বন্দীত্ব, কারাবাস ও পরীক্ষা – শায়খ আবু ক্বাতাদা আল ফিলিস্তিনি

কারাগার কি একজন দাঈর(আল্লাহর পথে আহ্বানকারী)জন্য একটি প্রয়োজনীয় ধাপ? এটা কি কোন প্রশংসিত মর্যাদা, যার দ্বারা একজন কারাভোগকারী তার চেয়ে অধিকতর চারিত্রিক উৎকর্ষ সাধন করে যে কারাভোগ করেনি?

এতে কোন সন্দেহ নেই যে, দাওয়াহর পথ অসংখ্য বিপদ-আপদ ও কষ্টপূর্ণ। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

أَحَسِبَ النَّاسُ أَن يُتْرَكُوا أَن يَقُولُوا آمَنَّا وَهُمْ لَا يُفْتَنُونَ

وَلَقَدْ فَتَنَّا الَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ ۖ فَلَيَعْلَمَنَّ اللَّهُ الَّذِينَ صَدَقُوا وَلَيَعْلَمَنَّ الْكَاذِبِينَ

মানুষ কি মনে করে যে, তারা একথা বলেই অব্যাহতি পেয়ে যাবে যে, আমরা বিশ্বাস করি এবং তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে না? আমি তাদেরকেও পরীক্ষা করেছি, যারা তাদের পূর্বে ছিল। আল্লাহ অবশ্যই জেনে নেবেন যারা সত্যবাদী এবং নিশ্চয়ই জেনে নেবেন মিথ্যুকদেরকে। (যদিও আল্লাহ তাদেরকে পরীক্ষা করার পূর্বেই সব কিছু জানেন)। [১]

এটা এজন্য যে, একজন দাঈ মানুষের কাছে এমনসব বিষয় নিয়ে আসেন যা নতুন, আর তিনি তাদেরকে তাদের মুনাফা ত্যাগ করতে ও তাদের চুক্তি পরিহার করতে আহ্বান করেন এবং তারা যে পথে রয়েছে তা দেখে তিনি কষ্ট পান। আর এটা লোকদের জন্য ভয়ংকর একটি বিষয় কারণ তিনি তাদের আচরণের মূলনীতি ও তাদের দৃঢ় বিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করান।

সুতরাং, দাঈকে উগ্রতা ও নির্যাতনের শিকার হতে হয়। আর এজন্যই, কষ্টকর পরিস্থিতি মানুষের মর্যাদাকে পৃথক করে দেয় এবং এরকম কষ্টকর পরিস্থিতির মাধ্যমেই মানুষ কোন রকম অস্পষ্টটা ও ভ্রান্তি ছাড়াই তাদের যথার্থ স্থানে পৌঁছে যায়। পরীক্ষা মানুষের অবস্থানকে প্রকাশ করে দেয় আর সহিষ্ণুতা একমাত্র ধৈর্যশীলদের জন্যই।

মহান আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

وَجَعَلْنَا مِنْهُمْ أَئِمَّةً يَهْدُونَ بِأَمْرِنَا لَمَّا صَبَرُوا ۖ وَكَانُوا بِآيَاتِنَا يُوقِنُونَ

তারা সবর করত বিধায় আমি তাদের মধ্য থেকে নেতা মনোনীত করেছিলাম, যারা আমার আদেশে পথ প্রদর্শন করত। তারা আমার আয়াতসমূহে দৃঢ় বিশ্বাসী ছিল। [২]

