বাহায়ি সম্প্রদায় সম্পূর্ণ আলাদা ও স্বতন্ত্র একটি মনগড়া ও ভ্রান্ত ধর্মমতে বিশ্বাসী। ইসলামের সঙ্গে যেমন তাদের কোনো সম্পর্ক নেই, তেম্নি সম্পর্ক নেই অন্যকোনো ধর্মের সঙ্গেও। বাহায়িদের মূল বক্তব্য হলো, ইসলাম রহিত হয়ে গেছে এবং এটা করেছেন স্বয়ং আল্লাহ তাআলা। ইসলামের পরিবর্তে বাহাইয়্যাতকে ধর্ম হিসেবে প্রবর্তন করেছেন তিনি। কুরআনের স্থলাভিষিক্ত হিসেবে বাহায়িদের ধর্মগ্রন্থ ‘আকদাস’ ‘নাজিল’ করেছেন।
তাদের দাবি, ধর্মীয় ইতিহাস ঈশ্বরের দূতদের ধারাবাহিক আগমনের মাধ্যমে ধাপে ধাপে সম্পন্ন হয়েছে। তারা প্রত্যেকে নিজ সময়ের মানুষদের সামর্থ্য ও সময় অনুসারে একটি ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেছেন। এঁদের মধ্যে আছেন আদম, ইব্রাহিম, ইসা আলায়হুমুস সালাম, গৌতম বুদ্ধ, কৃষ্ণ এবং হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম। বাহায়িদের দাবি মতে এই ধারাবাহিকতায় সর্বশেষে আছে বাহায়ি মতবাদের প্রবর্তক বাহাউল্লাহ।
খ্রিষ্টাব্দ ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইরানে এই মতবাদের উৎপত্তি। ইরানের শায়খিয়্যাহ ফেরকার সাথে সম্পর্কিত আলি মুহাম্মদ নামক এক ব্যক্তি (১৮১৯-১৮৫০) ১৮৪৪ খ্রিষ্টাব্দের দিকে দাবি করে যে, সে ইমাম মাহদি আলায়হিস সালাম পর্যন্ত পৌঁছার ‘বাব’ তথা দরজা। ইরানি সরকার ইসলাম-বিরোধী আকিদা ও দৃষ্টিভঙ্গি লালন ও প্রসারের অপরাধে ১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দে তাকে ফাঁসিতে ঝোলায়।
তার ফাঁসির পর তারই ভাবাদর্শের অনুসারী হুসাইন আলি নুরি নামের এক শিয়া ব্যক্তি তার স্থলাভিষিক্ত হবার দাবি করে। এবং নিজেকে ‘বাহাউল্লাহ’ উপাধিতে ভূষিত করে। ইতিহাস এই লোককেই মূলত বাহায়ি বিশ্বাসের প্রবর্তক হিসেবে চিহ্নিত করে। এবং পৃথিবী তাকে ‘বাহাউল্লাহ’ নামে চেনে।
বাহাউল্লাহর গুরু মির্জা আলি মুহাম্মদ যে মতবাদের প্রচার করেছিল, সেটাকে ‘বাবিয়াত’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে ইতিহাস। আর বাহাউল্লাহ তার থেকে আরও ভয়ানক ভ্রান্তির দিকে ধাবিত হয়ে যে মতবাদের বিকাশ ঘটিয়েছিল, সেটাই হচ্ছে বাহাইয়্যাত।
আরবি বাহা শব্দের অর্থ মহিমা বা উজ্জ্বল দীপ্তি। চতুর হুসাইন আলি নুরি নিজেকে ‘আল্লাহর মহিমা বা আল্লাহর উজ্জ্বল দীপ্তি’ হিসেবে জাহের করার জন্য বাহাউদ্দিন নামটা নিয়েছিল। এবং এই বাহা শব্দ থেকে তার প্রচারিত বিশ্বাসকে বাহাইয়্যাত নাম দিয়েছিল।
বাহাউল্লাহ ঘোষণা করে—সে যা কিছু বলে, তা পুরোটাই হুজ্জত বা অকাট্য দলিল, এর আগের সব কিছুই রহিত হয়ে গেছে। (আকদাস-৮০)
বাহায়ি মতবাদের সকল মৌলনীতি বাহাউল্লাই প্রবর্তন করে। এই ভ্রান্ত মতবাদ প্রচারের জন্য ইরান সরকার বাহাউল্লাহকে ১৮৬৮ থেকে ১৮৯২ খ্রিষ্টাব্দে তার মৃত্যু অবধি ‘উকা’ নামক স্থানে বন্দী করে রাখে।
‘উকা’ উত্তর ফিলিস্তিনের একটি এলাকার নাম। যেখানে বিপদজনক চোর ডাকাত ও অপরাধীদের আমৃত্যু বন্দী রাখা হয়। বাহাউল্লাহ ৪০ বছর সেখানে বন্দী থাকার পর ১৮৯২ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ মে মৃত্যুবরণ করে। উকার জেল-কর্তৃপক্ষ উকার মাটিতেই তাকে কোনো ধরনের কবর না দিয়ে পুঁতে ফেলে।
বাহাউল্লার মৃত্যু উকার মাটিতে হওয়ায় বাহায়িরা উকাকে তাদের কেন্দ্র মনে করে।
