মাওলানা আলী আকবর ছাহেব, আমার মুহতারাম উস্তায। তিনি তাঁর শায়েখ ও মুরশিদ মাওলানা ইদ্রিস সন্দ্বীপী ছাহেব রাহ.-এর কাছে বসে কাঁদছেন আর বলে চলেছেন সদ্য ঘটে যাওয়া বিপদের কথা। মাদরাসায় ডাকাতি হওয়ার বর্ণনা দিচ্ছেন। অপরদিকে সন্দ্বীপী রাহ. বর্ণনা শুনছেন আর মৃদু হাসছেন; কী যেন ভাবছেন। বিপদের মাঝে তিনি কিসের যেন সুসংবাদ শুনতে পাচ্ছেন। আল্লাহর উপর যার ঈমান পাহাড়সম তিনি বিপদেও আল্লাহকে দেখেন, বিপদ-পরবর্তী আল্লাহর সাহায্যে নিশ্চিত বিশ্বাস করেন। বর্ণনা শেষ হলে তিনি বললেন, মাওলানা ছাহেব! সুসংবাদ গ্রহণ করুন। এই বিপদের মধ্যে মাদরাসার কবুলিয়াতের আলামত দেখতে পাচ্ছি। এই মাদরাসার (মাদানী নগর মাদরাসা) শুরুতেও এমন বড় বড় বিপদ এসেছে। ডাকাত পড়েছে, শত্রু আক্রমণ করেছে। আরো কত কী! আজ আল্লাহর মেহেরবানী নিজ চোখে দেখুন, কেমন দ্বীনের খেদমত চলছে।
তাঁর এই অমূল্য বাণীর মূল্য দীর্ঘ দেড় যুগ পরে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে। বাক্যগুলো ছিল ভরপুর-ঈমানের চাদরে আচ্ছাদিত। যত দিন যাচ্ছে মাদরাসার ততই যেন তারাক্কী হচ্ছে। পড়া-লেখা থেকে শুরু করে প্রতিটি পদক্ষেপেই আল্লাহ তাআলার নুসরতের বারিধারা অব্যাহত। এ তো কবুলেরই আলামত।
মাদরাসা প্রতিষ্ঠার শুরুতেই ডাকাতি। তালিবুল ইলমরা সবে আসতে শুরু করেছে। মাত্র দুদিন হল মাদরাসার বয়স, ছাত্ররা ভর্তি হচ্ছে। অমনি ডাকাত পড়ল। তাও রীতিমত আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার। এক উস্তাযে মুহতারাম ও এক তালিবুল ইলম গুলিবিদ্ধ। পুরো মাদরাসায় আতঙ্ক বিরাজ করছে। অভিভাবক মহোদয়গণ নিজ নিজ পোষ্যকে নিয়ে ভাবনায় পড়ে যান। আসাতেযায়ে কেরাম নতুন করে ভাবতে শুরু করেন, কী করবেন, কী করা উচিত। এখানে এই বিপদ মাথায় নিয়ে থাকবেন নাকি অন্য কোথাও চলে যাবেন? এলাকার সাধারণ মানুষের মাঝে কানাঘুষা। মাদরাসা শুরু না হতেই ডাকাতি!
হুযুরের সারা জীবনের লালিত স্বপ্ন। বছরের পর বছরের মেহনতের ফসল অঙ্কুরেই ঝরে যাবে! হুযুর আর ভার নিতে পারছিলেন না, তাই চলে গেলেন ঈমানের শক্তিতে বলিয়ান নিজের শায়েখ ও মুরশিদের কাছে। ঈমানী কথা শুনে, আল্লাহর তাআলার নুসরতের বাণী শুনে হুযুর শান্ত¡না পেলেন। ভাঙ্গা হৃদয় আবার ভরে উঠল ঈমানের শক্তিতে। মনে যেন আর কোনো কষ্ট নেই। ভার নেই, দুঃখও নেই।
মাদরাসায় এসে সকল তালিবুল ইলম ও আসাতেযায়ে কেরামকে একত্রিত করলেন। হৃদয় থেকে হৃদয়ে নিয়ে আসা সান্ত¡নার বাণী সবাইকে শোনালেন। হৃদয়ের পূর্ণ বিশ্বাস নিয়ে বললেন, বিপদের সময় আল্লাহকে স্মরণ করাই মুমিনের পরিচয়।
আইয়ূব আলাইহিস সালাম বিপদে পড়ে আল্লাহকেই ডেকেছিলেন, আল্লাহ তাঁর বিপদ দূর করেছিলেন-
وَأَيُّوبَ إِذْ نَادَى رَبَّهُ أَنِّي مَسَّنِيَ الضُّرُّ وَأَنْتَ أَرْحَمُ الرَّاحِمِينَ فَاسْتَجَبْنا لَهُ فَكَشَفْنا مَا بِهِ مِنْ ضُرٍّ وَآتَيْناهُ أَهْلَهُ وَمِثْلَهُمْ مَعَهُمْ رَحْمَةً مِنْ عِنْدِنا وَذِكْرى لِلْعابِدِينَ.
