আততাওয়াক্কুল ‘আলাল্লাহ – মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া আব্দুল্লাহ

بسم الله الرحمن الرحيم

‘তাওহীদ’ শব্দের সাথে আমরা সকলেই পরিচিত এবং সম্ভবত এর মৌলিক অর্থও আমাদের অজানা নয়। তাওহীদের মৌলিক অর্থ জানার ও বোঝার পর আমাদের বিশ্বাস ও কর্মে এবং সমগ্র ব্যবহারিক জীবনে আকীদায়ে তাওহীদের কী প্রভাব পরিলক্ষিত হওয়া দরকার সে সম্পর্কেও সচেতন হওয়া কর্তব্য। ইসলামের এ মৌলিক আকীদার সুফল ও প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা অর্জন করে সে আলোকে নিজের বিশ্বাস ও কর্মের পরীক্ষা নেওয়া এবং বাস্তব ও প্রায়োগিক জীবনে এ প্রভাবগুলো আনার চেষ্টা করা কর্তব্য। এতে আকীদায়ে তাওহীদের যে বীজ আমাদের হৃদয়ভূমিতে রয়েছে তা অঙ্কুরিত হবে এবং পত্র-পল্লবে বিকশিত হয়ে আমাদের সমগ্র জীবনে ছায়া বিস্তার করবে। এ দিক থেকে তাওহীদ-প্রসঙ্গ অনেক ব্যাপক এবং এর ক্ষেত্রও অনেক বিস্তৃত।

ঈমান ও তাওহীদের বিশ্বাস যখন মজবুত হয় তখন অন্তরের অবস্থায় পরিবর্তন আসে এবং বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্য আল্লাহপাক দান করেন। তেমনি বাহ্যিক কাজকর্মেও পরিবর্তন আসে এবং বিশেষ বিশেষ গুণ আল্লাহ পাক দান করে থাকেন।

আজ যে বিষয়টি আলোচনা করব তা হচ্ছে তাওহীদের এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ ও সুফল ‘তাওয়াক্কুল আলাল্লাহ’। ‘তাওয়াক্কুল’ আরবী শব্দ। এর অর্থ, ভরসা করা। অর্থাৎ, দুনিয়া-আখেরাতের সকল কাজে, সকল মকসুদ হাসিল করার জন্য এবং সকল বিপদ-মুসীবত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য একমাত্র আল্লাহ পাকের উপর ভরসা রাখা। এটা ইসলামের শিক্ষা। ঈমানের শিক্ষা। বিখ্যাত তাবেয়ী ইমাম সাঈদ ইবনে যুবাইর রাহ. বলেন-

التوكل على الله ـ عز وجل ـ جماع الإيمان

অর্থাৎ আল্লাহর উপর ভরসা করা এমন গুণ যা অনেক ঈমানী গুণের ধারক। (আযযুহদ, হান্নাদ ইবনুস সারী ১/৩০৪)

এ শিক্ষার অনেক সুফল এমন আছে যা দুনিয়ার জীবনেই পাওয়া যায়। আল্লাহ পাক যে আমাদের কুরআন-সুন্নাহর বিধান দান করেছেন এ শুধু আখেরাতের সফলতার জন্য নয়, দুনিয়া-আখেরাত উভয় জাহানের সফলতার জন্য। তাই কুরআন-সুন্নাহর শিক্ষা ও বিধান সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করলে দেখা যাবে, দুনিয়াতে যত অশান্তি, যত অনাচার তার মূলে রয়েছে কুরআন-সুন্নাহর শিক্ষা থেকে দূরে সরে যাওয়া। আল্লাহ পাকের বন্দেগী ও আনুগত্য ত্যাগ করা। আমরা যদি আল্লাহ পাকের আনুগত্যের দিকে ফিরে আসি এবং জীবনের সকল ক্ষেত্রে ইসলামের শিক্ষাকে অবলম্বন করি তাহলে আখেরাতের জীবন তো সফল হবেই আমাদের দুনিয়ার জীবনও সুন্দর ও শান্তিময় হবে। এটা ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।

