমর ইবন জারমুয বললো, ‘আমি যাচ্ছি।’ এই বলে সে অস্ত্র-সজ্জিত হয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে হযরত যুবাইরের সঙ্গে মিলিত হলো। তখন তিনি বসরা ছেড়ে একটু দূরে গিয়ে পৌঁছেছেন। কাছে এসে ইবনে জারমুয বললেনঃ
– আবু আবদুল্লাহ। জাতিকে আপনি কি অবস্থায় ছেড়ে এলেন?
– তারা সবাই একে অপরের গলা কাটছে।
– এখন কোথায় যাচ্ছেন?
– আমার ভুল আমি বুঝতে পেরেছি। এ কারণে এ ঝগড়া থেকে দূরে থাকার জন্যে অন্য কোথাও যেতে চাই।
ইবন জারমুয বললোঃ ‘চলুন, আমাকেও এ দিকে কিছুদূর যেতে হবে।’ দু’জন এক সংগে চললেন। জুহরের নামাযের সময় হযরত যুবাইর থামলেন। ইবনে জারমুয বললো, ‘আমিও আপনার সাথে নামায আদায় করবো। দু’জন নামাযে দাঁড়ালেন। হযরত যুবাইর যেই তাঁর মা’বুদের উদ্দেশ্যে সিজদাবনত হয়েছে, বিশ্বাসগত ইবন জারমুয অমনি তরবারির এক আঘাতে রাসূলুল্লাহ সা. হাওয়ারীর দেহ থেকে তাঁর শির বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
ইবন জারমুয হযরত যুবাইরের তরবারি, বর্ম ইত্যাদিসহ হযরত আলীর রা. নিকট উপস্থিত হয়ে অত্যন্ত গর্বের সাথে তার কৃতিত্বের বর্ণনা দিল। আলী রা. তলোয়ার খানির প্রতি অনুশোচনার দৃষ্টিতে এক নজর তাকিয়ে বললেন, ‘তিনি অসংখ্যবার রাসূলুল্লাহর সা. সম্মুখ থেকে মুসিবতের মেঘমালা অপসারণ করেছেন। ওরে ইবন সাফিয়্যার হন্তা, শুনে রাখ, জাহান্নাম তোর জন্যে প্রতীক্ষা করছে।’ এভাবে হযরত যুবাইর রা. হিজরী ৩৬ সনে শাহাদাত বরণ করেন এবং ‘আস-সিবা’ উপত্যকায় সমাহিত হন। তিনি ৬৪ বছর জীবন লাভ করেছিলেন।
হযরত যুবাইর ছিলেন অত্যন্ত মহৎ চরিত্রের অধিকারী। তাকওয়া, সত্য-প্রীতি, দানশীলতা, উদারতা ও বেপরোয়াভাব ছিল তাঁর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। শিশুদের মত তাঁর অন্তর ছিল কোমল। সামান্য ব্যাপারেই তিনি মোমের মত বিগলিত হয়ে যেতেন। যখন এ আয়াতটি অবতীর্ণ হলোঃ
‘তুমি তো মরণশীল এবং তারাও মরণশীল। অতঃপর কিয়ামত দিবসে তোমরা পরস্পর তোমাদের প্রতিপালকের সম্মুখে বাক-বিতণ্ডা করবে।’ (যুমার/৩১) তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! কিয়ামতের দিন আমাদের এ ঝগড়ার কি পুনরাবৃত্তি হবে?’ রাসূল সা. বললেন, ‘হ্যাঁ। অণু-পরমাণুর হিসাব করে প্রত্যেক হকদারকে তার হক দেওয়া হবে।’ এ কথা শুনে তার অন্তর কেঁপে ওঠে। তিনি বলে উঠলেন, ‘আল্লাহু আকবর। কেমন কঠিন ব্যবস্থা হবে।’
একবার তাঁর দাস ইবরাহীমের দাদী উম্মু আতার কাছে গিয়ে তিনি দেখলেন, আইয়্যামে তাশরীকের পরেও তাদের নিকট কুরবানীর গোশত অবশিষ্ট রয়েছে। তিনি বলরেন, ‘উম্মু আতা! রাসূল সা. মুসলমানদেরকে তিনদিনের বেশী কুরবানীর গোশত খেতে নিষেধ করেছেন।’ উম্মু ’আতা বললেন, ‘আমি কি করবো। লোকেরা এত হাদীয়া পাঠায় যে তা শেষই হয়না।’ (মুসনাদে ইমাম আহমাদ ১/১৬৬)