অর্থ : এবং স্মরণ কর আইয়ুবের কথা যখন সে তার প্রতিপালককে আহ্বান করে বলেছিল, ‘আমি দুঃখ-কষ্টে পড়েছি, আর তুমি তো সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু!’ তখন আমি তার ডাকে সাড়া দিলাম, তার দুঃখ-কষ্ট দুরীভ‚ত করে দিলাম, তাকে তার পরিবার-পরিজন ফিরিয়ে দিলাম এবং তাদের সঙ্গে তাদের মত আরো দিলাম আমার বিশেষ রহমতস্বরূপে এবং ইবাদতকারীদের জন্য উপদেশস্বরূপ। -সূরা আম্বিয়া (২১) : ৮৩-৮৪
নিআমত ও সুখও আল্লাহ দেন, মুসিবত ও বিপদও আল্লাহ দেন। মুমিনের কর্তব্য নিআমতের শুকরিআ আদায় করা, আর বিপদেও আল্লাহকে স্মরণ করা। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
وَما بِكُمْ مِنْ نِعْمَةٍ فَمِنَ اللَّهِ ثُمَّ إِذا مَسَّكُمُ الضُّرُّ فَإِلَيْهِ تَجْئَرُونَ.
অর্থ : তোমাদের নিকট যে সমস্ত নিআমত রয়েছে তা তো আল্লাহরই নিকট থেকে আবার যখন দুঃখ-দৈন্য তোমাদেরকে স্পর্শ করে তখন তোমরা তাঁকেই ব্যাকুলভাবে আহ্বান কর। -সূরা নহল (১৬) : ৫৩
বিপদে পড়লে মুমিনগণ আল্লাহকে ডাকে। আল্লাহ তাআলা এতে খুশি হন। বিপদ দূর করে দেন। অপরদিকে দুর্বল ঈমানের মানুষ বিপদে পড়লে ঘাবড়ে যায়, হতাশ হয়ে পড়ে। অথচ নিরাশ হতে আল্লাহ তাআলা নিষেধ করেছেন। তিনি ইরশাদ করেন, (তরজমা) ‘তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না’। -সূরা যুমার, (৩৯) : ৫৩
ব্যস, কাজ হয়ে গেল। পুরা মাদরাসায় ফিরে এল চঞ্চলতা। শুরু হল কুরআনের দরস। সবার মুখে দেখা যাচ্ছে জ্বলজ্বল আলো। সর্বত্রই বিরাজ করছে আসমানী ইতমিনান ও প্রশান্তি।
নামায ও ধৈর্য বিপদমুক্তির পথ
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوا اسْتَعِیْنُوْا بِالصَّبْرِ وَ الصَّلٰوةِ ؕ اِنَّ اللّٰهَ مَعَ الصّٰبِرِیْنَ
অর্থ : হে মুমিনগণ! তোমরা নামায ও ধৈর্যের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা রয়েছেন ধৈর্যশীলদের সাথে। -সূরা বাকারা (২) : ১৫৩
পার্থিব জীবনের পরতে পরতে রয়েছে সুখ-দুঃখ ও হাসি-কান্না। আবার এ থেকে উত্তরণের সহজ এবং কার্যকর পথ ও পন্থাও আল্লাহ বলে দিয়েছেন। বান্দার জীবন যেন বিপদের কারণে থমকে না দাঁড়ায়। বিপদের ঘোর অমানিশায়ও যেন সমাধানের পথ খুঁজে পায়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনী পড়লে এর প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায়। হুযাইফা রা. বলেন,
كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا حَزَبَهُ أَمْرٌ، صَلَّى.
অর্থ : যখন কোনো কঠিন বিষয় সামনে আসত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন নামাযে দাঁড়িয়ে যেতেন। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৩১৯
কুরআন ও হাদীসের উপর আমল ও তার বাস্তব উদাহরণ দেখেছি আমি জামিয়া সিদ্দিকিয়ায়। অসম্পূর্ণ নতুন ভবন। অঝোর ধারায় বাতাসসহ বৃষ্টিতে ভিতরের কাপড়-চোপড় ও বিছানা-সামগ্রী সব ভিজে যাচ্ছে। মুহতামিম ছাহেব হুযুর নামাযে দাঁড়িয়ে গেলেন। নামায শেষ হওয়ার সাথে সাথে বৃষ্টিও থেমে গেল। সুবহানাল্লাহ! বিপদে নামায কত কার্যকর। মেহেরবান আল্লাহ বান্দার জন্য জীবন কত সহজ করে দিয়েছেন। বিপদে যদি পড়, নামাযে দাঁড়াও আর আল্লাহর সাহায্য প্রত্যক্ষ কর। সাহাবাদের জীবন-কর্ম এমনই ছিল। যে কোনো প্রয়োজন, বিপদ-আপদ, অসুখ-বিসুখ, ও বালা-মুসিবতে নামাযে দাঁড়িয়ে যেতেন।
আল্লাহ তাআলা আমাদের আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন।
সফর ১৪৩৭ – ডিসেম্বর ২০১৫
মাসিক আলকাউসার