এক.
ইসলামের সূচনালগ্ন থেকেই নির্যাতিত হচ্ছে মুসলিম জাতি। নিপীড়িত হচ্ছে প্রতিটি ক্ষণে। সুপ্রশস্ত পৃথিবী তাদের জন্য বড় সংকীর্ণ ইসলামের সূচনালগ্ন থেকে আজ অবধি। মুসলমানের দুঃখ-দুর্দশায় দু’ফোঁটা তপ্ত অশ্রু ঝরাবে এমন সৎ ও সাধুর সচরাচর অস্তিত্ব মিলে না ধরিত্রীর কোথাও। ইউরোপ আমেরিকা ভারত ও অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো মুসলিম নিধনের মহড়া চালাচ্ছে অবিরাম। এতে বেশ উল্লসিত বহু হৃদয়, উচ্ছসিত অসংখ্য অন্তর। মুসলমানের খুন ঝরলে, ইসলামি সাম্রাজ্য পর্যুদস্ত হলে গগনবিদারী হাসির হররা ছোটে তাদের মহলগুলোতে। পৃথিবী থেকে মুসলিম জাতিকে নিশ্চিহ্ন করতে বদ্ধপরিকর তারা। তাদের প্রতিজ্ঞা, সত্যের দীপ্ত মশালকে নিজেদের মুখের ফুৎকারে নিভিয়ে তবেই তারা ক্ষান্ত হবে। কিন্তু কেনো এই হিংস্রতা ও নির্মমতা? মুসলমানদের প্রতি কেনো এই রূঢ়তা ও অবজ্ঞা? কী তাদের অপরাধ? সাহাবিদের সোনালি যুগ থেকে আজ পর্যন্ত বুকের লাল খুনে রঞ্জিত হয়েছে কতো যে মুসলিম, গুড়ানো হয়েছে কতো যে মসজিদ তার হিসাব আল্লাহই ভালো জানেন। স্মরণকালে বাবরি মসজিদ বিধ্বস্ত হওয়া ধারাবাহিক সেই নৃশংসতার এক করুণ ইতিহাস! বুকের তপ্ত খুনে রচিত লাল ইতিহাস।
দুই.
১৬১৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষে আক্রমণ করেন সম্রাট বাবর। পরপর চারবার পরাজয় বরণের পরে ১৫২৫ খ্রিস্টাব্দে ভারতের ভূমিতে মোঘল শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হন তিনি। ভারতের জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনে এ বিজয়। ইসলামের হেলালি নিশান পতপত করে উড়তে থাকে পুরো দেশজুড়ে। ১৫২৮ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট বাবর ভারতের উত্তর প্রদেশের অযোধ্যা রাজ্যে তার গভর্নর নিযুক্ত করেন মীর বাকি তাশকন্দিকে। সম্রাটের আজ্ঞাবহ গভর্নর মীর বাকি তাশকন্দি ১৫৩৮ সালে অযোধ্যা রাজ্যের ফয়জাবাদে এক খণ্ড পতিত জমিতে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। সম্রাট বাবরের স্মরণে মসজিদের নাম রাখা হয় বাবরি মসজিদ।
তিন.
