হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ. প্রায়ই রসিকতা করে বলতেন, ‘আমি কসাইনীর দুধ পান করেছি। এ কারণেই আমার প্রকৃতিতে তেজস্বিতা প্রবল। তবে আলহামদুলিল্লাহ্ তাতে হঠকারিতা ও কঠোরতা নেই। আমার অন্তর খুবই কোমল, ফলে আমি কারো সামান্য কষ্ট দেখতে পারি না। কারো কষ্ট দেখলে আমার অন্তর গলে যায়।’
উল্লেখ্য যে, হযরত হাকীমুল উম্মত রাহ.-এর ছোট ভাই হযরতের জন্মের মাত্র চৌদ্দমাস পরেই জন্মগ্রহণ করায় একসঙ্গে দুভাইয়ের জন্য মায়ের দুধ যথেষ্ট না হওয়ায় হযরত হাকীমুল উম্মত রাহ.-কে দুধ পান করানোর জন্য একজন ধাত্রীর (দুধ মায়ের) ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। তিনি মিরাঠের একটি গ্রামে থাকতেন এবং পেশায় কসাইনী ছিলেন।
হযরত হাকীমুল উম্মত রাহ. বলতেন, ‘আমার মায়ের আকার-আকৃতি ভালমতো মনে নেই। তবে খুব খেয়াল করলে এতটুকু মনে পড়ে যে, তিনি যেন একটি খাটের পায়ের দিকে বসে আছেন। এতটুকুই শুধু মনে পড়ে। এর অতিরিক্ত আর কিছু স্মরণ হয় না। কারণ সে সময় আমি খুবই ছোট ছিলাম। চার/পাঁচ বছর বয়সের কথা কতটুকুই বা মনে থাকে। আমার আম্মার ইন্তিকালের পর আববাজান খুবই স্নেহ-মমতার সাথে আমাদের দুভাইকে লালন-পালন করেছেন।
আববাজান মাখনে ভাজা রুটি টুকরো টুকরো করে পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘিয়ে ভিজিয়ে নিজ হাতে লোকমা বানিয়ে আমাদেরকে খাওয়াতেন। এভাবে তিনি আমাদের দুভাইকে অতীব আদর যত্নে প্রতিপালন করে আমাদেরকে মা হারানোর শোকও ভুলিয়ে দিয়েছেন। তিনি আমাদেরকে মায়ের চেয়েও বেশি মহববত করতেন।
আববাজান যদিও খুবই রাগী মানুষ ছিলেন, কিন্তু আমাদের দুভাইয়ের সাথে খুব কমই রাগ করতেন। বিশেষত আমার সাথে খুবই নম্র ব্যবহার করতেন।
একবার আমার বড় চাচীআম্মা আববাজানকে বলেই ফেললেন, ‘কী ব্যাপার? দুষ্টুমী করলে কেবল ছোট ছেলেকেই মারেন! বড় ছেলেকে যে খুব কমই মারতে দেখি?’ তিনি উত্তরে বললেন, ‘ভাবী ছাহেবা! এই ছোটটিই বড়টিকে দুষ্টুমী শেখায়। তাছাড়া বড়টি সবকও যথাযথ ইয়াদ করে। যার দরুণ তার প্রতি আমার টানও বেশি। ছোটটি ঠিকমতো সবক ইয়াদ করে না।’
মোটকথা! আমার আববা আমাকে খুব কমই মারতেন। আমি উস্তাযের পিটাইও খুবই কম খেয়েছি। খাইনি বললেও চলে। কারণ আমি নিয়মিত সবক ইয়াদ করতাম এবং আদব রক্ষা করে চলতাম।
ছাত্র অবস্থায় আমি একবার অসতর্ক মুহূর্তে দারুল উলূম দেওবন্দের সাবেক মুহতামিম হযরত মাওলানা রফীউদ্দীন ছাহেব রাহ.-এর আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছিলাম যে, ‘মাওলানা ছাহেব পড়া-লেখা বেশি করেননি।’