তবে ইসলামের শিক্ষা অনুসরণের ক্ষেত্রে দুনিয়ার উপকারিতা লাভ করা মুখ্য উদ্দেশ্য হবে না। আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য হবে আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি পাওয়া এবং আখেরাতের কামিয়াবী অর্জন করা।

কুরআন মজীদের বিভিন্ন জায়গায় তাওয়াক্কুল-প্রসঙ্গ আছে। হাদীস শরীফেও আছে। তাওয়াক্কুল কী, এর উপকারিতা কী, দুনিয়ার উপায়-উপকরণ অবলম্বনের সাথে তা সাংঘর্ষিক কি না এ ধরনের অনেক বিষয়ের সমাধান কুরআন-সুন্নাহয় আছে।

সূরায়ে যুমারে আল্লাহ তাআলার ইরশাদ-

وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ مَنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ لَيَقُولُنَّ اللَّهُ

(তরমজা) অর্থাৎ আপনি যদি মক্কার মুশরিকদের জিজ্ঞাসা করেন আসমান ও জমিন কে সৃষ্টি করেছেন? অবশ্যই তারা বলবে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। (সূরা যুমার : ৩৭)

তারা তো বিভিন্ন দেবদেবীর উপাসনা করে, কারো কাছে জ্ঞান চায় কারো কাছে স্বাস্থ্য চায়, কারো কাছে রিযিক চায়, কারো কাছে সন্তানসন্ততি চায়, কারো কাছে আয় উপার্জন চায়, কারো কাছে বালামুসিবত থেকে আশ্রয় চায় এভাবে অনেক খোদা, অনেক মাবুদ, একেক প্রয়োজনের জন্য একেক মাবুদ বানিয়ে রেখেছে। কিন্তু যখন জিজ্ঞাসা করবেন, ‘আসমান-যমীন কে সৃষ্টি করেছেন’ উত্তরে একথাই বলবে যে, আল্লাহ তাআলা সৃষ্টি করেছেন। অর্থাৎ তাদেরও বিশ্বাস ছিল, আসমান যমীনের সৃষ্টিতে এই সকল দেব-দেবীর কোনো হিস্যা নেই এবং আসমান-যমীনে মানুষের জীবনধারণের যত উপকরণ এগুলোও আল্লাহ ছাড়া আর কেউ সৃষ্টি করেননি। আল্লাহই সকল কিছুর স্রষ্টা। তাহলে এত দেব-দেবীর পূজা তারা কেন করত? তারা মনে করত কিছু কিছু কল্যাণ-অকল্যাণের ক্ষমতা এই সকল দেব-দেবীর আছে, যদিও সে ক্ষমতা স্বয়ংসম্পূর্ণ না, আল্লাহ প্রদত্ত! এজন্য তারা তালবিয়ায় ‘লা শারীকা লাক’ (‘তোমার কোনো শরীক নেই’) বাক্যের সাথে নিজেদের পক্ষ থেকে এ বাক্যটি জুড়ে নিয়েছিল- ‘ইল্লা শারীকান হুয়া লাক্ তামলিকুহূ ওয়ামা মালাক্’ অর্থাৎ, তবে এমন শরীক আছে যার মালিক অবশ্য তুমি আর ওদের যা কিছু ক্ষমতা-কর্তৃত্ব সেগুলোরও মালিক তুমি (নাউযুবিল্লাহ)। এ ছিল তাদের শিরকের ধরন। তারা নাস্তিক ছিল না, মুশরিক ছিল।