ভারতে মুসলমানদের আধিপত্য কোনোক্রমেই সইতে পারছিলো না সেখানকার কট্টরপন্থী হিন্দুরা। ক্ষোভের দহনে ছটফট করছিলো তারা। মুসলমানদের রাজ্য জয় তাদের দেহ থেকে ধড় আলাদা করে দিয়েছে, ভেতর থেকে প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। মুসলমানদের রক্তে গা ভেজাতে মরিয়া হয়ে ওঠে তাদের অন্তরাত্মা। উদ্দেশ্য সাধন করতে এক ঝান্ডার ছায়াতলে আশ্রয় নেয় তাদের সকলে। মুসলমানের ক্ষতি সাধন করতে প্রয়াসী তাদের প্রতিটি সদস্য। ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে শুরু করে তারা। পরিশেষে তাদের ষড়যন্ত্র পরিগ্রহ করে এক ভয়াবহ রূপ। ফয়জাবাদের যে ১৫০০ শতকে নির্মিত হয়েছিলো বাবরি মসজিদ, সেই জমিকে রাম মন্দিরের জন্য বরাদ্দকৃত বলে ঘোষণা দেয় তারা। প্রোপাগান্ডা ছড়াতে থাকে দেশের সর্বত্র। উগ্রতার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে তাদের সত্তা-অন্তরাত্মা। ষড়যন্ত্রের পর ষড়যন্ত্র! একবার, দু’বার পরপর বিশবার হামলা চালায় তারা। খোদার ঘরের সঙ্গে এ ধৃষ্টতা প্রদর্শন করে তারা উল্লাসে ফেটে পড়ে। খুশির প্রচণ্ডতায় মিছিল বের করে এলাকার পর এলাকা প্রদক্ষিণ করে।
চার.
ভারত তখন ব্রিটিশ শাসনের অধীন। এহেন সময় মোঘল সম্রাটদের দেশ পরিচালনা ও তাদের দ্যুতিময় স্মৃতি কাঁটা হয়ে বিঁধতে থাকে মুসলমানদের হৃদয়ে। কাল অতিক্রান্ত হতে থাকে, দিন অতিবাহিত হতে থাকে, মুসলমানদের দুঃখ-দুর্দশাও অধিক থেকে অধিকতর হতে থাকে। হিন্দুস্তানের গাছপালা আজও সাক্ষী হয়ে আছে, কী ভয়াল বিভীষিকা আবর্তিত হয়েছিলো তখন মুসলমানদের ওপরে। পথের দু’ধারে গাছের ডালে ডালে ঝুলছিলো বিজ্ঞ আলিমগণের পঁচে যাওয়া লাশ। গন্ধের তীব্রতায় পথচলা অসম্ভব হয়ে পড়েছিলো তখন। প্রকাশ্যে আজান ও জামাতের সাথে নামাজ আদায় নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। বাবরি মসজিদের ওপর চলতে থাকে পিশাচদের ক্রমাগত হামলা।
পাঁচ.
১৮৮৫ সালে অযোধ্যার কট্টরপন্থী হিন্দুরা বাবরি মসজিদ গুড়িয়ে হৃদয়ের খেদ ও অন্তরের জ্বালা মেটাতে ও পূর্বপুরুষদের সাধ-লালসা বাস্তবায়ন করতে আরো মরিয়া হয়ে ওঠে। ক্ষুধার্ত হায়েনার মতো তেড়ে আসতে থাকে বাবরি মসজিদ পানে। চোখে তাদের এক মন্দিরের স্বপ্ন। বুকে তাদের এক মসজিদ চূর্ণ করার বাসনা। সাজ-সরঞ্জাম নিয়ে উপস্থিত হয় তারা বাবরি মসজিদ প্রাঙ্গণে। ইমানের সুপ্ত শিখা জ্বলে ওঠে মুমিনদের হৃদয়ে। খোদাদ্রোহীদের বিষাক্ত ছোবল থেকে খোদার ঘরকে সুরক্ষিত রাখতে প্রতিরোধের ময়দানে তারা ছুটে আসে। লাঠিসোটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে উদ্ধত হিন্দুদের ওপরে। কিন্তু হিন্দুদের উন্নত অস্ত্রশস্ত্রের সামনে তাদের প্রতিরোধ দুর্বল হয়ে পড়ে। একের পর এক লুটিয়ে পড়তে থাকে ফয়জাবাদের ভূমিতে। শহিদানের রক্তে রঞ্জিত হয়ে ওঠে সেখানকার সবকিছু। বাবরি মসজিদকে শেষ বিদায় জানিয়ে, তার চিরোজ্জ্বল শোভার প্রতি আরেকবার দৃষ্টি বুলিয়ে শহিদানের কাফেলা হারিয়ে যেতে থাকে না ফেরার জগতে। পঁচাত্তর জন ইমানদীপ্ত মুসলমান সেদিন খোদাদ্রোহীদের হাতে নির্মমভাবে শাহাদাত বরণ করেন।
ছয়.