বস্ত্তত তিনি বাহ্যিক কিতাব-পত্র তেমন পড়েননি এবং নিয়মতান্ত্রিক পড়া-শোনাও তেমন করেননি। কিন্তু মাদরাসা পরিচালনার কাজে খুবই দক্ষ ছিলেন। কামেল বুযুর্গ ছিলেন।
আববাজান আমার উপরোক্ত কথায় খুবই রাগান্বিত হলেন এবং আমাকে ধমক দিয়ে বললেন, ‘বুযুর্গদের সম্পর্কে এ ধরণের উক্তি করা সমীচীন নয়।’ তিনি রাগে আমাকে মারতে পর্যন্ত উঠলেন, তবে মারেননি। আববাজন সর্বদাই আমাদের চরিত্র গঠনের ব্যাপারে খুবই লক্ষ্য রাখতেন। সাথে সাথে স্নেহ-মমতাও খুব করতেন।
হাকীমুল উম্মত হযরত থানভী রহ. বলেন, ‘আমি শৈশব থেকেই আল্লাহ পাকের অনুগ্রহে যেখানেই থেকেছি, (চাই আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে হোক বা অপরিচিতদের মধ্যে) সকলেরই ভালবাসা পেয়েছি, প্রিয়পাত্র হয়ে থেকেছি। যদিও আমি বাল্যকালে খুবই কৌতুক করতাম। কিন্তু ইদানিংকালের দুষ্ট ছেলেদের মতো নোংরা কৌতুক করতাম না। ফলে আমার কৌতুকে বিরক্ত হওয়ার পরিবর্তে সকলেই আনন্দিত হতো।’
হযরত থানভী রাহ. বলেন, ‘একবার আমার মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি চাপলো। বর্ষাকাল, বৃষ্টির দিন। মাঝে মাঝে বৃষ্টি হচ্ছে। আবার বৃষ্টি বন্ধও হয়ে যাচ্ছে। গরমের দরুণ আমাদের চারপায়ী (খাট) ঘরের বাইরে খোলা জায়গায় পাতা থাকতো। বৃষ্টি শুরু হলে খাট ঘরের ভেতরে নেয়া হতো। আবার বৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেলে বাইরে আনা হতো। আম্মাজানের যেহেতু ইন্তেকাল হয়ে গিয়েছিল, তাই আববাজান আর আমরা দু’ভাইই বাড়িতে থাকতাম। তিনজনের খাট পাশাপাশি একত্রে পাতা ছিলো। একদিন আমি চুপে চুপে তিনটি খাটের পায়া একটির সাথে আরেকটিকে রশি দিয়ে খুব টাইট করে বেঁধে রাখলাম। ফলে রাতে যখনই বৃষ্টি শুরু হলো, তখন আববাজান যেদিক থেকে যে খাট ধরেই টান দেন তিনটি খাটই একসাথে চলে আসে। বাঁধন খোলার চেষ্টা করেন কিন্তু খুলতে পারেন না। কারণ খুবই শক্ত করে বেঁধেছিলাম। বাঁধন কাটতে চেষ্টা করেন কিন্তু ছুড়ি খুঁজে পান না। মোটকথা খুবই কষ্ট হলো। অনেক চেষ্টার পর বাঁধন খুলতে পারলেন এবং খাট ঘরের ভেতর নিতে সক্ষম হলেন। কিন্তু একাজে এত দেরী হলো যে, সবকিছু একেবারে ভিজে গেলো। আববাজান খুবই ক্রোধান্বিত ও বিরক্ত হলেন। বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘এটা কেমন অযৌক্তিক কাজ।’
উপরোক্ত ঘটনা তো আমার একান্ত বাল্যকালের ঘটনা। আরেকটি ঘটনা কুরআন মাজীদ হিফজ করার পর পরেরই, মনে পড়ছে। আমাদের ওখানে একজন অন্ধ হাফেজ ছিলেন। যার কুরআন মাজীদ খুবই ইয়াদ ছিলো। এ ব্যাপারে তার গর্বও ছিলো।