সামনে আল্লাহ পাক তাদের এ বিভ্রান্তি সমূলে উৎপাটন করে তাঁর রাসূলকে বলছেন, ‘‘হে রাসূল, আপনি তাদের প্রশ্ন করুন, তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের কাছে প্রার্থনা কর, বল তো, আল্লাহ যদি আমার ব্যাপারে কোনো অকল্যাণের ইচ্ছা করেন তোমাদের এই দেবদেবী কি আমাকে ঐ অকল্যাণ থেকে রক্ষা করতে পারবে? তেমনি আল্লাহ যদি আমার ব্যাপারে কোনো কল্যাণের ফায়সালা করেন সমস্ত দেবদেবী মিলেও কি তা প্রতিরোধ করতে পারবে?’’ অর্থাৎ আমি তো এই সমস্ত মূর্তি ও দেব-দেবীর সবচেয়ে বড় শত্রু। এদের বিরুদ্ধেই তো আমার দাওয়াত। এরা কি পারবে আমার কোনো ক্ষতি করতে কিংবা পারবে কোনো উপকার করতে? পারবে না। আমার কল্যাণ-অকল্যাণ সবই হবে একমাত্র আল্লাহর ইচ্ছায়। এদের ইচ্ছায় নয়। তাহলে তোমাদেরও কোনো কল্যাণ-অকল্যাণের ক্ষমতা এদের নেই। যখন নেই তখন হে রাসূল আপনি বলুন, আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট আর আল্লাহর উপরেই প্রত্যেক ভরসাকারীর ভরসা করা উচিত।

 

কার উপর তাওয়াক্কুল?

মানুষকে দুনিয়ার জীবনে ভরসা করতে হয়। কোথাও না কোথাও তাকে আত্মসমর্পন করতেই হয়। সব দুঃখ বেদনা কোথাও না কোথাও বলতেই হয়। সেই স্থানটা কোনটা? যারা ঈমান থেকে বঞ্চিত, ঈমানের শিক্ষা থেকে মাহরূম, তারা সেই স্থান এমন ব্যক্তি বা বস্ত্তকে বানিয়ে নেয় বাস্তবে যাদের কল্যাণ-অকল্যাণের কোনোই ক্ষমতা নেই। পক্ষান্তরে আল্লাহ যাদেরকে ঈমান দান করেছেন, তাওহীদের আলোয় আলোকিত করেছেন তারা তাদের সকল বেদনা, সকল প্রার্থনা এমন একজনের কাছে পেশ করে যিনি বাস্তবেই মানুষের কল্যাণ-অকল্যাণের মালিক। আর যিনি সৃষ্টির প্রতি পরম দয়ালু।

ইরশাদ হয়েছে

وَتَوَكَّلْ عَلَى الْعَزِيزِ الرَّحِيمِ

‘ভরসা কর পরাক্রমশালী করুণাময়ের উপর।’ (সূরা শুআরা : ২১৭)

আরো ইরশাদ –

وَتَوَكَّلْ عَلَى الْحَيِّ الَّذِي لَا يَمُوتُ

ভরসা কর চিরঞ্জীবের উপর, যার মৃত্যু নেই। (সূরা ফুরকান : ৫৮)

তো সূরা যুমারের এ আয়াতে পরিষ্কার হয়ে গেল, তাওয়াক্কুলের হাকীকত কী, বা কাকে বলে তাওয়াক্কুল। তাওয়াক্কুল হচ্ছে ভরসা করা, জীবনের সকল বিষয়ে, কল্যাণ লাভের ক্ষেত্রেও, অকল্যাণ থেকে মুক্তি পাবার ক্ষেত্রেও। আর তা এমন সত্ত্বার উপরই হতে পারে যিনি সকল বস্ত্তর স্রষ্টা। বস্ত্তর গুণ ও বৈশিষ্ট্যের স্রষ্টা। যিনি গোটা জাহানের পালনকর্তা এবং যিনি দুনিয়া-আখিরাতের সকল কল্যাণ-অকল্যাণের মালিক, এমন সত্ত্বার উপরই ভরসা করা যায়। তাঁর পরিবর্তে মানুষ যদি অন্য কারো উপর ভরসা করে তাহলে তা হবে তাওয়াক্কুলের পরিপন্থী।

 