ইবনে তাইমিয়াহ (রহঃ) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, “নেতৃত্ব অর্জিত হয় ধৈর্য ও নিশ্চয়তা দ্বারা”। ধৈর্য তাড়াহুড়াকে দূর করে আর নিশ্চয়তা দূর করে হতাশা। সুতরাং, একজন দাঈর দুটি শক্তি রয়েছে যা তাকে ভুল করা থেকে হেফাজত করে। একটি শক্তি যা তাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়-তা হল নিশ্চয়তা আর অন্য একটি শক্তি যা তাকে অনুকূল সময়ের জন্য অপেক্ষা করায়- তা হল ধৈর্য। আসন্ন প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে নিশ্চয়তা এবং বর্তমানে ঘটে চলা পরীক্ষায় ধৈর্যধারণ। প্রত্যেক আহ্বানেই পরীক্ষা ও দুঃখ-কষ্ট সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় এবং এগুলো অবাধ্যদের ঘিরে ফেলে, হোক তাদের অবাধ্যতা সত্যের সাথে বা মিথ্যার সাথে। দাওয়াতের পথে শুধু নবীগণই (আঃ) বা তাদের অনুসারীরাই দুঃখ-কষ্ট ভোগ করেননি, বরং মানুষের নিকট যারাই নতুন কিছু নিয়ে এসেছেন তারাই এ ধরণের দুঃখ-কষ্টের শিকার হয়েছেন। কিন্তু যে বিষয়টা সত্যের অনুসারীদের অন্যদের থেকে পৃথক করে দেয় তা হল- নবীগণই (আঃ) এবং তাদের অনুসারীরা যে সকল কষ্ট ভোগ করেছেন তা ছিল আল্লাহর জন্য।

ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمْ لَا يُصِيبُهُمْ ظَمَأٌ وَلَا نَصَبٌ وَلَا مَخْمَصَةٌ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَلَا يَطَئُونَ مَوْطِئًا يَغِيظُ الْكُفَّارَ وَلَا يَنَالُونَ مِنْ عَدُوٍّ نَّيْلًا إِلَّا كُتِبَ لَهُم بِهِ عَمَلٌ صَالِحٌ ۚ إِنَّ اللَّهَ لَا يُضِيعُ أَجْرَ الْمُحْسِنِينَ

এটি এজন্য যে, আল্লাহর পথে যে তৃষ্ণা, ক্লান্তি ও ক্ষুধা তাদের স্পর্শ করে এবং তাদের এমন পদক্ষেপ যা কাফেরদের মনে ক্রোধের কারণ হয় আর শত্রুদের পক্ষ থেকে তারা যা কিছু প্রাপ্ত হয়-তার প্রত্যেকটির পরিবর্তে তাদের জন্য লিখিত হয় নেক আমল। নিঃসন্দেহে আল্লাহ সৎকর্মশীল লোকদের হক নষ্ট করেন না। [৩]

কিন্তু অন্যদের বেলায় তাদের কষ্টভোগ তাদের জন্য পরিতাপের একটি কারণ, যেমনটি আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ

عَامِلَةٌ نَّاصِبَةٌ تَصْلَىٰ نَارًا حَامِيَةً

ক্লিষ্ট, ক্লান্ত। তারা জ্বলন্ত আগুনে পতিত হবে। [৪]

আর আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا يُنفِقُونَ أَمْوَالَهُمْ لِيَصُدُّوا عَن سَبِيلِ اللَّهِ ۚ فَسَيُنفِقُونَهَا ثُمَّ تَكُونُ عَلَيْهِمْ حَسْرَةً ثُمَّ يُغْلَبُونَ ۗ وَالَّذِينَ كَفَرُوا إِلَىٰ جَهَنَّمَ يُحْشَرُونَ

নিঃসন্দেহে যেসব লোক কাফের, তারা ব্যয় করে নিজেদের ধন-সম্পদ, যাতে করে বাধাদান করতে পারে আল্লাহর পথে। বস্তুতঃ এখন তারা আরো ব্যয় করবে। তারপর তাই তাদের জন্য আক্ষেপের কারণ হবে এবং শেষ পর্যন্ত তারা হেরে যাবে। আর যারা কাফের তাদেরকে দোযখের দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। [৫]

সুতরাং, দাওয়াতের পথে পরীক্ষা ও দুঃখ-কষ্ট সুস্পষ্ট, আর শত্রুদের উপস্থিতি আল্লাহর আউলিয়াদের জন্য বিজয়ের ইঙ্গিতস্বরূপ।

আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

وَكَذَٰلِكَ جَعَلْنَا لِكُلِّ نَبِيٍّ عَدُوًّا شَيَاطِينَ الْإِنسِ وَالْجِنِّ ۚ

এমনিভাবে আমি প্রত্যেক নবীর জন্যে শত্রু করেছি শয়তান, মানব ও জিনকে। [৬]