উল্লেখ্য যে হযরত রাহ. বালেগ হওয়ার পূর্বে নফল নামাযে তাকে কুরআন শরীফ শোনাতেন। এক রমযানে দিনের বেলা নফল নামাযে অন্ধ হাফেজ ছাহেবকে কুরআন শরীফ শোনাচ্ছিলেন। নামায আরম্ভ করার পূর্বেই হযরত তাকে সতর্ক করে বললেন, আজ আমি আপনাকে ঠক দিবো। আপনাকে বলেই দিচ্ছি অমুক আয়াতে ঠক দিবো। অন্ধ হাফেজ ছাহেব বললেন, তুমি আমাকে কী ঠক দিবে, বড় বড় হাফেজ ছাহেবই আমাকে ঠক দিতে পারে না।
হযরত হাকীমুল উম্মত রাহ. যখন নামাযে কুরআন শরীফ শোনানোর জন্য দাঁড়ালেন এবং এ আয়াতেإِنَّمَا أَنْتَ مُنْذِرٌ وَلِكُلِّ قَوْمٍ هَادٍ পৌছলেন তখন খুব ধীরে ধীরে তারতীলের সাথে এমনভাবে পড়তে লাগলেন, যেমনটি র”কুতে যাওয়ার আগে ধীরে ধীরে পড়ে থাকেন। অতপর যখন তারপরের শব্দ اللَّهُ يَعْلَمُ পড়বেন তখন اللَّهُ শব্দটি ঠিক ঐভাবে টেনে পড়লেন যেন রুকুতে যাওয়ার জন্য اللَّهُ أَكْبَرُ – বলছেন। অন্ধ হাফেজ ছাহেব মনে করলেন হযরত রুকুতে যাচ্ছেন। তাই তিনি সাথে সাথে রুকুতে চলে গেলেন। আর হযরত কেরাত অব্যাহত রেখে সামনে পড়তে লাগলেন يَعْلَمُ مَا تَحْمِلُ এখন একদিকে হাফেজ ছাহেব যখন রুকুতে পৌছলেন, অপরদিকে তখন হযরত রহ. সামনে পড়ে চলছেন…। কাজেই অন্ধ হাফেজ ছাহেবও সোজা দাড়িয়ে গেলেন। এটা দেখে হযরতের অনিচ্ছায়ই খুব হাসি পেল। তিনি উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন। তিনি হাসি নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে নামায ছেড়ে একটু দূরে সরে গেলেন।
হযরত থানভী রাহ.-এর আববাজান অদূরে খাটে বসে পড়া শুনছিলেন। তিনি এভাবে নামায ছেড়ে হাসার কারণ জিজ্ঞেস করলেন। হযরত রাহ. পুরো ঘটনা খুলে বললেন। তিনি অত্যন্ত গম্ভীর প্রকৃতির হওয়া সত্ত্বেও হেসে দিলেন।
উল্লেখ্য, হযরত থানভী রাহ.-এর যেহেতু এ মাসআলা জানা ছিলো যে, নামাযে উচ্চস্বরে হাসার কারণে না বালেগ-এর ওযূ নষ্ট হয় না, কেবল নামায ভেঙ্গে যায়, তাই তিনি পুণরায় নামাযের জন্য অগ্রসর হলেন। কিন্তু তার আববাজন তাকে বাঁধা দিয়ে বললেন, এখনই নামায শুরু করো না। প্রথমে মন ভরে হেসে নাও, তারপর নামায আরম্ভ কর। তা না হলে আবারো নামাযের মধ্যে হাসি আসবে, নামায নষ্ট হবে।
হযরত থানভী রাহ. বললেন, আমার আববাজন খুবই বিচক্ষণ ও সচেতন মানুষ ছিলেন। হযরত রাহ. পিতার নির্দেশে প্রথমে খুব হাসলেন। অতপর পুণরায় নামাযের নিয়ত বেধে সেদিন যতটুকু কুরআন মাজীদ শোনানোর ছিল তা পূর্ণ করলেন।
(সূত্র: আশরাফুস সাওয়ানেহ, ১ম খন্ড, ২১-২৩ পৃষ্ঠা)
জুমাদাল উলা ১৪৩৫ – মার্চ ২০১৪
মাসিক আল কাউসার