তাওয়াক্কুলহীনতার বিভিন্ন পর্যায়

এখানে একটি বিষয় ভালোভাবে বুঝে নেওয়া দরকার। তা এই যে, ভালোর যেমন স্তরভেদ আছে তেমনি মন্দেরও আছে। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো উপর ভরসা করারও বিভিন্ন স্তর ও পর্যায় আছে। ভরসা করা অন্তরের কাজ। এটা আল্লাহর প্রতিই থাকতে হবে। একারণে অন্য কারো উপর ভরসা করলে তা নিঃসন্দেহে তাওয়াক্কুল পরিপন্থী ও মাসিয়াত। এখন যদি এর সাথে শিরকী কোনো আকীদা যুক্ত হয় যেমন গায়রুল্লাহকে অলৌকিক ক্ষমতার মালিক মনে করে তার উপর ভরসা করে তাহলে তা সরাসরি শিরক। আর যদি অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী বিশ্বাস করে নয়; বরং পার্থিব অর্থ, সম্পদ, ক্ষমতার কারণে ভরসা করে তবে তা সরাসরি শিরকে আকবর না হলেও মা’ছিয়াত ও তাওয়াক্কুল বিরোধী। এটা প্রকৃতপক্ষে পার্থিব উপায়-উপকরণের উপর ভরসা, যা নিষেধ। ভরসা একমাত্র আল্লাহর উপরই করতে হবে।

 

কর্মহীনতা তাওয়াক্কুল নয়

তদ্রূপ আরো একটি বিষয় পরিষ্কার থাকা প্রয়োজন। আর তা হচ্ছে ভরসা ও ব্যবহারের পার্থক্য। উপায়-উপকরণের উপর ভরসা করা যাবে না অর্থ এই নয় যে, তা ব্যবহারও করা যাবে না। বৈধ উপকরণ বৈধ পন্থায় ব্যবহার করা যাবে, কিন্তু ভরসা রাখতে হবে আল্লাহর উপর।

তাওয়াক্কুল বা আল্লাহর উপর ভরসা করার অর্থ দুনিয়ায় কাজকর্ম পরিত্যাগ করা নয়। ভরসা করা অন্তরের বিষয়। মুমিন অন্তর থেকে বিশ্বাস করে আমার সকল ভালো-মন্দ আল্লাহ পাকের হাতে, তবে দুনিয়ার জীবনের এবং আখিরাতের জীবনের সফলতা অর্জনের জন্য আল্লাহ পাক কিছু পথ ও পন্থা নির্ধারিত করেছেন। তা আমাকে অবলম্বন করতে হবে। ভালো-মন্দ আল্লাহর হাতে, কিন্তু আল্লাহ তাআলার কাছ থেকে সেই ভালো  পাওয়ার জন্য এবং সেই মন্দ থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহ যে পথে চলার আদেশ করেছেন সে পথেই আমাকে চলতে হবে। দুনিয়া ও আখিরাত উভয় ক্ষেত্রেই একথা সত্য। কর্মহীন বসে থাকার কথা আল্লাহ পাক দুনিয়ার ব্যাপারেও বলেননি, আখিরাতের ব্যাপারেও বলেননি। প্রথমে আখিরাতের বিষয়টি দেখুন। ইসলামে তো বলা হয়নি যে, আখিরাতে যেহেতু আল্লাহই নাজাত দিবেন তাই কোনো আমল করতে হবে না- নামায পড়তে হবে না, রোযা রাখতে হবে না, পর্দা করতে হবে না, হালাল মোতাবেক চলতে হবে না, হারাম থেকে বেঁচে থাকতে হবে না। এ কথা তো ইসলাম বলেনি; বরং গুরুত্বের সাথে এসব হুকুম-আহকামের পাবন্দী করতে বলেছে।

