বিবাহ-শাদী মানব জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। যা মহান আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদেরকে বিশেষ নে‘আমত হিসাবে দান করেছেন। বাহ্যিক দৃষ্টিতে বিবাহ-শাদী দুনিয়াবী কাজ বা মুবাহ মনে হলেও যথা নিয়মে সুন্নাত তরীকায় যদি তা সম্পাদন করা হয় তাহলে সেটা বরকতপূর্ণ ইবাদত ও অনেকে সওয়াবের কাজ হয়। এর মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার দাম্পত্য জীবন সুখময় হয়। কিন্তু বর্তমান সমাজে বিবাহ-শাদী সুন্নত তরীকায় তো হয়ই না। উপরন্তু এটা বিভিন্ন ধরনের কুপ্রথা এবং বড় বড় অনেক গুনাহের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে পারিবারিক জীবনে অশান্তির ঝড় বয়ে চলছে। এজন্য নিম্নে বিবাহ-শাদী সম্পর্কিত কিছু ভুল এবং কুপ্রথা তুলে ধারা হল। যাতে এগুলো থেকে বাঁচা হয়।
বিবাহের পূর্বের ভুলসমূহ
১. বিবাহ শাদী যেহেতু ইবাদত, সুতরাং এখানে দীনদারীকে প্রাধান্য দিতে হবে। দুনিয়াদারগণ সৌন্দর্য, মাল, দৌলত ও খান্দানকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। এটা রাসূলের সুন্নাতের বিপরীত হওয়ায় শান্তি বয়ে আনে না।
২. কোন কোন জায়গায় অভিভাবক এবং সাক্ষী ছাড়া শুধু বর কনের পরস্পরের সন্তুষ্টিতেই বিবাহের প্রচলন আছে। অথচ এভাবে বিবাহ বিশুদ্ধ হয় না। বরং এটি যিনা-ব্যভিচার বলে গণ্য হবে। সাক্ষী থাকা সত্ত্বেও যদি মেয়ে পক্ষের অভিভাবকের সম্মতি না থাকে, আর ছেলে সে মেয়ের “কুফু” তথা দীনদারী মালদারী ও পেশাগত দিক থেকে সামঞ্জস্যশীল না হয় তাহলে সে বিবাহও শুদ্ধ হয় না।
৩. কেউ কেউ ধারণা করে যে মাসিক চলাকালীন সময় বিবাহ শুদ্ধ হয় না। অথচ এ অবস্থায়ও বিবাহ শুদ্ধ হয়ে যায়। অবশ্য এ অবস্থায় সহবাস জায়িয নেই।
৪. কেউ কেউ ধারণা করে যে মুরীদনীর সাথে পীর সাহেবের বিবাহ জায়িয নেই। অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রীগণ সকলেই তাঁর মুরীদনী ছিলেন।
৫. অনেকে অনেক বয়স হওয়ার পরও বিবাহ করে না কিংবা প্রথম স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার পর বা সে মৃত্যু বরণ করার পর আর ২য় বিবাহ করে না। অথচ শারীরিক বিবেচনায় তার বিবাহ করা জরুরী ছিল। এ অবস্থায় থাকা মানে যিনা-ব্যভিচারে জড়িত হওয়ার রাস্তা খুলে দেয়া।
৬. অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় (উদাহরণ স্বরূপ) ৬০ বছরের বয়স্ক লোক অল্প বয়সী যুবতী মেয়েকে বিবাহ করে বসে। ফলে ঐ মেয়ে নিশ্চিত জুলুমের শিকার হয়।