হযরত যুবাইর যদিও রাসূলুল্লাহর সা. হাওয়ারী ও সার্বক্ষণিক সহচর ছিলেন, তবুও আল্লাহ-ভীতি ও সতর্কতার কারণে খুব কমই হাদীস বর্ণনা করতেন। একদিন পুত্র আবদুল্লাহ জিজ্ঞেস করলেন, ‘আব্বা, অন্যদের মত আপনি বেশী বেশী হাদীস বর্ণনা করেন না- এর কারণ কি?’ তিনি বললেন, ‘বেটা, অন্যদের থেকে রাসূলের সা. সাহচর্য ও বন্ধুত্ব আমার কোন অংশে কম ছিল না। যেদিন ইসলাম গ্রহণ করেছি, সেদিন থেকে রাসূলুল্লাহর সা. সাহচর্য হতে বিচ্ছিন্ন হইনি কিন্তু তাঁর এ সতর্কবাণীটি আমাকে দারুণভাবে সতর্ক করেছে- ‘যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত আমার পতি মিথ্যা আরোপ করবে, সে যেন জাহান্নামে তার আবাসস্থল নির্ধারণ করে নেয়।
ইসলামী সাম্যের প্রতি তিনি এতবেশী সতর্ক ছিলেন যে, দু’জন মুসলিম মৃতের মধ্যেও একজনকে সামান্য প্রাধান্য দান তিনি বৈধ মনে করেননি। উহুদের যুদ্ধে তাঁর মামা হযরত হামযা রা. শাহাদাত বরণ করেন। তাঁর মা হযরত সাফিয়্যা রা. ভাইয়ের কাফনের জন্যে দু’প্রস্থ কাপড় নিয়ে আসেন। কিন্তু মামার পাশেই একজন আনসারী ব্যক্তির লাশ ছিলো। একটি লাশের জন্যে দু’টি কাপড় হবে আর অন্যটি থাকবে কাফনহীন-ব্যাপারটি তিনি মেনে নিতে পারেননি। উভয়ের মধ্যে ভাগ করার জন্যে কাপড় দু’টিকে মাপলেন। ঘটনাক্রমে কাপড় দু’খানা ছিল ছোট-বড়। যাতে কারো প্রতি পক্ষপাতিত্ব না হয়, সে জন্য লটারীর মাধ্যমে বিষয়টির নিষ্পত্তি করেন।
হযরত যুবাইর যে কোন ধরণের বিপদ-আপদকে তুচ্ছ জ্ঞান করতেন। মৃত্যু-ভয় তাঁর দৃঢ় সংকল্পে কোনদিন বিন্দুমাত্র ফাটল ধরাতে পারেনি। ইসকান্দারিয়া অবরোধের সময় তিনি সিঁড়ি লাগিয়ে কিল্লার অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে চাইলেন। সঙ্গীরা বললেন, ‘ভেতরে মারাত্মক প্লেগ।’ জবাবে বললেন, ‘আমরা তো যখম ও প্লেগের জন্যেই এসেছি। সুতরাং মৃত্যুভয় কেন?’ সেদিন তিনি ভীষণ সাহসিকতার সঙ্গে সিঁড়ি লাগিয়ে কিল্লায় প্রবেশ করেছিলেন।
হযরত যুবাইরের সততা, আমানতদারী, পরিচালনা ক্ষমতা ও সংগঠন যোগ্যতা ছিল অসাধারণ। মৃত্যুকালে লোকেরা তাঁকে আপন আপন সন্তান-সন্ততি ও ধন-সম্পদের মুহাফিজ বানাবার ইচ্ছা ব্যক্ত করতো। মুতী ইবনুল আসওয়াদ তাঁকে অসী বানাতে চাইলে তিনি অস্বীকৃতি জানান। তখন তিনি কাতর কণ্ঠে বলতে থাকেন, ‘আমি আপনাকে আল্লাহ, রাসূল ও নিকট- আত্মীয়তার দোহাই দিয়ে বলছি। আমি ফারুকে আজম উমারকে বলতে শুনেছি, যুবাইর দ্বীনের একটি রুকন বা স্তম্ভ। হযরত উসমান, মিকদাদ, আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ, আবদুর রহমান ইবন আউফ প্রমুখ সাহাবী মৃত্যুকালে তাঁকে অসী নিযুক্ত করেছিলেন। অত্যন্ত সততার সাথে তিনি তাঁদের ধন-সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ করে তাঁদের সন্তান ও পরিবার-পরিজনদের জন্য ব্যয় করেন।