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেয়ে আল্লাহ পাকের উপর অধিক ভরসাকারী আর কে হতে পারেন? তিনিই তো সবচেয়ে বড় ভরসাকারী। তাঁর পর সাহাবায়ে কেরাম সবচেয়ে বড় ভরসাকারী। কিন্তু তাঁরা আখেরাতের মুক্তি ও সফলতা অর্জনের জন্য পুরা জীবন আল্লাহ পাকের বিধান মোতাবেক চলেছেন। নামায পড়েছেন, রোযা রেখেছেন, যাকাত দিয়েছেন, হজ্ব করেছেন, দান-খয়রাত করেছেন এবং আল্লাহ পাক যত বিধান ও আহকাম দান করেছেন তা পালন করেছেন। তবে এই আহকাম পালন করতে গিয়েও তাঁদের বিশ্বাস ছিল, আমি দ্বীনের যে কাজগুলো করছি, আখিরাতের যে কাজগুলো করছি- এগুলোই আমাকে মুক্তি দিবে না। মুক্তি দিবেন আল্লাহ তাআলা। তাঁর রহমতের উপরই আমাদের ভরসা। তবে মুক্তির যে পথ তিনি নির্ধারণ করেছেন আমি সে পথে চলতে চেষ্টা করছি। এই চেষ্টা তাঁরই আনুগত্য, তাঁর নিকট থেকে মুক্তি লাভের আকুতি। আর এই যে তা করতে পারছি -এটাই আশার বিষয় যে, আল্লাহ পাক আমাকে নাজাত দান করবেন। তিনি হয়তো আমার নাজাতেরই ফয়সালা লিখে রেখেছেন। ঠিক এমনিভাবে দুনিয়ার বিষয়েও, মুমিনের ভরসা থাকবে আল্লাহর উপর। কিন্তু এর অর্থ কর্ম পরিত্যাগ করা নয়। সূরা জুমুআর প্রসিদ্ধ আয়াত আমাদের সবার জানা।

فَإِذَا قُضِيَتِ الصَّلَاةُ فَانْتَشِرُوا فِي الْأَرْضِ وَابْتَغُوا مِنْ فَضْلِ اللَّهِ

(তরজমা) সালাত সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করবে। … (সূরা জুমুআ ৬২ : ১০)

তাহলে আল্লাহ তাআলাই আদেশ করেছেন তাওয়াক্কুল করার, আল্লাহর উপর ভরসা রাখার, আবার তিনিই আদেশ করেছেন, নামায শেষে ভূপৃষ্ঠে ছড়িয়ে পড়ার, আল্লাহর ফযল অন্বেষণ করার। এর তাৎপর্য হল মানুষ তার সাধ্য অনুযায়ী কাজ করবে, কিন্তু ঈমান থাকবে আল্লাহর ফয়সালার উপর। আমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কর্ম ও উপকরণের মাঝে, কিন্তু অন্তর আল্লাহর সাথে। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে কর্মক্ষেত্রে কর্ম করছি আর অন্তরে ভরসা আল্লাহর উপর পোষণ করছি।

হাদীস শরীফে আছে-

الكيس من دان نفسه وعمل لما بعد الموت، والعاجز من اتبع نفسه هواها وتمنى على الله.

বিচক্ষণ ঐ ব্যক্তি যে নিজের কর্মের হিসাব নেয় এবং মৃত্যুর পরের জন্য আমল করে। পক্ষান্তরে অক্ষম ঐ ব্যক্তি যে নিজেকে প্রবৃত্তির অনুসারী করে আর আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে অলীক আশা পোষণ করে। (জামে তিরমিযী, হাদীস : ২৪৫৯; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস : ৪২৬০)