৭. অনেকে স্ত্রীর খেদমতে অক্ষম হওয়া সত্ত্বেও দুর্বলতা লুকিয়ে লোক দেখানোর জন্য বিয়ে করে স্ত্রীর জীবনকে ধ্বংস করে দেয়। এটা মারাত্মক গুনাহের কাজ।
৮. কোন কোন আধুনিক শিক্ষিত লোক আধুনিক শিক্ষা তথা ডাক্তারি প্রফেসারি ইত্যাদি ডিগ্রি দেখে মেয়ে বিয়ে করে। তাদের ভাবা উচিৎ বিয়ের দ্বারা উদ্দেশ্য কী? যদি তার স্ত্রীর দ্বারা টাকা কামানো উদ্দেশ্য হয় তাহলে এটা তো বড় লজ্জাজনক কথা যে, পুরুষ হয়ে মহিলাদের কামাইয়ের আশায় বসে থাকবে। মনে রাখতে হবে এধরণের পরিবারে শান্তি আসে না।
৯. কেউ কেউ পালক পুত্রের তালাক দেয়া স্ত্রী বিবাহ করাকে না জায়িয মনে করে। এটা জাহিলী যুগের বদ-রসম।
১০. কেউ কেউ বিধবা মহিলাদের বিবাহ করাকে অপছন্দ করে। অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের অধিকাংশ স্ত্রী বিধবা ছিলেন। (বুখারী হাঃ নং ৫০৭৭)
বিবাহের সময়ের ভুলসমূহ
বর পক্ষের ভুলসমূহ
১. বিবাহ শাদী যেহেতু ইবাদত, সুতরাং বিবাহকে কেন্দ্র করে কোন প্রকার গুনাহ না হয় সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। তাহলে খায়ের বরকত লাভ হবে। যদি বিবাহকে গুনাহ মুক্ত করা না যায় তাহলে সেখানে অশান্তি হওয়া নিশ্চিত। ২. প্রথাগতভাবে অনেক লোকের বর যাত্রী হিসেবে যাওয়া। ৩. দাওয়াতকৃত সংখ্যার অধিক লোক নিয়ে যাওয়া। ৪. লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে কন্যার জন্য যৌতুক পাঠানো এবং এটাকে জরুরী মনে করা। ৫. গায়রে মাহরাম পুরুষ দ্বারা মেয়ের ইজন বা অনুমতি আনা। ৬. বেগানা পুরুষদের কন্যার মুখ দেখা এবং দেখানো। ৭. নাচ-গান, বাজনা ইত্যাদি করা। ৮. সালামী গ্রহণ করা। ৯. মোহরানা সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পূর্বেই না করা, বরং করাকে দোষ মনে করা। অতঃপর বিবাহের সময় তর্ক-বিতর্ক করা। ১০. লোক দেখানোর জন্য বা গর্বের সাথে ওলীমা করা। ১১. মোহরানার বিষয়ে গুরুত্ব না দেয়া এবং মোহরানা আদায়ে গাফলতী করা। ১২. ইচ্ছাকৃত এমন কর্মকাণ্ড করা যে কারণে কোন পক্ষের অদূরদর্শিতা প্রমাণিত হয় অথবা তাদের অস্থিরতার কারণ হয়। আর নিজেদের সুনাম প্রকাশ পায়। ১৩. বিবাহ অনুষ্ঠানের কারণে ফরয ওয়াজিবসহ শরী‘আতের বিধানের ব্যাপারে উদাসীনতা এবং অনীহা প্রকাশ করা।
কন্যা পক্ষের ভুলসমূহ
১. বর যাত্রার চাহিদা। ২. ছেলের জন্য উপঢৌকন/যৌতুক প্রকাশ্যে পাঠানো, পাঠানোকে পছন্দ করা এবং জরুরী মনে করা। ৩. আত্মীয়-স্বজন মহল্লাবাসীদের জন্য প্রথাগত দাওয়াত এবং খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা। ৪. বিবাহের সরঞ্জাম, অলংকারাদী প্রকাশ্যে দেখা এবং অন্যদেরকে দেখানো। ৫. বিবাহের পর রসম হিসাবে জামাতাকে শরবত পান করানো। ৬. বেগানা