মৃত্যর পূর্বে সে তার বড়ছেলে আব্দুল বাহা আব্বাস আফিন্দিকে তার স্থলাভিষিক্ত নির্বাচন করে এবং আরেক ছেলে শুকি আফিন্দিকে পরবর্তী গদিনিশিন নির্ধারণ করে যায়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে গদিনিশিন হওয়া নিয়ে দুই ভাইয়ের মধ্যে প্রচণ্ড ঝগড়া-বিভেদ হয়। ফলে গদিনিশিন বাদ দিয়ে ‘বাইতুল আদল’ নামে একটি কমিটি গঠিত হয় এবং এই কমিটিই বাহায়ি মতবাদের পরিচালনার ভার নেয়।
বর্তমানে বিশ্বের দুইশোটিরও অধিক দেশে বাহায়ি মতবাদের আনুমানিক ৬০ লক্ষ অনুসারী রয়েছে। ভারতে তাদের বেশ ক’টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে। দিল্লিতে আছে তাদের সর্ববৃহৎ মন্দির। দিল্লি ছাড়াও বোম্বে ইত্যাদি শহরে তাদের যথেষ্ট অনুসারী রয়েছে।
বাংলাদেশে বাহায়ি মতবাদের বিস্তৃতি শুরু হয় বাহাউল্লাহর জীবদ্দশাতেই। মতবাদটির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে সে তার কিছু অনুসারীকে ভারতে যাবার জন্য উৎসাহিত করে। ধারণা করা হয়, তাদের মধ্যে জামাল এফেন্দি-ই হচ্ছে প্রথম বাহায়ি, যে একাধিকবার ঢাকায় এসেছিল। বার্মায় থাকাকালে বর্তমান বাংলাদেশে অবস্থিত চট্টগ্রামের একটি গোষ্ঠী বাহায়ি মতবাদ গ্রহণ করে। ১৯৫০-এর দিকে এই ধর্মের অনুসারীর সংখ্যা যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পায়, এবং তারা চট্টগ্রাম ও ঢাকায় লোকাল স্পিরিচুয়াল অ্যাসেম্বিলি গঠন করে। ২০০৫ সালে ওয়ার্ল্ড ক্রিশ্চিয়ান এনসাইক্লোপিডিয়ার এক জরিপ অনুসারে বাংলাদেশে বাহায়ি ধর্মের অনুসারীর সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার।
ইসলামের সকল পণ্ডিতগণের ঐক্যমত্য সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাহায়ি মতবাদ ইসলামের সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে সংঘর্ষিক এবং কুফরি একটি ফেরকা। ইসলাম বা মুসলমানদের বিশ্বাসের সঙ্গে এদের কোনো সম্পর্ক নেই।
তাদের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কুফরি আকিদা সূত্রসহ নিম্নে প্রদান করা হলো—
১. তাদের মতে শেষ নবি মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরও নতুন নবির আগমন ও ওহির অবতরণ ঘটতে পারে। (আলওয়াহ-৩৭)
২. বাহাউল্লাহ নিজেকে রাসুল হবার দাবি করেছে। (কিতাব মুবিন-৬৭, আখবারে কাউকাব-১/৪)
৩. বাহাউল্লাহ নিজেকে মসিহে মওউদ হবারও দাবি করেছে। (কাউকাবে হিন্দ-১, ১৯২৪ ঈসাব্দ)
৪. বাহায়িদের মতে দীনে মুহাম্মদি ১২৬০ হিজরিতে রহিত হয়ে গেছে, তাই এখন বাহায়ি দীন আমলযোগ্য। (মিয়ারুস সহিহ ফি মারিফাতি জুহুরুল মাহদি ওয়াল মাসিহ :৬৩-৬৪)
৫. তাদের মতে ‘কিতাবে আকদাস’ নামের গ্রন্থ তেলাওয়াত করা পূণ্যের কাজ। শুধু তাই নয়, অন্যান্য আসমানি কিতাবের চেয়ে এটি উত্তম। (কিতাবে আকদাস-৮১)
এ ছাড়া তাদের আকিদা ও আমল এমন, যার সাথে কুরআন সুন্নাহ এবং মুতাওয়াতির হাদিসের কোনো সম্পর্ক নেই।
ইসলামি আইন বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাহায়িদের সঙ্গে মুসলমানদের কোনোরূপ আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়া যাবে না, মৃত্যুর পর এদের জানাজা পড়তে পারবেন না কোনো মুসলিম এবং এদেরকে মুসলমানদের গোরস্তানে দাফনও করা যাবে না।
তথ্য-সহযোগিতা : আহলে হক বাংলা মিডিয়া সার্ভিস, উইকিপিডিয়া, বিবিসি
হামমাদ রাগিব
সূত্রঃ fateh24