যেমন কেউ ধারণা করল, ‘আল্লাহ তো গাফূরুর রাহীম, তিনি আমাকে মাফ করে দিবেন। সুতরাং আমল না করলেও কোনো অসুবিধা নেই।’ এই ব্যক্তি মুতাওয়াক্কিল নয়। সে হচ্ছে অক্ষম নির্বোধ। তেমনি দুনিয়ার ব্যাপারেও যারা অলস ও কর্মবিমুখ, সাধ্যের ভিতরে এবং শরীয়তে যা বৈধ তা থেকেও বিমুখ, কিন্তু মুখে বলে, আমরা আল্লাহর উপর ভরসা করি। এরাও প্রকৃতপক্ষে মুতাওয়াক্কিল নয়। এরাও আজিয-অক্ষম। সহীহ বুখারীর বিখ্যাত ভাষ্যগ্রন্থ ‘ফাতহুল বারীতে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহ.-এর একটি উক্তি বর্ণিত হয়েছে। তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, কেউ যদি ঘরে বা মসজিদে এই বলে বসে থাকে যে, আমি কোনো কাজ করব না। আমার নির্ধারিত রিযক আমার কাছে এসে পড়বে। তার হুকুম কী? ইমাম আহমদ রাহ. জবাব দিলেন,هذا رجل جهل العلم ‘এ লোক প্রকৃত ইলম থেকে বঞ্চিত।’ এরপর বলেন, ‘স্বয়ং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইরশাদ, ‘আল্লাহ আমার রিযক রেখেছেন আমার বর্শার ছায়ায়’। তিনি আরো বলেছেন, ‘তোমরা যদি আল্লাহর উপর যথোপযুক্ত তাওয়াক্কুল করতে তাহলে তিনি তোমাদের সেভাবেই রিযিক দিতেন যেভাবে পাখিদের দিয়ে থাকেন। তারা সকালে ক্ষুধার্ত বের হয় আর সন্ধ্যায় তৃপ্ত ফেরে।’ এ হাদীসে রিযকের খোঁজে নীড় থেকে বের হওয়ার কথা আছে। একইভাবে সাহাবীগণ ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন, ক্ষেত-খামারে কাজ করতেন। আর والقدوة بهم  তারাই তো অনুসরণীয়।’ আবার অনেকের অবস্থা এমন যে, তাওক্কুলের ব্যাখ্যা ‘উপায়-উপকরণ বর্জন’ করেও উপায়-উপকরণে ডুবে থাকেন। একদিকে চাকুরি-বাকুরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, ক্ষেত-খামার সবকিছুতেই লিপ্ত অন্যদিকে সম্পূর্ণরূপে উপায়-উপকরণ অস্বীকার; এক আশ্চর্য স্ববিরোধী অবস্থা! বস্ত্তত এ স্ববিরোধিতার অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে তাওয়াক্কুলের সঠিক অর্থ না জানার কারণে। এ ধরনের মানসিক অবস্থা পোষণকারীরা একে তো নিজ কর্মপন্থা সম্পর্কেও অস্থিরতায় ভোগেন অন্যদিকে অন্যদের জন্যও বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ান। হালাল পন্থায় জীবিকা উপার্জনকারীদের ব্যাপারেও তাদের মনে থাকে অশ্রদ্ধা এবং এরা এদেরকে ‘দুনিয়াদার’ মনে করেন।

আরো বড় বিপদ হচ্ছে, তাওয়াক্কুলের এ অশুদ্ধ ব্যাখ্যাকারীদের অনেকেই জীবিকা উপার্জনের ক্ষেত্রে হালাল-হারাম পার্থক্য করার প্রেরণা হারিয়ে ফেলেন। জীবিকা উপার্জনের সকল উপায়ই যেহেতু তাদের দৃষ্টিতে নিরঙ্কুশ দুনিয়াদারী তাই জীবিকার হালাল উপায়টির প্রতিও তাদের মনে আলাদা কোনো শ্রদ্ধাবোধ থাকে না।

 

সব ঘটনা সহজ নয়

এ প্রসঙ্গে আরো একটি বিষয় পরিষ্কার হওয়া দরকার। আর তা হচ্ছে বুযুর্গানে দ্বীনের কোনো কোনো ঘটনায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে উপায়-উপকরণ ত্যাগের বিষয়টি পাওয়া যায়। এ ঘটনাগুলো সঠিকভাবে বোঝা উচিত। সাধারণত ঘটনা ও কাহিনীকে সহজ মনে করা হয়। সব ধরনের ঘটনার ক্ষেত্রে একথা সঠিক নয়। অনেক ঘটনা এমন আছে যা সঠিকভাবে না বোঝার কারণে নানা ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়, যা ব্যক্তির কর্ম ও বিশ্বাসে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা প্রয়োজন। আপাতত এ মূলনীতি মনে রাখা যায় যে, যে ঘটনাই দ্বীনের সহজ-স্বাভাবিক শিক্ষার ব্যতিক্রম তা থেকে নিজে নিজে কোনো নীতি উদ্ভাবনের পরিবর্তে প্রাজ্ঞ আহলে ইলমের কাছ থেকে বুঝে নেওয়া উচিত যে, এখানে শরীয়তের শিক্ষা কী আর এ ঘটনা থেকে শিক্ষণীয় কী।