আর এটা আল্লাহর নামঃ আল মুনতাক্বিম (প্রতিশোধ গ্রহণকারী) এর অন্যতম প্রয়োগক্ষেত্র।

মানুষের মধ্যে বৈষম্য একটি মহাজাগতিক সুন্নাহ। আর এরকমই তাদের প্রতিযোগিতামূলক পথ চলা যেন তাদের প্রত্যেকেই তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারে। আর এই দুই পক্ষের মধ্যে ভারসাম্য আসে কোরআনে বর্ণিত জয় আর পরাজয় বরণের মাধ্যমে। এটা বিজয়ের মধ্য থেকে অনেক উপাদানের মধ্যে একটি উপাদান এই বিষয়টি ছাড়া এরকম আর কোন পারলৌকিক নির্দেশ নেই আর শরিয়তের কোন লঙ্ঘন নেই এটা ছাড়া যে, এ হচ্ছে পরাজয়ের অনেকগুলো উপাদানের মধ্যে একটি উপাদান।

পরীক্ষার অন্যতম একটি বহিঃপ্রকাশ হল কারাগার আর এটা যন্ত্রণা প্রদানের অন্যতম মাধ্যম যার দ্বারা প্রত্যেক দলই অপর দলকে ভয় দেখায়, যেমন ফিরাউন ভীতি প্রদর্শনপূর্বক মূসা (আঃ) কে বলেছিলঃ

قَالَ لَئِنِ اتَّخَذْتَ إِلَٰهًا غَيْرِي لَأَجْعَلَنَّكَ مِنَ الْمَسْجُونِينَ

ফেরাউন বলল, “তুমি যদি আমার পরিবর্তে অন্যকে উপাস্যরূপে গ্রহণ কর তবে আমি অবশ্যই তোমাকে কারাগারে নিক্ষেপ করব”। [৭]

আর কুরাইশদের কাছেও এটা ছিল আল্লাহর রাসুল (সাঃ) কে নিদারুণ যন্ত্রণা দেয়ার অন্যতম মাধ্যম।

وَإِذْ يَمْكُرُ بِكَ الَّذِينَ كَفَرُوا لِيُثْبِتُوكَ أَوْ يَقْتُلُوكَ أَوْ يُخْرِجُوكَ ۚ

আর কাফেরেরা যখন প্রতারণা করত আপনাকে বন্দী অথবা হত্যা করার উদ্দেশ্যে কিংবা আপনাকে বের করে দেয়ার জন্য (মক্কা থেকে) [৮]

আর একারণেই কারাগার মানসিক ও শারীরিক যন্ত্রণা প্রদানের অন্যতম উপায় এবং এটা মানুষের আশা-আকাঙ্খার পায়ে বেড়ি পরিয়ে দেয় ও তাকে তার নাগরিক ও মানবিক অধিকার পালনে বাঁধা দেয়। আর দাঈর জন্য এটা আরো অসহনীয় ও ক্লান্তিকর কারণ এটা দায়ীকে তার দাওয়াতের জন্য চারপাশের প্রয়োজনীয় উপাদান থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।

দাঈর কাজ হল মানুষের অন্তরকে আলোকিত করা এবং সে আলো হল তাদেরকে যা কিছু উত্তম তা শিক্ষা দেয়া আর তার আহ্বানের জন্য অনুসারী তৈরি করা যারা তার আহ্বানকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেবে। আর কারাগার তাকে এই সবকিছু থেকে বঞ্চিত রাখে। দাঈকে তার চারপাশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয় যাতে সে কাউকে প্রভাবিত করতে ও তার অনুসারী বানাতে না পারে।

সমকালীন সময়ে গুরাবারা আল্লাহর দিকে আহ্বান করা শুরু করেছেন এবং হক্ব ও বাতিল দলের মধ্যে সত্যতা প্রতিপাদনের সুন্নাহ পূরণ হয়েছে আর তাগুত এই সকল সত্য আহ্বানকারীদের দ্বারা তার কারাগার পূর্ণ করছে এবং দুঃখ-কষ্টের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। আর এখন পর্যন্ত (অনেক) বড় বড় দলকে কারাবন্দী করা হয়েছে। কিন্তু কারাগার তাদের কীই বা করতে পেরেছে?