এভাবেই নির্যাতিত হচ্ছিলো মুসলিম জাতি। নির্যাতিত হচ্ছিলো বাবরি মসজিদ। অসহায় মুসলিম জনগোষ্ঠীর দৃষ্টি তখন ঊর্ধ্বালোকে। পার্থিব ক্ষমতা ও প্রতাপ নেই তাদের। নেই হিন্দুদের প্রতিরোধ করার মতো সমরশক্তি। সরকারের সমর্থনও তারা পায়নি। তাদের সম্বল ছিলো শুধু ইমানি বল ও খোদার মদদ। তবুও তারা দমবার পাত্র নয়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাবরি মসজিদে ইবাদত-বন্দেগি চালু রাখে। রোনাজারি ও ফরিয়াদ করতে থাকে খোদার দরবারে। অশ্রুর বান বইয়ে দিয়ে দু’হাত তুলে প্রার্থনা করতে থাকে, খোদা হে, তোমার ঘরকে তুমিই রক্ষা করো। আমরা বড় দুর্বল। আমাদের তুমি শক্তি যোগাও। তোমার পবিত্র ঘরের সাথে হঠকারীদেরকে মাটির সাথে মিশিয়ে দাও।
সাত.
১৮৮৭ সালে হিন্দুরা পুনরায় হামলা করে বাবরি মসজিদের ওপরে। মুসলমানরাও মৃত্যুর শপথ নিয়ে প্রতিরোধ করতে এগিয়ে আসে। এক পর্যায়ে অনন্যোপায় হয়ে পড়ে তারা। শহিদানের লাশ নিয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয় মুসলমানরা। শহিদানের কাফেলা বাবরি মসজিদের চত্বরে ও দেয়ালে সাক্ষীস্বরূপ রেখে যায় রক্তের ছিটেফোঁটা। মুসলমানদের দুর্বল করে মসজিদ চত্বরের কিছু অংশ দখল করে নেয় কট্টরপন্থী হিন্দুরা। তারা তখন সেখানে রামপূজার ছোট বেদি নির্মাণ করে। মুসলমানরা তখনও খোদার ঘরে ইবাদত-বন্দেগি চালু রাখে। ফলে একই সাথে চলতে থাকে মহান স্রষ্টার ইবাদত ও পাথরে নির্মিত রামের পূজা। মুসলমানদের হৃদয় গহীনে বাজতে থাকে বেদনার সকরুণ সানাই। পানির বুকে যেমন তলতল ধারা, মুসলমানদের বুকে তখন তেমন খলখল সর্বনাশা বান। অবিরমা কান্নার স্রোত বইতে থাকে তাদের দু’চোখ বেয়ে। কান্নার খিনখিন আওয়াজে রণিত হয়ে ওঠে আকাশ বাতাস। ফরিয়াদের আওয়াজ ভেসে আসে, হে মহান খোদা, আবরাহার হস্তিবাহিনীর হামলা থেকে বাইতুল্লাহকে তো তুমিই সুরক্ষিত রেখেছিলে। আজ আমাদের এই সুকঠিন ও অসহায় মুহূর্তে বাবরি মসজিদকে তোমার গায়বি ব্যবস্থায় সুরক্ষিত রাখো। আমরা আমাদের সাধ্যমতো প্রচেষ্টা চালিয়েছি। এখন তোমার হাতেই সবকিছু। ওদেরকে তুমি ধ্বংস করো। কালিমার হেলালি নিশান সমুন্নত করো।
আট.
