হাকীমুল উম্মত থানভী (রহঃ)
হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহ. বলেন, আমার আববাজান অত্যন্ত স্নেহের সাথে আমাদেরকে লালন-পালন করেছেন। তিনি অত্যন্ত সুশৃংখল ও গোছানো মানুষ ছিলেন। তিনি আমার ‘শিক্ষা ও গড়ে ওঠার’ ব্যাপারটিকে খুবই গুরুত্ব দিতেন।
আমাদের প্রতি তাঁর মুহাববত ছিল বুদ্ধিভিত্তিক। আমরা দীর্ঘদিন মীরাঠে থেকেছি। রমযান শরীফে তারাবীহর খতম উপলক্ষে কোথাও যেতে দিতেন না। কারণ এতে নিয়ত খারাপ হওয়ার আশংকা ছিল। না যেতে দেওয়ার ব্যাপারটি তিনি এভাবে পুষিয়ে দিতেন যে, নিজে বাজার থেকে মিষ্টি এনে বলতেন, ‘মিষ্টির জন্য ওখানে গিয়ে যে পরিমাণ পেতে তার চেয়ে অনেক বেশি আমি খাইয়ে দিলাম। মিষ্টির লোভে কোথাও যাওয়া আমার কাছে খারাপ মনে হয়।’
আববাজানের এভাবে সতর্ক করার ফলে এখনো কারো কাছ থেকে কোনো কিছু গ্রহণ করতে আত্মমর্যাদা বাধ সাধে। সব জায়গার দাওয়াতেই অপমান বোধ হয়। হ্যাঁ যাদের সাথে অকৃত্রিম সম্পর্ক রয়েছে তাদের ব্যাপার ভিন্ন। তালিবুল ইলমদের কোথাও দাওয়াতে পাঠানো তো পছন্দই করতে পারি না।
আমাদের দু‘ভাইকে যখন তিনি মারতেন, আমরা অভিমান করতাম। আমাদের অভিমান ছিল এ রকম যে, আমরা খানা খেতাম না। আমাদেরকে খেতে বললে আমরা বলতাম, ক্ষুধা লাগেনি। আববাজান বলতেন, আমি যেহেতু তোমাদেরকে মেরেছি, এজন্য ক্ষুধা লাগেনি। যাও! টাকার ছোট্ট বাক্সটি নিয়ে এসো। বাক্স হতে এক টাকা বের করে দিতেন। টাকা পেয়ে আমরা খানা খেতাম। তখন তিনি বলতেন, এখন কীভাবে ক্ষুধা লাগল? ছোট ছোট বিষয়ে আমাদেরকে ধরতেন। সংশোধন করতেন।
একবার ঈদের সময় শেরোয়ানি বানানোর জন্য দর্জিকে দেয়া হয়েছিল। যা খুবই আড়ম্বরপূর্ণ ও সুন্দর ছিল। সে সময় আমি যেহেতু ছিলাম একেবারেই অল্প বয়সের, ঈদের একদিন আগের ঘটনা; দর্জিকে তাগাদা দিয়ে তাড়াতাড়ি প্রস্ত্তত করালাম। আছরের নামাযের পর কাপড় হাতে পেলাম।
আমি আনন্দের আতিশয্যে এ কথা বলতে বলতে দৌড়ে আসছিলাম। আহা! কি মজা কালকে (এটা) পরবো! …. আববাজান বসে মিসওয়াক করছিলেন। দাঁড়িয়ে ঠাস করে একটি চড় মেরে বললেন, ‘অযোগ্য কোথাকার! অন্য কেউ শুনলে মনে করবে, এতদিন পরার কাপড় জোটেনি। এজন্যই আজ এত আনন্দিত হচ্ছে।’
আল্লাহপাক আমার আববাজানকে ক্ষমা করুন। আমার প্রতি তিনি এমন অনুগ্রহ করেছেন যে, কয়েক হরফ দ্বীনী শিক্ষা শিখিয়ে দিয়েছেন। যদি তিনি মিরাছ হিসেবে কয়েকটি গ্রাম পরিমাণ জমি-জায়গা রেখে যেতেন তাহলেও দ্বীনী শিক্ষার তুলনায় তা কিছুই না। এমনি তো লোকেরা তাঁকে দুনিয়াদার মনে করতো। অধিকাংশ দুনিয়াদার লোক ইলমে দ্বীনকে পিছনে রাখে, অবহেলা করে থাকে। কিন্তু আমার আববাজান সকল ব্যাপারে আমাকে আমার ভাইয়ের উপর প্রাধান্য দিতেন।
একবার আমার বড় চাচী কথাপ্রসঙ্গে কাউকে এ কথা বলেছিলেন, ‘ছোট ছেলেকে তো ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করেছে, সে হয়তো কামাই-রুজী করে খেতে পারবে। বড় ছেলে (কে তো ইংরেজি শেখায়নি দ্বীনী শিক্ষা দিয়েছে সে) কোত্থেকে খাবে?