তো তাওয়াক্কুলের মূল কথা অন্তরের ভরসা। দুনিয়া-আখিরাতের সকল কাজ সাধ্যমত করছি, কিন্তু বিশ্বাস রাখছি যে, সফলতা একমাত্র আল্লাহ তাআলার হাতে। তাঁরই উপর আমি ভরসা রাখি।

 

সতর্কতা অবলম্বন তাওয়াক্কুলের পরিপন্থী নয়

হযরত ইয়াকুব আ.-এর একটি ঘটনা সূরা ইউসুফে বর্ণিত হয়েছে। চারদিকে দুর্ভিক্ষ। ইয়াকুব আ.-এর সন্তানেরা খাদ্য-শস্য সংগ্রহের জন্য মিসরে যাচ্ছেন। তারা ছিলেন বারো ভাই। ইয়াকুব আ. বললেন, তোমরা যখন শহরে প্রবেশ করবে তো বারো ভাই এক দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে না। কারণ, সবাই তো ইউসুফ আ.-এর ভাই। রূপ-সৌন্দর্যে তাঁর মতো না হলেও কিছু মিল তো থাকবে। এ করকম বারোজন যুবক যদি একসাথে এক দরজা দিয়ে প্রবেশ করে তাহলে মানুষের বদনজর লেগে যেতে পারে। ইয়াকুব আ. বললেন, তোমরা এক দরজা দিয়ে প্রবেশ না করে বিভিন্ন দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে। এই কথাটা আল্লাহ তাআলা কুরআন মজীদে উল্লেখ করেছেন। এটা হচ্ছে সতর্কতা। এ উপায় বাতলে দেওয়ার পর ইয়াকুব আ. একথাও বললেন যে, ‘‘তবে এর দ্বারা আমি আল্লাহর ফয়সালাকে রদ করতে পারব না। আমি তো একটি উপায় নির্দেশ করলাম। কিন্তু আল্লাহ তাআলা যদি তোমাদের তাকদীরে কোনো ক্ষতি লিখে রাখেন তাহলে উপায় অবলম্বন করে সেই ক্ষতি থেকে তোমরা বাঁচতে পারবে না। ফয়সালা তো একমাত্র আল্লাহ তাআলারই। তিনি যার সম্পর্কে ইচ্ছা কল্যাণের ফায়সালা করেন, যার সম্পর্কে ইচ্ছা অকল্যাণের ফায়সালা করেন। তার ফায়সালাকে কেউ কোনোভাবেই রদ করতে পারবে না। এজন্য আমি তার উপরই ভরসা করছি এবং তাওয়াক্কুলকারীদের তার উপরই তাওয়াক্কুল করা উচিত।’’  তো আল্লাহর নবী আলাইহিস সালাম উপায় অবলম্বন করেছেন এবং আল্লাহর উপরে ভরসা করেছেন।

এমনিভাবে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্বোধন করে আল্লাহ তাআলা বলেছেন

فَبِمَا رَحْمَةٍ مِنَ اللَّهِ لِنْتَ لَهُمْ وَلَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِيظَ الْقَلْبِ لَانْفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ فَاعْفُ عَنْهُمْ وَاسْتَغْفِرْ لَهُمْ وَشَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِ فَإِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُتَوَكِّلِينَ

(তরজমা) (হে নবী! এসব ঘটনার পর) এ আল্লাহর রহমতই ছিল, যার  কারণে আপনি তাদের সাথে কোমল আচরণ করেছেন। আপনি যদি রূঢ় প্রকৃতির ও কঠোর হৃদয় হতেন তবে তারা আপনার আশপাশ থেকে বিক্ষিপ্ত হয়ে যেত। সুতরাং তাদের ক্ষমা করুন, তাদের জন্য মাগফিরাতের দুআ করুন এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাদের সাথে পরামর্শ করতে থাকুন। অতপর আপনি যখন কোনো বিষয়ে মতস্থির করে সংকল্পবদ্ধ হবেন তখন আল্লাহর উপর ভরসা করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাওয়াক্কুলকারীদের ভালবাসেন। (সূরা আলে ইমরান ৩ : ১৫৯)