মহিলারা জামাতার সামনে আসা। ৭. সালামী গ্রহণ করা। এটাকে জরুরী মনে করা এবং নেয়া দেয়া। ৮. যাতে মহল্লায় খুব প্রসিদ্ধ হয় সে জন্যে ইচ্ছাকৃত কোন কিছু করা। ৯. ফরয-ওয়াজিব ইত্যাদি বিষয়ে উদাসীন হওয়া। এছাড়াও বিবাহ উপলক্ষে অনেক বেপর্দা, যুবক যুবতীদের অবাধ মেলা-মেশা, অপব্যয়, ছবি এবং ভিডিও ইত্যাদি করা হয়, যাতে বিবাহের সকল খায়ের বরকত নষ্ট হয়ে যায়।
বিবাহের কিছু কুপ্রথা
১. মেয়ের ইযিন আনার জন্য ছেলেপক্ষ স্বাক্ষী পাঠিয়ে থাকে, শরী‘আতের দৃষ্টিতে এর কোন প্রয়োজন নেই।
২. বিবাহের সময় অনেকে বর-কনের দ্বারা তিনবার করে ইজাব কবূল পাঠ করিয়ে থাকে এবং পরে তাদের দ্বারা আমীন বলানো হয়। শরী‘আতে এর কোন ভিত্তি নেই।
৩. ইজাব কবূলের মাধ্যমে আকদ সম্পাদন হওয়ার পর মজলিসে উপস্থিত সকলকে লক্ষ্য করে সামনে দাঁড়িয়ে হাত উঠিয়ে বর যে সালাম করে থাকে তারও কোন ভিত্তি নেই।
৪. ঝগড়া-ফাসাদের আশংকা থাকা সত্ত্বেও খেজুর ছিটানোকে জরুরী মনে করা হয়। অথচ এ সম্পর্কিত হাদীসকে মুহাদ্দিসীনে কেরাম যঈফ বলেছেন।
বিবাহ শাদীর আরো কতিপয় কুসংস্কার
১. অনেক জায়গায় বিবাহ রওয়ানা হওয়ার আগে এলাকার প্রসিদ্ধ মাযার যিয়ারত করে তারপর রওয়ানা হয়। শরী‘আতে এর কোন ভিত্তি নেই।
২. বরের নিকট কনে পক্ষের লোকেরা হাত ধোয়ানোর টাকা, পান পাত্রের পানের সাথে টাকা দিয়ে তার থেকে কয়েকগুণ বেশী টাকা জোর যবরদস্তী করে আদায় করে থাকে। এটা না জায়িয।
৩. অনেক জায়গায় গেট সাজিয়ে সেখানে বরকে আটকে দেয়া হয় এবং টাকা না দেয়া পর্যন্ত ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়া হয় না। এটাও একটা গর্হিত কাজ।
৪. খাওয়া দাওয়া শেষে কনে পক্ষের লোকেরা বরের হাত ধোয়ায়। পরে হাত ধোয়ানো বাবদ টাকা দাবী করে। অনেক জায়গায় এ নিয়ে অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটতে দেখা যায়। এটা একেবারেই অনুচিত। মূলতঃ এসব হিন্দুয়ানী প্রথা। দীর্ঘ দিন যাবত হিন্দুদের সাথে বসবাস করার কারণে আমাদের মধ্যে এই কুসংস্কারগুলি অনুপ্রবেশ করেছে।
৫. বিবাহ পড়ানোর আগে বা পরে যৌতুকের বিভিন্ন জিনিস-পত্র প্রকাশ্য মজলিসে সকলের সামনে উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। এটাও অন্যায় ও নির্লজ্জতার কাজ।
৬. বিবাহের পরে নারী-পুরুষ সকলের সামনে কনের পিতা বা মাতা জামাই-মেয়ের হাত একসাথে করে তাদেরকে দু‘আ দেয়। কনের পিতা জামাইকে বলে “আমার মেয়েকে তোমার হাতে সঁপে দিলাম, তুমি এক দেখে শুনে রেখ” এর কোন ভিত্তি শরী‘আতে নেই।
৭. বিবাহ করে আনার পর শ্বশুর বাড়ীতে নববধূকে বিভিন্ন কায়দায় বরণ করা হয়। কোথাও ধান, দুবলা ঘাস, দুধের স্বর ইত্যাদি দিয়ে বরণ করা হয় এবং নববধূর চেহারা সকলকে দেখানো হয়; এসবই হিন্দুয়ানী প্রথা। কোন মুসলমানের জন্য এসব করা জায়িয নেই।
৮. অনেক জায়গায় মেয়ের বিয়ের আগের দিন আর কোথাও মেয়ে শ্বশুর বাড়ী যাওয়ার পরের দিন মেয়ের বাড়ী থেকে ছেলের বাড়ীতে মাছ-মিষ্টি ইত্যাদি পাঠানো হয়ে থাকে। কোথাও এটাকে চৌথি বলা হয়। এটাও বিজাতীয় নাজায়িয প্রথা।
৯. বর বা কনেকে কোলে করে গাড়ী বা পালকী থেকে নামিয়ে ঘরে তোলাও চরম অভদ্রতা বৈই কিছু নয়।
১০. ঈদের সময় বা অন্য কোন মৌসুমে মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে চাল, আটা, ময়দা, পিঠা ইত্যাদি পাঠানো এবং এ প্রচলনকে জরুরী মনে করার প্রথা অনেক জায়গায় চালু আছে। আবার অনেক জায়গায় আনুষ্ঠানিকভাবে জামাইকে এবং তার ভাই-বোনদেরকে কাপড়-চোপড় দেয়ার প্রথা আছে। এমনকি এটাকে এতটাই জরুরী মনে করা হয় যে, ঋণ করে হলেও তা দিতে হয়। এটা শরী‘আতের সীমালঙ্ঘন ছাড়া আর কিছু নয়।
১১. আজকাল বিবাহ অনুষ্ঠানে বেগানা মহিলাদের সাজ-সজ্জা করে নিজেকে বিকশিত করে একত্রিত হতে দেখা যায় এবং যুবক যুবতীদের অবাধ মেলা-মেশা করতেও দেখা যায়। এধরনের বেপর্দা আর বেহায়াপনার কারণে উক্ত মজলিসে উপস্থিত নারী পুরুষ সকলেই গুনাহগার হবে।
১২. বিবাহ উপলক্ষে গান-বাজনা, ভিডিও, ভিসিআর ইত্যাদি মহামারী আকার ধারণ করেছে। আর কোন কোন এলাকায় তো যুবতী তরুণী মেয়েরা একত্রিত হয়ে নাচ গানও করে থাকে। শরী‘আতের দৃষ্টিতে এসব হারাম ও নাজায়িয।
১৩. আজকাল বিবাহ অনুষ্ঠান মানেই গুনাহের ছড়াছড়ি। এমন এমন গুনাহ সেখানে সংঘটিত হয় যা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ছবি তোলা ও ভিডিও করা। শরী‘আতের দৃষ্টিতে কোন প্রাণীর ছবি তোলা চাই ক্যামেরার মাধ্যমে হোক কিংবা ভিডিও এর মাধ্যমে হোক বা অংকন করা হোক সবই হারাম।
১৪. বিবাহের পরে মেয়েকে উঠিয়ে দেয়ার আগ মুহূর্তে মেয়ের বাড়ীতে পাড়া-প্রতিবেশী মেয়েরা একত্রিত হয়, আর বরকে অন্দর মহলে এনে সকলে মিলে হৈ হুল্লা করে তার মুখ দর্শন করে। মেয়েরা হাসি মজাক করে বিভিন্ন উপায়ে নতুন দুলাকে বোকা বানানোর চেষ্টা করে। আর নির্লজ্জ হাসি তামাশায় মেতে উঠে। এধরনের বেপর্দেগী শরী‘আতের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ হারাম।
১৫. অনেক জায়গায় প্রথা চালু আছে যে, নববধূকে বর নিজে বা তার ভগ্নীপতি অথবা তার ছোট ভাই পালকী বা গাড়ী থেকে নামিয়ে কোলে করে ঘরে নেয়। তারপর উপস্থিত মহল্লাবাসীর সামনে নববধূর মুখ খুলে দেখানো হয়। এ সকল কাজ হারাম এবং নাজায়েয।