১৯৩৪ সালে সারা ভারতজুড়ে শুরু হয় হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা। মুসলমানদের জন্য বড় সংকীর্ণ হয়ে যায় পৃথিবী। তাদের লাশের স্তুপ ও রক্তের বন্যা দেখে আকাশ বাতাসও কেমন যেনো ভারি হয়ে ওঠেছিলো। মুসলিম জাতির সেই কঠিন কালে হিন্দুরা পুনরায় হামলা চালায় বাবরি মসজিদের ওপরে। মসজিদের দেয়ালের অংশবিশেষ ভেঙ্গে ফেলে তারা। এরপর আসে ১৯৪৯ সাল। তা ছিলো অসহায় মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্য চরম বিপর্যয়ের সময়। অকস্মাৎ একদিন উগ্র হিন্দুরা বাবরি মসজিদে ঢুকে সেখানে রামের মূর্তি স্থাপন করে। এ নিয়ে উত্তেজনা দেখা দিলে সরকার মসজিদ চত্বরকে ‘বিরোধপূর্ণ এলাকা’ ঘোষণা দেয়। এতে মুসলমানরা মসজিদে নামাজ আদায় করার সুযোগ না পেলেও হিন্দুরা রামের পূজা অব্যাহত রাখে। মুসলমানরাও পা গুটিয়ে বসে থাকেনি। কিছুদিনের মধ্যেই তারা বাবরি মসজিদ দখলে এনে তাতে তালা লাগিয়ে দেয়। ফলে সাময়িক সময়ের জন্য হিন্দুদের রামপূজা ব্যাহত হয়। ১৯৮৩ সালে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ মসজিদ চত্বরে মন্দির নির্মাণের অভিযান শুরু করে এবং মসজিদের তালা খুলে দেয়ার জন্য মুসলমানদের প্রতি আহ্বান জানায়। মুসলমানরা তাদের আহ্বান ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে। ১৯৮৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ফয়জাবাদের জেলা জজ তার এক রায়ে মসজিদের তালা খুলে দেয়ার নির্দেশ জারি করে, হিন্দুরা যাতে বিনা বাধায় বাবরি মসজিদে রামের পূজা করতে পারে। এ রায়ের প্রতিক্রিয়ায় মুসলমানরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। গঠন করা হয় ‘বাবরি মসজিদ একশন কমিটি’। বাবরি মসজিদ রক্ষার্থে জীবন বিসর্জনের শপথ নেয় কমিটির সকল সদস্য। বুকের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও বাবরি মসজিদকে খোদাদ্রোহীদের হাত থেকে সুরক্ষিত রাখবে এ অঙ্গীকার করে তারা। ‘বাবরি মসজিদ একশন কমিটি’র ডাকে ১৯৮৭ সালের ১৪ জানুয়ারি পালন হয় ‘কালো দিবস’। সারা ভারতে তখন পুনরায় শুরু হয় হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা। আবারো সারা দেশজুড়ে বইতে থাকে রক্তবন্যা।
নয়.