এটা অহুদ যুদ্ধের পরের ঘটনা। যুদ্ধে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি আদেশ অমান্য করার কারণে বিপর্যয় নেমে এসেছিল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও আহত হয়েছেন। বহু সাহাবী শহীদ হয়েছেন। সাহাবায়ে কেরাম অনুতপ্ত ও দুঃখিত। আল্লাহ তাআলা তাদের জন্য ক্ষমা ঘোষণা করেছেন এবং রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ঐ আদেশ করেছেন।

তো এখানে আল্লাহ তাআলা তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নম্রস্বভাবের সুফল আর রুক্ষ স্বভাবের কুফল সম্পর্কে জানিয়েছেন। অথচ এ-ও তো একটি সবব বা উপায়। মানুষকে একতাবদ্ধ রাখা, না রাখা এটাও তো প্রকৃতপক্ষে আল্লাহরই হাতে। কিন্তু আল্লাহ তাআলা এখানে কোমল স্বভাব ও রুক্ষস্বভাবকে একটি ‘সবব’ বা কার্যকারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

এরপর মশোয়ারা করতে বলেছেন এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করতে বলেছেন। এরও অর্থ এই যে, মানুষকে তার সাধ্যমত চেষ্টা করতে হবে, এরপর আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করতে হবে।

 

তাওয়াক্কুলের সুফল

এই ঈমান ও তাওয়াক্কুলের সুফল অনেক। তাওয়াক্কুল যত শক্তিশালী হবে সুফলও তত বেশি পরিলক্ষিত হবে। এক সুফল এই যে, এই বান্দা হালাল উপায় ছেড়ে হারাম উপায়ের দিকে যাবে না। আমার ভরসা যেহেতু আল্লাহ পাকের উপর তাহলে হারাম উপায়ের দিকে কেন আমি যাব? আমি যেহেতু আল্লাহর আদেশের আনুগত্য করে এবং পৃথিবীতে আল্লাহর ব্যবস্থার অধীন হয়েই উপায় অবলম্বন করেছি তাই সেই উপায়ই অবলম্বন করব যা হালাল। এর মাধ্যমেই আল্লাহ আমাকে রিযক দিবেন। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরিষ্কার ইরশাদ-

لَنْ تَمُوتَ نَفْسٌ حَتَّى تَسْتَوْفِيَ رِزْقَهَا فَاتَّقُوا اللهَ وَأَجْمِلُوا فِي الطَّلَبِ

কোনো প্রাণ তার রিযক পূর্ণ না করে মৃত্যু বরণ করবে না। সুতরাং আল্লাহকে ভয় কর এবং উত্তম পন্থায় অন্বেষণ কর।-শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ৯৮৯১; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস : ২১৪৪

বান্দা যখন আল্লাহর উপর ভরসা করে তো এর বিনিময়ে সে কী পায়? এর বিনিময়ে সে আল্লার ভালবাসা পায়। আল্লাহর নৈকট্য পায়

إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُتَوَكِّلِينَ

‘যারা ভরসা করে আল্লাহ তাদের ভালবাসেন।’ (আলে ইমরান ৩ : ১৫৯)

আল্লাহ তার অন্তরে শান্তি ও প্রশান্তি দান করেন এবং আল্লাহই তার জন্য যথেষ্ট হয়ে যান।

وَمَنْ يَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ فَهُوَ حَسْبُهُ

‘যে আল্লাহর উপর ভরসা করে আল্লাহই তার জন্য যথেষ্ট।’ (সূরা ত্বলাক ৬৫ : ৩)

 

শাওয়াল ১৪৩৫ . আগস্ট ২০১৪

মাসিক আলকাউসার