এ কথা শুনে আমার আববাজানের চেহারা (ক্রোধে) লাল হয়ে গেলো। তিনি অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হয়ে বললেন, ‘ভাবী ছাহেবা! আপনি আমাকে খুবই বিরক্ত (পেরেশান) করেছেন!
আমি কসম করে বলছি! টাকা-পয়সা (ধন-সম্পদ) ওর জুতার উপর পড়ে থাকবে ও সেদিকে ভ্রূক্ষেপও করবে না।’
উপরোক্ত মন্তব্য যদি কোন দরবেশ টাইপের লোক করতেন, তাহলে (বর্তমানে আমার অবস্থার কারণে) তাঁর এ কথা কারামাতরূপে প্রসিদ্ধি লাভ করতো। কিন্তু আমার আববাজানের পরিচিতি তো দুনিয়াদার মানুষ হিসেবেই হয়েছে।
আমার বিয়ের সময় আববাজান এক লোককে বলেছিলেন, ‘আমার মনে হচ্ছে আমার এ ছেলে অত্যন্ত সৌভাগ্যবান, সর্বদা সচ্ছলতা ও শান্তিতে থাকবে। তার জন্মের পর হতে, বিশেষত পড়া-শোনার সূচনা হতে পরিসমাপ্তি ও বিয়ে পর্যন্ত আমি তার শিক্ষা-দীক্ষা ও অন্যান্য প্রয়োজন পূরণার্থে অনেক অর্থ ব্যয় করেছি।’
আল্লাপাকের প্রতি (আমার ব্যাপারে) আমার আববাজানের সুধারণা এমন প্রবল ছিল যে, তিনি আমার বৈষয়িক ব্যাপারে কোনোদিন কোন দুশ্চিন্তা করেননি যে, এর জীবিকার কী ব্যবস্থা হবে?
আমরা যখন পায়জামাও পরতে শুরু করিনি (অর্থাৎ একেবারে শিশু) তখন থেকেই তিনি সিদ্ধান্ত করে রেখেছিলেন যে, আমাকে দ্বীনী শিক্ষা দিবেন আর আমার ছোট ভাইকে ইংরেজি শেখাবেন। আল্লাহ পাক আমার আববাজানকে এমন দূরদর্শিতা দান করেছিলেন যে, তিনি আমাদের উভয়ের রুচি-প্রকৃতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা করতে পেরেছিলেন এবং সে অনুপাতে শিক্ষার ধরন চয়ন করেছিলেন। এটা আববাজানের বিচক্ষণতার পরিচায়ক।
এক বাদশাহ তার দুই ক্রীতদাসকে শিক্ষা দিতে চাইলেন। একজনকে তীর নিক্ষেপ করা শিখাতে চাইলেন, অপরজনকে সুন্দর লেখা
শিখাতে চাইলেন এবং সে অনুপাতে ব্যবস্থাও নেয়া হলো। কিন্তু উভয়েই ব্যর্থ হল। কিছুই শিখতে পারল না।
পরবর্তীতে বাদশাহ একজন বিচক্ষণ ব্যক্তির সাথে পরামর্শ করলেন। সে উভয় গোলামের রুচি-প্রকৃতি জেনে বাদশাহর সিদ্ধান্তের বিপরীত পরামর্শ দিল। কারণ সে পরীক্ষা করে দেখল, বাদশাহ যাকে তীর নিক্ষেপ করা শেখাতে চাচ্ছেন তার আগ্রহ হস্তলিপি শিক্ষার প্রতি। আর বাদশাহ যাকে হস্তলিপি শেখাতে চাচ্ছেন তার আগ্রহ তীর নিক্ষেপ করার প্রতি। ঐ ব্যক্তির পরামর্শ মতো শিক্ষা দেওয়ায় অল্প দিনেই তারা প্রত্যেকে যোগ্য হয়ে উঠল।
(হাকীমুল উম্মাত কি মাহফিলে ইরশাদ, পৃ: ১৪-১৬)
রবিউস সানি ১৪৩৫ – ফেব্রুয়ারি ২০১৪
মাসিক আল কাউসার