কারাগার একটি পাত্রের মত। আর এর রং দৃশ্যমান হয় তার উপর ভিত্তি করে যা তার মধ্যে থাকে। কারাগার যাদেরকে অবনত ও ধরাশায়ী করেছে তাদের সংখ্যা খুবই কম আর তারা দৃষ্টির অগোচরেই থেকে যায়। কিন্তু অধিকাংশই কারাগার থেকে ব্যথা ও যন্ত্রণার স্মৃতি নিয়ে বের হয়েছেন আর মানুষের কাছে কারবালার মত কান্না ও শোকগাঁথায় ভরা লিখা লিখেছেন। আর এসব লেখকের প্রত্যেকেই পাঠকদের আবেগকে তার কাজের মাধ্যমে তার দিকে আকৃষ্ট করতে প্রচেষ্টা চালিয়েছেন ও এর দ্বারা তারা তাদের করুণা অর্জনের চেষ্টা করেছেন।

আর ইসলামি লাইব্রেরীগুলোতে এক ধরণের সাহিত্য পাওয়া যায় যা এধরণের শিল্পকে দৃষ্টান্তসহকারে ব্যাখ্যা করে, যেগুলো কারবালার মত কান্না ও শোকগাঁথায় ভরা। আর এর পিছনে যে উদ্দেশ্য কাজ করে তা হল, বুকের উপর মেডেল বা পদক ঝোলানো যাতে মানুষ বুঝতে পারে যে এই ব্যক্তিকে মারধর ও অত্যাচার করা হয়েছে। আর আজ পর্যন্ত এই পীড়িত শ্রেণীর মানুষদের অভিজ্ঞতা থেকে এমন কোন কাজ প্রকাশিত হয়নি যা আগামী প্রজন্মের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হতে পারে।

তাই কারাগার হল একটি পরীক্ষা, যা হয় কাউকে ভেঙ্গে ফেলবে, না হয় মচকিয়ে দেবে আর না হয় তাকে উপকৃত করবে যাতে সে সকল অপবিত্রতা থেকে পবিত্র হয়ে বেরিয়ে আসে-সে অপবিত্রতা হতে পারে চিন্তার এবং নফসের অপবিত্রতা। এর মাধ্যমে তার অন্তর্দৃষ্টি উন্নত হয় আর তার নফ্‌স উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণের পথে পরিমার্জিত হয়।

যিনি পরীক্ষিত হয়েছেন তাকে ততটুকুই প্রশংসা করা উচিত যতটুকু তিনি পরীক্ষার মধ্য দিয়ে উপকৃত হয়েছেন, এর বেশি নয়। তিনি একান্ত তার নিজের জন্যই প্রশংসিত ও মানুষের কাছে আকাঙ্ক্ষিত হন না, এর কারণ হল কারাগারে তার অবনতি ঘটতে পারে বা সে সেখান থেকে পূর্বে যেমন অজ্ঞ, অন্ধ ও নিন্দনীয় চরিত্রের অধিকারী ছিল তা নিয়েই বেরিয়ে আসতে পারে অথবা কারাগার থেকে সে বেরিয়ে আসতে পারে উন্নত মর্যাদার অধিকারী হয়ে।

আর এর সবটাই নির্ভর করে নির্দিষ্ট ব্যাক্তির উপর এবং সে কিভাবে তার জীবনে ঘটা এই সকল ধাপ ও ইঙ্গিতসমূহকে দেখছে তার উপর।

আর কারাগার না কোন প্রশংসনীয় ধাপ আর না তা এমন কিছু যা কারও খোঁজা উচিত যাতে সে তার নিকটবর্তীদের থেকে অধিকতর উৎকর্ষ সাধন করতে পারে। বরং তার উচিত এরকম একটি অভিজ্ঞতা থেকে যথাসাধ্য উপকার লাভ করার চেষ্টা করা।

-আল-জিহাদ ওয়াল-ইজতিহাদ ১০২-১০৪

 


[১] আল-আনকাবুতঃ ২-৩

[২] আস-সাজদাহঃ ২৪

[৩] আত-তাওবাহঃ ১২০

[৪] আল-গাশিয়াহঃ ৩-৪

[৫] আল-আনফালঃ ৩৬

[৬] আল-আন’আমঃ ১১২

[৭] আশ-শুআরাঃ ২৯

[৮] আল-আনফালঃ ৩০