১৯৮৯ সালে হিন্দু পরিষদ, ভারতীয় জনতা পার্টি প্রভৃতি হিন্দু সংগঠন বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে মন্দির নির্মাণের ঘোষণা দেয়। এ বছরই ২রা নভেম্বর বাবরি মসজিদে নিশান উড়িয়ে তারা তাদের দখল প্রতিষ্ঠা করে। সে সময়ে ভারতের ক্ষমতায় ছিলো রাজীব গান্ধী। অধিকাংশ বিশ্লেষকের ধারণা, কংগ্রেসের সহযোগিতায় হিন্দুরা এ কাজ করতে সমর্থ হয়েছে। কংগ্রেসের পতন হলে ১৯৯০ সালে বিজেপির সহযোগিতায় ক্ষমতার আসনে সমাসীন হন ‘বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং’। বিশ্বনাথ প্রতীপ সিং ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার কিছুদিন পরেই বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আদভানি বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে রাম মন্দির নির্মাণের ঘোষণা দেয় এবং অযোধ্যা অভিমুখে রথযাত্রার আয়োজন করে। এ সময়ে ভারতের উত্তর প্রদেশের ক্ষমতায় বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংয়ের জনতা দল যাদবের নেতৃত্বাধীন ছিলো রাজ্য সরকার। সরকার লালকৃষ্ণ আদভানির এ অমার্জিত অন্যায় ও উগ্র তৎপরতাকে বাধা দেয় এবং তার নির্দেশে পুলিশ আদভানিকে গ্রেফতার করে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে নিক্ষেপ করে। এ সময়ে পুলিশের গুলিতে বিজেপির বিশ সদস্য নিহত হয়। হিন্দু মুসলিম দাঙ্গায় নিহত হয় আরো শত শত লোক।
এ বছরের জুলাই মাসে নরসীমা রাওয়ের সময় বাবরি মসজিদ প্রাঙ্গণে রাম মন্দিরের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। তখনও মসজিদের ক্ষতি সাধন করেনি খোদাদ্রোহীরা। উগ্র হিন্দুদেরকে প্রতিরোধ করতে সর্বস্ব নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে মুসলমানরা। আবারো শুরু হয় রক্তের খেলা। বিরোধ নিষ্পত্তি জন্য নরসীমা তিন মাসের জন্য মন্দির নির্মাণের কাজ স্থগিত রাখে। পরিশেষে ১৯৯২ সালের ৫ই ডিসেম্বর লাখ লাখ লোকের উপস্থিতিতে উগ্র হিন্দুরা খোদার ঘর বাবরি মসজিদকে সমূলে ধ্বংস করে উল্লাসে ফেঁটে পড়ে। কিছু উগ্র যুবক পেশাব করে বাবরি মসজিদের বিধ্বস্ত ভবনে। মুসলমানদের হৃদয়গহিনে বয়ে যায় বেদনার স্রোত। দু’চোখ বেয়ে যায় অশ্রুর বান। হাপুসনয়নে অবিরাম কেঁদে চলে তারা। আকাশ-বাতাশ, বৃক্ষলতা ও পত্রপল্লব হতবাক হয়ে দেখছিলো এ নির্মম ঘটনা। বাতাসের প্রবাহের সেদিন কেমন যেন বইছিলো ধীরে ধীরে।
দশ.
উগ্রবাদী হিন্দু সংগঠন বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ৬ই ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে ফেলার পর সারা ভারতে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা ছাড়িয়ে পড়ে। এদিন এবং তার পরের দিন হিন্দু মুসলিম দাঙ্গায় নিহত হয় ২৩৭ জন নিরীহ মুসলিম। ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ভারত সরকার উত্তর প্রদেশের বিজিপির নেতৃত্বাধীন সরকারকে বরখাস্ত করে এবং সেখানে প্রেসিডেন্ট শাসন জারি করে। ৭ই ডিসেম্বর সারা ভারতে ঘটে এক নারকীয় দাঙ্গা এবং সহিংসতা। দিল্লি, আহমদাবাদ, জয়পুর, ভূপাল, এলাহাবাদ, বোম্বাই প্রভৃতি এলাকায় প্রচণ্ড সহিংসতায় প্রায় ১ হাজার নিরীহ মুসলমান শাহাদত বরণ করেন। ক্রমেই দাঙ্গা আরো ব্যাপকতা লাভ করে এবং পরের দিন তা গুজরাট, উত্তর প্রদেশ, অন্ধ প্রদেশ এবং মহীশুরে তণ্ডবলীলার আকার ধারণ করে। শাহজানপুর, ফয়জাবাদ, লাখনৌ, বানারসি, ফহেতনগর এবং কাঁসীতেও তা মারাত্মক আকার ধারণ করে। চলমান সহিংসতায় আরো দেড় হাজার মুসলমান শাহাদতের অমীয় সুধা পান করেন। ১০ ও ১১ ডিসেম্বরও এ দাঙ্গার প্রচণ্ডতা কমেনি। মুসলমান জনপদের ঘরে ঘরে অগ্নিসংযোগ করা হয়। অবুঝ শিশুদের আঁছড়ে আঁছড়ে, বেয়োনটের খোঁচায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। মুসলিম মেয়েদের সম্ভ্রমহানি করা হয়। মুসলমানদের রক্তে ভারতের মাটি হয়ে যায় রঞ্জিত। মুসলমানরা ধন-সম্পদের বুভুক্ষ ছিলো না, ছিলো না ক্ষমতার সুউচ্চ মহলের বিবিক্ষু। তারা চেয়েছিলো একটু নিরাপদ আশ্রয়। কিন্তু তাদেরকে চির বঞ্চিত করা হয়েছে। হত্যা করা হয়েছে নির্মমভাবে।
চলমান ভয়াবহ দাঙ্গায় নিহত হয় আরো প্রায় দু’হাজার মুসলিম। দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে কোলকাতা ও হাওড়ায় কারফিউ জারি করা হয়। কারফিউ চলাকালে ভারতীয় হিন্দু পুলিশ মুসলমানদের ওপর বেপরোয়া গুলি চালায়। কোথাও কোথাও ঘর থেকে টেনে এনে মুসলমানদেরকে হত্যা করা হয়। ভারতের সহিংসতার কারণে মুসলমানদের ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর ব্যাপক হামলা ও হুমকির সৃষ্টি হয়। এদিকে মুসলমানদের প্রতিবাদ এবং রক্তাক্ত প্রতিরোধকে পরোয়া না করে উত্তর প্রদেশ সরকার বাবরি মসজিদের স্থানে হিন্দুদের পূজার অনুমতি দিলে আবারো সহিংসতা বৃদ্ধি পায়। ১১ই জানুয়ারি বোম্বাই এবং আহমদাবাদে ঘটে প্রচণ্ড দাঙ্গা এবং সহিংসতা। হিন্দুরা বল খাটিয়ে মুসলমানদের ঘরবাড়ি দখল করে নেয়। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো জোরপূর্বক নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। শুধু এতেই ক্ষান্ত হয় না। মুসলমানরা যেনো অফিস আদালত ও অন্যান্য কর্মস্থলে যোগদান করতে না পারে এজন্য তারা সরকার ও প্রশাসনের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। অব্যাহত হত্যা, গুম এবং লুটতরাজের প্রেক্ষিতে প্রতিবাদস্বরূপ মুসলমানরা ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসকে বর্জন করে। কিন্তু এতে হিন্দুদের তাণ্ডবলীলা মোটেও কমেনি। আর এ সময়ে তাদের সহযোগিতায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে ভারত সরকার ও পুলিশ।
এগারো.
ভারতের মতো একটি গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ বিশাল দেশের অভ্যন্তরে সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠীর মসজিদ ভাঙ্গার ঘটনা গোটা দুনিয়ার মানুষকে হতবাক করে দিয়েছে। বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার এ ষড়যন্ত্র ভারতে মুসলিম জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করার একটি অংশ। এক শিবসেনা যুবক যে বাবরি মসজিদের সর্বশেষ গম্বুজটি ভেঙ্গেছিলো সে তার এক সাক্ষাৎকারে বলেছে, “আমরা মুসলমানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছি”।
এক শতাব্দীর চেয়েও দীর্ঘ সময় ধৈর্য ধরে খোদার ঘর মসজিদ ভাঙ্গার কাজ সুচারুরূপে আঞ্জাম দিয়েছে কট্টরপন্থী হিন্দুরা। আমরা কি পারি না বাবরি মসজিদকে পুনরায় তার অস্তিত্ব ফিরিয়ে দিতে? আমরা কি পারি না শহিদানের বাসনা পূর্ণ করে ইতিহাসের সোনালি অধ্যায় রচনা করতে? দেড়শ কোটি মুসলমানের প্রতি বাবরি মসজিদের এই আর্তি। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।