হযরত যুবাইর স্ত্রী ও ছেলে-সন্তানদের গভীরভাবে ভালোবাসতেন। বিশেষতঃ পুত্র আবদুল্লাহ ও তাঁর সন্তানদেরকে অতিমাত্রায় স্নেহ করতেন। মৃত্যুর পূর্বে সন্তানদের তা’লীম ও তারবিয়্যাতের ব্যাপারে তিনি ছিলেন দারুণ সচেতন। ইয়ারমুকের যুদ্ধে তিনি পুত্র আবদুল্লাহকে সংগে নিয়ে যান। তখন তার বয়স মাত্র দশ বছর। হযরত যুবাইর তাকে একটি ঘোড়ার ওপর বসিয়ে একজন সিপাহীর তত্ত্বাবধানে দিয়ে দেন, যাতে সে যুদ্ধের ভয়াবহ দৃশ্যগুলি দেখিয়ে তাকে বীরত্ব ও সাহসিকতার শিক্ষা দেয়।
বদান্যতা, দানশীলতা ও আল্লাহর রাস্তায় খরচের ব্যাপারে তিনি অন্য কারো থেকে কখনো পিছিয়ে থাকেননি। তাঁর এক হাজার দাস ছিল। প্রতিদিন তিনি তাদের ভাড়া খাটিয়ে মোটা অংকের অর্থ লাভ করতেন। কিন্তু তার একটি পয়সাও নিজের বা পরিবারবর্গের জন্য ব্যয় করা সমীচীন মনে করতেন না। সবই বিলিয়ে দিতেন। মোটকথা, নবীর একজন হাওয়ারীর মধ্যে যত রকমের গুণ থাকা সম্ভব, সবই হযরত যুবাইরের মধ্যে ছিল।
ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল হযরত যুবাইরের প্রধান পেশা। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, যে ব্যবসায়ে তিনি হাত দিয়েছেন, কখনো তাতে লোকসান হয়নি।
আল্লাহর রাহে সংগ্রামে দুশমনদের তীর-বর্শার অসংখ্য আঘাত তিনি খেয়েছেন। আলী ইবন খালিদ বলেন, আমাদের কাছে মুসেল থেকে একটি লোক এসেছিলো। সে বর্ণনা করলোঃ ‘আমি যুবাইর ইবনুল আওয়ামের একজন সফর-সঙ্গী ছিলাম। সফরের এক পর্যায়ে আমি তাঁর দেহের এমন সব ক্ষতিচিহ্ন দেখতে পেলাম যা অন্য কারো দেহে আর কখনো দেখিনি। জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেনঃ এ সবই ঘটেছে রাসূলুল্লাহর সা. সঙ্গে ও আল্লাহর রাহে।’
আলী ইবন যায়িদ বলেন, ‘যুবাইরকে দেখেছে এমন এক ব্যক্তি আমাকে বলেছে, ‘তাঁর (যুবাইরের) বুকে ঝরণার মত দেখতে তীর বর্শার অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন ছিল।’
পোশাক-পরিচ্ছদের ব্যাপারে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সাদাসিধে। তবে তাঁর তরবারিটি ছিল অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ। তরবারির হাতলটি ছিল চমৎকার নকশা অংকিত।
হযরত মুআবিয়া রা. আবদুল্লাহ ইবন আব্বাসকে রা. জিজ্ঞেস করলেন, ‘তালহা ও যুবাইর সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কি।’ তিনি বললেন, ‘আল্লাহ তাদের দু’জনের ওপর রহমত বর্ণন করুন। আল্লাহর কসম, তাঁরা দু’জনই ছিলেন অত্যন্ত সংযমী, পূণ্যবান, সৎকর্মশীল, আত্মসমর্পণকারী, পুত-পবিত্র, পবিত্রতা অর্জনকারী ও শাহাদাত বরণকারী।’
হযরত যুবাইর বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সা. আমার জন্য এবং আমার সন্তান-সন্ততি ও পৌত্র-পৌত্রীদের জন্য দু’আ করেছেন।’
হযরত যুবাইরের সবচেয়ে বড় পরিচয় ও সৌভাগ্য এই যে, তিনি আশারায়ে মুবাশ্শারা অর্থাৎ দুনিয়াতে জান্নাতের শুভ সংবাদ প্রাপ্ত দশজন সাহাবীর একজন।